কাশ্মীরের পথে পথে

শুভ্রা মিত্র

~ কাশ্মীরের তথ্য ~ কাশ্মীরের আরও ছবি ~ লাদাখের আরও ছবি

গত প্রায় সাত আট মাস ধরে যে সব জায়গার আরাধনা করে এসেছি, সেখানে পড়ল বাঁধা। যে মানসিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম উত্তরাখণ্ডের সঙ্গে, এক লহমায় তার মায়া কাটিয়ে কী করে আর এক নতুন পরিকল্পনা শুরু হয়! অগত্যা... মন খারাপ। এ যেন অঙ্কের পরীক্ষা। সিলি মিসটেকের জন্য কম নম্বর পেয়ে পরের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। কিন্তু আগের পরীক্ষার কথাই বারে বারে মনে পরে। মন খারাপ হয়। কিন্তু তখন কি জানি পরের পরীক্ষাতে ১০০ তে ১০০ নম্বর মিলবে ? একেই বলে ভবিতব্য। যাওয়ার আর এক সপ্তাহ বাকি। মনে জোর টেনে ল্যাপটপটাকে প্রায় সবসময়েই কোলে কাঁখে নিয়ে ঘোরা শুরু হল। হয়ে গেল বুকিং দিল্লি থেকে শ্রীনগর। নাহ্‌...বাসে যাবার সৌভাগ্য হল না। সময় কম। অগত্যা.., দু'দিনের যাত্রা দু'ঘণ্টায় সেরে নিতে হল। চটপট হয়ে গেল শ্রীনগর হাউস বোট বুকিং। পাহলগাম গেস্ট হাউস, কারগিল এবং সর্বশেষে... লে। গাড়িও বুকিং হয়ে গেল শ্রীনগর, পাহলগাম এবং লেহ্ যাওয়া অব্দি – এ সবই ট্রিপ অ্যাডভাইসারের দৌলতে। চল, লেটস্‌ গো... যা থাকে কপালে।
শ্রীনগর। প্লেনের জানলা দিয়ে তুষারে ঢাকা পিরপাঞ্জাল রেঞ্জ-এর অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নামলাম। বেরোনোর আগে সবাইকে নিজের সম্বন্ধে যাবতীয় খুঁটিনাটি লিখতে হল। অবাক হলাম, নিজের দেশের ভেতরে যেন আর এক নতুন দেশ! পরে অবশ্য লাদাখের বিভিন্ন জায়গায় এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে, পাক ও চিন সীমান্তের দৌলতে। আমাদের হাউস বোটের মালিক আবদুল দুনো গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল বাইরে। পথে যেতে যেতে নজরে এল বোরখা পরা মহিলাদের। সব সাইনবোর্ড উর্দুতে এবং কিছু ইংরেজিতে লেখা। স্থানীয় লোকেরা কাশ্মীরি ভাষায় কথা বলেন। এবারে গঙ্গার ঘাটে এলাম নৌকোয় উঠব বলে...থুড়ি...নাগিন লেকের ধারে গাড়ি থামল। শিকারা রেডি – আমাদের তোলার জন্য। কেমন সরু ছিপ ছিপে চেহারা। মন সংশয়ে দুলল। ডুবে যাবে নাতো! মোট ছ'জন লোক, তার মধ্যে আমি ডাবল! বাক্স-প্যাঁটরা প্রায় আশি-নব্বই কিলো। এত সব নিয়ে আমাদের সুপারস্মার্ট শিকারা চলল হাউস বোটের দিকে। দারুণ সুন্দর এই নৌকো-বাড়ি। পরিষ্কার পরিছন্ন। রয়েছে গরম জলের ব্যবস্থা। চটপট লাঞ্চ সেরে বারান্দায় এসে বসলাম – অভাবনীয়! উইলো, পপলার এবং পাহাড়ে ঘেরা নাগিন লেক অপেক্ষাকৃত বেশ শান্ত, পরিস্কার - ডাল লেকের তুলনায়। আমরা ঠিক করলাম শিকারা করে ডাল লেকে যাব। প্রায় চার ঘন্টার যাতায়াত। এখানে একটা কথা বলে রাখি। ডাল লেকে বাহারি শিকারা চড়ার আনন্দ আছে। কিন্তু শ্রীনগরে জলের মধ্যে যে জীবন গড়ে উঠেছে, তার একটি গভীর ছোঁয়া পেতে হলে এই দীর্ঘ জলভ্রমণের প্রয়োজন। ভেসে যেতে যেতে ভাসমান বাজার, সবজি বাগান আর কুরানের স্কুল দেখলাম। ছাত্রছাত্রীরা সব শিকারা নিয়ে আসে স্কুলে। ফিরে এলাম প্রায় রাত দশটা। চলার পথে গা ছমছম। লেকে তখন কোনো শিকারা নেই। অন্ধকারে শুধু জল কাটার শব্দ। দু'পাশের ঝোপ ঝাড়ের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে কেমন অশরীরি পরিবেশ মনে হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ছায়া দেখে চমকে উঠছি – মাঝি বলল – ওরা মাছ ধরছে।
পরের দিন য়ুসমার্গ যাত্রা। উচ্চতা প্রায় ২৫০০ মিটার, গাড়িতে যেতে প্রায় দু'ঘণ্টা (হাউস বোটে থাকলে একটা শিকারা রাউন্ড ট্রিপ ফ্রি)। সেখান থেকে চারঘণ্টা ঘোড়ায় চড়ে দুধগঙ্গা নদী দর্শন। ঝিলাম নদীর একটি শাখা। চলার পথে লেক নীলনাগ, তোসা ময়দান ইত্যাদি পরে। পুরো যাত্রার পথটাই অপরূপ। পীরপাঞ্জাল পরিবৃত ফার আর পাইন গাছের মধ্য দিয়ে চড়াই-উতরাইয়ের পথ এই আলপাইন উপত্যকায়। শীতকালে বরফে ঢাকা থাকে। জম্মু-কাশ্মীর সরকার এখানকার উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে সক্রিয়। যাক্... শেষের দিকে পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে – হাড়-পাঁজরা ভেঙে যখন দুধগঙ্গায় এসে নামলাম – নিজেকে বেশ 'অভিজ্ঞ' মনে করে পরিতৃপ্ত হলাম। পরমুহূর্তেই ঘোড়া থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম। পা একেবারে অবশ! ওখানকার ছোট ছেলেমেয়েরা কোনোমতে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। অতএব 'অভিজ্ঞতা' গোড়াতেই একেবারে যাকে বলে ফুটো বেলুন! স্কুল থেকে ছেলেমেয়েগুলো এখানে পিকনিক করতে এসেছে। বড় ছোট পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে ফেনিল স্রোতস্বিনী - মুগ্ধতা।

পাহলগাম। পরের দিন সকাল সাতটা নাগাদ অল্প কিছু গুছিয়ে (বড় বাক্স-প্যাঁটরা রেখে গেলাম বোটে) রওনা হলাম পাহলগাম এর উদ্দেশ্যে। মাত্র ১০০ কিমি শ্রীনগর থেকে। কোনো পাহাড়ি বাঁক নেই। এনএইচ-১ ধরে সোজা রাস্তা। আড়াই ঘণ্টার পথ। পথে পড়ল শালিমার বাগ। পাহাড়ে ঘেরা এই বাগান। ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে পটচিত্র ক্রমশই বদলে যাচ্ছে। যেন ফ্রেমে বাঁধানো অনেক ছবি। বাহবা দিতে হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরকে এমন একটি জায়গা নূরজাহানকে উপহার দেওয়ার জন্যে। চশম-এ-শাহিতে ঝরনার ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ পেলাম। পথে পড়ল পাম্পোর – দু'দিকে অজস্র জাফরানের দোকান ও ক্ষেত। অক্টোবরে এর ফুল ফোটে – পরাগ থেকে তৈরি হয় এই কেশর। পাহলগাম এর কাছাকাছি দু'দিকে শুধু আপেল, অ্যাপ্রিকট (খোবানি)-র গাছ। আর রয়েছে দুদিকে উইলো গাছের সারি। এই স্থানের উচ্চতা ২০০০ মিটারের কিছু বেশি এবং অনন্তনাগ অঞ্চলের অন্তর্গত। অমরনাথ যাত্রা শুরু এখান থেকেই। লিডার নদী চলেছে রাস্তার পাশে পাশে। এর জন্ম সোনামার্গ এর কাছে কোলহাই গ্লেসিয়ার থেকে। আমাদের ছোট গেস্ট হাউসটি একেবারে নদীর বিপরীত দিকে শহরের বাইরে। যেন স্বর্গাবাসে উঠলাম। সব কিছুই এখানে স্বর্গীয়। পাইন এবং ফারের উঁচু মাথাগুলি অনবরত বাতাসের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। নীচে প্রবাহমান স্বচ্ছ নীল নদীর ফেনিল কলরব। গাড়ি বিদায় নিল। ট্রিপ-এর জন্য স্থানীয় ট্রান্সপোর্ট নিতে হবে। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটাপথে ছোট শহর ঘুরতে। এখানকার শীতের পোশাক অনেক সস্তা শ্রীনগর থেকে। রাত্রে অসাধারণ একটা ডিনারের পর গাইডের সঙ্গে পরের দিনের প্ল্যান তৈরি হল – তুলিয়ান লেক। এর উচ্চতা প্রায় ৩৫০০ মিটার! আগেই বলেছি য়ুশমার্গে আমার 'অভিজ্ঞতার'-র কথা। অনেকটাই সাহস করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রায় দশ ঘণ্টার মতন যাত্রা।

পরের দিন সকাল সাতটার মধ্যে ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। সুন্দর দিন – শান্ত – রোদে ঝক ঝক করছে চতুর্দিক। উতরাইয়ের পথে তিন-চারবার বিশ্রামের দরকার। কিছু পরেই এল বৈশরণ – স্থানীয় লোকেদের মতে – ক্ষুদে সুইজারল্যান্ড - সত্যি বটে। আবার স্বর্গীয় কথাটাই বার বার মনে পরে। সবুজ মখমলের মতন উপত্যকা, পাহাড়ি ঝরনা, পাথুরে নদীর কল কল শব্দ, সবুজ পাহাড়ের ঢাল, ঘন পাইন,ফার গাছের সারি। জিপসিদের কাঠের ঘর পাহাড়ের ঢালে, এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অলস পাহাড়ি ভেড়া... সব কিছুর মধ্য দিয়ে চলা, দেখা, অনুভব করা এবং সর্বোপরি স্পর্শ করা। জিপসিদের হাতে চা খেলাম। গাইডের তুলনা নেই। দুজনে মিলে পুরোদস্তুর রান্না খাবার পিঠ ব্যাগে বয়ে নিয়ে এসেছে। গ্লেসিয়ারের কাছে বসে – পাহাড়ি নদীর জলে হাত মুখ ধুয়ে আমাদের দুপুরের গ্র্যান্ড লাঞ্চ। ডাক ঘরের অমল – কোন কিছু না দেখেই এসব কল্পনা করেছে। আমি বলতে পারছি সব কিছু