ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - হিমালয়ের ডায়েরি (নবম পর্ব)
আগের পর্ব – যমুনোত্রীর পথে – গোমুখ থেকে উত্তরকাশী
পথের শেষে যমুনোত্রীতে
সুবীর কুমার রায়
পূর্বপ্রকাশিতের পর -
মাধবকে জলখাবার ও সঙ্গে নেওয়ার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে, আমি ও দিলীপ, ট্রাভেলার্স লজে লাগেজ ছাড়াতে গেলাম। যাওয়ার পথে দেখা সেই অফিসার ভদ্রলোককে এখন আর দেখলাম না। যে কর্মচারীটি আমাদের মালপত্র রেখেছিল, একটু পরেই তার খোঁজ পাওয়া গেল। আমাদের দুটো হোল্ড-অল ও তিনটে স্যুটকেস আছে। যাওয়ার সময় শুনেছিলাম পার লাগেজ পার ডে একটাকা ভাড়া। সেই হিসাবে অনেক টাকাই ভাড়া নেওয়া উচিত। কিন্তু কর্মচারীটি আমাদের কাছ থেকে দশ টাকা ভাড়া চাইলো। ভাড়া মিটিয়ে বাইরে এলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যমুনোত্রী যেতে হলে হয় "ধরাসু" যেতে হবে, আর তা নাহলে "বারকোট" যেতে হবে। এই দুই জায়গা থেকেই সরাসরি সায়নাচট্টি যাবার বাস পাওয়া যাবে। এও জানা গেল যে, ওই দুটো জায়গার মধ্যে বারকোট বেশ বড় জায়গা। কাজেই আমরা বারকোট যাব স্থির করে, কাউন্টার থেকে তিনটে বারকোটের টিকিট কাটলাম। তিনটে টিকিটের ভাড়া লাগল, পঁচিশ টাকা আশি পয়সা। বাসের ছাদে মালপত্র গুছিয়ে রেখে, আসন দখল করে বসলাম। পছন্দ মতো সামনের দিকে ড্রাইভারের ঠিক পিছনে, বাঁদিকে আমরা তিনটে আসন দখল করলাম। এবার বাস থেকে নেমে, পাঁউরুটি, কলা ও ডিম সিদ্ধ খেয়ে, একটা ওয়াটার বটল্ কিনে তাতে জল ভরে, জল খেয়ে, বাসে এসে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাস ছেড়ে দিল। মনে বেশ আনন্দ, শেষ পর্যায় প্রায় উপস্থিত। এখানে পৌঁছতে পারলে, এ পথের সমস্ত দর্শনীয় স্থান আমাদের দেখা হয়ে যাবে। আঁকাবাঁকা রাস্তা পার হয়ে, একসময় আমরা আবার সেই ধরাসু এসে পৌঁছলাম। আসলে ধরাসু হচ্ছে একটা জংশন। এখান থেকে একটু এগিয়েই রাস্তা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। একটা যাচ্ছে উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রী, অপরটা যমুনোত্রী। এখন আমাদের ধরাসু যাবার কোন প্রয়োজন ছিল না। বোধহয় আরও কিছু যাত্রীর আশায়, বাস ধরাসু গিয়ে অহেতুক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল।
ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ হল। ভদ্রলোকের খুব সুন্দর ব্যবহার। দেখতে অনেকটা আমার অফিসের আর্মড-গার্ড, কল্যাণ সাহার মতো। আমরা নিজেদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে কথা বলার সময়, তাঁকে কল্যাণদা বলে উল্লেখ করতে শুরু করলাম। এখানে একটা বড় হোটেল আছে। আমরা সেখানে সামান্য কিছু খেয়ে নিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে, কল্যাণদা বাসটা অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে গেলেন, বাসের মুখ ঘুরিয়ে আনার জন্য। অর্থাৎ যেদিক থেকে এসেছি, বাস আবার সেই দিকেই বেশ কিছুটা এগিয়ে, বাঁদিকে বারকোটের উদ্দেশ্যে বাঁক নেবে। আমরা দোকানেই বসে ছিলাম। বাস ঘুরিয়ে আনলে, বাসে উঠে বসলাম। সুন্দর রাস্তা, সুন্দর আবহাওয়া, মনটাও বেশ ভাল আছে। আমাদের ঠিক সামনে, বাসের সব থেকে সামনে, ড্রাইভারের আসনের বাঁপাশের সিঙ্গল সিটটা একজন যুবক দখল করে বসেছে। হাতে ম্যাগাজিন, চোখে রোদ চশমা। বাস যখন বেশ কিছুটা এগিয়েছে, যুবকটি ঘুমতে শুরু করল। আমরা ভাবছি ড্রাইভার হয়তো রেগে গিয়ে দুটো কটু কথা শোনাবেন। ওই সিটে বসে ঘুমনো নিষেধ। আমরা যে সিটে বসে আছি, এবং আমাদের ঠিক ডানপাশের সিটটাও, ওই একই নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। যাত্রীটি খুব সম্ভবত এইসব অঞ্চলেরই বাসিন্দা, হয়ত উত্তরকাশীরই। ড্রাইভার ভদ্রলোক ঘন ঘন সিগারেট খান। তিনি পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে, যুবকটিকে দিলেন। যুবকটি খুব লজ্জা পেয়ে একটু হেসে, হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিল।
এই রাস্তাটার দেখছি একটা বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে রাস্তা খুব সুন্দর এবং একভাবে ওপর দিকে উঠেছে। এখনও পর্যন্ত রাস্তা কখনও নীচের দিকে নামেনি। একভাবে ওপরে উঠতে হচ্ছে বলেই বোধহয়, বাসের ইঞ্জিন থেকে একটা বিশ্রি আওয়াজ হচ্ছে। আবার সেই পুরাতন ভয়টা, মাথা চাড়া দিয়ে উঠল - বাস আবার না খারাপ হয়, আবার না বলে বসে, বাস আজ আর যাবে না। এ পথের সৌন্দর্য বেশ ভাল। রাস্তা থেকে অনেক নীচের জমিকে, খুব সুন্দর দেখতে লাগছে। দুপাশে বড় বড় পাইন জাতীয় গাছ। আর এইসব গাছ থেকেই আসছে একভাবে সেই পোকার ডাক। কখনও বিরাম নেই। পরে দেখলাম এটা কোনও পোকার ডাক নয়। ধূসর রঙের বেশ বড় আকারের গঙ্গা ফড়িং জাতীয় এক রকম পোকা, নীচের দিকে মুখ করে পিছন দিকটা ওপরের দিকে উঁচু করে, একভাবে দ্রুত পাখা নেড়ে চলেছে। আর তার আওয়াজেই কানে তালা লাগিয়ে দেবার মতো অবস্থা। একসাথে প্রচুর ওই জাতীয় পোকা, বিভিন্ন গাছের ডালে বসে সব কাজ ফেলে, সারাদিন একভাবে পাখা নেড়ে চলেছে। এতে যে কী সুখ ওরা পাচ্ছে ওরাই জানে!
