মান্ডভির সৈকতে

হিমাদ্রী শেখর দত্ত

~ মাণ্ডভির তথ্য ~

আচমকাই ঠিক হয়ে যায় মান্ডভি যাওয়া হবে। গুজরাতে আসবার আগে একটা আবছা ধারণা ছিল জায়গাটা সম্বন্ধে, সমুদ্র সৈকত অবশ্যই, কিন্তু রঙ রূপে এক্কেবারে আলাদা। বারো বছরের ওপরে গুজরাতে আছি, সেই সুবাদে সোমনাথ, দ্বারকা দিউ, দমন এ সব দেখা। আর বছরে অন্ততঃ একবার কোলকাতা আসা যাওয়ার পথে মুম্বাই-এর সমুদ্র তাও দেখা হয়ে যায়। এই সব জায়গাতেই সমুদ্র কিন্তু একটাই - আরব সাগর। অথচ মান্ডভির আরব সাগর একেবারেই আলাদা। ভারতের একমাত্র রাজ্য গুজরাট, যার পশ্চিম সীমানা পুরোটাই সাগর আর তার কোল ঘেঁষা বেলাভূমিতে ঘেরা।
আমেদাবাদ থেকে বাগোদ্রা ও লিমডি ছাড়িয়ে পৌঁছালাম চোটিলা বলে একটি মনোরম জায়গায়। হাইওয়ে থেকেই সটান একটা বিশাল উঁচু পাহাড় আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পাহাড়ের মাথায় কালী মন্দির। সেখানে পৌঁছাতে হলে ১০১০ খানা সিঁড়ি চড়তে হবে। মাঝে মাঝে সমতল চাতাল আছে, সেখানে দু-দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমাদের মধ্যে কেউই ভর দুপুরে এই কসরত করতে রাজি না হওয়ায়, আমরা পাহাড়ের নীচে থেকেই মায়ের পায়ে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে যাই। চোটিলা থেকে মোরবি (অজন্তা হাওয়াই চপ্পল, দেওয়াল ঘড়ি আর ভারতে ব্যাবহৃত হাউস টাইলস সব এখানেই তৈরি হয়) হয়ে গাড়ি ঘোরালাম পশ্চিম পানে। পথে শ্যামখেয়ালি বলে একটি জায়গা পার হতে হয়, যেটা রণ এলাকার শুরু ঘোষণা করে। শ্যাম খেয়ালি থেকে বাচাউ (২০০১ সালের বিধ্বংসী ভুমিকম্পের এপিসেন্টার) হয়ে আমরা ভুজ পৌঁছালাম। ভুজ থেকে আনজার হয়ে মান্ডভি সব মিলিয়ে ৫৫০ কিলোমিটার পথ। অসাধারণ রাস্তা - ছোট রণের, যার দুধারে কেবল সাগরের জল আর জল (তখন জোয়ার ছিল), জোয়ার ভাঁটার টানে যা কখনও কখনও সাগর আর পথের মাঝখানে মেলে রাখে বিস্তৃর্ণ লবনাক্ত পাশুঁটে তটরেখা। সেখানে ভিড় করে থাকে নানা জাতের সামুদ্রিক পাখিরা। এত নিস্তব্ধ চারপাশ, যে পাখিদের কলকাকলি বেশ জোরেই আমাদের কানে আসছিল। জুম লেন্সে কিছু পাখিকে ক্যামেরা বন্দী করা গেল। আশ্চর্য দৃশ্য! এ ছবি কোনও দিনই মন থেকে মুছে যাবে না। ওই রাস্তার দুধারে কোন রেলিং লাগানো নেই, জল ছুঁই ছুঁই উঁচু নীচু রাস্তার তালে তালে, পথ চলার নেশা এমন লাগে, যা ঘর থেকে বেরোনোর সময় মনের কোথাও ছিল না। সমান্তরাল আরও দুটি রাস্তা তৈরি হচ্ছে এখন। যাত্রা পথের প্রায় পুরোটাই ন্যাশনাল হাইওয়ে ৮-ক ধরে, কেবল আনজার থেকে রাজ্যের রাস্তায় নামতে হয়, তবে সেটাও কোন অংশে ন্যাশনাল হাইওয়ের থেকে নিম্ন মানের নয়। সমুদ্র পাবার আগে এমন পাহাড় শ্রেণী চোখে পড়বে, এটা কল্পনার বাইরে ছিল। এমন সবুজ পাহাড় (বৃষ্টির ঠিক পরে পরে আমরা গেছিলাম বলে বোধহয়) আর পাক খাওয়া রাস্তার মেল বন্ধন দেখছি, যা কেবল ছবিতে দেখা যায়। এ পাহাড় কি আরাবল্লীর অফস্যুট? নাকি পাকিস্তানের সল্ট রেঞ্জের সমসাময়িক? এম এস কৃষ্ণান খুলে দেখতে হবে। কিন্তু অসাধারণ। আমার ভূতাত্ত্বিক মন পাহাড়ের জন্মের খোঁজে নেমে পড়ে মনে মনে। আর তার জন্যে পথ চলার চোখকে আরোও ধারালো করতে হল। সাবজেক্টের কচকচানি মানে পাহাড়ের বয়স, জন্ম বৃত্তান্ত এ সব বাদ দিলে জোর গলায় বলা যায় "এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি" - কবির এ কথার মধ্যে সত্যিই কোন আতিশয্য নেই।

