ভালো থেকো কেদার
সুমন্ত মিশ্র
~ ~ কেদারের তথ্য ~ কেদারের আরও ছবি ~
ছোটবেলায় যেদিন বিকেলে মাঠে যাওয়া হত না, বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সূয্যি ডোবা দেখতাম! আর চোখে পড়ত একটা অবাক করা দৃশ্য - পাশের তেজপাতা গাছটা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়াই কিচিরমিচির শব্দে নিচের পড়ে থাকা বালিতে ঝাঁপ দিচ্ছে, আবার গা ঝেড়ে ফড়ফড় শব্দে উড়ে লুকিয়ে পড়ছে ঘন তেজপাতার আড়ালে! কী ভালোলাগা যে জুড়ে থাকত ওদের ওই ওঠা-নামায় - আজও ভাবলে সেই আমেজটা পাই মনে মনে! মা বলেছিল, "অমন করে ওরা বালিতে চান করে" - সে তো ঠিকই, স্নান করলে যে সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলা যায় সেটাতো চিরকালই অনুভব করি! কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে নিছক শরীরেরই নয়, মাঝে মাঝে মনের ক্লান্তি দূর করাটাও খুব জরুরি হয়ে পড়ে। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সারাবছরের মনের ওই ক্লান্তি দূর করতে বছরের কোনও না কোনও সময় পাড়ি দেন হিমালয়ের কোলে, আবার ফিরে আসেন পরের বছর যাওয়ার অপেক্ষার আনন্দ নিয়ে! নিজের অজান্তে কখন যেন আমিও সে দলে ভিড়েছি! তাই বছর বছর ছুটে যাওয়া বাঁকের পর বাঁক নেওয়া পাহাড়ি পথের নির্জন মৌনী আনন্দে! সমতলের কোলাহলকে আপন পথের পাকে ফেলে জব্দ করার এমন জব্বর কৌশল হিমালয়ের সুউচ্চ বরফ শীতল মস্তিস্ক ছাড়া আর কোথা থেকেই বা বেরোতে পারে!
২০১৩-য়, যেবার বর্ষার প্রথম ধারায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল উত্তরাখণ্ডের হাজার হাজার জীবন - অ্যাক্সিডেন্টে পা-কাঁধ ভেঙে বিছানায় ছটফট করছিলাম অসহায়ের মতো! টিভির পর্দায় একের পর এক চেনা জায়গাগুলোর নিশ্চিহ্ন হওয়ার ছবি দেখেছি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। পাহাড়ে ঘোরার শীতল দিনগুলোয় যাদের উষ্ণতা বছরের পর বছর পথ চলিয়েছে নির্বিঘ্নে, তাদের এতবড় বিপর্যয়ের দিনে পাশে থাকতে না পারার আফশোস আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে চিরদিন! রূদ্রপ্রয়াগ, গৌরীকুণ্ড, যোশীমঠ, গোবিন্দঘাট – একটার পর একটা পরিচিত স্থানের শিউরে ওঠা দৃশ্য দেখেছি আর মনেমনে অঝোরে কেঁদেছি! তবু বোধহয় সবচেয়ে মনখারাপ হয়েছিল আমার প্রিয় কেদারের জন্যই! তাই ২০১৪-য় অমরনাথের পথে সক্ষমতার পরীক্ষায় পাশ করে ফিরে এসেই ফের কেদার যাওয়া স্থির করলাম।
লক্ষ্মীপূজোর পরেরদিন ট্রেন ধরলাম আসানসোল থেকে -'উপাসনা এক্সপ্রেস'। এবার একা, আগেরবার গিয়েছিলাম সদলবলে। জানলার বাইরে বিশ্বপ্রকৃতির অপার শারদ সৌন্দর্যছবি - উপভোগ করব কী, মনে ভিড় করছিল ষোল বছর আগের সেই ভ্রমণের দৃশ্যপট! 'ভুখহরতাল' বাসে চেপে বদ্রী থেকে গৌরীকুণ্ড পৌঁছনো, পথে ছবির মতো 'চোপতা' দর্শন, 'কালীকমলি' ধর্মশালায় থাকা, কেদার পৌঁছে আত্মহারা অবস্থায় হাওয়াই চটি পায়ে চারদিক ঘুরে বেড়ানো, শিবের পিতা দর্শন, চোরাবারিতালের মুগ্ধতা! – সব যেন শরতের সাদা মেঘের মতোই আমার মনের আকাশে উড়ে উড়ে আসছিল সেই মুহূর্তে! মধুপুর পেরিয়ে জসিডি আসতেই কামরায় নিত্যযাত্রীদের ভিড় বাড়ে, সংরক্ষিত আসন ভাগ করে নিই আরও অনেকের সঙ্গে। পাশে বসে থাকা গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী কিছুটা বিরক্তি নিয়েই মন দেন 'সল্টেড' বাদামে। নিত্যযাত্রীর দল বাঙালিদের বাপ-বাপান্ত করতে করতে উচ্চগ্রামে আলোচনা জোড়েন। আমি আবার কখন হারিয়ে যাই কেদারপথের নুড়িপাথর, গাছ-গাছালিতে!