বাস একভাবে ওপর দিকে উঠছিল। আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বোধহয়, এইবার শুরু হল নীচে নামার পালা। একভাবে এঁকেবেঁকে, বাস নীচে নামতে শুরু করেছে। অনেকটা পথ পার হয়ে আসার পর দেখলাম, একটা গাছ কিভাবে ভেঙে রাস্তার ডান দিক থেকে বাঁদিকে, রাস্তা বন্ধ করে শুয়ে আছে। গাছটা এত প্রকাণ্ড আকারের, যে ওটাকে ঠেলে সরিয়ে একপাশে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কল্যাণদা ও কন্ডাক্টার বাস থেকে নেমে ব্যাপারটা উপলব্ধি করে, সবাইকে বাস থেকে নেমে আসতে বললেন। একে একে বাসের প্রায় সকল পুরুষ যাত্রী বাস থেকে নেমে হাত লাগালো। শেষে অনেক চেষ্টার পর, গাছটা একপাশে সরে গিয়ে, আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিল। আবার এগিয়ে চললাম। দুপাশের সারিবদ্ধ গাছে রাস্তা ছায়ায় ঢাকা। রাস্তার পাশে মাইলস্টোনগুলো ক্রমশঃ বারকোটের নিকটবর্তী হওয়ার সংবাদ জানাচ্ছে। বারকোট পৌঁছতে যখন আর মাত্র দশ-বার কিলোমিটার পথ বাকি, বাস দেহ রাখল। এই মুহূর্তে নিজেকে বড় অসহায়, বড় দূর্বল মনে হচ্ছে। আবার সেই অশান্তি। কিন্তু দক্ষ বাস ড্রাইভার ও কন্ডাক্টারের যৌথ প্রচেষ্টায়, বাসের ইঞ্জিন প্রাণ ফিরে পেল। কন্ডাক্টার রাস্তার পাশের ঝরনার জল টিনে করে এনে, বাসের ইঞ্জিনের সামনে ছেটাতে শুরু করলো। বাস থেকে অস্বাভাবিক রকমের ধোঁয়া বার হচ্ছে। বোধহয় ইঞ্জিন কোন কারণে খুব গরম হয়ে গেছে। এবার যদিও বাস ছাড়ল, ভয় কিন্তু গেল না। একটা বিশ্রি রকমের আওয়াজ করতে করতে, খুব ধীর গতিতে বাস এগিয়ে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ অন্তর একটা করে মাইলস্টোন অতিক্রম করছে, আর আমরা অস্থির মন নিয়ে মনে মনে ভাগ্য বিধাতার দয়া ভিক্ষা করছি - আর কয়েকটা মাইলস্টোন এগিয়ে নিয়ে চলো। আসলে ভয়টা বেশি পাওয়ার একটাই কারণ,আমাদের সঙ্গে এখন সমস্ত লাগেজ আছে। তা নাহলে এই সামান্য কয়েক কিলোমিটার রাস্তা, তাও আবার পাকা বাস রাস্তা, আমাদের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। অন্তত এখন তো নয়ই। ডানপাশে একটা রাস্তাকে ফেলে, আমরা বেশ কিছুটা নীচে বারকোট এসে পৌঁছলাম।
বাস থেকে মালপত্র নামিয়ে ভরদুপুরে একপাশে দাঁড়ালাম। কতদিন স্নান করিনি, অসহ্য লাগছে। খিদেও বেশ ভালোই পেয়েছে। পাশেই রাওত হোটেল। তিনতলা বাড়ি, এরই একটা অংশে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়ার শাখা। হোটেলে ঢুকে বাসের খবর নিয়ে জানা গেল, সাড়ে তিনটে-চারটে নাগাদ, হৃষিকেশ থেকে বাস আসবে। হৃষিকেশ থেকে বাস ধরাসু হয়ে সায়নাচট্টির পথ ডানপাশে ফেলে বারকোট আসবে। তারপর আবার ব্যাক করে বাঁহাতে সায়নাচট্টির ফেলে আসা পথ ধরবে। এই সায়নাচট্টি থেকেই যমুনোত্রী যাবার হাঁটা পথের শুরু। এখানে আরও একটা সুসংবাদ পাওয়া গেল ভাল চালের গরম ভাত ও মাংস পাওয়া যাবে। পাশেই একটা টেবিলে দেখলাম, একজন তুষার শুভ্র লম্বা লম্বা ভাত নিয়ে খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতদিনের অতৃপ্ত ক্ষুধা চাঙ্গা হয়ে পেটের ভিতর লাফ ঝাঁপ করে বিদ্রোহ শুরু করে দিল। সময় নষ্ট না করে,তিন প্লেট মাংস আর ভাত দিতে বললাম। মাংস পাঁচ টাকা প্লেট্, হোটেল কাউন্টারে বসা লোকটা জিজ্ঞাসা করল, মাংস কী হাফ্-হাফ্-হাফ্? অর্থাৎ হাফ্ প্লেট করে তিনজনকে দেবে কী না? এখানে বোধহয় এত দাম দিয়ে, ফুল প্লেট্ করে মাংস সচরাচর কেউ খায় না,বা খাওয়ার খুব একটা চল্ নেই। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের গুলিয়ে ফেললে চলবে কেন? আমরা পাঁচ টাকা প্লেটে খাসির খাদ্যনালী খাওয়া পাবলিক। ভাল মাংস দিলে আজ দশ টাকা প্লেট হলেও, ফুল প্লেটই খাব। আধ প্লেটে মন ভরবে কেন? বললাম, 'না, ফুল্-ফুল্-ফুল্, একটু দেখে দেবেন'। এবার দোকানদারও খুশি, আমরাও খুশি। তার হাবভাব দেখে মনে হল, সে বোধহয় আমাদের টাটা-বিড়লা জাতীয় কেউকেটা বলে মনে করছে। যাহোক খাবার এল। রান্না কেমন হয়েছে এই মুহূর্তে বর্ণনা করে সময় নষ্ট করতে পারব না, তবে মনে হচ্ছে জীবনে এত সুস্বাদু খাদ্য কখনও কোথাও খাইনি।
হোটেলের বাইরে মালপত্র ও লাঠি সাজিয়ে রাখা আছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আশেপাশে ইতস্তত ঘুরে ফিরে, আর হোটেলে বসে বসে, একসময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল, এল না আমাদের বাস। এবার অস্থির হয়ে উঠলাম। হোটেল মালিক কিন্তু এখনও একই সুরে বলে যাচ্ছে, "বাস আসবে। এখান থেকে সায়না চট্টি সামান্যই পথ, তাই সন্ধ্যা হলেও বাস ওখানে যাবে"। বাস কিন্তু আসবে সেই হৃষিকেশ থেকে। হঠাৎ মনে হল, বাসটা আমাদের আগের সব বাসের মতো রাস্তায় কোন কারণে আটকে পড়েনি তো? হোটেলের পাশেই বাঁহাতে একটা গুমটি ঘর। ওখান থেকেই বাসের টিকিট বিক্রি হয়। ওখানে গিয়ে বাসের খবর জিজ্ঞাসা করাতে, ওরাও বেশ জোরের সঙ্গেই জানালো বাস আসবে। সামনে বাঁপাশের রাস্তা ক্রমশঃ এঁকেবেঁকে ওপরে উঠেছে। ওই দিক থেকেই আমরা এখানে এসেছি। ওই দিক থেকেই এখন বাস আসবার কথা, আবার সেই বাসে আমরা ওই দিকেই যাব। যতদূর লক্ষ্য করা যায়, কোনও বাস আসতে দেখা যাচ্ছে কী না নজর রাখছি। নাহ, বাস এল না, তার পরিবর্তে রাত এসে হাজির হল। সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমশঃ ঘন হতে হতে রাত্রির রূপ নিল। আশা ছেড়ে দিয়ে হোটেলে একটা ঘর নেওয়াই মনস্থ করলাম। রাওত হোটেল আমাদের তিনতলায়, ঠিক বাস রাস্তার ওপরে একটা ঘর দিল। খাটে বসে বড় জানালা দিয়ে ঠিক নীচে অসংখ্য লোকের যাতায়াত, ট্রাকের যাওয়া আসা ইত্যাদি লক্ষ্য করতে করতে সময় কেটে যাবে, এটাই সান্ত্বনা।
বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ, একটা লোক সাইকেল নিয়ে বিড়ি বিক্রি করতে, আমাদের হোটেলের ঠিক নীচে, বাস রাস্তার ওপর এসেছিল। লোকটার একটা হাত কাটা। সাইকেলের কেরিয়ারে একটা বেশ বড় টিনের বাক্স লাগানো। ওই বাক্সে অসংখ্য বিড়ি। সামনে অদ্ভুত ভাবে একটা রেকর্ড প্লেয়ার লাগানো। সাইকেল দাঁড় করিয়ে, লোকটা তার ছোট্ট মাউথপিসটার মাধ্যমে, সামনের ছোট মাইকটায়, বিড়ির গুণগান গেয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল, আর মাঝেমাঝে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে, "নাগিন"-এর একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড বাজাচ্ছিল। এই অবস্থাতেও এত দূরের হোটেলের ঘরে বসে, আমাদের ঘরের হেমন্ত মুখার্জীর কন্ঠস্বরে, এই মুহূর্তে নিজের শহরের স্বাদ, গন্ধ অনুভব করছি। রাত আরও বাড়তে, লোকটা তার সাইকেলে, সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এতক্ষণ লোকটাকে ঘিরে রাখা লোকের ভিড় পাতলা হয়ে গেল। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, এত লোকের ভিড়েও, তার বিড়ি বিক্রির পরিমাণ কিন্তু অতি সামান্য। নাঃ, বাস আজ আর এল না। সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ কেটে গেল। এতদিনে খুব ভাল করে সাবান শ্যাম্পু মেখে, তিনজনে পর পর অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলাম।
