এভারেস্ট বেস ক্যাম্প - পথের ডায়েরি
শুভজিত চৌধুরী
~ তথ্য- এভারেস্ট বেসক্যাম্প ট্রেক ~ || ~ এভারেস্ট বেসক্যাম্প ট্রেকিং-এর আরও ছবি ~ || ~ এভারেস্ট বেসক্যাম্প ট্রেকরুট ম্যাপ ~
এভারেস্ট - নামটার মধ্যেই যে কি এক চৌম্বক শক্তি লুকিয়ে আছে কে জানে! পৃথিবীর পর্বতপিপাসু সব মানুষের কাছেই হিমালয়ের এ মুকুট যেন নয়নের মণি। এহেন পর্বতশৃঙ্গের পাদমূল স্পর্শ করতে পারা যে কী আনন্দের তা বলে বোঝানোর নয়। অথচ স্বপ্ন যে সত্যি এভাবে সফল হবে তা ভাবতে পারিনি। স্বপ্ন দেখছি অবশ্য সেই ২০০৯ থেকে। ট্রেক করতে যাওয়ার উপযুক্ত সময়, আনান্ খুঁটিনাটি, অফিসের ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ খবর সেরে ঠিক করলাম ২০১৪-এর শেষে যাব। সঙ্গী হবে আমার মামাতো ভাই শান্তনু।
নেপালের প্রচুর ট্রেকিং এজেন্সি থেকে একটা ঠিক করলাম – আমাদের কাঠমান্ডু থেকে লুকলা যাওয়া ও আসার বিমানের টিকিট কাটা, TIMS Card ও বাকি এন্ট্রি ফি দেওয়া, একজন গাইড সঙ্গে দেওয়া যে আমাদের সঙ্গে থেকে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করিয়ে দেবে আর মালবাহক যোগাড় করা। যাওয়ার দিন স্থির হল পয়লা নভেম্বর। ব্যবস্থা যখন সব প্রায় পাকা সেসময় সুদূর কানাডায় থাকা ছোটমাসির ছেলে গৌরব আমাদের সঙ্গী হবার জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে গেল। মেনে নিলাম।
১ নভেম্বর – কলকাতা - কাঠমান্ডু
বেলা দেড়টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের কাঠমান্ডুগামী ফ্লাইট। কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের ছোট টার্মিনালের ভিড় ঠেলে ব্যাগ নিয়ে প্রি-পেড ট্যাক্সি ধরে পৌঁছলাম থ্যামেল অঞ্চলে একমে গেস্ট হাউসে, সন্ধ্যে ছ'টায়। গৌরব সেখানে একদিন আগে এসে আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। হোটেলের রিসেপশনে কাগজে সাঁটা রয়েছে লোডশেডিং-এর সময়সূচি! কিন্ত সেদিন কী ভাগ্যিস আলো নেভেনি থ্যামেল অঞ্চলে। কাজ ছিল বেশ কিছু। রিসেপশনেই আমাদের সঙ্গে দেখা করল এজেন্ট দেভেন্দ্র। পরিচয় করাল গাইড রমেশ এর সঙ্গে, যে কিনা পরদিন থেকে আমাদের সঙ্গী। ভোরবেলায় আসবে পিক-আপ করতে। পরের কাজ হল কাছের এ টি এম থেকে নেপালি টাকা তুলে নেওয়া এবং স্লিপিং ব্যাগ আর ডাউন জ্যাকেট ভাড়া করা। এয়ারপোর্ট-এর বাইরে আসার পর থেকে সব জায়গায় ওয়াইফাই-এর সুবিধা পাচ্ছিলাম ফলে বাড়িতে খবর দেওয়ার কাজটা হয়ে গিয়েছিল।
২রা নভেম্বর: কাঠমান্ডু – লুকলা – ফাকডিং – মঞ্জো
চারটেয় উঠে তৈরি হয়ে ট্যাক্সি ধরে ত্রিভূবন এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক টার্মিনালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। লুকলা পৃথিবীর প্রথম দশটি বিপজ্জনক এয়ারপোর্টের মধ্যে পড়ে। সকালের পরিষ্কার আবহাওয়ায় ঝুঁকি কিঞ্চিৎ কম ফলে চাহিদা বেশি। ছ'টায় গেট খোলার পর দেখা গেল কেউ যেন লাইন মেনে চলার ধার ধারছে না। সাহেব-মেমসাহেবরাও দেখলাম ঠেলাঠেলি আর গুঁতোগুঁতি করে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বোর্ডিং পাস দেখে বুঝলাম এযাবৎকাল দেখা কোনো বোর্ডিং পাসের সাথে মিল নেই। ফ্লাইট নম্বর, সময় বা গেট নম্বরই লেখা নেই। সেখানে সিট নম্বরের প্রশ্নই ওঠেনা।
লুকলার ফ্লাইট খেলনা প্লেনের মত দেখতে। পনেরো আসনের ছোট ডর্নিয়ার প্লেন। দৌড়ে সবার আগে লাইন দিলাম। প্লেনের বাঁদিকের সিট দখল করাই লক্ষ্য। সেদিকেই নেপালের উচ্চ হিমালয়ের শৃঙ্গগুলির সারি স্পষ্ট দেখা যায়। পঁচিশ মিনিটের ছোট্ট সফর শেষে পাহাড়ের ফাঁক গলে একটা মাথা কাটা পাহাড়ের ঢালু চ্যাটালো রানওয়েতে প্লেনটা সহজেই নেমে পড়ল। যাক, এপিঠের যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন!
লুকলার তেনজিং-হিলারি এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে চোখ মেলতেই দেখি কুসুমক্যাং (৬৩৬৯ মি )। এয়ারপোর্ট থেকেই হাঁটা শুরু। একটু এগোতেই লুকলার সবচেয়ে প্রাণময় অঞ্চলে পৌঁছলাম। পাথরের রাস্তার দুপাশে সার বেঁধে দোকান। কোনও কিছুরই অভাব নেই। লুকলার ফ্লাইটে অনেকেরই পেট ভর্তি থাকলে বমির উদ্রেক করে। আমরা সে সম্ভাবনাই রাখিনি। এবার খেয়ে এগোনো হবে। ব্রেকফাস্ট সারার জন্য এক লজে ঢোকা হল। লুকলায় পৌঁছনোর পর থেকেই জিনিসপত্রের দাম সম্বন্ধে যাবতীয় আন্দাজ ওই খাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। এখানে সভ্য জগতকে বাঁচিয়ে রাখতে যা প্রয়োজনীয়, সমস্ত খাদ্যসামগ্রী সবই হয়ত ওই ফ্লাইটে করে এসেছে অথবা মোটবাহকেরা কয়েকদিন ধরে হেঁটে নিয়ে এসেছে। এরপর যত ওপরের দিকে ওঠা হবে ততই পাল্লা দিয়ে দামও চড়বে। ২০০ টাকায় ডবল ডিমের ওমলেট খেয়ে রমেশের ঠিক করা পোর্টার দুজনকে রুকস্যাক দিয়ে যে যার ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
আজ মোটামুটি পুরোটাই উতরাই। গন্তব্য – ফাকদিং (২৬৫২ মিঃ)। পাথর বসানো এবড়ো-খেবড়ো ভিজে রাস্তা। এদিকটায় গাছ-গাছালি বেশি। সূর্যের রোদ সব জায়গায় সরাসরি পড়ে না। গল্প করতে করতে হাঁটছি। উলটো দিক থেকে প্রচুর লোক ফিরছে। দুধকোশী নদীকে বাঁ দিকের খাদে রেখে চেপলুং, চৌরিখারকা এসব গ্রাম ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি। এখানে একই নামের গ্রাম পরপর বেশ কয়েকটি, আর তাদের নামের শেষে রয়েছে ১,২,৩ করে নম্বর। মানে যে গ্রাম সবচেয়ে নীচে সেটা চৌরিখারকা ৬, পরের গ্রাম চৌরিখারকা ৫ এভাবে কমেছে। প্রায় সব গ্রামেই থাকার লজ আছে, বাইরেটা পরিস্কার আর সুন্দর করে সাজানো। ঘন্টাখানেক চলবার পর লোহার সরু ঝুলন্ত সেতু এল যা চওড়া নদীখাতের দুপ্রান্তের পাহাড়কে ৭০/৮০মি দূরে জুড়েছে। বেলা প্রায় সাড়ে এগারটা নাগাদ প্রথম চড়াই পথের সম্মুখীন হলাম। এরপর কখনও ওঠা কখনও নামা। ফাকডিং পৌঁছে গেলাম সাড়ে বারটায়। ছবির মত সুন্দর গ্রাম ফাকদিং। নভেম্বরেও রয়েছে ফুলের বাহার। ঠিক হল শুধু বিশ্রামের জন্য না থেমে এখানে লাঞ্চ সেরে নিয়ে এগোব মঞ্জো পর্যন্ত। টোকটোক, বেনকার ইত্যাদি গ্রাম ছাড়িয়ে প্রায় চারটে নাগাদ আমরা পৌঁছলাম ছুমুয়া বলে একটা জায়গায়। ট্রেকারদের TIMS Card নেওয়ার এখানেই শেষ সুযোগ। আমাদের এজেন্টের মাধ্যমে আগেই একাজ সেরে ফেলা ছিল। ছুমুয়া থেকে আরও মিনিট পনেরো হেঁটে আমরা মঞ্জো-তে শেরপা লজে সেদিনের মত যাত্রায় বিরতি নিলাম। এখানেই রাত্রিযাপন। নেপালের খুম্বু অঞ্চলে প্রথম রাত। ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগে। প্রথম দিনের ধকল ভালই গেছে। ফাকদিং অবধি আট আর তারপরে আরও প্রায় চার, সবমিলিয়ে মোট বারো কিমি হেঁটে মঞ্জো (২৮১৪মি) এসেছি। রাত আটটায় নেপালি ডাল-ভাত খেয়ে ঘরে গিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
নভেম্বর ৩, মঞ্জো – নামচেবাজার
ব্রেকফাস্ট সেরে সাতটায় বের হলাম। আজকের গন্তব্য নামচে বাজার। মিনিট দশ হাঁটতেই পৌঁছলাম জোরসালে-তে, সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্কের গেটের সামনে। এখানে এন্ট্রি ফি দিতে হয়। জোরসালে-র গেট দিয়ে ঢুকেই সিঁড়ি ভাঙা উৎরাই। প্রায় পরপর দুটো সেতু পার করে আবার দুধকোশীর বাঁ ধার দিয়ে চলেছি। অনেকক্ষণ একটানা নদীর ধার বরাবর বোল্ডার পেরিয়ে হাঁটা।