'ঝাঁঝাঁ' আসতেই কামরায় ঠাসা ভিড়, কানে 'মুমফালি', 'সমোসা', 'চানা', 'চাআয়' শব্দের হুড়োহুড়ি। ওরই মাঝে নিম্ন আয়ের এক দম্পতি দুই শিশুকে নিয়ে উঠেই কিছুটা দিশাহারা হয়ে জিজ্ঞেস করেন, "ইয়ে রিজার্ভেশন কামরা হ্যায় ক্যায়া বাবু?" 'হ্যাঁ' বলতেই পড়িমরি করে ঘুরে নেমে পড়েন। আমার পাশের সন্ন্যাসী ভদ্রলোক চরম তাচ্ছিল্যে বলে ওঠেন, "এসব অশিক্ষিত লোকেদের জন্যই দেশটার এই দশা", কেমন খটকা লাগল কথাটায়! ট্রেন ছাড়তে আলাপ জমালাম গেরুয়াধারীর সঙ্গে। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী, আছেন দেরাদুনের মিশনে। অনেক বছর দুর্গাপুজো দেখা হয়নি বলে এবার পুজো কাটিয়ে গেলেন আসানসোলে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করি - "মহারাজ, শিক্ষা-অশিক্ষার পার্থক্য করেন কীভাবে?" একটু থতমত ভাব দেখে নিজেই সহজ করি, স্মরণ করাই, তাঁর কিছুক্ষণ আগে বলা কথাক'টি! এবার মহারাজ বেশ স্বাভাবিক হয়েই বলেন - "আর দশজন যেভাবে করে সেভাবেই!" তাইতো! কিন্তু যাঁকে দেখে এই সংসারত্যাগী সন্নাসী মানুষটিরও মনে অশিক্ষার যন্ত্রণা উদয় হয়েছিল তিনি কি আদৌ অশিক্ষিতের মতো কোনোও আচরণ করেছিলেন? প্রশ্ন জাগে আমার! তেমন তো মনে হয়না, বরং কিছু সুবেশ সহযাত্রী, যাঁরা সাধারণ টিকিটে এই সংরক্ষিত কামরায় উঠে বৈধ যাত্রীদের অসুবিধার সৃষ্টি করেছেন তাঁদের চেয়ে তিনি সুশিক্ষারই পরিচয় রেখেছেন। প্রৌঢ়ত্বের দ্বারে এসে একটা কথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করি জীবনে প্রকৃত শিক্ষার কোনোটার জন্যই স্কুল, কলেজ অথবা ইউনিভার্সিটির দরকার পড়েনা, বাড়ি কিংবা পরিবেশই তার জন্য যথেষ্ট!
এসব হাবিজাবি ভাবতে-ভাবতেই 'পাটনা'। উহ্, সে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা! মিনিটের মধ্যে পিলপিল করে ওঠা ছেলের দল 'দখল' নিল কামরার! কিছু বুঝে ওঠার আগেই সর্বত্র জাঁকিয়ে বসল তারা, আমরা আক্ষরিক অর্থেই হতবাক! ট্রেন ছাড়তে প্রশ্ন করে জানলাম, সকলেই একটি চাকরির পরীক্ষা দিতে দেরাদুন যাচ্ছে। বুঝলাম ভোগান্তি পুরো রাস্তাটাই! কিন্তু বিশ্বাস করুন রাগ হলনা, বরং কিছুটা মায়াই হল ওই কচি মুখগুলো দেখে! আমার দেশের জীবন সংগ্রামের এও এক করুণ চালচিত্র!
হরিদ্বার স্টেশনে পৌঁছলাম নির্ধারিত সময়েই। কাঁধে বোঁচকা ফেলে সোজা হাঁটা দিলাম 'মিশ্র ভবন' -সেদিনের মতো আমার রাতের আশ্রয়স্থল। পুরনো লোকেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে ঢুকলাম নিজের বরাদ্দ ঘরে। তারপর জমিয়ে গঙ্গাস্নান, শীতল জলধারায় ধুয়ে গেল দু'দিনের সকল শ্রান্তি! ঝরঝরে হয়েই সেরে নিলাম কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা,'দাদাবৌদির হোটেল'-এ রাতের খাওয়া সেরে আটটার মধ্যেই বিছানার নরমে ডুব্!