মান্ডভিকে বলা হতো প্রাচ্যের প্যারিস। কচ্ছের মহারাজেরা গরমের সময় মান্ডভিতে তাদের রাজপাট সরিয়ে আনতেন এখানকার অনুকূল আবহাওয়ার জন্যে। রুক্মাবতী নদীর পাড়ে এই নগরের গোড়া পত্তন হয় ১৬শ শতাব্দীর (১৫৮১ এ ডি) কোন এক সময়ে কচ্ছের প্রথম জাডেজা সম্প্রদায়ের মহারাজা রাও খেঙ্গারজীর হাত ধরে। রুক্মাবতী নদী সেন্ট্রাল কচ্ছের পাহাড়ি এলাকা থেকে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে মিশেছে। এই নদীর ওপরে ১৮৮৩ সালে পাথরের ব্রিজ বানানো হয়, যা কিনা কচ্ছের সবচেয়ে লম্বা ব্রিজ, যা আজও অটুট আছে। যাই হোক, জাডেজাদের সম্বন্ধে অনেক ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ছেলে শাম্বের বংশধরেরাই যদু কুলের শেষ চিহ্ন। তারাই মহাভারতের যুগের আজকের প্রতিনিধি। ১৬শ শতাব্দী থেকে মুঘল আমল হয়ে ১৯শ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত মান্ডভি ছিল পশ্চিম ভারতের সবচেয়ে ব্যস্ত আর সফল বন্দর। এটা ছিল পশ্চিম ভূখন্ডের এক মাত্র বন্দর যা কিনা ভারতে ঢোকার ও ব্যবসাপত্র করবার জন্য সবচেয়ে সুবিধার। মান্ডভির ৩০০ বছরের ইতিহাসের বিকাশ আর উন্নতির প্রধান মেরুদণ্ডই ছিল এই ব্যবসা। বাণিজ্যের প্রধান পণ্য ছিল সারা ভারতের মশলাপাতি আর পশ্চিমের ঊষর মরুপথে উটে করে বয়ে আনা নানা ধরনের শষ্য, শুকনো মাংস, খেজুর আর পশুলোম দিয়ে হাতে বোনা কাপড়, যা পাড়ি দিতো সুদূর ইংল্যান্ডে এই বন্দর থেকেই। আর কে না জানে, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। এই বন্দর নগরীর সারা বছরের আয়, রাজধানী ভূজের থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি ছিল। কেবল জাহাজ বোঝাই পণ্যের রফতানির বাবদ মান্ডভির জনপ্রতি আয় ভুজের সাধারণ নাগরিকের থেকে চার গুণ বেশি ছিল। ব্যবসার কাজের জন্যে কাঠের নৌকা ও পাল তোলা বড় বড় জাহাজ তৈরি করতে, মান্ডভির কারিগরেরা সারা ভারতেই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বে বিশেষ নাম অর্জন করেছিল। আজকের দিনেও আধুনিক সাজ সরঞ্জাম ব্যাতিত সফল নৌকা বা পাল তোলা জাহাজ (যাকে ইংরাজীতে রিড বোটস বলে) একমাত্র মান্ডভিতেই তৈরি হয়। ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৫-এ, ভারত-ওমান এর মিলিত প্রয়াসে আটজনের একটি দল চার হাজার বছরের পুরোনো বাণিজ্য রাস্তার হারিয়ে যাওয়া পথ পুনঃ অনুসন্ধানের জন্যে ওমান উপকূল থেকে ভেসে পড়ে। আধুনিক উপকরণ ছাড়াই সাধারণ কাঠের পাল তোলা জাহাজ নিয়ে ওমানের 'সুর' বন্দর হতে জাহাজ পাড়ি দেয় মান্ডভির উদ্দেশ্যে। কথা ছিলো ২২ সেপ্টেম্বর ১২ মিটার লম্বা নিওলিথিক যুগের ঐ প্রতিকী নৌকাটি (যার নাম ছিল মাগান), খেজুর, চূণ, শুকনো মাছ, লবণ, তামার বাসনাদি এই সব নিয়ে দ্বারকা হয়ে মান্ডভি পৌঁছাবে। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের নৃতত্ত্ব বিভাগের অলোক ত্রিপাঠি। যাত্রাপথ ছিল ওমান থেকে মেসোপটামিয়া হয়ে আরবিয়ান পেনিনসুলা হয়ে ভারতের পশ্চিম প্রান্তে সিন্ধু সভ্যতার তটরেখা ছোঁয়ার। ১৫-দিনের সময় সীমা নির্ধারিত করা হয়েছিল। কোন ইঞ্জিন ছাড়া, কেবল মাত্র মৌসুমীবায়ুর প্রবাহের ওপর নির্ভরতা রেখে, সাগরের ঢেউ-এর ছন্দ পরিবর্তন মেপে, পাখিদের দেখানো আকাশ পথ অনুসরণ করে এবং সূর্য্য, চাঁদ আর অগণিত তারাদের সঙ্গী করে পথ চিনে নেওয়ার পরীক্ষায় এই যাত্রা শুরু হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ রওয়ানা দেবার ছাব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আকস্মিক দুর্ঘটনায় নৌকাটির সলিল সমাধি হয়। যাত্রীদের সকলকেই অবশ্য প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। 'মাগান' অবশ্য মান্ডভির কারিগরি কুশলতায় তৈরি হয়নি, কেবল বেসিক আইডিয়াটা মান্ডভির ক্রাফটসম্যানশিপ থেকে নেওয়া। এই ধরনের সাগর যাত্রায় যে ধরনের জাহাজ লাগে সেটা বানাবার বংশানুক্রমিক বিদ্যা মান্ডভিতে এখনো বিদ্যমান। নিজের চোখে সুবিশাল কাঠের জলপোতগুলিকে মেরামতি হতে দেখেছি ওখানে, ক্রিকের স্বল্প জলে। আমাদের মতো শহুরে বাবুদের ধারণারও বাইরে এগুলির আয়তন আর বিশালতা।