সেতু পেরিয়ে যখন উল্টোদিকের পাহাড়ে সরু রাস্তা বরাবর পাক খেয়ে উঠছি তখন বেলা সবে ন'টা, কিন্তু রোদের তাপ ও ঝাঁঝ বেশ। এক ঘণ্টা পর চ্যাটালো একটা একফালি জায়গায় পৌঁছলাম। দেখলাম আগে থেকেই চার-পাঁচজন পৌঁছে বেশ একটা হৈহৈ করছে। ব্যাপার কী? আসলে এখানে পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে এভারেস্টকে প্রথমবারের জন্য দর্শন করা যাচ্ছে। সবার আনন্দ তাই আর ধরে না! এবার ধুলোজড়ানো মেঠো চড়াই ভেঙে আমরা এগোতে থাকলাম। সাড়ে এগারটার পর একটা বাঁক পেরোতেই চোখের সামনে নামচে বাজার। কী সুন্দর গ্রামের গড়ন। অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের ঢাল উঁচু হয়ে পেছনের দিকে উঠে গেছে অনেকখানি। সোলোখুম্বু অঞ্চলে শেরপাদের রাজধানী এই নামচে। আস্তানা হলিডে নামচে। খিদে ভালোই পেয়েছিল, আগে ঢুকে গেলাম ডাইনিং রুমে। খাবার অর্ডার করে বাইরের দিকে চেয়ে দেখতেই কথা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কাঁচের জানালার ঠিক বাইরেই হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে বিশাল কাংটেগা (৬৭৮২ মিঃ)-কে ।
হাল্কা বিশ্রাম সেরে বেরোলাম নামচে অঞ্চলটা ঘুরে বেড়ানোর জন্য। হরেক রকম দোকান। পাশেই ব্যাঙ্ক, এ টি এম,পাব, ক্যাফে, কফিশপ, সাইবার ক্যাফে আরও কত কি! স্যুভেনির শপ, ট্রেকিং-এর জিনিসপত্রের, অন্যান্য পোশাক, নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদি খানার দোকানে ঠাসা জমজমাট বাজার। সকালের ঝকঝকে আবহাওয়া আর নেই। নিয়ম মেনে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে বেলা দুটোর পর থেকেই আর সঙ্গে বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া। ঘন্টাখানেক এদিক সেদিক ঘুরে বেলাটুকু কাটিয়ে সস্তার ইন্টারনেট-এর খোঁজ করতে করতে এক দিদির দোকানের সন্ধান পেলাম। অনেক ঝুলোঝুলির পর মোবাইলে ওয়াইফাই ব্যবহার করতে দিলেন ১০০ টাকায় আধ ঘন্টা। বাড়িতে খবর দেওয়া নেওয়া হল। নামচের পর যোগাযোগ বেশি রাখা খরচসাপেক্ষ। সন্ধ্যের পর হোটেলের ডাইনিং হলে নানা দেশের মানুষের ভিড়, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে আড্ডা চলল ডিনার পর্যন্ত।
নভেম্বর ৪ - নামচেবাজার
প্ল্যান অনুযায়ী দিনটা আমাদের অ্যাক্লেমাটাইজ করে কাটানোর কথা। আর সেটার জন্য নামচের পেছনের দিকে পাহাড়ে খুঞ্জুং-এ থাকবার কথা। কিন্তু আমরা সেটা পালটে ওই গ্রাম ঘুরে নামচে ফিরে আসব স্থির করলাম। মেজাজে চলেছি কংদে রি (Kongde Ri), কাংটেগা (Kangtega), থামসেরকু (Thamserku) ইত্যাদি পিক আর পাখির ফটো তুলতে তুলতে। সিয়াংবোচে এয়ারস্ট্রিপ পার করে খয়েরি হয়ে যাওয়া ঘাসের ঢালু ময়দান-এর দু'পাশে রডোডেনড্রনের-এর সারি। তারই ফাঁকে কখনও নীলটাভা, কখনও গ্রসবীক বা অ্যাক্সেন্টর-এর দেখা মিলছে।
এভারেস্ট ভিউ হোটেল থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেক এগিয়ে গিয়ে যে জায়গায় পৌঁছলাম সেখান থেকে ভিউ অসাধারণ। ছবি তুলে আশ আর মেটে না। বাঁদিকে ঘন বনের মধ্যে দিয়ে পথ বেঁকে নেমে গেছে খুন্দের দিকে। সেদিকেই পা বাড়ালাম। অল্প এগোতেই নজরে এল বিস্তীর্ণ উপত্যকা, যেখানে খুন্দে গ্রামের অবস্থান। খুন্দে-খুমজুং আয়তনে বোধহয় নামচের পরেই। এডমন্ড হিলারি অকৃপণ হাতে দান করে গেছেন এই গ্রামকে। খুন্দের বাসিন্দারা তার প্রতিদানে হিলারিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রতি বিন্দুতে – স্কুল, রাস্তা, সাইবার ক্যাফে, মুদির দোকান, সর্বত্রই তাঁর নাম ছেয়ে আছে। এমনকী গ্রামের একটু বাইরে একটা চোর্তেনও তাঁর নামাঙ্কিত।
হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সারলাম। গৌরবের ফেরা ইস্তক মাথা যন্ত্রণা করছে, সঙ্গে অল্প কাশি। একটু বাদে জ্বরও এল। কানাডায় যতই ঠাণ্ডা পড়ুক, হিমালয়ের শৈত্য আর এই উচ্চতা দুইই ওকে কাবু করেছে।
নভেম্বর ৫ - নামচেবাজারে আরও একদিন
এদিন এগোনোর চিন্তা ত্যাগ করতে হল। মানসিকভাবে চাঙ্গা হলেও গৌরবের শরীর ট্রেকিং এর জন্য পুরোপুরি ফিট নয়। এগারো কিমি হেঁটে আরও উচ্চতায় যাওয়ার প্রশ্নই নেই। আমাদের হাতে যে অতিরিক্ত একদিন ছিল, খারাপ আবহাওয়া বা অন্যান্য অসুবিধার জন্য, সেটা আজই খরচ হয়ে গেল। এরপর আমাদের আর ঢিলে দেওয়ার সুযোগ নেই। ঠিক হল রমেশ গৌরবকে নিয়ে স্থানীয় মেডিকাল সেন্টারে ডাক্তার দেখাবে। আমরাও বসে না থেকে বেরোলাম পাখির খোঁজে। কালকে ইউরেশিয়ান আর হিমালয়ান গ্রিফন-এর দুটো দলকে আকাশে চক্কর কাটতে দেখেছিলাম। ছবি তোলা হয়নি।
গতকালের রাস্তাই ধরলাম। কিন্তু আশ্চর্যের কথা কাল যা যা দেখেছিলাম তার ছিঁটেফোঁটাও নজরে এলো না। প্রায় ঘণ্টা দুই ব্যর্থ ঘোরাঘুরির শেষে পথ বদল করে শেরপা কালচারাল মিউজিয়ামে পৌঁছলাম। পাশেই ফটো এবং আর্ট গ্যালারি। দিব্যি জায়গা। লাকপা সোনাম শেরপা নামক ফটোগ্রাফারের ধৈর্য, অধ্যাবসায় ও দক্ষতাকে কুর্নিস। তিনি সম্ভবত এ অঞ্চলের প্রতিটি চূড়া আরোহণ করে সেখানে বিভিন্ন ঋতু ও সময়ে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে তুলে বড় আকারে প্রিন্ট করে এক্সিবিশনের জন্য সাজিয়ে রেখেছেন। ফটোগুলো দেখেই প্রশংসা করার আগে মাথায় প্রশ্ন আসে –"তুলল কি করে?" ফটোর ফটো তুলে আর বাকি স্যুভেনিরের আকাশছোঁয়া দাম শুনে ফেরার রাস্তা ধরলাম।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে বুঝলাম জায়গাটায় এসে ভুল করিনি। মিনিটখানেকের মধ্যেই বেশ কিছু রেডস্টার্ট, বিভিন্ন টিট, ফুলভেট্টা, চুঘ ইত্যাদির দর্শন পাওয়া গেল। দশ মিনিট হেঁটে যে জায়গাটায় পৌঁছলাম সেখানে তখন আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। আর রয়েছেন হাতে ভারত, নেপাল আর ব্রিটিশ অভিযানের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তেনজিং নোরগের বিশাল স্ট্যাচু। ব্যাকগ্রাউণ্ডে সার দিয়ে আমাদাবলাম, লোৎসে আর সাগরমাথা! মজার ব্যাপার গতকালের এভারেস্ট ভিউ হোটেলের থেকে দেখা দৃশ্যপট অবিকল আবার চোখের সামনে। দূরে নজর করলে থিয়াংবোচে-কেও দেখা যাচ্ছে, যেখানে আজ যাওয়ার কথা ছিল।
ফিরে এসে গৌরবের সাথে কথা বলে বুঝলাম বুকে সর্দি জমেছে। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন বটে কিন্তু আদৌ ও এরপর এগোতে পারবে কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। এদিকে আমাদের আর অপেক্ষা করার মত দিন নেই।
নভেম্বর ৬ - নামচে থেকে ডেবুচে
প্ল্যান মাফিক চলা শুরু হল, গন্তব্য থিয়াংবোচে বা থেংবোচে। পোর্টাররা আগে যাচ্ছে। আমি আর রমেশ কথা বলতে বলতে ওদের পরে চলেছি। শান্তনু আর গৌরব সবার শেষে। তিন রাত নামচে-তে থাকার ফলে অ্যাক্লেমাটাইজেশনটা ভালই হয়েছে। খুন্দের দিকের টানা চড়াই এদিকে নেই, অপেক্ষাকৃত ঢালু পথ পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়েছে। গ্রাম ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গা পেরোতেই ডানদিকে রাস্তা থেকে নীচুতে দেখলাম একজোড়া হিমালয়ান মোনাল! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সংবরণ করলাম। এভারেস্ট এর মতই মোনাল দেখবার সাধ ছিল অনেকদিন। যদিও দূরে থাকায় ক্যামেরায় ভাল ছবি তোলা গেল না, কিন্তু সঙ্গের বাইনোকুলারে তার রঙের ছটায় অভিভূত হয়ে পড়লাম। একটু বাদে খেয়াল হল শান্তনু ও গৌরব ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। গৌরবের শ্বাসকষ্ট দেখে রমেশের সঙ্গে আলোচনায় স্থির হল ওকে নামচেতে ফেরত পাঠানো হবে। একজন কুলি - ঈশ্বর, সঙ্গে থাকবে। রমেশ ওকে পৌঁছে দিয়ে পরদিন রওনা হবে। ডিংবোচে-তে একদিন বিশ্রামের জন্য রাখা আছে। সেদিন ও দলে ফের যোগ দেবে। অন্য কুলি দুর্গাকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব থিয়াংবোচের দিকে। গৌরবের সঙ্গে টাকা, এ টি এম কার্ড, নেপালি সিম কার্ড সহ ফোন, ওষুধ ইত্যাদি দিয়ে ভগ্নহৃদয়ে দল ভাগ করে দুদিকে যাত্রা শুরু করলাম। এদিকে বেলা অনেক গড়িয়ে গেছে। দুপুরের মধ্যে আমাদের পৌঁছনো উচিত ছিল। সুতরাং দুর্গা বেশ তাড়া লাগাতে শুরু করল। রমেশ ভালই ইংরেজি জানে বলে কথাবার্তা সহজে হচ্ছিল, কিন্তু দুর্গা শুধু "থ্যাঙ্ক ইউ" টাই জানে বোধহয়। যে কথাই বলি- উত্তর আসে শুধু থ্যাঙ্ক ইউ তেই। "আর কতদূর" - থ্যাঙ্ক ইউ , "ইংরেজি বুঝতে পার?" - থ্যাঙ্ক ইউ, "রমেশ আমাদের থাকার ব্যাপারে কি বলেছে?" - থ্যাঙ্ক ইউ । মহা জ্বালা!