পরদিন সকাল সকাল নাওয়া-খাওয়া মিটিয়ে বাসে সওয়ারি হয়ে রওনা দিলাম হৃষীকেশ - ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। ক'টায় বাস পাব, কী রকম সিট পাব – এসব ভাবতে ভাবতেই হৃষীকেশ। সাড়ে আটটায় স্ট্যান্ডে নেমে স্যাক্ কাঁধে নিতেই কানে আসে "গুপ্তকাশী গুপ্তকাশী" আওয়াজ! গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দিকে নজর পড়তেই হাত উঁচিয়ে ছুট দিই! সামনে জানলার ধারের সিটে বসে কেন জানিনা সবকিছুতে কেদারনাথেরই অদৃশ্য সহায়তা অনুভব করি! চোখবন্ধ করে স্মরণ করি তাঁকে! বাসের ভেতরেও সমস্বরে ধ্বনি ওঠে, -"জয় বাবা কেদারনাথ"! বাস চলতে শুরু করে, একটু পরেই দৃশ্যমান হয় গঙ্গার পান্নাসবুজ জলধারা -আহা, কতবার দেখেছি এই মনোরম সবুজ স্রোত! তবু আজও যেন সেই প্রথম দেখার মতোই আনন্দে উদ্বেল হয় মন, র্যাফটিং-এর ভেলার মতোই মনে মনে ভেসে যাই ওর টুকরো টুকরো ঢেউয়ে।
দেবপ্রয়াগ পৌঁছতেই তান্ডবের কিছু নিদর্শন চোখে পড়ল – নিচেরদিকে থাকা বেশ কিছু বাড়িঘরের শুধুমাত্র ভগ্নাবশেষটুকু পড়ে আছে, আছে দু'নদীর মিলনস্থলে (অ)সভ্যতার আর্তনাদ, আছে মানবদম্ভের হাঁটুমোড়া আত্মসমর্পণ! আগে কেদার-বদ্রী যাত্রীদের বাস দেবপ্রয়াগেই মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য দাঁড়াত, সে ছিল এক বাড়তি পাওনা -সুগন্ধি সরু চালের গরম ভাত আর চাপচাপ অড়হর ডাল, সঙ্গে পাহাড়ি সব্জি, মুখে লেগে আছে আজও! এখন অবশ্য সে পর্ব আরও কিছুটা আগেই সারা হয়, পরিবর্তিত স্থানে তন্দুরি রুটি আর পরোটারই রমরমা! দেবপ্রয়াগেই ভাগীরথী পেরিয়ে কেদার-বদ্রীর রাস্তা ডানদিকে বাঁক নেয় অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলিত জলধারাকে ডানহাতে রেখে। প্রায় সাড়ে বারোটায় পৌঁছই শ্রীনগর, গাঢ়োয়ালের সবচেয়ে বড় জনপদ। কোনও একবার বৃষ্টিশেষে রামধনু ছোঁয়ার সাধ মিটিয়েছিলাম এই শহরেরই গায়ে, সেইথেকে এই শহর আমার কাছে 'স্পেশাল', সাত রঙয়ে বর্ণময়! স্ট্যান্ডে বাস দাঁড়াবে কিছুক্ষণ, নেমে দাঁড়াই। রবিবার, আজ ব্যস্ততা কিছু কম, যাত্রীর সংখ্যাও। তিন-চারজন নতুন যাত্রী উঠতেই বাস আবার ছাড়ল। একটু এগোতেই চোখে পড়ল প্রকৃতির রোষে অগাধ জলে হাবুডুবু খাওয়া শ্রীনগর হাইড্রাল প্রোজেক্টের নবনির্মিত ভবনগুলি, আরও একটু দূরে দেখি সখাত সলিলে মুখ লুকানো এক আস্ত সেতু! মনে পড়ল দুর্ঘটনার একমাস পর উত্তরাখণ্ড সরকার এই 'প্রজেক্ট' টি বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কোথায় কী – এ তো দিব্যি আবার কাজ শুরু হয়েছে! ভালো, অতীতের ভুল থেকে 'শিক্ষা'-ই যদি নেব তবে আর ভারতবাসী কেন!
আড়াইটে নাগাদ পৌঁছলাম রুদ্রপ্রয়াগ, বাস দাঁড়াল। এখানে 'চা'য় পি লো' বলে ড্রাইভার সাহেব অজ্ঞাতবাসে গেলেন। নামলাম আমিও, বাসে বসেই মনস্থির করে ফেলেছি - আজ গুপ্তকাশীতেই রাত্রিবাস। সেইমতো স্থানীয়দের কাছে কিছু খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, বাসস্ট্যান্ড থেকে ওপরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই জি এম ভি এন গেস্ট হাউস। সেখানে থাকার বাড়তি সুবিধা এই যে, নতুন নিয়মে কেদারযাত্রীদের 'বায়োমেট্রি' টেস্টের ব্যবস্থাও ওখানেই আছে। পরদিন শোনপ্রয়াগে গিয়ে সময় নষ্ট না করেই এগিয়ে যাওয়া যাবে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বাস ছাড়ল প্রায় সাড়ে তিনটেয়। অগস্ত্যমুনি নালা পেরিয়ে গুপ্তকাশী যখন পৌঁছলাম তখন সাড়ে পাঁচটা। নেমেই স্যাক পিঠে নিয়ে জোরে হাঁটা দিলাম - শুনেছি বায়োমেট্রির 'কাউন্টার' ছ'টা পর্যন্ত খোলা থাকে! মিনিট সাতেক লাগল লজে পৌঁছতে। দেখি, ডাক্তারবাবু বাড়ি যাওয়ার গোছগাছ শুরু করেছেন। মুখে একটা ক্যাবলা হাসি ঝুলিয়ে নিজের পরিচয় দিই। ভদ্রলোক আমার চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা ছোটই হবেন, হাসি মুখেই আমার শারীরিক পরীক্ষা সারেন। বলেন, "পালস্ রেট থোড়া হাই হ্যায়, আপকা সুগার নরম্যাল হ্যায় তো?" বুঝিয়ে বলি, তাড়াহুড়ো করে ওপরে উঠে এসেছি বলেই এই বিপত্তি, সুগার-টুগার কিছু এখনও হয়নি বলেই জানি! সমস্যা মিটল, টেস্টের সফল কাগজপত্র হাতে নিয়ে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করি। সূর্য ডুবছে, সোনারঙে সেজে উঠছে হিমালয়ের সারিবদ্ধ শ্বেতশুভ্র শিখরমালা, এখন কি ঘরে থাকা যায়! – ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে আসি বাইরে। চুপটি করে বসে থাকি এক কোণে, আপনিই মনে আসে, "তোমার দুয়ার হতে কেহ না ফিরে / যে আসে অমৃত পিয়াসে।"
