বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই কিন্তু এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - amaderchhuti@gmail.com
শুশুনিয়া পাহাড় আর এক টেনিদার গল্প
তীর্থঙ্কর ঘোষ
|| তথ্য - শুশুনিয়া ||
বর্ষাকাল হলে কী হবে, ছিটেফোঁটা বৃষ্টিরও লক্ষণ নেই, বরং বেশ গরম। সকাল দশটা বাজে, কলকাতা থেকে ট্রেনে ছাতনা এসে পৌঁছেছি। ছাতনায় চণ্ডীদাসের নামে একটা কলেজ হয়েছে -বড়ু চণ্ডীদাস মহাবিদ্যালয় -বাইরে থেকেই ঘুরে দেখলাম। একটুক্ষণ আশপাশটা ঘুরে নিয়ে এক কাপ চা খেয়ে শুশুনিয়া মোড় থেকে ট্রেকারে রওনা -সবুজ জঙ্গলে ঘেরা পথে মিনিট পনেরো-কুড়ি - তিন মাথার মোড়ে।
তিনমাথার মোড় থেকেই ডানদিকের সরু রাস্তাটা চলে গেছে একেবারে শুশুনিয়া পাহাড়ের নীচে যেখানে ঝরনার জলটা এসে পড়েছে। মোড়ের মাথায় বেশ কয়েকটা ঝুপড়ি দোকান আছে। ঠিক বাঁহাতেরটাই ঝড়ুদার দোকান। ঝড়ুদার সঙ্গে ফোনে কথা বলাই ছিল, দোকানে গিয়ে বলতেই সোজা পাঠিয়ে দিল গ্রিন লজে। এখানে থাকার জায়গা মোটে তিনটে - কোলে বাংলো, রামকৃষ্ণ লজ আর এই গ্রিন লজ। গ্রিন লজে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে দেখি পুরো লজটাই ফাঁকা, কোনও বোর্ডারতো নেই-ই, নাইটগার্ডও পালিয়েছে। আমি রাতে থাকব শুনে ম্যানেজার একটু কিন্তু-কিন্তু করছেন -রাতে তাঁরও বাড়িতে নাকি কীসব কাজ আছে। ঝড়ুদাকে আবার ফোন করতেই মুশকিল আসান -ম্যানেজারকে বলে দিল, চাবিটা ওকে দিয়ে দিন।
মোড়ের মাথার একটা ঝুপড়িতে খেয়ে, লজের কেয়ারটেকার ছেলেটার সাইকেলটা ম্যানেজ করে দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম। ছেলেটা পাশের গ্রামেই থাকে। গ্রিন লজের পাশ দিয়ে চার -পাঁচ কিলোমিটার নীচে নেমে, শুশুনিয়া গ্রাম। গ্রামটায় কয়েক হাজার লোকের বাস। একটা হাইস্কুল আছে, লাইব্রেরি আছে, ব্যাঙ্ক আছে। একটুক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে আবার তিনমাথার মোড়ে ফেরত এলাম। ট্রেকারটা ছাতনা থেকে এসে সোজা গেলে যেদিকে যেত সেইদিকে আরেকটু এগিয়ে বাঁহাতে একটা রাস্তা চলে গেছে হুকুমিয়া গ্রামের দিকে। দু’পাশে সুন্দর শালের জঙ্গল। দশ-পনেরো দিন টানা বৃষ্টি হয়নি, তবু বর্ষাকালতো, চারদিকটায় কেমন একটা সবুজ সবুজ ভাব, বেশ ভালো লাগছিল। ওই রাস্তাটা ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোলাম, গ্রাম পর্যন্ত আর যাইনি। ফিরে এসে সাইকেলটা ফেরত দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে ফের হাঁটতে হাঁটতে এসে শুশুনিয়া পাহাড়টার তলায় বসে রইলাম অনেকক্ষণ। কাল ভোর ভোর বেরিয়ে পাহাড়টায় উঠব ঠিক করলাম। সন্ধে সাতটা নাগাদ যখন ফিরছি তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। ফেরার সময় একটা দোকানে রাতের খাবারের কথা বলতেই বলল ঠিকাছে সাড়ে ন’টা নাগাদ চলে আসুন, খাবার রেডি হয়ে যাবে।
লজে ফিরতেই দেখি নিশ্ছিদ্র অন্ধকার -লোডশেডিং। কোনও লোক নেই, আলো নেই, গরম আর মশা -খানিক্ষণ এই বীভৎস অবস্থাটায় কাটিয়ে, দুত্তোর বলে চাবি লাগিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। পাশে একটা দোকান থেকে টর্চ কিনে নিয়ে ছাতনার দিকের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা নীচে নেমে এলাম। চারদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে দেখে নিচ্ছি আর তারপরেই মনে হচ্ছে অন্ধকারটা যেন আরও চেপে বসছে। দেখতে দেখতে সাড়ে ন’টা বাজল। খেয়ে নিয়ে খানিকক্ষণ বাইরে বসে রইলাম। রাস্তায় কুকুরগুলো চ্যাঁচামেচি করছে। স্থানীয় লোকজন কেউ কেউ বাইরেই চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। তীব্র অন্ধকার আর নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে একটা ট্রেকার চলে গেল। তার আলোটা চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। লজে ফিরে কিছুক্ষণ ছাদে কাটিয়ে আলো এলে নীচে নেমে এলাম।
পরদিন বেশ ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সাড়ে পাচঁটা বাজে। মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মোড়ে এসে দেখি একটা ঝুপড়ি দোকান খুলেছে। চা খেয়ে এগোলাম পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের পায়ের কাছে যেখানে ঝরনাটা এসে পড়েছে তার পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলার পথ উঠছে উপরে। স্থানীয় মানুষজন এই ঝরনার জলও পান করে। এটা নাকি বেশ উপকারীও, নানারকম মিনারেলস্ আছে। ঝরনার আশেপাশে কয়েকটা দোকান আছে। এখানকার বাসিন্দারা পাথর কেটে নানান জিনিসপত্র তৈরি করেন, তারই সব দোকান। তিনমাথার মোড়ের কাছেও এরকম বেশ কয়েকটা দোকান আছে। তবে হুকুমিয়া গ্রামের কাছে শিলালিপি গ্রামে গেলে কারিগরদের কাজ একেবারে সামনে বসেই দেখা যায়।
পাহাড় তো নয়, গাছপালায় ছাওয়া বড়সড় একটা টিলা। নানারকম পাখির ডাক শুনতে শুনতে আঁকাবাঁকাপথে ওপরে উঠছি।অর্ধেকটার কিছুটা ওপরে উঠে দেখি পায়ে চলার পথটা শেষ হয়ে গেছে, আন্দাজে আন্দাজেই উঠতে লাগলাম। পাহাড়ের একবারে মাথায় একটা ছোটমতো শিবমন্দির আছে। ঠিক ওপরে ওঠার আগেই একটা ঘনজঙ্গল। জঙ্গলটায় সবে ঢুকেছি। দেখি কীসের একটা খচখচ আওয়াজ হচ্ছে। ওঠার সময় মাঝেমধ্যে দুয়েকটা কাটা গাছ চোখে পড়েছিল ভাবলাম কেউ হয়তো কাঠ-টাঠ কাটতে এসেছে। নির্জন জঙ্গলে আওয়াজটা বেশ অদ্ভুত লাগছিল। ‘কে, কে’ করে চেঁচিয়ে উঠতেই আওয়াজটা থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড থেমে গিয়েই ফের শুরুহল। চারপাশে তাকিয়ে দেখি গাছের ডালে বেশ বড় বড় আমলকির মতো ফল ঝুলছে। তারই একটা ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়তেই কুরুক্ষেত্র কাণ্ড শুরু হল। উঁচু উঁচু গাছ -মাথার ওপরে ধুপধাপ ভয়ানক আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি কতগুলো প্রমাণ সাইজের হনুমান একগাছ থেকে অন্যগাছে লাফাচ্ছে। আমার মাথার উপরে গাছের ডালে বসে ওরা এতক্ষণ ফল খাচ্ছিল। আমি ফলটা ছুঁড়তেই ভীষণ একটা গোলযোগ বেঁধে গেছে। হঠাৎ নজরে পড়ল একটা হনুমান কিন্তু লেজটাকে গাছের ডালে জড়িয়ে রেখে দিব্যি ফল খেয়ে যাচ্ছে। এত কাণ্ডে ঘাবড়ায়নিতো বটেই উলটে আমার চোখে চোখ পড়তেই দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসার ভঙ্গী করছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখলাম, তারপর জঙ্গল থেকে একটু নেমে এসে ডানদিক দিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠলাম।
পাহাড়ের মাথায় গাছের ছায়ায় বসে আছি। নীচে তাকিয়ে দেখি সূর্য উঠে গেছে। জঙ্গল আর পাহাড়ের মাথায় কিন্তু রোদের আলো পৌঁছোচ্ছেনা। বেশ খানিক্ষণ পরে আস্তে আস্তে নীচে নেমে এলাম। ফিরে এসে লজের ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করি, পাহাড়ের উপরে জঙ্গলে হনুমান আছে? ম্যানেজারের নির্বিকার উত্তর, শুধু হনুমান কেন বুনো শুয়োরও আছে।
ভাগ্যিস!
নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার উচ্চপদে কর্মরত তীর্থঙ্কর কাজের ফাঁকে সময় পেলেই কাঁধে ঝোলা ফেলে বেরিয়ে পড়তে ভালোবাসেন।
ভাসছি রঙিন ক্যানভাসে
নীলাঞ্জন কুণ্ডু
|| তথ্য - গাদিয়াড়া ||
ডায়মন্ডহারবার লোকাল। সকালের চা গরম, কিছু নিত্যযাত্রীর হাসি-তামাসা, বাদাম ভাজা, খোলা মাঠ আর নীল আকাশ দেখতে দেখতে ছুটতে লাগলাম ডায়মন্ডহারবার। নিকোটিনে ভরা শহুরে ফুসফুস ক্রমশ চাঙ্গা হচ্ছে। মনে হল সব পিছু ফেলে এলাম। এসব ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম ডায়মন্ডহারবার স্টেশন। জনবহুল মফঃস্বল। টিকিট কাউন্টারের সামনে দিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছেই ভ্যানওয়ালাদের হাঁকডাক শোনা গেল। তাদের হাত এড়িয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়াই।
পরবর্তী গন্তব্য নূরপুর। খানিক্ষণের মধ্যেই এসে গেল বাস। উঠে পড়লাম। মিনিট চল্লিশেক ঝাঁকুনি, দুলুনি, খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম নূরপুর। এখান থেকে লঞ্চে নদী পেরোলেই গাদিয়াড়া। নদী দেখেই মন নেচে উঠল। এতকাছে এত সুন্দর জায়গা!
অনেকবার ছোটবেলায় এমন ভাবনা তো হয়েইছে। মাস্টারমশাই দিয়েছেন তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠানামার হিসাব করতে আর আমার মন সেই বর্ষার দিনে পক্ষিরাজ হতে চাইছে। সেদিন মনে হত ছুটি পেলেই ছুট্ লাগাবো। কিন্তু লম্বা ছুটি আর কই? তাই একছুটে ঘুরে আসা যায় এমন জায়গাই বড়ো টানে। নদীর অসীম বিস্তৃতি আর লঞ্চের দুলকি চালে চলে এলাম গাদিয়াড়া। লঞ্চঘাটে নেমে ডানদিকে সরকারি লজ আর বাঁদিকে বেশকিছু বেসরকারি খাওয়া ও থাকার জায়গা। যদিও অনেকেই দিনের দিন এসে ফিরে যান। আমার ইচ্ছাও তাই। শহর ছেড়ে দূরে মগ্ন হতে চাইছিলাম আমি। শঙ্খবাবুর কবিতা ধার করে বলি-
মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই
মানব শরীর একবার?
চুপ করে নিজের নির্জনতা খুঁজে নিয়ে সরে এলাম নদীর কাছাকাছি। আমি আর প্রকৃতি। ওপারে আরেকটি চর দেখা যাবে, গেঁওখালি। সেটিও টুরিস্ট স্পট হিসাবে সেজে উঠেছে। কিন্তু এবার পেটে বড় ভুখ্ - না খেলেই নয়। নদীর পাড়েই একটি পরিষ্কার হোটেল। ঢুকে পড়লাম। ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দির - এমন আদর্শে বিশ্বাসী না হলে তো আর হুট করে ছুট্ দেওয়া যায় না। খেয়ে এসে আবার নদী।যদিও এবার তাতে অন্য রং।দুপুর পেরিয়ে বিকেল আসছে।নদী শান্ত হচ্ছে। আকাশ ম্লান হচ্ছে।সূয্যিমামাও পাড়ি দিচ্ছে পশ্চিমের ঘর।
হঠাৎ মনে হল কনে দেখা এই গোধূলি আলোয় যদি নৌবিহার না করি তবে তো অসম্পূর্ণ এ ভ্রমণ। একটি কিশোর মাঝির সঙ্গে রফা করে চড়ে বসলাম। আহা, কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না! আপামর বাঙালি আজীবন নবকুমারের এই উক্তি মনে রাখবে। আমিও আরেকবার উচ্চারণ করলাম।
সাদা ছেঁড়া গেঞ্জি, হ্যাফপ্যান্ট আর মুখে সরল হাসি নিয়ে আমার নৌকার সারেং আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছিল দুই নদীর মিশে যাওয়ার কথা। দুটি রং মিশছে এক পাত্রে। আর তাতে এসে পড়েছে পড়ন্ত সূর্যের আভা। এত রঙিন ক্যানভাসে ভাসমান থাকতে পেরে ধন্য হচ্ছিলাম আমি। কিন্তু সময় তো নদীর মতো প্রবাহমান। তাই ফেরার সময়ও এগিয়ে আসে। আসার সময় গাদিয়াড়া লঞ্চঘাটে নূরপুর ফেরত লঞ্চের সময় জেনে নিয়েছিলাম। ফলে সময়ের সঙ্গে উপভোগ মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হল না। আমার তরণীর কিশোর আমায় উপহার দিল তালপাতায় বানানো তার হাতের কাজ। একসঙ্গে চা খেতে খেতে তার সঙ্গে খানিক্ষণ সুখদুঃখের গল্প করলাম। তার অভাবী সংসারের বারমাস্যা ঘোচাতে পারেনি গাদিয়াড়া। কারণ সৌন্দর্য মনের দরজায় নাড়া দেয় পেটের থাবার কাছে সে ঠাঁই পায় না। যাই হোক, অবশেষে চেনাবৃত্তের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই। সঙ্গে থাকল অনন্ত -অপারবিস্তৃত জলরাশি, ঘননিবিড় সবুজের মাঝে নির্জনতার শান্তি আর ডিঙি বাওয়া কিশোরের সরলতামাখা হাসির স্মৃতি।
এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে।
নীলাঞ্জন পেশায় শিক্ষক।