প্রায় চল্লিশ মিনিট উৎরাই শেষে পৌঁছলাম ফুঙ্গি থাঙ্কা (৩২৫০মি)। নামচের প্রায় ২০০ মিঃ নীচে। এরপর পুরোটাই চড়াই, কারণ থিয়াংবোচে ৩৭০০ মিঃ-এ। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে চকোলেট ও জলপান শেষে যাত্রা শুরু। এতক্ষণ পথে বিভিন্ন জায়গায় জলের প্রাচুর্য থাকায় আমাদের ধারণা ছিল এর পরেও সেটার অভাব হবে না। সুতরাং অতিরিক্ত জল বয়ে নিয়ে চলা অর্থহীন। এই সিদ্ধান্ত যে আমাদের কতবড় ভুল তা কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম। ফুঙ্গি থাঙ্কায় দুধকোশীর ওপর পুল পেরোনোর পর রাস্তা মনে হল আকাশে উঠে গেছে। ওপরের দিকে তাকালে শেষ খুঁজে পাওয়া যায়েনা। হাঁটতে শুরু করলাম মহা উদ্দ্যমে। তবে তা খুব বেশিক্ষণ চলল না। প্রথম দিকে আমরা পনেরো মিনিট উঠে একবার করে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। দু'তিনবারের পরেই দেখা গেল অতি ঘন ঘন দাঁড়াচ্ছি। ওদিকে দুর্গার অবস্থাও ভাল না। আমাদের দুজনের রুকস্যাকের ওজন পঁচিশ কেজি হবে, সেটা নিয়ে ও উঠছে। ফুঙ্গি থাঙ্কা সেতু পেরিয়ে হাঁটা শুরু করেছি বারটা থেকে। বেলা দেড়টার পর দম আর জল দুটোই একদম ফুরিয়ে এল। এদিকের রাস্তায় অনেকটা বড় বড় পাথরের ধাপ খাড়া উঠে গেছে। যদিও সে ধাপ মানুষের হাতে বানানো নয়। ভীষণ পাথুরে, আর সঙ্গে ধুলো-কাঁকরের মিশ্রণ, একটু পা ফসকালেই নুড়ি- কাঁকরে হড়কে যায়। এই ধরণের পথে চলতে সময় বেশি লাগে, কষ্টও হয় বেশি। ক্রমে বিশ্রামের মধ্যে ব্যবধান পাঁচ মিনিট হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেরাই ভাবছি এরকম চললে কখন পৌঁছব? গায়ের জামা ঘামে ভিজে একসা হয়েছে। শরীর থেকে জল বেরিয়ে গিয়ে খুব দুর্বল লাগছিল। পথে একবার কয়েকজন রাশিয়ান অভিযাত্রীদের কাছ থেকে জল চেয়ে খেতে বাধ্য হলাম। ইতিমধ্যে দুর্গা আমাদের পেরিয়েছে। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে এই নেপালি কুলিরা কি অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। দুর্গার শরীরের ওজন মেরে কেটে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ কেজি হবে। পিঠে আমাদের পর্বত প্রমাণ দুটি রুকস্যাক নিয়ে যখন চলছে তখন তাকে প্রায় দেখাই যায় না। কিন্তু প্রবল শারীরিক সক্ষমতায় একবার হাঁটা শুরু করলে পনের-কুড়ি মিনিটের আগে থামে না। দুর্গার মত এরকম অনেক পোর্টারকে দেখে মনে হয় এক্ষুনি হয়ত শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে যাবে নয়ত মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু আমাদের সমতলের শহুরে ধারণায় জল ঢেলে ওরা এগিয়ে চলে, আমাদেরই জন্য, আমাদেরই মাল বহন করে।
রাস্তায় জানতে পারলাম থিয়াংবোচে-তে থাকবার জায়গা হাতে গোনা । অর্থাৎ দেরি করে গিয়ে পৌঁছলে থাকবার জায়গা নাও পাওয়া যেতে পারে! তখন উপায়? উত্তর এল – যেতে হবে হয় ডেবুচে নয়ত প্যাংবোচে। থিয়াংবোচে থেকে দু-তিন কিমি উৎরাই নামলে ছোট গ্রাম ডেবুচে। সেখানে গুটিকয়েক থাকবার জায়গা। না হলে যেতে হবে প্যাংবোচে। কিন্তু তা আরও তিন ঘন্টার দূরত্বে। শুনে আমাদের আত্মারাম বুকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। গত এক ঘন্টায় উলটো দিক থেকে আসা যাকেই জিজ্ঞাসা করেছি , "থিয়াংবোচে আর কতদূর" , উত্তর এসেছে "এই তো আর একটু"। চড়াই ভাঙতে ভাঙতে থাই-এর পেশীগুলো যেন আড়ষ্ট, আর কাজ করতেই চাইছে না। দুজনেই পা টেনে টেনে এগোচ্ছি। ক্ষিদের চোটে চকলেট খেয়েছি কিন্তু তাতে তেষ্টা বেড়েছে। একটা করে খাড়া বাঁক টপকাই আর মনে হয় এবার বুঝি শিখর দেখতে পাব। কিন্তু কোথায় কী?
বেলা আড়াইটে বাজল। আর কেউ পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে না। হয়ত আমরাই সবার পেছনে। আমাদের জন্য কোন ঘর ফাঁকা থাকবে কি? উঠতে উঠতে হঠাৎ দেখি দুর্গা হাত পা নেড়ে ডাকছে। বেশ উত্তেজিত। ব্যাপার কী? চেঁচিয়ে কথা বলার সাহস বা শক্তি কোনটাই নেই, তাও আবার দুর্গার সঙ্গে! কোনরকমে কাছে এগিয়ে দেখি একটা ঝরনা। ঠাণ্ডা জলধারা বয়ে চলেছে। খাওয়ার যোগ্য তো? দুর্গা ইশারা করতেই বোতলে ভরে আকন্ঠ পান করলাম। শরীর একটু জুড়োতেই উদ্যম ফিরে এল। আশার কথা, একদম কাছেই এসে পড়েছি থিয়াংবোচের। সত্যিই আর দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। কিন্তু থাকার জায়গা আছে তো? সময় নষ্ট না করে দুর্গা খোঁজ নিতে চলে গেলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বোঝালো আশঙ্কাটাই সত্যি হয়েছে। সুতরাং না দাঁড়িয়ে চল ডেবুচে।
আকাশে মেঘ জমছে। মনেও দুশ্চিন্তার মেঘ। ডেবুচের দিকে সবে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ দেখি পেছনে বেশ কিছু ট্রেকারের ভিড়। সবাই ডেবুচের দিকেই আসছে। অর্থাৎ এরাও থাকবার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। ঠিক করলাম যেমন করে হোক এই দলটার আগে আমাদের পৌঁছতেই হবে। চারদিকে আমাদাবলাম, কোয়াং দে, থামসেরকু, লোৎসের মত পিক, বিখ্যাত থিয়াংবোচে মনাস্ট্রি , শরীরের ক্লান্তি ও খিদে – সব কিছুকে উপেক্ষা করে আমরা প্রায় দৌড়ে নামতে শুরু করলাম। দুদ্দাড়িয়ে পনেরো-কুড়ি মিনিটেই পার করলাম পথটা। লজে পৌঁছে পরের আধঘন্টায় একটু ফ্রেশ হয়ে একবাটি করে স্যুপ খেয়ে যখন খালি পায়ে লজের সামনের ঘাসে পায়চারি করছি তখন কোথায় ক্লান্তি আর আশঙ্কা। সব দূর হয়ে গিয়ে শুধুই মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকা।
দিন শেষের সূর্য চোখের সামনে আসতে আসতে পশ্চিমের শৃঙ্গগুলির পেছনে বিদায় নিল। সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা লাফিয়ে নামতে লাগল। কাঁপতে কাঁপতে ডাইনিং রুমে হিটারের পাশে জড়ো হলাম। সেখানে ততক্ষণে জমায়েত হয়েছে লজের সব ট্রেকার। গা ঘেঁষাঘেষি করে বসে সবাই হিটারের উত্তাপ থেকে নিজেকে সেঁকে নিচ্ছে। আলাপ হল সকলের সঙ্গে – কেউ শিক্ষক, কেউ শেফ, কেউবা আমার মতো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। পাহাড়ের প্রতি অমোঘ আকর্ষণে সবাই একই পথের পথিক।
নভেম্বর ৭ - ডেবুচে,প্যাংবোচে, সোমারে, ডিংবোচে
সকালে ঘুম ভেঙে উঠে পরিস্কার আকাশে, বরফ মাখা পাহাড়চূড়োয় সূর্যের আলো দেখেই গতকালের কষ্টের কথা একেবারে ভুলে গেলাম। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাড়ে সাতটায়। ডেবুচে এবড়োখেবড়ো চ্যাটালো জমির ওপর জঙ্গলে ঢাকা গ্রাম। দুপাশে নানা আকারের রডোডেনড্রন ,বার্চ, জুনিপার, পাইন ও অন্যান্য গাছের ঘন জঙ্গল। পাতা প্রায় সব গাছেই কমে এসেছে এই নভেম্বরে, তবু সবজে আভা রয়ে গেছে চারপাশে। প্রায় মিনিট পঞ্চাশ চলার পর পথ নীচে নেমে গেছে ইমজে খোলার বুকে। বড় বড় পাথরের আড়ালে দূরে একটা সাঁকো পার করে আবার পথ এসে উঠেছে প্রায় সমান উচ্চতায়। ওদিকে নদীর বুক থেকে যেন আমাদাবলাম সোজা উঠে গেছে আকাশের দিকে। দুপাশের পাহাড়ের আড়ালে আর কোন বরফঢাকা উঁচু শৃঙ্গ চোখে পড়ছে না। সাঁকো পার হবার খানিক আগে জোরে হাওয়া বওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখি রকফল হচ্ছে – পাহাড়ের গা বেয়ে পাথর ঝরে পড়ছে। একটু অপেক্ষা করে দ্রুত বড় বোল্ডার পার হয়ে, সাঁকো পার করে পাহাড়ের অপর ঢালে পৌঁছলাম। এই চড়াইটার শেষে গুম্ফার তোরণের মত একটা দ্বার পেরিয়ে দেখি পথ সমান হয়েছে। এর পর প্রায় মিনিট কুড়ি পথ চলে, সকাল থেকে প্রায় দু'ঘন্টা একটানা এসে প্যাংবোচে পৌঁছলাম। কাল ডেবুচেতে থাকার জায়গা না পেলে হয়েছিল আর কি! আজ সকালের তরতাজা শরীরে দু'ঘণ্টা লেগেছে, সেখানে কাল এলে কী হত আর ভেবে লাভ কী?
প্যাংবোচের অসাধারণ সৌন্দর্যের কথা বইতে পড়েছিলাম। গ্রামখানি বেশ বড়। শীতের ঠিক আগে লালচে হয়ে যাওয়া পাতা ভরা গাছে অদ্ভুত রঙের ফুলঝুরি। ৪০০০মি উচ্চতার এই গ্রামে থাকার জায়গা অনেক। প্রায় সব বাড়ির সামনেই সুযোগ সুবিধার বহর সাইনবোর্ডে লেখা - ওয়াইফাই, ঘোড়া ভাড়া, হেলিকপ্টার সার্ভিস, অক্সিজেন, টেলিফোন, ব্যাটারি রিচার্জ, মেমরি কার্ড – কী নেই! আরও দেখলাম গ্রামের নামের আগে খুমজুং - ৭ লেখা আছে। আমাদাবলাম এখানে ডান দিকে অনন্য মুহূর্ত তৈরি করছে প্রতি ক্ষণে। তার সঙ্গে লোৎসে সার ও পেছনে উঁকি মারা এভারেস্ট পিরামিড। সামনে ভাল করে নজর করলে সোমারে গ্রামকেও দেখা যায়। না থেমে এগিয়ে চললাম।
সোমারে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা বেশি বাড়েনি। কিন্তু দশটা বাজতে না বাজতেই বেশ খিদে পেয়ে গেছে। আগের দিনের ভুল আর না করে প্রথম খাবারের দোকানে ঢুকেই অর্ডার করে ফেললাম। কিছুক্ষণ ফাঁকা সময় পাওয়া গেল ভেবে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় ছোট কোন পাখির তীক্ষ্ণ কিন্তু চাপা আওয়াজ পেয়ে সন্তর্পণে এগোলাম। ভাবিনি এখানে আসে পাশে প্রচুর ব্ল্যাক ফেসড লাফিংথ্রাসের মাঝে রেন ব্যাবলার দেখতে পাব।
সোমারে থেকে রাস্তা এগিয়েছে বুগিয়াল মতো অঞ্চল জুড়ে। পথের কষ্ট কিছুটা কমে যাওয়ায় দুচোখ ভরে দুপাশের দৃশ্য দেখি আর ক্যামেরার শাটার টিপি। আবার তারপরেই দেরি হওয়ার ভয়ে দ্রুত এগিয়ে চলি। ঘণ্টাদেড়েকের পথ চলার পর হঠাৎ একটাই সবুজ টিনের চালওয়ালা বাড়ি চোখে পড়ল এই উন্মুক্ত প্রান্তরে। লেখা রয়েছে –"সানরাইজ গেস্ট হাউস , ওর্সো ৪০৪০ মিঃ"। বাপ রে , কার এখানে শখ হয়েছে গেস্ট হাউস বানানোর! সোমারের পর বড় গাছ আর নেই, শুধু ছোট ঝোপ এদিকে ওদিকে। এর পর কিছুটা এগোতেই রাস্তা দুভাগ হয়েছে, বাঁদিকে অপেক্ষাকৃত উঁচু পথটা চলে গেছে ফেরিচের দিকে। আমরা যাব ডানদিকের রাস্তা ধরে, যা প্রথমে নীচে নেমে গেছে নদীর বুকে। এরপর খুম্বু খোলার ওপরে সাঁকো পেরিয়ে ডাইনে ঘুরে পাহাড়ের ঢাল বরাবর চলে গেছে। সেই রাস্তা নীচে ইমজে খোলাকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেছে ডিংবোচের দিকে। ৪০০০মি পার করলেই শরীরকে খাপ খাইয়ে নিতে একদিন বিশ্রাম নেওয়া উচিত। ডিংবোচে (৪৪১০মি) আর ফেরিচের(৪২৪০মি) উচ্চতা প্রায় এক। কিন্তু ডিংবোচের তুলনায় ফেরিচে পাহাড়ের যে ঢালু উপত্যকায় রয়েছে সেদিকে ঠাণ্ডার প্রকোপ বেশি। তাই গ্রামে লোকজনও কম।
বেশ অবাকই হলাম যে বেলা একটার মধ্যেই এমন এক জায়গায় এসে পড়লাম যেখান থেকে পুরো ডিংবোচে দেখা গেল। ডিংবোচের বাইরে একটা ছোট চোর্তেন। এখানকার চোর্তেনগুলোতে বৌদ্ধদের রঙিন নিশান যেমন আছে, আবার তেমনি ওপরের দিকে চোখ আঁকা থাকে। যা নেপালের চোর্তেনের বৈশিষ্ট্য। ডিংবোচে গ্রাম ইমজে খোলার ডানধারে লম্বালম্বি অবস্থিত। আর বামধারে আমাদাবলামের উত্তর-পশ্চিম পিঠ খাড়া নেমে এসেছে। সামনের দিকে চাইলে দেখতে পাওয়া যায় বিখ্যাত আইল্যাণ্ড পিক, লোৎসে, লোৎসে সার,বরুণৎসে ইত্যাদিকে। এভারেস্ট পিরামিড এখানে লোৎসের পেছনে ঢাকা পড়ে গেছে। আইল্যাণ্ড পিকের আশেপাশে অনেক জানা-অজানা শৃঙ্গের ভিড়।
আমরা এসে উঠলাম হোটেল ফ্যামিলি ডিংবোচে-তে। যদিও দুপুর আর অল্প খিদেও পেয়েছে, কিন্তু সোমারেতে ভাত খেয়েছিলাম বলে এখন চকোলেট খেয়ে কাটালাম। বাইরে বেশ খটখটে রোদ, কিন্তু ৪০০০ মিঃ-এর ওপরে বলে বেশ ঠাণ্ডা। গাছ নেই বলে হাওয়া কোথাও বাধা পাচ্ছে না। রোদে বসে নতুন প্রতিবেশিদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠলাম। কিন্তু খানিক পরেই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করল। ঝোড়ো হাওয়া। ঘরে ঢুকে এসে দেখি যেদিক থেকে উঠেছি সেদিক থেকে একরাশ ঘন মেঘ এসে সবকিছুকে ঢেকে দিল। রোদের জন্য যে আরামদায়ক অনুভূতি ছিল তা উধাও। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে বিকেল পাঁচটায় দিনের আলো থাকা সত্ত্বেও ঠকঠকানি লেগে গেলো হাড়ে। শেষে দুজনে ঠিক করলাম ডাইনিং হলে যাই, সেখানে নিশ্চয়ই চুল্লি জ্বালিয়ে ফেলেছে এতক্ষণে। নীচে নেমে সেখানে পৌঁছতেই আমরা অবাক। দেখি রমেশ বসে গরম স্যুপ খাচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম ও হয়ত আগামীকাল আসবে, আমাদের এখানে যে অ্যাক্লিমাটাইজেশনের জন্য অতিরিক্ত একদিন রাখা আছে, সেদিনে। কিন্তু ও আজ নামচে থেকে বেরিয়ে একটানা ট্রেক করে পৌঁছেছে এই ডিংবোচেতে, তাও শেষের এই খারাপ আবহাওয়ায়। ওকে দৃশ্যতই ক্লান্ত লাগল। নেপালের এই অসীম শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার অধিকারী শেরপারাও তাহলে ক্লান্ত হয়! অতিমানব নয় তাহলে সবাই! ইতিমধ্যে ডাইনিং রুম বিদেশি ট্রেকারদের ভিড়ে গমগম করছে। গল্পগুজব করে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বিছানায় স্লিপিং ব্যাগের ভেতর আশ্রয় নিলাম।
নভেম্বর ৮ - ডিংবোচে
এদিনটা রাখা ছিল বিশ্রাম আর অ্যাক্লিমাটাইজেশনের জন্য। সারাদিনের কাজ বলতে চুকুং রি বা তার বেস ক্যাম্প অবধি যাওয়া - আইল্যান্ড পিকের দিকে এগিয়ে বিবরে পেরিয়ে। বিকল্প ছিল হোটেলের পেছন দিকে যে খাড়া বরফহীন পাহাড় আছে ৫১০০মিঃ পর্যন্ত সেই পথে এগোনো। চুকুং গেলে ৪৭৩০ মিঃ, তাই ঠিক হল পেছনের নাগার্জুনাতেই যাব।
তাড়াহুড়ো নেই। ব্রেকফাস্ট সেরে বেশ অলস ভাবেই উঠতে শুরু করলাম। চূড়ো অবধি না পারলেও যতটা যাব ততটাই শরীরের পক্ষে লাভ। ওদিকে আগামী তিনদিন ট্রেকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, কঠিনও বটে। সুতরাং শরীরকে কষ্ট না দিয়ে, চোট আঘাত থেকে বাঁচিয়ে, শুধু সক্ষমতা বাড়ানোর মহড়া। দুর্গার পিঠে আজ স্যাক নেই। সে নিজেকে চড়ুইপাখি ভাবছে মনে হচ্ছে দেখে, তিড়িং-বিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে। রমেশ ও দুর্গা আজ নিজেদের স্বাভাবিক গতি ও ছন্দে চলেছে, মাঝে মাঝে পাথরের ওপর বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। উচ্চতামাপক কোন যন্ত্র বা চিহ্ন নেই। যতটা পারি চূড়োর কাছাকছি পৌঁছে মনে হল যথেষ্ট গা ঘামানো হয়েছে। উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপও খাইয়ে নেওয়া যাচ্ছে। এবার ফেরাই ভালো।
গ্রামে ফিরতে বেশি বেলা হয়নি। প্রথমে খানিকক্ষণ ওয়াইফাই-এর খোঁজে এদিক সেদিক ঘুরলাম। হোটেলের রেটটা বেশি। কিন্তু আধ ঘন্টাটাক ঘোরাঘুরি করে খুব একটা সুবিধে করতে পারা গেল না, গ্রামটা ভাল করে ঘুরে দেখা ছাড়া। শুধু একবার স্নো পিজিয়ন দেখতে পেয়ে তার ছবি তুললাম। হোটেলে ফিরে ওয়াইফাই দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগে বাড়িতে খবরাখবর দেওয়া নেওয়া সেরে নিলাম। গৌরবের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে। বাকি পুরো দিনটা নির্ভেজাল আড্ডা। আজ অনেক ট্রেকার এসে জুটেছে। ভারতীয় বলতে আমরা দুজনই। ডাইনিং হলে জার্মান অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার আন্দ্রে আমান-এর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গল্প হল। এঁর সঙ্গে কাল এসেই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। উনি আমাদের যাত্রাপথ মেনে চলবেন বাকি রাস্তাটা। খাওয়া দাওয়ার পর ফুটফুটে চাঁদের আলো মাখা আমাদাবলামের রাতের রূপ ক্যামেরাবন্দি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রায় আধ ঘন্টা ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ছবি তুলে, ব্যাটারির কথা ভেবে ঘরে ফিরে এলাম। সব জায়গায় ব্যাটারি চার্জ করার সুযোগ নেই।
নভেম্বর ৯: ডিংবোচে থেকে লোবুচে
আজকের গন্তব্য লোবুচে খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু বেশি উচ্চতায় একটানা অনেকক্ষণ পথ চলা যায় না। প্রথমেই ডিংবোচের গায়ে নাগার্জুনা পাহাড়ের একটা রিজ পেরোতে হল। এই পাহাড়ের উলটো দিকের ঢালেই ফেরিচে। নাগার্জুনার এই রিজ-এর প্রাচীরই ডিংবোচেকে প্রবল ঠাণ্ডা হাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রিজ পার হওয়ার পর রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়েছে। একটা উঠে গেছে শৃঙ্গের দিকে, যে পথে আমরা কাল গেছিলাম। অন্যটা যেদিক থেকে উঠেছি তার বিপরীত দিকে সটান নেমে গিয়ে মিশেছে দুজা বুগিয়ালে। বুগিয়ালে ঢাল প্রায় নেই বললেই চলে এবং লম্বায় খুব দীর্ঘ। ৩-৪ কিমি পর্যন্ত পায়ে চলার রাস্তা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। জোরেই হাঁটছি। কিন্তু শত্রু এখানে দম। দেখলে মনে হয় এই সামান্য ঢালু রাস্তায় চলা খুব সহজ, কিন্তু একটু গতি বাড়ালেই হাঁপিয়ে পড়ছি।
দিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তর মানেই হাওয়ার অবাধ বিচরণ। বড় গাছ দুদিন আগে প্যাংবোচেতে শেষবার দেখেছি, এখানে এরপর ঘাসও শেষ হয়ে এল। বেলা একটু বাড়তেই সামনের দিক থেকে হাওয়া গতিরোধ করছে। দুজা বুগিয়ালে অসংখ্য চ্যপকে (ইয়াক ও গরুর সঙ্কর), ইয়াক, অল্প কিছু ঘোড়া ও ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাথরের দেওয়ালে ঘেরা ঘর চোখে পড়ে, বোধহয় আস্তাবল হবে। বুগিয়াল পার হয়ে রাস্তা ঢালু পথে নদীখাতে নেমেছে। সেদিকে এগোতে এগোতে দেখি বাঁদিকে পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে সোলা-সো বা সোলা লেক। আসলে এই পথ কিছুক্ষণ বাদে মিশে যাবে গোকিও হ্রদের দিক থেকে আসা পথের সঙ্গে। খুম্বু খোলার ওপরে ছোট পুল পার করেই থুকলা বা ধুকলা (৪৬২০মি), যেখানে বিশ্রাম নেওয়ার পালা। এখানে বিশ্রাম নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। কেন? রমেশের কাছে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্নটা করতেই ও একটু হেসে আঙ্গুল তুলে গন্তব্যের দিকটা দেখাল। রাস্তাটা খাড়া ওপরে উঠেছে প্রায় ১১০০ ফুট। এই তার মানে থুকলার কঠিন রাস্তা!