হাতে অনেক সময় পেয়ে, নতুন করে মালপত্র গোছাবার জন্য স্যুটকেস খুললাম। আমার স্যুটকেসে জামাকাপড় ছাড়া, হেমকুণ্ড থেকে পলিথিন ব্যাগে বয়ে নিয়ে আসা একগাদা ব্রহ্মকমল ছিল। ফুলগুলো গাছ থেকে তুলে পলিথিন ব্যাগে পুরে স্যুটকেসে নেবার পর থেকে, পনের দিন পরে এই প্রথম স্যুটকেস খোলা হল। এগুলো নিয়ে আসার সময় এক ভদ্রলোকের হাতে ব্লটিং পেপার দেখে, এবং তার কাছে, ব্লটিং পেপার দিয়ে মুড়ে ফুল নিলে অনেক দিন ভাল ও টাটকা থাকে শুনে, সবজান্তা বিজ্ঞের মতো তাকে বলেছিলাম, "মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া 'ব্লটিং' দিয়ে শুষে, ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে" গোছের ব্যাপার বলছেন? এখন বুঝতে পারছি, অত সহজে এই মূল্যবান ফুল নিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। স্যুটকেসটা খুলতেই, একটা তীব্র পচা গন্ধে ঘর ভরে গেল। স্যুটকেসের নীচের দিকটা কালো জলে ভিজে গেছে। পলিথিন ব্যাগটা বেশ খানিকটা ফেটে গেছে। ফেটে না বলে, গলে গেছে বলাই বোধহয় ঠিক হবে। বোধহয় পচে অ্যাসিড ফর্ম করেই এটা হয়েছে। ছেঁড়া পলিথিন ব্যাগের ভিতর ফুলগুলো, পচে গলে কালো জলীয় পদার্থে পরিণত হয়েছে। আর স্যুটকেসের তলার অংশটা পুরো ভিজে এবং কালো রঙের দেখতে হয়ে গেছে। সমস্ত পচা ফুলসমেত পলিথিন ব্যাগটা ফেলে দিতে হল। স্যুটকেসটাও ফেলে দিতে পারলেই বোধহয় ভাল হয়, কিন্তু এখন মাঝপথে তা সম্ভব নয়। ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে অনেকবার ভাল করে মুছেও, স্যুটকেসটা পরিষ্কার করা গেল না। পচা গন্ধটা সামান্য কমলো বলে মনে হয়। শেষে নীচে গিয়ে একটা দামী ভাল পাউডার কিনে এনে, নিজের গায়ে না মেখে, পরম স্নেহে আদরের স্যুটকেসকে অর্ধেক মাখিয়ে, কাগজ পেতে ওটাকে মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হলাম। ফুলগুলো নিয়ে যেতে পারলাম না বলে খারাপও লাগছিল। অফিসের একজন আমাকে বার বার করে একটা ব্রহ্মকমল, তার জন্য কষ্ট করে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিল। ইচ্ছা থাকলেও, তাকে আর তার আকাঙ্খিত জিনিস এনে দিতে পারলাম না।
একটু রাত করেই একতলায় হোটেলে খেতে নামলাম। আমার আজ রাতেও আবার সেই সকালের খাবার খাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বন্ধুরা একই দিনে দুবার মাংস খেতে ভয় পেল। আমি জানি না রোজ রোজ পচা আলুর তরকারি, কাঁচা রুটি আর ঝুড়িভাজা খেলে যদি কোন ক্ষতি না হয়, তবে একদিনে দুবার মাংস ভাত খেলে, কতটা ক্ষতি বৃদ্ধি হতে পারে। তবু তাদের ইচ্ছায়, ডিমের ঝোল ভাত খেতে রাজি হতে হল। তবে হোটেল মালিক বোধহয় সব খদ্দেরের মন জুগিয়ে ব্যালান্সড্ করে চলেন। ডিমের ঝোলটা ভালই খেতে হয়েছে। তবে ডিমের ঝোলের ভিতর থেকে ছোট সাইজ হলেও, এক টুকরো মাংস উদ্ধার হওয়ায়, রাতের খাবারটাও আমার ভালই জমল। বেশ বুঝতে পারছি, এটা ওবেলার মাংসের ঝোলে ডিম সিদ্ধ করে মিশিয়ে দিয়ে, ডিমের ঝোল হয়েছে। তা হোক, ভদ্রলোককে বেশ সৎই বলতে হবে। ডিমের ঝোলে মাংসের টুকরো দিয়েছেন, মাংসের ঝোলে ডিমের টুকরো দেননি, এবং খেতেও বেশ উপাদেয় হয়েছে। যাহোক্, কিছুক্ষণ বাস রাস্তায় পায়চারি করে, তিন তলায় নিজেদের ঘরে ফিরে এলাম। ওপরে উঠবার সময় হোটেল মালিক আশ্বাস দিলেন আগামীকাল বাস পাওয়া যাবেই। মনে মনে, তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক বলে, ওপরে উঠে এলাম। গল্পগুজব করে অনেকক্ষণ কাটলো। আবার আমার সঙ্গীদের মধ্যে ফিরে যাবার পুরনো ঝোঁকটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মাধবের বক্তব্য, এখানে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই আগামীকাল আমাদের ফিরে যাওয়াই উচিৎ। আমি বললাম, কাল নিশ্চয়ই বাস পাওয়া যাবে। আর বাস না পাওয়া গেলেও, জীপ বা অন্য কিছুর একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা যাবে। তাছাড়া খরচ তো আমাদের হাতে। ডাল ভাত খেলেই খরচ কমে যাবে। অবশ্য ঘর ভাড়া প্রতিদিন পনের টাকা করে লাগবেই। ওদের অবস্থা দেখে ভয় হল, কাল বাস না এলে, যমুনোত্রী যাওয়ার আশা শেষ। ঘরের বাঁপাশের জানালা দিয়ে দূরে, অনেক দূরে, মিটমিট্ করে অনেক আলো জ্বলছে। আমাদের ধারণা, ওখানেই হয়তো যমুনোত্রী। ঘরটায় মাত্র দুটো খাট। একটায় দিলীপ, অপরটায় আমি আর মাধব শুয়ে পড়লাম। মশার উপদ্রব উপেক্ষা করে, একসময় ঘুমিয়েও পড়লাম।
আজ সেপ্টেম্বর মাসের তিন তারিখ। বেশ ভোরে ঘুম থেকে উঠে, মুখ ধুয়ে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে নীচে নেমে এলাম। হোটেল মালিক বললেন, গতকাল নিশ্চয়ই রাস্তায় কোথাও ধ্বসে বাস আটকে গিয়েছিল। চিন্তা করবেন না, আজ অবশ্যই বাস এসে যাবে। জিজ্ঞাসা করলাম, বাসের কোনও খবর পাওয়া গেছে কিনা। ওদের কথাবার্তায় মনে হল, এখানে বাসের খবর ওভাবে রাখা হয় না, হয়তো রাখাও যায় না। আশ্চর্য, এই বিপজ্জনক রাস্তায়, অতগুলো প্যাসেঞ্জার নিয়ে, বাসটা কেন এল না, রাস্তায় খাদে তলিয়ে গেল কিনা, জানার ইচ্ছা বা দায়িত্ব কারোর নেই। জানার উপায়ও বোধহয় নেই। অনেকক্ষণ রাস্তায় অপেক্ষা করে, আবার হোটেলে ফিরে এলাম। আমার দুজন সঙ্গী যেন বুঝে ফেলেছে যে, আজও আমাদের নিতে কোন বাস আসবে না। এবার খুব নার্ভাস ফিল করতে লাগলাম। বাঁদিকের জানলা দিয়ে কোন গাড়ির আওয়াজ আসলেই, বাসের আশায় সেদিকে তাকাই। কিন্তু হয় ট্রাক, নাহয় জীপ আসে। বাসও কয়েকটা পরপর এল বটে, তবে সেগুলো সায়নাচট্টি যাবে না। রাওত হোটেলকে ডানপাশে রেখে, সোজা এগিয়ে যাবে। শুয়ে বসে আর সময় কাটে না। বাসও আসে না। বোর্ণভিটা আর আমসত্ত্ব ধ্বংস হতে লাগল। এগুলো আর সংরক্ষণ করার প্রয়োজন নেই। একসময় স্নান সেরে একতলায় খেতে গেলাম। মানসিক কষ্ট, সময় সময় শারীরিক কষ্টের থেকেও কষ্টকর হয়, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কিছু না খেয়ে, সারাদিন পরিশ্রম করে, পিসু ভর্তি নোংরা বিছানায় শুয়ে, আমরা যে কষ্ট ভোগ করেছিলাম, এখন ভাল হোটেলে থেকে, ভাল খাবার খেয়ে, ভাল বিছানায় শুয়ে, তার থেকে অনেক বেশি যন্ত্রণা ভোগ করছি, সামান্য একটা বাসের অনুপস্থিতির জন্য। খাওয়া দাওয়া সেরে, আবার নিজেদের ঘরে বসে, ফিরে যাওয়া না যাওয়া, ইত্যাদি আলোচনায় বারটা, একটা, দুটো, ক্রমে বিকেল তিনটে বাজল, বাস কিন্তু এল না। মাধব বেশ অধৈর্য হয়ে পড়ছে। শেষে বাস আসার আশা ছেড়ে, গতকালের সেই বিড়িওয়ালার আসার অপেক্ষায় রইলাম। অন্তত তার সেই রেকর্ডের গান শুনে অনেকটা সময় কাটবে। গতকাল শুনেছিলাম, বিকেল সাড়ে তিনটে-চারটে নাগাদ বাস আসে। আমি ভাবছি আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে যদি বাস না আসে, তবে এদের সঙ্গে ফিরে যাবার যুদ্ধে, আর হয়তো নিজেকে জিতিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। বিড়িওয়ালা তার গানের ডালি, বিড়ির ঝুলি নিয়ে, সময় মতো এসে হাজির হল। গানের না বিড়ির আকর্ষণে জানিনা, লোকের ভিড়ও বাড়ল। আমরা নীচে নেমে এলাম।
হোটেলের বাঁপাশে বাসের টিকিট কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চা খেয়ে মাধব ওপরে চলে গেল। একটু দুরে রাস্তায় একটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই ওতে করে সায়নাচট্টি যাবার চেষ্টা করছে। মাথাপিছু দশ টাকা ভাড়া। আমি ও দিলীপ ঠিক করলাম, হোটেলে থাকতেও তো অনেক খরচ হচ্ছে, কাজেই জীপেই চলে যাব। জীপের কাছে যখন পৌঁছলাম, তখন অনেক পুরুষ ও মহিলা আসন দখল করে নিয়েছে। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বললাম। সে রাজিও হল, কিন্তু আমাদের অত মালপত্র, জীপে নিয়ে যেতে রাজি হল না। রাজি হল না, কারণ খদ্দেরের অভাব নেই। রাস্তার একপাশে কাল যে বাসটায় আমরা এসেছিলাম, দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জীপ ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে, ও কী করব ঠিক করতে করতেই, জীপটা লোক ভর্তি করে নাকের ডগা দিয়ে চলে যেতে, যমুনোত্রী যাবার শেষ আলোও নিভে গেল। আগের দিনের বাস ড্রাইভার, কল্যাণদার সঙ্গে বাস কর্তৃপক্ষের বেশ উত্তেজক আলোচনা হচ্ছে শুনলাম। কল্যাণদার বক্তব্য, দুদিন ধরে এত লোক আটকা পড়ে আছে, তার বাস তো আজ আর কোথাও যাবে না, কাজেই সে বাস নিয়ে সমস্ত প্যাসেঞ্জারকে সায়নাচট্টি পৌঁছে দিতে চায়। কর্তৃপক্ষের তাতে ভীষণ আপত্তি। আমরা মনে মনে কল্যাণদার জয়লাভ কামনা করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কল্যাণদা পরাজয় বরণ করে অসহায় ভাবে ফিরে এল। আমরা আবার বাসের অপেক্ষায় রাস্তায় বসে রইলাম।
আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি ও দিলীপ ওপরে নিজেদের ঘরে ফিরে আসতে যাব, হঠাৎ দেখি পাল পাল লোক ছুটে গিয়ে কল্যাণদার বাসে উঠছে। বাস কোথায় যাবে, আদৌ যাবে কী না, খোঁজ নেবার সময় নেই। দিলীপকে প্রায় ঠেলে বাসে উঠে জায়গা দখল করতে পাঠিয়ে, আমি ওপরে নিজেদের ঘরে ছুটলাম মালপত্র নামাতে। তখনও কিন্তু জানিনা বাস আদৌ যাবে কী না, বা গেলেও কোথায় যাবে। তবে কল্যাণদা যেহেুতু সায়নাচট্টি যাবার আগ্রহ দেখিয়ে ছিলেন, তাই ধরে নেওয়া যায়, বাস সায়নাচট্টি যাচ্ছে। তবে সে চিন্তা পরে করলেও চলবে।
ওপরে এসে মাধবকে বললাম, তাড়াতাড়ি মালপত্র নামাতে। আকাশে আবার এখন বেশ মেঘ করে এসেছে। মাধব বললো, মালপত্র এখানেই রেখে যেতে। আমার তাতে একবারেই মত নেই। বললাম কোন কারণে ফিরতে দেরি হলে, প্রতিদিন পনের টাকা করে অহেতুক ভাড়া গুনতে হবে। মাধব কিন্তু সেই খরচ করেও, মালপত্র এখানেই রেখে যাওয়া ঠিক বলে মনে করল, কারণ সায়নাচট্টিতে হয়তো মাল রাখার ভাল জায়গা নাও পাওয়া যেতে পারে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তবু এখানে মালপত্র রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ও আমার যুক্তি মেনে না নিলেও, বেজার মুখে আমাকেই মেনে নিল। শুধু বলল, রাস্তায় বৃষ্টি নামলে বিপদে পড়তে হবে। হাতে হাতে মাল নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি আমরা নীচে নেমে এসে, হোটেলের বিল মেটালাম। হোটেল মালিক আমাদের শুভ যাত্রা কামনা করলেন। আমি বাসের ছাদে মাল সাজিয়ে রেখে, নীচে নেমে এসে দিলীপের নাম ধরে চিৎকার করেও কোন সাড়া পেলাম না। বাসে এত ভিড়, যে ওকে উঠে খোঁজারও কোনও উপায় নেই। এই বাসে এখন অফিস টাইমের হাওড়া-কলকাতার মতো মানুষ ঝুলছে। দরজার দিকে এসে দেখলাম, দিলীপ একেবারে পিছনের সিটে জানলার ধারে জায়গা দখল করে বসে আছে। ও আমাদের দেখতে পেয়ে, তাড়াতাড়ি জানলা দিয়ে উঠে পড়তে বলল। ও আমাদের জন্য জানলার ধারে একটু জায়গা রেখে বসেছে। ও আমাদের দুজনের জন্যই দুটো বসার জায়গা রেখে, তারপরে নিজে বসেছিল। কিন্তু ওর ডানপাশে অনেকেই ওকে ঠেলে বাঁপাশে সরিয়ে, বসার জায়গা করে নিতে চাইছে। স্বাভাবিক, কারণ তারা দেখতে পাচ্ছে এত ভিড় বাসে দিলীপের বাঁপাশে জানালার ধারে দুজন বসার মতো জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। রোগা পটকা দিলীপ যতই 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী' পণ করে বসে থাকুক, তারা শুনবে কেন? ক্রমাগত চাপে তখন ওর বাঁপাশে কোন মতে একজন বসার মতো জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। এদিকে বাসে এত ভিড়, যে দরজা দিয়ে উঠে ভিতরে যাবার কোন উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত জানালা দিয়ে বাসে ঢুকে, কোনক্রমে জানলার ধারে বসে পড়লাম। এবার মাধবও জানালা গলে উঠে এসে আমার বাঁপাশে, জানালার ধারে জোর করে চেপে বসে পড়ল। পাঁচ-ছজন বসার জায়গায়, এগিয়ে পিছিয়ে আটজন বসেছি। জানালার ধারে মাধব, তারপরে আমি, আমার পরে দিলীপ। দিলীপের ডানপাশে একবারে নোংরা কতগুলো নারীপুরুষ। ওর পাশেই একটা স্ত্রীলোকের কোলে একটা বছর বার-তের বয়সের মেয়ে। এপথের একটা সুন্দর ব্যবস্থা, বাসে যতই ভিড় হোক না কেন, বাস ছাড়ার আগে বাসের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবেই। আমাদের এই বাসটায় একটাই মাত্র দরজা, এবং সেটা একদম সামনের দিকে। পিছন দিকে কোন দরজা না থাকায়, আমার ও মাধবের ঠিক সামনে, দরজার পরিবর্তে একটা দুজন বসার চেয়ার সিট করা হয়েছে। এই সিটটায় দুজন লোক বসেও আছে। একটু পরেই দেখি অন্য একজন লোক কিভাবে ম্যানেজ করে, ওই সিটটার জানালার ধারে দিব্বি নিজের বসার ব্যবস্থা করে নিল। বাসে কোথাও একটু দাঁড়াবার জায়গা পর্যন্ত নেই। পিলপিল করে লোক বাসের ছাদে উঠছে। কল্যাণদা একবার আমাদের সিটের পাশে জানলার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, 'সিট মিলেছে তো?' আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ওর সঙ্গে আমাদের কতটুকুই বা পরিচয়। বললাম, হ্যাঁ মিলেছে। কল্যাণদা বললেন, 'বাস ছেড়ে দিই?' আমরা বাস ছেড়ে দিতে বললাম। বুঝলাম না বাসে এত লোক থাকতে, উনি হঠাৎ আমাদেরই বা কেন জিজ্ঞাসা করলেন! কন্ডাক্টার কিন্তু এত ভিড়েও ঠিক কায়দা করে বাসের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাসের ছাদে এত লোক উঠছে যে ভয় হচ্ছে, আমাদের স্যুটকেস বা হোল্ড্-অল্ গুলো, লোকে বসে বা পায়ের চাপে নষ্ট না করে দেয়। যাহোক, এবার বাস ছেড়ে দিল। কোথাও একটু বাস দাঁড়ালেই, একগাদা করে লোক বাসের ছাদে উঠছে। এত লোক কোথায় ছিল জানিনা। মাধব আর আমি মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে শরীরের অনেকটা অংশ বার করে বাসের ছাদে লাগেজ ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য করছি। একবার দেখলাম দুটো স্যুটকেস ছাদের একপাশে দাঁড় করানো আছে। অর্থাৎ কেউ ওগুলো ওখানে সরিয়ে রেখেছে। আকাশে প্রচণ্ড মেঘ করেছে, সঙ্গে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একটাই ভয় হচ্ছে, হোল্ড্-অল্ গুলো পলিথিনে মোড়া, কিন্তু বৃষ্টি হলে স্যুটকেসগুলো ভিজবে, আর মাধবের কাছে গালাগালি খেতে হবে। তা খেতে হলেও এখন আর আমার কোন দুঃখ নেই, কারণ এখন এটা নিশ্চিত যে আমরা এবারের শেষ গন্তব্যস্থল, যমুনোত্রী যাচ্ছিই।
হঠাৎ দিলীপের পাশের মহিলার কোলে বসা সেই মেয়েটা, উল্টি, অর্থাৎ বমি করবে বলে জানালো। আমি দিলীপকে বললাম, খুব গম্ভীর হয়ে চোখ পাকিয়ে ওদের দিকে তাকাতে, তা নাহলে মেয়েটা আমাদের গায়েই উল্টি করবে। মহিলাটিকে বললাম, মেয়েটাকে ডানপাশে জানলার ধারে দাঁড় করিয়ে দিতে। মেয়েটা কাঁদতে এবং ঘামতে শুরু করলেও, নিজের জায়গা ছেড়ে নড়লো না এবং একটু পরেই মহিলাটির কোলে বমি করল। আমাদের সামনের চেয়ার সিটের একজন, নিজের সিটটা ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে বলল। কিন্তু মেয়েটার বোধহয় ইচ্ছা, কোথাও না গিয়ে আমাদের গায়েই বমি করা। বাধ্য হয়ে মহিলাটিকে খুব গরম দেখিয়ে, সামনের সিটে জানালার ধারে পাঠাতে বললাম। কিন্তু ওরা নীরব। এদিকে মেয়েটা একভাবে কেঁদে যাচ্ছে ও মাঝে মাঝে বমি করার মতো ওয়াক্ ওয়াক্ করে আওয়াজ করে যাচ্ছে। সামনের সিটের সেই ম্যানেজ করে জানালার ধারে বসা লোকটা আমাদের বলল, আমাদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে ওকে জানালার ধারে বসতে দেওয়া উচিৎ। দিলীপ তাকে ধমকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললো, "তোমার যদি এত দয়া, তবে তুমি তোমার সিটটা ছেড়ে দিয়ে ওকে বসতে দাও না"। লোকটা বিপদের আঁচ পেয়ে চুপ করে গেল। মনে হল দিলীপের হিন্দি বলার ক্ষমতাই, এক্ষেত্রে লোকটাকে চুপ করাতে সাহায্য করেছে। ইতিমধ্যে কন্ডাক্টার এসে টিকিট দিয়ে ভাড়া নিয়ে গেল। তিনজনের মোট ন'টাকা ভাড়া লাগল। সন্ধ্যা অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে। বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বোধহয় বৃষ্টি শুরু হল। একসময় একটা ঝরনার তলা দিয়ে বাসটা গেল। পাহাড়ের একটা অংশ রাস্তার ওপর ছাদের মতো ঝুলে আছে, আর সেইখান থেকেই খুব জোরে রাস্তায় জল পড়ছে। কিন্তু সেটা খুব সামান্য জায়গা জুড়ে হওয়ায়, বাসের ছাদে জল পড়ে জানলা ভিজিয়ে দিলেও, মালপত্রের খুব একটা ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। এইভাবে এক সময় বেশ অন্ধকারে বাস এসে সায়নাচট্টি উপস্থিত হল।