সত্যি দেখে এবং ছুঁয়ে! ট্রেক থেকে ফিরে এসে হট শাওয়ার। ওয়াকিলের হাতের অসাধারণ রান্না খেয়ে সবাই হট ব্যাগ আর ব্যথার মলম মেখে সটান বিছানায়। চোখে জড়িয়ে এলো ঘুম। ঠিক ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল নদীর একটানা গর্জনে। চলে গেলাম প্রভাতী আলোয় এবং তাজা হাওয়ায় নিজেকে স্নাত করতে। বাতাসে ফার গাছের গন্ধ। গেট থেকে বেরিয়ে যে পাথুরে রাস্তা – তার পাশাপাশি চলেছে এই পাহাড়ি নদী। তারই পথে পথে মিলিটারি টহল।
গাড়ি ঠিক ন'টায় এসে হাজির। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নিলাম পাহলগাম থেকে। এখানে থেকে গাড়ি ভাড়া করে কাছাকাছি আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি এবং চন্দনবাড়ি যেতে পারা যায়। প্রায় বিকেল তিনটে নাগাদ পৌঁছলাম। আজ শ্রীনগরে শেষ দিন। কাল শুরু হবে যাত্রা লাদাখ অঞ্চলের পথে। শেষ দিনের মতন শিকারায় নিশি ভ্রমণ। শান্ত নাগিনের বুকে শিকারা চলে আরও নিঃশব্দে – অন্ধকারে। জল রেস্তঁরা ম্যাক – সেখানে রাত্রের কফি খেয়ে ফিরে আসা নিজেদের নৌকো বাড়িতে। চোখে ঘুম, মনে উত্তেজনা - পরের দিন সম্পূর্ণ এক অচেনা অজানা জায়গা দেখবার জন্য।
কারগিল-লাদাখ। সকাল সাতটার মধ্যে গাড়ি রেডি। জিনিসপত্র তুলে দিয়ে চলতে শুরু করল। এনএইচ-১ডি – শ্রীনগর -লাদাখ হাইওয়ে। জাহুর – অতি দক্ষ এবং শিক্ষিত ড্রাইভার। স্থানীয় ইতিহাস নখদর্পণে। ঝিলাম বিদায় নিল। স্বাগত জানাল সিন্ধু নদ (Indus River)। ছোটবেলায় ভূগোলে কতবার পড়েছি কতভাবে, এত বছর পর তাকে দেখতে পেয়ে মনে হল অনেক আগে থেকেই যেন চেনা। এই সিন্ধু নদ চলে সারা রাস্তা – কারগিল পৌঁছনোর একটু আগে বাঁক নেবে ভারতবর্ষ থেকে – পাকিস্তানের দিকে। তখন তার সঙ্গে থাকবে জাঁসকর নদী।
দশটার কিছু আগে পৌঁছলাম সোনমার্গ। স্বর্গের শেষের ধাপ হয়ত। সৌন্দর্যের কোন কুল কিনারা নেই। বরফে মোড়া পাহাড়, সবুজ পাহাড়ের ঢাল, ঘন পাইন, ফারের উঁচু গাছ, মখমলের মতন ঘাসে ঢাকা আলপাইন উপত্যকা। আর এক আকর্ষণ হল সিন্ধুতে ট্রাউট মাছ ধরা। আমরা এখন ২৮০০ মিটার উঁচুতে। অনেক নীচে দেখা যায় বালতাল উপত্যকা। রঙিন তাঁবুগুলোকে মনে হচ্ছে ছোট ছোট বিন্দু। সেখানে এখন অমরনাথ যাত্রীদের ভীড়। সোনমার্গ এবং পাহলগাম– এই দুদিক দিয়েই যাওয়া যায় অমরনাথে। পৌঁছলাম এসে 'জিরো পয়েন্ট'-এ। আর চার কিমি পরেই জোজি লা। এরপর আর পেছন ফেরা নয়। চরৈবতি... রাস্তা ক্রমশঃই কঠিনতর এবং সঙ্কীর্ণ হতে শুরু করেছে। ড্রাইভার অত্যন্ত সুদক্ষতার সাথে গাড়ি চালালেও – পুরোপুরি প্রকৃতির প্রতি মনসংযোগ একটু দুরূহ হয়ে ওঠে। চলে এলাম জোজি লা মাউন্টেন পাস-এ। উচ্চতা ৩৫০০ মিটার! গেটওয়ে টু লাদাখ। বিআরও (BRO)-এর দায়িত্ব এই রাস্তা ঠিক রাখার। এদের জওয়ানরা ঈশ্বর তুল্য! এখানে স্লেজ-এ চড়ে বরফের উপর ছোট বড় সবাই আনন্দে মত্ত। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জোজি লা-র পর থেকে বেশ হঠাৎ করেই মানুষ, ভাষা ও প্রকৃতির দৃশ্যপট বদল। সবুজ ক্রমেই ফুরিয়ে এলো। পথে পড়ল 'ওয়েলকাম টু লাদাখ রিজিওন' - জুলে! অবশেষে দ্রাসে পৌঁছলাম। শুনশান জায়গা। এখানে সারা হল দুপুরের খাওয়া - ল্যাম্ব কারি, রাইস। কারগিল পৌঁছনোর কিছু আগে পড়ল কারগিল ওয়ার মেমোরিয়াল। চলতে চলতে (যেখানে সিন্ধু নদ বেঁকে গিয়েছে পাকিস্তানের দিকে) রাস্তার বাঁদিকে টানা ইঁটের দেওয়াল। বেশ উঁচু ও পুরু। জাহুর জানালেন, বিপরীত দিকে অদূরেই পাক-ভারত লাইন অফ কন্ট্রোল। সেখান থেকে গোলা বারুদ প্রায়ই ছুটে আসে। সাধারণ মানুষের জীবন বিব্রত করে। স্থানীয় সরকারের তরফে তাই এই ব্যবস্থা।

কারগিল শহর। উচ্চতা ২৭০০ মিটার। যাত্রীরা এখানে এসে এক রাত্রি থাকে। শ্রীনগর ও লেহ-এর মাঝামাঝি জায়গা। শীতের সময়ে (- ৪৮ ডিগ্রি) কোন টু্রিস্ট আসেনা - জিনিষপত্রের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। পরের দিন সকাল। যাত্রা চলল সুরু নদী (সিন্ধুর শাখা)-র ধার দিয়ে - পাহাড় পেরিয়ে উপত্যকা – আবার পাহাড়ে ওঠা। সামনে এল উঁচু গিরিপথ নামিকা লা - এর উচ্চতা ৩৮০০ মি। চারিদিকে শক্তিশালী হাওয়া আর ধু ধু করছে জাঁসকর রেঞ্জের রুক্ষ পাহাড়ের স্তর। যত্র তত্র বরফ জমে আছে। পরের গিরিপথের উচ্চতা আরও বেশি। পৌঁছলাম ফোতু লা-তে। এর উচ্চতা ৪২০০ মি। এই শ্রীনগর-লেহ্ এন এইচ ডি১-এর পথে ফোতু লা-ই উচ্চতম স্থান। ফটো নেওয়ার পালা। গাড়ি থেকে নামতেই মনে হল মাথার ওপর বেশ ভারী চাপ। হাওয়া বইছে প্রচণ্ড। সবাই চটপট ফটো তুলে তাড়াতাড়ি গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। পথে পড়ল খালাতসি গ্রাম – চেক পয়েন্ট। লাঞ্চ পয়েন্ট। আমরা তিব্বতীয় বুদ্ধের দেশে এলাম। আমার খানিক অলটিচিউড সিকনেস শুরু হয়েছিল আগেই। তবে সেটা ক্রমশঃ মিলিয়ে গেল – কারণ এরপর শুধু নীচের দিকে নামা। ৪২০০ মি থেকে ৩৫০০ মি। লেহ্। মাঝখানে গাড়ি দ্রুত চলল অস্বাভাবিক এক সমতল উপত্যকা দিয়ে। পথে পড়ল লামায়ুরু মনাস্টারি – চলন্ত গাড়ি থেকেই ছবি তোলা হল। এখানে স্থানীয় গাড়ির একমাত্র থামার অধিকার আছে। লামায়ুরু এবং আলচি যেতে হলে লেহ্ থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে হবে। লেহ-তে পৌঁছে রেস্ট নিয়ে বিকেলে দেখতে গেলাম শান্তিস্তুপ। পাঁচ দিনের জন্য স্থানীয় ড্রাইভারকে নেওয়া হয়েছে। পরেরদিন রেস্ট। হাই অল্টিচুড অ্যাক্লাইমাটাইজেসনের জন্য। হোটেলই ইনারলাইন পারমিটের ব্যবস্থা করল সেদিন। নুব্রা ভ্যালি এবং প্যাংগং লেক-এর জন্য। বিকেল চারটে নাগাদ ঘুরে এলাম থিকসে মনাস্টারি - বিশাল গোম্ফা। লাসার পোতালা প্রাসাদের সমতুল্য। পরের দিন বড় জার্নি। লোকেদের মুখে রাস্তার বর্ণনা শুনে মনে মনে বেশ দমে গেলাম। যাই হোক, রাতে অলটিচিউড সিকনেসের ওষুধ ডায়ামোক্স খেয়ে শুয়ে পড়া হল।

প্যাংগং। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ন'টা নাগাদ গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই। রাস্তা ক্রমশঃই খারাপ হতে শুরু করে। ঝাঁকুনিও প্রচুর। লক্ষ্য চাং লা। উচ্চতা ৫৩৬০ মি! স্থানীয় লোকেরা চাং-পা নামে ডাকে। ভারতীয় সেনার সংরক্ষিত এই জায়গা – চিন সীমান্তের দৌলতে। খুব ঘন ঘন রাস্তার বাঁক। দুদিকে ন্যাড়া পাহাড়গুলো বরফে মোড়া। চাং লা পৌঁছনোর আগেই গাড়িতে অসুস্থতার লক্ষণ। ওষুধ কাজে লাগল না। ওখানকার ব্ল্যাক টি খেয়ে রওনা হলাম অতঃপর। এবারের রাস্তা অপেক্ষাকৃত সহজ। দৃশ্যপট ঘন ঘন পরিবর্তন হতে লাগলো। কখনও রুক্ষ পাহাড় পরিবৃত শস্য শ্যামলা উপত্যকা (সর্ষের খেত), কখন পাথুরে মাটি, ঝুর ঝুরে বালির পাহাড়, কখনোবা বালিয়াড়ি। দু'চোখ ভরে দেখবার শেষ নেই। হঠাৎ দুটো ঢালু পাহাড়ের মাঝখানে এক চিলতে নীল রং। নজরে এলো লেখা – 'ফার্স্ট সাইট অফ লেক প্যাংগং'। ক্রমশঃই বাঁকে বাঁকে নীল লেক বিভিন্ন ভাবে ধরা দিতে লাগল। এর উচ্চতা প্রায় ৪৩০০ মি। শীতকালে পুরো লেক হয়ে যায় বরফের চাঁই। এর দুভাগ ভারতের, আর তিন ভাগ চিনের। একসময় লেকের ধার দিয়ে সোজা ড্রাইভ। বাঁদিকে হৃদয় স্তব্ধ করা শান্ত নীল লেক। বেলা তখন প্রায় তিনটে। অসম্ভব জোরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। কয়েকটি তাঁবু ঘুরে অবশেষে সিদ্ধান্ত হল প্যাংগং লেক রিসর্টে থাকবার। পরের দিন ভোরবেলায় সূর্যোদয় দেখা হল – লেককে ঘিরে বরফে মোড়া পাহাড়ের চূড়াগুলোর ওপর সূর্যের হলুদ নরম আলো বিভিন্ন সময়ে যখন এসে পড়ল, মনে হল প্রকৃতি যেন একটি একটি করে রাজমুকুট পরিয়ে দিল। লেকের ধারে কিছুক্ষণ হেঁটে এবার ফেরার পালা। লেহ্ তে ঢুকবার কিছু আগে হেমিস মনাস্টারি দর্শন হল। পরের দিন রেস্ট এবং শপিং। চপস্টিকে লাঞ্চ। তিবেতান কিচেনের খ্যাতি আছে। সুযোগ হয়নি।

