আমেদাবাদ(Ahmedabad)- সুলতান আহমেদ শাহ ১৪১১ খ্রিস্টাব্দে পাটন থেকে সরিয়ে এনে সবরমতী নদীর তীরে কর্ণবতীতে রাজধানী স্থাপন করেন। নাম বদলে হয় আমেদাবাদ। হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যকলার মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন আমেদাবাদ যার নির্দশন আজও বর্তমান। বয়নশিল্পের খ্যাতির জন্য ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার নামেও পরিচিত এই শহর। প্রাচীন নগরীকে ঘিরে রাখা প্রাচীর এখন অবলুপ্ত হলেও বেশ কয়েকটি তোরণদ্বার এখনও আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিল্লি দরওয়াজা, লাল দরওয়াজা, তিন দরওয়াজা, প্রেম দরওয়াজা, রায়পুর দরওয়াজা প্রভৃতি। সবরমতীর তীরে প্রাচীন দুর্গ ভদ্রফোর্ট। দুর্গের ভিতরে রয়েছে ভদ্রকালীর মন্দির। দুর্গে এখন সরকারী নানান অফিস বসেছে। দুর্গের দুপাশে সবরমতীর ওপরে নেহেরু ব্রিজ ও এলিস ব্রিজ। দূরে উত্তরে গান্ধি ব্রিজ ও দক্ষিণে সর্দার ব্রিজ।
শহরের মধ্যে বেশ কয়েকটি পুরনো মসজিদ আছে। লাল দরওয়াজার কাছেই সিদি সৈয়দ জালি মসজিদ। এই মসজিদের জাফরির কাজ অনবদ্য। মসজিদ তৈরিতে হিন্দু ভাস্করদের অবদান থাকায় হিন্দু পুরাণের নানান কাহিনীও উঠে এসেছে মসজিদের চিত্রকল্পে। তিন দরওয়াজার কাছেই জুম্মা মসজিদ। ডানদিকে একটু দূরে মানেক চক-এ রয়েছে রানি সিপরি মসজিদ। কাছেই বাদশা-বেগমদের সমাধিসৌধ বাদশা হাজিরা ও রানিথো হাজিরা। কাছেপিঠে অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে স্বামীনারায়ণ মন্দির, হাতি সিং জৈন মন্দির, গীতামন্দির, সিদি বসির মসজিদে শেকিং টাওয়ার, কাঁকারিয়া লেক ও লেকের পাশে বাল ভাটিকা, চিড়িয়াখানা প্রভৃতি। লেকের মাঝে দ্বীপে এককালীন সুলতানের গ্রীষ্মাবাসে এখন গড়ে উঠেছে অ্যাকোয়ারিয়াম। লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি মিউজিয়াম রয়েছে। এর মধ্যে বয়নশিল্পের ক্যালিকো মিউজিয়াম, ট্রাইবাল মিউজিয়াম, ফোক আর্ট মিউজিয়াম, এন সি মেহতা মিউজিয়াম অব মিনিয়াচার পেন্টিং প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
নদীর ওপারে ৭ কিমি দূরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান মহাত্মা গান্ধি প্রতিষ্ঠিত সবরমতী আশ্রম (Sabarmati Ashrama)।
আমেদাবাদ শহর থেকে ২৩কিমি দূরে গুজরাটের নতুন রাজধানী গান্ধিনগর (Gandhinagar)। এখানেই রয়েছে অক্ষরধাম মন্দির (Akshardham Temple)। এপথে আমেদাবাদ থেকে ১৯ কিমি দূরে আদালজ ভাভ কূপ। ভাভের স্থাপত্যশৈলি দর্শণীয়।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর আমেদাবাদ। আমেদাবাদে কাছেপিঠের দ্রষ্টব্যগুলি পায়ে হেঁটেই ঘুরে নেওয়া যায়। আশেপাশে ঘোরার জন্য রয়েছে অটো বা বাস। ট্যুরিজমের বা বেসরকারি প্যাকেজ ট্যুরেও বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- সবরমতী আশ্রমের কাছে গুজরাট পর্যটনের হোটেল রয়েছে। এছাড়া শহর জুড়ে নানান মান ও দামের হোটেল পাওয়া যায়। থাকার জন্য মিউনিসিপাল গেস্ট হাউস ও বিভিন্ন ধর্মশালাও আছে।
ভুজ (Bhuj) - অতীতে কচ্ছদেশের রাজধানী ছিল ভুজ শহর। ১৫৪৯ খ্রিষ্টাব্দে রাও প্রথম খেংগারজি এই নগরীর পত্তন করেন। হামিরসর হ্রদকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই শহরকে বেষ্টন করে রয়েছে অনুচ্চ পাহাড়ি টিলা। ওরই এক টিলা ভুজিয়া পাহাড়ের মাথায় প্রাচীন দুর্গে এখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ারবেস। প্রাচীর ঘেরা পুরনো শহরের মধ্যেই রয়েছে ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যগুলি। এরমধ্যে রাও লাক্ষা প্রাসাদ, রাও প্রাগমলজির প্রাসাদ, আয়নামহল প্রাসাদ, সরাদবাগ প্রাসাদ, শ্রীস্বামীনারায়ণ মন্দির, আশাপুরা মাতামন্দির, লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির, ফতেহ্ মহম্মদ দরগা, মহম্মদ পান্না মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। হ্রদের তীরে রয়েছে রাজপরিবারের সমাধিসৌধ ছত্রী। তবে একের পর এক ভূমিকম্পে সেগুলি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। সরোবরের একপাশে কচ্ছ মিউজিয়াম। এখানে প্রাচীন নানা সম্পদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকশিল্পের সংগ্রহও দর্শণীয়। ভুজ থেকে উত্তরে গ্রেট রণের দিকে ১৬ কিমি দূরে রুদ্রাণীমাতার মন্দির। আরও ১৪ কিমি দূরে কোটায় স্থানীয় আহিরদের বাড়িতে গিয়ে তাদের হস্তশিল্পের কাজ দেখে আসা বা কেনাকাটা করা যায়। কোটায় রয়েছে এক হাজার বছরের প্রাচীন রাও লাখ ফুলানি শিবমন্দির।
শীতের দিনে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমায় কচ্ছ উপদ্বীপে। প্রচুর ফ্লেমিংগো এবং পেলিক্যান দেখতে পাওয়া যায়।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ভুজ। ভুজের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে আমেদাবাদ, ম্যায়সানা, পালানপুর প্রভৃতি জায়গার যোগাযোগ রয়েছে। ভুজ থেকে সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে আনজার, ভদ্রেশ্বর, মুন্দ্রা ও মাণ্ডবী ঘুরে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- গুজরাট ট্যুরিজমের হোটেল তোরণ রণ রির্সট। এছাড়া বেসরকারি নানা হোটেল রয়েছে। ভুজের এস টি ডি কোডঃ- ০২৮৩২।
কেনাকাটাঃ- কচ্ছের হস্তশিল্পের জন্য খ্যাত আনজার আর তার আশেপাশের গ্রামগুলি। বাটিক প্রিন্ট, বাঁধনি প্রিন্ট আর আজরাখ প্রিন্টের সুদৃশ্য শাড়ি, কাপড় মিলবে এখানে। মাণ্ডবীতেও বাঁধনি শাড়ির কারখানা আছে। আনজার অঞ্চলে গ্রামের কামারশালায় কারুকার্যময় ছুরি, কাঁচি, জাঁতি, তরোয়াল তৈরি হয়।
উৎসবঃ- ৩০ কিলোমিটার দূরে ধ্রাংগ্রামে প্রতিবছর মাঘমাসে আহিরদের উপাস্য মেকনদাদার আশ্রমের কাছে বিশাল মেলা বসে। আঠেরশ শতকে কচ্ছের রাজা রাও দেশালের আমলে রাজগুরু ছিলেন এই মেকনদাদা।
ধোলাভিরা (Dholavira) - গুজরাটে লোথাল ও ধোলাভিরায় সিন্ধুসভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে ধোলাভিরায় অবস্থিত প্রাচীন নগরীটি আকার আয়তনে অনেকটা বড়। ৭৭১ মি লম্বা ও ৬১৭ মি চওড়া এলাকা জুড়ে দুর্গ গড়ে উঠেছিল। চারপাশে ছিল পাথরের চওড়া পাঁচিল। দুর্গের প্রাচীরের বাইরেও নগরী বিস্তৃত ছিল। উন্নতমানের পয়ঃপ্রণালী, পরিকল্পিত নগর নির্মাণকৌশল দেখলে চমৎকৃত হতে হয়। প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া সিলমোহর, মাটির বাসনপত্র, গয়নাগাটি সংগ্রহ করে বিভিন্ন মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে।
যাওয়াঃ- আমেদাবাদ থেকে বাসে সরাসরি ধোলাভিরা যাওয়াই সুবিধাজনক। রেলপথে ভুজ হয়ে সামখিয়ালি স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাসে ঘন্টা চারেকে ধোলাভিরা পৌঁছান যায়। ভুজ থেকে পর্যটন দপ্তরের প্যাকেজ ট্যুরে বা গাড়ি ভাড়া করে ধোলাভিরা বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে।
লিটল রণ ওয়াইল্ড অ্যাস স্যাংচুয়ারি (Little Rann Wild Ass Sanctuary) - লিটল রণ আর আশপাশের বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর মিলিয়ে ওয়াইল্ড অ্যাস স্যাংচুয়ারি। ১৯৭৩ সালে স্যাংচুয়ারির মর্যাদা পায় এই অঞ্চল। ধ্রাংগাধরা বা দশাড়াতে কাঁটাঝোপের প্রান্তরে দেখা মেলে বুনো গাধার। ভারতীয় বুনো গাধা খুবই কষ্টসহিষ্ণু প্রাণী। ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতাতেও রুক্ষ প্রান্তরে বেঁচে থাকে এরা। ঘোড়ার মতই ঘন্টায় ৬০-৭০ কিলোমিটার গতিতে দৌড়তে পারে। লম্বায় ২১০ সেন্টিমিটার, উচ্চতা ১২০ সেন্টিমিটার, ওজন মোটামুটি ২৩০ কিলোগ্রাম। চকচকে সাদা চামড়ায় ঢাকা শরীরে ছাই-বাদামী মেশানো ছোপ, তার ওপরে কালো বা বাদামী দাগ টানা ভারি সুন্দর চেহারা। একা একা বা দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় এরা।
যাওয়াঃ-নিকটতম রেলস্টেশন ভুজ-আমেদাবাদ রেলপথে ১৬ কিলোমিটার দূরে ধ্রাংগাধরা। এখানের বাজানা রেঞ্জটি শীতকালে পাখি দেখার জন্য আদর্শ। ধ্রাংগাধরায় পৌঁছে বনদপ্তরের অনুমতি নিয়ে স্যাংচুয়ারিতে যাওয়া যায়। জিপ ভাড়া পাওয়া যায়। গাইড সঙ্গে নিতে হবে।
৪৫ কিলোমিটার দূরে ভিরামগম রেলস্টেশন। এখান থেকে ছাকদা হয়ে জৈনাবাদ দিয়েও ঢোকা যায়।
অন্যপথে, আমেদাবাদ থেকে রাধানপুরের বাসে দু-আড়াইঘন্টা দূরত্বে ১১০ কিলোমিটার দূরে দশাড়া। এখান থেকেও বনদপ্তরের অনুমতি নিয়ে স্যাংচুয়ারিতে যাওয়া যায়। বেসরকারি কিছু সংস্থাও রণ সাফারিতে নিয়ে যায়।
থাকাঃ- ধ্রাংগাধরায় একটি সরকারি গেস্টহাউস আছে। এছাড়া সর্বত্রই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকা যায়।
লোথাল (Lothal)- সিন্ধুসভ্যতার আরেক শহর লোথাল। ৪৫০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধমাখা প্রাচীরে ঘেরা বন্দরনগরী। গড়ের উপরের দিকের উঁচু অংশে মহেঞ্জোদড়োর মতো বিশালাকার একটি স্নানাগার পাওয়া গেছে। নিচের অংশে ঘরবাড়ি-দোকানপাট। শহরে উন্নত জলনিকাশী ব্যবস্থা ছিল। হরপ্পা ধ্বংসের পাঁচশো বছর পরেও টিঁকে ছিল লোথাল। শেষপর্যন্ত বিধ্বংসী বন্যায় মুছে যায় জনজীবন। লোথালে মাটি খুঁড়ে সিলমোহর, পোড়ামাটির মূর্তি ও তৈজসপত্র, পুঁতির গয়না, ব্রোঞ্জ, তামা, পাথর, হাড়ের তৈরি নানা দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট মিউজিয়ামটিতে এইসব দেখতে পাওয়া যাবে। মেসোপটেমিয়া, পারস্য ও ঈজিপ্টের সঙ্গে লোথালবাসীদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন লোথাল আমেদাবাদ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। বাসে বা গাড়িতেও চলে আসা যায়।
থাকাঃ- লোথালে গুজরাট ট্যুরিজমের হোটেল তোরান।
নল সরোবর বার্ড স্যাংচুয়ারি (Nal Sarovar Bird Sanctuary) - লোথাল থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাখির রাজ্য নল সরোবর। শীতের দিনে দেশবিদেশের পরিযায়ী পাখিদের ঠিকানা।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন আমেদাবাদ ৬৫ কিলোমিটার ও ভিরামগম ৪০ কিলোমিটার দূরে। স্যাংচুয়ারিতে প্রবেশের জন্য বনদপ্তরের অনুমতি লাগে।
থাকাঃ- গুজরাট ট্যুরিজমের হোটেল তারান আর ফরেস্ট রেস্ট হাউস।
সপুতারা (Saputara)- গুজরাটের একমাত্র শৈলাবাস। সহ্যাদ্রি পাহাড়ের কোলে আদিবাসী অধ্যুষিত বনপাহাড়ি শান্তির ঠিকানা। সানসেট পয়েন্ট থেকে দেখা অপরূপ সূর্যাস্ত মনে আঁকা হয়ে যায়। অন্যান্য দ্রষ্টব্য নাগেশ্বর মহাদেবের মন্দির, রোজ গার্ডেন, মিউজিয়াম, ডাংস ফরেস্ট, গীরা জলপ্রপাত প্রভৃতি। সপুতারা লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ওয়াঘাই ৫১ কিলোমিটার দূরে। পশ্চিম রেলপথের বিলিমোরিয়া-ওয়াঘাই ন্যারোগেজ লাইনে। তবে আমেদাবাদ, নাসিক, সুরাট, মুম্বাই যেকোনো দিকদিয়ে এলেই বিলিমোরিয়ায় নামা সুবিধাজনক। এখান থেকে সপুতারা যাওয়ার সরাসরি বাস পাওয়া যায়। সপুতারা থেকে নাসিক রোড ৬৮ কিলোমিটার, সুরাট ১৬৪ কিলোমিটার, আমেদাবাদ ৪০৯ কিলোমিটার, মুম্বাই ২৫০ কিলোমিটার, ও ভদোদরা ৩০৯ কিলোমিটার।
থাকাঃ- গুজরাট ট্যুরিজমের হোটেল তোরান ও ফরেস্ট লগ হাট আছে।
নারায়ণ সরোবর-লাখপাত (Narayan Sarovar - Lakhpat) - প্রাচীন তীর্থ নারায়ণ সরোবর। মন্দির এলাকা প্রাচীর ঘেরা। মন্দিরচত্ত্বরে রয়েছে আদিনারায়ণ, গোবর্ধননাথ, দ্বারকানাথ, লক্ষ্মী-নারায়ণ প্রভৃতি সাতটি মন্দির। দুর্গের পাথর কুঁদে তৈরি রামগুম্ফা, লক্ষ্মণগুম্ফা, শেষগুম্ফা প্রভৃতি সাধনাস্থল। মন্দির এলাকার বাইরে নারায়ণ সরোবর চিঙ্কারা স্যাংচুয়ারি। নারায়ণ সরোবর থেকে ২ কিমি দূরে কোটিশ্বর শিবমন্দির। সমুদ্রের খাঁড়ির গায়ে নিরালায় পাহাড়ি পরিবেশে ভারি সুন্দর জায়গায় মন্দিরের অবস্থান। এই সমুদ্র খাঁড়ির একেবারে শেষপ্রান্তে লাখপাত-একসময়ের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। সমুদ্রের তীরে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আর অপরূপ কারুকার্যমণ্ডিত প্রাচীন মন্দির-মসজিদ এখানের দ্রষ্টব্য। ভুজ থেকে আসার পথে ৮০ কিমি দূরে আশাপুরা মাতার প্রাচীন মন্দির।
যাওয়াঃ- ভুজ থেকে নারায়ণ সরোবর ও লাখপাতের দূরত্ব যথাক্রমে ১৪৭ কিমি ও ১৩২ কিমি। গাডুলিতে এসে রাস্তা দু'ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে।
গাডুলি থেকে নারায়ণ সরোবরের দূরত্ব ৩৪ কিমি আর লাখপাত ১৯ কিমি। ভুজ থেকে মোটামুটি ৪-৫ ঘন্টায় যেকোনটাতেই পৌঁছে যাওয়া যায়।
থাকাঃ- নারায়ণ সরোবরে মন্দিরের ধর্মশালায় থাকতে হবে।
মাণ্ডবী (মাণ্ডভি) - মুন্দ্রা (Mandvi - Mundra) - ভুজ শহরের দক্ষিণে কচ্ছ উপসাগরের তীরে প্রাচীন দুই বন্দর। মাণ্ডবী থেকে মুন্দ্রার দূরত্ব ৫৫ কিমি। বন্দরের জনপ্রিয়তা আজ ততো না থাকলেও জাহাজ তৈরি হয় এখনও। অতীতের বন্দর নগরী আজ বিচ রিসর্ট - জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত মাণ্ডবী। ভুজ শহরের প্রতিষ্ঠাতা রাও খেংগারজি মাণ্ডবী বন্দরটির প্রতিষ্ঠা করেন। রুক্মাবতী নদীর মোহনায় জাহাজঘাটার কাছে বন্দরের গায়েই শহর। প্রাচীনকালে শহরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এখনও সেই প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। শহরে দ্রষ্টব্য বিজয়বিলাস প্যালেস ও হাওয়ামহল। প্যালেসটি শহরের বাইরে, সমুদ্রের কাছে। বিশাল সাদা রঙের প্রাসাদ দূর থেকেই দেখা যায়। এখানে 'হাম দিল দে চুকে সনম'-এর শ্যুটিং হয়েছিল। প্যালেস সংলগ্ন খোলা জায়গায় 'লাগান' সিনেমার ক্রিকেট ম্যাচের শ্যুটিং হয়েছিল। এখানকার বাঁধনি শাড়ি কেনাকাটার তালিকায় রাখার মতো।
খেবরি ও ভুখি নদীর সঙ্গমে মুন্দ্রা বন্দর। মুন্দ্রা শহর থেকে বন্দর ১০ কিমি দূরে। এ দুয়ের মাঝে বিস্তীর্ণ কচ্ছের রণ (Rann of Kutch)। ভুজ থেকে মুন্দ্রা আসার পথে ২০ কিমি দূরত্বে কেরা-য় নাগমতী নদীর তীরে লাখেশ্বর শিবমন্দির ও কপিলকোট দুর্গ। মুন্দ্রা থেকে পূর্বদিকে ২২ কিমি দূরে জৈনতীর্থ ভদ্রেশ্বর।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলওয়ে স্টেশান নিউ ভুজ, গান্ধীধাম। সড়কপথে (জাতীয় সড়ক ৮-ক) আমেদাবাদ থেকে ৫৫০ কিমি - ভুজ অবধি ৩৫০ কিমি,ভুজ থেকে ২০০ কিমি ( রাজ্য সড়কে), গান্ধীধাম স্টেশান থেকে ৫০ কিমি। আমেদাবাদ থেকে ট্রেনে গান্ধিধাম পৌঁছে বাসে মাণ্ডবী যাওয়া যায়। আবার সরাসরি বাসে আমেদাবাদ থেকে মাণ্ডবী পৌঁছান যায়। ভুজ থেকেও ঘন্টাদেড়েকে মাণ্ডবী চলে আসা যায়। মাণ্ডবী থেকে বাসে, অটোয় ঘুরে নেওয়া যায় মুন্দ্রা।
থাকাঃ- মাণ্ডবীতে গুজরাট ট্যুরিজমের তোরণ বিচ রির্সট ও কয়েকটি বেসরকারি হোটেল আছে।
উৎসবঃ- ফাল্গুন মাসে ভদ্রেশ্বরে পার্শ্বনাথের মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে বড় মেলা বসে।
ভ্রমণ কাহিনি - || মাণ্ডভির সৈকতে ||
মধেরা-পাটন (Madhera - Patan) - অষ্টম শতকে সোলাঙ্কি রাজা প্রথম ভীমদেবের তৈরি অসাধারণ স্থাপত্য-ভাস্কর্যের সূর্যমন্দিরের ধ্বংসাবশেষের জন্য বিখ্যাত মধেরা। সংলগ্ন মিউজিয়ামেও মন্দিরের বেশকিছু মূর্তি রয়েছে। পাটনে দ্রষ্টব্য প্রাচীন জৈনমন্দির, সহস্র জ্যোর্তিলিঙ্গ মন্দির ও সাততলা রানি-কি-ভাও কূপ। পাটোলা সিল্ক শাড়ির জন্যও খ্যাতি রয়েছে পাটনের।
যাওয়াঃ-নিকটতম রেলস্টেশন ম্যায়সানা। আমেদাবাদ থেকে ম্যায়সানার দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটার। ম্যায়সানা থেকে মধেরার দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। মধেরা থেকে পাটনের দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার। পাটন থেকে ম্যায়সানার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। ম্যায়সানা থেকে বাসে বাসে বা গাড়িতে বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- মধেরা ও পাটনে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে।
রাজকোট (Rajkot) - মহাত্মা গান্ধির ছেলেবেলার শহর পশ্চিম গুজরাটের রাজকোট। এখানে দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে গান্ধিজির বাড়ি যা বর্তমানে বালমন্দির স্কুল, গান্ধি মিউজিয়াম, ওয়াটসন মিউজিয়াম, রামকৃষ্ণ মিশন, লালপরি লেক প্রভৃতি।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন রাজকোট। আমেদাবাদ ও ভুজ থেকে দূরত্ব যথাক্রমে ২১৬ কিমি ও ২৪৫ কিমি।
থাকাঃ- রাজকোটে বেসরকারি অনেক হোটেল ও ধর্মশালা আছে।
জুনাগড় (Junagarh)- খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে জুনাগড়ের প্রাচীন দুর্গটির নির্মাণ হয়। টিলার ওপরে দুর্ভেদ্য এই দুর্গটি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। দুর্গের মধ্যে রয়েছে সেই সময়কার বৌদ্ধবিহার ও পরবর্তীকালে মুসলমান শাসনকালে তৈরি মসজিদটি।
দুর্গের অভ্যন্তরে বিশাল শস্যভান্ডার এবং নওগড় কুয়া ও আধি চাষি বাউরি নামক জলভান্ডারদুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। খাদ্য ও পানীয়ের অভাব ঘটেনি বলেই বহুকাল দুর্গের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন হিন্দু রাজারা। সম্রাট অশোকের সমসাময়িক শিলালিপিও উদ্ধার হয়েছে জুনাগড়ে। দুর্গ থেকে গিরনার পাহাড়ের ওপরে দ্বাদশ শতকে তৈরি জৈনমন্দিরটি দেখা যায়। জৈনমন্দিরের পাশাপাশি অম্বামাতার হিন্দুমাতার মন্দিরও রয়েছে পাহাড়চূড়োয়। ৯,৯৯৯টি সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছতে হবে পাহাড়ের মাথায়। শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে রঙমহল প্রাসাদ, মহব্বত মকবারা, ড্যাম, সোলাপুরী শ্মশান, অশোকের শিলালিপি, বাগেশ্বরী মন্দির, দামোদর কুণ্ড, মুচকুন্দ গুম্ফা, শখের বাগ চিড়িয়াখানা ও মিউজিয়াম।
জুনাগড় থেকে ঘন্টাদুয়েকের সড়কযাত্রায় পৌঁছে যাওয়া যায় গির অরণ্যে (Gir Forest)। ৬০ কিমি দূরে শাসনগির - গির অরণ্যের এন্ট্রিপয়েন্ট। শাসনগিরের ফরেস্ট অফিস থেকেই অরণ্যে ঢোকার পারমিট করতে হবে ও গাইড নিতে হবে। সকালে-বিকেলে ঘন্টা তিনেক করে জঙ্গল সফর হয়। জুনাগড় থেকে ট্যুরিজমের প্যাকেজ ট্যুরেও গির অরণ্যে বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন জুনাগড়। সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে রাজকোট, আমেদাবাদ, সোমনাথ, উনা, পোরবন্দর, দ্বারকা প্রভৃতি শহরের সঙ্গে। জুনাগড়ের থেকে রাজকোট ও সোমনাথের দূরত্ব যথাক্রমে ৯৯ কিমি ও ৮০ কিমি।
থাকাঃ- জুনাগড়ে গুজরাট ট্যুরিজমের হোটেল গিরনার। এছাড়াও বেসরকারি বেশ কয়েকটি হোটেলও আছে। গির-এ রয়েছে ট্যুরিজমের লায়ন সাফারি লজ এবং ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সিংহদমন লজ।
সোমনাথ (Somnath) - সোমনাথের মন্দির বলতেই ছেলেবেলায় পড়া ইতিহাস বইয়ের পাতা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ভারতের অন্যতম তীর্থ ও ঐশ্বর্যশালী এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় মার্কোপোলো, আলবিরুনির মতো পর্যটকদের লেখায়। যুগের পর যুগ ধরে হানাদারদের হাতে বারবার ধ্বংস হয়েছে সোমনাথের মন্দির, লুন্ঠিত হয়েছে ১৭ বার। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবও এই মন্দির ধ্বংস করেন। বারবারই নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে ভারতের ঐতিহ্যশালী এই মন্দির। স্বাধীনতার পরে সর্দার বল্লভাই প্যাটেলের উদ্যোগে মন্দিরটির পুননির্মাণ করা হয়।
সমুদ্রতীরে মহামেরু মন্দিরটি সোমনাথের প্রধান দ্রষ্টব্য। অন্যান্য দর্শণীয়ের মধ্যে রয়েছে পুরোনো মন্দির, পরশুরামের তপোভূমি, প্রাচীন সূর্যমন্দির, আদি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত সারদামঠ, পাণ্ডবগুহা, গীতা ভবন, প্রভাসতীর্থ, ভালুকার কৃষ্ণমন্দির প্রভৃতি।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ৬ কিমি দূরে ভেরাবল। রাজকোট বা জুনাগড় থেকে এক্সপ্রেস বাসেও সোমনাথ পৌঁছান যায়।
থাকাঃ- ভেরাবল ট্যুরিজমের তোরণ ট্যুরিস্ট লজ রয়েছে। এছাড়া সোমনাথে মন্দিরের নিজস্ব গেস্ট হাউস বা ধর্মশালায় থাকার ব্যবস্থা আছে। বেসরকারি হোটেলও আছে।
পোরবন্দর (Porbandar) - গান্ধিজির জন্মস্থান পোরবন্দর। তাঁর সেই বাড়ি এখন গান্ধি কীর্তিমন্দির - এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য। অন্যান্য দর্শণীয়ের মধ্যে রয়েছে বিবেকানন্দর স্মৃতিবিজরিত স্বামীজী স্মৃতি মন্দির, সুদামার প্রাসাদমন্দির, ভারত মন্দির, বার্ড স্যাঙ্কচুয়ারি, লায়ন স্যাঙ্কচুয়ারি প্রভৃতি।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন পোরবন্দর। সোমনাথ, দ্বারকা ও জামনগরের দূরত্ব যথাক্রমে ১২৮ কিমি, ১২২ কিমি, ১৩১ কিমি।
থাকাঃ- থাকার জন্য এখানে রয়েছে গুজরাট ট্যুরিজমের তোরণ ট্যুরিস্ট বাংলো ও বিভিন্ন বেসরকারি হোটেল।
দ্বারকা (Dwarka) - হিন্দুতীর্থ দ্বারকার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের পৌরাণিক কাহিনী। দ্বারকাধীশ মন্দিরের ভাস্কর্যও অপরূপ। কৃষ্ণ ছাড়াও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে মন্দিরে। মন্দিরের সামনের প্রবেশপথ স্বর্গদ্বার। পিছনে মোক্ষদ্বার দিয়ে বেরিয়ে নীচে গোমতী নদীর ঘাট। দ্বারকা জুড়ে অজস্র মন্দির আছে, যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল-গোমতীর ধারে আরেকটি কৃষ্ণমন্দির, সমুদ্র সৈকতের কাছে ভাড়কেশ্বর শিবমন্দির, গোমতী ও সাগরসঙ্গমে সঙ্গম নারায়ণ মন্দির, পঞ্চনদ তীর্থ, সারদা মঠ, ভদ্রকালীর মন্দির, রুক্মিণীমাতার মন্দির।
সমুদ্রের মাঝে ভেটদ্বারকা দ্বীপ। ওখা থেকে লঞ্চে মিনিট কুড়ির সমুদ্রযাত্রায় ভেটদ্বারকা পৌঁছে যাওয়া যায়। দ্বারকা থেকে বাসে ঘন্টাখানেকের দূরত্বে ওখা। পথে পড়বে মীরাবাঈ মন্দির, গোপীতালাও এবং নাগেশ্বর মহাদেব মন্দির। ভেটদ্বারকায় রণছোড়জির মূল মন্দির ছাড়াও কৃষ্ণমন্দির, শঙ্খতালাও, হনুমান দাণ্ডি সৈকত, পদ্মতীর্থ, রামদ্বারকা, হাজি করমা প্রভৃতি দর্শণীয়।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন দ্বারকা। দ্বারকার থেকে সোমনাথ, পোরবন্দর, জামনগর ও আমেদাবাদের দূরত্ব যথাক্রমে ২৫০ কিমি, ১২২ কিমি, ১৩৭ কিমি ও ৪৫০ কিমি। দ্বারকা থেকে কন্ডাক্টেড ট্যুরেও ওখা-ভেটদ্বারকা বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- দ্বারকায় গুজরাট ট্যুরিজমের তোরণ ট্যুরিস্ট বাংলো, নানান বেসরকারি হোটেল, ধর্মশালা, ভারত সেবাশ্রমের অতিথিশালা প্রভৃতি রয়েছে।
জামনগর (Jamnagar) - ষোড়শ শতাব্দীতে জাদেজা রাজপুতেরা জামনগরের পত্তন করেন। শহরের কেন্দ্রে সুরসাগর হ্রদের দ্বীপে গ্রীষ্মকালীন রাজআবাস এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মিউজিয়াম। হ্রদের পাশে সাজানোগোছানো পার্কে বেড়াতেও ভালোলাগে। শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে রাজবাড়ি, প্রাচীন কালীমন্দির, হনুমান মন্দির, জৈনমন্দির, সিটি লেক অ্যাকোয়ারিয়াম। কিছুটা দূরে মেরিন মিউজিয়াম। শহর থেকে ১০ কিমি দূরে খিজাদিয়া লেক ও বার্ড স্যাংচুয়ারি। শীতে পরিযায়ী পাখিদের ঠিকানা। জামনগর থেকে ৩০ কিমি দূরে পিরোটান দ্বীপে মেরিন ন্যাশনাল পার্ক।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন জামনগর। রাজকোট থেকে জামনগরের দূরত্ব ৯০ কিমি। মেরিন ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে হলে বনদপ্তরের অনুমতি লাগবে।
থাকাঃ- জামনগরের বেসরকারি হোটেল বা ধর্মশালায় থাকতে হবে।