-->
ঘন সবুজ নারকেল গাছে ছাওয়া সোনালি সৈকত, নীল সমুদ্র, পশ্চিমঘাট ও সহ্যাদ্রি পর্বত থেকে নেমে আসা মাকড়সার জালের মতো নদীপথ আর লাল পাহাড় নিয়ে গোয়া দেশবিদেশের পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ। পূর্বে সহ্যাদ্রি পর্বত, পশ্চিমে আরবসাগর, উত্তরে মহারাষ্ট্র এবং পূর্ব ও দক্ষিণ জুড়ে কর্ণাটক রাজ্য ঘিরে রয়েছে ছোট্ট রাজ্য গোয়াকে। কাজু, আম, তাল,পাম, দারুচিনি ছাওয়া স্বপ্নময় এই রাজ্যে কোঙ্কণিদের বাস।
রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণেও গোয়ার উল্লেখ আছে। অতীতে গোয়ার খ্যাতি ছিল প্রাচ্যের রানি নামে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতকে মৌর্য রাজারা তারপর চালুক্যরাজা এবং কদম্বরাজারা এখানে রাজত্ব করেন। ১৩১২-তে মুসলিম হস্তগত হয় গোয়া। ১৩৭০-এ আবার মুসলিমদের পরাজিত করে বিজয়নগরের রাজা হরিহর দখল নেন গোয়ার। ১৪৭০-এ ফের বাহমনি সুলতানের করায়ত হয় গোয়া। এরপরে হাতঘুরে চলে আসে বিজাপুরের আদিল শাহি রাজবংশের দখলে। ১৫১০ সালে পর্তুগিজ নাবিক অ্যালফানসো ডে আলবুকার্ক বিজাপুরের রাজা আদিল শাহকে পরাজিত করে দখল নেন এই রাজ্যের। সেই থেকে আগমন হয় ব্যবসায়ীদের। সঙ্গে আসেন ধর্মযাজকেরা। এঁদের মধ্যে ১৫৪২ সালে আসেন বিশিষ্ট ধর্মযাজক সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার। ১৯৬১ সালে প্রায় ৪৫০ বছরের দীর্ঘ পর্তুগিজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হয় গোয়া।
নর্থ গোয়া আর সাউথ গোয়া ট্যুর-এ গোয়ার প্রধান প্রধান দ্রষ্টব্যগুলি দেখে নেওয়া যায়। নর্থ গোয়া ট্যুরে দেখে নেওয়া যাবে কালাঙ্গুটে সমুদ্র সৈকত, বাগা বিচ, আগুয়াদা দুর্গ, আঞ্জুনা সৈকত, মাপুসা, আরামবোল সৈকত, ভাগাতোর সৈকত প্রভৃতি। সাউথ গোয়া ট্যুরে দেখতে হবে ডোনাপাওলা বিচ, মিরামার বিচ, কোলভা সৈকত, অ্যানসেস্ট্রাল গোয়া মিউজিয়াম, শ্রীমঙ্গেশমন্দির, চ্যাপেল অফ সেন্ট ক্যাথরিন চার্চ, সেন্ট ক্যাথিড্রাল চার্চ, ব্যাসিলিকা-অফ-বমজেসাস, সে ক্যাথিড্রাল, সপ্তকোটেশ্বর মন্দির, শ্রীমল্লিকার্জুন মন্দির ইত্যাদি। গোয়ার জনপ্রিয় সৈকতগুলিতে সর্বত্রই ওয়াটার স্কুটার, প্যারাসেলিংয়ের মত বিচ স্পোর্টসের আনন্দ নেওয়া যায়। সৈকতের ধারে নারকেল পাতায় ছাওয়া রেস্তোঁরাতে বসে গোয়ার একান্ত নিজস্ব সুরা কাজুফেনিতে চুমুক দিতে দিতে দেখা যাবে আরব সাগরের জল সূর্যাস্তের রঙে রাঙা হয়ে উঠছে।
পানাজি (Panaji / Panjim)- মাণ্ডবী নদীর তীরে গোয়ার রাজধানী পানাজি। নদীর ওপারে বেতিম। এরই উত্তরে মাপুসা শহর। আর পশ্চিমে কালাঙ্গুটে সাগরবেলা। মাণ্ডবীর পাড়ে সবুজ পাহাড়ের কোলে ১৫৫১ সালে তৈরি রাইস মাগোস দুর্গ।
মাণ্ডবীর বুকে আদিল শাহর তৈরি গ্রীষ্মকালীন আবাস পরে পর্তুগিজ ভাইসরয়ের বাসভবনে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি গোয়া সেক্রেটারিয়েট, সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। বিপরীতে আধুনিক হিপনোটিজমের জনক আবে ফারিয়ার মূর্তি। পাহাড়ের ঢালে জোড়া চূড়া নিয়ে তৈরি পানাজির প্রধান চার্চ - ‘চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ দ্য ইমাকুলেট কনসেপশন’। এর কাছেপিঠেই রয়েছে মহালক্ষ্মী মন্দির আর জামা মসজিদ। একটু এগিয়ে আলটিনো পাহাড়ের মাথায় বিশপের আবাস। উপর থেকে গোয়া শহরকে পটে আঁকা ছবির মত লাগে। উরেম ক্রিক ও আলটিনো পাহাড়ের মাঝে ফন্টেনাস এলাকায় পর্তুগিজ আমলের প্রাচীন ঘরবাড়ি-পথঘাট আজও আছে।
শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে ডোনাপাওলা বিচ (Donapaola Beach) । বায়ে জুয়ারি নদী, ডাইনে মাণ্ডবী। দুই নদীর মাঝে ডোনাপাওলা উপসাগর। পর্তুগিজ ভাইসরয়ের মেয়ে সুন্দরী ডোনা স্থানীয় জেলের ছেলে পাওলাকে ভালোবেসে তার জীবন সঙ্গী হতে চায়। কিন্তু তা কিছুতেই সম্ভব হওয়ার নয়। দুজনে টিলার উপর থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মবিসর্জন করে। সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা টিলার উপর ডোনাপাওলার মূর্তি তাঁদের স্মরণ করেই। সাগরের বুকে সেতু বেঁধে ও সিড়ি নির্মাণ করে টিলার উপরে ওঠার পথ করা হয়েছে। দুপাশে লাগানো রয়েছে নানা ফুলের গাছ। উপর থেকে চারপাশের দৃশ্য ভারি সুন্দর। এখানে সূর্যাস্ত সত্যিই অসাধারণ। দূরে মার্মাগাঁও বন্দর নজরে পড়ে।
১কিলোমিটার দূরে নারকেল গাছে ছাওয়া রুপোলি সৈকত মিরামার(Miramar)। এখানে মাণ্ডবী নদী এসে মিশেছে আরব সাগরের নীল জলে।
পানাজি থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে নার্ভেতে কদম্বরাজাদের গৃহদেবতা সপ্তকোটেশ্বরের মন্দির। সাতটি পাহাড় অর্থাৎ কোট দিয়ে ঘেরা বলেই এই নাম। অল্পদূরে দ্রাবিড় বংশের হাবুরাজার তৈরি কারুকার্যমণ্ডিত শ্রীমল্লিকার্জুন মন্দির।
কালাঙ্গুটে (Calangute Beach)- পানাজি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে গোয়ার অন্যতম সমুদ্র সৈকত কালাঙ্গুটে ও কণ্ডোলিম- পাশাপাশি দুই যমজ সৈকত। বিচ জুড়ে নারকেল ও ঝাউ গাছের সারি। সোনালি বালির প্রশস্ত এই সমুদ্রসৈকত সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ। পর্যটকদের, বিশেষত বিদেশিদের ভিড় এখানে খুব বেশি। সৈকতে লাইফগার্ডের টাওয়ার থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হয় পর্যটকদের ওপর, যাতে কেউ বিপদে না পড়েন। বিচ জুড়ে রয়েছে রেস্টুরেন্ট আর শ্যাক। এদের পেতে রাখা বড় বড় ছাতায় ঢাকা আরামচেয়ার ভাড়া করে দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা সমুদ্রের মুখোমুখি খানিকক্ষণের বিশ্রাম নিয়ে নেন। রয়েছে ওয়াটার স্কুটার, ব্যানানা রাইড, প্যারাসেলিংয়ের মত ওয়াটার স্পোর্টসের আয়োজন।
বাগা (Baga Beach) -কালাঙ্গুটে থেকে ২ কিলোমিটার উত্তরে বাগা বিচ। সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে যাওয়া যায়। পাহাড়ে ঘেরা নীল সাগরের জলে স্নাত সোনালি বালিরাশি। এখানেও সৈকতের ধারে রয়েছে রেস্টুরেন্ট আর শ্যাক। বিচের ধার দিয়ে চলে গেছে সড়কপথ।
আগুয়াদা (Aguada Beach)-সড়কপথে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে আগুয়াদা সৈকত। কিছুটা এগোলে মাণ্ডবী নদীর মুখে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের তৈরি আগুয়াদা দুর্গ। এই দুর্গই এখন সেন্ট্রাল জেল। পাশে লাইট হাউস। বিকেল ৪টে থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত উপরে ওঠা যায়। দুর্গে হেরিটেজ হোটেলও আছে।
মাপুসা (Mapusa)-আগুয়াদা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে পর্তুগিজ আমলের বাড়িঘর আর বাগিচায় ঘেরা মাপুসা শহর। এখানকার মূল আকর্ষণ প্রাচীন চার্চ - চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ মিরাকেলস।
ছাপোরা (Chhapora Beach)- মাপুসা থেকে আধ ঘন্টার দূরত্বে নারকেল গাছে ছাওয়া পাহাড়ে ঘেরা ছাপোরা বিচ। সমুদ্রের ধারে জেলেদের গ্রাম। ছাপোরা নদী এখানে সাগরে মিশেছে। নদীর তীরে আদিলশাহীদের গড়া ছাপোরা দুর্গ।
আঞ্জুনা-ভাগাতোর (Anjuna & Bagator Beach)-বাগা থেকে ২ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে আরেক সাগরবেলা আঞ্জুনা। সোনালি বালুরাশির মাঝে বড়ো বড়ো পাথর খন্ড সারা বিচ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে পাথরে। পাড় ধরে সারি সারি নারকেল আর ঝাউ গাছ। দেশবিদেশের নানান সামগ্রীর পসরা নিয়ে প্রতি বুধবারে বিচের গায়ে বসে ফ্লি মার্কেট। ৩ কিলোমিটার দূরে নিরালা অপরূপ সৈকত ভাগাতোর।
আরামবোল (Arambol Beach)-আঞ্জুনা থেকে ৩২ কিমি দূরে আরামবোল সাগরবেলা। পামে ছাওয়া সুন্দর এই সৈকত জুড়ে জেলেদের বাস। বিদেশিদের কাছে এই বিচটি খুবই আকর্ষণীয়।
মায়েম (Mayem Lake) - পানাজি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সবুজ প্রকৃতির মাঝে আরেক দ্রষ্টব্য মায়েম লেক। হ্রদের জলে বোটিং করা যায়। লেকের পাড়ে গোয়া পর্যটনের লেকরিসর্ট।
মারগাঁও (Madgaon)- লাল টালিতে ছাওয়া সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি, বাগিচা, মন্দির নিয়ে দক্ষিণ গোয়ার জেলাসদর মারগাঁও। মারগাঁও-এ চার্চ অফ দি হোলি স্পিরিট গড়ে উঠেছিল হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে। পরবর্তীকালে মুসলিম আক্রমণে চার্চটিও ধ্বংস হয়। বর্তমান চার্চটি ১৬৭৫ সালে নির্মিত। মন্টি হিলের মাথায় আরেকটি ছোট চার্চ আছে। উপর থেকে মারগাঁও বন্দর এবং এঁকেবেঁকে চলা জুয়ারি নদীর ছবি অসাধারণ।