নুব্রা ভ্যালি। পরের দিন ঠিক সাতটায় গাড়ি হাজির। হোটেল থেকে ঝটিতি ব্রেকফাস্ট প্যাক করে দিল। অবশেষে নুব্রা ভ্যালি! পথে পড়বে খারদুংলা পাস – যার উচ্চতা ৬০০০ মিটার! সবাই মন শক্ত করলাম, এবার দুটো করে ডায়ামক্স খাওয়া হয়েছে। মিনি অক্সিজেন প্যাক রেডি। সবাই বলল – সাউথ পুল্লু থেকে নর্থ পুল্লু রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। চাং লা-র পথকেও হার মানে। অতএব যাত্রা শুরু। জিম্মি একটি সুর বাজাচ্ছে - শান্ত স্তোত্র। পরে বুঝলাম ওটা মনকে শান্ত রাখার জন্য। বেশ অনেকক্ষণের সুন্দর যাত্রা। ধীরে ধীরে এক উচ্চতা থেকে আর এক উচ্চতা পেরিয়ে যাওয়া। আমাদের অভিজ্ঞ ড্রাইভার বলল – নীচের দিকে না তাকানোই ভাল। তুষারাবৃত কারাকোরাম রেঞ্জ – বাঁকে বাঁকে – বিভিন্ন মোহিনী রূপে দেখা দিচ্ছে। ক্রমঃশই বরফের ধারা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। খারদুংলার কাছাকাছি একটি বাঁকের পর হঠাৎ দেখি দুদিকে পাহাড়ের পর পাহাড় জুড়ে বরফে ঘেরা – অনেক ওপরের দিকে তাকালে একটি বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া, ওটাই নাকি খারদুংলা পয়েন্ট! আর দেখা যায় দেশলাই বাক্সের মতন গাড়ির সারি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। প্রতিটি বাঁক বেশ চ্যালেঞ্জিং। অবশেষে পৌঁছলাম। আরে! ভুলেই গেলাম – কোথায়! কেউ তো অসুস্থ হইনি! বুঝতে পারলাম আমরা অভ্যস্ত হয়ে এসেছি। চারিদিকে বাইকের ভিড়। বিদেশি-বিদেশিনী আর ভারতীয় মেয়েরাও। এছাড়া বিদেশ থেকে অ্যাডভেঞ্চারিস্টরা পেডাল বাইকে করে এই পয়েন্টে আসে। তবে বেশীক্ষণ থাকার উপায় নেই, নিয়মও নেই। ফটো ইত্যাদি তুলে - একটু নীচে খারদুংলা ভিলেজ – সেখানে রেস্ট নেওয়া হল। খারদুংলা পেরিয়ে এসে পড়লাম নুব্রা উপত্যকায়। এবারের পথের সঙ্গী শায়ক নদী। এর পরের রাস্তা চমৎকার। আরও উচ্চতার ভয় নেই। তবে পথে ঘন ঘন চেক পোস্ট। সব করে দুপুর নাগাদ এলাম খালসারে। খালসার থেকে দুটো রাস্তা ভাগ হয়ে গিয়েছে। ডানদিকের রাস্তায় সুমুর, পানামিক এবং বাঁদিকে দিসকিট, হুন্ডার এবং তুরতুক। আমরা সুমুর-এ লাঞ্চ সেরে পানামিক-এ হট স্প্রিং দেখতে গেলাম। আমাদের সঙ্গী এখন নুব্রা নদী। পানামিক-এর পরে সিয়াচেন বেস ক্যাম্প। সাধারণের দৃষ্টির বাইরে। পানামিক হল এই পথের সর্বশেষ গ্রাম। সুমুর মনাস্টারি দেখে ফিরে এলাম খালসার-এ। এবার বাঁদিকের রাস্তায় দিসকিট এবং শেষে হুন্ডার-এ রাত্রিযাপন। দিসকিট মনাস্টারি – পাথুরে পাহাড়ের গায়ে অসাধারণ সেট আপ। মনাস্ট্রিগুলো একই ধরনের, কোনটা আকারে ছোট বা বড়। প্রায় তিনটের সময় নুব্রা উপত্যকার প্রধান শহর দিসকিট-এ পৌঁছলাম। আইন