ক্রৌঞ্চদ্বীপ কুমারাকোমে
মণিদীপা বন্দোপাধ্যায়
~ কুমারাকোমে়র তথ্য ~ কুমারাকোমে়র আরও ছবি ~
কর্মসূত্রে কোচি আসাযাওয়া লেগেই থাকে। এবারে একটা সাপ্তাহান্তিক ছুটি ম্যানেজ করে ছুট লাগালাম কুমারাকোমে। কুমারাকোম পাখিরালয় কোট্টায়াম জেলায় ভেম্বানাড হ্রদের ধারে ছায়া সুনিবিড় শান্তির এক পক্ষীনীড়। সর্ববিষয়ে জ্ঞান সম্পন্ন ইন্টারনেট মহোদয়ের হিসেব অনুযায়ী কোচিন থেকে দূরত্ব ৬২-৯০ কিমির ভেতরে। সময় লাগা উচিত সোয়া ঘন্টা থেকে বড়জোর পৌনে দুই। নানা মুনির নানা মত অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়েবসাইটের হিসেব বিভিন্ন রকম, তাই এই মতভেদ। সে যাইহোক ছ'ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। শুরুতে মারাত্মক ট্রাফিক জ্যাম, তার পর কখনো ঝিরঝিরিয়ে কখনোবা মুষলধারায় নামা বৃষ্টির যুগপৎ আক্রমণে সময়ের দফারফা। তা অঘটন-ঘটন-পটিয়সী 'ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া'-র এও একটা বড় আকর্ষণ বৈকি। তাই কখন পৌঁছব তার ভাবনা শিকেয় তুলে বৃষ্টি স্নাত প্রকৃতির স্নিগ্ধ কোমল রূপ নেহারনে মন দিলাম।
যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। কোথাও শস্যভরা হালকা সবুজ ক্ষেত্র, কোথাও তাল, সুপুরি, নারকেলের ঘন সবুজ বনানী। কোথাও রবার গাছের দলবদ্ধ জোট, তাদের গায়ে নীল রংয়ের থলি বাঁধা, যাতে টিপ টিপ করে সংগৃহীত হয় তাদের শরীরনিঃসৃত ঘন তাজা রস, যা পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয় জমাট রবার ও হাজারো জিনিসে। এর ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারে দুধসাদা বাড়ি, তার লাল টালির চাল। আঙিনায় কলাগাছের ঝোপ, আবার তার পাশেই ঝাঁ-চকচকে দামি গাড়ি। ট্রাডিশন আর আধুনিকতার চমৎকার মেলবন্ধন। বৃষ্টির ক্রমাগত অভিঘাতে, কেরালায় বৃষ্টির আধিক্য বরাবরই বেশি, সর্বত্রই এক জড়সড়, নরমসরম ভাব। দুঃখ একটাই, চা আর গরমাগরম পকোড়াটাই পাওয়া গেল না। বৃষ্টি উপেক্ষা করে কোকথামঙ্গলামে (KOKATHAMANGALAM) চা পান বিরতি নেওয়া হল। কিন্তু প্রচণ্ড মিষ্টি কফি, আর ধোসা, ইডলি, সম্বর বড়া ছাড়া কিছুই জুটল না। তাতে বঙ্গললনার স্বাদ বা সাধ কোনটাই মিটল না।
সন্ধ্যে ছুঁই ছুঁই, পৌঁছলাম কুমারাকোম। কেরালার অন্নক্ষেত্র (Rice Bowl) কুট্টানাড় অঞ্চলের একটি ছোট্ট জনপদ। সমুদ্রতল থেকে নীচে এই অঞ্চলটি আসলে কয়েকটি খুবই ছোট ছোট দ্বীপের সমষ্টি। কোনো সমুদ্র নয়, ভেম্বানাড হ্রদই এখানে সমুদ্রসম। লোকমুখে শোনা, ১৮৪৭ সাল নাগাদ অ্যালফ্রেড জর্জ বেকার তৎকালীন কেরালার রাজার থেকে অনুমতি নিয়ে ভেম্বানাড হ্রদের পার্শ্ববর্তী জায়গাতে চাষবাসের জন্য কিছু জমি তৈরি করতে শুরু করেন। তবে জলাজমিরই প্রাধান্য এখানে। খাল, খাঁড়ি, বিল, লেক, নদী সযতনে ঘিরে রয়েছে এই জনপদটিকে। তাই যে দুটি মালয়ালি শব্দ মিলে কুমারাকোম, 'কুমিনজা' আর 'আকম', তার অর্থ নদীর পলি জমে জমে তৈরি হওয়া স্থান। অবশ্য এর মতভেদও আছে। মতান্তরে 'কুমার' দেব যাঁর অন্য নাম ভগবান মুরুগন-এর আলয় বা 'অহম' আছে বলেই এর নাম কুমারাকোম। প্রমাণস্বরূপ কুমারাকোমের কেন্দ্রে রয়েছে একটি সুদৃশ্য 'মুরুগন' মন্দির। এখানে বলে রাখি, 'মুরুগন' দেব হলেন আমাদের দুগ্গা ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র – কার্তিকেয় বা কার্তিক। ইনি দক্ষিণ ভারতে বিশেষভাবে পূজিত হন।
তা সে যে মতেই বিশ্বাস করা হোক না কেন, আধুনিক কুমারাকোমের রূপকার এবং স্থপতি হিসাবে বেকার সাহেবের নাম সর্বজনবিদিত এবং স্বীকৃত। সেই বেকার সাহেবের বাংলোতে, বর্তমানে যেটি তাজ গ্রুপের হোটেল, সেখানেই আমাদের রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত। গাছগাছালিতে ভরা মূল বাংলোটি এখনও অক্ষতই আছে। সেটি এখন ডাইনিং হল ও রিসেপশন এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাঝখানে একটি ছোট্ট জলাধার বা লেক। তার একপাশ দিয়ে সার সার কুটির, যার অন্দরের অঙ্গসজ্জায় আধুনিকতার সবরকম উপাদান মজুত থাকলেও বহিরঙ্গে পড়েনি কোনো ছাপ। রাঙা ইঁটের পথ ধরে খানিক এগোলে সবুজের ফাঁক দিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়ায় ভেম্বানাড - দিগন্তবিস্তৃত অতল জলরাশি ধূসর সন্ধের রহস্যময়তা গায়ে মেখে।
বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ খানিকক্ষণ। দুকাপ কফি নিয়ে বারান্দায় বসে মৃদু আলাপচারিতা চলছে। ঝিঁঝিঁদের একটানা ঐকতানে কানে তালা লাগার যোগাড়। হঠাৎই প্রথমে একটা দুটো করে তারপর একসঙ্গে ডাইনিং হল সংলগ্ন মাঠে হাজার বাতির রোশনাই। খানিক থতমত খেয়ে শুভাশীষ ছুটল ক্যামেরা আনতে। আর আমি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে মন ক্যামেরায় গেঁথে নিলাম সেই অনবদ্য দৃশ্যটি। লেকের মাঝখানে একটা ছোট্ট দ্বীপ – তাতে হাত পা মেলা এক বিশালাকায় বটবৃক্ষ আগেই লক্ষ্য করেছিলাম। বড় বড় পাথরের চাঁইও পড়ে থাকতে দেখছিলাম। সেই দ্বীপে গাছ-পাথরের গা বেয়ে হঠাৎ ধেয়ে এল চলমান জলরাশি – আলোর ঢেউয়ে নাচতে নাচতে, আওয়াজে কাঁপন তুলে দিল এতক্ষণের শান্ত লেকের বুকে।
ভোর হতে না হতেই প্রথম সূর্যের আলোর আভাসে পক্ষীকূলের সোল্লাস অভ্যর্থনায় কান পাতা দায়। তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লাম প্রাতঃভ্রমণে। তাজ হোটেলের পাশেই কুমারাকোম পাখিরালয় যেটি ভেম্বানাড বার্ড স্যাংচুয়ারি নামেও পরিচিত। চৌদ্দ একর জায়গা নিয়ে বেকার সাহেবের নিজ হাতে সৃষ্ট এই পাখিরালয়টি গড়ে উঠেছে কাভানুর নদীর তীরে। অবশ্য সাহেব এটিকে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবেই শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে স্থানীয় ও পরদেশি পক্ষীকূল নিজেরাই এই স্থানটিকে পছন্দ করে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একসময় গড়ে ওঠে কুমারাকোম পাখিরালয় - কেরালার প্রথম সংরক্ষিত পক্ষিনিবাস। ১৮০ টি প্রজাতির প্রায় ২৫০০০ পাখির আবাসস্থল যার মধ্যে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যাও কম নয়। বিভিন্ন ধরনের হেরন ছাড়াও, টীল, পার্পল মুরহেন, ইগরেট, মার্শ হ্যারিয়ার, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, চিল, টিয়া, বিভিন্ন রকমের হাঁস এখানে সবসময় দেখতে পাওয়া যায়। ঋতুভেদে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বাড়ে কমে।
প্রাতঃরাশ সেরে চললাম পক্ষীদর্শনে। 'তাজ ভিভান্ত' ছেড়ে দু'পা এগোলেই স্যাংচুয়ারির গেট। গেট পেরোতেই পার্কিং লট। তার পাশে অফিসঘর। টিকিট কেটে প্রদর্শনী কক্ষে ঢুকলাম। বিভিন্ন সময়ে দৃশ্য পাখিদের ভারি সুন্দর, রঙিন সব ফটো দেওয়াল জুড়ে। পাশের প্রোজেকশন হলে নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী কুমারাকোম স্যাংচুয়ারি নিয়ে তথ্যচিত্র দেখানো হয়। প্রায় বছর পনেরো আগে যখন প্রথমবার কুমারাকোমে আসি তখন এসব কিছুই ছিল না। পায়ে চলা সরু রাস্তা দিয়ে, জল কাদা ভেঙে, কাঁটায় হাত পা কেটে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম বেনু গাইডের হাত ধরে। ছোট ছোট খালগুলির ওপরে কাঠের গুড়ির সাঁকো, জোরে হাঁটলে প্রবল দুলতে থাকত। মনে আছে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল ছেলেমেয়েরা। সেই তুলনায় এখনকার ব্যবস্থাপত্র অতি চমৎকার। এখন স্যাংচুয়ারির ভিতরে কেরালা ট্যুরিজমের হোটেল তৈরি হয়েছে – ওয়াটারস্কেপ। সেখানে ওয়াচ টাওয়ারে বসে দিনণভর পাখিদের নড়াচড়া, কার্যকলাপ লক্ষ্য করা যায়। সেক্ষেত্রে চাই অশেষ ধৈর্য ও অসীম মনোযোগ। পক্ষীপ্রেমী মাত্রই আমার এই কথাটি এক বাক্যে মেনে নেবেন।
অফিস ঘর পেছনে ফেলে পিচরাস্তা ধরে খানিকটা এগোতেই চেকপোস্ট। পিচরাস্তা পৌঁছেছে পর্যটক আবাসে। তার জন্য বুকিং থাকা আবশ্যক। ডানদিকের সরু ইঁট বাঁধানো রাস্তা ধরে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের অন্দরমহলে। জঙ্গলই বটে। বিরাট বিরাট ম্যানগ্রোভজাতীয় বৃক্ষ তাদের বড় বড় পাতার ছাতা মেলে রুদ্ধ করে রেখেছে সূর্যালোকের সহজ আনাগোনা। চমৎকার আলো-আঁধারি পরিবেশ। নীচে মাটির বুকে ঘাস আর বুনো ঝোপের ঠাস বুনোট। পাখি সব কলরব তো করছেই কিন্তু দর্শন পাওয়া যায় না সহজে। যা হোক, চেষ্টার খামতি থাকে কেন? পথ গিয়েছে জঙ্গলের এক ধার দিয়ে। যে পথে যাওয়া, ফেরাও সেই পথে। সব মিলিয়ে ছ'সাত কিমি রাস্তা হবে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কাভানুর নদী, নদী না বলে খালই বলা ভাল। মাছরাঙা ও পানকৌড়ির দাপাদাপিতে মনে হচ্ছে মাছ ভালই আছে। মাছরাঙার মাছ ধরার দৃশ্যটি বড় নজরকাড়া, অনেকক্ষণ ধরে শিকারটিকে তার পছন্দমতো উচ্চস্থান থেকে তাক করে, তারপর সুপারসনিক গতিতে ডাইভ মেরে জল থেকে শিকারটি ছোঁ মেরে নিয়ে সটান উর্দ্ধপানে। অথচ জলের বুকে হালকা কাঁপন ছাড়া বিশেষ কিছুই অনুভূত হয় না। তুলনায় পানকৌড়ির মৎস্যশিকার খানিকটা মন্থর গতির। তারা আবার অনেক সময় সাবমেরিনের মতো ডুব সাঁতার দিয়েও শিকার ধরে। এর স্থানীয় নামটি ভারী মজার 'কাক্কাতাড়ুয়া'।
বেশ খানিকক্ষণ অন্ধকারে থাকলে চোখ যেমন সয়ে যায়, জঙ্গলেও তাই। প্রথমে কিছুই দেখা বা বোঝা যায় না তারপর আস্তে আস্তে সজাগ হয়ে ওঠে ইন্দ্রিয়গুলো – চোখে তখন হাজার পাওয়ারের জ্যোতি। হাওয়ার মৃদু শনশনানিও কানে বাজে। শরীরের রোমকূপগুলো প্রখর অনুভূতি প্রবল হয়ে ওঠে। বিশেষতঃ সেটা যদি হয় কোনো অভয়ারণ্য। অতটা না হলেও অতিন্দ্রিয় ক্ষমতায় বলীয়ান আমি রীতিমতো চিরুনিতল্লাশি চালাতে লাগলাম। পাতার সরসরানিতে তাকিয়ে দেখি ৪-৫ জনের এক হেরন পরিবার বন ভ্রমণে বেড়িয়েছেন – সঙ্গে একটি নেহাতই দুগ্ধপোষ্য শিশু। কুমারাকোমে চার রকমের হেরন প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই স্যাংচুয়ারিতে পুরো কেরালা রাজ্যের মধ্যে সব থেকে বেশি সংখ্যক হেরন পাওয়া যায়। গ্রে হেরন, পন্ড হেরন, নাইট হেরন, ইস্টার্ন গ্রে হেরন। রিফ হেরনের খবর এখানে বিশেষ পাওয়া যায় নি। এদের স্থানীয় নামগুলি বেশ ধ্বনিমধুর। চরামুন্টি (গ্রে), কুলামুন্টি (পন্ড), পেরুমুন্টি (ইস্টার্ন গ্রে) ইত্যাদি।
