ছবিপটের ছায়ানটে
অভীক আচার্য
~ তথ্য- নয়াগ্রাম ~ || ~পটের ছবি ~
“তরুতলে কৃষ্ণ যে মূরলী দিল টান
গৃহকর্ম ছেড়ে রাধা জল আনিতে যান”
হাওড়া কলকাতা হস্তশিল্প মেলা -কাঠ, বেত, বাঁশ, বাটিক, কাঁথাস্টিচের ভিড়ে একপাশে নজরে পড়ল বেশকিছু পটচিত্র সাজিয়ে বসেছেন এক বৃদ্ধ। সামনে অসম্পূর্ণ পট, খয়ের ভেজাচ্ছেন জলে। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাই কী করবেন খয়ের ভিজিয়ে? বৃদ্ধ উত্তর দিলেন, চলে এস বালিচক, সব দেখতে পাবে।
যেন এই ডাকটার অপেক্ষাতেই ছিলাম…।
ট্রেন যখন বালিচক স্টেশনে পৌঁছোল তখন ঠিক দুপুর একটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে এসে পড়লাম বাস রাস্তায়। উঠেও পড়লাম বাসে। তবে ভেতরে নয় , ছাদে। ওখানেই যা একটু জায়গা ছিল। নাম না জানা গ্রামগুলো একে একে পেরোচ্ছে আর আমি এক একবার, এক একজনকে ‘দাদা/কাকু বালিচক আর কতদূর?’ - জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি। যত মত তত পথ। প্রশ্নের থেকে উত্তর বেশি পেয়ে যখন বেশ বিভ্রান্ত হয়ে উঠেছি ঠিক তখনই রাস্তার ধারে দোকানের হোর্ডিং-এ ‘বালিচক’ লেখাটা নজরে পড়ল। কন্ডাক্টরও বালিচক-বালিচক বলে চিৎকার করছে। নামতে গিয়ে দেখি একটা ছাগল ঘাড়ে করে এক যুবক সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। অগত্যা ছোট একটা লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। তখন মাথার উপর গনগনে সূর্য আর পেটের মধ্যে দাউদাউ আগুন। বাসস্ট্যান্ডে মাত্র দু’একটা দোকানই চোখে পড়ল। তারই একটায় ঢুকে দেখি বাংলা মদ আর মুড়ি বিক্রি হচ্ছে, সঙ্গে রসগোল্লা। চারটে বড় বড় বোম্বাই রসগোল্লা আত্মসাৎ করতে দু’মিনিটও লাগল না। খাওয়ার সময় স্বাদ বুঝিনি, পরে বুঝলাম শুধু এই রসগোল্লা খাওয়ার জন্যই বালিচক আসা যেতে পারে।
পথচলতি মানুষজনকে পটুয়াদের গ্রাম কোথায় জিজ্ঞেস করতে সকলেই একই জবাব দিলেন-‘পিছন দিকে একটু যান, গেলেই দেখতে পাবেন’। একটু একটু করে তা প্রায় দেড় কিলোমিটার পার হওয়ার পর রাস্তার ধারে দেখি একটা শিরিষ গাছের গায়ে ব্যানার টাঙানো –“ময়না পটুয়া - আহার ও থাকার সুব্যবস্থা আছে”। হোটেল ভেবে ভিতরে ঢুকে জানতে পারি ময়না পটুয়া আদতে একজন পটশিল্পী। পেটের দায়ে তুলি ছেড়ে হাতা-খুন্তি ধরেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে এসে সিগারেটের প্যাকেটটা পকেট থেকে বার করতে গিয়ে চোখ পড়ল এক বৃদ্ধের ওপরে। উনিও আমাকে আপাদমস্তক লক্ষ করছেন। এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন আসার কারণ। সব শুনে ওনার সঙ্গে যেতে বললেন একটা সিগারেটের বিনিময়ে। সরু মেঠো পথ বেয়ে গ্রামের ভেতরে ঢুকি। উঠোন, পেয়ারাতলা, বাবলা গাছের কোল ঘেঁষে পৌঁছোই টাটি দিয়ে তৈরি আচ্ছাদনে ঘেরা, মাথার ওপর প্লাস্টিকে ছাওয়া ঘরটার সামনে। বৃদ্ধ বললেন-‘ঘনশ্যাম-যান দেখে আসেন’। কাউকে দেখতে না পেয়ে ঘনশ্যাম পটুয়ার নাম ধরে ডাক দিই। ডাক শুনে একটা বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে এসে বলল, ‘দাদু ছাগল নাড়তে গেছে, বসেন - অখনি আসবে’। মিনিট পনেরো পর একটা ছেঁড়া গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বৃদ্ধ ঘনশ্যাম পটুয়া এলেন। মাঝারি উচ্চতার কাঁচাপাকা চুলদাড়িওলা এই মানুষটিকে দেখলে হঠাৎ করে হয়তো আলাদা করা যাবে না। গ্রামবাংলার দারিদ্র্যের চিহ্ন তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্যে, বিষণ্ণ চেহারায় আঁকা হয়ে রয়েছে। ওরই মধ্যে শিল্পীর চোখদুটো কিন্তু অন্যকথা বলছে। স্বীকৃতি কিম্বা ক্ষুধার অন্ন না পাওয়ার বেদনার পাশাপাশি জেগে রয়েছে শিল্পীর পূর্ণতার ইশারা।
‘দাদু এলোরে, আম্মা চা দে -আর একটা লোক বাইরে থেকে এসেছে দাদুর লগে দেখা করবে’-বাচ্চা মেয়েটির গলা শোনা গেল। চায়ের আমন্ত্রণে ভেতরে গেলাম। একটাই বড় ঘর - প্লাস্টিক, ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে বিভাজন। ঘরের যে অংশটা চোখে পড়ছে তাতে একটা মাদুর পাতা আর পাশে দুটো বিরাট টিনের বাক্স। পরিচয়পর্ব শেষ হতে না হতে লাল চা নিয়ে নয়না হাজির - ঘনশ্যাম পটুয়ার নাতনি। আমার আসার কারণ শুনে টিনের বাক্স খুলে দেড়শো বছরের প্রাচীন পট মেলে ধরলেন ঘনশ্যাম। কথায় কথায় ফুটে উঠল অপমান আর বঞ্চনার সুর। এত বছর ধরে সরকার থেকে কোনও সাহায্য পাননি। চার ছেলের একজনও বেছে নেয়নি শিল্পের এই পেশা। খিদের তাগিদে তাদের কেউ দিয়েছে সাইকেলের দোকান, কেউবা হয়েছে মিস্ত্রি। তবু তিরিশ হাজার টাকার প্রস্তাব পেয়েও ঘনশ্যাম দালালের হাতে বেচে দেননি তাঁর দাদুর আঁকা ‘রাবণ বধ’-এর জড়ানো পটটির মতো অসাধারণ সব সংগ্রহ। কিন্তু এরপর?
ঘনশ্যাম একের পর এক পট দেখান আর গল্প বলেন - পটের গল্প, পটুয়াদের কথা। পটের জন্মকথার জড়িয়ে আছে এক চেনা রূপকথা। সেই এক গ্রামে বক রাক্ষস এসে উপস্থিত হয়েছিল। তার খিদে মেটাতে প্রতিদিন গ্রামের একজনকে প্রাণ দিতে হত। সেবার পালা ছিল এক ব্রাহ্মণ পরিবারের। বাবা-মা দু’জনেই আগে রাক্ষসের হাতে প্রাণ দিয়েছে। এবার ভাই বা বোনের পালা। অথচ কেউই কাউকে ছাড়তে পারছে না মৃত্যুর হাতে। সেইসময় সেই গ্রামে উপস্থিত হয়েছিল চালচুলোহীন এক ফকির। তিনি এগিয়ে আসেন ভাইবোনদের বাঁচাতে। তবে শুধু বাঁচানোই নয়, ফন্দি করে বক রাক্ষসকে আয়না পাহাড়ের সামনে নিয়ে গিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিয়ে তাকে ফাঁদে ফেলে হত্যাও করে সেই ফকির। এই সংবাদ রাজার কানে পৌঁছোলে রাজা পুরস্কৃত করেন ফকিরকে। চিত্ররূপে সেই বীরত্বের কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে অনুরোধও করেন তাঁকে। ফকির সমস্ত ঘটনাটি নিয়ে গান রচনা করেন। তুলির রেখায় পটচিত্রে ফুটিয়ে তোলেন সেই যুদ্ধগাথা। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয় দিয়ে সূচনা হল পটশিল্পের। আগে গান, পরে হয় পট।
তুলি কালি মন
আঁকে লিখে তিনজন”
মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি ঘনশ্যামের বিচিত্র কথা। পটশিল্পের কাহিনি চিত্রিত হত হ্যান্ডমেড পেপারের ওপর প্রাকৃতিক রং আর ছাগলের লোম দিয়ে তৈরি তুলি দিয়ে। রং বলতে গুলঞ্চ, তেলাকুচা, খয়ের, হলুদ এইসব। আর রঙের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য তাতে মেশানো হত বেলের আঠা। চিত্র সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে গেলে কাগজের পিছনে সুতির কাপড়, গদের আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া হত। মূলতঃ দু’ধরনের পট তৈরি হয়-জড়ানো পট আর চৌকো পট। জড়ানো পটে কোনও কাব্য, ঘটনা এইসব চিত্রিত। পটুয়া দেখালেন কৃষ্ণলীলা, মনসামঙ্গল কাব্য, রামের বিবাহ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো অপূর্ব সব পটচিত্র। এখন নানান সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপরেও জড়ানো পট তৈরি হয়। গুনগুন করে সুর ধরলেন ঘনশ্যাম - জড়ানো পটের গল্প ‘বৃক্ষরোপণ’ -
‘সবাই মিলে কর গাছ রোপণ
ও জনগণ
গাছ থাকিলে পরে মানুষের উপকার করে
বাতাসে নিশ্বাস ধরে গাছের ধরম’…।
‘মাছের বিয়ে’ কিম্বা ‘সাঁওতালের চক্ষুদান’ এমন সব গল্পকথা নিয়ে শিল্পী ফুটিয়ে তোলেন চৌকো পট।
শিল্পের কোনও জাত নেই, জাত নেই শিল্পীরও। ঘনশ্যাম পটুয়া আর ওসমান একই ব্যক্তি। হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের মেলবন্ধনের উত্তরাধিকার এঁদের রক্তে। হিন্দুধর্ম অনুসারে অন্নপ্রাশন আর ভাইফোঁটার পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী নিকাহ্ কিম্বা মৃত্যুর পরে গোর দেওয়া হয়। এই ধর্মান্ধ পৃথিবীতে কত সহজে দুটো ধর্ম মিশে যেতে পারে দেখে আশ্চর্য হতে হয়। ডুয়েল রিলিজিওন বা ডুয়েল আইডেনটিটি এদের সম্পদ-যা কিনা এই ফান্ডামেন্টালিস্ট পৃথিবীর বুকে এক বিরল ইউনিভার্সাল ব্রাদারহুডের উদাহরণ। অথচ আমরা পারিনা।
গল্প শুনতে শুনতে হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য দুনিয়ায়। হঠাৎ ঘর থেকে মাঝবয়েসি এক মহিলা বেরিয়ে এলেন-‘চলেন খেয়ে লেবেন গা’ - চমকে উঠলাম। এ কেমন আব্দার। চেনা নেই, জানা নেই, একেবারে ভাত বেড়ে আন্তরিকতার হুকুম জারি! অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। শানকির থালায় মোটা চালের ভাত, ঢেড়স ভাজা আর পুঁই চিংড়ি। মন ভরে খেলাম। এতটা সম্মান, আন্তরিকতা - কোনওদিন পেয়েছি কিনা জানি না, মনে নেই। ‘আর একটু ভাত দিই’ - আমি অসম্মতি জানালাম - এক ঝলকে দেখার চেষ্টা করলাম সবটুকু ভাত-তরকারিই অনাহূত অতিথির পাতে ঢেলে দিয়েছে কিনা। বুঝলাম, আবার আরও একটা দুপুর বাড়ির মেয়েরা মুড়ি-বাতাসা খেয়ে কাটাবে। লজ্জা পাইনি - শুধুই বিষ্ময়, শ্রদ্ধা আর অজানা একটা রাগ নিয়ে গুম মেরে গেলাম। ঘনশ্যাম পটুয়ার গলায় তখন ক্ষোভের সুর - একটা মাঝারি মাপের পট বানাতেই অনেক সময় লাগে, কিন্তু সময় কোথায়? সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কেটে যায় জমিতে জন খেটে। তারপর সূর্য ডোবা পর্যন্ত শিল্পীর নিজস্ব সময়। গোধূলির তুলির টান দিতে দিতে সে হয়তো ভাববে রামধনুতে নিশ্চয় ফুটে উঠবে আদি, অকৃত্রিম, প্রাকৃতিক, কাল্পনিক “মাছের বিয়ে”-র রূপ।
“সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার কে জানে তার রূপ দিলো সে কোন মণিকার”
ট্রেনের জানালায় সরে সরে যাচ্ছে দৃশ্যপট। কানে বাজছে ঘনশ্যাম পটুয়ার কন্ঠস্বর। “দেখেন না শহরে গিয়ে যদি কয়েকটা ছবি বিক্রি করতে পারি। তাহলে প্রথম নাতিটার মতো দ্বিতীয় নাতনিটা নিউমোনিয়ায় মরবে না। সামনে বর্ষা-সব ভিজে যায় - শুধু পট ভর্তি টিনের বাক্সটা সবকিছু দিয়ে ঢেকে রাখি। পটগুলো যেন নষ্ট না হয়। এটা তো আমাদের দেশের গর্ব-ঐতিহ্য”।
হয়তো কিছুই করতে পারব না, ওর জন্য, ওদের জন্য - অনেকটা রাগ আর অক্ষমতা আমাকে কুরেকুরে খায়। কলকাতার জনস্রোতে হাঁটতে হাঁটতে ওই দালাল কিম্বা শৌখিন ট্যুরিস্টদের থেকে নিজেকে আর আলাদা করে চিনতে পারি না।
~ তথ্য- নয়াগ্রাম ~ || ~ পটের ছবি ~
বেসক্যাম্প পর্যটন সংস্থার কর্ণধার অভীকের নেশা ও পেশা দুই-ই ভ্রমণ।