কোলভা (Colva)-পানাজি থেকে ৪০কিলোমিটার এবং মারগাঁও থেকে ৮কিলোমিটার দূরে নারকেল, পামে ছাওয়া মনোরম সৈকত কোলভা। বিচের মাঝে লাইফগার্ডের উঁচু টাওয়ার। এই বিচ থেকে সুর্যোদয়ের মুহূর্তে চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। সারাদিনধরেই রংবেরঙের ওয়াটার স্কুটার আর স্পিডবোটে আরবসাগরের ফেনা ছড়িয়ে প্রবল গতিতে দিগন্ত ছুঁয়ে আসেন পর্যটকরা। প্যারাসেলিংয়ের উত্তেজনা অনুভবেরতো মজাই আলাদা। বিচের গায়ে নানান পসরা নিয়ে দোকান বসেছে। সূর্যাস্তের পরে আলোঝলমলে বিচ রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে আহার ও পানীয়ের স্বাদ নেওয়া - সেও আরেক অভিজ্ঞতা। আওয়ার লেডি অফ মার্সি চার্চে মেনিন জেসাস (শিশু যীশু)-র মূর্তিকে নিয়ে কোলভা উৎসবে মেতে ওঠে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি।
২ কিলোমিটার দূরে শান্ত নিরিবিলি বেনৌলিম বিচ (Benoulim Beach) ।
পালোলেম(Palolem Beach)-মারগাঁও থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে চৌরি গ্রাম ছাড়িয়ে তালগাছে ছাওয়া পাথুরে টিলাময় পালোলেম সাগরবেলা। নির্জন অপরূপ এই সৈকতে ভিড় জমান বিদেশিরা।
পোণ্ডা(Ponda)- পানাজি থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে পোণ্ডা শহরের মঙ্গেশি গ্রামে পাহাড়ে ঘেরা ৪০০ বছরের প্রাচীন শ্রীমঙ্গেশ শিবমন্দির (Sri Mangesh Temple)। দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরগুলির মতো অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত শ্বেতশুভ্র অষ্টকোণী গোপুরম বা প্রবেশদ্বার। শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশে বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে কারুকার্যমন্ডিত মন্দিরটি। এখানে তীর্থযাত্রীদের থাকার বাবস্থা আছে। মন্দিরের সামনে দীপস্তম্ভটি বেশ অভিনব। প্রখ্যাত সঙ্গিতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের আদি নিবাস এই শ্রীমঙ্গেশ গ্রাম। এখান থেকে ২ কিলোমিটার এগোলে বিষ্ণুমন্দির শ্রীমহলসা। ভিন্ন মতে, কালী হলেন প্রধান উপাস্য দেবী। শ্রীমঙ্গেশ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ১৭১৩ সালে তৈরি দোলাপুর রাজপরিবারের উপাস্য দেবী শ্রীশান্তাদুর্গার মন্দির (Santadurga Temple)। প্যাগোডাধর্মী চূড়া এবং কারুকার্যমন্ডিত মন্দিরে উপাস্য শান্তিময়ী চতুর্ভুজা দেবী জগদম্বা বা দুর্গা। আর একটু এগিয়েই গোয়ার সবথেকে ধনী দেবতা শ্রীরামনাথজীর মন্দির। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের আদলে বিশাল চত্বর জুড়ে কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির।
ওল্ড গোয়া(Old Goa)- পানাজি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকাভুক্ত ওল্ড গোয়াতেই রয়েছে শ্বেত শুভ্র চ্যাপেল অফ সেন্ট ক্যাথরিন, সে ক্যাথিড্রাল, ব্যাসিলিকা-অফ-বমজেসাস। মারগাঁও থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। স্থানীয় নাম এলা। অতীতে কদম্ব রাজবংশ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বাহমনী সুলতানদের আমল থেকে এলা হয়ে ওঠে গোয়ার রাজধানী। ১৮৪৩ সালে পর্তুগীজরা পানাজিতে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যায়। ব্যাসিলিকা-অফ-বমজেসাস (Basilica of Bom Jesus)
সৌধটি সারাবিশ্বের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে খুবই পবিত্র। ১৫৯৪-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি এই গির্জা শিল্পনৈপুণ্যে অসাধারণ। চার্চের অভ্যন্তরে সোনার গিলটি করা কারুকার্য ঘুরে দেখতে দেখতে সেই সময়কে ছোঁয়া যায়। এখানেই রুপোর কফিনে শায়িত রয়েছেন সেন্ট জেভিয়ার। বিদেশে ধর্মপ্রচারে গিয়ে জাপান থেকে ফেরার পথে ফ্রান্সিস জেভিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েন চিনের সাঞ্চিয়ান দ্বীপে। ১৫৫২ সালের ৩রা ডিসেম্বর মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ওখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ১৫৫৪ সালে সেখান থেকে তাঁর মরদেহ মালাক্কা হয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়। প্রতি ১২ বছর অন্তর সেন্ট জেভিয়ারের মৃত্যুর দিনে তাঁর দেহ ভক্তদের জন্য প্রদর্শিত হয়। ওই পবিত্র দিনে সারা বিশ্ব থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্তবৃন্দ ও পর্যটকেরা এখানে উপস্থিত হন। এটি কার্নিভাল ফেস্টিভ্যাল নামে পরিচিত। ১৫৬২-১৬১৯ সাল, এই দীর্ঘ সময় জুড়ে বম জেসাসের বিপরীতে তৈরি হয় সেন্ট ক্যাথরিনের নামে উৎসর্গীকৃত গোয়ার বৃহত্তম চার্চ সে ক্যাথিড্রাল (Se Cathedral)। পর্তুগীজ ও গোথিকস্থাপত্যের এই চার্চের অন্তর্ভাগ করিন্থিয়ান শৈলীতে তৈরি। কারুকার্যে হিন্দু-মুসলিম স্থাপত্যের নির্দশন রয়েছে। দেওয়ালের ম্যুরালে সেন্ট ক্যাথরিনের জীবনের নানান ঘটনাবলী আঁকায় আর খোদাই কাজে সাজানো আছে। এই চার্চে রাখা ৫টি ঘন্টার মধ্যে যেটি গোল্ডেন বেল নামে পরিচিত, সেটি গোয়ার বৃহত্তম ঘন্টা। ৯-১০ কিলোমিটার দূর থেকে এই ঘন্টার আওয়াজ শোনা যায়। পাশেই বিজয়তোরণ বা চ্যাপেল অফ সেন্ট ক্যাথরিন। আলবুকার্ক যেদিন গোয়া জয় করেন সেদিনই সেন্ট ক্যাথরিনের শিরচ্ছেদ করেন। এই দুয়ের স্মারক এই বিজয়তোরণ।
একটু এগোলে একমাত্র মহিলা মঠ সেন্ট মনিকা কনভেন্ট, দুর্গাকারে তৈরি। প্রাচীরগাত্র তৈলচিত্র এবং বাইবেলের কাহিনিতে চিত্রিত আছে। ১৬০৬-১৬২৭ সাল ধরে তৈরি হয় এই মঠ। তৈরির ৯ বছর পরে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয়ে যায়। পরে নতুন করে আবার তৈরি করা হয়। রোমের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার আদলে ১৫১৭ সালে তৈরি কনভেন্ট ও চার্চ অফ সেন্ট ফ্রান্সিস দা অ্যামিসি। কাঠ খোদাই করা কারুকার্য, গিলটি করা অলংকরণ, ম্যুরালে সেন্ট ফ্রান্সিসের জীবনগাথা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এর পিছনেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মিউজিয়াম। চালুক্য ও হোয়সলীয় রাজাদের সময়ের নানা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী এবং পর্তুগিজদের ব্যবহৃত সামগ্রী প্রদর্শিত রয়েছে এই মিউজিয়ামে।
পাশেই সেন্ট ক্যাজেটন চার্চ, রোমের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার আদলে করিন্থিয়ান শৈলীতে ১৬৫৫ সালে তৈরি।
দুধসাগর (Dudhsagar Waterfalls)- পানাজি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে দুধসাগর জলপ্রপাত। ৬০৩ মিটার উঁচু থেকে ধাপে ধাপে নেমে আসা দুধের মতো সাদা জলের রাশি ‘ওশন অব মিল্ক’ নামেও পরিচিত। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অপূর্ব। গোয়া পর্যটনের বিশেষ ট্যুরে বা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বেড়িয়ে নেওয়া যায় দুধসাগর। সাউথ-সেন্ট্রাল রেলপথে ট্রেন থেকেও এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
যাওয়া- মারগাঁও বন্দর থেকে ৬ কিলোমিটার এবং পানাজি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গোয়ায় রেলের শেষ স্টেশন ভাস্কো। গোয়ার একমাত্র বিমান বন্দর ডাবোলিম (Dabolim)এই ভাস্কোতেই। কোঙ্কণ রেলপথে কারমালি স্টেশন পানাজি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। কালাঙ্গুটে দিয়ে গোয়া ভ্রমণ শুরু করতে চাইলে থিভিমে (Thibhim) নামা যায়। প্রথমে কোলভা আসতে গেলে মারগাঁওই সুবিধাজনক।
গোয়াকে দু’ভাগে ভাগ করে ঘুরে নেওয়া যায়। একদিন নর্থ গোয়া ও আরেকদিন সাউথ গোয়া। গোয়া ট্যুরিজমের বাসে সকাল সারাদিন ধরে যেকোন ট্যুরই করা যায়। সঙ্গে থাকেন সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভ্রমণগাইড। এছাড়া প্রাইভেট ডিলাক্স বাসে বা সুমো, বোলেরো, কোয়ালিস প্রভৃতি প্রাইভেট গাড়ি করে ঘুরে নেওয়া যায়। তবে আরেকটু ভাল করে ঘুরতে হাতে আরও ২-৩ দিন রাখা উচিত।
থাকাঃ- সমস্ত গোয়া জুড়েই গোয়া ট্যুরিজম কর্পোরেশনের পরিচালিত হোটেল রয়েছে।, পানাজিতে গোয়া ট্যুরিজমের পানাজি রেসিডেন্সি, মারগাঁওতে মারগাঁও রেসিডেন্সি, কোলভায় কোলভা রেসিডেন্সি, ভাস্কোয় ভাস্কো রেসিডেন্সি, মাপুসায় মাপুসা রেসিডেন্সি, কালাঙ্গুটেতে কালাঙ্গুটে রেসিডেন্সি ও কালাঙ্গুটে রেসিডেন্সি অ্যানেক্স, মিরামারে মিরামার রেসিডেন্সি, পুরাতন গোয়ায় ওল্ড গোয়া রেসিডেন্সি, মায়েমে লেকভিউ রেসিডেন্সি এবং পোন্ডায় ফারমাগুড়ি রেসিডেন্সি ইত্যাদি। এছাড়া সর্বত্র প্রচুর নানান দামের ও মানের বেসরকারি হোটেল ও রিসর্ট আছে ।
ভ্রমণ কাহিনি || আকাশের কথা সাগরের কানে || বর্ষায় গোয়ায় ||