স্যাংচুয়ারির শেষ প্রান্তে যেখানে কাভানুর এসে মিশেছে ভেম্বানাড লেকে, সেখানে বেশ কিছু ওয়াটার বার্ড দেখলাম, বিভিন্ন ধরনের ইগ্রেট – ক্যাটল ইগ্রেটেরই সংখ্যাধিক্য ছাড়াও রয়েছে টিল আর স্টর্কজাতীয় পাখি। পরিযায়ী পাখিদের সময় নয় এটি – তারা আসে মোটামুটি নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ, কখনও বা জানুয়ারিও হয়ে যায়। মার্চ-এপ্রিল থেকে আবার ফিরতে শুরু করে। স্যাংচুয়ারি দর্শনের সেরা সময় তাই ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল।
দুপুরে ডিঙি নৌকো বেয়ে খাঁড়ি পথে পাড়ি দিলাম। স্যাংচুয়ারি থেকে খানিকটা এগোতেই বোট ক্লাব। ঘন্টায় তিনশো টাকা দর হেঁকে মাঝি বাবাজীবন কী ভেবে দুশোতেই রাজি হয়ে গেলেন। আমি পড়ে গেলাম সমস্যায় – গড়িয়াহাট, হাতিবাগানে বাজার-করা মানসিকতায় আর একটু দরাদরি করলে ঠিক হতো কিনা ভাবতে ভাবতেই নৌকায় উঠতে গিয়ে প্রায় উল্টে পড়ার যোগাড়। শেষে সেই মাঝির সাহায্যেই কোনক্রমে থিতু হলাম। এই ধরনের নৌকাবিহার করতে চাইলে, দুটি আপ্তবাক্য মেনে চলবেন - প্রথমতঃ একটু দরদাম করে নেবেন তবে সিজনে সম্ভবপর কিনা বলতে পারবো না, দ্বিতীয়তঃ এবং বেশি জরুরি – নৌকাতে উঠবার বা নামবার সময়, এবং নৌকা চলাকালীন বেশি নড়াচড়া করবেন না। তাহলেই নিজে বা তরণী ডুবে যাওয়ার ঘোরতর সম্ভাবনা। শুভাশীষ ছবি তোলার অত্যুৎসাহে বার কয়েক নৌকা টালমাটাল হলেও মাঝি দক্ষ হাতেই তা সামাল দিয়েছিলেন।
আমাদের ছোটোনদীর মতো ছোট খাঁড়িটিও এঁকেবেঁকে চলেছে। কাশবনের বদলে কখনও একধারে কখনও দুধারেই লোকালয়। বাংলো প্যাটার্নের সুন্দর সুন্দর বাড়ি - সাদা দেওয়াল আর লাল টালির চাল, একঘেয়ে সবুজের মধ্যে ভারী দৃষ্টিনন্দন। প্রত্যেক বাড়ি থেকে বাঁধানো ঘাট এসে মিশেছে জলে। কোথাও কোন গ্রামের বউ বসে গৃহকর্ম সারছে, কোথাও ভাই বোনে মিলে বড় এক ছাঁকনি দিয়ে কুচো মাছ ধরায় ব্যস্ত। কোথাও এক পাল হাঁস রীতিমতো শোরগোল তুলে জলে দাপাচ্ছে। একজনকে দেখলাম একটি ডিঙি নৌকো নিয়ে প্রায় শতখানেক হাঁসের এক দলকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভারি মজার সে দৃশ্য। একদিক থেকে জড়ো করে তো তারা অন্যদিকে পালায়। জলে তার বিশাল লগির আওয়াজ ওঠে ছপাৎ ছপাৎ, ঠিক যেন গ্রামীণ বঙ্গজীবনের জলছবি। শুধু বাড়ির দোরগোড়ায় গরুর গাড়ির বদলে অত্যাধুনিক চারচাকা। তা যে জেলা থেকে সব থেকে বেশি সংখ্যক NRI উৎপাদিত হয় – বাড়ি পিছু একটি-দুটি – সেখানকার গ্রামও যে প্রাচুর্যে ভরপুর হবে তাতে আর আশ্চর্য কি!
বিকেলে রিসর্টের লঞ্চে করে ভেম্বানাডে জলবিহার। বেশির ভাগই বিদেশি, দু'চারজন উত্তর ভারতীয়, আর বেশ কয়েকজন বাঙালি। পরে রিসর্ট আয়োজিত 'চা পান' অনুষ্ঠানে বাঙালি ম্যানেজার শ্রী জয়ন্ত দাস জানালেন যে বাঙালি পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে। ভারি অমায়িক ভদ্রলোক, কর্মসূত্রে প্রায় বছর দশেক বাংলার বাইরে। তাজ গ্রুপের বিভিন্ন পর্যটক আবাস ও রিসর্টে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর আগে ছিলেন কোচিনে। জানালেন রিসর্টের তরফ থেকে প্রতি সন্ধ্যায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে নৃত্যগীত পরিবেশিত হয়। বৃষ্টি না হলে তা অনুষ্ঠিত হয় খোলা জায়গায়, অন্যথায় ডাইনিং হলের ভিতরে। আর রোজ সন্ধ্যে সাতটায় সাড়ে সাতশ মাটির প্রদীপ জ্বালান হয় মাঝখানের লেক ও তার সংলগ্ন স্থান জুড়ে। এটি এদের 'কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট' প্রকল্পের অন্তর্গত। স্থানীয় কমিউনিটির লোকেরা এই কার্যটি করে থাকেন। কাল দেখেছিলাম, আজ জানলাম। ভারি অভিনব লাগল এই ভাবনাটি। মাটির প্রদীপ তো আজকাল দেখাই যায় না বিশেষ – সর্বত্রই টি ক্যান্ডেল (Tea Candle) এর চল। সেখানে মৃৎশিল্পীদের সাহায্যকল্পে গৃহীত এই প্রজেক্ট নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ।
জেটিতে বসে ভেম্বানাডের শান্ত সৌন্দর্য উপভোগ করছি। মাঝে মাঝে মোটরবোটের বিক্ষিপ্ত আওয়াজ, তাদের যাবার সময় জলের বুকে কিছু ঢেউয়ের উথালপাথাল, এছাড়া বিশেষ কোনও শব্দ নেই। বহু দূরে সবুজ তটরেখা, তার পিছনে আকাশ জোড়া নীল ক্যানভাস। ধীরে ধীরে তাতে ফুটে ওঠে লাল তুলির আঁচড়। একটা, দুটো, চারটে, ছটা বাড়তে বাড়তে একসময় সমস্ত ক্যানভাসটাই তারপর লাল হয়ে যায়। সেই লালের ছোঁয়া এসে লাগে ভেম্বানাডের বুকে। লজ্জারাঙা কনেবউটির মতো ঘোমটা টানে সে, তার ঘোমটার আড়ালে টুপ করে লুকিয়ে পড়ে রক্তচক্ষু দামাল সূর্যটা। ঘরে ফিরতে শুরু করে পাখির ঝাঁক। পাড়ের কাছে যে শাপলার দঙ্গল এতক্ষণ নিথর পড়েছিল হঠাৎই তা সরগরম হয়ে ওঠে পাখিদের বিশ্রম্ভালাপে। কত পাখিই না বাসা বেঁধেছে সেখানে। কিছুক্ষণ বসে বসে তাদের নানান ধরনের আলোচনা শুনলাম সরু, মোটা, বিভিন্ন ধরনের গলায়, শেষে মশার কামড়ে রণে ভঙ্গ দিলাম। একটা মশক নিবারণী ক্রিম অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন।
ঠিক সাতটায় কালকের মতোই আলো জ্বলে উঠল। কিছু কিছু জিনিস যেমন কিছুতে পুরোনো হয় না, আলোকসজ্জাও তাই। বিশেষতঃ তা যদি পরিবেশের সঙ্গে সুন্দর করে মানিয়ে যায়। আমাদের কুমারাকোম সফরের এই আলোকসজ্জাটি উপরি পাওনা। কর্নাটকি সঙ্গীত ও নৃত্যসহযোগে নৈশাহারটিও খুবই উপভোগ্য ছিল।
পরদিন ঝলমলে সকালে কুমারাকোমের ঝলমলে স্মৃতি নিয়ে 'ফুল রিচার্জড' হয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিলাম।
~ কুমারাকোমে়র তথ্য ~ কুমারাকোমে়র আরও ছবি ~
কুড়ি বছরেরও বেশি সাংবাদিক জীবনে দেশবিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে শিল্প-সংস্কৃতি-ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা পরিবেশন করছেন মণিদীপা। ভ্রমণপিপাসু এই লেখিকা ঘুরেছেনও সারা ভারতে তথা বিশ্বের নানান দেশে। স্টেট্সম্যান, জেটউইং, ভ্রমণ ও মনোরমা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে সাবলীল হয়েছে তাঁর লেখনী। তাইপেই-তে বসবাসকালীন চায়না পোষ্ট কাগজে সাপ্তাহিক কলাম লিখতেন। এছাড়াও ওয়াশিংটন পোষ্ট, ডিসকভার তাইপেই, ট্রাভেল ইন তাইওয়ান ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা প্রবন্ধ।