ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - হিমালয়ের ডায়েরি (ষষ্ঠ পর্ব)
অতিকষ্টে লঙ্কা ও গঙ্গোত্রী
সুবীর কুমার রায়
পূর্বপ্রকাশিতের পর -
ব্রিজটার কাছে একটা গাছের তলায় চায়ের দোকান। দোকানে একজন সাধু গোছের লোককে দেখলাম। একে গতকাল গাংগানীতে দেখেছিলাম। গরমকুণ্ডে রান্নাবান্না করতেও দেখেছিলাম। আরেকটু এগিয়ে একটা আধা শহর। গোটা তিনেক বাস দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়িতে সোয়া দশটা বাজে। কোনটা যাবে জিজ্ঞাসা করে, নাম্বার জেনে নিয়ে, বাসে উঠে জায়গা দখল করলাম। এই প্রথম দেখলাম ড্রাইভারের একটু পিছনে, গ্রিলের পার্টিশন দিয়ে প্রথম শ্রেণী। পিছনে চারটে লম্বা রো। এগুলো দ্বিতীয় শ্রেণী। ভাড়া হয়তো কিছু কম। প্রথম শ্রেণীতে একটা লম্বা বড় সিট, ড্রাইভারের পাশে দু'জনের বসার সিট। নীচে এসে দেখলাম দু'পাশে কয়েকটা দোকান আছে। কিন্তু কোনও খাবার দোকান দেখলাম না। সকাল থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত পেটে পড়ে নি। কাল রাতে ছয়-সাতটা প্রায় কাঁচা রুটি খাওয়া বোধহয় ঠিক হয়নি। শরীরটায় খুব জুৎ নেই। এ রাস্তায় পেট খারাপ হওয়া খুব বিপজ্জনক। তার ওপর আবার এখন যাচ্ছি সব থেকে বিপদসঙ্কুল স্থানে। লোকে বলে গোমুখ গেলে মানুষ নাকি আর ফেরেনা। ওখানে পৌঁছে ফিরে আসতে না পারলে দুঃখ নেই, কিন্তু পৌঁছনোর আগেই কিছু ঘটে গেলে মৃত্যুটা বড়ই দুঃখজনক ও লজ্জাকর হবে। তাই ঠিক করলাম দুপুরে কিছু খাব না। একটু পকোড়া ও এক কাপ চা খেয়ে বাসে উঠে বসলাম।
মনে মনে বেশ একটা আনন্দ অনুভব করছি। লঙ্কা যাওয়ার বাস যখন পেয়ে গেছি, তখন গঙ্গোত্রী, গোমুখ পৌঁছেই গেছি বলা যায়। ক্রমে ক্রমে বেলা প্রায় বারটা বাজল। পিছনের দ্বিতীয় শ্রেণীর সিটে সেই সাধু গোছের লোকটা এসে উঠেছে। আরও উঠেছে একজন গেরুয়া রঙের ধুতি পাঞ্জাবী পরা সাধু, তার এক বাচ্চা শিষ্য ও বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের একজন চেলা। মাধব ও দিলীপ ভাত রুটি যা পাওয়া যায়, খেতে গেল। আমি লম্বা সিটটায় চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। পিছন থেকে গেরুয়াধারীর মাহাত্ম্য, তাঁর নিজের মুখেই শুনছি। ভীষণ বিরক্ত লাগছে। নিজেকে সে মহাত্মা বলে সম্বোধন করছে। অন্য সাধু গোছের লোকটা, তার কথায় সায় দিচ্ছে বটে, তবে বেশ বোঝা যাচ্ছে, সে গেরুয়াধারীর একটা কথাও বিশ্বাস করছে না। শুয়ে শুয়েই শুনলাম, সাধু গোছের লোকটা গঙ্গোত্রী থেকে ফিরে যমুনোত্রী যাবে। আমি যমুনোত্রী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম, ওই পথ সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মাধব আর দিলীপ ফিরে এসেছে। ওরাও শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। গেরুয়াধারীর কথার ফুলঝুরি যেন বেড়েছে। সাধু গোছের লোকটাকে বোঝাচ্ছে যে জহরলাল নেহরুকে বলেছিল, সে একটা অপদার্থ। তার দ্বারা দেশ চালানো সম্ভব নয়। শুনে শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি ও দিলীপ তাকে একটু উসকে দিতেই জানাল, ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিল, "ইন্দিরা তোর দ্বারা দেশের কোন ভাল কাজ হবে না। তুই যা করছিস, তাতে তোর বিপদ হবে"। যা বুঝলাম, সে সুভাষ, গান্ধী, জহরলাল, সবাইকেই ভালভাবে চিনত এবং সবার সঙ্গেই তুই তোকারি সম্পর্ক ছিল। ভাবছিলাম, এবার কেনেডি, কার্টার বা ব্রেজনেভকে কী কী বলেছিল তার ফিরিস্তি দেবে। এবার বলল, একবার ধ্যানে বসে জানতে পারে যে তার মা প্রায় মৃত্যু শয্যায়। সাপে কেটেছে। ধ্যানেই মা-কে বাঁচাবার জন্য দেবতাদের স্মরণ নেয়। মা বেঁচেছিল কী না জানবার আর আগ্রহ নেই। এই মুহূর্তে কখন বাস ছাড়বে, সেটা জানার আগ্রহ আমার অনেক বেশি। তবু মনে হল ওর মা'কে সাপে না কেটে, যদি ওকে কাটত, তাহলে ওর মা এবং আমরা, উভয়পক্ষই শান্তি পেতাম।
শুয়ে বসে কোমরে বাত ধরার উপক্রম। বাস থেকে নেমে খোঁজ নিতে গেলাম। জানা গেল গতকাল কোন বাস লঙ্কা যায় নি। এখানে বাসের তেল ভুখি থেকে খচ্চরের পিঠে বয়ে আনতে হয়। একটা খচ্চর এক ব্যারেলও তেল আনে না। তার জন্য ভাড়া দিতে হয়, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। তাছাড়া উত্তরকাশী থেকে ভুখি পর্যন্ত তেল বয়ে আনতেও বাস খরচ অনেক লেগে যায়। কাজেই পঁচিশ-ত্রিশজন প্যাসেঞ্জার না হলে বাস ছাড়বে না। গতকালও এই একই কারণে কোন বাস ছাড়ে নি। একজন আবার বলল, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী, প্যাসেঞ্জার না হলেও, রোজ একটা অন্ততঃ বাস ছাড়ার কথা। শুনে একটু আশার আলো দেখলাম। কোন কথাটা সত্যি আর কোনটা যে মিথ্যে বোঝার উপায় নেই। শুনলাম লঙ্কা পর্যন্ত জীপও যায়। কিন্তু কোথাও কোন জীপের চিহ্ন দেখলাম না। আবার বাসে এসে বসলাম। একটু পরে সত্যিই লঙ্কা থেকে প্যাসেঞ্জার নিয়ে একটা জীপ এল। জানা গেল অন্তত ছয়জন প্যাসেঞ্জার না হলে, জীপ যাবে না। ভাড়া মাথাপিছু কুড়ি টাকা। বাসে ভাড়া নেয় দশ টাকা মতো। ইতিমধ্যে একজন যুবক এসে বাসে উঠেছে, যাবে হরশিল। দেখে মনে হল, এখানকার লোক নয়। প্যাসেঞ্জারের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজও নেই। আমার বেশ খিদে পাচ্ছে এবার। মাধবকে নিয়ে গেলাম কিছু খাবারের সন্ধানে। ভাবলাম কয়েকটা বিস্কুট আর চা খেয়ে নেব। কোনও দোকানে বিস্কুট পেলাম না। কিন্তু সব দোকানেই অনেক রকম গায়ে মাখার সাবান আছে। এত সাবান এখানে কে মাখে বুঝলাম না! অনেক নীচে সমতল এলাকায়, গোটাকতক মিলিটারি ক্যাম্প। রাস্তার পাশে একটা কল থেকে অবিরাম জল পড়ে যাচ্ছে। শেষে একটা দোকানে বিস্কুটের প্যাকেট পাওয়া গেল। গ্লুকোজ বিস্কুট। প্যাকেটটা খুলতেই অর্ধেক বিস্কুট গুঁড়ো হয়ে পড়ে গেল। কত সালে এই প্যাকেটটা তৈরি হয়েছিল ভগবান জানেন। বাসের সেই মহাত্মা গেরুয়াধারী জানলেও জানতে পারে! উপায় নেই, তাই-ই খেয়ে নিলাম।