বাচাউ পৌঁছানোর পর চায়ের জন্যে আবার একটা ব্রেক দিতে হল। চা খেতে খেতে দোকানের মালিকের সঙ্গে ২০০১ সালের কথা ওঠায়, ওর চোখে সেই দিনের ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলির ছবি ভেসে উঠতে দেখলাম। এত অসীম ক্ষতির পরেও এখানকার লোকজন তার সমস্ত সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে যে ভাবে এই অল্প সময়ের মধ্যে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাতে বাহবা না দিয়ে উপায় নেই। এই মনোভাব ওদের প্রগতিশীলতার দাবি করে। মিনিট পনেরো বিশ্রাম নেবার পরে আবার চলার শুরু। শেষ চরণে এখনও ১৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। রাস্তা বেশ ভালো। অবশেষে ভুজ পার করে আমরা সন্ধ্যার কিছুটা আগে মান্ডভির বিচে পা রাখলাম। 'সারা পথের ক্লান্তি আমার, সারা পথের তৃষা'... অসীম জলরাশির সামনে এক লহমায় দূর হয়ে গেল। শান্ত সমাহিত কোন যোগীর মতো মান্ডভির তটরেখা যেন ধ্যানে বসেছে বিদায়ী ভাস্করের শেষ পূজায়। জীবনভোর প্রতিদিনের দেখা এই আলোক পুঞ্জ সাগরের বিশালতার বুকে এক নতুন অর্থ নিয়ে মনের মধ্যে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেল। যেন সমগ্র প্রাণীকূলের চরৈবেতির মন্ত্র নিঃশব্দে ঘোষিত হতে থাকল এই আলোক পুঞ্জের বিচ্ছুরণে। ইঁট কাঠের জ্যামিতিক ছকের বাইরে বেরিয়ে যদি হৃদয়টাকে একটু প্রসারিত করতে হয়, আমার মনে হয় সমুদ্রের নিকটে এসে দাঁড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই। আমরা যে কতটা নগণ্য এই বিপুলতার সামনে তার বোধটুকু উপলব্ধ হয়। সৈকতেই একটা ডরমিটরি টাইপের মোটেলে খোঁজ খবর করতে, ওখানকার ছেলেটি 'মিসুজু রিসর্টের' খবর আর ফোন নম্বর দিল। আলাদা আলাদা কটেজে অনেকটা বাংলো ধাঁচের থাকার আয়োজন। ভাড়া সামান্য বেশি হলেও ঘরগুলো খুব ভালো। একদম নির্জন সৈকতে ফ্যামিলি নিয়ে থাকতে একটু ভয়-ভয়ই পাচ্ছিলাম। মনে মনে হাসি এল, যে সৈকতে কিছুক্ষণ আগে এমন একটা দিব্য অনুভুতির স্বাদ পেয়ে এলাম, মায়ার টানে সে সব কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল? এরই নাম সংসার!


~ মাণ্ডভির তথ্য ~

জিওলজি পড়ার সময় আর চাকরির খাতিরে ভারতের বিভিন্ন দেশ, শহর, গ্রাম ঘুরেছেন হিমাদ্রি শেখর দত্ত। মিশেছেন স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে। বাংলা-ইংরেজির পাশাপাশি স্বচ্ছন্দ অসমিয়া ও গুজরাটি ভাষাতেও। নানা বিষয়ে লেখালখি করাটাই শখ। পাঠকের ভাল লাগলে অবসরের পর লেখালেখি নিয়েই দিনযাপনের ইচ্ছে। প্রকাশিত পুস্তক – 'স্ব' এবং 'এক ছক্কা তিন পুট'।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher