ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - হিমালয়ের ডায়েরি (অষ্টম পর্ব)
যমুনোত্রীর পথে – গোমুখ থেকে উত্তরকাশী
সুবীর কুমার রায়
পূর্বপ্রকাশিতের পর -
আবার সেই কষ্টকর রাস্তা। এবার আবার সঙ্গে খাবার জলও নেই। লালবাবার ভিজিটিং কার্ডে কলকাতায় কখন, কোথায়, কোন সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করা যাবে - সব লেখা আছে। এরকম একজন মানুষকে একবার দেখতে না পাওয়ায়, মনে একটা দুঃখ নিয়েই ফিরতে হচ্ছে। ঠিক করলাম কলকাতাতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করব। গতকাল এ রাস্তার শেষ অংশে খাড়া উতরাই নামতে হয়েছিল। বেশ আরামে, বিনা কষ্টে প্রায় ছুটেই নেমেছিলাম। আজ ওপরে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এর আগেও লক্ষ্য করেছি, নতুন কোন জায়গায় যাওয়ার সময় খুব কষ্টকর রাস্তাও খুব একটা কষ্টকর বলে মনে হয় না। অথচ ফিরবার সময় যেন আর হাঁটার শক্তি বা ইচ্ছা থাকে না। তখন যেন কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। মাধব আর দিলীপ অনেক এগিয়ে গেছে। আমি সেই বিপজ্জনক রাস্তাটার কয়েকটা ছবি তুলব ভেবে আস্তে আস্তে ওদের অনেক পিছনে পিছনে হাঁটছি। এইভাবে এক সময় সেই ধুলো-পাহাড়, যেখানে বড় বড় পাথর অনবরত নীচে নেমে এসে গভীর খাদে গড়িয়ে পড়ে, যেখানে আসবার সময় মাধবের কৃপায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি, সেই জায়গায় এসে পৌঁছলাম। দেখি মাধব ও দিলীপ দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকার কারণ অন্য কিছু নয়, ওই সরু বিপজ্জনক রাস্তায়, লাইন দিয়ে পরপর এক পাল গরু হেঁটে চলেছে। বিপজ্জনক রাস্তাটার ওদিক থেকে এদিক পর্যন্ত, সারিবদ্ধ গরুর পাল। যাচ্ছে গঙ্গোত্রীর দিকেই। হয়তো চিরবাসা বা অন্য কোথাও যাবে। একেবারে পিছনে একটা লোক, সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে। গরুগুলো একটুও এগোচ্ছে না। ওরা না এগোলে, আমাদের পার হয়ে যাবার উপায় নেই। একে অত্যন্ত সরু রাস্তা, তার ওপর গরুগুলো খাদ বাঁচিয়ে, ধুলো পাহাড় ঘেঁসে যাচ্ছে। ওদের পাশ দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হলে, খাদের দিক দিয়ে যেতে হবে। এদের চরিত্রও সঠিক জানা নেই। একটু ঠেলে দিলে একবারে সোজা গঙ্গায় চলে যাব। গরুর মালিক ও বাচ্চা ছেলেটা আমাদের পাশ থেকে একেবারে সামনের গরুগুলোর দিকে পাথর ছুঁড়ছে। পাথরের আঘাতে বা ভয় পেয়ে সামনের গরু একটু এগোলে গোটা লাইনটা এগোবে। এই চেষ্টাতেও তেমন লাভ কিছুই হচ্ছে না। ভাবলাম, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে, জীবনে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। এ যেন মহাত্মা গান্ধী রোডের জ্যামে দাঁড়িয়ে - বাসে করে কলেজ স্ট্রিট যাচ্ছি। লোকটা অভয় দিয়ে বলল, গরুগুলো খুব শান্ত, কোন ভয় নেই। পাশ দিয়ে চলে যেতে পারেন। অথচ সে নিজে বা তার চেলা, কেউ কিন্তু গরুগুলোর পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে, ওদের তাড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে না। ওর কথাটা "মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না - জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতই না" গোছের সান্ত্বনা বাক্য বলে মনে হল। ভয় হচ্ছে এত ধীর গতিতে গরুগুলোর পিছন পিছন বা পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে, গরুগুলো কিছু না করলেও, গতকালের মতো পাথর নেমে আসলে কী করব? ছুটে পালাবার উপায়ও তো থাকবে না। শেষ পর্যন্ত কোনও উপায় না দেখে, বাধ্য হয়ে পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই স্থির করলাম। প্রথমে আমি, তারপর দিলীপ, সব শেষে মাধব। খাদের দিক দিয়ে গেলাম না। গরুগুলোর পিঠে চড় চাপড় মেরে, ডানপাশ দিয়ে, অর্থাৎ ধুলো-পাহাড়ের ধার ঘেঁসে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে চললাম। গরুগুলো সত্যিই খুব শান্ত ও ভদ্র। আমাদের এগিয়ে যাবার রাস্তা না দিলেও, আক্রমণ করার কোন ইচ্ছা প্রকাশ করল না। এরমধ্যে আবার নতুন এক বিপদ দেখা দিল। একটা গরু হঠাৎ কিরকম ভয় পেয়ে, খাদের দিকে খানিকটা কাত হয়ে নেমে গেল। খাদে তলিয়ে গেল না। অসহায় ভাবে রাস্তায় উঠে আসার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু হাঁচোড়-পাঁচোড় করে রাস্তায় উঠে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও পা পিছলে যাওয়ায়, উঠে আসতে পারছে না। পিছন থেকে লোকটা চিৎকার শুরু করে দিল। ভয় হল গরুটা তলায় চলে গেলে, তার দায় না আবার আমার ওপর বর্তায়। যাহোক, শেষ পর্যন্ত গরুটা সম্পূর্ণ নিজের একক চেষ্টাতেই, রাস্তায় উঠে আসতে সক্ষম হল। আমরা ধড়ে প্রাণ ফিরে পেয়ে আবার এগিয়ে চললাম।
বেশ কিছুটা রাস্তা পার হয়ে দেখলাম, স্থানীয় একটা ছেলে ঝরনার পাশে পাথরের ওপর বসে কাপড় কাচছে। আমরাও ঝরনার পাশে বসে, গতকালের সঙ্গে আনা পুরি আর খেজুর খেলাম। সাত সকালে একদিন আগেকার তৈরি ঠাণ্ডা, শক্ত পুরি খেতে ইচ্ছা করছে না। যে ছেলেটা কাপড় কাচছে, তাকে খানিকটা দিতে গেলে, বলল খাবে না। কী আর করব, ছুঁড়ে গঙ্গায় ফেলে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে সেই পাথর ফেলা জায়গাটায় এসে হাজির হলাম। এখানেই গতকাল রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পাথরগুলোর পিছন দিক দিয়ে পরিস্কার রাস্তা ধরে ব্রিজে এসে উঠলাম। এখান থেকে আর একবার দেখবার চেষ্টা করলাম যে কিভাবে যাবার সময়, রাস্তা হারিয়ে গোলোকধাঁধায় ঘুরছিলাম। একসময় চিরবাসার সেই টিনের ছাদের ঘরটা চোখে পড়ল। আজকেও বেশ পরিষ্কার আকাশ, সুন্দর রোদ উঠেছে।। খুব ভাল করে আগের দিনের দেখা তারার মতো জিনিসটা খুঁজলাম। গতকাল আর আজকের আবহাওয়া প্রায় একই রকম। আকাশের অবস্থা, সূর্যালোকও প্রায় একই রকম, এমন কী সময়টা এক না হলেও প্রায় কাছাকাছি, অথচ আজ কিন্তু তারাটা কোথাও দেখা গেল না। মনে মনে কিভাবে লঙ্কা থেকে ভুখি, এই মরণ ফাঁদ থেকে বার হব, সেই চিন্তা করতে করতে পথ চলছি। চিরবাসার খুব কাছে এসে, ডানপাশে লাল রঙে "VIMAL" লেখা বড় পাথরটা চোখে পড়তে দিলীপকে বোতলটা বার করে আনতে বললাম। বলল, আগেই কাজটা সেরে রেখেছে। ওটাকে ব্যাগে ভালভাবে সোজা করে রেখে দিলাম। কাঁধের ব্যাগটা এখন বেশ ভারি বলে মনে হচ্ছে। কাঁধে যেন চেপে বসে যাচ্ছে। ওরা আবার এগিয়ে গেছে, আমি ধীরেসুস্থে পথ চলছি। তাড়াতাড়ি হাঁটতে গেলে বোতলটা কাত হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর ছবি তোলা আছে। একসময় ওদের আর চোখে না পড়ায়, বাধ্য হয়ে জোরে পা চালালাম। এঁকেবেঁকে বিপজ্জনক সরু রাস্তা পার হয়ে, একসময় মাধবের সঙ্গে দেখা হল। আমরা দুজনে এবার একসঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। দিলীপ এগিয়ে গেছে। রাস্তা আর শেষ হয় না। এইভাবে একই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে, একসময় পুলিশ স্টেশনের কাছে এসে হাজির হলাম। পুলিশের দুজন লোক আমাদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেন "ফিরে এসেছেন? তিনজনেই এসেছেন তো?" জানালাম, আমরা তিনজনই ভালভাবে ফিরে এসেছি। বললেন, "বাঁচা গেল" – যেন একটা বড় চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পেলেন। নীচে নেমে এসে, সেই চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম, সঙ্গে ঝুড়িভাজা।
কয়েকজন বেশ ভাল চেহারার যুবক এল। থাকে হরিদ্বার। ওখান থেকে হেঁটে গঙ্গোত্রী এসেছে। আগেও নাকি একবার হেঁটে কেদার-বদ্রী, গঙ্গোত্রী-গোমুখ-যমুনোত্রী গিয়েছিল। এবার কয়েকজনের সামনে পরীক্ষা থাকায়, অন্য কোথাও যাবে না। জানালাম, আমরা এইমাত্র গোমুখ থেকে ফিরছি। যাহোক, চা খেয়ে দিলীপ ও মাধব গেল জীপ এসেছে কিনা খোঁজ করতে। জীপ এখান থেকে কিছুটা রাস্তা আগে দাঁড়ায়। দোকানদার বলল, "গতকাল ভোরে জীপ একবার এসেছিল। তারপর থেকে জীপ আর আসে নি। আজ হয়তো আসতে পারে। প্রায় প্রতিদিনই জীপটা আসে"। রামজীকে কোথাও দেখলাম না। মাধবরা ফিরে এসে খবর দিল, জীপ আসেনি। মাধব বলল, জীপের জন্য অপেক্ষা করবে। আমি আর দিলীপ, দুজনেই হেঁটে যাবার পক্ষপাতী। কারণ আজ যদি লঙ্কায় ডাবরানী থেকে বাস আসে, তবে সেটা ধরতেই হবে। কবে আবার দয়া করে আসবে বলা যায় না। মাধবের দেখলাম হেঁটে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই নেই। আমাদেরও যে হাঁটতে খুব ভাল লাগছে তা নয়, তবু আজ বাস এলে সেটা ছেড়ে দেওয়া কোনমতেই উচিত হবে না। দুদিন আগে আমরা বাসে লঙ্কায় এসেছিলাম। কাজেই গতকাল না এলেও, আজ লঙ্কায় বাস আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। সবে প্রায় সতের কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছি। কিন্তু সবদিক চিন্তা করে, শেষ পর্যন্ত হেঁটে যাওয়াই স্থির হল। ঠিক করলাম রাস্তায় জীপ আসতে দেখলে, তাতেই চলে যাব। আস্তে আস্তে লঙ্কার দিকে পা বাড়ালাম।
হাঁটতে আর ভালো লাগছে না। আগেও শুনেছি, এবার রাস্তাতেও শুনলাম, যমুনোত্রীর প্রাকৃতিক দৃশ্য নাকি মোটেই সুন্দর নয়। কিছুই দেখার নেই। বোধহয় তাই যমুনোত্রীর জন্য কষ্ট করতে আরও ভাল লাগছে না। বন্ধুদের মানসিক অবস্থা পরখ করবার জন্য বললাম, সবাই বলছে যমুনোত্রীতে দেখার মতো কিছুই নেই, তাই ওখানে যেতে চায় কী না। আশ্চর্য, এবার কিন্তু দুজনেই, যমুনোত্রী যাবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হলাম। তবে জানিনা এই ফাঁদ থেকে বেরোবার পর ওরা তো দূরের কথা, আমার নিজেরই কতটা ক্ষমতা বা ইচ্ছা থাকবে, যমুনোত্রী দেখার! প্রায় দশ কিলোমিটার পথ হাঁটলে, ভৈরবঘাঁটি চড়াই পৌঁছব। কয়েকজন হিন্দুস্থানী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও দেখলাম হেঁটে চলেছে। লঙ্কাগামী রাস্তা পাকা, তার ওপর খুব একটা উতরাই না হলেও, চড়াই নয়। হাঁটার কষ্ট অনেক কম। তবু সতের কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে, নতুন করে দশ কিলোমিটার এই পথ, তা যতই ভাল রাস্তা হোক, হাঁটতে বেশ কষ্টই হচ্ছে। ভৈরবঘাঁটি থেকে লঙ্কা আবার প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পার হতে হবে। আসবার সময় ওই পথে আসতে কষ্ট হয়েছে ঠিক, কিন্তু ফিরবার সময় মৃত্যুযন্ত্রনা ভোগ করতে হবে। রাস্তা এবার সোজা ওপর দিকে উঠতে শুরু করেছে। দিলীপ একটু এগিয়ে গেছে। আমি আর মাধব খুব আস্তে আস্তে, গল্প করতে করতে চলেছি। এ রাস্তায় জীপ যায়, কাজেই বিপদের সম্ভাবনা প্রায় নেই। বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে ডানপাশে, ওপর থেকে একটা বড় ঝরনা নেমে এসেছে। সঙ্গে তিন-তিনটে ওয়াটার বটল থাকলেও, সবকটাতেই গোমুখের পবিত্র গঙ্গাজল ভরে আনা হয়েছে। এপথে জলের কষ্ট খুব একটা হবে না। কিন্তু চিন্তা হচ্ছে, ডাবরানী থেকে ভুখি পর্যন্ত জল ছাড়া যাব কী ভাবে? আসবার সময় তিনটে ওয়াটার বটল সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও, জল ভরে না নিয়ে আসার জন্য, প্রচণ্ড জলকষ্টে ভুগেছি। আট কিলোমিটার হাঁটা-পথের দুই প্রান্তে দুটো ঝরনা। ফিরবার সময় ওয়াটার বটল সঙ্গে থাকলেও, খাবার জল ভরে নিয়ে যাবার উপায় নেই। এখানে এখন নতুন কোন ওয়াটার বটল কিনতে পাওয়াও যাবে না। সঙ্গী দুজনকে বললাম, একটা বটল খালি করে ঝরনার জল ভরে নেব। যমুনোত্রী থেকে বটলটায় যমুনার জল ভরে নেওয়া যাবে। ওরা যমুনার জল বয়ে নিয়ে যেতে রাজি হল না। তিনটে বটলেই গোমুখের জল ভরে নিয়ে যেতে চায়। অগত্যা আকন্ঠ ঝরনার জল পান করে, এগিয়ে চললাম। বাঁপাশে গভীর খাদ - মাঝেমাঝে মাইল স্টোন। প্রতি কিলোমিটার রাস্তাকে, পাঁচ ভাগে ভাগ করে করে মাইল স্টোনগুলো রয়েছে। যেমন, ভৈরবঘাঁটী ৯ কিলোমিটার। এরপর ২/৯, ৪/৯, ৬/৯, ৮/৯। তারপর ভৈরবঘাঁটী ৮ কিলোমিটার। একটা মাইল স্টোন পার হয়ে কখন দুই দেখব, তারপর চার দেখব, তারপর কখন ছয় দেখব, এই আশা নিয়ে ক্রমে এগোতে লাগলাম। মনে হয় এই আশায় আমাদের হাঁটার গতিও অনেক বেড়ে গেল,অপর দিকে হাঁটার কষ্টও কিছু লাঘব হল। "ধন্য আশা কুহকিনী"। আহা এই সময় যদি সুকুমার রায়ের "খুড়োর কল" একটা সঙ্গে থাকত, তাহলে কত সুবিধাই না হত।
রাস্তা একেবারে ফাঁকা, কোথাও কোনও লোকজন নেই। সুন্দর সবুজ গাছপালা দিয়ে সাজানো নীচের খাদ যেন সেজেগুজে তার রূপ প্রদর্শন করছে। দিলীপ পাকা রাস্তা পেয়ে, বার বার অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার যেন আর শেষ নেই। এতদূর চলে এলাম, এখনও পর্যন্ত জীপটা ওদিক থেকে এল না! অপেক্ষা না করে হেঁটে যাব স্থির করেছিলাম বলে বেঁচে গেলাম। কবে যে ওটা আবার গঙ্গোত্রী আসবে ভগবান জানেন! কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রাস্তার একপাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ওঁরাও লঙ্কার দিকেরই যাত্রী। আমরা না থেমে, পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম। দিলীপকে দেখা যাচ্ছে না। ও বোধহয় সোজা পাকা রাস্তা পেয়ে, লাগাম ছাড়া হয়ে ছুটছে। রাস্তার উভয় পাশেই, নতুন কোন দৃশ্যও চোখে পড়ছে না। একপাশে খাড়া পাহাড়, অন্য দিকে খাদ। কিন্তু সবুজ বনজঙ্গলে ঢাকা খাদ এখানে খুব গভীর নয়। রাস্তায় এমন কেউ নেই, যার কাছে নতুন কোনও খবর পাওয়া যায়, পাওয়া যায় একটু উৎসাহ। একমাত্র রাস্তার মাইল স্টোনগুলো ভৈরবঘাঁটি থেকে তাদের নিজ নিজ দূরত্ব জানিয়ে যেন ইশারায় আমাদের বলছে, জোরে, আরও জোরে, আর বেশি পথ নেই। ওগুলোর ওপর চোখ পড়লে যেন নতুন করে উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আর সামান্য কয়েকটা দিন কষ্ট করলেই আমাদের দীর্ঘদিনের মনস্কামনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারব। বাঁপাশে রাস্তা থেকে একটু নীচে, একটা দোকান চোখে পড়ল। ওখান থেকেই আসবার সময় জীপ ছেড়ে ছিল। ওটাই ভৈরবঘাঁটি, পাশেই মন্দির। গতি বেড়ে গেল। অনেকটা পথ ঘুরে ওখানে যেতে হবে। মাধবকে বললাম রাস্তার পাশ দিয়ে, ঢালু জায়গার ওপর দিয়ে, সাবধানে নেমে আসতে। পা পিছলে যাচ্ছে, পড়ে যাবার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। পড়ে গেলে হাত পা কেটে ছড়ে যাবে। কোনমতে দুজনে ওপর থেকে শর্টকাটে নেমে এসে দোকানে ঢুকলাম। দিলীপ আগেই চলে এসেছে। দোকানে চা, বিস্কুট দিতে বললাম।
সকাল থেকে একভাবে হেঁটে আসছি। প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ কিলোমিটার পথ হেঁটে এখানে এসেছি। এখন পর্যন্ত পেটে একটু ঝুড়িভাজা, একটা ঠাণ্ডা শক্ত পুরি, খান তিন-চার খেজুর আর দুকাপ চা পড়েছে। খিদেও পেয়েছে খুব। তবে আমার মাথায় এখন ওর থেকেও অনেক বড় চিন্তা, আজ লঙ্কা থেকে ডাবরানী যাবার বাস পাওয়া যাবে তো? এই দোকানে আলাপ হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। থাকেন দেরাদুনে। ওখানেই ব্যবসা করেন। সময় পেলেই সোজা গঙ্গোত্রী চলে আসেন। জিজ্ঞাসা করলাম, হাওড়া ফেরার জন্য দুন এক্সপ্রেসে সহজে রিজার্ভেশন পাওয়ার জন্য, কোথায় যাওয়া ঠিক হবে - হরিদ্বার, না দেরাদুন? ভদ্রলোক বললেন, হরিদ্বার গেলে পেয়ে যাবেন। দেরাদুন থেকে তো অবশ্যই পাবেন, কারণ মুসৌরিতে এখন খুব কম ট্যুরিষ্ট। ভরা সিজনেও টুরিষ্টের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। কারণ মাদকবর্জন আইনে মুসৌরিতে সরাব বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভ্রমণার্থীর ভিড় একবারে নেই। যে কোন হোটেলে বেশ সস্তায় ঘর পাওয়া যায়। হোটেলওলাদের মনে তাই প্রচণ্ড ক্ষোভ। ঠিক করলাম, যমুনোত্রী হয়ে সোজা হরিদ্বার চলে যাব। ওখান থেকেই ফেরার টিকিট কাটা যাবে। কয়েকদিন নির্ভেজাল বিশ্রাম নিয়ে, একটু চাঙ্গা হয়ে বাড়ি ফেরা যাবে। কিন্তু সে অনেক পরের কথা, আগে তো লঙ্কা পৌঁছই।
কাঁধের ঝোলা নিয়ে রাস্তায় নামলাম। লঙ্কা থেকে ভৈরবঘাঁটি আসার সময় আমাদের খুব একটা কষ্ট হয়নি। আসবার সময় ভৈরবঘাঁটির কাছাকাছি বেশ কিছুটা রাস্তা নেমে এসেছিলাম। রাস্তাটা সিমেন্ট দিয়ে একটু পাকা করা হয়েছে। বেশ কিছু চওড়া চওড়া সিঁড়িও আছে। এবার সেগুলো ভেঙে ওপর দিকে উঠতে হবে ভাবতেই, বুকের ভিতর কেমন একটা শিরশির করে উঠল। হাঁটার গতিও বেশ কমে গেছে। সঙ্গীদের বললাম একটু জোরে পা চালাতে। এত কষ্টের শেষে বাস ধরতে না পারলে, আফসোসের আর সীমা থাকবে না। মাধব সরাসরি জানাল যে, ওর পক্ষে আর জোরে হাঁটা সম্ভব নয়। আমি আর দিলীপ এগিয়ে গেলাম। মাধব ধীরে ধীরে পেছনে আসছে। এবার একটা ব্রিজ পার হয়ে এলাম। এখানে ডানদিক থেকে একটা নদী এসে গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে। শুনলাম আগে এখানে এত ভাল ব্রিজ ছিল না। যদিও এখনও এটা একটা কাঠের তৈরি ব্রিজ, তবে বেশ চওড়া ও মজবুত। আগে নাকি লম্বা লম্বা, মোটা মোটা, গাছের ডাল ফেলে এখানে ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল। দুটো নদীরই প্রকৃতি এখানে খুব একটা অশান্ত নয়, তবু নীচে তাকালে কিরকম একটা গা ছমছম করে। জানতে পারলাম, ডানদিকের নদীটাকে 'নীলগঙ্গা' বলা হয়। কেউ কেউ আবার 'জাহ্নবীগঙ্গা'ও বলে। যেদিক থেকে নদীটা এসেছে, সেদিকের বাসিন্দারা ওটাকেই আসল গঙ্গা বলে দাবি করে। নদীটার জল গঙ্গার তুলনায় বেশ পরিষ্কার ও নীলচে। আমরা ধীরে ধীরে, দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে আর জানতে জানতে পথ চলছি। এই দু-তিন কিলোমিটার রাস্তার পরেই, আজকের মতো বিশ্রাম। অবশ্য যতক্ষণ না ডাবরানী যেতে পারছি, ততক্ষণ এই মরণফাঁদ থেকে মুক্তি পাব না। আমরা এখানকার পরিবহণ ব্যবস্থার হাতের পুতুল। এখানেও দেখছি কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রাস্তায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। নিজের মুখ আজ প্রায় দিন পনের হল দেখার সৌভাগ্য হয়নি। হাত-পায়ের রঙ দেখে বেশ বুঝতে পারছি, শ্রীমুখের অবস্থা কী হতে পারে। পথে বসে থাকা এই অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে ক্লান্তির ছায়া। ওঁদের মুখমন্ডলকে আয়না হিসাবে ধরে, বুঝতে পারছি আমাদের এই অবসাদ, এই নিরুৎসাহ ভাব, অস্বাভাবিক কিছু নয়। লঙ্কার যত কাছাকাছি আসছি, গতি যেন তত কমে আসছে। শেষে ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে লঙ্কার সেই পুরানো মিষ্টির দোকান-কাম-হোটেলে এসে বেঞ্চে বসে পড়লাম। প্রথমেই খবর নিলাম, আজ বাস এসেছিল কী না। দোকানদার বলল, গতকাল বা আজ কোন বাস ডাবরানী থেকে লঙ্কায় আসে নি। মনে একটাই সান্ত্বনা, এখান থেকে একটাও প্যাসেঞ্জার না পেলেও বাস এলে আবার সঙ্গে সঙ্গেই ডাবরানী ফিরে যাবে।
বিকেল তিনটে বাজে। দোকানে এখন আর কোন খাবার পাওয়া যাবে না। সারাদিনের শেষে প্রধান খাদ্য আবার সেই ঝুড়িভাজা ও চা। বসে বসে কোমর ব্যথা হয়ে গেল। বাস বোধহয় আজ আর আসবে না। হয়তো এদিকের লোকেদের এখন ময়দা, ডালডা ইত্যাদির বিশেষ প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারছি বাস আসার সম্ভাবনা ক্রমশঃ কমে আসছে। বন্ধুরা দোকানেই বসে রইল। আমি যেদিক থেকে বাস আসবে, রাস্তা ধরে সেদিকে অনেকটা পথ এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ মনে হল দূরে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে, একটা হর্ণের আওয়াজ এল। কান খাড়া করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে বেশ ফুর্তি হচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আর কিছু শুনতে না পেয়ে বুঝলাম, সারাক্ষণ বাসের চিন্তা আমায় পাগল করে ছেড়েছে। আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করে দোকানে ফিরে এলাম। ওদের বাসের হর্ণের কথা বললাম। হঠাৎ আবার সেই হর্ণের আওয়াজ শুনলাম মনে হল। এবার ওরাও আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝলাম, ওরাও একই রোগের রোগী। এবার তিনজনেই একসঙ্গে ভুল শুনেছি। এরমধ্যে আবার দোকানদার বলল, তার কপালে খুব যন্ত্রণা করছে, আমরা কোন ওষুধ দিতে পারব কিনা। এখন নাহয় ঝুড়িভাজা খেয়ে কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু রাতে থাকতে হলে, এই দোকানদার ছাড়া গতি নেই। ওর সুস্থ থাকা আমাদের থেকেও বেশি জরুরী। বিজ্ঞ ডাক্তারের মতো জিজ্ঞাসা করলাম, জ্বর আছে? হাতটা ধরে নাড়ি দেখার ভান করে, তাকে একটা স্যারিডন ট্যাবলেট দিয়ে খেয়ে নিতে বললাম।
মাধব তিতিবিরক্ত হয়ে বলল, বাসের দরকার নেই, চল ট্রাভেলার্স লজ বুক করি। একটু শুয়ে থেকে বিশ্রাম নেওয়া যাক। আমি বললাম, সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত দেখবো। ক্লান্তি আমারও খুব কম লাগছে না। তবে এখনই ঘর বুক করা বোকামি হবে, কারণ দেখা যাবে ঘরও বুক করলাম, আর বাসও এসে হাজির হল। ও আর কথা বাড়াল না। আর এক দফা চা খেয়ে, দোকানের আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দোকানটার সামনে বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা, বাসের অপেক্ষায় বসে আছে। একপাশে পরপর দুটো কুঁড়েঘরের মতো, তার মধ্যেও অনেকে একই উদ্দেশ্যে বসে আছে। গতকাল থেকেই হয়তো ওরা এখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। যে দোকানটায় বসেছিলাম,তার ভিতরে একটা কাঠের মাচায় কম্বল পেতে দুজন শুয়ে আছে। পোশাক দেখে মনে হল, ওরাও বাসে যাবে এবং গতকাল এখানেই রাত কাটিয়েছে। এখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে, স্থানীয় কিছু যুবক এল দোকানে আড্ডা মারতে। হঠাৎ তীব্র একটা হর্ণের আওয়াজ। নাঃ, এবার আর কোন ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। উঃ! সে যে কী আনন্দ হল,ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মরণফাঁদ থেকে উদ্ধার করার জন্য, রথ এসে হাজির। এবার মনে হচ্ছে, আগের দুবার এই বাসেরই হর্ণের আওয়াজ শুনেছিলাম। পথে থেমে থেমে,লোক নামিয়ে আসতে এত সময় নিল। বাসটা এসে লোক নামিয়েই ফিরে যাবার জন্য ডাবরানীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াল। আমি মহানন্দে ছুটে গিয়ে ড্রাইভারের হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, "বাস আজ যাবে তো?" ড্রাইভার জানাল, একটু পরেই বাস ডাবরানী ফিরে যাবে। একেবারে সামনে জানালার ধারে আমাদের জায়গা রেখে, নিচে নেমে দোকানে এলাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, দেখি গোটাকতক মিলিটারি এসে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো। একটু পরেই জানা গেল, মিলিটারিরা বলেছে আগামীকাল সকালে হরশিল থেকে ওদের ক্যাম্পের ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন মিলিটারির একটা দল, ডাবরানী যাবে। কাজেই এই বাস যেন কাল সকালে ছাড়ে। সকলের সব অনুরোধকে উপেক্ষা করে, ড্রাইভার ঘোষণা করল, বাস আজ আর যাবে না, কাল ভোরে বাস ছাড়বে। ব্যস, হয়ে গেল - বাড়া ভাতে ছাই। বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলাম, "কাল সকালে কি বাস হরশিল গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? কখন মিলিটারিরা আসবে তবে বাস ছাড়বে?" ড্রাইভার বলল, "ওরা খুব ভোরে তৈরি হয়েই থাকবে। হরশিল পৌঁছালেই বাসে উঠে পড়বে।" ড্রাইভারের কথা বলার ধরণ দেখে মনে হল, এ ঘটনা এখানে আখছারই ঘটে এবং বাস নিয়ে আজ ডাবরানী ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা বা সাহস, কোনটাই তার নেই।
হায়! বহু আকাঙ্খিত রথ হাতে পেয়েও, সব হারালাম। ওদের জন্য বাস যদি দেরিতে ডাবরানী পৌঁছয়, তবে কাল আর এগনো যাবে না। রাতে আবার বুদ্ধি সিং-এর তাঁবুতেই থাকতে হবে। কিন্তু কিছু করারও নেই। সেই ট্রাভেলার্স লজেই একটা ঘর বুক করলাম। ঘরটায় চারটে বেড, কুড়ি টাকা ভাড়া লাগবে। প্লাইউডের দেওয়াল, অ্যাটাচ বাথ। বেশ ভালই ব্যবস্থা, তবে সবই অসমাপ্ত। গত বছর বন্যার আগে কাজ আরম্ভ হয়েছিল। বন্যার পর যাত্রী আসার সম্ভাবনা না থাকায় কাজও বন্ধ হয়ে আছে। তাছাড়া উত্তরকাশীর সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকায় মালপত্র নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। ঘরটা ভিতর থেকে বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা নেই। অর্ধেক তৈরি অ্যাটাচ বাথটা এখন স্টোর রুম। ভাবলাম, একটা বেডকে টেনে এনে দরজার সঙ্গে চেপে পেতে দেব। কেয়ারটেকার পরামর্শ দিল, দরজা ও দেওয়ালের প্লাইউডের ফাঁকে ছোট একটা পাতলা কাঠের টুকরো গুঁজে দিয়ে দরজা বন্ধ করতে, তাহলে দরজা সহজে খুলবে না। ঠিক করলাম, দুরকম ব্যবস্থাই করব। ঘরভাড়া কাল সকালে যাবার সময় দিলেই হবে। ঘরে ঢুকে একটা হ্যারিকেন দিতে বলে, তিনজন তিনটে খাটে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। এত ক্লান্তিকর দিন, এর আগে বোধহয় কাটাতে হয় নি। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে, মালপত্র ঘরে রেখে, বাইরে থেকে তালা দিয়ে দোকানে ফিরে এলাম। বৃদ্ধ দোকানদারের সঙ্গে দেখা হতে, দুহাত তুলে নমস্কার করে 'ডাগতার সাব' বলে সম্বোধন করে জানালেন, তাঁর কপালের যন্ত্রণা এক্দম কমে গেছে। রাতের খাবারের অর্ডার দিলাম। আজও সেই আলুর তরকারি আর রুটি। এখানে অবশ্য তরকারিটা একটা প্যানে, কাঠের আগুনে বসিয়ে, একটু নেড়েচেড়ে বেশ ঘন করা হয়। এরা এটাকে সবজি ফ্রাই বলে। রুটিগুলো একটু পাতলা পাতলা করে করতে বলে, তরকারিটা ফ্রাই করে দিতে বললাম। দোকানটায় এখন অনেকগুলো যুবকের ভিড়। দেখে স্থানীয় বলেই মনে হল।
যে বাসটা এসেছিল, সেটা দেখি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। খুব চিন্তায় পড়লাম। আর হয়তো দু-চার দিনের মধ্যে কোন বাসের টিকি দেখা যাবে না। এগিয়ে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আজ রাতেই আবার ফিরে আসবে। রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করার সময় একজনের পায়ে একটা বড় পাথর পড়ে গেছে। বাসটা তাকে হরশিল পৌঁছে দিয়ে আবার এখানে আসবে। খুব ভাবনা হল, সত্যি কথা বলছে তো? বাস সোজা ডাবরানী চলে যাবে না তো? যাহোক, সঙ্গে নিয়ে আসা মাখন দিয়ে, যদিও তারও অবস্থা আমাদেরই মতো কাহিল, সবজি ফ্রাই আর রুটি খেয়ে, ক্লান্ত দেহে, লজে ফিরে এলাম। কত রাত জানিনা, বাসের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। শুয়ে শুয়েই বুঝতে পারলাম, বাসটা কথামতো ফিরে এল। যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল!
পয়লা সেপ্টেম্বর। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, একেবারে সামনের সিটে ও ঠিক তার পিছনের দুজন বসার চেয়ার সিটে নিজেদের জায়গা রেখে এসে, দোকানে গেলাম। মাধব চা খেয়ে, দোকানের টেবিলের ওপর মানিব্যাগটা রেখে, আমাদের দাম দিয়ে দিতে বলে, একটু দূরে প্রাতঃকৃত্যাদি সারতে চলে গেল। দোকানে স্থানীয় যুবকদের ভিড়। আমি চা খেয়ে, দিলীপকে দাম দিয়ে দিতে বলে একই উদ্দেশ্যে এগোলাম। অনেকক্ষণ পরে দিলীপ এসে বলল, "তোরা টাকা দিয়ে আসিসনি বলে চায়ের দাম দিতে পারলাম না।" শুনে তো আমার মাথা ঘুরে গেল। ও আসার পর, অন্তত দশ-পনের মিনিট কেটে গেছে। এতক্ষণে মানিব্যাগ নিশ্চয় অন্য কারো পকেট সঙ্গী হয়ে গেছে। দিলীপকে বললাম ছুটে দোকানে গিয়ে বেঞ্চের ওপর দেখতে। ও চলে গেল। ব্যাগে প্রায় শ'চারেক টাকা তো ছিলই। একটু পরে দিলীপ ফেলে আসা মানিব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরে এল। ঠিক কত টাকা ছিল, এখনই বলা সম্ভব নয়, তবে মনে হল টাকা পয়সা ঠিকই আছে। কেউ হাত দিলে সবটাই নিয়ে নিত, কয়েকটা নোট বার করে নিত না। অথচ ব্যাগটা মাধব যেখানে রেখে এসেছিল, দোকানদার ও ওই যুবকদের চোখ পড়তে বাধ্য। দিলীপ বলল, দোকানে এখনও সবাই বসে গল্প করছে। ও দোকানের বেঞ্চের ওপর থেকেই ব্যাগটা নিয়ে এসেছে। এদের সততা, আমাদের অসততা কমাতে পারল না, এটাই দুঃখ। যাহোক ঘর থেকে ব্যাগ, লাঠি, ওয়াটার বটলগুলো নিয়ে এসে, বাসে উঠে বসলাম। কেয়ারটেকার এসে ভাড়ার টাকা নিয়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বাসও ছাড়ল। কিন্তু এ ওঠে তো সে ওঠে না, ফলে বারবার বাস দাঁড় করাতে হচ্ছে। ড্রাইভারও বিরক্ত হচ্ছে। বাসে অল্প কয়েকজন মিলিটারিও আছে। অবশেষে বাস সত্যিই ছেড়ে দিল এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হরশিল এসে পৌঁছল। রাস্তার বাঁপাশে মিলিটারি ক্যাম্প। ওরা তৈরি হয়েই ছিল। নানা আকারের বন্দুক, রাইফেল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাসের ভিতরে ও ছাদে চটপট উঠে পড়ল। দেখলাম সঙ্গে মদের বোতল, রেডিও ইত্যাদিও আছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাম্প প্রায় ফাঁকা। কোথায় যাবে জানিনা, তবে এখানে বোধহয় একসঙ্গে অনেকদিনই ছিল, কারণ যে দুচারজন গেল না, তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে এবং মনে হল তাদের চোখে জল। বাস ছেড়ে দিল। ওরা কিন্তু আমাদের কোন অসুবিধার সৃষ্টি করল না। আমরা আগের মতোই বেশ আরামে বসে আছি। একটু এগিয়েই রাস্তার ডানপাশে দেখলাম, গতকালের আহত ছেলেটাকে, একটা গাছের ডাল কেটে তৈরি স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে। জানালা দিয়ে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওকে এই বাসে ডাবরানী নিয়ে যাবার জন্য ওর কয়েকজন সঙ্গী ড্রাইভারকে অনুরোধ করল। ড্রাইভার জানালো, আহত ছেলেটাকে বাসে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, শুইয়ে নিয়ে যেতে হবে। অথচ বাসের ভিতরে ও ছাদে কোথাও এতটুকু জায়গা নেই, যেখানে তাকে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ড্রাইভার আশ্বাস দিল, ডাবরানী পৌঁছেই, হয় সে নিজে বাস নিয়ে ফিরে আসবে, নাহলে অন্য কাউকে বাস নিয়ে পাঠাবে, আহত যুবকটিকে ডাবরানী নিয়ে যাবার জন্য। বাস ছেড়ে দিল। স্বার্থপর আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
একটু এগোতেই এক সাধু হাত দেখিয়ে বাস দাঁড় করালেন। দেখেই চিনতে পারলাম। বাসে উঠে উনি আমাদের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াতেই ওদিকের একজন একটু সরে বসে তাঁকে বসবার জায়গা করে দিল। আমি আমার বিশুদ্ধ হিন্দিতে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, "আচ্ছা, আপ্ কি, মানে….।" মাধব বলল, "তোর হিন্দি বুঝবেন না, বাংলাতেই জিজ্ঞাসা কর।" আমি আবার বললাম, "আচ্ছা, আপ্ কি…" সাধু আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই ভাঙা ফ্যাঁসফেসে গলায় বাংলায় বললেন, "ভুজবাসার লালবাবা। তা তোরা তো তিনজনে গিয়েছিলি?" আমরা দিলীপকে দেখালাম। আসলে ভুজবাসায় লালবাবার ছবি দেখায়, তাঁকে চিনতে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি। লালবাবা এবার জাপানি ছেলেটা আশ্রমে উঠেছিল কিনা, আশ্রমে আমাদের কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন শুরু করে দিলেন। বুঝলাম ভুজবাসা থেকে আসার সময় তিনি গঙ্গোত্রীতে, কজন যাত্রী গোমুখ গেছে বা যাবে, তারা কোথা থেকে এসেছে, সমস্ত খবরাখবর নিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, গতকাল তাঁর আশ্রম থেকে সকালে ফিরে আসার সময় আমরা রুটি খেয়ে এসেছিলাম কিনা। বললাম, শুধু চা খেয়েই আমরা বেড়িয়ে ছিলাম। তিনি শুনে বললেন – "খুব অন্যায় করেছিলি, ওপথে খালি পেটে হাঁটতে নেই। তার মানে সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি?" বাধ্য হয়ে বলতেই হল, বিকেলবেলা লঙ্কা পৌঁছে ঝুড়িভাজা খেয়েছিলাম। রাতে রুটি তরকারি। উনি আবার বললেন, "খুব অন্যায় করেছিস।" ভাবলাম, এর নামই বোধহয় মানব সেবা। লালবাবা না থাকলে যে নিশ্চিন্তে গোমুখ দেখার সুযোগ কারো ভাগ্যে জুটত না, অন্তত আমাদের মতো সহায়-সম্বলহীন, তাঁবুহীন যাত্রীদের পক্ষে, এটা বোধহয় বলাই যায়। অথচ গঙ্গোত্রীতে এবং লঙ্কাতেও দেখলাম, দোকানের সবাই, বিশেষ করে স্থানীয় পান্ডারা, লালবাবাকে নিয়ে কী ঠাট্টা-বিদ্রূপই না করে। হয়তো লালবাবার নিঃস্বার্থ মানব সেবা, স্বার্থান্বেষী পান্ডাদের যাত্রীদের নিয়ে রমরমা ব্যবসার প্রধান অন্তরায়, তাই এত ঈর্ষা, তাই এত বিদ্রূপ। তাঁকে আশ্রমের পথে দেখা তারার কথা জিজ্ঞাসা করতে বললেন, তোরা দেখেছিস? খুব পরিষ্কার আকাশ থাকলে দিনের বেলায় ওটা দেখতে পাওয়া যায়। বললাম, ফেরার পথে প্রায় একই রকম পরিষ্কার আকাশেও ওই তারাটা দেখতে পাইনি। লালবাবা বললেন, ওটার নাম 'পুচ্ছল'। রোজ দেখা যায় না। খুব পরিষ্কার আকাশ থাকলে, মাঝে মাঝে দেখা যায়। লালবাবার আশ্রমে এত কষ্ট করে গিয়েও তাঁকে দেখতে না পাওয়ার একটা দুঃখ বা মন খারাপের ব্যাপার ছিলই, সেই আকাঙ্খাও পূরণ হল।
ড্রাইভারের পাশে বসায়, অনেকক্ষণ থেকেই বেশ পেট্রলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ করে সামনে নেমে ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে ড্রাইভার জানাল, ইঞ্জিনে তেলবহনকারী পাইপটা ফেটে গেছে। বোঝো ঠ্যালা, এখনি হয়তো বলে বসবে বাস আজ আর যাবে না। ড্রাইভার সাহেব, বাসের ক্লিনার-কাম-কন্ডাক্টার-কাম-হেল্পারকে আগে এটা লক্ষ্য না করায় এবং প্রচুর তেল নষ্ট হওয়ায় খুব একচোট গালিগালাজ করে ওপর থেকে একটা নতুন পাইপ বার করে দিল। অনেক চেষ্টার পর ক্লিনার জানালো, মাপে গোলমাল আছে, ফিট করছে না। ড্রাইভার বাস থেকে নেমে অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও লাগাতে না পেরে, মেজাজ হারিয়ে ক্লিনারকে গালিগালাজ করতে শুরু করে দিল। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। হাজার হোক ঘর-পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘের মতো, এ পথের বাস, জীপে একটু গোলমাল দেখলে, ভয় তো হবেই। যাহোক, আরও বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর, পাইপটা লাগানো হলে, বাসের ইঞ্জিনে অনেক জল ঢালা হল। এবার সুস্থ হয়ে বাস ছেড়ে দিল।
লালবাবার সঙ্গে মিলিটারিদের দেখলাম, খুব সুন্দর সম্পর্ক। লালবাবাকে খুব সম্মান করে, বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছে। বাইরে আসা প্রসঙ্গে লালবাবা একজন যাত্রীকে বললেন, "মন্দির দেখতে চাও তো বদ্রীনারায়ণ যাও। মন্দির দেখে কী হবে? প্রকৃতির রূপ দেখতে চাও তো গোমুখ যাও, তপোবন যাও। এখন যাওয়া অনেক ঝামেলার তাই, না হলে যোশীমঠ থেকে মানস সরোবর কৈলাস যাও"। সত্যিই তাই। কত আশা নিয়ে বদ্রীনারায়ণ গিয়েছিলাম, ওই কী মন্দির? মন্দির আর হোটেল গায়ে গায়ে বিরাজ করছে। কেদারনাথ সেই তুলনায় সত্যিই সুন্দর, পাগল করা সৌন্দর্য। লালবাবা বললেন, হরশিলকে আগে হরপ্রয়াগ বলা হত। আরও কত কথা যে তিনি বললেন। কথায় কথায় একসময় আমরা ডাবরানী এসে গেলাম। ব্যস মুক্তি! এবার আর অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে হবে না। আমাদের পা দুটোই সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।।
লালবাবার একটা ছবি তুলব বলে দিলীপের কাছ থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে তৈরি হয়েই ছিলাম। উনি বাস থেকে নেমে আমাদের চেনা বুদ্ধি সিং-এর দোকানে ঢুকলেন। সঙ্গে একজন লোক। পরে শুনলাম দ্বিতীয়জন লালবাবারই গুরুভাই, ডাবরানীতেই থাকেন। দেখা হয়ে গেল বুদ্ধি সিং-এর সঙ্গেও। বুদ্ধি সিং অনেকক্ষণ ধরে করমর্দন করে সমস্ত খবরাখবর নিলেন। ভালভাবে সমস্ত ঘুরে ফিরছি শুনে খুশি হলেন। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল গাংগানী-গরমকুণ্ডের সেই সন্দেহজনক ব্যক্তিটির সঙ্গে। একগাল হেসে এগিয়ে এসে সব খবর জানতে চাইলেন। ভীষণ খারাপ লাগছিল। তাকে অহেতুক ওই রকম সন্দেহ করার জন্য নিজেদের সত্যিই খুব অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু আমাদেরও দোষ দেওয়া যায় না, আমরা যে সভ্য শহরের লোক, ঠগ দেখে দেখে, ভাল লোকও যে দেশে থাকতে পারে, বিশ্বাস করতেই ভুলে গেছি! যাহোক, এবার একটা দোকানে চা আর বনরুটি খেয়ে হাঁটার জন্য তৈরি হলাম। দেখি লালবাবা তাঁর গুরুভাইয়ের সঙ্গে এগিয়ে আসছেন। তাঁর ছবি তুলতে দেন কিনা জানিনা, সরাসরিই বললাম, যদি অনুমতি করেন তো আপনার একটা ছবি তুলতাম। উনি বললেন,"আমার ছবি? আমার ছবি নিয়ে কী করবি?" বললাম, "বাঁধিয়ে রাখব।" রাজি হলেন, গুরুভাই, মাধব ও দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর একটা ছবি নিলাম। মাধব তার জায়গায় আমাকে দাঁড় করিয়ে আর একটা ছবি তুলল। তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, এগিয়ে চললাম সেই প্রাণান্তকর কষ্টের আট কিলোমিটার রাস্তার উদ্দেশ্যে।
এবার আর ভুল করা নেই। একটু এগিয়েই প্রথম ঝরনার জল পেট ভরে খেয়ে নিলাম। পথে আর জল পাওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে বেশ একটা খুশির মেজাজে হেঁটে চলেছি। উল্টো দিক থেকে অনবরত মিলিটারি ঘোড়া ও খচ্চর, মাল বয়ে নিয়ে আসছে। একটা খচ্চরকে রক্তাক্ত অবস্থায়, খুব ধীরে ধীরে আসতে দেখলাম। শুনলাম খাদে পড়ে গিয়েছিল। এবার এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যাব জানি বলেই বোধহয় হাঁটতে সেরকম কষ্ট অনুভব করছি না। পথটা আবার অদ্ভুত, কোথাও সমতল রাস্তা নেই। হয় একবারে জিভ বার করে ওপরে ওঠো, না হয় একবারে সোজা নিচের দিকে নামো। আমরা এখন ওপর দিকে উঠছি। প্রথমে মাধব, তার পিছনে আমি, সব শেষে দিলীপ। ওপর থেকে বেশ কয়েকটা খচ্চর, পিঠে অনেক মালপত্র নিয়ে, লাইন দিয়ে নেমে, আমাদের দিকে আসছে। মাধব রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়াল। রাস্তার ডানপাশে গভীর খাদ। অনেক নীচ দিয়ে রূপোলি ফিতের মতো গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। বাঁপাশে খাড়া পাহাড় ও রাস্তার মাঝখানে একটু নীচুতে, খানিকটা কাঁচা জায়গা, হয়তো বৃষ্টি বা বর্ষার জল বয়ে যাওয়ার জন্য নালার মতো রাখা। মাধব একপাশে সরে গিয়ে, আমাকেও সরে দাঁড়াতে বলল। দেখলাম খাদের দিকে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। নীচের ওই সরু নালার মতো কাঁচা জমিটায় না নেমে, শরীরটাকে একটু কাত করে, খচ্চরগুলোকে যাবার জায়গা ছেড়ে দিলাম। খচ্চরগুলো পরপর মাধব ও আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল। হঠাৎ কী রকম একটা আওয়াজ হতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, দিলীপ একটা খচ্চরের মালপত্রের ধাক্কায়, বাঁপাশের সেই নীচু সমতল কাঁচা জমিতে নেমে গেছে। খচ্চরগুলোর পিছন পিছন একটা লোক, ওগুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে ঠিকমতো নিয়ে যাচ্ছে। দিলীপ খুব কড়া দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে, ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, রাস্তায় উঠে এসে, আমাদের পিছন পিছন আবার ওপর দিকে হেঁটে চলল। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পরে মাধব হঠাৎ আবিষ্কার করল দিলীপের ওয়াটার বটলের ঢাকনা-কাম গ্লাসটা বটলের সঙ্গে নেই। বটলটার মুখে একটা পাতলা চাকতি চেপে বসানো থাকে। তার ওপরে গ্লাশটা প্যাঁচ দিয়ে লাগাতে হয়। কাজেই গ্লাস বিহীন ওই ওয়াটার বটলের কোন মূল্যই নেই। আমি বললাম খচ্চরের ধাক্কায় নিশ্চই ঢাকনাটা ওখানে পড়ে গেছে। দিলীপ সঙ্গে সঙ্গে আবার নীচের দিকে অকুস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। আমরা পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে দিলীপ ফিরে এল বটে, কিন্তু ওটাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। এখনও পর্যন্ত আমার বর্ষাতির টুপি, মাধবের লাঠির নাল আর দিলীপের ওয়াটার বটলের গ্লাস, তাদের নিজ নিজ প্রভুদের ত্যাগ করে, হিমালয়ে চলে গেছে। আর কে-কে, কাকে কাকে ছেড়ে চলে যাবে জানিনা। দিলীপকে বললাম মন খারাপ না করে সামনের দিকে এগোতে। উত্তরকাশীর আগে কিছু করার উপায় নেই। উত্তরকাশী গিয়ে বটলের মুখটা পলিথিন সিট ও কাগজ দিয়ে ভাল ভাবে শক্ত করে বেঁধে দেব। এবার বেশ জোরে হাঁটা দিলাম। আজ কিন্তু সত্যিই সেরকম উল্লেখযোগ্য পরিশ্রম বোধ হচ্ছে না।
একসময় মাধব দেখাল কিছুটা পিছনে, নিচের দিকে লালবাবা হেঁটে আসছেন। ওনার হাঁটার গতি এত দ্রুত যে এর মধ্যেই আমাদের ধরে ফেলেছেন। এখন বুঝতে পারছি, সেদিন সন্ধ্যার সময় লালবাবার আশ্রম থেকে সত্যনারায়ণ পান্ডার দাহকাজের শেষে, ওরা আমাদের কেন ওদের সঙ্গে গঙ্গোত্রী নিয়ে যেতে রাজি হয় নি। আমি বেশ দ্রুত হেঁটে চলেছি। রাস্তা অনবরত বাঁক নিচ্ছে, ফলে একটু পরেই দিলীপ ও মাধব, আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। কতটা পথ এইভাবে এগিয়েছি জানিনা, সামনে জনা ছয়-সাত যুবক-যুবতীকে আসতে দেখলাম। সবাই বাঙালি। প্রথম এই রাস্তায় বাঙালি কোন মহিলা যাত্রীকে, যাত্রী না বলে তীর্থযাত্রীকে বলা বোধহয় ঠিক হবে, আসতে দেখলাম। ওরা নিজেরাই আলাপ শুরু করে দিল। হাওড়া-কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে। যমুনোত্রী হয়ে গঙ্গোত্রী যাচ্ছে, ক্ষমতায় কুলোলে গোমুখ যাবে। তবে ওদের কথাবার্তায়, গোমুখ যাবার মতো ক্ষমতা থাকলেও, মনোবল আছে বলে মনে হল না। প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্যই জানালাম। ওরা জিজ্ঞাসা করলো, ডাবরানী থেকে আজ বাস পাওয়া যাবে কিনা। আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বলে জানালাম, ভাগ্য ভাল থাকলে, প্যাসেঞ্জার পাওয়া গেলে, ড্রাইভারের মর্জি হলে, আজই বাস পাওয়া যেতে পারে। প্যাসেঞ্জার না পেলে দশ দিনও অপেক্ষা করতে হতে পারে। ইতিমধ্যে মাধব ও দিলীপ এসে গেছে। আমরা এবার ওদের যমুনোত্রীর পথ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। শ্রীরামপুরের এক যুবক জানাল, যমুনোত্রীর পথ খুব কষ্টকর। সেই তুলনায় এ পথে কষ্ট অনেক কম। আরও বলল, ও পথে দেখার বিশেষ কিছু নেই, শুধু মাত্র যাওয়ার জন্যই যাওয়া। চেষ্টা করে দেখুন, পৌঁছে যেতে পারেন। ওর বাচনভঙ্গি সহ্য হল না। বললাম, আমরা হেমকুন্ড সাহেব, ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, বসুধারা, ত্রিযুগীনারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী আর গোমুখ হয়ে যমুনোত্রীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছি। এতগুলো জায়গার পথের কষ্ট নিশ্চই যমুনোত্রীর পথের কষ্টের চেয়ে কিছু বেশিই হবে। কাজেই আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, আমরা ওখানে পৌঁছে যাব। ওরা এই মরণফাঁদ থেকে কম কষ্টে, সহজে ফিরে আসুক কামনা করে, শুভেচ্ছা জানিয়ে, আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
একে গোটা রাস্তাটাতেই খুব চড়াই উতরাই ভাঙতে হয়, তার ওপর আমরা আবার বাইপাস ব্যবহার করতে শুরু করলাম। ফলে প্রাণান্তকর কষ্ট হলেও খুব তাড়াতাড়ি এগোতে লাগলাম। তবু যেন যাওয়ার সময়ের কষ্টের কাছে কিছুই কষ্ট নয় বলে মনে হচ্ছিল। সব জায়গায় দেখেছি, যাওয়ার সময় একটা নতুন জায়গা দেখার আগ্রহেই বোধহয়, হাঁটার কষ্ট ফেরার সময়ের তুলনায় অনেক কম বলে মনে হয়। একমাত্র এই পথে, ফাঁদ থেকে বেরোবার তাগিদেই বোধহয়, ঠিক তার উল্টো অনুভুতি হচ্ছে। আসবার সময় কিছুটা এগিয়ে একটা ছোট ব্রিজ পার হতে হয়েছিল। ব্রিজটার তলায় অল্প নিচু দিয়ে কোন একটা ঝরনা বা ছোট পাহাড়ি নদীর জল, নীচে গঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। মাধব অনেক ওপর থেকে চিৎকার করে আমায় ডেকে খাবার জল সংগ্রহ করতে বলল। আর কিছুটা এগোলেই যাবার সময় দেখা প্রথম ঝরনাটা পাওয়া যাবে। তবু ওর কথায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। কয়েকজন স্থানীয় ছেলে মগ হাতে ব্রিজের শেষে দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও বোধহয় এই ব্রিজের নীচ থেকেই জল তুলে এনে পান করেছে। পাত্রটা চেয়ে নিয়ে খুব ঢালু পথ বেয়ে নেমে, খানিকটা জল এনে আমরা তিনজনই অল্প করে জল পান করলাম। পাত্রটা ফেরৎ দিয়ে আবার এগিয়ে চললাম। আরও খানিকটা পথ এগিয়ে গাংগানীর সেই জলপাই রঙের নতুন ব্রিজটা চোখে পড়লো। গতি বৃদ্ধি করে এগিয়ে গিয়ে, গাংগানীর একটু আগে একটা চায়ের দোকানে, একজনের ডাকে, ঢুকলাম। আসবার সময় গাংগানী বা গরমকুণ্ড থেকে একটু ওপরে উঠে অনেকগুলো সম্ভবত মিলিটারি তাঁবু দেখেছিলাম। এই দোকানটা তখন বন্ধ ছিল। এখন শুনলাম, ওই তাঁবুগুলোতে রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে এবং খাটিয়া ভাড়া পাওয়া যায়। যে ভদ্রলোক আমাদের ডাকলেন, তিনি বললেন, "আপনারা তো যাবার সময় গরমকুণ্ডে ছিলেন। ওই দোকানে আমি আপনাদের দেখেছিলাম।" আমরা ভালভাবে ঘুরেছি শুনে উনি খুব খুশি হলেন। এমন সময় পাশ দিয়ে লালবাবাকে যেতে দেখলাম। দোকানী লালবাবাকে চা খেয়ে যাওয়ার জন্য ডাকলেন। তিনি গরমকুণ্ডে স্নান সেরে চা খাবেন জানালেন। চা খেয়ে, ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, এগিয়ে গেলাম। যাবার পথে লালাজীর দোকানে একবার উঁকি দিয়ে গেলাম। লালাজীর দেখা মিলল না। ব্রিজ পার হয়ে, সোজা ভুখির উদ্দেশ্যে এগোলাম।
এবারের রাস্তা ভাঙা হলেও বাস রাস্তা। সঙ্গীদের বললাম পা চালাতে। সম্ভব হলে আজই ভুখি থেকে সোজা উত্তরকাশী চলে যাব। হাতে যথেষ্ট সময় আছে। একসময় ভাঙা এবড়ো-খেবড়ো জায়গাটা পার হয়ে, যেখানে ড্রিল করে ব্লাষ্টিং করিয়ে, পাহাড় কেটে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সেই জায়গায় এসে হাজির হলাম। দূর থেকে দেখলাম কয়েকজন লোক, ওই ব্লাষ্টিং করা জায়গাটার আগের বাঁকটায় বসে আছে। একটা বুলডোজার দাঁড়িয়ে আছে। ওটা ব্লাষ্টিং করে ভাঙা পাহাড়ের টুকরোগুলো ঠেলে খাদে ফেলছে। মাধবের পায়ের ব্যথাটা বোধহয় আবার বেড়েছে। চিৎকার করে ওকে তাড়াতাড়ি আসতে বললাম। বুলডোজারটা লোক চলাচলের জন্য কিছুক্ষণ কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছে। ওটা কাজ শুরু করলে আবার অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। প্রায় পার হয়ে গিয়ে, মাধবকে হাত নেড়ে তাড়াতাড়ি আসতে বলছি, ওদিকে বুলডোজারটা আর অপেক্ষা না করে নড়ে উঠে কাজ শুরু করে দিল। একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক কাজ তদারকি করছেন। ভদ্র্রলোক আমাকে ডেকে এদিকে ফিরে আসতে বললেন। ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে মাধব এসে গেছে। পাঞ্জাবি ভদ্রলোক বললেন "একটু অপেক্ষা করে যান। এখন পার হওয়া বিপজ্জনক"। বুলডোজারটা পাথরগুলো খাদে ঠেলে না ফেলে, রাস্তার ধারে, খাদের দিকে জড়ো করে রাখছে। সম্ভবত একবারে ঠেলে সব পাথর তলার খাদে ফেলবে। ওই জড়ো করা পাথরের ওপর দিয়েই আমাদের পার হতে হবে। অর্থাৎ একবারে রাস্তার ধারে, শেষ প্রান্ত দিয়ে যেতে হবে। ভয় হচ্ছে কোন পাথরে পা দিয়ে সব সমেত খাদে না চলে যাই, সমস্ত পাথরই ভাঙা, নড়বড়ে। অনেক নীচ দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। তলায় গড়িয়ে পড়লে গঙ্গার জল মুখে ঢোকার আগেই, গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে। একটু পরে একে একে খুব সাবধানে ভাঙা জায়গাটা পার হয়ে এলাম। এবার রাস্তা পাকা ও বেশ ভাল। বাস যাবার উপযুক্ত। আর হাঁটায় কোনও অসুবিধা নেই। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুখি চলে এলাম।
হায় কপাল! একটা বাসকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম না। টিকিট কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আজ কোন বাস যাবে না। কাল ভোরে বাস ছাড়বে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আজ বাস না পাওয়া মানে পুরো একটা দিন নষ্ট। তাও আবার ভুখির মতো একটা অখ্যাত গন্ডগ্রামে। আজ উত্তরকাশী যেতে পারলে, আগামী কালই আমরা যমুনোত্রী যাবার হাঁটাপথের শুরু, সায়নাচট্টি চলে যেতে পারতাম। এখন তো মনে হচ্ছে এর থেকে গরমকুণ্ডে লালাজীর দোকানে থেকে গেলেই ভাল করতাম। কোন উপায় নেই। বাঁপাশের ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিলাম। দোকানীর সঙ্গে কথা বলে এখানেই রাতের বিশ্র্রামের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেললাম। এখানেও কোনরকম আমিষ খাবার পাওয়া যাবে না। তার মানে সেই রুটি আর পচা আলুর তরকারি কপালে নাচছে। একটু কিছু ভাল খাবারের জন্য জিভ একবারে ছটফট করছে। থাকা খাওয়ার কথা পাকা করার ব্যাপারে কথা বলছি, এমন সময় একটা বাস উত্তরকাশীর দিক থেকে এসে হাজির হল। আবার টিকিট কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাস আজ যাবে, তবে ঊত্তরকাশী পর্যন্ত যাবে না। আজ 'ভাটোয়ারী' পর্যন্ত যাবে। ওখানে বাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে, সম্ভব হলে উত্তরকাশী যাবে। থাকা-খাওয়ার প্রোগ্রাম চটজলদি বাতিল করে ভাটোয়ারী পর্যন্ত তিনটে টিকিট কাটা হল। কাউন্টার থেকে উত্তরকাশী পর্যন্ত কোনও টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। ভাটোয়ারী পর্যন্ত তিনজনের সেই মোট তিন টাকা ভাড়া লাগল। বাসে অনেক প্যাসেঞ্জার উঠেলেও, বাস ছাড়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। "না আঁচালে বিশ্বাস নেই" কথাটার প্রকৃত অর্থ বাস্তবে বুঝতে হলে এইসব এলাকার বাসে চাপতে হবে! বাস ছাড়ার আগে যে কোন মুহূর্তে, আজ আর বাস যাবে না, বা বাস আজ অতদূর না গিয়ে এই জায়গা পর্যন্ত যাবে, শোনার সম্ভাবনা পদে পদে। বাসের সব প্যাসেঞ্জার তাড়াতাড়ি বাস ছাড়ার জন্য অনুরোধ করছে। দেরি হলে উত্তরকাশী যাবার আর কোন সম্ভাবনাই থাকবে না। বেশ কয়েকজন মিলিটারি যাত্রীও আছে। এমন সময় বাসটার ঠিক পিছনে খুব উঁচু একটা ট্রাক এসে দাঁড়াল। ট্রাকটার একেবারে ওপর পর্যন্ত, কাঠের গুঁড়ি বোঝাই। একে একে মিলিটারিরা প্রায় সবাই, ট্রাক ড্রাইভারকে বলে, ট্রাকের ভিতরে ও ওপরে কাঠের গুঁড়ির ওপর চেপে বসল। জানা গেল ট্রাকটা সোজা উত্তরকাশী যাবে। আমরাও ঠিক করলাম ট্রাক ড্রাইভারকে অনুরোধ করে, এই ট্রাকেই উত্তরকাশী চলে যাব। মাধব বলল, ওতে করে যাওয়া খুব বিপজ্জনক হবে। দিলীপের কিন্তু ট্রাকে যাবার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেখলাম। আমিও বুঝতে পারছি, ওই উঁচু ট্রাকে কাঠের ওপর কোন কিছু না ধরে অতটা পথ যাওয়া সত্যিই খুব ঝুঁকির। কিন্তু এই মুহূর্তে উত্তরকাশী যাওয়ার জন্য যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। ভাবতে ভাবতেই দেখি, অনেক সাধারণ যাত্রীও ট্রাকে উঠে পড়ল। ট্রাকের একেবারে ওপরে, গাছের গুঁড়ির ওপর উঁচু হয়ে বসে, মোটা গুঁড়ি ধরে রয়েছে। ট্রাক একটু লাফালে টাল সামলানো সত্যিই খুব কষ্টকর হবে। ভাবলাম, এগুলো নিয়ে ট্রাকে বসে ভাবা যাবে, আগে ট্রাকে যাওয়ার ব্যবস্থাটা পাকা করে নেওয়া যাক। শেষ পর্যন্ত দিলীপ গিয়ে ড্রাইভারকে অনুরোধ করল বটে, কিন্তু ওর সেই দুর্বল অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে, ড্রাইভার জানাল, ভাটোয়ারীতে ট্রাক একটু খালি হবে, তখন সে আমাদের তার ট্রাকে তুলে নেবে। আরও বেশ কিছুক্ষণ বাস ও ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকার পর কী হল বুঝলাম না, বেশ কিছু লোক ট্রাক থেকে নেমে এসে আবার বাসে উঠে বসল। একটু পরেই ট্রাকটা ছেড়ে দিল। বাসের ড্রাইভার বলল, ভাটোয়ারীর পরে পাহাড় ব্লাষ্টিং করানো হয়েছে। কাজেই ট্রাকের সব যাত্রীকেই ওখানে নেমে যেতে হবে। আজ আর কোন গাড়িকেই ভাটোয়ারীর ওদিকে যেতে দেওয়া হবে না। সামান্যই পথ, একটু পরেই আমরা ভাটোয়ারী পৌঁছে গেলাম। বাস কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল, আজ আর বাস যাবে না। কাল ভোর বেলা বাস ছাড়বে। বাসের অফিসের সামনে অনেক প্যাসেঞ্জারের ভিড়। সকলেই বাসকে আজই উত্তরকাশী নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করছে। ড্রাইভারের কথাবার্তায় বেশ বুঝতে পারছি, ও ইচ্ছা করেই আজ বাস নিয়ে যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত অত লোকের অনুরোধে, কর্তৃপক্ষ জানাল, ওদিক থেকে কোন বাস এলে, তবেই এই বাস যাবে। ট্রাক থেকে সত্যিই সব লোককে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাধব বলল, অনেক লোক, জায়গাটাও খুবই ছোট, আগে থেকে একটা থাকার জায়গা ঠিক করা উচিৎ। কিন্তু ওই যে, আশায় মরে চাষা। আমাদের এখনও আশা, বাস হয়তো যাবে। এর মধ্যে উত্তরকাশীর দিক থেকে সত্যিই একটা বাস এসে উপস্থিত হল। কথামতো এবার আমাদের বাস ছাড়ার কথা। সমস্ত প্যাসেঞ্জার বাসে উঠে পড়ল। এবার কিন্তু ড্রাইভার অন্য চাল চালল। আমাদের বাসের ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর, ভুখিগামী বাস ড্রাইভারকে বলল, এই বাসের প্যাসেঞ্জারদের উত্তরকাশী নিয়ে যেতে। সে নিজে তার বাসে ভুখির প্যাসেঞ্জারদের পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ এ বাসের প্যাসেঞ্জারদের ওই বাস এবং ওই বাসের প্যাসেঞ্জারদের এই বাস নিয়ে যাবে। এই ব্যবস্থায় আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু আপত্তি করল অন্য বাসের ড্রাইভার। সে এই প্রস্তাবে রাজি হল না। আমাদের উত্তরকাশী যাওয়ার বাড়া ভাতে, ওই ড্রাইভার, জল ঢেলে দিল। সকলের সমস্ত অনুরোধ উপেক্ষা করে, আমাদের বাস ড্রাইভার বলল, ওদিকের রাস্তা ভাল নেই, বাস আজ আর যাবে না। কাল খুব ভোরে বাস যাবে। ট্রাকটা চলে গেল। আমাদের অজানা-অচেনা ছোট্ট একটা আধা শহরে বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে, ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর বাস কর্তৃপক্ষের অফিসে আড্ডা দিতে চলে গেল।
অফিস ঘরের ঠিক পাশের ঘরটা আমরা রাতের আস্তানা হিসাবে ভাড়া নিলাম। এখানে থাকার মতো কোন হোটেল নেই। ঘরবাড়ির সংখ্যাও খুব কম। কোন গেষ্ট হাউস বা ট্রাভেলার্স লজও নেই। ঘরের মালিকের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলাম, আমরা তিনজন থাকব, আর কাউকে ঘরে ঢোকানো যাবে না। ছ'টাকা ভাড়া দিলে সে তাতে রাজি আছে জানাল। আমরাও রা্জি হয়ে গেলাম। ঘরের মালিক ভাঁজ করা কাঠের দরজা খুলে দিল। এটা একটা গুদামঘর বলে বলে মনে হল। এর দরজাও, দোকানের দরজার মতোই একদিক থেকে অপর দিক পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং একদিক থেকে অপর দিক ভাঁজ করে করে খুলতে হয়। ঘরের ভিতরে একপাশে, প্রায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে, সম্ভবত ময়দার বস্তা, একটার ওপর একটা, প্রায় ছাদ পর্যন্ত সাজিয়ে রাখা আছে। পাশে দুটো চওড়া তক্তাপোশ। তক্তাপোশে গরমকুণ্ডের লালাজীর দোকানের মতোই নোংরা, ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত তোষক পাতা ও একই মানের লেপ ভাঁজ করে রাখা আছে। ঘরের পিছন দিকে, অর্থাৎ মূল দরজার বিপরীতে আর একটা সরু দরজা বন্ধ করা আছে। ঘরের মালিক পাশ দিয়ে গিয়ে পিছনের ছোট দরজার শিকলটা খুলে দিল। এখানে বেশ গরম। রাতে এই বদ্ধ গুদাম ঘরে ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। দরজা খুলতে পিছনে এক অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ল। দরজা দিয়ে বেরিয়েই, সরু বারান্দা। আমাদের ডানপাশের বাসের অফিস ঘরেরও একই রকম একটা দরজা দিয়ে, ওই বারান্দায় আসা যায়। আমাদের এই বাড়িটা যদিও একতলা, বাস রাস্তার ওপরে একই লেভেল-এ অবস্থিত, তবু পিছনের বারান্দায় দাঁড়ালে বোঝা যায়, অন্তত তিন-চার তলা উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছি। বারান্দার ঠিক পরেই খাদ। বেশ নিচে দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। বারান্দাটা যেন ওই খাদের ওপর ঝোলানো। দোকানের মালিককে বিদায় করে, বারান্দায় বসে, প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে, মনের সুখে এখান থেকে কেনা চিনাবাদাম খেলাম। আহা কী সুখ! বাদামের খোলা ফেলার কোন ঝামেলা পর্যন্ত নেই। হাত বাড়িয়ে নীচের খাদে ফেলে দিলেই হল। কত সুবিধা। দোকানের মালিক নিজে থেকে উপযাচক হয়ে এসে, বেগন বা ফ্লিট জাতীয় কিছু একটা, ঘরের তক্তাপোশের ওপর বেশ ভাল করে স্প্রে করে দিয়ে গেল। এতদিন অন্যান্য সব জায়গায় দেখে এসেছি, দোকান, হোটেল বা লজে,পিসু নামক ভয়ঙ্কর প্রাণীটিকে কোন ধর্তব্যের ব্যাপার বলে মনে করে না। এ বাবু আবার কিছু বলার আগেই বিছানায় স্প্রে করে দিয়ে যেতে, এখানে মহাপিসু বা রামপিসু জাতীয় কিছু আছে কিনা ভেবে ভয় হল।
আসার সময়, বাস থেকে নেমেই, একটা ছোট্ট হোটেলগোছের দোকানে ডিম সাজানো আছে দেখেছিলাম। তাই বোধহয় সন্ধ্যাবেলাতেই প্রচন্ড খিদে-খিদে পাচ্ছে। বাইরে যাব বলে ঘরের পিছন দিকের ছোট দরজাটা বন্ধ করে শিকল দিতে গিয়ে দেখি, শিকলটা মাপে বেশ ছোট। মালিক কী কায়দায় ওটা আটকে ছিল বুঝতে না পেরে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে, সামনের বিরাট চওড়া দরজাটা হাট করে খুলে রেখে, সমস্ত জিনিসপত্র ঘরের একপাশে রেখে, জলখাবার খেতে গেলাম। সামনের দরজা খুলে রাখার কারণ, যাতে পিছনের দরজা দিয়ে পাশের ঘরের কেউ ঢুকলে রাস্তার লোক দেখতে পায়। রাস্তার দু'পাশে অনেক দোকান। রাস্তার ওপাশে স্টেট ব্যাঙ্ক। সুন্দর রাস্তা পাহাড় ও গঙ্গার পাশ দিয়ে চলে গেছে। আমরা তিনজন বুভূক্ষু সোজা সেই দোকানে গিয়ে তিনটে ওমলেট, সেঁকা পাঁউরুটি আর চায়ের অর্ডার দিলাম। মনটা বেশ খুশিতে ভরে গেছে। ডিমের ওমলেট আমাদের উত্তরকাশী না যেতে পারার দুঃখ অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছে। রাতের কী খাবার পাওয়া যাবে খোঁজ করতে গিয়ে তো দেখি, আমাদের জন্য আরও অনেক বড় বিষ্ময় অপেক্ষা করছে। এখানেই থেকে যাব কী না ভাবতে হবে। এই দোকানে মাংস পাওয়া যায়, - দাম পাঁচ টাকা প্লেট! এক মুহর্ত সময় নষ্ট না করে, তিন প্লেট মাংসের অর্ডার দিয়ে, জলখাবার খেয়ে, এদিক ওদিক একটু ঘুরতে গেলাম। আকাশে বেশ মেঘ করেছে, বৃষ্টি এলেও আসতে পারে। একটু ঘুরেফিরে, রাতের আস্তানায় ফিরে গেলাম।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ খেতে গেলাম। এতদিন পেট ভরাবার জন্য খেতে গেছি, আজ অনেক দিন পরে, খাওয়ার জন্য খেতে গেলাম। দোকানে গিয়ে দেখি তিনটে বেঞ্চ, তিনটেতেই খদ্দের ভর্তি। এইসব এলাকার লোকেরা যেমন পরিশ্রমী হয়, এদের আহারও সেইরকম দেখার মতো। একজন লোক সেই পুরোনো কায়দায় রুটি তৈরি করে যাচ্ছে। আর একজন খাবার থালায় রুটি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। রুটির যোগান দিতে গিয়ে, দু'জনেই হাঁফিয়ে যাচ্ছে। এক-একজন বোধহয় গোটা কুড়ি করে রুটি খেয়ে নিল। কাঠের আগুনের তেজ ক্রমে কমে আসছে, আমরা দাঁড়িয়েই আছি। অন্য কোথাও যাবারও উপায় নেই, কারণ অন্য কোথাও এমন সুখাদ্য মিলবে কিনা জানা নেই। এবার রুটি খাওয়া শেষ করে, ওরা চাউল আনতে বললো। তা বলুক, যা খুশি আনতে বলুক, মাংস আনতে না বললেই হল! কিন্তু ভয় হল রুটির মতো চাউল খেলে, আমাদের রাত এগারোটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ভেবে। বোধহয় আমাদের তিনজনের ক্ষুধার্ত, অসহায়, অবাক হওয়া মুখগুলো খেয়াল করে লজ্জায় ওরা আজকের মতো খাওয়ায় ইতি টানল।
তিনজন মহানন্দে বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। তিনটে প্লেটে, চার টুকরো করে মাংস ও ঝোল দেওয়া হল। হাওড়া-কলকাতায় অমানুষ পাঁপড় নামে, এক্রকম পাঁপড় বিক্রি হয়, ভাজলে হলদেটে গোল নলের মতো দেখতে। চার টুকরোর মধ্যে তিন টুকরো করে ওই রকম নলী। লম্বা কোন নলীকে পিস্ পিস্ করে কেটে দেওয়া হয়েছে। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, নলীগুলোকে ঘষে মেজে বেশ পরিষ্কার করা হয়েছে। বাইরে তো কিছু নেই-ই ভিতরেও কোন ময়লা নেই, চোখের কাছে দুরবীনের মতো ধরলে দূরের জিনিস একবারে পরিষ্কার দেখা যায়। বাধ্য হয়ে ফেলে দিলাম। খুব লজ্জা করলেও, বলতে বাধা নেই, ফেলবার আগে চুষে নিতে কিন্তু ভুল করি নি। কাঠের উনুনে আগুন তখন প্রায় নিভে এসেছে। ফলে প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট অন্তর, তিনজনের তিনটে করে আধ পোড়া, আধ কাঁচা রুটি নিয়ে আসছে। তিনজনের তিন-চারটে করে রুটি পেতেই, বেশ দেরি হয়ে গেল। অগত্যা আর রুটি খাবার আশা ত্যাগ করে উঠে পড়লাম। মাংসের কথা বলতে দোকানদার বলল, এখানে একমাত্র সেই মাংস রাখে। উত্তরকাশী থেকে মাংস আসে। ফলে যা পাঠায় তাই নিতে হয়। মিলিটারিরা মাঝে মধ্যে পাঁঠা কাটে। তারা সমস্ত ভাল মাংস নিয়ে, তাকে এই জাতীয় মাংসই বিক্রি করে। স্থানীয় লোকেরা বাধ্য হয়ে এই মাংসই কিনে খায়। সে ইচ্ছা করে আমাদের খারাপ মাংস দেয়নি। এরপর তাকে আর কিছুই বলার থাকতে পারে না। খাওয়া সেরে মৌরি মুখে দিয়ে পরম সুখে গুদামঘরে ফিরে এলাম।
এরকম গুরুপাক খাবার পর একটু নেশা না করলে চলে না। দেখি একটাও সিগারেট সঙ্গে নেই। আমি ও মাধব, দিলীপকে গুদাম ঘরে বসিয়ে রেখে, গেলাম সিগারেটের দোকানের খোঁজে। আশেপাশে কোন দোকান খোলা নেই। অত রাতে, রাত বলতে তখন প্রায় দশটা বাজে, যে কয়টা দোকান খোলা আছে, সব-ই টেলারিং শপ। এখানে এত জামা প্যান্ট কারা তৈরি করতে দেয়, ভগবান জানেন! আশা ছেড়ে দিয়ে গুদাম ঘরে ফিরে এসে দেখি, দিলীপ একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে তক্তাপোশে বসে কথা বলছে। ভদ্রলোক অনেকক্ষণ আমাদের সঙ্গে গল্প করলেন। একপুরুষ আগে থেকেই তাঁরা এখানকার বাসিন্দা। সৎপথে ব্যবসা করায় আজ আর তাঁর কোন অভাব নেই। গত বছরের বন্যার কথা উঠতে বললেন, এরকম ভয়ঙ্কর বন্যা তিনি কোনদিন দেখেননি। প্রায় রাত এগারোটা পর্যন্ত কাটিয়ে তিনি যাবার জন্য উঠলেন। আমাদের কাছে সিগারেট নেই শুনে বেশ কয়েকটা বিড়ি দিয়ে গেলেন।
জল খেয়ে, বাইরের বড় দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। দিলীপ বলল, ভদ্রলোক এসে তার ঘড়িটার খুব প্রশংসা করে, হাতে নিয়ে দেখতে চান এবং কত দাম ইত্যাদি খোঁজখবর করেন। লোকটার ঘড়িটা ছিনতাই করার মতলব আছে ভেবে ও খুব ভয় পেয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রেই পরে আমাদের অনুতাপ হয়। আমরা সবাইকে কলকাতার কলুষিত মন নিয়ে বিচার করি, সন্দেহ করি। এখানে পিসু আছে কিনা জানার সৌভাগ্য না এখনও হলেও, ছারপোকার দৌরাত্ম্য যথেষ্ট আছে। তাদের বিছানার ওপর দিয়ে পরিবার নিয়ে ঘোরাফেরা করতেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ছারপোকারা বোধহয় পিসুর এঁটো খায় না, তাই রাতে ওরা আমাদের খুব একটা অত্যাচার করেনি।
বেশ ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। সেপ্টেম্বর মাসের দু তারিখ। আজ সম্ভবত সায়নাচট্টি পৌঁছাব। তার মানে আগামীকাল যমুনোত্রী যাচ্ছি। দিলীপ ও মাধবকে বিছানায় দেখতে পেলাম না। বালিশের তলায় দেখলাম ওদের ঘড়িদুটো রাখা আছে। ওগুলো পকেটে নিয়ে, দরজা খুলে রেখেই রাস্তায় এলাম। সকালের কাজকর্ম সেরে, হাতমুখ ধুয়ে, চা জলখাবার খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়ে বাসে গিয়ে নিজেদের আসন দখল করে বসলাম। ঠিক সময়েই বাস ছেড়ে দিল। তিনটে উত্তরকাশীর টিকিট বার টাকা ত্রিশ পয়সা দিয়ে কেটে নিয়েছিলাম। উত্তরকাশী ট্রাভেলার্স লজ থেকে মালপত্রগুলো নিতে হবে। বাস আবার সেই আগের দেখা রাস্তা দিয়ে উত্তরকাশীর পথে এগিয়ে চলল। একসময় আসবার পথে দেখা ড্যামটাকে বাঁপাশে রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। আসবার পথে এ রাস্তা আমরা দেখে গেছি, কাজেই নতুন করে দেখার কিছু নেই। তাছাড়া ভয়ঙ্কর খাদ, সুন্দরী ঝরনা, মন মাতানো রঙিন ফুল, কোন কিছুই আর আমাদের আগের মতো পাগল করছে না। মনে শুধু একটাই চিন্তা, কখন উত্তরকাশী পৌঁছব, আজ সায়নাচট্টি পৌঁছতে পারব তো?
ভাবতে ভাবতেই উত্তরকাশীতে বাস এসে দাঁড়াল।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। ভ্রমণ কাহিনি ছাড়া গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লিখতে ভালো লাগলেও এই প্রথম কোনও পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠানো। 'আমাদের ছুটি' পত্রিকার নিয়মিত লেখক, পাঠক, সমালোচক এখন নেমে পড়েছেন কীবোর্ডে-মাউসে সহযোগিতাতেও।