এইভাবে বেলা তিনটে বেজে গেল। ঠিক করলাম আর অপেক্ষা না করে, জীপেই যাব। বাসের সেই নবাগত যুবকটি খুব আগ্রহ প্রকাশ করল। বাসে গিয়ে সাধু গোছের লোকটাকে, গেরুয়াধারী সাধু ও তার দুটো চেলাকে জীপে যাওয়ার কথা বললাম। ওরা পরিষ্কার জানাল এত ভাড়া দিয়ে জীপে যাবে না। বললাম বাস কবে ছাড়বে তার ঠিক নেই। বলল, ওদেরও কোন তাড়াহুড়ো নেই, এখানেই দুটো চাল ডাল সেদ্ধ করে খেয়ে থেকে যাবে। রাগ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রকাশ করলে চলবে না। কারণ ওরা না গেলে কিছুতেই ছ'জন খদ্দের হচ্ছে না। বললাম, বাসে তো থাকতে দেওয়া হয় না, রাতে কোথাও থাকতেও তো পাঁচ-সাত টাকা খরচ হবে। তাছাড়া কবে বাস যাবে, তারও তো কোন ঠিক নেই। তাই রোজ থাকা খাওয়া বাবদ এত টাকা খরচ করার থেকে, দশটা টাকা বেশি দিয়ে জীপে চলে যাওয়াই লাভজনক। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়, কিছুতেই রাজি হল না। এইভাবে প্রায় সাড়ে তিনটে পর্যন্ত খদ্দেরের আশায় কাটালাম। গতকাল ও আজ, দু'দিনে মোট আটজন প্যাসেঞ্জার জুটেছে। কাজেই পঁচিশ-ত্রিশজন যাত্রী যোগাড় হতে কতদিন লাগতে পারে হিসাব করে, মনস্থির করলাম যেভাবে হোক জীপেই যাব। একবার ভেবেছিলাম মিলিটারি ট্রাকে অনুরোধ করে লঙ্কা যাব। কিন্তু সাধারণ মানুষকে কখনও তাদের ট্রাকে জায়গা দেয় না জেনে সে অনুরোধ আর করি নি। শেষ পর্যন্ত অনেক বোঝাবার পরে, সাধু যুগল ও চেলাদ্বয়, জীপে যেতে রাজি হল। সামনে ড্রাইভারের পাশে জায়গা নিয়ে বসলাম। আমার পাশে আর একটা বাচ্চা ছেলে কোথা থেকে এসে আসন দখল করল বুঝলাম না। তার পাশে, দরজার ধারে, যুবকটি বসল। পিছনে মাধব, দিলীপ, দুই সাধু ও দুই চেলা। অবশেষে সব অশান্তির সমাপ্তি ঘটিয়ে, জীপ ছেড়ে দিল। ও মা, এবার দেখি এদিক ওদিক থেকে দু-একজন এসে জীপের পেছনে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল! রাস্তায় অজস্র গিরগিটি এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এখানে ওদের এত আধিপত্য কেন বুঝলাম না। একপাল ছাগল, ভেড়া রাস্তায় চরে বেড়াচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর তাদের সরিয়ে, জীপ সামনে এগিয়ে চলল।
এইভাবে দেড় কিলোমিটার মতো পথ এসে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। বন্যার আগে রাস্তা যখন স্বাভাবিক ছিল, সমস্ত বাস, জীপ উত্তরকাশী-লঙ্কা যাতায়াত করতো। উত্তরকাশীতেই গাড়িগুলোর সার্ভিসিং বা মেরামতের কাজ হ'ত। বন্যার সময় ডাবরানীর দিকে পাঁচটা বাস ও দুটো জীপ ছিল। এগুলো আর রাস্তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উত্তরকাশী যেতে পারছে না। ফলে গাড়িগুলো তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত মেরামত করে নিচ্ছে। মিলিটারিদের সঙ্গে এদের খুব সুসম্পর্ক, সেরকম বড় কোন অসুবিধা হলে, মিলিটারিরা যথেষ্ট সাহায্য করে। জীপ মেরামত করতে করতে ড্রাইভার এসব তথ্য জানাল। যাহোক, ড্রাইভার ও যুবকটির চেষ্টায়, জীপ আবার সচল হয়ে অসংখ্য গিরগিটি, ছাগল ভেড়াকে কাটিয়ে, নিজের রাস্তায় এগিয়ে চলল। পাশে গভীর খাদ। আরও দেড়-দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জীপ আবার দেহ রাখল। ডাবরানী থেকে লঙ্কা ঊনচল্লিশ কিলোমিটার পথ। তিন-চার কিলোমিটার পথ পেরোতেই জীপ দু'-দু'বার খারাপ হল। উল্টো দিক থেকে একটা মিলিটারি ট্রাক এসে দাঁড়াল। একজন মিলিটারি যুবক নেমে পড়তে, ট্রাকটা ডাবরানী চলে গেল। এই যুবকটির চেষ্টায় জীপ আবার প্রাণ ফিরে পেল। শুনলাম যুবকটি মিলিটারি ট্রাক চালায়। জীপ আবার এগিয়ে চলল। আরও খানিকটা পথ পাড়ি গিয়ে, ডাবরানী থেকে সাত কিলোমিটার দূরে আমাদের রথ আবার বিগড়ে গেল। রাস্তায় নেমে দাঁড়ালাম। জীপটাকে একবার পিছন দিকে, একবার সামনের দিকে ঠেলে অনেক চেষ্টা করেও তার হৃৎপিন্ড সচল করা গেল না। পাইপ দিয়ে তেল বার করে ড্রাইভার তার বুদ্ধিমত অনেক চেষ্টা করল। ফল কিছু হল না। তখন আবার ঠেলে জীপের মুখ ডাবরানীর দিক করে, ঢালু রাস্তায় জীপ গড়িয়ে অনেকটা রাস্তা পিছিয়ে এসে বার বার স্টার্ট নেওয়ার চেষ্টা করেও, কোনও সুফল পাওয়া গেল না। জীপেই মালপত্র, টাকা পয়সা ছিল, আমরা হেঁটে হেঁটে জীপের কাছে এলাম। ড্রাইভার জানাল ফিল্টারে ময়লা জমেছে। সে ফিল্টার খুলে রাস্তায় বসে পরিষ্কার করতে শুরু করল। শক্ত একটা কাঠি দিয়ে খুঁটে খুঁটে, কফি রঙের জমাট বাঁধা পাথরের মতো শক্ত ময়লা বার করে, পেট্রল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হল। যে পরিমাণ পেট্রল নষ্ট হল, ভয় হচ্ছে যে জীপ চালু হলেও, তেলের অভাবে না ইঞ্জিন আবার বন্ধ হয়ে যায়! ড্রাইভার ও যুবকের চেষ্টায় ফিল্টারটা ঠিক জায়গায় লাগানো হল। আমাদেরও হেল্পারের কাজ করতে হল। কিন্তু এত কিছুর পরেও জীপ চালু করা সম্ভব হল না। ড্রাইভার তবু হাল ছাড়লনা, একটা পাইপ দিয়ে ট্যাঙ্ক থেকে আমাদের পল টানতে বলল। সম্ভবত সাইফন প্রক্রিয়ায় তেল বার করে কোন কাজ করবে। মুখ দিয়ে খুব জোরে টান দিতে আমার মুখ, জামা, প্যান্ট পেট্রলে ভিজে গেল। ড্রাইভার আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল, পেট্রলে কাপড়ে দাগ পড়ে না। আর ভাল লাগছে না, হাল ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় বসে পড়লাম।