ঘুম ভাঙল যখন, বাইরে গাঢ় অন্ধকার, মোবাইলে দেখ্লাম, ভোর পাঁচটা। কম্বলের উষ্ণ সোহাগ সরিয়ে উঠে পড়লাম। উইন্ডচিটার গায়ে দিয়ে, গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে সোজা বাইরে। দূরে উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে উখিমঠের ঝকমকে উপস্থিতি! এ পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে তখনও ফিকে হওয়া রাত্রির ছোপ, রাতঘুমে নিশ্চল গাড়ির কাঁচে গড়িয়ে পড়া শিশিরের আলপনা। চারদিক নিস্তব্ধ, নিজের পায়ের শব্দটুকুই শুধু কানে আসে! ধীরে ধীরে আলো ফোটে, উত্তরের দিগন্ত জুড়ে প্রকাশিত হয় বরফঢাকা শিখরের সারি, বয়ে যাওয়া সময়ের তালে তারা রঙ পাল্টায়, সেই খেলা একমনে দেখি! কতক্ষণ? হিসেব থাকেনা, শুধু মনেমনে গুনগুন করি - "এসো হে আনন্দময়, এসো চিরসুন্দর।।"
গুপ্তকাশী ছাড়লাম সকাল সাড়ে আটটায়, শেয়ার জিপে সওয়ারি, গন্তব্য শোনপ্রয়াগ। আসার আগে গুপ্তকাশীর জি এম ভি এন লজের ম্যানেজার রাওয়াত বাবু সহৃদয় হয়ে গৌরীকুণ্ডের পান্ডেজিকে একটা চিঠি লিখে দিলেন, বার বার অভয় দিলেন কেদার পথের! পথে নেমে এঁদের শুভেচ্ছাই যে সবচেয়ে বড় পাথেয়! পথে পড়ল 'ফাটা', এখান থেকেই শুরু হয়েছে নতুন উৎপাত -হেলিকপ্টার পরিষেবা! জানিনা এখানেও এর কি প্রয়োজন ছিল! তৈরি হচ্ছে বড় বড় হোটেল, লজ - 'বিশিষ্ট' যাত্রীদের থাকার সুবন্দোবস্ত! জিপ চলছে, প্রাণভরে দু'ধারের প্রকৃতিকে দেখছি, তবে শিউরে উঠছি মন্দাকিনীর প্রতিটা বাঁকে বাঁকে, অনুমান করার চেষ্টা করছি কী বিপুল প্রত্যাঘাত এসেছিল সেদিনের সেই রাতে! একসময় পৌঁছে যাই শোনপ্রয়াগ। প্রথম পর্যবেক্ষণে মনে হয় পরিত্যক্ত কোনও জনপদ, যেন বিপুল ধ্বংসের মাঝে গুটিকয়েক প্রাণের স্পন্দন! জিপ দাঁড়াল কেদারযাত্রীদের স্বাগত জানানো এক তোরণের সামনে। মালপত্র নিয়ে এগোতেই শুরু হল সিকিউরিটি চেকিং, পাশেই থানায় গিয়ে দেখাতে হল পরিচয়পত্র ও বায়োমেট্রি টেস্টের ছাড়পত্র, সাকুল্যে লাগলো মিনিট দশ। ব্যস্, এখান থেকেই শুরু হোলো পথিকের পথ চলা - কেদারের আপন অন্দরে!
পথ কোথায়? সামনের বিস্তীর্ণ অংশ যেন শতসহস্র পাথরের প্রদর্শনী - যেন আস্ত একটা পাহাড় ভেঙে পড়ে আছে শোনপ্রয়াগের পদতলে। মনে হয় যেন মন্দাকিনীর জলধারায় ভেসে আসা সহস্র মানুষের কান্না চাপা পড়ে আছে সেই ভেঙে পড়া পাহাড়ের বড় বড় পাথরের নিচে! ওরই মাঝে নতুন রাস্তা গড়ে উঠেছে, - গৌরীকুণ্ডের পথ, দূরত্ব ৬ কিমি। আগে এপথেও যান চলাচল ছিল, বাসে চেপে সোজা নামা যেত গৌরীকুণ্ডে। যাত্রী নেই, যতদুর দৃষ্টি যায় কেউ কোত্থাও নেই, আমি একলা পথিক! দেবতার গর্ভগৃহের পথে সচরাচর এমন তো হয় না, এ দৃশ্য তাই একেবারে নতুন! তবে আমি তো দেবদর্শনে আসিনি, সবুজে ছাওয়া ভেজা নুড়ির রাস্তা আর একান্ত প্রকৃতি আমায় যেন ঘোর লাগিয়ে দিল! মন্দাকিনীর সুর, ঝরে পড়া পাতার কথা, পাখির গান - পথের শ্রম দিল ভুলিয়ে! মনে এল প্রিয় কালকূটের লেখা একটা লাইন, - "সমতলের ছেলে, হিমালয় আমাদের কাছে চিরবিস্ময়ের।" বিস্ময়ই বটে, এত বছরেও এ বিস্ময় আর কাটল না! বিস্মিত হয়েই এগিয়ে চলেছি, দূরে যেন কারও নেমে আসার আভাস! হ্যাঁ, তাইতো, কোনও গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী যেন ভোরালের চাঞ্চল্য নিয়ে নেমে আসছেন! কয়েক মিনিটেই মুখোমুখি, সোজা এসে আমার হাত দু'টি নিলেন নিজের দু'হাতে, - "কেদার যাচ্ছেন?" পরিষ্কার বাংলায় এমন প্রশ্ন শুনে আরও বিস্মিত হই! উত্তর দিই - হ্যাঁ। "চলে যান, কোনও অসুবিধা হবে না, সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে যাবেন।" হেসে বললাম, আজ গৌরীকুণ্ডেই থাকব। "সেকি, গৌরীকুণ্ড তো আর পাঁচ মিনিট, এখনও এগারোটাই বাজেনি, যান যান আজই ঠাকুর দর্শন করে নিন!" - বেশ আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল ওঁর কথায়। বললাম, ঠাকুর দর্শন করতে তো আসিনি, এসেছি ওঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা কেমন আছেন তাই দেখতে! সে কথায় গুরুত্ব না দিয়েই বললেন, -"হ্যাঁ হ্যাঁ অমন সবাই বলে!" ভারী ভালো লাগল মানুষটির সঙ্গে আলাপ হয়ে, নাম জয়দেব মহারাজ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসী, আছেন শোনপ্রয়াগ আশ্রমে। যাওয়ার আগে বারবার অনুরোধ জানালেন ফেরার পথে যেন দেখা করি, যদিও সে অনুরোধ শেষপর্যন্ত রাখা হয়নি।
যার সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটাই যে গৌরীকুণ্ড বিশ্বাস হয়না! খুব চেনা, আবার খুউউউব অচেনা! অনেকটা 'সোনার কেল্লা' দেখা মুকুলের অবস্থা আমার! যা-ই দেখতে যাই, ভাবি, হ্যাঁ এখানেই তো ছিল এটা, দেখি না, এখন আর নেই! ভেঙে যাওয়া দরজা-জানলা দিয়ে যেন এখনও কান্নার রোল ভেসে আসছে! কী নির্মম আক্রোশে প্রকৃতি সে রাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই অসহায় জনবসতিতে ভাবলে এখনও বুক ছ্যাঁত করে ওঠে! ভেঙে পড়া বাড়ি আগেও দেখেছি, কিন্তু ছিঁড়ে যাওয়া বাড়ি দেখলাম এই প্রথমবার! প্রায় আধঘন্টা ঘুরে ঘুরে শুধু ষোলো বছর আগে ফেলে যাওয়া জায়গাটাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, নাহ্, সব ধুলিসাৎ! একরাশ হতাশা আর কষ্ট নিয়ে গেলাম পান্ডেজির কাছে, নতুনভাবে গড়ে তোলা লজে রুম নিলাম। স্নান করে পাশের ভান্ডারায় খাওয়া সেরে লজে ফিরতেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল! পাহাড়ে হাঁটাপথে মেঘ দেখলেই দুশ্চিন্তা, এখানে যেন একটু বেশিই হল! সারাদিন কেদারের পথের দিকে চেয়ে বসে রইলাম, সন্ধের মুখে দু'তিনজন ওপর থেকে নেমে এলেন। বৃষ্টি কমেছে, কিন্তু বেড়েছে ঠান্ডা, ভান্ডারায় খেতে গেলাম রাত্রি সাতটাতেই। হ্যাজাকের আলোয় খাওয়া বেগুনের তরকারি আর লুচির স্বাদ মনে থাকবে চিরকাল! সকাল সকাল বেরোব ভেবে শুয়ে পড়লাম আটটাতেই!
পরদিন সকাল, বৃষ্টি নেই তবে আকাশে টুকরো টুকরো কালো মেঘের আনাগোনা। সাড়ে সাতটায় ভান্ডারায় চা খেয়ে 'জয় কেদার' বলে হাঁটা দিলাম। বাঁধানো রাস্তা, তাও রেলিং দিয়ে ঘেরা, রাস্তায় নিয়ন আলো, সবকিছুই আগের মতো! শুধু আগেরবার এই রাস্তাই ছিল জনাকীর্ণ আর এবার প্রকৃতই জনশূন্য! প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর নীচ থেকে টুংটাং শব্দ কানে আসে, রেলিং ধরে নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে খচ্চরের পিঠে সওয়ারি এক যাত্রীদল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করি বেচারিরা শ্যামবাজার পাঁচমাথার নেতাজির মতো কাঠ হয়ে বসে আছেন! ওঁরা চলে যেতেই আবার সব শুনশান, ছবি নিতে নিতে এগিয়ে চলি। প্রায় দুঘন্টা হেঁটে পৌঁছই 'ভীমবালি'। ভীমবালি আদতে রাস্তা সারাইয়ের কুলি-মজুরদের অস্থায়ী আস্তানা, গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগম সেখানেই যাত্রীদের থাকার ক্যাম্প ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন। একটু আগেই টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাই ভীমবালি পৌঁছেই আশ্রয় খোঁজ করে সোজা ক্যান্টিনে ঢুকি। সেখানে তখন এক বিদেশি পর্যটক দলের জমজমাট উপস্থিতি। বেশ ঠান্ডা, সামনে ধোঁয়া ওঠা গ্লাসে গরম চা দেখে নিজেরও ওই উষ্ণতার স্বাদ পেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু ক্যান্টিনের ছেলেটি পরিষ্কার জানিয়ে দিল, বিদেশি অতিথিদের 'সেবা' সম্পূর্ণ না করে সে আমাকে চা দিতেও অপারগ! ত্বকের রঙের রকমফেরে যে "বসুধৈব কুটুম্বকম্"-এরও রকমফের ঘটে! বসে রইলাম প্রায় মিনিট কুড়ি, খিদেও পেয়েছে অল্পবিস্তর, আবার অনুনয় করি চায়ের। এবারও সেই একই উত্তর। নাহ্, আর মাথা ঠান্ডা রাখা গেলনা! – বললাম, জয়(ততক্ষণে নাম জেনেছি), উও সির্ফ আপকা গেস্ট নেহি হামলোগোকা ভি গেস্ট হ্যায়, লেকিন ম্যায়ভি তো আপকা গেস্ট হুঁ, অউর এক বাত বাতাইয়ে– আপ ক্যায়া ভুখা পেট উনলোগোকো খিলা রহে হো? আগর পাঁচ মিনিটকা অন্দর মুঝে চা অউর নাস্তা না মিলা তো ম্যায় কিসিকো খানে নেহি দুঙ্গা! এবারে আর পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি, তার আগেই চলে এল চা আর ছোলাসেদ্ধ! ততক্ষণে বৃষ্টিও কমে এসেছে, জয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার পথে পা রাখা।
মিনিট দশ হেঁটেই মন্দাকিনীর সেতু, এখান থেকে শুরু কেদারের নতুন পথের। আগে বাঁদিকের এ পথই সোজা উঠে যেত রামওয়াড়া হয়ে। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকালাম রামওয়াড়ার দিকে - নিশ্চিহ্ন, পুরোনো কেদারপথের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ত জনপদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন! একবুক কান্না এসে চোখ ভিজিয়ে দিল। কত প্রাণ যে সেদিনের বলি তার হিসেব কেউ জানবেনা কোনোদিনও! চোখ মুছে হাঁটা দিলাম নতুন পথে। এপথে মন্দাকিনীকে বাঁদিকে রেখে চলা, প্রশস্ত পথ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেবার জায়গা - সবমিলিয়ে কেদারপথের পথিকের জন্য অত্যন্ত সুব্যবস্থা। শুধু আগের পথের থেকে চড়াই কিঞ্চিৎ বেশি, জায়গায় জায়গায় তারই বিজ্ঞাপন - "উচ্চ মার্গ, ধীরে চলেঁ"। তবে এ রাস্তায় জলদি চলে কার সাধ্যি! প্রায় দেড়ঘন্টা চলে পৌঁছলাম 'লিনচুলি'। ঠিক ঢোকার মুখেই নামল তুমুল বৃষ্টি, কোনোরকমে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলাম একটা খচ্চরের আস্তানায়। মিনিট চল্লিশেও বৃষ্টি না থামলে একদৌড়ে জি এম ভি এন ক্য্যান্টিন। সেখানে জনা পাঁচ-ছয় সাধু আর কিছু নেপালি দিনমজুর ছাড়া কাউকে চোখে পড়লনা! চড়াই ভেঙে উঠে আসার ক্লান্তি আর তারপর জামা-গেঞ্জি সব ভিজে সপসপ করছে, সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা, হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। স্যাক্ খুলে তাড়াতাড়ি পাল্টে নিই জামাকাপড়, গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ধাতস্থ হই! নজর যায় সাধুদের দিকে, সকলেরই উদ্বিগ্ন মুখ! কাছে গিয়ে আলাপ করি। তিনজন বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী, বাকি দুজন অন্ধ্রের ও অন্যজন বিহারের সমস্তিপুরের বাসিন্দা। বেলুড়ের ওঁরা বাঙালি, বয়স কম (৩০-৩২এর মধ্যে), সদ্য গেরুয়া পেয়েছেন, কেদার দেখে আজ নিচে নামছেন। এই প্রথম হিমালয় দর্শন, তাও আবার দুর্যোগ সঙ্গী, স্বভাবতই একটু উদ্বেগেই আছেন। বাকিরা সবাই আমার মতোই আজ কেদার দর্শনে চলেছেন। টিনের চালে বৃষ্টির ঝুমঝুমি সঙ্গতে সাধুসঙ্গ জমে উঠল! বেলা প্রায় দুটো নাগাদ সিদ্ধান্তে এলাম - আজ লিনচুলিতেই থাকছি।
ক্যান্টিনের দরজায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মতি-গতি বোঝার চেষ্টা করছি - বেলুড়ের ওঁরা কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, -"কি করি বলুনতো?" অভয় দিয়ে বললাম, আপনাদের সঙ্গে যখন 'রেনকোট' আছে ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ুন, নিচের দিকে বৃষ্টি আর জোরে নামবে বলে মনে হয়না, যদি নামেও ভীমবালিতে থেকে যাবেন! ওঁরা একটু ইতস্তত করেও শেষমেষ পা বাড়ালেন। আমি 'চাউল অউর কালি ডাল' দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নির্ধারিত টেন্টে ঢুকলাম। বেশ ভালো ব্যবস্থা। অন্তত পনেরোজন থাকার মতো জায়গা, নিচে ম্যাট্রেস পাতা, আর এক কোণে রয়েছে অন্তত কুড়িটা স্লিপিং ব্যাগ। সত্যি কথা বলতে এত ভালো স্লিপিং ব্যাগ এর আগে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কেদার পথের বাকি তিনজন সাধুও রয়েছেন পাশের তাঁবুতে - বৃষ্টির অবসরে ওঁদের কথার আওয়াজ কানে আসে। আমি ভিজে জামা-জুতো, স্যাক এসবের হিল্লে করে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকি। চরম ঠান্ডায় হাত-পা জমে অসাড় - ঘষে ঘষে সাড় ফেরাই! বাইরে দুর্যোগ আরও বাড়ে, সোঁ সোঁ হাওয়া। বিকেল চারটেতেই আঁধার তার কেশভার এলিয়ে দিল লিনচুলির বুকে!
কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে হইচইয়ে ধড়মড় করে উঠে বসি! নবাগত যাত্রীদল, সাকুল্যে পাঁচজন। একজন ষাটোর্ধ, বাকিদের বয়স কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে। আমি উঠে বসতেই একজন 'হ্যালো আঙ্কেল' বলে পরিচয় সারেন। ওঁরা নিজেদের গুছিয়ে নিলে, আলাপ করি! এঁরা আসছেন বাঙ্গালোর থেকে। চার বন্ধু ও তাঁদের একজনের বাবা এসেছেন কেদার দর্শনে। বেলা বারটায় গৌরীকুণ্ড থেকে হেঁটে পৌঁছেচেন এখানে! একে চড়াই তার ওপর এই দুর্যোগ পেরিয়ে এসে বেশ পরিশ্রান্ত। শুরুতেই একটা কথা জিজ্ঞাসা করে নিই, আপলোগ রাস্তে মে তিন সাধুসে মিলেথে? সদর্থক উত্তর পেতেই বলি, কাঁহা? জানালেন, - "ভীমবালি কে আগে।" ওহ্, বুকের ওপর থেকে একটা বোঝা নামল। সকালে সেই সন্ন্যাসীদের রওনা হওয়ার পরে থেকেই দুশ্চিন্তা ছিল, যাক্ এখন স্বস্তি। দুপুরেই শুনে এসেছি রাত সাড়ে আটটায় ক্যান্টিন বন্ধ! আটটা বাজে দেখে এবার ওঁদের সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাজিরা দিই ক্যান্টিনে! রুটি আর 'পিলা ডাল' দিয়ে রাতের খাওয়া চুকিয়েই আবার তাঁবুতে ফেরা। সেখানে তখন আমাদের জন্য অপেক্ষারত এক নতুন বন্ধু! নতুনই বা বলি কেন, ভীমবালি থেকে লিনচুলি সারাটা পথে তো ওই আমার সঙ্গী ছিল! 'ধলু', ভল্লুক সদৃশ একটি সাদা সারমেয়। সকলে ওকে দেখে বিরক্ত হলেও টেন্টে সিনিয়র হওয়ার 'ভেটো' প্রয়োগ করে ওকে রাত্রির সঙ্গী করলাম! বাইরে প্রকৃতির সশব্দ আক্রোশ, ভেতরে উদ্বিগ্ন সাতটি প্রাণ! দুর্গাপুর থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখনই 'হুদহুদ্' নামের এক সাইক্লোন আসার খবর দেখে এসেছিলাম। ভাবিইনি দুহাজার কিমি উত্তর-পশ্চিমে পৌঁছেও এভাবে তার মুখোমুখি হতে হবে! 'চিন্তা' যখন 'দুশ্চিন্তা' হয় তখন চিন্তামুক্ত থাকাটাই বরাবরের অভ্যাস, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলনা - নিজেকে স্লিপিংব্যাগে পুরে ঘুমিয়ে পড়লাম! "আরে রাম" –ঘুম ভাঙল এই শব্দে! উঠে দেখি পাঁচজনই খাড়া হয়ে বসে আছেন, চোখে ঘুমের বদলে উপচানো ভয়! আমাকে উঠতে দেখেই একজন বলে ওঠে, "ক্যায়া হোগা আঙ্কেল? লাগ রাহা হ্যায় ইয়ে টেন্ট উখাড়কে ফেক্ দেগা!" সত্যিই বাইরে তীব্র হাওয়ার বেগ যেন তাঁবুর শক্তি পরীক্ষা নিতে নেমেছে! কিন্তু ভালো করে কান পেতে মনে হল বৃষ্টি বুঝি থেমেছে! তাঁবুর জানলার চিটপটিটুকু খুলে মাথা বার করে আকাশের দিকে তাকাতেই মনে বল পেলাম - ওইতো এককোণে একটা তারা দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টিও থেমেছে। এবার হেসে ওঁদের বললাম - শো যাইয়ে, বাদল ফাট্ চুকা, লাগ রাহা হ্যায় সুবহা তক্ মৌসম সাফ হো যায়েগা! প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পাহাড়ে আসার অভিজ্ঞতা আমাকে এটুকু আভাস দিল!
অ্যালার্ম ছিল চারটেয়, উঠে পড়লাম। আধঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়ে ঠিক পাঁচটায় লিনচুলির ঘন অন্ধকারে বরফমোড়া পথে পা বাড়ালাম মচ্ মচ্ শব্দে। এক আকাশ তারা চোখ মিটমিট করে ঝলমলে হাসল! মিনিট দশ চড়াই উঠেই যেন ম্যাজিক – চারদিক শুধু সাদা-ই সাদা! দুর্যোগশ্রান্ত, অন্ধকারঘন কালো পৃথিবী যেন সাদা চাদর গায়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। সকালে উঠে গায়ত্রীমন্ত্র জপ বহুদিনের অভ্যাস - ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ, আমি বিশ্ব ভুবনের অধিবাসী - এই কথাটা আজ সত্যি হয়ে মনের মধ্যে উচ্চারিত হল। বুকে হাঁফ, পিঠে ঘাম নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি - নিরন্তর ওঠা! ভোরের আলো ফুটছে, দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে, আহ্, এই জন্যই তো এত আশঙ্কা, এত বিঘ্ন জেনেও এপথে পা বাড়ানো! জীবনের সব গ্লানি, সব দৈন্যের মুক্তি যেন এক লহমায়, প্রণত চিত্ত যেন আপনিই করজোড় করে! অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, ফড়ফড় শব্দে সম্বিত ফেরাল একটা মোনাল, শুভ্র প্রকৃতির একটুকরো রঙিন বৈচিত্র্য - ফ্রেমবন্দি করার আগেই গেল হারিয়ে! এখানে রাস্তা একটা 'ইউ টার্ন' নিয়ে কিছুটা খাড়া উঠে গেছে, - উঠেই প্রকাশিত কেদারের প্রশস্ত ভ্যালি। কী নয়নাভিরাম দৃশ্য! বরফমোড়া প্রান্তরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কেদার মন্দিরের চূড়া, পেছনে সারিবদ্ধ শৃঙ্গমালা – সকালের সোনারোদে সেখানে মুকুটের প্রান্তবদল ঘটছে! এ প্রান্তে করুণ আর্তি – "ওই যে আলোক পড়েছে তাঁহার উদার ললাটদেশে, / সেথা হতে তারি একটি রশ্মি পড়ুক মাথায় এসে!" মন্দির থেকে ভেসে আসছে শিবস্তোত্র পাঠ - সত্যিই এ এক অপার্থিব অনুভুতি! রাস্তার ওপরে জমে যাওয়া বরফ বেশ শক্ত, পা পিছলে যাচ্ছে বারবার, আছাড়ও খেলাম বারদুয়েক! নাহ্, আর ঝুঁকি নিলাম না, শরীরের চেয়েও ক্যামেরার মায়া বেশি – রাস্তার পাশে নরম বরফে নেমে হাঁটতে থাকলাম! প্রায় সোওয়া ছ'টা বাজে, রাস্তায় এক-দু'জনের দেখা মিলছে -বেশিরভাগই সেনা আধিকারিক। 'সুপ্রভাত' বিনিময় করতে করতে এগিয়ে চলা। প্রায় সাড়ে ছ'টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ধ্বংসলীলার কেন্দ্রস্থলে – কেদার। হিমরাজ্যের অন্তরাত্মা!
এ কোন কেদার! সেই বড়বড় অট্টালিকা ঘেরা দেবদালান! এই হাল হয়েছিল তবে কেদারের! দেবতার অলিন্দে সার বেঁধে শুয়ে থাকা বাড়িঘর - সে সবই তো কোনও আশ্রম কিংবা সঙ্ঘের সম্পত্তি। লোভ তাহলে পিছু ছাড়েনি ওঁদেরও! 'লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু' – ঠিক কত প্রাণ গেলে হৃদয়ঙ্গম হয় একথা? উত্তরটা হয়ত দিতে পারবেন গেরুয়া বসন ম্যানেজার ওরফে 'মহারাজ'-এর দল-ই! মিথ্যে বলবনা, সারাটা রাস্তা উঠে এসেছি যে কষ্ট বুকে চেপে, এখানে এসে তাতে কিছুটা খুশির প্রলেপই পড়ল!
আজ আবহাওয়া অনুকূল, তাই সকাল সকাল চালু হয়েছে হেলিকপ্টার পরিষেবা! বেশকিছু সচ্ছ্বল যাত্রী নিয়ে কেদার ভূখন্ডে তাঁদের সফল অবতরণ! কোথায় শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতি, নিমেষে সেসব খানখান, চারদিকে উচ্চকিত অর্থের আস্ফালন! দেবদর্শন সারি। ঘুরে ফিরে দেখি কেদার সাম্রাজ্যের ভগ্নরূপ। সময় পেরিয়ে যায়, একসময় ফেরার পথে পা বাড়াই।
এক কথায় কিভাবে প্রকাশ করব এবারের কেদার দেখাকে? 'নতুন পথে কেদার দর্শন?' না না, সেটা হয়ত ঠিক হবেনা! 'ধ্বংসলীলার কেদারভূম?' উঁহু, এটাও ঠিক মনে ধরছে না! বরং বলতে পারি,'দেবতার আত্মরক্ষা!' ভালো থেকো কেদার।
~ কেদারের তথ্য ~ কেদারের আরও ছবি ~
সেলফ্ এমপ্লয়েড - 'হরফ' নামে একটি প্রিপ্রেস ইউনিট চালান সুমন্ত মিশ্র। হিমালয়ের আতিথ্য গ্রহণ ও ফুটবল খেলার দৃষ্টিসুখ তাঁকে অসীম তৃপ্তি দেয়! ভালোবাসেন রবি ঠাকুরের গান শুনতে, প্রবন্ধ পড়তে, ছোটগাছকে বড় করতে, বেড়াতে আর নানারকমের মানুষের সাহচর্য পেতে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় 'আমাদের ছুটি' কিছু সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়ায় আনন্দিত হয়েছেন!