মুন্সিয়ারির আত্মীয়তায়
সুমন্ত মিশ্র
~ মুন্সিয়ারির তথ্য ~ মুন্সিয়ারির আরও ছবি ~
জীপটা একটানা গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে বাঁকের পর বাঁক ঘুরে ওপরে উঠছে। ডান দিকে অনেক নিচে গৌরীগঙ্গার আঁকা-বাঁকা পথ, বাঁদিকে খাড়া পাথরের দেওয়াল, তার বুক চিরে কিছু গাছ সোজা ওপরে উঠে উঁকি দিচ্ছে আরও, আরও ওপরে কী আছে তা চাক্ষুষ করতে। জীপের গোঁ গোঁ আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার দূরের কোনো গ্রামে বেজে চলা মাদলের দিম্ দিম্ আওয়াজ। জীপের শব্দ যেখানে একটু কম, সেখানে মাদলের আওয়াজের সঙ্গে ভেসে আসছে মনমাতানো পাহাড়ি সুর - এমনই সুরেলা অভ্যর্থনায় কিছুটা বিস্ময়াবিষ্ট হয়েই আমার মুন্সিয়ারি পদার্পণ।
সচরাচর ট্রেক শেষ হওয়ার পর কোনও জায়গা-ই আমাকে সেভাবে আকর্ষণ করে না, তা সে যতই মনমুগ্ধকর হোক। নেহাৎ রাত্রিবাসের তাগিদে এক একটা জায়গা পার হয়ে ফিরে আসি বাড়িতে। পরে অবশ্য অনুতাপ হয় - যতটা অবজ্ঞা করেছি ওই জায়গাগুলোকে ততটা বোধহয় প্রাপ্য ছিলনা ওদের। সেবার গিয়েছিলাম 'দরমা ভ্যালি' বা 'পঞ্চচুলি বেসক্যাম্প' ট্রেক। ২০০৭-এ বাবাকে হারানোর পর হিমালয়ের গভীর অন্দরে আবার পথচলা। সেটা ২০০৯ - আমার প্রথম 'সোলো ট্রেক'। সম্ভবত দীর্ঘ তিন বছর বিচ্ছেদের পর হিমতীর্থ হিমালয়ও চেয়েছিল আমাকে একান্ত একা করেই, নইলে পাঁচ দিনের সারাটা পথ অমন পর্যটকশূন্য থাকবে কেন? সেও তো প্রথমবার। হিমপ্রকৃতির চড়াই উৎরাইয়ে দু'জনে কথা বলেছিলাম অনর্গল। পায়ে পায়ে পথচলা শেষ করেই ফিরে চলার পথে এক রাত্রিবাস ওই মুন্সিয়ারিতে।
জীপের মাথা থেকে স্যাক নামিয়ে শহরটা যেটুকু দেখা যায় একটু চোখ বোলালাম – বেশ বড় শহর, ভালো লাগল অনেক সবুজ এখনও অবশিষ্ট আছে দেখে। পিঠে স্যাক গলিয়ে হাঁটা দিলাম আরও কিছুটা ওপরে কুমায়ুন মন্ডলের গেস্ট হাউসের দিকে। পথ চলছি, কিন্তু চোখ সেই পঞ্চচুলির দিকে, পরিষ্কার নীল আকাশের নিচে শ্বেতশুভ্র পঞ্চশিখর, কানে ভেসে আসা পাহাড়ি সুর কথা খুঁজে পায় -"তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না"। সত্যিই, জীবনের সেই কোন সকালে দেওয়া তার ডাকে এই মধ্য চল্লিশেও ফিরে আসি বারবার।
গেস্ট হাউসের রিসেপশন জানাল –'নো রুম'। আমি একা, এবং এতটা ট্রেক করে ফিরছি শুনে অবশ্য একটা উপায় বের হল - বেসমেন্টে ওঁদের দু'টি ডরমিটর' আছে, দু'টিতেই আটটি করে 'বেড'। আমাকে যে ডরমেটরিতে থাকতে দেওয়া হল, ওঁরা ঠিক করলেন সেদিন এরপর কোনো গেস্ট এলে পাশের ঘরটাতেই তাঁদের থাকতে দেবেন, একান্ত সেটাও ভর্তি হয়ে গেলে তবেই ওঁরা আমার বরাদ্দ ঘরটিতে অন্যদের জায়গা দেবেন। আব্দার এল - ট্রেকের সমস্ত ছবি ওঁদের দেখাতে হবে, আর কেমন করে সেখানে গেলাম তার বর্ণনা দিতে হবে। আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে গেল, সানন্দে রাজি হলাম। নিজের রুমে গিয়ে দু'দিকের জানলার পর্দা সরালাম - সামনেই দিগন্ত জোড়া পঞ্চচুলি, মন ভরে গেল। টুকরো টুকরো সাদা মেঘ যেন চৈত্রের বুড়ির চুলের মতো ওর মুখের সামনে উড়ে বেড়াচ্ছে। গত সাত দিনে দূর থেকে, সামনে থেকে, এপার থেকে, ওপার থেকে দেখে দেখেও যেন আশ আর মেটেনা। সম্বিত ফেরে - "পিনে কা পানি সাব" আওয়াজে। ঘড়ি দেখি, বেলা দুটো, পেট চুঁইচুঁই, তাড়াতাড়ি 'ফ্রেশ' হয়ে বের হই।
বের হয়তো না হলেও চলতো, খাবার গেস্ট হাউসেও পাওয়া যেত। কিন্তু কাল রাত্রি থেকেই মনে সাধ জেগেছে চিংড়ি সহযোগে মধ্যাহ্নভোজ সারার – দিনটা ২৬ অক্টোবর আর সালটাতো আগেই বলেছি, মোহনবাগান সমর্থক মাত্রই বুঝতে পারবেন কেন সেদিন আমার মন চিংড়ির জন্য অমন ব্যাকুল ছিল। এর বেশি আর নাই বা বললাম। তবে সে সাধ আমার অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল। মোটামুটি সমস্ত বড় হোটেলে খোঁজ করে ব্যর্থ হয়ে, বেলা তিনটেয় চাইনিজ খাবারে পরিতৃপ্তি।
খাওয়ার পরেই ইচ্ছে হল শহরটার একেবারে মাথায় চড়ে বসার। ধীর পায়ে উঠতে থাকলাম পাহাড়ি পথ ধরে। বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ উঠে এলাম সব ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে মুন্সিয়ারির মাথায়। বসলাম তার সুদৃশ্য সবুজ টুপিতে - পঞ্চচুলির মখোমুখি। সূর্য ডোবার পালায় তখনও বেশ কিছুটা দেরি।
একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম পঞ্চচুলি ও ওর সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে, একেবারে বাঁদিকে সুন্দরী 'রম্ভা', মাঝে নাম না জানা কালো পাথরের এক শৃঙ্গ, তারপর পরপর পাণ্ডবদের পাঁচ চুলা – পঞ্চচুলি। প্রায় মিনিট কুড়ি একভাবে বসে থাকার পর লক্ষ্য করলাম আমার উঠে আসা পথেই আসছেন আরও কিছু আগন্তুক। কাছে আসতে বুঝলাম বিদেশি পর্যটক - একজন পুরুষ, দু'জন মহিলা। ভালো লাগল ওঁরা নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত নিচু গলায় কথা বলছেন দেখে। প্রকৃতি যেখানে ধ্যানমগ্ন সেখানে অহেতুক হাঁকডাক যে শিষ্টাচার পরিপন্থী এটা আমরা ভারতীয়রা কেমন করে জানি ভুলে যাই। অবশ্য যাঁরা আত্মবিস্মৃত জাতি, তাঁদের এমন বিস্মরণ স্বাভাবিক বৈকি। দেখতে দেখতে শুরু হল বরফের চূড়ায় চূড়ায় সূর্যাস্তের শেষ আলোর মায়াবী খেলা। ছবি তুললাম অনেকক্ষণ। গোধূলির রঙে ধরণীর স্বপ্নের রূপ প্রত্যক্ষ করে নেমে এলাম আজকের ডেরায় – কে.এম.ভি.এন. গেস্ট হাউস।
সন্ধ্যে সাতটায় ক্যান্টিনে ঢুকতেই হই হই করে সবাই ঘিরে ধরল। ক্যামেরা খুলে ছবি দেখালাম, সঙ্গে গল্পের স্রোত ভেসে যেতে লাগল পাহাড় থেকে পাহাড়ে। রাতের খাওয়া সেরে সাড়ে আটটাতেই বিছানার আশ্রয়। ঘুম আসার আগে বারবার মনে পড়ছিল ক্যান্টিনে ঘিরে থাকা মুখগুলো - ভাবছিলাম, আত্মীয় বলে জানি যাঁদের, এমন আন্তরিকতা কি তাঁদের কাছেও পেয়েছি কোনোদিনও!
মোবাইলের আ্যালার্ম বাজল - ভোর চারটে। মুখ ধুয়ে, টুপি, গ্লাভস, জ্যাকেট চাপিয়ে, মোটামুটি কল্পনার ইয়েতির মতো একটা সাজসজ্জা করে বেরিয়ে পড়লাম গতকাল বিকেলের গন্তব্যের দিকে। পাকদণ্ডির মুচমুচে বরফ ভেঙে উঠে এলাম চেনা জায়গাটিতে। প্রতীক্ষা সূর্যোদয়ের - পঞ্চচুলির দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা যেন - "এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত / এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত"। পাঁচটা বাজতে এখনও কিছুটা দেরি, পূবের আকাশ কিছুটা ফিকে হলেও আমার চারপাশে জমাট অন্ধকার, তারাদের আড্ডায় সব আকর্ষণ কি আজ বিচিত্র সাজের আমিই? সকলেই যেন চেয়ে রয়েছে আমারই মুখপানে! মুন্সিয়ারির ঘুম ভাঙতে হয়তো আরও কিছুটা দেরি – এমনটা ভাবতে ভাবতেই নীচ থেকে একটা আলোক বিন্দু এগিয়ে আসতে দেখলাম। তা থেমে গেল আমার থেকে কিছুটা দূরেই।
সময় দ্রুত পেরোচ্ছে, যেকোনও মূহূর্তে সূর্যের প্রথম কিরণ রাঙা হয়ে ঝাঁপ দেবে পঞ্চচুলির শিখর থেকে শিখরে। – ক্যামেরায় চোখ রাখি, ছবি নিই, তবে মন ভরেনা। পাহাড়ের মাথা টপকে সূর্যদেব পূর্ণ প্রকাশিত হতেই ফিরে যাওয়ার পালা, কয়েক ধাপ নামতেই চোখে পড়ল গতকালের সেই বিদেশি পর্যটক - ভোরের অন্ধকারে চলমান আলোকবিন্দু। আজ কোনো সঙ্গী ছাড়াই। বেচারি বেশ সমস্যায় পড়েছেন মনে হল, এক হাতে ক্যামেরা নিয়ে একটা উঁচু ঢিবি থেকে নামতে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত। কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। পথ চলতে আলাপ জমে উঠল। ভদ্রলোকের নাম 'জন', আমাদের দেশে নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত। তাঁর এক বন্ধু থাইল্যান্ড থেকে সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছেন। বন্ধুদের নিয়ে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী কুমায়ুন ভ্রমণে বেরিয়েছেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ আগ্রহী হয়ে আমার তোলা ছবি দেখতে চাইলেন। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে স্ক্রিনে সব দেখালাম। গতকালের সূর্যাস্তের ছবি দেখে একেবারে আত্মহারা। বিশ্বাসই করতে চাননা কোনো আলাদা 'ফিল্টার' ব্যাবহার না করেই এমন ছবি উঠেছে। শেষমেশ ওঁর ক্যামেরাতেই পঞ্চচুলির সঙ্গে একটি ছবি তুলে দিয়ে তবে নিস্তার মিলল। আবার পথচলা। আমার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতেই আবার গল্প জমল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা কাল সারাদিন এখানে একটা ড্রামের আওয়াজ পেয়েছ?" হ্যাঁ বলতেই বললেন, "আমি ওই আওয়াজটা অনুসরণ করে কাল নিচের একটা গ্রামে গিয়েছিলাম", জানতে চাই, গিয়ে কি দেখলেন? বলেন, "আরে আমি তো তাজ্জব বনে গেছি, দেখি পুজোর নাম করে ওঁরা জীবহত্যা করছে।" তারপরই আমায় প্রশ্ন করেন, -"আচ্ছা তোমাদের ধর্ম কি জীবহত্যার কথা বলে?" কি বলব! আমার দেশের ধর্মই যে বলে, 'আত্মবৎ সর্বভূতেষূ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি' - সকল প্রাণীকে আত্মবৎ যে দেখে, সেই যথার্থ দেখে। কারণ সে জগতের সমস্ত পার্থক্যের মধ্যে পরম সত্য কে দেখে। আমি আমার মত করে সাহেবকে বোঝাই - সমস্ত দেশে, সমস্ত কালে মানুষ তার তাৎক্ষণিক সুখের কারণে ধর্মের উপদেশ অগ্রাহ্য করেছে, আমার দেশের সাধারণ মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। পার্থক্য একটাই, এমন সুখের দিনেও তাঁরা অন্যদের মতো পরমেশ্বরকে বিস্মৃত হন না। এমন দিনেও ওঁরা ইষ্টদেবের পূজার্চনা করেন। সাহেব কী বুঝল জানিনা, তবে সম্মতির অভিব্যক্তি লক্ষ্য করলাম।
জন আজ যাবেন 'চৌকরি'। আমি যাব 'লোহাঘাট', সেখান থেকে মায়াবতী আশ্রম ঘুরে টনকপুর, লখনউ হয়ে বাড়ি। জনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম গেস্ট হাউসের গেটে। বিদায় নিলাম আন্তরিক উষ্ণতায় ভরিয়ে দেওয়া গেস্ট হাউসের প্রতিটি মানুষের কাছে। পথে যেতে যেতে মনে পড়ছিল আমার দেশের মাটি থেকে উঠে আসা ক'টি কথা, - অসতো মা সদগময়/তমসো মা জ্যোতির্গময়/মৃত্যোর্মামৃতং গময়, - অসত্য হতে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে আমাকে জ্যোতিতে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে আমায় অমৃতে নিয়ে যাও, - জানিনা আমার দেশের মানুষজন এই প্রার্থনাটি সমস্ত জীবন দিয়ে কবে খুঁজে পাবেন।
আমিও কি খুঁজে পাব কোনোদিন?
~ মুন্সিয়ারির তথ্য ~ মুন্সিয়ারির আরও ছবি ~
অ্যাকাউন্টেন্সির ছাত্র সুমন্ত কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস্ থেকে কম্পিউটার সার্টিফিকেট কোর্সের শেষে কিছুদিন দিল্লিতে একটা চাটার্ড ফার্মে কাজ করে বর্তমান ঠিকানা দুর্গাপুরে ফিরে আসেন। এখন সেলফ্ এমপ্লয়েড, - 'হরফ' নামে একটি প্রিপ্রেস ইউনিট চালান। হিমালয়ের আতিথ্য গ্রহণ ও ফুটবল খেলার দৃষ্টিসুখ তাঁকে অসীম তৃপ্তি দেয়। ভালোবাসেন রবি ঠাকুরের গান শুনতে, প্রবন্ধ পড়তে, ছোটগাছকে বড় করতে, বেড়াতে আর নানারকমের মানুষের সাহচর্য পেতে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় 'আমাদের ছুটি' কিছু সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়ায় আনন্দিত হয়েছেন।