থুকলায় দুটো দোকান আছে, আর আছে তিন-চারটে থাকার জায়গা, সবশুদ্ধু চত্বরটা ধর্মতলার সিটিসি বাসস্ট্যান্ডের সিকিভাগ। দোকানগুলোয় ওয়াইফাই-এর সুবিধা আছে। খাবারের মূল্য তালিকা আমাদের প্রায় হার্ট অ্যাট্যাক দিয়ে দোকান থেকে বার করে দিল। সঙ্গে থাকা জিওলিন দেওয়া জল আর স্নিকার্স চকোলেট দিয়ে নিজেদের রিচার্জ করে বের হলাম। চড়াই থিয়াংবোচে আসার সময়েও পেয়েছি, কিন্তু এখানে তফাৎ হল উচ্চতা – সেদিনের থেকে ১০০০মিঃ-এর চেয়েও বেশি উচ্চতায়, গাছ একদম নেই ফলে অক্সিজেনের খামতি। কিন্তু একটাই জিনিস সেদিনের থেকে আজকে আলাদা করছে, সেটা হল লক্ষ্য। সেদিন পাহাড়ে পাক খেয়ে উঠতে গিয়ে শেষটা যে কোথায় তা বোঝা যাচ্ছিল না, এখানে কিন্তু চূড়োটা দেখা যাচ্ছে। ফলে আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা কম লাগে। রাস্তা জিগজ্যাগ করে উঠেছে, পাথরের ধাপ আছে। আমরা শুরু করার পর অনেকেই আমাদের পেছন থেকে এসে টপকে গেল। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে কারোর অবস্থা ভাল নয়। হাঁপাতে হাঁপাতে এগোচ্ছে সবাই। আমরাও লড়ছি। ইয়াক আর চ্যপকেগুলো পিঠে মাল নিয়ে যখন উঠছে তখন ওদের শ্বাসপ্রশ্বাস-এর শব্দ বোধহয় ১০ মিটার দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ক্রুদ্ধ ইয়াক এই বুঝি কাউকে আক্রমণ করবে।
একসময় দেখি সামনে প্রায় ৫০ গজ দূরে শান্তনু মাথার ওপর মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে দিয়েছে। বড় বোল্ডারগুলো টপকে ওখানে পৌঁছে আমারও আনন্দের সীমা রইল না। অদ্ভূত দৃশ্য। চূড়োর খাঁজ পার করেই এক চওড়া সমতল মত জায়গা, পাথরের কিয়ার্ন দিয়ে বানানো চোর্তেনে রঙিন নিশান উড়ছে, চতুর্দিকে বড় বরফঢাকা শৃঙ্গ। সমতল অঞ্চল জুড়ে এভারেস্ট অভিযানের হতভাগ্য শহীদদের স্মৃতিসৌধ। রয়েছে ১৯৯৬ সালে এভারেস্ট বিপর্যয়খ্যাত স্কট ফিশার-এর মেমোরিয়াল। এছাড়াও বাংলাদেশী পর্বতারোহী সজল খালেদ, অস্ট্রিয়ান সিন এগান,কত বুল্গেরিয়ান, চাইনিজ এর সঙ্গে রোমানিয়ান হৃষ্ট প্রোদানভ-এর সৌধও চোখে পড়ে। যিনি বিনা অক্সিজেনে পশ্চিম রিজের রুটে এভারেস্ট শীর্ষে ১৯৮৪ তে ওঠেন। এই স্মৃতিসৌধের মাঝে দাঁড়িয়ে ওঁদের জীবনকাহিনীর কথা ভেবে অজান্তেই চোখে জল আসে।
রমেশের হাঁকডাকে আবার চলা শুরু হল। স্নো লাইনে ঢুকে পড়েছি। এতদিন পাহাড়ের ওপরের ঢালে বরফ দেখেছি। নিজেরাই এখন প্রায় ৫০০০ মিঃ এর কাছে পৌঁছে যাওয়ায় আশেপাশে পথে বরফের দেখা মিলল। নদীর ওপারে পাহাড়ের পেট বরাবর একটা রেখা চলছে আমাদের সমান্তরালে। ভাল করে নজর করলে দেখা যায় ওটা পায়ে চলা পথ, গোকিও হ্রদ থেকে চো-লা, জং-লা অতিক্রম করে লোবুচের দিকে আসা পথ। দুই পথ মিশেছে খুম্বু খোলার অপর পারে। খোলায় জল কম, সহজেই বোল্ডার টপকে পেরোনো গেল। একদল ইউক্রেনিয়ান ট্রেকারের সাথে গল্প করতে করতে বাকি রাস্তাটুকু পেরিয়ে গেলাম।
লোবুচের উচ্চতা প্রায় ৪৯০০ মিঃ। এখানেও থাকার জায়গা সত্যিই কম। ১৯৭৫-এ কমলা মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা পড়ে জেনেছিলাম তখন ছিল একটি মাত্র দোকানঘর। এখন সে তুলনায় অনেক আধুনিক সুবিধা আছে , সন্দেহ নেই। সে যাই হোক, ডিংবোচে-তে লজের লোকের ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ ছিলাম, লোবুচে-তে আঙ্কেলজীর "হোটেল পিক XV"-এ ঢুকে মনটা খুশিতে ভরে গেল। এটা বাড়ির মধ্যেই হোটেল। আঙ্কেলজীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম ওনার দুই ছেলে দার্জিলিং আর কার্শিয়াং-এ পড়াশোনা করে। ছুটিতে বাড়ি আসে। মানে ওরা বছরে দুবার প্রায় এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেক করে! আঙ্কেলজী আমরা ভারতীয় শুনে একটু খাতির করে অনেক গল্প করলেন। সদা ব্যস্ত, তার মধ্যেও যত প্রশ্ন করেছি, সবেরই উত্তর দিয়েছেন।
মালপত্র রেখে, খানিক বিশ্রাম নিয়ে লাঞ্চ সারলাম। এই উচ্চতায় সুস্থ থাকতে রসুনের স্যুপই যথার্থ। খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে বের হলাম অ্যাক্লিমাটাইজেশনের জন্য পদচারণায়। দুপুরে ঘরে বসে সময় নষ্টের কোন মানে হয় না। রমেশ সঙ্গে আসতে চাইল না। শুধু বলল আবহাওয়া বুঝে বেশিদূর যেন না যাই। পথ বলতে কিছু নেই প্রায়, শুধুই ছোট বড় বোল্ডার। কষ্ট বলতে এখন শুধু চড়া রোদের সঙ্গে দমকা হাওয়া আর সারাদিনের ক্লান্তি। কুড়ি-পঁচিশ মিনিট ওই বোল্ডার টপকে এগিয়ে একটা টিলার ওপর উঠে প্রাণ ভরে নুপৎসে আর পুমোরি এর অসাধারণ শোভা দেখে সে ক্লান্তিও উধাও। রোদ পড়তেই জাঁকিয়ে ঠান্ডা। জোরে পা চালিয়ে লজে ফিরে এলাম। এর পর রোজকার রুটিন।
নভেম্বর ১০ - লোবুচে, গোরখশেপ, বেস ক্যাম্প, কালাপাত্থর
লোবুচের পর রাস্তা বলতে কিছু নেই। শুধু ছোট-বড় বোল্ডার। কিছুক্ষণ পরেই মাটি একেবারে শেষ হয়ে কেবল এবং কেবল মাত্র পাথর রয়ে গেল পায়ের নীচে। আসলে এগুলো খুম্বু গ্লেসিয়ারের টার্মিনাল আর ল্যাটেরাল মোরেন। আজ পথ চলা শুরু করেছি ভোর সাড়ে ছ'টায়। সূর্যের প্রথম আলো যখন পুমোরির ওপর পড়ছে তখন আমাদের প্রায় আধ ঘন্টাটাক হাঁটা হয়ে গেছে। অসাধারণ চোখ ধাঁধানো দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে এগোচ্ছি। সকালে ভালই ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা মাইনাস তিন কী চার তো হবেই। তবে হাওয়ার দাপটে মাইনাস দশে নেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু শরীরের কাছে সব মাইনাস-ই এক। এদিকে পায়ের নীচে পাথর, সন্তর্পণে পা ফেলতে হয়। নইলে পা মচকানোর সম্ভাবনা। ঘন্টা দুয়েক হাঁটবার পর এক জায়গায় এসে পড়লাম, যেখানে মনে হল রাস্তাটা দুম করে একটা পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়েছে। আর সেই দেওয়াল বেয়ে জিগজ্যাগ রাস্তা ওপরে উঠে গেছে। আজ আমাদের গন্তব্য বেস ক্যাম্প। সেই টানেই উঠতে শুরু করলাম। আবার সেই বুকে হাঁপর টানার মত কষ্ট, নাক থেকে জল পড়া, পা আর তুলতে না পারা। অক্সিজেন কম। তবে ক্রমে ব্যাপারটা অভ্যাসে পরিণত হল। মনে মনে ভাবি এই না হলে কি আর ই.বি.সি.-টা ই.বি.সি. হত? সান্দাকফু হয়ে যেত! সবাই দিব্ব্যি গাড়ি করে চলে আসলে মজাটাই নষ্ট। যেটা উত্তর ই.বি.সি.-তে চিন করে ফেলেছে!
আধঘন্টায় খাড়াই পথটুকু পার হয়ে গেলাম। থিয়াংবোচের পর এইখানে শান্তনুর ফোনে নেটওয়ার্ক সিগনাল এল। বাড়িতে ছোট করে খবর জানিয়ে আবার হাঁটা শুরু। বোল্ডারের আকার বেড়েছে। দেখে মনে হয় ক্ষুদ্র টিলাই যেন এক একটি। এরকম ক্ষুদ্র টিলায় ভরা কয়েকটা ছোট পাহাড়ের মতো জায়গা পার করে হঠাৎই চোখের সামনে ফুটে উঠল গোরখশেপের ছোট ঘরগুলো। সময় দেখলাম মোটে ৯.৪৫। অবাক হলাম এটা দেখে যে এখন যেখানে আছি গোরখশেপ তার থেকে অন্তুত ৪০-৫০ মি নীচেতে। অদ্ভূত ! তেমন কষ্ট হল না তো। নিজেদের ওপর বিশ্বাস কয়েকগুণ বেড়ে গেল। রমেশ তাড়া লাগাতে শুরু করল। কিন্তু এই জায়গার কিছু ছবি না তুলে এবং বেশ ভাল করে উপভোগ না করে চলে যাওয়াটাও অন্যায়। সামনে ডানদিকে কোনাকুনি নুপৎসে, তার পেছনে উঁকি মারছে এভারেস্ট, তারপর লো-লা, খুম্বুৎসে, দূরে চাংৎসে, সোজা নীচের দিকে ই.বি.সি.-এর ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড এতদূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে। তার পেছনে খুম্বু আইসফল, তার নীচে থেকে টানা বেরিয়ে এসে আমাদের ডানদিক ধরে সোজা লোবুচের দিকে চলে গেছে খুম্বু গ্লেসিয়ার। বাঁদিকে কোনাকুনি পুমোরি, আর পেছনদিকে বেশ দূরে আমাদাবলাম। আহা! চোখ জুড়িয়ে গেল। খুম্বু গ্লেসিয়ারকে এখান থেকে দেখে মনে হয় যেন বরফে সমুদ্রের মত ঢেউ খেলে গেছে অথবা ঢেউ খেলতে খেলতে বয়ে যাওয়া একটা বিরাট নদীকে কেউ যেন এক লহমায় ঠাণ্ডায় জমিয়ে দিয়েছে।
মিনিট দশেকের বিহ্বল ভাব কাটিয়ে বেশ দ্রুতগতিতে গোরখশেপ চলে এলাম। সামনেই বুদ্ধ লজের ঘরে জিনিসপত্র রেখে সবাই গার্লিক স্যুপ খেয়ে নিলাম। এখানে এসে থেকেই শান্তনুর মাথা ধরেছিল – অল্টিচ্যুড সিকনেস। স্যুপ খেয়ে খানিক সুস্থ হল। বাকিরাও চাঙ্গা হলাম। বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। এগারটার মধ্যে তৈরি হয়ে সামান্য কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। গোরখশেপ থেকে এগোনোর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রকৃতি কেমন যেন ভয়ঙ্কর সুন্দর চেহারা নিতে শুরু করল। চোখ ধাঁধানো রোদ, তার সঙ্গে বরফ ঠাণ্ডা হাওয়া, পায়ের নীচে প্রায় পুরোটাই ঝুরো পাথর। এর ওপর দিয়ে হাঁটা যথেষ্ট কষ্টকর। দ্রুত চলা যায় না, আর পিছলে যাওয়া আটকাতে পা টিপে টিপে চলতে গিয়ে সহজেই ব্যথা করতে শুরু করে।
গাঢ় রোদচশমার ওপর দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়াতে, সর্ষেফুল দেখার উপক্রম হল। ভাল মাউণ্টেনিয়ারিং গগলস্-এর অভাব প্রতি মুহূর্তে বোধ করছি। মাথা নীচু করে যেদিকেই তাকাই ফ্যাকাশে, নয়ত হলদেটে-সাদা বা ধূসর বর্ণের পাথর। চারিদিক রুক্ষ, শুষ্ক অথচ কত কাছেই না পৃথিবীর সেরা মিষ্টি জলের ভাণ্ডার! খুম্বু হিমবাহকে ডানদিকে রেখে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে এমন এক জায়গায় এসে পড়লাম যেখান থেকে ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড সামনে প্রায় ১০০ মিঃ নীচে গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে কোনাকুনি ভাবে চলে গেছে খুম্বু আইসফলের প্রান্ত পর্যন্ত। এখান থেকে ই.বি.সি. এবং এভারেস্ট দুটোই এক সরলরেখায় দেখা যায়। তবে এই জায়গাটা ভীষণ অস্থির, ঠিক ভারসাম্য নেই যেন। টুকটাক পাথর এদিক সেদিক থেকে পড়ছে। দাঁড়িয়ে ফটো তোলার অবকাশ নেই। রমেশের কথামত প্রায় একদৌড়ে জায়গাটা পার করে ডানদিকে ঘুরে নীচে নেমে পড়লাম। এবার সোজা বেস ক্যাম্পের দিকে এগোনো। দূরত্ব খুব জোর ১ কিমি হবে। এমনিতে দেখে মনে হয় ২০০-৩০০ মিঃ-এর বেশি নয়। কিন্তু খুম্বু গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে তো কেউ আর গাড়ি চলার রাস্তা বানায়নি। সুতরাং আরও আধ ঘন্টা মতো হেঁটে পৌঁছে গেলাম।
পৌঁছতেই প্রথমে স্বাগত জানাল একটা গ্রেট রোজফিঞ্চ পাখি। আমাদের দেখে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে নিজের মত ঘোরাঘুরি করল। যেন তোয়াক্কাই করল না। আর সত্যি বলতে কি, ভয় পাওয়া দূরে থাক – নিজে থেকেই কাছে এসে পোজ্ দিল যেন। এ অভাবনীয় উপহার আর লক্ষ্যে পৌঁছতে পারার জন্য হিমালয়কে করজোড়ে প্রণাম।
ই.বি.সি. এভারেস্টের ঠিক কোলে নয়। এভারেস্টের কোলে আছে লো-লা এবং তার কোলে বেস ক্যাম্প। ফলে এখান থেকে এভারেস্টের চূড়া দেখা যায় না, শুধু ওয়েস্ট সোলডারের খানিক দেখা যায় আর বাকি সবই নুপৎসে তে ঢাকা পড়ে যায়। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প লেখা ব্যানার আর প্রচুর প্রেয়ার ফ্ল্যাগ জড়ানো একটা জায়গায় আমরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রমাণস্বরূপ কিছু ছবি তুললাম। শুনেছি এপ্রিল-মে মাসে গরমকালে ২৮০০০ ফিটের ওপরে তাপমাত্রা থাকে -৩৫ ডিগ্রী। এই নভেম্বর মাসে কত হবে কে জানে! চূড়োর দিকটায় তাকালে ধোঁয়ার মত দেখাচ্ছে। বরফের ঝড় বইছে বোধহয়। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড-এ সময় কাটিয়ে মন ভরিয়ে ছবি তোলার পর ফেরার পথ ধরলাম।
গ্লেসিয়ার থেকে বেরিয়ে প্রধান রাস্তায় ফিরতে গিয়ে মনে হল পাথর সব আলগা। আসার সময় দৌড়ে পেরিয়েছিলাম। তবে তখন লোকজন কিছু বেশি ছিল। হঠাৎ আমরা এখন একা হয়ে পড়েছি। রমেশ চলেছে সবার আগে, তার দুহাত পেছনেই দিব্যি লাফাতে লাফাতে দুর্গা, তার পেছনে কুড়ি-পঁচিশ হাত দূরে আমি, আমার থেকে সাত-আট হাত পেছনে শান্তনু। হাওয়ার দাপট বেড়েছে। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে টুকটাক করে পাথর পড়ছে। এগিয়ে গিয়ে যখন রিজটার নীচে পৌঁছেছি তখন এক কাণ্ড হল। হঠাৎ কড়মড় করে আওয়াজ, থতমত খেয়ে কী হচ্ছে বোঝার আগেই দেখি রমেশ আর দুর্গা "ভাগো" বলে বিদ্যুৎ বেগে আমার দিকে দৌড়ে এলো এবং আমাদের দুজনকে পেরিয়ে গিয়ে একটা বড় পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল। ততক্ষণে পাথর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরাও মারলাম পেছনে দৌড়। যেসব আকারের পাথর পড়ছে তাতে গায়ে পড়লে মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়, নাহলে অন্তত অঙ্গহানি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সুতরাং কিছুক্ষণ আগেই যে পাথর ডিঙ্গিয়ে এগোনো দুষ্কর মনে হচ্ছিল, সেগুলোকেই এখন দুদ্দারিয়ে দৌড়ে পেরোলাম। প্রাণভয়ে দৌড়লে যে মানুষের ক্ষমতা বাড়ে তার প্রমাণ। অবশ্য পা মচ্কাতেও পারত, হাই অ্যাঙ্কেল জুতো তার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। আমরা অক্ষত অবস্থায় একখানি বিরাট পাথরের আড়ালে রকফল থামার অপেক্ষায় রইলাম তিন-চার মিনিট। পাথর পড়া বন্ধ হলে প্রায় দৌড়ে রকফল অঞ্চল পার হলাম। বুক যেন ফেটে যাচ্ছে, ক্রমাগত হাপর টানার মত ব্যাপার। সমুদ্রতল থেকে ৫৩০০ মিঃ ওপরে দৌড়োনো যে মুখের কথা নয়! ফুসফুসের ক্ষমতার চূড়ান্ত পরীক্ষা! ফেরার পথে আর উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি, শুধু স্বপ্ন আর লক্ষ্যপূরণের আনন্দের এক অদ্ভূত অনুভূতি সারা শরীর ও মন জুড়ে রইল। স্মারক হিসাবে সঙ্গী করে নিয়ে এলাম একখন্ড ছোট নুড়ি – যা বহুকাল পূর্বে টেথিস সাগরের বুক থেকে উঠে এসে হিমালয়ের এই সর্বোচ্চ অঞ্চলে বিরাজ করেছে।
