ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - ২য় পর্ব

আগের পর্ব – প্রথম পত্র


ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র - লাদাখ পর্ব

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

~ লাদাখের আরও ছবি ~

দ্বিতীয় পত্র



বন্ধুবর,

লাদাখ বেড়ানোর তৃতীয় দিনের গন্তব্য নুব্রা ভ্যালি – হুন্ডার। কোল্ড ডেজার্ট। আর দু-কুঁজওয়ালা ব্যাকট্রিয়ান উট ও পশমিনা ভেড়ার দেশ। এখানে সিন্ধু নদের উপনদী শায়ক মিশেছে নুব্রা বা সিয়াচেন নদীর সঙ্গে। তারই বিস্তীর্ণ উপত্যকা লাদাখ পাহাড়শ্রেণীকে আলাদা করেছে কারাকোরাম রেঞ্জ থেকে। উপত্যকার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মোটামুটি ১০,০০০ ফিট বা ৩০৪৮ মিটার।
ডায়েরির পাতা ওল্টাই এবার। লেখাগুলো একটু ছেঁড়া, ছেঁড়া - ঠান্ডায় আর গাড়ির ঝাঁকুনিতে পথ চলার মতই থমকে থমকে।

১৪/১০/২০১৫
সকাল ৯-৪০। লেহ

ন্যাড়া পাহাড়ের পাশ দিয়ে গাড়ি এগোচ্ছে। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। প্রথমদিকে বরফমাথা পাহাড়ে সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসাচ্ছিল। এখন ন্যাড়া পাহাড়ের গায়ে শুধু ঘাস-গুল্ম। বড় গাছেরা অনেক নীচে। এর আগে ঘাসগুলোর গায়ে লাল লাল ছোট্ট ছোট্ট ফুল চোখে পড়ছিল। এখন হলুদ ফুলে আলো হয়ে আছে। আকাশে আজ গাভীর মতো চড়ছে মেঘেরা। তাদের রঙ সাদা বা ধূসর। ওরই ফাঁক দিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর এসে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে।

সকাল ১০-৩০। সাউথ পুল্লু
ছোট্ট জনপদ। চেকিং পয়েন্ট। পিচরাস্তা শেষ হয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা ছোট লেক চোখে পড়ল। খানিক বাদে ফের পিচের রাস্তায় উঠে এলাম। এবার বরফ পাহাড়ের দেখা মিলছে আবার। ক্রমশঃ কাছে চলে আসছে। নেড়া পাহাড়ের গায়ে শ্বেত আবরণ। পাহাড়ের গায়ে রোদ্দুর এসে পড়েছে। রাস্তা খুব খারাপ। সত্যি বলতে কী টানাই খারাপ রাস্তা। মাঝে মাঝে সারাইয়ের কাজ চলছে। অধিকাংশই মহিলা শ্রমিক। রাস্তা এতটাই খারাপ যে গাড়ি মোটামুটি লাফাতে লাফাতে চলেছে। সৌম্যর বক্তব্য, 'ঘোড়ার পিঠে উঠেছি মনে হচ্ছে।' পাহাড়ের গায়ে অজস্র আলগা পাথর, যে কোনও সময়ে গড়িয়ে পড়তে পারে। পড়েও আছে রাস্তায়। বুলডোজার দিয়ে বড় বড় পাথর সরানোর কাজও চলছে মাঝে মাঝে। এবারে সামনে মিলিটারি ট্রাকের সারি। ব্যস হয়ে গেল। পিছন পিছনই চলতে হবে অনন্তকাল। কিছুতেই পথ দেয়না এরা। পুরো রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে।
রাস্তার পাশে এবার পুরোটাই বরফের পাহাড়। ফাঁকে ফাঁকে পাথর দেখা যাচ্ছে। উলটোদিকের পাহাড়ের গা ন্যাড়া। আবার কখনও আমরা ন্যাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলেছি, বিপরীতে বরফ পাহাড়।
আরও অনেকটাই উঠে এসেছি। খুব ঘুম পাচ্ছে। এটা কি অক্সিজেনের স্বল্পতার জন্য?