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাস থেকে নেমেই দুজন বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। এই বাসে আমরা তিনজনই একমাত্র ট্যুরিষ্ট। আর সকলেই স্থানীয় বা আশেপাশের বাসিন্দা, কেউ কেউ হয়তো কাজেও এসে থাকতে পারে। ভদ্রলোক দুজন একটা কুলি ডেকে, আমাদের ট্রাভেলার্স লজে নিয়ে গেলেন। এখানকার ট্রাভেলার্স লজে দেখলাম অনেকগুলো ঘর আছে। ব্যবস্থাও, এখন পর্যন্ত যতগুলো টুরিষ্ট লজ বা ট্রাভেলার্স লজে উঠেছি, তার মধ্যে সবথেকে ভাল। আমরা একটা তিন শয্যা বিশিষ্ট ঘর নিলাম। এই ভদ্রলোকরাও দেখলাম সংখ্যায় তিনজন। আমাদের ঘরের দুএকটা ঘর পরেই, ওদের ঘর। একটু পরে ওঁদের ঘরে গেলাম খোঁজখবর নিতে। একজন ডায়েরি লিখছেন বলে মনে হল। আলাপ করে জানলাম, ওঁরা জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কর্মচারী। অফিসের কাজেই এদিকে এসেছেন, এবং এই ফাঁকে যমুনোত্রী দেখে, গঙ্গোত্রী যাবার ইচ্ছা আছে। গত দুদিন কোন বাস না আসায়, ওঁদেরও আমাদের মতোই অবস্থা। আজ বাস আসতে তাঁরা আনন্দে ছুটে গিয়েছিলেন। যমুনোত্রী ওঁদের ভাল লাগেনি। আমাদের কাছে হেমকুণ্ড ও নন্দন কাননের কথা শুনে, ওই দুটো জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমরা ঘরে ফিরে এসে মালপত্র গুছিয়ে রাখলাম। বাসে আসবার সময় ছাদে অত লোক উঠতে দেখে, কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম স্যুটকেসগুলো বোধহয় আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না। কিন্তু আশ্চর্য, একটা পায়ের দাগ পর্যন্ত কোন লাগেজে পড়ে নি। ওরা মালপত্র সাবধানে সরিয়ে রেখে ছাদে বসছিল। বলতে লজ্জা করলেও, সত্যি কথা বললে বলতেই হবে, আমি হলে হয়তো স্যুটকেসের ওপরেই আরাম করে বসতাম। বিশেষ করে যেখানে কেউ দেখার বা বলার লোক নেই। আকাশে মেঘ থাকলেও, বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। আমরা তিনজনে ঘুটঘুটে অন্ধকারে, খানিকটা মাঠের মতো ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে, ডান হাতে একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে, রাতের খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। একজন যুবক দোকানটা চালায়। সে বলল, আমাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসবে। বললাম, আমরা নিজেরাই আসব। ঘরে ফিরে এসে, যে যার খাটে আরামে শুয়ে থাকলাম। লোহার খাটে, স্পঞ্জের গদি। অনেকদিন বাদে নিশ্চিন্তে ঘুমনো যাবে। দিলীপের খাটটার একটা ঠ্যাং আবার নড়বড়ে, সত্যি কোথাও শান্তি নেই। রাত প্রায় ন'টা নাগাদ তিনজনে দোকানে গিয়ে ডাল, তরকারি ও রুটি খেয়ে, ঘরে ফিরে এলাম। আগামীকালের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস কাঁধের ঝোলা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে, যাবার প্রস্তুতি শেষ করলাম। এরপর পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লাম।
আজ সেপ্টেম্বর মাসের চার তারিখ। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সমস্ত মালপত্র ট্রাভেলার্স লজের ক্লোক রুমে রেখে দিলাম। যমুনোত্রী যাব। আজ আর ফিরব না। কাজেই শুধু শুধু ঘরভাড়া গোনার কোন মানে হয় না। গতরাতের জন্য আঠারো টাকা ভাড়া মিটিয়ে, মালপত্র একজন অল্প বয়সী কেয়ারটেকারের কাছে জমা দিয়ে, আমরা গতরাতের চায়ের দোকানে এলাম, চা খেতে।
দোকানের সামনে দেখলাম বিভিন্ন জায়গার দূরত্ব লেখা একটা বড় বোর্ড লাগানো আছে – তাতে যা বুঝলাম তা হল এখান থেকে যমুনোত্রীর দূরত্ব ২১ কিমি। আগে আরও আট কিমি এগিয়ে হনুমান চটি পর্যন্ত জীপ ও বাস যেত। এখন যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এখানেও আমাদের যাতায়াতে ৮+৮=১৬ কিলোমিটার পথ, অতিরিক্ত হাঁটতে হবে। আমরা শেষ পর্যন্ত হাঁটা পথেই, আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তা মোটেই খাড়া নয়। ভোরের সূর্যালোকে প্রফুল্ল মনে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি। বন্ধুদের কথা বলতে পারব না, তবে আমার মনে এখন এক অদ্ভুত প্রশান্তি। এবারও আমারই জয় হল। যমুনোত্রী যাওয়ার জন্য হাঁটা যখন শুরু করেছি, তখন আর শুধু পৌঁছনোর অপেক্ষা। একসময় হাঁটা পথ এসে বড় পাকা রাস্তায় মিশে গেল। আর কিছুটা এগিয়েই হনুমান চটি। গঙ্গোত্রী যাবার পথে লঙ্কায় এক দোকানদার, আমাদের হাতে একটা চিঠি দিয়ে, হনুমান চটির এক দোকানদারকে চিঠিটা দিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেছিল। এখন সেই দোকানদারের খোঁজ করে,তার হাতে চিঠিটা দিলাম। দোকানে চা ও ঝুড়িভাজা খেয়ে রওনা হবার আগে, মাধব ও দিলীপ ওই দোকানে ফেরার পথে রাত্রে থাকার ব্যবস্থাও পাকা করে ফেললো। দোকানদার খুব খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল। রাতে আমাদের জন্য সে চাপাটি ও তরকারি বানাবে বললো। আমিও এই উত্তম প্রস্তাবে সায় দিলাম বটে, তবে মনে একটা আশা, ঠিকমতো হাঁটতে পারলে,আজ রাতে সায়নাচট্টির ট্রাভেলার্স লজের নরম গদিতে শান্তির ঘুম কে আটকায়? আগে পথেও শুনেছি, এখানেও আবার সেই সাবধান বাণী শুনলাম যে, যমুনোত্রীতে একজন বাঙালি সাধুবাবা থাকেন। সবাই তাঁকে মাধব বাবা বলে। তিনি পথিকদের খিচুড়ি খাওয়ান। তবে সে খিচুড়ি না খাওয়াই ভাল, কারণ ওই খিচুড়ি খেলেই নাকি হজমের গণ্ডগোল হয়। অত কষ্টকর জায়গায় কষ্ট করে থেকে, নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে, কেন তিনি যাত্রীদের অসুস্থ করার ব্রত নিয়ে ওখানে পড়ে আছেন জানিনা! জানিনা এই গল্পটা এত প্রচারই বা পেল কী ভাবে! তবে সাবধানের মার নেই। আমরাও ঠিক করলাম, মাধব বাবার কাছে কিছু খাব না। আস্তে আস্তে একসময় "ফুল চটি" এসে পৌঁছলাম। রাস্তা হনুমান চটি থেকে পাঁচ কিলোমিটার। রাস্তা আস্তে আস্তে ওপরে উঠে আবার নীচে নেমে এসেছে। অর্থাৎ আমরা একুশ কিলোমিটার পথের, তের কিলোমিটার পথ শুধু হেঁটেই এলাম, উচ্চতায় কিন্তু অতি সামান্যই উঠেছি। বুঝতে পারছি এ রাস্তার শেষে বেশ ভোগান্তি আছে। শেষ পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে, আমরা মাত্র ৩২৯ মিটার উচ্চতায় উঠেছি। অথচ রাস্তা কিন্তু কোথাও সমতল ছিল না। তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা বেশ ভাল গতিতেই এগোচ্ছি। আঁকাবাঁকা, চওড়া রাস্তা দিয়ে আমরা লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলেছি। ডানহাতে অনেক নীচে যমুনা। চলার পথটা শক্ত পাথরের ওপর দিয়ে গেছে বলেই বোধহয়, এর জল এত পরিষ্কার নীল। গঙ্গা গেছে নরম কাদামাটির পথ দিয়ে। গঙ্গার জলও তাই বেশ অপরিষ্কার।
দেখতে দেখতে আমরা "জানকী চটি" এসে পৌঁছলাম। এখানে একটা টুরিষ্ট লজ থাকায়, রাতে থাকার বেশ ভাল ব্যবস্থা আছে। রাস্তার ডানপাশে একটা দোকান। এক বৃদ্ধ এই দোকানের মালিক। এখানে আমরা চা খেলাম এবং ফেরার পথে খাবার জন্য চাপাটি বানাতে বললাম। বৃদ্ধ একবার চাউলের কথা বললেও, আমরা তাঁকে চাপাটিই বানাতে বলে, রাস্তায় নামলাম। এখন পর্যন্ত রাস্তা বেশ আরামদায়ক বললে ভুল বলা হবে না। কারণ রাস্তা কিছুটা ওপরে উঠে, আবার নীচের দিকে নামায়, খুব একটা কষ্টকর নয়। বৃদ্ধ দোকানদার জানালেন, আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পথ বাকী আছে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় হেঁটে চলেছি। পথের সৌন্দর্য বলে কিছু নেই। সেই একঘেয়ে বন, লতাপাতা,পাথর,আর ডানদিকে বহু নীচে, নীল যমুনা। আমরা এতদিন বিভিন্ন জায়গায় যে সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখে এসেছি, তারপর এই জায়গা ভাল লাগার কথাও নয়। আরও পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। এবার কিন্তু হঠাৎ রাস্তা ওপর দিকে উঠতে শুরু করল। আমরা যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, তখন আকাশে রোদ ও ছায়ার খেলা শুরু হয়ে গেছে। মাধব ও দিলীপ বেশ হাঁপিয়ে পড়েছে। আমার অবস্থাও খুব শোচনীয়। তবু ওদের ফেলে আমি প্রায় ছুটেই বলা যায়, এগিয়ে গেলাম। কারণ আকাশে বেশ মেঘ করে আসছে। সমস্ত জায়গার অনেক ছবি তুলেছি। এখন এই শেষ জায়গার ছবি, মেঘ করলে আমাদের এই অতি সাধারণ ভারতীয় ক্যামেরায় তোলা যাবে বলে মনে হয় না। উঠলেও, সে ছবি ভাল হবে বলে মনে হয় না। অনেকক্ষণ একা একা এগোচ্ছি। হঠাৎ রাস্তার ওপর ছোট একটা সাপকে দেখলাম, রাস্তার একপাশ থেকে অপর পাশে যাচ্ছে। আমার হাতের লাঠি দিয়ে ওটার পথরোধ করতেই, সে তার ছোট্ট ফণা তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেহ কিন্তু মাটি থেকে একটুও উঠছে না, শুধু মাথাটা সামান্য তুলছে। মনে হয় একবারে বাচ্চা। হঠাৎ ভয় হল, এটার মা যদি প্রতিবাদ করতে আসে। লাঠির নালে ওটাকে আটকে নিয়ে, ছুঁড়ে অনেক নীচের যমুনায় ফেলে দিলাম। জানি অন্যায় করলাম, কিন্তু এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় এটা কাউকে ছোবল মারলে, তাকেই যমুনার পারে শেষকৃত্য করতে নিয়ে যেতে হবে।
আবার নিজের পথ ধরলাম। এবার দেখছি রাস্তা, বোধহয় সত্তর ডিগ্রি অ্যাংগেলে, সিঁড়ির মতো উঠতে শুরু করেছে। এই রাস্তাতেও আমি সাধ্য মতো যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, ওপরে উঠতে শুরু করলাম। বাড়ির সিঁড়ি যেমন প্রথম একদফা উঠে, বাঁক নিয়ে নতুন করে আর একদফা উঠতে হয়, আবার বেঁকে নতুন আর এক দফা, এই রাস্তাও ঠিক সেই ভাবে ওপরে উঠেছে। বেশ কয়েক পাক ওঠার পর, দূরে মন্দির দেখতে পেলাম। মন্দিরের মাথায় লাল পতাকা উড়ছে। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। চিৎকার করে সঙ্গীদের ডাকতে শুরু করলাম। ওরা কতটা পিছনে আছে জানিনা, কোন উত্তর এল না। মন্দিরে গেলাম। একজন বসে আছেন, বোধহয় পুরোহিত হবেন। তবে তাঁর কাছে প্রথম যেটা জানতে পারলাম, তাতে আমার হার্ট অ্যাটাক হবার উপক্রম। আমি তখন প্রায় জিভ বার করে কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছি, সেই অবস্থায় শুনলাম, এটা যমুনোত্রী মন্দির নয়। যমুনোত্রী মন্দির এখান থেকে আরও প্রায় দুই কিলোমিটার দুরে। কথাটা শুনে প্রথম অবস্থায় ভেঙ্গে পড়লেও, এখানে আর বৃথা সময় নষ্ট না করে, নতুন উদ্যমে এগোতে শুরু করলাম।
রাস্তা ঠিক একই ভাবে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এত কষ্ট অন্য কোথাও বোধ হয়নি। রাস্তা আর শেষ হয় না। একভাবে চড়াই ভাঙতে নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। শেষে অনেক দূরে, ছোট্ট যমুনোত্রী মন্দির চোখ পড়ল। ডান হাতে একটা ব্রিজ যমুনার ওপর দিয়ে গেছে। ব্রিজটা কিন্তু ভেঙে গেছে। ব্রিজের দুপাশেই গাছের ডালপালা দিয়ে, রাস্তা বন্ধের নির্দেশ। একটু বাঁপাশে অনেক নীচে, যমুনার ওপর দিয়ে একটা সাময়িক ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে গাছের ডাল দিয়ে। ব্রিজটার ওপর দিয়ে হাঁটার সময় দেখি বেশ লাফাচ্ছে। পড়ে গেলে আর কিছু না হোক, হাত-পা ভাঙার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। গাছের দুটো মোটা ডালের ওপর, সরু সরু ডালপালা ফেলে, ওগুলো যাতে সরে না যায় তাই, মধ্যে মধ্যে পাথর ফেলে রাখা হয়েছে। পরে মনে হল, এটা বোধহয় যমুনা নয়, কোনও শাখা নদী। জানিনা এটার কী নাম। যাহোক, ব্রিজ পার হয়ে আরও বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে, মন্দিরের বেশ কাছে এসে দেখলাম, আরও একটা ব্রিজ। এই ব্রিজটা বোধহয় যমুনার ওপর দিয়েই গেছে। আমি যখন ব্রিজটার প্রায় এক চতুর্থাংশ পার হয়ে গেছি, তখন বাঁদিক থেকে চিৎকার শুনে তাকালাম। দেখি বাঁপাশে বেশ খানিকটা নীচে মন্দির, এবং একজন হাত নেড়ে আমায় রাস্তা দেখাচ্ছে। আসলে মন্দিরে যেতে হলে, ব্রিজটা পার হতে হবে না। ঠিক ব্রিজটার আগে থেকে বাঁপাশে নেমে আসতে হবে। ফিরে এসে নীচে নেমে, মন্দির চত্বরে এসে হাজির হলাম। পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সঙ্গী দুজন চলে এল। ওদের কাছে শুনলাম, ওরাও আমার মতোই আগের মন্দিরটাকে, যমুনোত্রী মন্দির ভেবেছিল। ইতিমধ্যে আমার কয়েকটা ছবি তোলা হয়ে গেছে। সব জায়গার ছবি বেশ ভালভাবে তুলতে পেরেছি বলে, বেশ ভাল লাগছে। এই ছবিগুলোই সারা জীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।
যমুনোত্রী মন্দির বলতে ছোট্ট একটা ঘর, সাদা দেওয়াল, ভিতরে যমুনার মূর্তি। যমুনোত্রীকে নিয়ে যতই হৈ-চৈ করা হোক, যতই যাত্রী সেখানে যাক না কেন, মানুষ ও প্রকৃতি, উভয়ই তাকে উপেক্ষা করেছে, বঞ্চনা করেছে। মাধব বাবার সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি আমাদের স্নান করে নিতে বললেন। একবারে মন্দিরের কাছে ছোট্ট একটা কুণ্ড থেকে গরম জল বার হচ্ছে। এখানকার কুণ্ডের জল কিন্তু গঙ্গোত্রীর মতো হালকা গরম নয়। এই কুণ্ডের জল এত গরম, যে ন্যাকড়া করে চাল ডাল বেঁধে জলে ফেলে দিয়ে ভাত, ডাল সিদ্ধ করা হয়। অনেকটা "মণিকরণ"-এর মতো। জল ফুটলে যেমন টগবগ করে আওয়াজ হয়, এই কুণ্ডের জল থেকে সেরকম একটা আওয়াজ হচ্ছে। তপ্ত কুণ্ডের জল গড়িয়ে এসে একটু নীচে একটা চৌবাচ্চায় পড়ছে। এই চৌবাচ্চার জল অত গরম না হলেও, স্নান করা যায় না। এই দ্বিতীয় চৌবাচ্চা থেকে আরও নীচে, আর একটা চৌবাচ্চায়, জল গড়িয়ে পড়ছে। এই তৃতীয় চৌবাচ্চার জল খুব আরামদায়ক গরম। আমরা জামা প্যান্ট ছেড়ে, জলে নেমে পড়লাম। মাধব বাবা বললেন, খিচুড়ি তৈরি করছেন, আমরা যেন স্নান সেরে খাওয়াদাওয়া করে, যমুনোত্রী ত্যাগ করি। সবিনয়ে জানালাম যে রাস্তায় খেয়ে এসেছি, কাজেই এখন আর কিছুই খাব না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন যে আমরা কোথায় খেয়েছি। একটু ইতস্তত করে বললাম, জানকী চটিতে। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, "তোমরা ওখানে কী খেয়ে এসেছ?" বললাম রুটি তরকারি খেয়েছি। বললেন, "তবে দুটো খিচুড়ি খেয়েই যাও।" এতো মহা মুশকিল, এক মাধবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে, সব জায়গা ঘুরে এসে এখানে এলাম, তো আর এক মাধবের খপ্পরে পড়লাম। জয় মাধবায় নম। যাহোক্, শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করানো গেল। তিনি বললেন "তবে চা করি।" আমরা বারণ করলাম। তিনি বোধহয় এবার একটু দুঃখই পেলেন। বললেন, "এত দূরে এসে কিছু খাবে না?" সবিনয়ে বললাম, এর জন্য তাঁকে ব্যস্ত হতে হবে না। যে জায়গাটায় স্নান করলাম, তার পিছন দিকটায় মাধব বাবার মন্দির-কাম-আশ্রম। মাধব বাবার সঙ্গে আমরা তাঁর আশ্রমে গেলাম। অনেক কথা হল। উনি দেখলাম হাওড়া শিবপুরের প্রায় সমস্ত রাস্তা ঘাট চেনেন। এমন কী হাওড়া বাকসাড়া-ব্যাতরের কয়েকজনের নাম করে করে খোঁজখবর নিলেন। তারাও আগে যমুনোত্রী দেখতে এসেছিল। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, তিনি প্রায় নয়-দশ বছর যমুনোত্রীতে আছেন। ভদ্রলোক বাঙালি। হয়তো সন্ন্যাসী হয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন।
