সুন্দরবন দর্শন
শ্রাবণী ব্যানার্জী
~ সুন্দরবনের তথ্য ~ সুন্দরবনের আরও ছবি ~
প্রতিবছর মার্কিন মুল্লুক থেকে এসে কলকাতায় কাটানোর স্বল্প কয়েকটি দিনে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই বাড়িতে একটি মজলিসি আড্ডা বসে। সেই আসরে রাজনীতি, বিরিয়ানি, দেশবরেণ্য নেতা, চলচ্চিত্র, পুরনো দিনের গান, টিকটিকি, চোরডাকাত, রবীন্দ্রনাথ, বার্নাড শ, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বাঘ, তেলেভাজা, ভূত, কুকুর মায় পাজামার দড়ি পর্যন্ত কোনওটাই আড্ডার টপিক থেকে বাদ পড়ে না। আসর জমানোর কম্পিটিশনে নিঃসন্দেহে অনেকেই ব্রোঞ্জ বা সিলভার মেডেল পাওয়ার উপযুক্ত কিন্তু গোল্ড মেডেলটি সযত্নে তোলা থাকে শুধু একটি মানুষের জন্য — যিনি সম্পর্কে আমার এক দাদা। কখনও ছড়া কেটে, কখনও গান গেয়ে আর কখনও বা শুধুই অভিনয়ের দ্বারা (তিনটিতেই সিদ্ধহস্ত) তিনি এমন একটি গল্পের পরিবেশ সৃষ্টি করেন যে লোকজন নাওয়াখাওয়া ভুলে শুধু তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে, মায় দুঁদে উকিলরাও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে অসহায় বোধ করেন। এক কথায় আমার এই দাদাটি ব্রজদা, টেনিদা ও তাড়িণীখুড়োর এক মিলিত সংস্করণ।
এই ভাবেই কিছুবছর আগে শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় হাতে রঙিন পানীয় নিয়ে দাদা তাঁর সুন্দরবনের বাঘ দেখার গল্প আরম্ভ করলেন। প্রথমেই হাত দুটিকে কপালে ঠেকিয়ে পরশুরাম বর্ণিত বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের স্তবটি সেরে নিলেন। কারণ নাকি তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন বলেই বাঘ দাদাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখেছিল।
'নমামি দক্ষিণরায় সোঁদরবনে বাস,
হোগলা উলুর ঝোপে থাকেন বারোমাস।
দক্ষিণেতে কাকদ্বীপ শাহাবাজপুর
উত্তরেতে ভাগীরথী বহে যতদূর,
পশ্চিমে ঘাটাল পূবে বাকলা পরগণা —
এই সীমানার মাঝে প্রভু দেন হানা।'
জ্যোৎস্না রাতে দাদা একা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছেন — মাঝে মধ্যে জলের ঝুপঝাপ, গাছ থেকে ডাব পড়ার ধুপধাপ, সাপ চলার খসখস ও ওনার জুতোর মসমস শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। এইভাবেই চলতে চলতে হঠাৎই এক অপরূপ দৃশ্য দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। চাঁদের আলো গায়ে মাখিয়ে একটি কেঁদো বাঘ গ্যাঁট্ হয়ে ঠিক তাঁর সামনেই থাবা গেড়ে বসে আছে। আহা কি হ্যান্ডসাম দেখতে, রূপ যেন একেবারে ফেটে পড়ছে আর তেমনি পাগলা করা চাহনি। মুগ্ধ হয়ে দাদা তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন আর সেও অপলক দৃষ্টিতে দাদাকে দেখতে লাগল। পাশ থেকে একজন বেরসিক ফোড়ন কাটল, 'আপনাদের শুভদৃষ্টি হয়েছিল নাকি দাদা?' এ ধরনের তুচ্ছ মন্তব্য গায়ে মেখে দাদা কোনও দিনই গল্পের ফ্লো নষ্ট করেন না আর তাঁর সেই অসাধারণ গল্প বলার গুণে ধীরে ধীরে আমাদের সবারই মানসপটে যেন বাঘের সেই মিষ্টি মুখটি ভেসে উঠল শুধু কাছে গিয়ে তার থুতনিটা তুলে ধরে একটু চুমু খাওয়ার অপেক্ষা।
পরের দিন সকালেই এক পাড়াতুতো ভাই এসে বলল, (তিনিও সেই সান্ধ্য আড্ডাতে উপস্থিত ছিলেন) 'চলো না দিদি আমরা সবাই মিলে একটু হৈ হৈ করে সুন্দরবন ঘুরে আসি।' সে আর বলতে! দিদি তো সারাক্ষণ নেচেই আছে তাতে হ্যান্ডসাম বাঘের যে বর্ণনা শুনেছে তাতে এখন মাথা ঠিক রাখাই শক্ত। তাই কয়েকদিনের মধ্যেই সুন্দরবন যাওয়ার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। শুধু দাদা এই ট্রিপে যোগ দিতে পারলেন না বলে সবারই মনটা একটু খারাপ। যাত্রার আগে উনি টেলিফোনেই জ্ঞান দিয়ে বললেন 'ওখানে গিয়ে চাষা, জেলে মাঝি সবার সাথেই আলাপ করিস তাহলে ওদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনেককিছুই জানতে পারবি। সবসময় মনে রাখিস —
যস্মিন দেশে যদাচার
কাছা খুলে নদী পার।'
প্রথম লাইনটি আমি সব জায়গাতে গিয়েই মেনে চলি আর দ্বিতীয়টি আমার জেন্ডারে ফলো করা অসম্ভব বলে কান দিলাম না।
ভোর বেলাতেই একটি বড়সড় জীপ নিয়ে সুন্দরবনের দিকে রওনা হলাম। শহর ছাড়ার পর থেকেই রাস্তার অবস্থা হয়ে উঠল ভয়াবহ। সব গর্তাগর্ত উপেক্ষা করে ছোকরা ড্রাইভার তীরবেগে জীপটি চালিয়ে দিল। কখনও শূন্যে লাফ মেরে জীপের ছাদে গিয়ে মাথা ঠুকি আর কখনও বা টাল সামলাতে না পেরে অন্যের কোলে গিয়ে বসি। পেছন থেকে একজন বলে উঠল 'এক পিস্-এ একটু গদখালি পর্যন্ত পৌঁছে দাও ভাই (কারণ তারপর আর রাস্তা নেই - নৌকোই ভরসা) সারাজীবন তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।' আমার পাশের মানুষটি করুণ সুরে বলতে লাগলেন তাঁর ভেতরের অনেক অর্গানই নাকি ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম করছে উনি কোনওমতে সেগুলিকে চেপেচুপে সামলে রেখেছেন। আমাদের ড্রাইভার বাবাজি সব কথাই অগ্রাহ্য করে নিজেও নাচতে নাচতে এবং আমাদেরও নাচাতে নাচাতে গোলার বেগে ছুটে চললেন। ঘন্টা আড়াই পরে যখন গদখালি পৌঁছোলাম তখন একজনই মাত্র ড্রাইভারের উচ্ছ্বসিত প্রসংসা করে বললেন, বেশ কিছু দিন যাবৎ ওনার কোমরের গোটা দুয়েক হাড় নাকি এদিক ওদিক ম্যুভ করে যাওয়ায় অকথ্য কষ্ট পাচ্ছিলেন আর এখন ঝাঁকানিতে সেগুলি আবার যথাস্থানে বসে যাওয়ায় অত্যন্ত আরাম বোধ করছেন। গদখালিতে নেমেই কয়েকজন প্রচুর পরিমাণে কর্দমাক্ত পানিফল, শাঁস