এতক্ষণ চুপ করে বসে থেকে, গেরুয়াধারী আমায় বলল —"বাঙালিবাবু, যে সব কাজে তাড়াহুড়া করে, সে সফল হতে পারে না, পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না"। বললাম, তা হয়তো ঠিক, তবে যে চেষ্টা করে, সে পূর্ণতা অর্জন করলেও করতে পারে, কিন্তু যে বসে থাকে, তার ভাগ্যও বসে থাকে। তারপক্ষে কোনদিনই পূর্ণতা অর্জন সম্ভব নয়। ড্রাইভার এখনও গাড়ি চালু করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। গেরুয়াধারী পকেট থেকে একটা ছোট বই বার করে পড়ার ভান করছে। মাঝেমাঝে কান, নাক, বুক, পেটে আঙ্গুল দিয়ে প্রণাম করছে। এদিকে ক্রমশঃ সন্ধ্যা নেমে আসছে, বুঝতে পারছি সামনে সমূহ বিপদ। গেরুয়াধারী এবার ড্রাইভারকে বলল, "আমি মহাত্মা, সব কাজ সময়মত করতে হয়। যে কাজে মন দেয় না, সময়মত কাজ করে না, তার কখনও উন্নতি হয় না"। এই মুহূর্তে এইসব জ্ঞানবাক্য অসহ্য মনে হচ্ছে, বিরক্ত লাগছে। ড্রাইভার বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, 'একটু অপেক্ষা করুন, গাড়ি ঠিক হবেই।' গেরুয়াধারী উত্তরে বলল, 'এই জন্যই এই গাড়িতে আসতে চাইছিলাম না। বাঙালিরা বেশি চালাক, তাই নিজেরা এসে আমাদের বিপদে ফেলল। আমি মহাত্মা, আমি সব আগে থেকে বুঝতে পারি। কী বাঙালিরা, কতদূর পৌঁছলে? লঙ্কা পৌঁছে গেছ?' রাগে গা জ্বলে গেল। গালাগাল দিয়ে বললাম, 'তোমাকে সঙ্গে নেওয়াটাই আমাদের চরম ভুল হয়েছে।' মাধব আমাকে এসব কথা বলতে বারণ করছিল। ড্রাইভার এবার বেশ কড়া সুরে বলল, 'কথা না বলে একটু চুপ করে বসুন। গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।' গেরুয়াধারী কিন্তু চুপ করে থাকতে নারাজ। সে দম নিয়ে নতুন করে বলতে শুরু করল, 'বাঙালিরা বেশি পণ্ডিত হয়, তাই ফল পাচ্ছে।' আমি আবার গালাগালি দিয়ে উঠলাম চটে গিয়ে। বলিহারি মাধবের সহ্যশক্তি! চুপ করে বসে কাজ দেখছে। গেরুয়াধারী আবার মুখ খুলতেই, দিলীপ হঠাৎ চুউউউউপ বলে চিৎকার করে ধমক দিতেই, ও কীরকম ঘাবড়ে গিয়ে মুখে কূলুপ এঁটে দিল। অবশেষে ড্রাইভার ঘোষণা করল, জীপ আর যাবে না। যুবকটি আর সাধুরা ঠিক করল শর্টকাট রাস্তায় হরশিলের দিকে হেঁটে যাবে। হরশিলের দূরত্ব কত তাও জানা নেই। তাছাড়া এই সন্ধ্যায় যাওয়া ঠিক হবে কী না, তাও বুঝতে পারছি না। যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম হরশিলে রাতে থাকা খাওয়ার জায়গা পাওয়া যাবে কী না। সে জানাল পাওয়া যেতে পারে। পাওয়া যাবেই কিন্তু বলল না। ড্রাইভারও সেরকম জোর দিয়ে কিছু বলল না। কী বিপদেই যে পড়লাম। ঠিক করলাম ডাবরানী ফিরে যাব। ওরা হরশিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।।
ড্রাইভারকে বললাম, ডাবরানীর দিকে তো ঢালু পথ, জীপ গড়িয়ে নিয়ে চল। সে জীপে উঠে বসল। আমরা তিনজনে জীপ ঠেলতে শুরু করলাম। ঢালু রাস্তায় জীপ বেশ গতি নিলে, লাফিয়ে উঠে বসলাম। আবার চড়াইয়ের রাস্তা এলে, জিভ বার করে জীপ ঠেলতে শুরু করলাম। আবার উতরাইয়ের রাস্তায় এসে জীপ অসম্ভব গতিতে গড়াতে শুরু করলে, লাফিয়ে উঠে বসলাম। এইভাবে একবার ঠেলে, একবার দৌড়ে, একবার জীপে বসে আমরা পিছোচ্ছি। সবাই গাড়ি নিয়ে এগোয়, আমরা পিছোচ্ছি! এইভাবে একসময় অনেকটা রাস্তা উতরাই পাওয়া গেল। জীপ অসম্ভব গতিতে এগিয়ে চলেছে। অনবরত বাঁক। আমার একটাই চিন্তা, জীপে কোন হর্ন নেই। উল্টোদিক থেকে মিলিটারি ট্রাক আসলে চোখের নিমেষে খাদে চলে যাব। মাধবকে অফিসের কাজে গাড়ি করে অনেক ঘুরতে হয়। কাজেই ওর ধারণা থাকতে পারে ভেবে জিজ্ঞাসা করলাম, ইঞ্জিন বন্ধ থাকলে ব্রেক কাজ করে কিনা। ও বলল, এ বিষয়ে ও নিশ্চিত যে কাজ করে। গলার ঝোলা ব্যাগ সিটে রেখে, জীপের বাইরে একটা পা ঝুলিয়ে, রেডি হয়ে বসলাম। প্রয়োজনে যাতে সহজেই লাফিয়ে নেমে পড়তে পারি। যাহোক, কোন বিপদ না ঘটিয়ে জীপ রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার বলল, জীপ আর যাবে না। এখান থেকে ডাবরানী প্রায় চার কিলোমিটার পথ। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করলাম। একসময় ডাবরানী ফেরত চলে এলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সারাদিনের নেট লাভ, অন্তত পাঁচজন যাত্রীকে হারানো। অর্থাৎ আমাদের তিনজনকে বাদ দিয়ে কাল আবার সতেরো থেকে বাইশজন নতুন যাত্রী যোগাড় করা।
ডাবরানীতে এসে একটা দোকানে বুদ্ধি সিং-এর খোঁজ করলাম। যে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন আপনারা ঠিক জায়গায় এসেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম— "আপনার নামই কী বুদ্ধি সিং"? উত্তরে বললেন যে তিনি বুদ্ধি সিং নন। বললাম, আমরা উত্তরকাশী ট্রাভেলার্স লজে বুদ্ধি সিং-এর নাম শুনে এসেছি। আজ রাতে আমাদের থাকার জন্য তিনটে খাটিয়া, লেপ, তোষক চাই। ভদ্রলোক যেন বিনয়ের অবতার। একগাল হেসে বললেন, আপনারা একটু কষ্ট করে বসুন। বুদ্ধি সিং এখনই এসে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। একটু পরেই ভদ্রলোক সামনে একটা বড় তাঁবু দেখিয়ে বললেন, এখানে কষ্ট করে না বসে, আপনারা তাঁবুতে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমরা তাঁর কথামত তাঁবুর ভিতরে গিয়ে দেখলাম, দুটো সারিতে পরপর অনেকগুলো খাটিয়া পাতা। আরও বেশ কয়েকটা দাঁড় করানো আছে। একদিকের রো-তে পরপর দুটো খাটিয়ায়, এক বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী জায়গা নিয়েছেন। অপর দিকের রো-তে পরপর তিনটে খাটিয়ায়, আমরা তিনজনে জায়গা দখল করে বসলাম। বুদ্ধি সিং হাজির হলেন। আমরা তাঁকে উত্তরকাশীর কথা বললাম। তিনি দুহাত তুলে নমস্কার করে বেশ নতুন ধবধবে সাদা কভার লাগানো লেপ, তোষক বার করে দিলেন। এত আরামে এখানে থাকা যাবে স্বপ্নেও ভাবি নি। বুদ্ধি সিং বললেন, 'নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন, কোনও চিন্তা করবেন না।' অনেকটা জায়গা নিয়ে তাঁবুটা খাটানো হয়েছে। সুন্দর ভাবে কেটে দরজা-জানালাও করা হয়েছে। এ জায়গায় এটাকে রীতিমত গ্র্যান্ড হোটেল বলা চলে!