দুপুর ২-৩০। খারদুং লা
শায়ক নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছি। নদীখাত বিস্তীর্ণ। কিন্তু এখন শুধু নীল জলের সরু সরু ধারা হয়ে রয়েছে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে নদীর পাশে কোথাও কোথাও ছড়ানো-ছিটানো গাছপালা, বাড়ি। প্রচণ্ড হাওয়া দিচ্ছে বাইরে।
খারদুং লা-র আগে অবধি রাস্তা এতটাই খারাপ ছিল যে ঝাঁকুনি খেতে খেতে শরীরের সব তালগোল পাকিয়ে গেছে।
বরফে মোড়া খারদুং পাসে নেমে পড়লাম সকলেই। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মোটরেবল রোড বলে এর যে পরিচিতি রয়েছে তা অবশ্য ঠিক নয় – সেই তালিকায় খারদুং লা-র স্থান আসলে এগার নম্বরে। এমনকি লেহ থেকে প্যাংগং সো যাওয়ার পথে চ্যাং লা-ও নাকি এর থেকে উঁচু! যাইহোক চারদিক বরফে সাদা হয়ে আছে। তুমুল ঠান্ডায় শরীরের খোলা অংশ জমে যাচ্ছে। তাও বরফ ভেঙে কিছুটা ওপরে ওঠা আর বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি - ও তো হবেই। ড্রাইভার তুন্ডুপ ভাইয়া তাড়া লাগান। আমরাও গাড়িতে ফিরে আসি। হুন্ডার এখনও ছিয়াশি কিলোমিটার।
খারদুং ছোট্ট জনপদ। পাসের কিছুটা পরেই। ওখানেই কেউ ডালেভাতে কেউ বা নুডলসে খাওয়া সেরে নিলাম।
বরফ পাহাড় পেরিয়ে আবার রঙিন পাহাড়ের এলাকায় এসে পড়েছি। সাদা, কালো, লাল, সবুজ...। কেমিস্ট্রির অধ্যাপক চন্দনদার কাছে এই রঙের ব্যাখ্যা খুঁজেছি মাঝে মধ্যেই। এক জায়গায় ক্যানিয়নের মতো হয়ে রয়েছে।

দুপুর ২-৪৫। খালসার
এও খুব ছোট জনপদ। ২০১০ সালের হড়কা বানের চিহ্ন এখনও বর্তমান। অনেকটা অংশই মিলিটারি অধ্যুষিত। একটু এগিয়ে লাল, সবুজ, হলুদ ঝোপ ঝোপ ধরণের গাছ চোখে পড়ল।
এবারে একেবারে নদীর পাশ দিয়ে যাওয়া। নীল জলে সাদা ঢেউয়ে হলুদ পাহাড়ের ছায়া। নীল-হলুদে মিলে মিশে সবুজ। পাহাড় ছেড়ে উপত্যকায় নেমে এসেছে গাড়ি। দুপাশের ন্যাড়া উপত্যকায় মাঝে মাঝে রঙিন আগাছা চোখে পড়ছে। মাঝখান দিয়ে পথ গিয়েছে এঁকেবেঁকে। নির্জন। দুপাশে বালি।
আবার পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা। পাশে ঝোপঝাড়ের বদলে কিছুটা বড় গাছ। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে এসেছি অনেকটাই। পাশে বিস্তীর্ণ নদী উপত্যকা বেশ খানিকটা নীচে।
বিকেল ৩-৩০। দিসকিট
কোল্ড ডেজার্টের এলাকায় ঢুকে গেছি। ১০,৪৮০ ফুট ওপরে রয়েছি। শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। হঠাৎ কে যেন 'উট উট' বলতে নড়েচড়ে বসে জানলা দিয়ে দেখি সত্যিই দূরে নিচের বালিয়াড়িতে উট চড়ে বেড়াচ্ছে! দিসকিট এসে গেলাম তাহলে?

১৫/১০/২০১৫
হুন্ডার

গতকাল সন্ধেবেলায় আর ডায়েরি লেখা হয়নি। শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল। দিসকিট ছাড়িয়ে শেষ বিকেলে হুন্ডার পৌঁছে দলের বাকিরা উটের পিঠে চাপতে গেল। বুইকেও পাঠিয়ে দিলাম। আমরা দুজনে গাড়িটা নিয়ে হোটেল খুঁজতে বেরোলাম। বেশ কিছুটা ঘোরাঘুরি করে একটা হোটেল পছন্দ হল – ইউরদুম গেস্ট হাউস। সিজন শেষ হয়ে আসায় অনেক হোটেলই বন্ধ হয়ে গেছে। এটা খানিক হোমস্টে ধরণের – মালকিন আর তার মেয়ে এখানেই থাকে। সিজন শেষ, তাই রাঁধুনি নেই, তবে ডিম-ভাত পাওয়া যাবে রাতে আর আগামীকাল সকালে টোস্ট-ওমলেট। দরাদরি করে মাথাপিছু তিনশ টাকায় থাকা-খাওয়ার রফা হল। হোটেলের সামনে অনেকটা বাগান, বড় বড় ঘর-অ্যাটাচড বাথরুম। সবচেয়ে মজার হল জানলা খুললেই আপেলে ভরে থাকা গাছ চোখে পড়ছে। আমাদের আবার 'বিম্‌লা' হোটেলের আপেল খেতে খেতে কেমন আপেল খাওয়ার নেশা হয়ে গেছে। আর বীরেনের গাছ থেকে আপেল পাড়ারও। সকালে গাড়িতেও সবার হাতে, পকেটে আপেল ছিল। খেতে খেতেই আসা হয়েছে পথে। আমরা হোটেল খুঁজতে বেরোনোর সময়ও বীরেন হেঁকে বলেছিল, দেখিস যেন আপেল গাছ থাকে। পরে ওরা সবাই হোটেলে এলে বীরেন সোজা আপেল গাছের দিকেই তদন্ত করতে গেল – পাড়া এবং তা পারার বিষয়ে। নুব্রায় প্রচুর গাছপালা – পাতা ঝরানোর মরশুমে তাদের বেশির ভাগই এখন লাল, হলুদ, বাদামি রঙে সেজেছে।
সন্ধেয় সবাই বসে আড্ডা – চা আর পকোড়া ম্যানেজ করা গেছে অনেক বলেকয়ে।