এবার ওপরে যমুনোত্রী মন্দিরে গেলাম। পুজো হয়ে গেছে, মন্দিরের দরজা বন্ধ। একজন এসে দরজা খুলে দিল। মাধব ও দিলীপ ঠাকুর দর্শন করে, প্রসাদ নিল। আমি আরও কয়েকটা ছবি নিলাম। এরপর আমরা তিনজন মনের আনন্দে অনেকটা করে আমসত্ত্ব খেলাম। এবার ওঠার পালা। একটা হৃষ্টপুষ্ট ছেলে এসে আমায় বলল, তার একটা ছবি তুলে দিতে। মন্দিরের অনেক ছবি তোলা হয়েছে বলে, তাকে আশ্রমের কাছে দাঁড়াতে বললাম। সে কিন্তু মন্দিরের কাছে দাঁড়িয়েই, ছবি তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করল। কথা বলে জানা গেল, সে মন্দিরের কেয়ারটেকার মতো। নাম, "রাই সিং"। আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে, পোষাক বদলে এল। গায়ের কোটটা অনেক জায়গায় তালি দেওয়া। এবার বলল, আমার গায়ের হলুদ রঙের গেঞ্জিটা তাকে দিতে। বললাম, ছবি তুললে কিছু বোঝা যাবে না। ছেঁড়া জামা ছবিতে উঠবেও না, বোঝাও যাবে না। একটা ছবি নিলাম। তার অনুরোধে ছবির একটা কপি তাকে পাঠিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তার ঠিকানা নিয়ে, ফিরবার পথ ধরলাম।
একটু এগিয়েই আমার হাতের লাঠিটা আমায় ত্যাগ করে, নীচে যমুনায় চলে যাচ্ছিল। ওটাকে ধরে আবার আমার সঙ্গে নিয়ে চললাম। মাধব ও দিলীপ অনেক এগিয়ে গেছে। আমি বেশ ধীরে সুস্থে পথ চলছি। বেশ বুঝতে পারছি, চেষ্টা করলে আজই সায়নাচট্টি ফেরা সম্ভব হবে। আর এও বুঝতে পারছি, আজ যাওয়া আসা নিয়ে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ কিলোমিটার পথ হাঁটতে বললেও, ওরা দু'জনের কেউই আজ আপত্তি করবে না।
আমার এখন একটাই ভাবনা, আগামীকাল ফেরার বাস পাওয়া যাবে তো? কল্যাণদা যদি বাসটা আবার নিয়ে আসে তো খুব ভাল হয়। হাঁটতে হাঁটতে যখন একসময়, সেই ভুল করে যমুনোত্রী মন্দির ভাবা, মন্দিরটার কাছে এলাম, তখন দেখি, একদল স্ত্রী ও পুরুষ, সঙ্গে বাচ্ছা নিয়ে আসছে। ওরা যমুনোত্রী যাবে। আরও অনেকটা পথ হাঁটার পর, আর একজনের সাথে দেখা হ'ল। সে আমাদের কাছে একটা সিগারেট চাইলো। তাকে একটা সিগারেট দিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বার করে দেবার আগেই, সে সিগারেটটা ছিঁড়ে ফেলে, মশলাটা খৈনির মতো হাতে পিষে, মুখে ফেলে দিল। একসময় জানকী চটির সেই দোকানে এসে হাজির হলাম। মাধব ও দিলীপ দোকানে বসেই ছিল। আমাদের খাবার তৈরিই ছিল, তাই অহেতুক সময় নষ্ট না করে, ডাল আর রুটি খেয়ে আবার নিজেদের চলার পথ ধরলাম। ওদের এবার একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে বলে বললাম, আজই সম্ভব হলে সায়নাচট্টি ফিরে যাব। এবার উৎরাই-এর পথই বেশি, কাজেই হাঁটার কষ্ট অনেক কম। কিন্তু মাধবের আবার এই এক রোগ, ওপরে ওঠার সময় কিছু হয় না বটে, কিন্তু নীচে নামতে হলেই ওর হাঁটুর ব্যথা শুরু হয়। হাঁটতে হাঁটতে সেই পুরানো পথ ধরেই একসময় ফুলচটি এসে পৌঁছলাম। বেশ বুঝতে পারছি যে, যে কারণেই হোক, আজ কিন্তু আমাদের হাঁটার গতিবেগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই পুরানো একঘেয়ে পথ ধরে, একসময় আমরা এঁকেবেঁকে হনুমান চটির সেই দোকানে ঢুকে, চা, ঝুড়িভাজা আর মিষ্টি খেয়ে, বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। এখন সবে বিকেল, তার মানে হাতে অনেক সময় আছে। দোকানদারকে জানালাম যে, আমরা আজই সায়নাচট্টি চলে যাব, কাজেই আজ রাতে আর এখানে থাকবো না।
হঠাৎই লক্ষ্য করলাম, আকাশের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। আর সময় নষ্ট না করে উঠে পড়লাম। সঙ্গীদের বললাম, খুব জোরে বৃষ্টি আসবে, তাড়াতাড়ি পা চালাতে। দিলীপকে নিয়ে এখন আর কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মাধবের হাঁটার গতি ক্রমশঃ কমে আসছে। দাঁড়িয়ে পড়লে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে, কাজেই হাঁটতে শুরু করলাম। আমি আর দিলীপ একটু আগে আগে হাঁটছি, মাধব কিছুটা পিছনে। মাঝে মাঝেই পিছন ফিরে ওকে গতি বাড়াতে বলছি। বড় রাস্তা থেকে যেখানে ডানদিকে পায়ে হাঁটার সেই শর্টকাট পথটা নেমেছে, সেখানে পৌঁছে বুঝলাম, বৃষ্টি নামলো বলে। মাধবকে আরও তাড়াতড়ি নামতে বলে, আমি আর দিলীপ খুব জোরে পা চালিয়ে নামতে শুরু করলাম। এইভাবে যখন আমরা প্রায় নেমে এসেছি, তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হ'ল। বৃষ্টির ভয়ে মাধবও দেখি তার পায়ের ব্যথা ভুলে, আমাদের ধরে ফেললো। আমরা এবার ছুটতে শুরু করলাম। এইভাবে আমরা যখন প্রায় ট্রাভেলার্স লজের সামনে এসে পৌছলাম, তখন বেশ বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হ'ল। আমরা ছুটে ট্রাভেলার্স লজে গিয়ে ঢুকলাম। এবার শুরু হ'ল প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি। আমাদের দেখে তো কেয়ারটেকার অবাক। সে জিজ্ঞাসা করলো, এত তাড়াতাড়ি আমরা কিভাবে ফিরে আসলাম? সে আমাদের ভাগ্যবান আখ্যা দিয়ে বললো, দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির পর, আজই প্রথম বৃষ্টি নামলো। আমরা আমাদের মালপত্র নিয়ে আগের সেই ঘরটায় চলে এলাম। ঘরে ঢুকেই যে যার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এখন বেশ ঠান্ডা লাগছে। কম্বল চাপা দিয়ে আরাম করে শুয়ে থাকতে খুব ভাল লাগছে। শুয়ে শুয়ে ঘরের ছাদে, জানালায়, একভাবে শিল পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে ভাবছি, বৃষ্টি নামায় এরা এত খুশি, কিন্তু রাস্তায় যদি ধ্বস নামে তাহলে আমাদের কী হবে? আবার বাস বন্ধ হয়ে যাবে না তো? এই বৃষ্টিতেই সেই দোকানদারটা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলো যে, সে আমাদের খাবার নিয়ে আসবে কী না। বললাম, একটু পরে আমরা নিজেরাই যাব। রাত ন'টা নাগাদ দোকানে গিয়ে রুটি-তরকারি খেয়ে, সমস্ত দাম মিটিয়ে ঘরে ফিরে এসে, মালপত্র গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়লাম।
আজ সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখ। আজও বেশ সকালেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিয়ে চা খেতে গেলাম। দেখলাম আমাদের বাস গতকাল সন্ধ্যাতেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল অন্ধকার আর মেঘবৃষ্টির মধ্যে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটাকে লক্ষ্য করি নি। মালপত্র নিয়ে লজের বিল মিটিয়ে, বাসে এসে মালপত্র গুছিয়ে তুললাম। আর কোন চিন্তা নেই। চা জলখাবার খেয়ে বাস ছাড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাসে আস্তে আস্তে লোক উঠছে। আমরাও বাসে উঠে বসলাম। একটু পরেই বাস ছেড়ে দিল।
আগের দিন এ পথ সন্ধ্যার অন্ধকারে এবং ভীষণ ভিড়ে এসেছিলাম। তাই রাস্তাঘাট, নদীনালা, ভালভাবে দেখার সুযোগ হয় নি। আজ খুশি মনে চারিদিক লক্ষ্য করতে করতে, ফুরফুরে মেজাজে চলেছি। অনেকটা পথ এসে, বাসটা একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে গেল। গতকালের প্রবল বর্ষণে ছোট হলেও, ভয়ঙ্কর ধ্বস নেমেছে। ঠিক বাঁকটার মুখে, রাস্তার খাদের দিকটায়, অনেকটা অংশ বহু নীচে নেমে গেছে। পাশ দিয়ে একটা জীপ চলে যেতে পারে, কিন্তু বাস নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জায়গাটার নাম দেখলাম "পালিগড়"। বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া, আমাদের আর করার কিছুই নেই। এ রাস্তা সারানো আমাদের কর্ম নয়। এর জন্য স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও যথেষ্ট দক্ষতা থাকার বিশেষ প্রয়োজন। বাসের কয়েকজন বাস ড্রাইভারকে বললো, বাস খালি করে, সাবধানে ভাঙ্গা জায়গাটা পার হয়ে যেতে। সকলকে বাস থেকে নামিয়ে, বাস খালি করাও হ'ল। কিন্তু ঐ ভাঙ্গা অংশ পার করে বাস নিয়ে যাওয়া সম্ভব হ'ল না। তখন স্থানীয় বাস যাত্রীরা উপর থেকে বড় বড় পাথর বয়ে নিয়ে এসে, ভাঙ্গা জায়গা মেরামত করতে শুরু করে দিল। পাহাড়ের দিক, অর্থাৎ খাদের উল্টোদিকে রাস্তার একবারে পাশ থেকে পাথর সরিয়ে, ঐ জায়গার রাস্তা, খানিকটা চওড়া করার চেষ্টাও করা হ'ল। বুঝতে পারছি এটা সম্পূর্ণ সাময়িক, হয়তো দু'চারটে গাড়ি পার করার মতো ব্যবস্থা হচ্ছে। তা হোক, তবু একটা গাড়ি পার করা সম্ভব হলেও, আমরাই পার হচ্ছি। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাজ করার পর, বাস চলাচলের মতো অবস্থা তৈরি করা সম্ভব হ'ল। ড্রাইভার খুব সাবধানে ভাঙ্গা জায়গাটা দক্ষ হাতে পার করে নিয়ে গেল। জানিনা সামনে আবার আমাদের জন্য আর কোন দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে কী না। আস্তে আস্তে এঁকেবেঁকে আগের দিনের সেই পুরানো পথ ধরে, আমরা বারকোট ফিরে এলাম। সমস্ত লোক বাস থেকে নেমে পড়লো। মাধব ও দিলীপ রাস্তায় নেমে পড়েছে। প্রত্যেক বারের মতো, আমি বাসের ছাদে উঠেছি মালপত্র নামাতে। আমাদের ছাড়া আর সকলের মালপত্র বলতে ঝুড়ি, ছোট ছোট কাপড়ের পোঁটলা ইত্যাদি। কাজেই ওরা চটপট্ নিজেদের মালপত্র নিয়ে বাসের ছাদ থেকে নেমে পড়লো। আমাকে অতগুলো হোল্ড-অল্, ও সুটকেস নামাতে হবে। একটা মালও নীচে নামানো হয় নি, বাসের মুখ ঘুরিয়ে আনার জন্য, বাস ছেড়ে দিল। সঙ্গীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমি বাসের ছাদে উবু হয়ে বসে আছি। ড্রাইভার খুব জোরে বাস চালিয়ে নিয়ে চললো। অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েও, বাসের মুখ উল্টোদিকে ঘোরানোর কোন লক্ষণ দেখছি না। কোন জায়গা থেকে বাসকে আবার মুখ ঘুরিয়ে বারকোট নিয়ে যাওয়া হয় তাও জানিনা। বাসটা আদৌ মুখ ঘুরিয়ে আনতে যাচ্ছে কী না, তাও সঠিক জানা নেই। ভয় হচ্ছে, এখন যদি বলে এবেলা বাস এখানেই থাকবে, তাহলে এত মালপত্র নিয়ে কী করবো? হঠাৎ রাস্তায় বাসের ছাদে হনুমানের মতো আমার বসে থাকার ছায়া দেখে, ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বার করে, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, বাসের ছাদে বসে আমি কী করছি। বললাম আমাদের মালপত্র এখনও নামানো হয় নি। বুঝলাম ড্রাইভার বা কন্ডাক্টার, কেউই জানতো না যে, আমি বাসের ছাদে বসে আছি। যাহোক্, এতক্ষণে একটা জায়গায় এসে, বাসের মুখ আবার বারকোটের দিকে ঘোরানো শুরু হ'ল। এই জায়গার রাস্তাও কিন্তু বেশ সরুই। বাসটা একবার সামনে উচু পাহাড়ের দিকে এগোয়, আবার খাদের দিকে পিছিয়ে এসে, ব্রেক কষে হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়ায়। এইভাবে এগিয়ে পিছিয়ে, অনেক কসরত করে বাসের মুখ ঘোরানো পর্ব চলছে। আমি খুব সাবধানে ছাদের একটা পাটাতন ধরে বসে আছি। ড্রাইভার আমাকে ধার থেকে সরে গিয়ে বাসের মাঝখানে বসতে বলল। বাসটা যখন পিছিয়ে খাদের দিকে এসে থেমে যাচ্ছে, বাসের ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বাসের পিছন দিকের অনেকটা অংশ, পিছনের চাকার প্রায় আগে পর্যন্ত, আমাকে নিয়ে খাদে ঝুলছে। বুঝতে পারছি না, সেই যদি সরু রাস্তার ওপরেই বাস ঘোরাত হয়, তাহলে বারকোট থেকে তেল পুড়িয়ে এতটা পথ কষ্ট করে পার হয়ে, এই সুইসাইডাল পয়েন্টে আসার দরকার কী! বাসের ছাদে উবু হয়ে বসে, প্রায় দম বন্ধ করে ড্রাইভারের কেরামতি দেখছি। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঐ ভাবে এগিয়ে পিছিয়ে বাসের মুখ ঘরিয়ে, বাসকে আবার বারকোটের দিকে নিয়ে যাওয়া হ'ল। বারকোটে ফিরে এসে, মালপত্র নামিয়ে, হোটেলে ঢুকলাম। আগের দিনের সেই ঘরটা পাওয়া গেল না। ঠিক তার উল্টো দিকে একটা ঘর পেলাম। এ ঘরটা থেকে বাথরুম পায়খানা কাছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, একে একে তিনজনে খুব ভাল করে স্নান করে, অবশিষ্ট বোর্ণভিটাটা শেষ করলাম। তারপরে একতলায় গিয়ে খেয়েদেয়ে, আবার ঘরে ফিরে এলাম। আগেরবার লক্ষ্য করেছি, বিকেল তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ, একটা স্টেট বাস বারকোট আসে। বাসটা কিন্তু আসে, যেদিক থেকে আমরা প্রথম দিন বারকোট এসেছিলাম, তার উল্টো দিক থেকে। অর্থাৎ বাসের ছাদে বসে আমাকে যেদিকে যেতে হয়েছিল, সেই দিক থেকে। বাসটা রাতে বারকোটে থেকে, পরদিন সকালে ঐ পথে মুসৌরি হয়ে, দেরাদুন যায়। অপর দিকে যে বাসটা হৃষিকেশ থেকে বারকোট হয়ে, সায়নাচট্টি যায়, সেটা আবার বারকোট থেকে হৃষিকেশ ফিরে যায়। আমরা আর কোন ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে ঠিক করলাম যে, সকালে যে বাসটা আগে ছাড়বে, তাতেই দেরাদুন বা হৃষিকেশ চলে যাব।
আমরা ঠিক করেছিলাম, সমস্ত জায়গা ঘুরে, ফিরবার সময় হরিদ্বারে দিনকতক রেষ্ট নিয়ে হাওড়া ফিরব। রেষ্ট মানে কমপ্লিট রেষ্ট। ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া করব, আর নিশ্চিন্তে ঘুমাব। সন্ধ্যাবেলা হর-কি-পেয়ারিতে গিয়ে আরতি দেখে, বসে বসে গল্প করে সময় কাটাব। এই উদ্দেশ্যে মাধব একসেট পায়জামা পাঞ্জারিও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন বুঝছি বাড়ির টান, নাড়ির টানের মতোই প্রবল। এখন আর আমাদের কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই। এখন শুধু একটাই চিন্তা, কখন বাড়ি ফিরব।
পুঃ – দেরাদুন থেকে ফেরার ট্রেনে আমি আর মাধব কিছুতেই বেড়ানোর খরচের হিসাব মেলাতে পারছিলাম না। হিসাব মতো হাতে সাত টাকা ছিয়ানব্বই পয়সা একসেস্ থেকে যাচ্ছে। পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, হিসাব মেলাচ্ছেন? ওটা কোনদিন মেলে না। আমরা হেসে হিসাব নিকাশ বন্ধ করে রাখার আগে শুধু দেখে নিলাম, এই ট্যুরে আমাদের জুতো, ওয়াটার প্রুফ, ওয়াটার বটল্, ইত্যাদি কেনার খরচ বাদ দিয়ে, এক একজনের, সাত শত ছিয়াত্তর টাকা ঊনত্রিশ পয়সা করে খরচ হয়েছে, আর প্রায় ২২৫ কিলোমিটার মতো হাঁটতে হয়েছে। ( গোবিন্দ ঘাট—হেমকুণ্ড ১৮.৫ কি.মি.+ হেমকুণ্ড-ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ৮.৫ কি.মি.+ ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স-ঘাংরিয়া ৩.৫ কি.মি.+ ঘাংরিয়া-ভ্যালি অফ্ ফাওয়ার্স ৫ কি.মি.+ ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স-গোবিন্দ ঘাট ১৮ কি.মি.+ বদ্রীনারায়ণ-বসুধারা ৮ কি.মি.+ বসুধারা-বদ্রীনারায়ণ ৮ কি.মি.+ শোণপ্রয়াগ-ত্রিযুগী নারায়ণ ৫ কি.মি.+ ত্রিযুগী নারায়ণ-শোণপ্রয়াগ ৫ কি.মি.+ গৌরীকুণ্ড-কেদারনাথ ১৪ কি.মি.+ কেদারনাথ-গৌরীকুণ্ড ১৪ কি.মি.+ ভুখি-ডাবরানী ১৩ কি.মি.+ লঙ্কা-ভৈরবঘাঁটি ৩ কি.মি.+ গঙ্গোত্রী-গোমুখ ১৮ কি.মি.+ গোমুখ-লঙ্কা ২৮ কি.মি.+ ডাবরানী-ভুখি ১৩ কি.মি.+ সায়নাচট্টি-যমুনোত্রী ২১ কি.মি.+ যমুনোত্রী-সায়নাচট্টি ২১ কি.মি. = মোট ২২৪.৫ কি.মি.)।
= সমাপ্ত =
আগের পর্ব – যমুনোত্রীর পথে – গোমুখ থেকে উত্তরকাশী
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। ভ্রমণ কাহিনি ছাড়া গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লিখতে ভালো লাগলেও এই প্রথম কোনও পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠানো। 'আমাদের ছুটি' পত্রিকার নিয়মিত লেখক, পাঠক, সমালোচক এখন নেমে পড়েছেন কীবোর্ডে-মাউসে সহযোগিতাতেও।