কানুনের সব কাজ – এখান থেকেই হয়। এর পরের গন্তব্যস্থান হুন্ডার - মরুভূমি পরিবৃত মরুদ্যান। চতুর্দিকে রুক্ষ পাহাড়, সঙ্গে বালিয়াড়ির ঢাল, মাঝখানে নদী ও সবুজের সমারোহ। রাত্রিযাপন নুব্রা অর্গানিক রিট্রিট-এ। আট একর জমি নিয়ে এই অতিথিনিবাস। প্রত্যেকটি তাঁবু সুইস ডিলাক্স। চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা রকমের আকর্ষণ। ছোট ছোট ঝোরা, তার ওপরে ছোট সাঁকো। ট্রি হাউসে চা খাবার সরঞ্জাম। সেখানে গাছে গাছে ধরে আছে আপেল, অ্যাপ্রিকট। অরগানিক ভাবে চাষ করা হয় সমস্ত সবজি, ফল। সেই খেতের সবজিতে রান্না হয় – সব অতিথিদের জন্য। খেত পরিভ্রমণ করাও একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা। যাই হোক, তাড়াতাড়ি চা শেষ করে রওনা হলাম উটের পিঠে চড়বার জন্য – দু-কুঁজওলা ব্যাকট্রিয় উট। চারদিকে মনে হয় যেন লাল পাথুরে মাটির পাহাড়। সামনে বালিয়াড়ি। আবার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট নদী। যেন রূপকথার রাজ্য। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। নানা রঙের আলো আর আঁধারির খেলায় মেতে উঠল নুব্রা উপত্যকা। পরের দিন ভোরবেলায় উঠে 'টি সেন্টারে' চলে এলাম। বিভিন্ন প্রকারের চা তৈরি করে রাখা আছে ফ্লাস্কে। সুন্দর খোলামেলা বসবার জায়গা।
এরপর বিদায়ের পালা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। লেহতে পৌঁছে গেলাম ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে। মন খারাপের পালা। কাল সকালে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট – দিল্লি উড়ে যাবার। ইচ্ছে ছিল মোটর পথে লেহ থেকে সারচু, রোটাং পাস, মানালি হয়ে দিল্লি যাওয়ার। বাদ সাধল প্রকৃতি। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারায় হিমাচল প্রদেশ তখন টইটম্বুর। অতএব... দিল্লি চলো। প্লেনের জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে মনে হল যেন সব পাহাড়গুলোতেই চড়েছি... ছুঁয়েছি...সব কিছুই চেনা মনে হতে লাগল...।


~ কাশ্মীরের তথ্য ~ কাশ্মীরের আরও ছবি ~ লাদাখের আরও ছবি ~

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী শুভ্রা মিত্র বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। আই টি-তে কর্মরত। নেশা নাটক পরিচালনা এবং অংশগ্রহণ। ভালোবাসেন বই পড়তে, বেড়াতে এবং ছোটগল্প লিখতে। এই প্রথম ভ্রমণকাহিনি লেখা। অবসর সময়ে 'আমাদের ছুটি' তাঁর ক্লান্তি দূর করে।


 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher