বর্ষায় গোয়ায়
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
~ ~ গোয়ার তথ্য ~ গোয়ার আরও ছবি ~
বর্ষায় গোয়াতে অফ সিজন...। যেতে হয়েছিল, বিশেষ কাজ ছিল তাই।
আর তাই 'সিজন'-এ যা দেখা যায়, তা থেকে সম্পূর্ণ অন্য একরকমের গোয়াকে দেখে এলাম। ট্যুরিস্টহীন, ভিড়বিহীন। সবুজে সবুজ, জলে অথৈ।
ট্রেনে যাওয়া নিশ্চিত করা হল পথের আনন্দ নেব বলে।
মুম্বইয়ের দাদার থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ভোর পাঁচটা কুড়িতে ছাড়ে — চেয়ার কার (এসি/নন এসি)। তখন আলো ফোটেনি। পশ্চিমে সূয্যিমামা মুখ দেখান দেরিতে। তার ওপরে বৃষ্টি বলে মেঘলা-আকাশ। যাত্রার বেশিটা ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কন্যাসহ আমি। এসি-র চেয়ে একেবারে আলাদা প্রকৃতির বাতাস। ফোটো তোলাও আরেকটি উদ্দেশ্য বটে। ট্রেন ভালো, প্যান্ট্রি কারসহ। এমনিতেও ফেরিওলার আসা যাওয়া। বড়াপাও, ভাজাভুজি, ব্রেড অমলেট পাওয়া যায় স্টেশনে ট্রেন থামলেই।
প্রায় ৮০০কিমি রেলযাত্রার সমস্তটা পশ্চিমঘাট পর্বতের কোলে কোলে। অনেকগুলো টানেল পড়ে পথে, অন্ধকারে যেন পাতালে চলেছি। বাকি সবুজে নীচু মেঘ ভাসে, নেমে আসে, ঢেকে দেয়। আমরা সন্ধে ছটায় মদগাঁও স্টেশনে পৌঁছালাম। মেঘ ও বৃষ্টি অব্যাহত, কিন্তু আকাশের আলো নেভেনি।
জীবনের দিকে ফিরে চাওয়ার অর্থ সবুজ হয়ে ওঠা। এসময়ে এখানে Lush green all around - বলতে যা বোঝা যায়। মে মাস পর্যন্ত হা বৃষ্টি জো বৃষ্টি সবখানে। তীব্র ঘামময় গরম। এই তিনমাস নাকি এমন অঝোর ঝরবে, বলছিল স্থানীয়রা। ভাবছিলাম, বিধি বাম। আগে আসিনি, এমন সময়ে এলাম,যখন...।
উঠলাম মার্মাগাঁও পোর্ট ট্রাস্টের গেস্ট হাউসে। এসেছি যখন বেপরোয়া হয়েই বেরনো আমাদের, উপরঝান্তি বৃষ্টি শিরোধার্য করে। হাওয়ায় জলের শৈত্য, থামলে সামুদ্রিক চিটচিটানি।
পরদিন গাড়ি উত্তর গোয়ার আগুয়াডা ফোর্টে (১৬১২ সালে তৈরি) নামার মুখেই কালো আকাশ মুখ ভার করল। মাণ্ডবী নদী আর কণ্ডোলি সৈকতের পাশে এই দুর্গ তৈরি হয়েছিল। আগুয়াডা শব্দের অর্থ জল। অঝোর বৃষ্টিতে ছাতাধারী আমরা পেছল কার্নিশ ধরে সরীসৃপের মতো পা ফস্কানোর ভয় পেতে পেতে এধার থেকে ওধার হাঁটি। পাঁচিলের নীচে তাকালেই সাগর অপার। চিরকাল সমুদ্রের খোলা মুখেই গড়ে উঠেছিল যত দুর্গ। জলের নাম জীবন। জল বেয়েই এসেছিল অসমসাহসীপর্তুগিজরা,অচেনা অজানা কতশত মাইল দূরের সবুজ দেশে।
অদূরে লাইট হাউস। নীচে ঔপনিবেশিক স্টোর হাউস ছিল যেখানে, নামতে হল জল এড়াতে। কী উঁচু সিঁড়ি! চারপাশে পরিখা, এখন অবশ্য জলহীন। সবুজ গজিয়েছে ঘন হয়ে।
গাড়িতে পরপর আঞ্জুনা, বাগাতোর, কালাঙ্গুটে সৈকত। তখন ঠিক মুষলধার বৃষ্টি বলতে যা বোঝায় তাই! সামুদ্রিক হাওয়া এমনিতেই পাগলাটে। তারপরে শলার মতো বৃষ্টির জল। শৌখিন ছাতা অতি দুর্বল এক সুরক্ষা ব্যবস্থা। উলটে যাচ্ছে অনবরত। ক্যামেরায় বাষ্প। জলে ভিজে ফোটো তোলা।
কিন্তু সে অদ্ভুত দেখন! শান্ত সুশীল আরবসাগরের উত্তাল ঢেউ। কোনো জলক্রীড়ার (water sports) নামগন্ধও নেই।
বাগা সৈকতে এসে বৃষ্টি ধরল। হাওয়ায় বেহাল ছাতা। আপাদমস্তক চুপচুপে ভেজা। নীরবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
দুধসাগর ফলস - শুনেছি, ছবিও দেখেছি। বারেবারে শুধাই গাড়ি-চালককে - যাওয়া যায় না? এই অন্তত খানিকটা দূর অবধি দেখে আসা? ট্রেনে? গাড়িতে?
বললেন, 'অভী সব বন্দ্ হ্যায়। কুছ দূর তক গাড়ি জায়েগা।'
সেখান থেকে আবার মোটর সাইকেল আরোহীর পেছনে বসে যেতে হবে কোমর অবধি জল ঠেঙিয়ে। তার দুপাশে ঘন জঙ্গল পড়ে।
পিছু হটে এলাম। ওরকম অ্যাডভেঞ্চার করব দিন শেষ হয়ে এলে। জীবনে প্রথম আর শেষবার দেখে আর ভুলব না, নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার মতো সলিলসমাধি!
দুপুরে খাবার জন্যে কাছাকাছি থামা গেল। শ্যাক বা ধাবা যাই বলা যাক, আরও অনেক আছে আশেপাশে। আমরা হাভাতের মতো গোয়ানিজ-থালি বলে হামলে পড়েছি। কপাটহীন দরজার সামনে রাস্তা, ওধারে গ্রাম। ভিজছে,ভিজছে। তুমুল ছাঁট আসছে আমাদের বসার জায়গাতেও।
মেনুকার্ড নিয়ে এসে হাসিমুখে ছেলেটি বলল,'ক্যায়া খাইয়ে গা?'
মেনু দেখে নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলছিলাম।
সে বলে উঠল – 'বাংরামাছ খান। টাটকা হবে। গোয়ানিজ রান্না।' পুলকিত হয়ে বলি - আরে, বাঙালি? কোথায় বাস?
বলে, 'দাঁতন চেনেন? সেখান থেকে।'
কী খুশি সে! পথেপ্রান্তরে এমন আপন মানুষ জুটে যাওয়া উভয়পক্ষকেই মোহিত করে। থালিতে আয়োজন সামান্য। ভাতের সঙ্গে আবার একটা করে রুটিও। আর সে যে কী আতিথেয়তা করবে ভেবে পায়না। শেষে বলে,আমি আপনাদের দুটো করে রুটি দেব এনে। দিলও।
রুটি আমরা খাইনা যে দুপুরে! ফিরিয়ে দিতেই মুখটুকু শুকিয়ে গেল, কেন স্যার?
এই ভাতই অনেক! আমরা খাই খুব কম। তবু কেন জানি রেখে দিলাম একখানা।
তারপর? মাছ নিলাম আবার। তিনটে বাড়তি ভাজামাছের টাকা দিল নিজের থেকে, কিছুতেই শুনল না।
না না, একী? এটা কেন?
রুটি তো খেলেন না, তাই!
তার ক্ষমতায় কুলোল যতটুকু। মন ও মগজ মিলিয়ে বেরিয়ে এসে ভাবতে লাগলাম অনেক কিছু - আর কোনোদিন দেখাও হবে না!
ফেরার আগে রিভার ক্রুইজ মাণ্ডভী নদীর বুকে। দোতলার ডেকে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। বৃষ্টি অবিরাম। ভেজা জামাকাপড়ে শীত করছে আমাদের। নীচে তিনটে গোয়ানিজ নাচ দেখানো হল। ডিজে বাজাচ্ছিল বাজার-চলতি হিন্দি গান। চা-কফি-মদিরার ব্যবস্থা ছিল। সঙ্গে দর্শকের উদ্দাম নাচ। কিছুটা এলোপাথাড়ি উত্তেজনায় গরম হওয়া।
খানিক দেখলাম, খানিক জানলায় ভিড় ঠেলে চারপাশ, ফোটো ইত্যাদি। গোয়ানিজ নাচের ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলাম, ধরল না ক্যামেরা।
পোর্ট ট্রাস্ট গেস্ট হাউস আড়ে-দৈর্ঘ্যে মুক্তাঙ্গনে ছড়ানো। ভালো ব্যবস্থা। ভিড় নেই।
বৃষ্টিরও শেষ নেই। আকাশের অবস্থা একই। নিম্নচাপের বর্ষণ ক্ষান্ত দেয় না। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে বিরক্ত যে লাগছিল না, তা নয়। প্রোগ্রাম ঠিক করা হয়েছিল একটু কাঠখড় পুড়িয়ে। অনুমতি যোগাড় হল পোর্ট-এর অন্দরে প্রবেশের। পুরনো বার্থ ছিল মোটে তিনটে,পর্তুগিজদের সময়ে তৈরি(ঊনবিংশ শতকের গোড়ায়)। ভারত সরকারের আমলে সংখ্যা বেড়েছে অনেকগুলো। এবিষয়ে আমার জ্ঞান ছিলনা কিছু। মুখ্য উদ্যোক্তা আমার স্বামী, উৎসাহও মূলত তাঁরই। আমার দেখাটা উপরি পাওনা। জমজমে ব্যস্ততা ছিল হয়ত, কিংবা অন্যসময়ে থাকে। ছিলনা তখন। বৃষ্টির মরশুমে আপাদমস্তক সিক্ত নীল বর্ষাতি-পরিহিত জাহাজঘাটার কর্মীদের দেখে মধ্যযুগ ও তৎকালীন সময় অনুমান করার অমূলক চেষ্টা করছিলাম। ওঁরা আগ্রহ নিয়ে দেখালেন, মাল ওঠানামা এবং আরও নানান কিছু।
বার্থ নাম্বার ওয়ান-এই এখন একমাত্র যাত্রীবাহী জাহাজ আসে যায়। যাওয়ার রাস্তায় জঙ্গলাবৃত পরিত্যক্ত পর্তুগিজ হোটেল - বিধ্বস্ত চেহারায়। সমুদ্রের গা ঘেঁষে জাহাজঘাটা, জাহাজ অদূরে জলে পা। প্রবল জলোচ্ছ্বাস পাঁচিল টপকে এসে পড়ছে দানাদানা জলসমেত। আধিকারিকের কাঠের কেবিনে অতিথি আপ্যায়নের জন্যে নকল মুকুট আর বর্শা।
বেলা গড়ালে অনন্ত আশ্রম সিটি শ্যাক-এ আহার আমাদের। বেশ সাজানো,মনোরম, আরামদায়ক। স্কুইড আর গোয়ানিজ আমিষ থালি - পঞ্চব্যঞ্জনে মহা আহার, নারকেলের দুধ আর কোকাম মেশানো সফেদ পানীয় 'সোলকারি'।
সেদিন সকালের মেঘ কাটল একটু বেলাতে। নিম্নচাপের অজস্র বর্ষণের অসোয়াস্তিমুক্ত ঝিলমিলে দিন। আর্দ্রতা আছে,বেশ চিটচিটে গরম।
দক্ষিণ গোয়াতে বম জেসাস ব্যাসিলিকা (১৬ শতকের)। ঔপনিবেশিকযুগ ফিরে আসে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে। স্তব্ধ কোলাহলহীন। পথেঘাটে পুরনো গোয়ার গন্ধস্পর্শ অনুভব করা যায় স্পষ্ট। এই চার্চ পোর্তুগিজদের এদেশে উদয় ও অস্ত দুয়েরই সাক্ষ্য বহন করে।
প্রথমে ক্যাথরিনস চ্যাপেল,পরে এই চার্চ। অভ্যন্তর ঘুরে ঘুরে দেখি। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রোগ্রাম হয় সেন্ট ফ্রান্সিস দ্য সেভিয়ার (১৫০৬-১৫৫২)-এর জীবন নিয়ে। কী ভাবে এলেন, কোথায় চিনসমুদ্রের জনহীন কিনারে দেহ রাখলেন। কয়েকটি ঘরে মানবোদ্ধার,ধর্মপ্রচার ও মহিমার কথা মূর্তি, মানচিত্র দিয়ে মিনিট পনেরোর চমৎকার অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন মেয়েরা। এঁদের কথা বলার ধরন ভারী নরম, বাক্যের শেষে একটি অদ্ভুত সুরেলা টান। চার্চ এবং চ্যাপেল স্থাপত্যে করিন্থিয়াম স্থাপত্যের মিশ্রন। এছাড়া কিছু সে আমলের ধ্বসে যাওয়া তোরণ,থাম,কোণের অংশ দর্শকের জন্যে বাইরে সাজানো।
তারপরে মঙ্গেশ মন্দির - শিবের মন্দির। গ্রামের নাম মঙ্গেশি। আমাদের গাড়িচালক চার্চবিরোধী হিন্দু, মনে হচ্ছিল কথাবার্তায়। ঘাঁটাইনি তাঁকে। মন্দিরে ওঠার রাস্তায় প্রচুর ছোটবড় দোকান। মাত্র ৮০টাকা করে গোয়া-লেখা টীশার্ট বেচাকেনা। মাথায় লাগানোর গোয়ান-স্টাইল প্লাস্টিকের ফুলের রিং ৩০টাকা।
এখানে সবকিছু অন্য রাজ্য থেকে আসে, নিজস্ব কুটীরশিল্প উৎপাদন নেই। এমনকি কাঁচামালের মধ্যে নারকেল পর্যন্ত আসে কেরালা থেকে। অথচ অসংখ্য নারকেলগাছে ছবির মতো ঘেরা উপত্যকা। নারকেল পাড়বার লোক নাকি পাওয়া যায়না - বললেন আমাদের কোঙ্কনি চালক। (কেরালায় দেখেছি কীভাবে নারকেলকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন ওঁরা।)
শান্তাদুর্গা মন্দির এখানে বিখ্যাত মাতৃমন্দির। সুন্দর,শোভন,পরিচ্ছন্ন। যে কোনো মন্দিরের সামনে পিসার হেলানো মিনারের কাছাকাছি আকৃতির একটি করে দর্শনীয় উঁচু স্তম্ভ, আসলে প্রদীপদান।
আবার গন্তব্য সমুদ্রকিনারা...
বর্ষা মানে বৃষ্টিযাপন,এই স্বাভাবিক।
তবু সেদিন বৃষ্টিকে আকাশ নিয়ন্ত্রণ করছিল। হয়ত আমাদেরই জন্যে - ভাবতে ক্ষতি কি? আর আবহাওয়াবিদরা যদি অন্য ব্যাখ্যা দেন, শিরোধার্য।
খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুরে এলাম তিনটি সৈকতে—বেনোলি, কোলভা আর বোগমালো। যদিও সেদিন জনাকয় পর্যটক ছিলেন, তা সত্ত্বেও 'নির্জন সৈকতে' শব্দদুটি একমাত্র উপযুক্ত।
এর আকাশের মেজাজের উত্থান ও পতন বুঝে জল আনাগোনা করছে। সমুদ্রপ্রহরীরা বালির ওপরে সীমানির্দেশক লাল ঝাণ্ডা পুঁতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
অতএব আমরা দণ্ডায়মান দর্শক — আকাশের রঙ, মেঘ আর সেই সঙ্গে সন্ধে নেমে আসার। সাহস করে সীমাহীন আরবসাগরের গড়িয়ে আসা ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে ছুটে ফিরে আসি।
সুয্যি পাটে যাওয়ার আয়োজন করতে, আমাদেরও ফেরার তাড়া। ঘড়িতে তখন? সাতটা। পশ্চিম কিনা!
ভাস্কোতে আমাদের অতিথি-আবাস। যাত্রাপথের অল্পদূরে তীরচিহ্ণ পথসূচিত করছে বায়না সৈকত মাত্র কয়েক কিমি। শুনলাম আগে ভিড় থাকত খুব, ইদানীং কৌলিন্য গেছে। খুল্লমখুল্লা নানান অসামাজিক কাজকর্ম চলে, আদিমতম ব্যবসাও। জানালেন গাড়ির চালক। আমরা গেলাম না। মাদক, মদিরা, জুয়া এবং দেহব্যবসা - পৃথিবীর অন্যান্য অনেক পর্যটনক্ষেত্রের মতো এখানেও মৌরসিপট্টা জমিয়ে নিয়েছে। ব্যাপারগুলো মোটামুটি ওপেন সিক্রেট - কার আর কী এল গেল?
পরদিন আবার উত্তরায়ণ। বৃষ্টি বর্ষাকালের মতো, আসে যায়। রোদ্দুরও তাই, মেঘও তাই।
চললাম চাপোরা দুর্গদর্শনে। শুরুতে খানিক কথা কাটাকাটি গাড়ির চালকের সঙ্গে। বুঝতে পারছিলাম - অনেক বেশিই চাইছেন। যাই হোক, উপায় নেই যখন!পৌঁছতে সময় লাগল অনেকখানি।
গ্রামের নাম বারডেজ, পর্তুগিজরা অধিকার করেছিল। আপাতত অকুস্থলে পৌঁছে আমরা হতোদ্যম। আদি ও অকৃত্রিম উঁচু টিলা একেবারে খাড়া হয়ে উঠেছে। লালচে গুঁড়োগুঁড়ো ঝুরঝুরে পাথর। তার ওপরে দুর্গ, নিরাপদ বৈকি! ভাবলাম, থাক এখানে দাঁড়িয়েই দর্শন সারি। কন্যা চিয়ার আপ করল - ভয় পেয়ো না। আর কি কোনওদিন আসতে পারবে? চলো।
বিপদকে বিপদ না গণি। ভয় আর কী,সে নিজেকে নিয়েই।
হামাগুড়ি দিয়ে কচ্ছপ-গমনে উঠতে উঠতে শেষ পাথরটায় পা রেখে মনে হল - আঃ, আমাকে আর পায় কে? বিশাল ট্রেকিং-এ সামিল হলাম! পতন ও অধঃপতনের চিন্তা তখন করে কে?
দুর্গের প্রাকার ছাড়া আর কিছু নেই এখন। আগে দুর্গ অন্যরকম ছিল, চার্চ-ও ছিল। ষোল সতেরো শতাব্দীতে মুঘল,মারাঠা আর পর্তুগিজদের ক্ষমতা দখলের মারামারিতে বহুবার হাতবদল হয়েছে এই দুর্গের। বহুবার ভেঙে বহুবার পুনর্গঠিত। ১৭১৭ সালে স্থাপিত বর্তমান দুর্গ শুধু ধ্বংসাবশেষ নিয়ে স্মৃতিবাহকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে। এখন ভারতীয় নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে।
আরেকটি কারণে পর্যটকের ভিড় হয়। কষ্টগম্য ও নির্জনতার কারণে এটি শ্যুটিং স্পট - হাল আমলের 'দিল চাহতা হ্যায়' এবং 'খামোসি' ছবির শ্যুটিং হয়েছে এখানে। পাঁচিলের পাশে দাঁড়ালে সমুদ্রের বাতাস ও ঢেউয়ের চঞ্চলতা সজীব করে রাখে।
নেমে আসার সময়ে আবার সেই 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু' -গোছের এখানে পা ওখানে পাথর - এই করতে করতে, সাবধানের মার নেই জপতে জপতে নেমে আসা আমার!
কাছে বাগাতোর সৈকত, আরেকবার সেখানে - কারণ বৃষ্টিহীন সে একদিন পাওয়া গেছে, সমুদ্রের প্রতি অমোঘ টান আমাদের কন্যার।
'ফিশারম্যান ওয়ার্ফ' পানাজিতে – এককথায় যাকে বলে অসাধারণ! যেমন পরিবেশ, তেমন রন্ধন। অবশ্য তুমুল বর্ষণে মাছের বৈচিত্র্য খানিক কম। ওঁরা আমাদের দেখালেন ওঁদের সংগ্রহ, অর্ডার দিতে পারি ইচ্ছে করলে। অন্দরসাজ ঐতিহ্য বজায় রেখে, পরিচ্ছন্নতা উদাহরণযোগ্য। ভোজনান্তে তুমুল বর্ষণ আবার। অতিথিনারায়ণকে ছত্রধারণ করে এগিয়ে দিলেন বাহন পর্যন্ত।
সিক্ত অপার সবুজের অনন্য রূপ দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছি গ্রাম,ক্ষেত,শহরতলি।
পরের দুপুরে আমরা চার কিমি দূরত্বে ভাস্কো সিটিতে। সেখানে পৌঁছালে বাস, অটো পাওয়া যায়। ভাড়া তুলনায় বেশি। তবু নিজেরা একবার না ঘুরে এলে দেখা যে অসম্পূর্ণ থাকে,সকলে জানেন।
তা বেশ লাগল। ছোটোমতো গোছানো শহর। অনেক দোকান আছে পাশাপাশি পরপর। মলের আদবকায়দা আপাতত না থাকলেও 'ইট আউট'-এর খোলা জায়গায় পাতা চেয়ারগুলো ভিজছে। মাথায় টুপি ব্যস্ত শ্যেফেরা পরিবেশন করছেন কফি, কুকিজ এমনকী চাইনিজ ও অন্যান্য আমিষাহার। মানুষজন বন্ধুস্বভাবী। মুশকিলে পড়লে দুহাত বাড়িয়ে দেন।
আর পানাজি বা পানজিম তো বেশ সমৃদ্ধ ও কেতাদুরস্ত শহর। আমাদের গোয়া বেড়ানোর তালিকায় শেষ জনপদ।
ভাস্কো দ্য গামা-র পথভ্রান্তির কারণে একদা ১৪৯৮-এ কালিকট, গোয়া, দমন, দিউ - কোঙ্কনোপকূলে পশ্চিমপ্রান্তিক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। ১৯৬১ পর্যন্ত গোয়ার মাটিতে দাপিয়ে রাজত্ব করেছে পর্তুগিজরা। শুরুতে বলে-কৌশলে নিজেদের মাটি শক্ত করেছে। জোর করে, ভুলিয়ে, লোভ দেখিয়ে ধর্মপ্রচার করেছে। অনেক চার্চ,অনেক চ্যাপেল ছড়িয়ে আছে আশেপাশে, বিশেষত পুরনো গোয়ায়। স্থানীয় বয়স্ক জনৈক বললেন, 'রোজগার করো, খাও-পিও। কাল কী হবে ভেব না' - এই নাকি পর্তুগিজদের জীবনের মকসদ ছিল। হবেও বা। ক্যাসিনো - পয়সায় পয়সা টেনে আনে। হয়ত কালো রং সাদা করে ফেরে কেউ! জানি না।
টানা তিনমাস (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর) অঝোর বরিষণে অনাবিল হরিৎ উৎসব। রূপটান ও অঙ্গসজ্জা সবই প্রকৃতির নিজস্ব পার্লারে। তাই এর রূপ অপূর্ব। দূরবিস্তৃত জলমগ্ন ক্ষেতে কাজ করছে মানুষ। পশ্চিমঘাট উপত্যকা বিভিন্ন পর্যায়ে ঢালু-খাড়া হয়ে কখনও পিছিয়ে প্রান্তরেখায় আবছা,কখনও সামনে এসে হাজির। পেশা বা উপজীবিকা বলতে মাছের চাষ আর কান্ট্রি ওয়াইনের ব্যবসা। গ্রামের মধ্যে চোখ ছড়িয়ে হাঁটু-পর্যন্ত জামা পরা কর্মরতা মধ্যবয়সিনী নজরে এসেছে।
শ্যামল সরস সজীব সতেজ - ঘরের চালা দুপাশে ঢালু। অঢেল বৃষ্টি ঝরিয়ে দেয় মাটিতে। মেঘ নেমে আসে। সমস্তটা কেমন প্রশান্ত,আরাম-ধরানো, ঘুমঘুম। তাড়াহুড়ো নেই, গড়িমসির জীবন। আমি পর্যটক বলে হয়ত এমন লেগেছে, কী জানি! ফিরতি আকাশপথে মেঘের আস্তরণ ভেদ করে নেওয়া ছবিগুলো স্পষ্ট হল না তেমন। না হোক, চোখে রয়ে গেল আরও অনেক বিস্তারে।
~ ~ গোয়ার তথ্য ~ গোয়ার আরও ছবি ~
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী শ্রাবণী দাশগুপ্ত বর্তমানে থাকেন স্বামীর কর্মসূত্রে রাঁচিতে। কিছুকাল স্কুলে পড়ানোর পর বাড়িতে থিতু হয়ে এখন লেখালেখি আর বই পড়াই ভাললাগার বিষয়। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন এবং ই-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে ছোট গল্প। প্রথম পছন্দ পাহাড় - জঙ্গলও খুব প্রিয়। বেড়াতে ভালোবাসলেও ভ্রমণ কাহিনি লেখায় হাত পাকানো অল্পদিন।