নিজেদের খাটিয়ায় বসে অপর দিকের ওই স্বামী-স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। আজ লঙ্কা থেকে আমাদের যে অভিশপ্ত জীপটা এসেছে, ওই জীপেই তাঁরা লঙ্কা থেকে এসেছেন। ভদ্রলোক বললেন, খুব অসুস্থ বোধ করছেন। পায়ের জুতো থেকে অনেকগুলো ফোস্কা হয়ে ঘা হয়ে গেছে। বললাম, এক সাইজ বড় জুতো কেনা উচিত ছিল। জায়গাগুলো ভাল করে পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগাতেও বললাম। ভদ্রলোক ওষুধ খেয়ে, ভাল করে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে আমাদের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। থাকেন বোম্বাই শহরে। ব্যবসা করেন। অমরনাথ হয়ে গঙ্গোত্রী গোমুখ গিয়েছিলেন। অমরনাথের আগেও অনেকগুলো জায়গা ঘুরে এসেছেন। যদিও সব জায়গাতেই ঘোড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখান থেকে যমুনোত্রী যাবেন। আরও অনেকগুলো জায়গা যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। বললেন, বিয়াল্লিশ দিন হল বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। কথাবার্তায় বোঝা গেল ভদ্রলোক অগাধ পয়সার মালিক, তবে দেশ ভ্রমণের ইচ্ছাও যথেষ্ট। ভদ্রলোককে গঙ্গোত্রী, গোমুখের রাস্তাঘাট সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। বললেন, প্রথম দিনই এখান থেকে লঙ্কাগামী বাস পেয়েছিলেন। লঙ্কা থেকে গঙ্গোত্রীর জীপও পাওয়া যাবে। মনে মনে ভাবলাম, আমরাই বোধহয় ঘোর পাপী, তাই ওই রকম একজন সাধুসঙ্গেও কাজ হয়নি। বললেন, গোমুখ যেতে হলে, গঙ্গোত্রী পুলিশ স্টেশনে নাম, ঠিকানা ইত্যাদি লিখে, তবে যেতে দেওয়া হচ্ছে। একজন পান্ডার সঙ্গে এক ভদ্রলোক গোমুখ গিয়েছিলেন। তাঁদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তা খুব কষ্টকর। ভূজবাসার লালবাবার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, ওই রকম একজন মানুষ তিনি জীবনে কোনদিন দেখেন নি। অতিথিদের দেবতাজ্ঞান করেন। বললেন, প্রথমে লালবাবার ওপর ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন। অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে লালবাবার আশ্রমে পৌঁছলে, লালবাবা তাঁদের অনেকটা করে চা খেতে দেন। কোনদিন চা পান করেন না, তাই তাঁরা চা খেতে রাজি হননি। তখন লালবাবা বলেন, চা খেলে শরীর ভাল থাকবে। এরপরও চা খেতে অস্বীকার করলে, লালবাবা বলেন, চা পান না করলে এখানে তাঁদের থাকতে দেওয়া হবে না। ফলে বাধ্য হয়ে চা পান করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, এবং বেশ সুস্থও বোধ করেন। লালবাবা তখন বলেন, এত কষ্ট করে এখানে আসার পর গরম চা পান করলে শরীর অনেক সুস্থ হয়ে যায়। তাই তাঁদের জোর করে চা পান করানো হল। রাতে তাঁদের অনেকগুলো রুটি খেতে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা রুটি কমিয়ে দিতে বললেও, কমানো হয়নি। ওখানে অত কষ্ট করে অত মূল্যবান খাবার নিয়ে যাওয়া হয়, তার জন্য কোন দাম পর্যন্ত নেওয়া হয় না। ফলে রুটি ফেলে দিতেও পারছেন না। ওখানে ভীষণ ঠাণ্ডা, তাঁর স্ত্রী লালবাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, রাতে ক'টা কম্বল পাওয়া যাবে। উত্তরে তিনি বলেন, যতগুলো রুটি খাবে, ঠিক ততগুলো কম্বল। বাধ্য হয়ে ইচ্ছা না থাকলেও তাঁরা চার-পাঁচটা করে রুটি খেয়ে নেন। রাতে কিন্তু তিনি অনেকগুলো করে কম্বল পেতে শোওয়ার ও গায়ে দেওয়ার জন্য দিয়ে বলেছিলেন, এখানে আসার পর বেশীরভাগ যাত্রীই পথশ্রমে রাত্রে না খেয়ে শুয়ে পড়তে চান। খালিপেটে এতবড় রাত কাটালে শরীর খারাপ হবেই, তাই তাঁকে ভয় দেখিয়ে খাবার নিয়ে জোর করতেই হয়। তীর্থযাত্রীদের সুস্থ রাখার জন্য সব সময় চিন্তা করেন। ভদ্রলোক ওখানে একজনের কাছে শুনেছেন যে, কারো পায়ে খুব বেশি ব্যথা হলে, তাকে সুস্থ করার জন্য লালবাবা নাকি পা পর্যন্ত টিপে দেন। যাহোক, এবার ভদ্রলোক আমাদের পরামর্শ দিলেন যে, আমরা যেন ওখানে পৌঁছেই তাঁকে জানাই যে আমরা খেয়ে এসেছি এবং শরীরও ভাল নয়, কাজেই খুব অল্প করে খাব। খেতে বসে শরীর খারাপ বললে তিনি বিশ্বাস করবেন না। এত কথা শুনে লালবাবাকে দেখবার খুব ইচ্ছাও হল। দিলীপ ও মাধব জিজ্ঞাসা করল, ভূজবাসা থেকে গোমুখ যাবার জন্য গাইড নিতে হবে কিনা। বললাম, বছর দুই আগে আমার পরিচিত একজন গোমুখ গিয়েছিল, সে বলেছে গাইড নেবার প্রয়োজন হয় না। ভদ্রলোকও বললেন, শেষ আধ মাইল কোন রাস্তা নেই বটে, তাহলেও নিজেরাই যাওয়া যায়। গাইডের প্রয়োজন হয় না। যাহোক, তখনকার মতো কথা থামিয়ে তাঁবুর বাইরে এলাম।
দোকানে এসে দেখি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন আদিবাসী গোছের পুরুষ ও নারী একটা পালকির মতো কী নিয়ে ওই দোকানে এসে উঠেছে। দুটো লাঠির মাঝখানে পালকির আকারের একটা মন্দিরের মতো ঘর। তার মধ্যে কিছু একটা দেবদেবীর মূর্তি আছে। স্থানীয় কোন গ্রাম থেকে ওরা এখানে এসেছে, যাবে গঙ্গোত্রী। দেখলাম দোকানে বসে বেশ কয়েকজন হালুয়া তৈরি করছে। ওই দেবতার প্রসাদ। দোকানদার জানাল, ইচ্ছা করলে আমরাও খেতে পারি। ভাবলাম খেয়ে দেখলে মন্দ হয় না। এটা তো মানতেই হবে, ইনি যে দেব বা দেবীই হ'ন না কেন, অত্যন্ত জাগ্রত। যাত্রীর অভাবে আমরা ভয়ঙ্কর বিপদ ও শোচনীয় কষ্টের মধ্যে আছি জানতে পেরেই, প্রয়োজনীয় সংখ্যার বেশীই লোকজনকে গঙ্গোত্রী পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আগামী কাল আমাদের লঙ্কা যাওয়া কে আটকায়? খাবারের অর্ডার দিয়ে, দোকানদারকে আগামী কালের বাসের খোঁজখবর দিতে বললাম। সে বলল, পরপর দু'দিন কোনও বাস যায়নি, কাজেই কাল নিশ্চয় বাস ছাড়বে। বললাম, এরা সবাই গঙ্গোত্রী গেলে, প্যাসেঞ্জারের তো অভাব হবার কথা নয়। দোকানদার বলল, এরা স্থানীয় মানু্ষ, সবাই হেঁটেই যাবে। ব্যস, বাড়া ভাতে ছাই হয়ে গেল। আমাদের মুষড়ে পড়তে দেখে, সে আশ্বাস দিয়ে বলল, আগামী কাল পঁচিশ-ত্রিশ বস্তা ময়দা ও চার-পাঁচ টিন ডালডা নিয়ে যাওয়া হবে, ফলে বাস ছাড়বেই। প্যাসেঞ্জারের বদলে ময়দা ও ডালডা? সবই কপাল। যা খুশি, যে খুশি যাক, বাস গেলেই হল। তাঁবুর ভদ্রলোক বলেছিলেন রাতে তিনি কিছু খাবেন না। আমরা খেতে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে,খুব উপকার হয়। ডাকতে গিয়ে শুনলাম, তাঁবুতেই খাবার দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। দোকানে ফিরে গেলাম। সেই একঘেয়ে রুটি আর আলুর তরকারি, সঙ্গে অবশ্য ডাল আছে। হালুয়া আর খেলাম না। একবার ভেবেছিলাম অন্য একটা দোকান থেকে পরোটা কিনে খাব। শেষ পর্যন্ত তা আর খাওয়া হল না। তাঁবুতে ফিরে এসে একটু গল্পগুজব করে শুয়ে পড়লাম। আজ আমরা সত্যিই বড় ক্লান্ত। তার ওপর এত আরামে এ পথে ঘুমোবার কথা ভাবতেও পারিনি। আগে ডাবরানীতে কেউ নামতোও না। বন্যার পর সবাইকে ডাবরানী আসতেই হবে, আর প্যাসেঞ্জারের অভাবে বাস না পেলে দু-এক রাত থাকতেও হবে। ফলে বুদ্ধি সিং বুদ্ধি করে খাসা ব্যবসা খুলে বসেছেন। অবশ্য ব্যবস্থাও খুবই ভাল করেছেন। সব থেকে বড় কথা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যেটার এপথে খুবই অভাব।
আজ ঊনত্রিশ আগষ্ট। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে, বুদ্ধি সিংকে তাতাঁবু ভাড়া বাবদ বারো টাকা মিটিয়ে দিয়ে একবার বাইরে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসবো ভাবছি, বুদ্ধি সিং বললেন, যতক্ষণ না বাস ছাড়ে এখানেই বিশ্রাম নিন। বাস ছাড়লে এখান থেকে বাসে উঠে পড়বেন।
বাস ছাড়ার কিন্তু কোনও লক্ষণ দেখছি না। ভোরবেলা সেই ত্রিশ-চল্লিশ জনের আদিবাসী দলটা গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। জানা গেছে গতকালের সেই বাসটাই যাবে। বাসে গতকালের মতো একেবারে সামনে জায়গা রেখে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি। চায়ের দোকানে গিয়ে খোঁজ করলাম। জানতে পারলাম, একটু অপেক্ষা করে দেখা হবে, যদি ভুখি থেকে কোন প্যাসেঞ্জার আসে। তবে বাস আজ যাবেই, কোন সন্দেহ নেই। গতকাল যখন জীপ খারাপ হওয়ায় হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম, মাধব ও দিলীপের কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম, ওদের বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে। গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী ওদের আর এবার যাওয়ার ইচ্ছা নেই। গতকাল বাসে যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখনও ওরা সেইরকম একটা আভাস দিয়েছিল। যে কারণে আমি সাধু গোছের লোকটাকে যমুনোত্রী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছিলাম। যাতে আমার কথায় ওরা বুঝতে পারে, আমি গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী যাবই। জানি যে, আমাকে ফেলে ওদের পক্ষে ফিরে যাওয়া খুব মুশকিল। ওরা চাইছে আমি নিজে থেকে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবটা পেশ করি। গতকাল হেঁটে হেঁটে ফিরবার পথে দিলীপ আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি কী করব? শুনে ভীষণ রাগ হয়ে গিয়েছিল। মাধব একে ফিরে যাব ফিরে যাব করছে, তার ওপর ও আবার মাধবের সাথে পোঁ ধরেছে। বলেছিলাম, "আমি তোদের মতো অত সহজে ভেঙে পড়তে বা হাল ছেড়ে দিতে শিখি নি। তোরাও তো আসবার সময় বলেছিলি, যতক্ষণ টাকা থাকবে ও শরীর ঠিক থাকবে, ততক্ষণ সবক'টা জায়গা না দেখে ফিরবি না। এখনও পর্যন্ত সব জায়গা সহজ ভাবেই ঘোরা গেছে। এখনও এমন কিছু ঘটেনি, যে এর মধ্যেই ভেঙে পড়ে ফিরে যাবার চিন্তা করতে হবে। আমাদের হাওড়া-কলকাতাতেও মাঝ রাস্তায় বাস খারাপ হলে, সব প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দেওয়া হয়। আর এখানে তো এমন হতেই পারে"। দিলীপ মাধবকে উদ্দেশ্য করে বলল, সে ইন্টারেস্ট পাচ্ছে না। মাধব কী করবে তাও জানতে চাইল। মাধব এবার আমায় জিজ্ঞাসা করল আমি কী করব? আমি সরাসরি উত্তর দিলাম, "এক কাজ কর। আমায় কিছু টাকা দিয়ে, তোরা বরং ফিরে যা। আমার বাড়িতে একটা খবর দিয়ে দিস। আমি শেষ চেষ্টা না করে ফিরব না, আর এটাই আমার শেষ কথা"। চোখের সামনে লঙ্কা, গঙ্গোত্রীর মাইল স্টোন দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি দূরত্ব, মাত্র ঊনচল্লিশ কিলোমিটার। মনে মনে রাগের মাথায় ঠিক করে ফেললাম, ভবিষ্যতে যেখানেই যাই না কেন, দিলীপকে আর সঙ্গে নেওয়া নেই। কোথায় ও এই মুহূর্তে আমার পাশে থেকে মাধবকে মনোবল যোগাবে, উৎসাহ দেবে, তা না, বরং উসকে দিচ্ছে ফিরে যাবার জন্য। মাধবকে খুব ভালভাবে বোঝালাম যে, আর একটু কষ্ট করলে চরম ফল আমরা লাভ করবই। সে যেন একটু ধৈর্য ধরে আমার পাশে থাকে। পরে এ কষ্ট আর থাকবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাধব বলল, আমার সঙ্গে বাকী জায়গাগুলো যেতে রাজি আছে।
মনে মনে বাস ছাড়ার জন্য প্রার্থনা করছি। আজও যদি বাস না যায়, তাহলে ওদের সঙ্গে রাখা সত্যিই কঠিন হবে। অবশেষে অনেকগুলো, প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বস্তা আটা বা ময়দা ও পাঁচ-ছয় টিন ডালডান সত্যিই বাসের ছাদে ও ভিতরে তোলা হল। ওঃ! কী আনন্দ, কী শান্তি যে পেলাম বলে বোঝাতে পারব না। বাসের মুখ ঘুরিয়ে লঙ্কার দিকে করা হল। ড্রাইভার আবার বাস থেকে নেমে চলে গেল। আরও দু'কাপ করে চা শেষ করলাম। অবশেষে বাস সত্যিই ছাড়ল! আজ দেখলাম কিছু প্যাসেঞ্জারও হয়েছে। ড্রাইভারের পাশেই আমি বসেছি। আমার পাশে বাসেরই একজন কর্মী। আমার ঠিক পিছনের সিটে, ড্রাইভারের পিছনে মাধব ও দিলীপ। মাঝেমাঝেই বাসটায় কী রকম একটা বিশ্রী আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ইঞ্জিন বোধহয় বন্ধ হয়ে যাবে। ভয় হল, গতকাল জীপ ঠেলেছি, আজ বাস ঠেলতে হলে আর বাঁচব না। আগে হলুদ রঙের ছিল, বর্তমানে প্রায় কালো রঙের গায়ের মোটা গেঞ্জি ও সোয়েটারটা প্যান্টের ভিতর গুঁজে পরতে হচ্ছে। এই ক'দিনেই কোমর এত সরু হয়ে গেছে যে, তা নাহলে প্যান্ট নেমে আসছে। তিনজনের বাস ভাড়া বাবদ একত্রিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা মিটিয়ে দেওয়া হল। অবশ্য তার জন্য কোনও টিকিট পেলাম না। সেই গিরগিটি, ভেড়া ও ছাগলের পাল কাটিয়ে, গতকালের রাস্তা দিয়ে বাস এগিয়ে চলল। ড্রাইভার অনবরত গিয়ার চেঞ্জ করছে এবং গিয়ারের রডটা বারবার আমার পায়ে বেশ জোরে জোরে আঘাত করছে। বাধ্য হয়ে গিয়ারের দু'দিকে দুটো পা রেখে প্রথম শ্রেণীর সিটে কষ্টেসৃষ্টে বসে আছি। আচমকা গিয়ারের রডটা নীচের দিকে নামাতে আমার হাতে লেগে খানিকটা কেটে রক্ত পড়তে শুরু করল।
হরশিল এসে বাস দাঁড়াল। সেই ত্রিশ-চল্লিশজনের আদিবাসী দলটা এখানে এসে হাজির হয়েছে। একটা গাছে কুলের মতো কী একটা ফল অসংখ্য ফলে আছে। ওরা পাথর ছুড়ে ওগুলো পাড়ছে আর টপাটপ মুখে পুরছে। আমার পাশে বসা বাসের লোকটাও, বাস থেকে নেমে ওগুলো পাড়তে শুরু করে দিল। আমি দুটো ফল চাইতে, সে অনেকগুলো ফল আমার হাতে দিয়ে গেল। টক টক, কষা কষা খেতে। আদিবাসী দলটা এবার ঠিক করল, এখান থেকে এই বাসেই লঙ্কা যাবে। আগে, সকালে এটা ঠিক করলে, এতটা সময় নষ্ট হ'ত না। এত লোকের বাসে জায়গা হবে না - ড্রাইভার জানাল। দু'দিন পরে বাস ছেড়েছে বলেই বোধহয়, আসবার পথে ভালই প্যাসেঞ্জার হয়েছে। ওরা কিন্তু ড্রাইভারের কথায় কান না দিয়ে, বাসের ভিতরে ও ছাদে উঠে পড়ল। পালকির মতো জিনিসটা, বাসের ভিতরে ঢোকানো হল। বাস ছেড়ে দিতেই ভেঁপু, শিঙ্গা, ঢোল, ব্যান্ড পার্টির বাঁশীর মতো দেখতে কী একটা জিনিস, একসঙ্গে বাজাতে শুরু করে দিল। ওই ভিড়ে কানের কাছে শিঙ্গার বীভৎস আওয়াজ, বিড়ির ধোঁয়া, সে এক নরক যন্ত্রণা! এক জায়গায় বাস দাঁড় করিয়ে, ইঞ্জিনে অনেক জল ঢালা হল। ভাগ্য আমাদের খুব ভালই বলতে হবে, নতুন কোনও বিপদ না ঘটিয়ে, বাস লঙ্কায় এসে পৌঁছল। আমরা নামতেই, ডাবরানীর দিকে যাওয়ার জন্য লঙ্কায় যে ক'জন প্যাসেঞ্জার ছিল, তাদের নিয়ে বাস ডাবরানীর উদ্দেশ্যে চলে গেল। শুনলাম কোন বাস বা জীপকে লঙ্কায় থাকতে দেওয়া হয় না, তারাও লঙ্কায় থাকতে চায় না। প্যাসেঞ্জার না পেলেও, এখানে বাস আসার সঙ্গে সঙ্গে ডাবরানী ফিরে যায়। ভয় হল ফিরবার সময় আবার বাস পাব তো? কবে ডাবরানীতে প্যাসেঞ্জার জমা হবে, বা ডালডা, ময়দা ইত্যাদি লঙ্কায় নিয়ে আসা হবে, তবে বাস লঙ্কায় আসবে। আবার বাস আসার শুভ মুহূর্তটাতে আমাদের লঙ্কায় উপস্থিত থাকতে হবে, তা নাহলে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, বাস ডাবরানী ফিরে যাবে। এ এক কঠিন অঙ্ক!
ছোট্ট জায়গা। পরপর দুটো মিষ্টির দোকান-কাম-হোটেল। ভাত, ডাল, তরকারি খেয়ে নিলাম। পালকির মতো জিনিসটাকে কাঁধে নিয়ে ওই দলটাও এদিকে এল। কেউ পয়সা দিয়ে নমস্কার করলে, ঝাঁকিয়ে কাত করে ওই ব্যক্তির বুকে বা মাথায় পালকির মতো মন্দিরটাকে ঠেকানো হচ্ছে। যেন দেবতা নিজেই কাত হয়ে আশীর্বাদ করছেন। এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে ভৈরবঘাঁটির চড়াই পার হতে হবে। শুনেছি খুবই কষ্টকর চড়াই। আস্তে আস্তে পথ চলতে শুরু করলাম। এই মুহূর্তে রাস্তা খুব কষ্টকর বলে মনে হচ্ছে না। তবে ভাত খাওয়ার পরেই হাঁটতে তো একটু কষ্ট হবেই। চারপাশে একই দৃশ্য, এই সব দৃশ্য আর নতুন করে কী দেখব? ক্রমে মালুম পেতে শুরু করলাম, কত কষ্টের এই চড়াই। ধীরে ধীরে একসময় এই চড়াই পার হয়ে, আমরা ভৈরবঘাঁটী এসে পৌঁছলাম। রাস্তার শেষে একটা বোর্ড দেখলাম। তাতে হিন্দীতে লেখা "কষ্টকে লিয়ে ধন্যবাদ"। এ কীরকম তামাশা বুঝলাম না! এত কষ্টের পর, কষ্টের জন্য শুধু শুকনো ধন্যবাদ জানানো! এতদিনে আমাদের প্রতি ভাগ্যদেবতা বোধহয় প্রসন্ন হয়েছেন। ভৈরবঘাঁটী থেকে গঙ্গোত্রীর জীপ শুধু পাওয়াই যায় তা নয়, একটা জীপ কয়েকজন যাত্রী নিয়ে বোধহয় আমাদের জন্যই অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা উঠতেই জীপ ছেড়ে দিল। তিনজনের ভাড়া লাগল, আঠারো টাকা। মাত্র নয়-দশ কিলোমিটার পথ, দেখতে দেখতেই আমরা গঙ্গোত্রী পৌঁছে গেলাম।
একটু ওপরে ট্রাভেলার্স লজে আঠারো টাকা ভাড়ায়, একটা তিন বিছানার ঘর ভাড়া নিলাম। স্থানীয় পান্ডারা অবশ্য তাদের ঘরে থাকতে অনেক অনুরোধ করেছিল। একটু আরামে থাকার আশায় ট্রাভেলার্স লজই বুক করলাম। আমরাই একমাত্র বোর্ডার। তিনটে খাট, গোটা ছয়েক কম্বল দেওয়া আছে। মাধবের আবার সামান্য জ্বর এসেছে। পথে একবারও ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খায়নি। ওকে এক ডোজ ওষুধ খাইয়ে, আমি আর দিলীপ বাইরে এলাম। চারদিকে খুব আরামদায়ক রোদ্দুর। একটু নীচেই বাঁদিকে গঙ্গোত্রী মন্দির। এখান থেকে মন্দিরের পিছন দিকটা দেখা যায়। মন্দিরের সামনে, দূরে বরফ ঢাকা শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। একবারে ডানদিকে সুদর্শন শৃঙ্গ, তার বাঁ পাশে কালো, একটু বাঁকা মতো গণেশ শৃঙ্গ। কয়েকটা ছবি নিয়ে, পোষ্ট অফিসের খোঁজে গেলাম। উত্তরকাশী থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে এনেছিলাম। ছুটি বাড়াতে হবে। ভাবলাম আন্ডার সার্টিফিকেট অফ্ পোষ্টিং করে পাঠাব। মন্দিরের ডানদিকে ব্রিজ পেরিয়ে পোষ্ট অফিস। একটা বেঞ্চে বসে এক ভদ্রলোক পরম নিশ্চিন্তে উল বুনছেন। আর কাউকে দেখলাম না। মনে হয় এই একজনই পোষ্ট মাষ্টার জেনারেল-কাম-পিওন। ছোট্ট অন্ধকার একটা ঘরে অফিস। অপর একটা ঘরে সম্ভবত তাঁর থাকার ব্যবস্থা। তাঁকে দুটো আন্ডার সার্টিফিকেট অফ্ পোষ্টিং এর ফর্ম দিতে বললাম। বললেন, ওই ফর্মের কথা তিনি আগে কখনও শোনেননি, এবং জানেনও না। অনেকভাবে তাঁকে বোঝাবার পর, উল বোনা ছেড়ে অফিস ঘরে ঢুকে, কোনও বার পার্শেল ফর্ম, কোনও বার আবার অন্য কোন ফর্ম নিয়ে আসেন। এতো মহা বিপদ! কোনও ফর্মটাই আমাদের পছন্দ হচ্ছেনা দেখে, তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হলেন। শেষে দুটো ভাঁজ করা, প্রায় পাঁপড় ভাজার মতো মড়মড়ে, লালচে রঙের ফর্ম নিয়ে এসে বললেন, এই দুটো ফর্মই আছে, আর কোনও রকম ফর্ম এখানে পাওয়া যাবে না। এই ফর্ম দুটোই আমাদের প্রয়োজন। রঙ বদলে গেলেও কাজ চলে যাবে। তবে সোজা করে, যাতে ভাঁজ না পড়ে, সেইভাবে যত্ন করে রাখতে হবে। ফর্ম ভর্তি করে ভদ্রলোকের হাতে দিলাম। এবার বললেন, ইংরেজি পড়তে পারেন না। বললাম, আমরা পড়ে দিচ্ছি, দরকার হলে তিনি মিলিয়ে নিতে পারেন। এবার পরিষ্কার জানালেন, এভাবে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে বললাম, আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী, আমাদের সঙ্গে আইডেন্টিটি কার্ড আছে। এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাকটিকিট লাগিয়ে, ওই ডাকঘরের ছাপ মেরে দিয়ে, বাইরের ডাক বাক্সে ফেলে দিতে বললেন। আমরা ডাকবাক্সে চিঠি দুটো ফেললাম কিনা, তিনি সেটাও ঘাড় বেঁকিয়ে লক্ষ্য করলেন। একেই বোধহয় 'জাতে মাতাল, তালে ঠিক' বলে। চিঠি পোষ্ট করে এক চক্করে মন্দির ঘুরে দেখে, ঘরে ফিরে এলাম।
মাধব ঘুমোচ্ছে। গায়ে এখনও জ্বর আছে। আমরাও রেষ্ট নেবার জন্য শুয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে দরজায় কড়া নেড়ে কে একজন আমাদের ডাকতে, খুলে দেখি ট্রাভেলার্স লজের একজন কর্মী। বললেন, "এই তো পাহাড় দেখার সময়, আপনারা ঘরে শুয়ে আছেন"? বাইরে এসে দেখি, সূর্যাস্তের আভা বরফের ওপর পড়ে লাল-হলুদ রঙ ছড়াচ্ছে। ঘর থেকে মাধবকে ডেকে আনলাম। কর্মীটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ওই দৃশ্য উপভোগ করলাম। অন্ধকার না নামা পর্যন্ত ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করল না। ফিরে এসে মাধবকে একা রেখে, টাকা নিয়ে নীচের দোকানে রাতের খাবারের অর্ডার দিতে গেলাম। চা খেয়ে, রাতের পুরী তরকারি ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলে ফিরে এসে দেখি, ঘর অন্ধকার, মাধব দরজা খুলে রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওকে ডেকে দিলাম। লজের লোক একটা হ্যারিকেন দিয়ে গেল। এখানে বিদ্যুৎ নেই। একটু জ্বলেই হ্যারিকেনটা দপ্ দপ্ করে নিভে গেল। দেখলাম হ্যারিকেনে যথেষ্টই তেল আছে। আবার জ্বাললাম। কিছুক্ষণ ভালভাবে জ্বলে, দপ্ দপ্ করে আবার নিভে গেল। বাইরে গিয়ে বাঁ পাশে কর্মীটির ঘর থেকে অন্য একটা হ্যারিকেন বদলে আনলাম। কিন্তু আশ্চর্য, এটাও সেই একই ভাবে নিভে যাচ্ছে। দিলীপকে বললাম হয়তো অক্সিজেনের অভাব। কাচটা খুলে দিয়ে জ্বাললাম, তাতেও কোন লাভ হল না। ঘর অন্ধকার রেখেই চুপ করে শুয়ে থাকলাম। একটু পরে আমি আর দিলীপ আরতি দেখতে মন্দিরে গেলাম। ঘরে ফিরে এসে আবার শুয়ে আছি, খাবার আর দিয়ে যায় না। শেষে নিজেরাই খাবার আনতে যাব বলে তৈরি হচ্ছি, দোকানদার কী একটা পাতা করে একগাদা পুরী তরকারি দিয়ে গেল। তাকে প্রশ্ন করে জানলাম, ওটা ভূজপাতা।
এ রাস্তায় দেখেছি মোমবাতি অনেকক্ষণ জ্বলে। যে মোমবাতি কলকাতায় এক ঘন্টা জ্বলে, সেটা এসব জায়গায় স্বচ্ছন্দে দেড়-দু'ঘন্টা জ্বলবেই। একটা মোমবাতি জ্বেলে, কোনরকমে অল্প কয়েকটা পুরী খেয়ে, বাকীগুলো রেখে দিলাম। মাধবতো মাত্র দুটো পুরী খেল। দিলীপ বলল, আগামীকাল রাস্তায় কাজে লাগবে। আমরা কিন্তু তাতে রাজি হলাম না। ঠিক হল, কাল সকালে নতুন পুরী, তরকারী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে। এগুলোও ফেলে না দিয়ে সঙ্গে রাখা হবে, দরকার হলে কাজে লাগানো যাবে। দোকানদার এতক্ষণ আর কিছু লাগবে কী না জানার জন্য, বসে বসে কথা বলছিল। তাকে সেইমতো অর্ডার দিয়ে, দরজা বন্ধ করে, কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। পান্ডাদের বাড়িতে না থেকে, এখানে উঠলাম একটু আরাম খোঁজার জন্য। কিন্তু বিছানায় এত পিসু, ভাবা যায় না। নাক, কান, গলা সর্বত্র হেঁটে হেঁটে গিয়ে, শরীরের বিশেষ বিশেষ পছন্দের জায়গাগুলো রক্ত চোষার জন্য বেছে নিয়ে, জ্বালিয়ে দিল। হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললে বোধহয় চামড়া বা লোমকূপের সাথে লেপ্টে থাকছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে, পরিবেশ আবার শান্ত হলে, আবার আমাদের মতোই পথ পরিক্রমায় বার হচ্ছে। শুয়ে শুয়ে ঠিক করলাম, আজ এত রাতে আর কিছু করার নেই, তবে ফেরার সময় গঙ্গোত্রীতে থাকতে হলে, এখানে আর নয়। এর থেকে লালাজীর দোকানের পিসুরা অনেক ভদ্র, অনেক নির্লোভ ছিল। এদের আমাকে এত বেশি কেন পছন্দ, এরাই জানে! মাধব আর দিলীপ দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি রাত দুপুর পর্যন্ত পিসু নিধন নিয়ে ব্যস্ত। একবার ঘুম আসে, আবার ওদের অত্যাচারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এইভাবে একসময় রাত কেটে ভোর হল।
আজ ত্রিশ আগষ্ট। ঘুম থেকে উঠে সুদর্শন শৃঙ্গের দর্শন লাভ করলাম। ভোরের আলোয় যেন এক অন্য রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তৈরি হয়ে দোকানে এলাম। চা খেয়ে পুরী তরকারি গুছিয়ে নিলাম, সঙ্গে মাইসোরপাক গোছের একরকম মিষ্টি। জানলাম, কাল রাতে খবর পাওয়া গেছে, গোমুখে হারিয়ে যাওয়া পান্ডা সত্যনারায়ণ প্রসাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু সঙ্গের গোয়ালিয়রের যাত্রীটিকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি। বরফের চাঁই চাপা পড়ে সত্যনারায়ণ পান্ডা মারা গেছেন। কানে খুব কম শুনতেন, বয়স বছর পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন মতো হবে। গোয়ালিয়রের ভদ্রলোকও সম্ভবতঃ মারাই গেছেন। গঙ্গার জলে ভেসে গিয়েই থাকুক বা কোথাও বরফ চাপা পড়েই থাকুক, তাঁকে খোঁজা হচ্ছে। দোকানদার সাবধান করে দিয়ে বলল, এখন বরফ গলার সময়, যেন গোমুখের খুব কাছে না যাই। শুনলাম, এখানকার সব পান্ডারা সত্য নারায়ণের শেষকৃত্য করতে গোমুখ চলে গেছে। খবর শুনে পুলিশ স্টেশনে এলাম। ট্রাভেলার্স লজের পাশেই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার পুলিশ স্টেশনে তালা দেওয়া। শুনলাম সবাই গোমুখ চলে গেছে। ভেবে দেখলাম পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে গেলে, একটা দিন অন্তত নষ্ট। গঙ্গোত্রী ঝেঁটিয়ে সবাই যখন গোমুখ গেছে, তখন আমরা আর পড়ে থাকি কেন? আমরাও সেই একই পথে পা বাড়ালাম। বুকের মধ্যে যেন কেমন একটা ভয় দানা বেঁধে উঠছে, সেটা রাস্তার বিপদের ভয়, না পুলিশের ঝামেলার ভয়, বলতে পারব না। দোকানে দেখা হয়ে গেল ডাবরানী, গরমকুণ্ডে দেখা সেই সাধু গোছের ভদ্রলোকটির সঙ্গে, যিনি আমাদের অভিশপ্ত জীপেও সঙ্গী হয়েছিলেন। জানতে পারলাম তাঁর নাম রামজী। এখানে ভৈরবঘাঁটী থেকে লঙ্কা আসার জীপ ড্রাইভারকেও চা খেতে দেখলাম। জানা গেল, এপথে ওই একটাই জীপ যাতায়াত করে। আমরাও গতকাল ওতেই গঙ্গোত্রী এসেছিলাম। বললাম, আগামীকাল দুপুর নাগাদ এখান থেকে লঙ্কা ফিরব, যদি দয়া করে সেই সময় জীপটা গঙ্গোত্রী নিয়ে আসে, তাহলে খুব ভাল হয়। জানাল, লঙ্কা থেকে গঙ্গোত্রীর প্যাসেঞ্জার না পেলে সে গঙ্গোত্রী আসে না। তবু আমাদের অনুরোধে এখানে জীপ নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। এখান থেকে লঙ্কা যেতে, বা লঙ্কা থেকে ডাবরানী যেতে প্যাসেঞ্জারের অভাবে যাতে অসুবিধায় পড়তে না হয়, তাই রামজীকেও অনুরোধ করলাম আগামীকাল আমাদের সঙ্গে লঙ্কা ফিরতে।
এবার এগোনোর জন্য উঠে পড়লাম। দোকানদার ও স্থানীয় কিছু পান্ডা আমাদের যাত্রার শুভ কামনা জানাল। আমরা ফিরে না আসার দেশ, গোমুখের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। ভ্রমণ কাহিনি ছাড়া গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লিখতে ভালো লাগলেও এই প্রথম কোনও পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠানো। 'আমাদের ছুটি' পত্রিকার নিয়মিত লেখক, পাঠক, সমালোচক এখন নেমে পড়েছেন কীবোর্ডে-মাউসে সহযোগিতাতেও।