লজে ফিরে তিনটে নাগাদ লাঞ্চ সারলাম। শান্তনু আর আমি ঠিক করলাম কালাপাত্থরের দিকে যতটা পারি এগোব। রমেশ সম্মতি জানাতে আর আবহাওয়া ভালো থাকায় এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। পথ হারানোর ভয় নেই। যারা ওপরে উঠেছিল তারা ফিরছে। এখন ওপরে ওঠবার কেউ নেই। দেখতে ঢালু হলেও উঠতে গিয়ে বুঝলাম বেশ খাড়া। তাছাড়া ৪৫ ডিগ্রী কোণটা নেহাত কম নয়, ঝুরো পাথর আর নুড়ির জন্য বেশ সময় লাগছে। একটু পিছলে গেলে সামাল দেবার মত বিশেষ কিছু নেই। বেশ পরিশ্রমসাপেক্ষ। হাঁফাতে হাঁফাতে বুঝলাম শরীর বেশিক্ষণ চলবে না। রাস্তায় প্রথম যে স্যাডল্ পেলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম, তাও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ওঠার পর। কালাপাত্থর যে কতদূর তা বোঝার কোন উপায় দেখলাম না। ছদ্মচূড়া দেখে ভুল হয়। সামনে যাকে উঁচু চূড়ো বলে মনে হচ্ছে তার মাথায় পৌঁছলে দেখা যায় ওপরে আরেকটা তেমনই চূড়া। এবং এরকম চলতেই থাকে। সুতরাং খানিক বাদে আমরা ঠিক করলাম আর বেশি না এগিয়ে একটু চওড়া যে জায়গাটায় অপেক্ষা করা যাবে সেখান পর্যন্তই এগোব। দেখে শুনে পছন্দ করলাম সেরকম একফালি জায়গা যেখানে এভারেস্ট পিরামিড নুপৎসের পাশে ভালভাবে দৃশ্যমান। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা মুখে এসে পড়ছে আর ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠছে।
এখানে বসে থাকার সিদ্ধান্তে আমরা যে কোনো ভুল করিনি তা মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল। অস্তাগত সূর্যের ছটা এভারেস্ট আর নুপৎসের রঙ মিনিটে মিনিটে পালটে দিচ্ছে। চারপাশে পুমোরি, লো-লা বা ম্যালোরি গ্যাপ, তাওচে, খুম্বুৎসে, লিন্ট্রেন – কাকে ছেড়ে কাকে দেখব! কিন্তু মন টানছে এভারেস্ট-ই। সুর্যের শেষ রশ্মি এভারেস্ট এর ওপরেই পড়ছে, তা সে যতই এখান থেকে নুপৎসে কে উঁচু দেখাক! এত রঙের সম্ভার আগে কখনো কোন পর্বতচূড়ায় দেখিনি। আমরা অভিভূত হয়ে শুধু দেখে চলেছি এ মায়াবী রঙের খেলা। মাঝে মধ্যে বোধহয় ভুল করেই ক্যামেরার শাটার টিপেছি। সাদা থেকে স্বর্ণাভ হলুদ, তারপর তা থেকে উজ্জ্বল কমলা, তারপর লাল গনগনে আগুন। লাভা উদ্গীরণ হবে যেন! সূর্যাস্তের পরেও রঙের খেলা শেষ হল না। লালবর্ণ আসতে আসতে হাল্কা হতে হতে কেমন নীলচে বেগুনীতে পরিণত হল। কিছু পরেই পাংশুটে ধূসর হয়ে আবছা আলো মেখে রইল সে। প্রকৃতির এই ছবি আঁকা দেখেত দেখতে বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ দেরি হয়ে গেছে। পাঁচটা কুড়ি। ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে গায়ে কেটে বসছে। সন্ধ্যে হতে না হতেই তাপমাত্রা শূন্যের কত নীচে চলে গেছে তা কে জানে! ডাউন জ্যাকেটের প্রয়োজন। কিন্তু আমরা শুধু কয়েকটা মোটা আস্তরণ আর উইন্ডস্টপারের ভরসায়! সঙ্গে টর্চও আছে একটাই। ৪৫ ডিগ্রি কোণে দ্রুত নামা যায় না, তাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামার চেষ্টা করলাম। বোধহয় মিনিট পঁচিশেক লেগেছে, কিন্তু তারমধ্যেই দাঁতে দাঁত লেগে যাবার যোগাড় হয়েছিল। আস্তানায় ফিরে একবাটি করে গরম গার্লিক স্যুপ খেয়ে চাঙ্গা হলাম।
এখানকার হোটেল নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের সমাহার। বৈচিত্র্যের মধ্যেও ঠাণ্ডায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে গা গরমের আশায় গোল হয়ে গল্পগুজব করছে। শান্তনু আজ ভীষণ ক্লান্ত। কথা বলতে বলতে তার ঢুলুনি এসে যাচ্ছে। কোনরকমে তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সাঙ্গ করে ঘরে গেলাম শুতে। এখানকার কম্বলের দশা দেখে ভরসা করতে পারছিলাম না। ঠাণ্ডা সাংঘাতিক, কম্বল ফিনফিনে। কিন্তু কম্বলগুলোকে বৃথাই তাচ্ছিল্য করেছিলাম! মারাত্মক উপযোগী জিনিস। কী দিয়ে তৈরি জিজ্ঞাসা করেছিলাম পরের দিন, ওরা বলেওছিল কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি সেটা কী বস্তু। সে রাতেই আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল - আমরা দুজনেই হ্যালুসিনেট করেছিলাম আর উদ্ভট সব স্বপ্ন দেখেছি, সকালে উঠে বুঝেছি ভাল ঘুম হয়নি। এর কারণ অবশ্য বোঝাই যায় - উচ্চতা, কম বায়ুচাপ আর অক্সিজেনের অভাব। একসময় তো দমবন্ধ হওয়ায়, ঘরের একটা জানলা অল্প ফাঁক করে দিয়েছিলাম। দেখলাম মাথার দিকের কাঁচের জানলায় তখন নুপৎসে চাঁদের আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে।
নভেম্বর ১১ - কালাপাত্থর টপ
ভোররাতে উঠে জানলার দুদিকে বরফ জমে থাকতে দেখলাম। আজকের দিনটা শুরু করার কথা ছিল ভোর চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে। কিন্তু রাতে ভাল ঘুম না হওয়ায় আর বাইরের ঠাণ্ডার ধাক্কায় বেরোতে বেরোতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেলো। বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস বারো থেকে পনেরোর মধ্যে তো হবেই। সঙ্গে মৃদুমন্দ হাওয়া। তবে সে হাওয়াই ঠকঠকানি ধরানোর জন্য যথেষ্ট। কালাপাত্থরের পথ এই ঠাণ্ডার জন্য একেবারে যুতসই। যতই ঠাণ্ডা থাক, একবার চড়াই উঠতে শুরু করলে পনেরো মিনিটের মধ্যেই শরীর গরম হয়ে যাবে। আজ অবশ্য জ্যাকেট পরেই হাঁটছি, হাওয়ার দাপটে খোলবার সাহস হয়নি। অন্ধকার থাকতেই মন্থরগতিতে উঠছি। কাল বিকেলে যেখানে এসেছিলাম, ততটা আসতেই আলো ফুটে গেল। ধীরে ধীরে আকাশে আলো বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে সব শৃঙ্গের রঙ বদলাতে শুরু করল।
৫৫৫০ মিঃ এর কাছে পথ চলতে বেশ কষ্ট। প্রচুর জোর দরকার পড়ছে। রমেশ বার বার তাড়া দিচ্ছে। যত বেলা বাড়বে তত হাওয়া বাড়বে। আরেকটা সমস্যা আছে। কালাপাত্থর এভারেস্টের ঠিক পশ্চিমে, একটু দক্ষিণ কোনাকুনি।তাই কালকে সন্ধ্যায় অস্তমান সূর্যের আলো এভারেস্টের চুড়োয় পড়তে দেখেছি। কিন্তু সেই অবস্থানই আজ সমস্যার কারণ হতে পারে। সূর্যোদয় হবে এভারেস্টের পেছন দিক থেকে। সে সময়ের আগে না পৌঁছলে ভালভাবে দেখা বা ছবি তোলা কোনটাই হবে না। চোখে সরাসরি সূর্যের আলো এসে পড়বে। সুতরাং পা চালাও। কিন্তু গতির ব্যাপারে নিজেদের ক্ষমতা অনুসারে চলাই ভাল। সকাল প্রায় আটটা নাগাদ তিন ঘন্টার পরিশ্রম শেষে উঠে এলাম কালাপাত্থরের শীর্ষে। এখানে রয়েছে এভারেস্টের ওয়েদার রিপোর্ট দেওয়ার যন্ত্রপাতি, টাওয়ার, সামিট এক্সপেডিশনে অভিযাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার আরও অনেক যন্ত্র। ছোটখাটো মোবাইল টাওয়ার। গোরখশেপ থেকে এই পথটুকুতে তাই নেটওয়ার্ক রয়েছে পুরোমাত্রায়। চূড়োর ওপর এত কিছু থাকার দরুণ মানুষ দাঁড়ানোর জায়গার অভাব।
কালাপাত্থরের অবস্থান মাউন্ট পুমোরির দক্ষিণ-পূর্ব গিরিশিরা বা রিজ্-এর ওপর। এই গিরিশিরাটি সটান পুমোরি থেকে নেমে স্থূলকোণ করে উঠে এসে এই কালাপাত্থর টপ তৈরি করেছে। আর তারপর ঢাল বেয়ে নেমে গেছে গোরখশেপ পর্যন্ত। সেজন্য এই একদিক থেকেই এখানে ওঠা যায়। অপর দিকে খাড়া খাদ। সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। এই চূড়ার কাছাকাছি ছোট পাথরও নেই। শুধু বড় বড় কালচে বোল্ডার। ভাল করে নজর করলে দেখা যায়, পাথরের গায়ে একরকম শৈবাল জন্মায়। সেগুলি তীব্র রোদ আর অতিবেগুনি রশ্মিতে পুড়ে স্রেফ কালো ছোপে পরিণত হয়েছে। সেজন্যেই এই জায়গার এই নাম। এর ওপর দিয়ে চলা বেশ ঝকমারি। প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে পাথর ডিঙোতে হয়। দুটো বোল্ডারের মাঝে একটা পা ঢুকে গেলেই চিত্তির। তখন হেলিকপ্টার রেসকিউ করতে হবে। সূর্যোদয়ের অনেক পরে আমরা পৌঁছেছি। সূর্যের চোখ ধাঁধানো আলো এভারেস্ট আর নুপৎসের মাঝখান দিয়ে এসে পড়ছে কালাপাত্থরের মাথায়। বাস্তবিকই, কালাপাত্থর কেন এত বিখ্যাত সেটা এর ওপরে উঠে আসাতে একদম পরিস্কার। এভারেস্টকে এত বড় করে, এত পরিস্কার ভাবে ধরণীর আর কোন বিন্দু থেকে দেখা যায় না। এখান থেকে মাউন্ট পুমোরিকে হাতের টোকায় ছোঁয়া যাবে বলে মনে হয়। অনেকদূর অবধি খুম্বু হিমবাহের বিস্তার চোখে পড়ে। তীব্র নীলাভ আকাশের বুকে এতগুলি শ্বেতশুভ্র বিরাটকায় পর্বতশৃঙ্গ আর তাদের মধ্যমণি এভারেস্ট - সব মিলিয়ে এ এক অসামান্য অনুভূতি। আমাদের ট্রেকের সবচেয়ে উত্তেজনাময় মুহূর্ত এটাই।
এবার ফেরার পালা।
~ তথ্য- এভারেস্ট বেসক্যাম্প ট্রেক ~ || ~ এভারেস্ট বেসক্যাম্প ট্রেকিং-এর আরও ছবি ~ || ~ এভারেস্ট বেসক্যাম্প ট্রেক রুট ম্যাপ ~
শিবপুর বি–ই কলেজের প্রাক্তনী সিভিল ইঞ্জিনীয়ার শুভজিত চৌধুরী, বর্তমানে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। প্রধান শখ পাহাড়ে বেড়ানোর পাশাপাশি পাখি দেখার নেশা।