সমেত ডাব আর তেলেভাজা কিনে নিয়ে এলে আমার স্বামী একটিও দাঁতে কাটলেন না আর তা দেখে লোকজন আমাদের আমেরিকান পেট ও ইমিউনিটি নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। সেসব শুনে কেমন যেন একটা রোখ চেপে গেল। অত্যন্ত তেজের সঙ্গে সেই রাস্তার তেলেভাজা, কাদায় ভরা পানিফল ও ডাবের শাঁস খেয়ে দেখিয়ে দিলাম এতবছর আমেরিকায় থাকলেও ইমিউনিটিতে আমি তাদের থেকে কিছুমাত্র কম যাই না।
গদখালি থেকে নৌকাযাত্রা আরম্ভ হল - ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা হোটেলে গিয়ে পৌঁছোলাম। এই গ্রামটি জনমানবশূন্য না হলেও গণ্ডগ্রাম বললে অত্যুক্তি হয় না। ইলেকট্রিসিটির কোনও বালাই নেই তাই হোটেলের আলো পাখা জেনারেটরেই চলে। নৌকো থেকে নামতে গিয়ে দেখলাম অনেকেরই পা হড়কে গেল। ঘাটের গায়েই একটি ছোট মুদির দোকান আর তার পাশে গোটা দুয়েক ছাগল আর একটি বাছুর বাঁধা। সেই দোকানে আবার ভাঁড়ে চা বিক্রি হয়, দেখলাম লোকজন লেড়ো বিস্কুট সহযোগে সেটি সেবন করছে। আগেও দেখেছি গ্রামাঞ্চলে লোকজন মাঝে মধ্যেই খুব ভালো ভালো বাংলা বলে। দোকানের মালিক সেই বৃদ্ধ চাচা আমাদের চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন কারণ ওনার তৈরি চা-তে নাকি অত্যন্ত ভালো সুবাস। পরে আসব বলে হোটেলে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। মেনু ছিল - ডাল, চচ্চড়ি, মাছের ঝোল আর আমড়ার টক।
বলাবাহুল্য কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার আমেরিকার পেট সেই বিশুদ্ধ পাঁক মাখানো পানিফল, ধুলোর কোটিং দেওয়া রাস্তার তেলেভাজা আর এখনের আমড়ার টকের ধাক্কা সামলাতে পারল না, কোনওমতে ধুঁকতে ধুঁকতে বিছানার পরিবর্তে বাথরুমের মেঝেতেই শয্যা নিলাম। চতুর্দিকে তখন আমাকে নিয়ে একেবারে হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড। এখানে না আছে কোনও রাস্তাঘাট, না কোনও ডাক্তার বা হাসপাতাল মায় হিন্দু সৎকার সমিতিকে খবর দেওয়ার পথও বন্ধ! এমন সময় হোটেলের বাচ্চা চাকরটা ছুটতে ছুটতে এসে বলল — চাচার দোকানে ইলেকট্রিকের গুঁড়ো (ইলেকট্রল) পাওয়া যায়, জলে গুলে খেয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কাণ্ডকারখানার সঙ্গে বহুদিনের পরিচয় থাকায় আমার স্বামীর কাছে সব ব্যবস্থাই মজুত থাকে, তিনি দুটি ট্যাবলেট আমার হাতে দিয়ে রাস্তার তেলেভাজা ভক্ষণের জন্য যে পরিমাণ বাক্যিবাণ ছাড়তে লাগলেন তাতে মনে হল এর থেকে বাঘের পেটে যাওয়াও শ্রেয়।
পরের দিন সকালে লোকজন আমার সামনেই গরম গরম ফুলকো লুচি, হালুয়া আর আলুর দম দিয়ে প্রাতরাশ সারল আর আমার হাতে ধরাল জলে ভেজানো কিছুটা চিঁড়ে। এমন সময় একটি সৌম্যদর্শন ছেলে এসে হাতজোড় করে নমস্কার করল। তার নাম দীপ্ত আর সে নাকি দুদিন ধরে গাইড হিসাবে আমাদের সুন্দরবন ঘুরিয়ে দেখাবে। ছেলেটিকে দেখে একটু অবাক হলাম কারণ তার চালচলন কথাবার্তা কোনওটাই ঠিক পেশাদারি গাইডের মত নয় যাদের বেশিরভাগেরই জ্ঞানগম্যির ওপরে আমার কোনও শ্রদ্ধা নেই। তখনই হোটেলের মালিক ফোন করে জানালেন, এই ছেলেটি অত্যন্ত বড়লোকের একমাত্র সন্তান। তাদের কাছ থেকে একটি নয়াপয়সাও পায় না শুধু জঙ্গল ভালোবাসে বলে সুন্দরবনে কিছুদিন আছে। ছেলেটির নাকি জঙ্গল সম্বন্ধে অসাধারণ জ্ঞান আর শুধু ভারতবর্ষ নয় ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়েও কিছুদিন থেকে এসেছে। পথ চলতে চলতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কতরকম বিচিত্র লোকের সঙ্গে যে আলাপ হল তার কোন ইয়ত্তা নেই - এই ছেলেটি নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন।
দীপ্ত আমাদের নিয়ে নৌকোতে সজনেখালির দিকে চলল, সেখানেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যাঘ্র ও কুমীর সংরক্ষণের ব্যবস্থা। জলের ধারে ধারে ম্যানগ্রোভ বা গরান গাছগুলিকে দেখিয়ে বলল সারা পৃথিবীতে আর কোথাও এত ম্যানগ্রোভের জঙ্গল নেই। ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশ দুটোতেই সুন্দরবনের ব্যাপ্তি। তাই জলে এক নদী থেকে আর এক নদীতে যেতে যেতে কোনটা যে ভারতবর্ষ আর কোনটা বাংলাদেশ সেটা বোঝাই ভার। এখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলেমিশেই থাকে আর বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায় ছাড়াও কালুখাঁ ও বনবিবির পুজোও লোকজন খুব ভক্তিভরে করে। সজনেখালিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিষ্ট লজ দেখতে পেলাম - সামনে বেশ কিছু ইউরোপীয়ান বাঁদরদের কলা খাওয়াচ্ছে। যদিও ট্যুরিস্টদের কল্যাণে এখানে বাঁদরদের খাওয়ার কোনও অভাব নেই তবুও দেখলাম একটি বাঁদর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে আর একজনের পিঠ থেকে উকুন বেছে দিচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে সেগুলিকে মুখেও পুরছে। দীপ্ত বলল, বাঁদররা মূলত ভেজিটেরিয়ান হলেও উকুনগুলোকে ঠিক ননভেজের মধ্যে ধরে না, এগুলো অনেকটা খাওয়াদাওয়ার পর মুখশুদ্ধির কাজ করে।
এ তল্লাটে ছোট বড় সব সাইজের কুমীরই দেখতে পেলাম কিন্তু বাঘ দেখার সৌভাগ্য হল না। একটা কুমীর ছলোছলো চোখে এমনভাবে শুয়ে আছে যে দেখে বড় মায়া হল। পাশ থেকে একজন বলে উঠল 'দেখো দিদি আহা বলে যেন আবার রুমাল দিয়ে চোখের জল মোছাতে যেও না তাহলেই ল্যাজের ঝাপটা দিয়ে জলে টেনে নেবে। কুম্ভীরাশ্রু কথাটা মনে আছে তো?'
শুনলাম পশ্চিমবঙ্গের দিকের সুন্দরবনে দুশো আড়াইশোর বেশি বাঘ থাকে না আর বাংলাদেশকেও ধরলে খুব বেশি হলে পাঁচশো। যদিও এদের পাসপোর্ট ভিসা লাগে না তবুও বাঘেরা যে যার নিজেদের গণ্ডির মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। মাঝিদের সঙ্গেই দীপ্ত আমাদের বাঘের দেবতা 'দক্ষিণ রায়'-এর মন্দিরে নিয়ে গেল। তারা দেখলাম দক্ষিণরায় ছাড়াও কালুখাঁ ও বনবিবিকেও ভক্তিভরে প্রণাম করছে যাতে সাপ কুমীরেরও দর্শন পেতে না হয়, অর্থাৎ ইনসিওরেন্সের ফুল কভারেজই নিয়ে রাখছে। আমি ভাবলাম — এটা কেমন হল? আমি বলে প্রার্থনা করছি যাতে বাঘের দর্শন পাই আর এরা কিনা উল্টো গান গাইছে? নাহ্, ঈশ্বরদের অযথা ডিলেমায় ফেলে লাভ নেই তাই আর কোনও প্রার্থনা না করেই কয়েকটি টাকা পুরোহিতের হাতে তুলে দিলাম।
দীপ্ত আমারই অনুরোধে মন্দিরের কাছে একটি বিধবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল যার স্বামী ও একটি সন্তান বেআইনি ভাবে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের পেটে গেছে। এই তল্লাটে লোকজন অত্যন্ত গরিব তাই পেটের দায়ে মধু চুরি করতে যায়। বাঘ পেছন থেকে অ্যাটাক্ করে বলে তাদের ধোঁকা দেবার জন্য মাথার পেছনে মানুষের মুখোস সেঁটে বেরোয় যাতে বাঘ তাদেরকে সামনে থেকে দেখছে বলে মনে করে। সামনের লোকটি মুখ না ঘুরিয়ে পেছনের লোকের উদ্দেশ্যে একটি করে সংকেত পাঠায়, উত্তর পেলে বোঝে এখনও তারা আছে, না পেলে ধরে নেয় বাঘ নিয়ে গেছে। বাঘ এতটাই নিঃশব্দে কাজ সারে যে অনেক সময় পাশের লোকটিও টের পায় না কখন তুলে নিয়ে গেল। দীপ্ত বলল, মামাদের শিকারের পদ্ধতি হল পেছন থেকে এসে সজোরে ঘাড়ে থাবা মেরে এক ঝটকায় ঘাড়টা ভেঙে দেওয়া। এই তল্লাটে একটি বিধবাদের গ্রাম আছে যাদের স্বামীরা নাকি প্রায় সবাই-ই মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের পেটে গেছে।
শুনলাম বাঘ অত্যন্ত ভালো সাঁতারু। জন্তুজানোয়ারকে নদী পেরোতে দেখলে জলে গোঁফ ডুবিয়ে স্রোতের গতিটা মেপে নেয় তারপর ঠিক ততটা পিছিয়ে এসে স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাঁৎরাতে থাকে। দীপ্ত বলল, সপ্তাহখানেক আগে ও নাকি নৌকোতে চেপে যাচ্ছিল হঠাৎ নৌকোটাকে অসম্ভব টলমল করতে দেখে পেছনের মাঝিকে ঠিক করে লগি ধরতে বলতে গিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দ্যাখে মাঝিটা আর নেই।
এখানে বাঘ, সাপ বা কুমীরের কামড়ে মরাটা এতটাই স্বাভাবিক ব্যাপার যে বলতে গিয়ে লোকজনের গলাও কাঁপে না। হোটেলের রাঁধুনি বলল, কয়েকদিন আগেই নাকি পথে একটি সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়েছিল, কোনওমতে এঁকেবেঁকে দৌড়ে প্রাণে বেঁচেছে।
আমাদের লঞ্চটা যখন পাখিরালয়ের পাশ দিয়ে চলতে লাগল তখন নামটা কানে বেশ মধুর ঠেকল কারণ চারদিকে গ্রামের নামগুলির পেছনে 'খালি' শুনতে শুনতে কান যেন ধরে গিয়েছিল। এই যেমন ধরুন, গদখালি, বকখালি, সজনেখালি, সন্দেশখালি, সুধন্যখালি ইত্যাদি। লোকজন এখানে হয় নৌকায় নয়ত নির্দিষ্ট সময়ে চলা লঞ্চে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে যাতায়াত করে, রাস্তাঘাটের কোনও বালাই নেই। দীপ্ত মাঝিকে বিদ্যাধরী নদীর ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে বলল। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম মাতলা নদীও তার সঙ্গে এসে মিশেছে। সাগরের কাছে এসে অনেকগুলি নদীই মিলেমিশে একাকার হয়ে পলিমাটি ফেলে বিশ্বের সবথেকে বড় ডেল্টা বা বদ্বীপ সৃষ্টি করেছে।
শুনলাম জঙ্গলে হরিণ ও অন্যান্য জন্তুর সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে বাঘেদের খাবার বড় একটা জোটে না তাই বাঘ মূলত অনাহারেই মারা যাচ্ছে। পেটের জ্বালাতেই তারা গ্রামের মধ্যে ঢুকে গরু ছাগল তুলে নিয়ে যায়, জাল দিয়ে আড়াল করেও বিশেষ লাভ হয় নি। সেটা শোনার পর থেকেই সেই খেতে না পাওয়া বাঘগুলোর ওপর আমার ভাইয়ের দরদ একেবারে উথলে উঠল। যখনই কোথাও হরিণ চরতে দ্যাখে তখনই আহা বাঘ ওদের মিস্ করে গেল বলে হাহুতাশ করে। শুধু তাই নয় দীপ্ত যখন বলল — এখন ভাঁটার সময় তাই বাঘ নদীতে মাছ খেতে আসতে পারে তখুনি সে ছুটে গিয়ে তার কাছে ঝুলোঝুলি করতে লাগল একটু বাঘ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য; ভাবখানা এমন যেন দীপ্ত বাঘ পকেটে নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন সময় দূর থেকে তিনটে চিতল হরিণ দেখতে পেয়ে আমার পাতানো ভাইটি একেবারে হায় হায় করে উঠল সম্ভব হলে সে নাকি তখুনি এসএমএস পাঠিয়ে মামাবাবুকে হরিণগুলোর লোকেশন জানিয়ে দিত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দীপ্ত ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলল। নদীর ধারে সে বাঘের পায়ের টাটকা ছাপ দেখতে পেয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন চোখের পলকে ঘটনাটা ঘটে গেল, হরিণগুলো প্রাণভয়ে এক চুড়ান্ত লাফ দিল আর তাদেরকে একটি ডোরাকাটা বিদ্যুৎবেগে ধাওয়া করল। মুখচোখ ভালো করে দেখতে না পেলেও সেটা যে বাঘ সে বিষয়ে কোন সন্দেহই ছিল না, তাই আমি আর ভাই দুজনেই বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করে উঠলাম। দুঃখের বিষয়, আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ সেই দ্রুত গতিতে চলে যাওয়া বাঘটিকে দেখতে পায়নি, তাই অন্যান্যরা বয়েসের দরুণ আমাদের কার চোখে ঠিক কতটা চালশে পড়েছে সেই গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শুধু আমার কর্তা মশাই ভিন্ন মত দিয়ে বললেন— পরশুরাতে সেই চাচার দোকানের ভেজাল 'ইলেকট্রিকের' জল খাওয়ার পর থেকেই আমি নাকি লাগাতার চোখে সরষে ফুল দেখে যাচ্ছি আর খুব সম্ভবত সেটিকেই 'রয়েল বেঙ্গল টাইগার' বলে ভ্রম করেছি।
সব টিটকিরি অগ্রাহ্য করে আমার ভাই আবেগের বশে সামনে হাত বাড়িয়ে সাংঘাতিক হেঁড়ে গলায় কিশোর কুমারের সেই বিখ্যাত গানটি গেয়ে উঠল – 'এক পলকে একটু দেখা আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি?' ক্ষতি যথেষ্টই হত যদি মামাবাবু সামনে উপস্থিত থাকতেন। ভাগ্নের গলায় সেই বিকট বেসুরো গান শুনে তিনি নিঃসন্দেহে মেজাজ ঠিক রাখতে পারতেন না আর ক্ষেপে গিয়ে তাকেই হয়ত সে রাত্রের ডিনার হিসাবে ব্যবহার করতেন।
সেদিনের মধ্যাহ্ন ভোজন বোটেই সারা হল আর তার কিছুক্ষণ পরেই দীপ্ত এসে বলল ও আমাদেরকে বিদায় জানাতে এসেছে। এক মাঝির সঙ্গে তাদের গ্রামে চলে যাচ্ছে, সেখানেই কয়েকটা দিন কাটাবে। খেয়াল করলাম 'পথের আলাপ পথেই শেষ হয়ে যাওয়া ভাল' কথাটা মুখে বলা যতটা সহজ কাজে করা ঠিক ততটা নয়। গত দুদিনে এই আপনভোলা ছেলেটিকে সবাই-ই খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম আর ওর জ্ঞানের পরিধি দেখেও অবাক হয়েছিলাম। বাঘ, কুমীর, পাখি বিভিন্ন লতাপাতা মায় বাঁদর সম্বন্ধেও বিচিত্র প্রশ্ন করে তাকে উত্যক্ত করে তুলেছিলাম কিন্তু বিরক্ত হওয়ার পরিবর্তে সে হাসিমুখে ধৈর্য্য ধরে আমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে তাই একসময় ভুলেই গিয়েছিলাম এই ছেলেটি দুদিন আগেও আমার কাছে ছিল অপরিচিত। ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম 'তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে ভাই?' উত্তর পেলাম 'জানি না তো দিদি, হয়ত এই সুন্দরবনেই আপনাদের সাথে কোনও একদিন দেখা হয়ে যাবে, তখন আমার কথা আপনাদের মনে থাকবে তো?' নাহ্, আজও আমরা সেই সদাহাস্যময় ভবঘুরে জঙ্গলপ্রেমী ছেলেটির কথা ভুলি নি।
পরেরদিন সকালে আমাদের ফিরে আসার পালা। শুনতে পেলাম চাচার দোকানের পাশে বসে থাকা বাছুরটিকে কাল রাতেই বাঘে তুলে নিয়ে গেছে, সেটা শোনা অবধি বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগল। কাল সকালেও বাছুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে নৌকোয় উঠেছিলাম আর আজ কিনা সে নেই? ফেরার পথে সেই শূন্য খুঁটিটার দিকে তাকিয়ে বার বার বাছুরটার মুখ মনে পড়তে লাগল তবুও কেন জানিনা সেই ঘাতক বাঘটার ওপর রাগ করতে পারলাম না। খাদ্য-খাদক সম্পর্ক তো পৃথিবীতে চিরদিনের। তবু তো প্রাণীরা বাঁচার তাগিদে হত্যা করে আর আমরা তথাকথিত সভ্য মানুষরা তো অকারণেই হিংস্রতা দেখাই। এ প্রসঙ্গে বার্নাড শর সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে গেল - 'When a man wants to murder a tiger he calls it sport; when a tiger wants to murder him he calls it ferocity'।
মনে পড়ে গেল আমার বাবা মাঝেমধ্যেই বলতেন, 'মনে রাখিস পৃথিবীটা শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয়।' সুন্দরবনকে বিদায় জানানোর আগে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায় ছাড়াও কালুখাঁ, গাজি সাহেব সবাইকেই মনে মনে পেন্নাম ঠুকে বলে এলাম এই 'বন্যেরা বনে সুন্দর' প্রাণীগুলো তোমাদের জিম্মাতেই রইল প্রভু, দেখো এরা যেন পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যায়।
~ সুন্দরবনের তথ্য ~ সুন্দরবনের আরও ছবি ~
শ্রাবণী ব্যানার্জীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।