সকাল ৯-৩০
নুব্রা লেহ-এর থেকে বেশ নিচে, ঠাণ্ডাও তাই অনেক কম। গরম জলে স্নান সেরে বেশ ফ্রেশ সবাই। সকালে হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরোনোর তোড়জোড়। বাইরে আসতেই চোখ টানল সকালের রোদ্দুরে আর ফুলে আলো হয়ে থাকা সামনের বাগান। থোকা থোকা গোলাপে ভরে আছে গাছ। সকলেই যেন গোলাপসুন্দরী। প্যাঞ্জি, পিটুনিয়ারাও দলে বেশ ভারী। চন্দ্রমল্লিকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ছে প্রজাপতিরা। সবজির খেতও ভরে আছে হৃষ্টপুষ্ট বাঁধাকপিতে। বাগানের ধার বরাবর বড় গাছেরা সবুজ-সাদা হয়ে ঘিরে রয়েছে। বাইরে বেরোতে গাছেরাও আরও রঙ ছড়াতে লাগলো।
আজ হুন্ডার থেকে দিসকিট মনাস্ট্রি হয়ে লেহ-তে ফেরা। ১২৫ কিমি পথ। হাতে সময় থাকলে হুন্ডার থেকে তুরতুক ঘুরেই ফেরার প্ল্যান ছিল। কিন্তু কাল আমার উটে চাপা হয়নি। আর কি এ জীবনে দু-কুঁজওলা উটে চাপতে পারব? তাই লালমোহনবাবুর জন্য উটই সই। তুরতুকের মায়াবী আকর্ষণ অদেখাই রয়ে গেল।
এই নিয়ে উটে চাপার এটা আমার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। প্রথমবার জয়পুরের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না। এবারেও প্রথম উটটায় চাপতে গিয়ে সুবিধা হয় না। দ্বিতীয় উটের দুই কুঁজের মাঝখানে আটকে বসি। উট ওঠে। উটের এই ওঠা-বসাটাই সবথেকে মারাত্মক। উটে উঠে নিজেকে সেই লালমোহনবাবুর মতোই লাগে। উটটা কী ভাবছিল কে জানে! তবে ভালো কিছু ভাবেনি নিশ্চিত। কারণ আমি থেকে থেকে উটের সামনের কুঁজ খামচে ধরছিলাম আর বুই বকুনি দিচ্ছিল। উটটার নাকি চোখ দিয়ে জল পড়ছিল বলল আমায় ফেরার সময়। তা দেখিনি তবে সে যে অন্য উটদের গোঁতাচ্ছিল সেটা ঠিক।
যাইহোক, উটের পিঠ থেকে পৃথিবীটা ভারী চমৎকার লাগছিল। দিগন্তবিস্তৃত বালুভূমি। দুপাশে পাহাড়। দূরে গাছপালা। আর আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ ভিড় করে এসেছে যেন। পাহাড়ের গায়ে মেঘের ছায়া পড়ে ভারী অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। দূরে দিসকিট মনাস্ট্রি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে মোবাইলটা পর্যন্ত ছিল না, আর থাকলেও ছবি তোলার হাত দুটো তো উটকে আঁকড়ে! মনে হয় শেষপর্যন্ত পিঠ থেকে আমাকে নামাতে পেরে উটটা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল।
বেলা ১১-০০। দিসকিট
দিসকিট মনাস্ট্রি পাহাড়ের অনেকটা ওপরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। দূর থেকে দেখেই আপাতত সন্তুষ্ট হই। এখন আর অত সিঁড়ি ভাঙতে চাইছেনা কেউই। তবে অন্য মনাস্ট্রিগুলোর মতোই এর সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখি তোমায়। নুব্রা উপত্যকার প্রাচীনতম ও বৃহত্তম এই মনাস্ট্রিটি হলুদ টুপি বা গেলুগপা সম্প্রদায়ের বৌদ্ধদের অধীনে। চোদ্দ শতকে গেলুগপা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা চাংজেম সেরাব জাংপো, থিকসে গুম্ফার শাখা হিসেবে এই মনাস্ট্রিটির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রার্থনা হলে মুকুট পরা বুদ্ধের (চো রিংপোচে) প্রধান মূর্তি, অন্যান্য বেশ কয়েকটি রক্ষাকারী ক্রুদ্ধ দেবমূর্তি আর একটি বিশালাকৃতি ড্রাম রয়েছে। মনাস্ট্রি চত্ত্বরে একটি এনজিও-চালিত স্কুলও আছে স্থানীয় শিশুদের শিক্ষার জন্য। ফেব্রুয়ারি মাসে মনাস্ট্রিতে হওয়া 'দসমোচে' উৎসবটি স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।
মনাস্ট্রির ঠিক আগেই আরেকটা পাহাড়ের মাথায় ৩২ মিটার উঁচু বিশাল সোনালি রঙের মৈত্রেয় বুদ্ধের পায়ের নীচে চত্ত্বরটায় দাঁড়িয়ে আছি। রোদ্দুর ঝলমল করছে। ওপর থেকে পুরো ভ্যালির দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। যদিও ফেলুদা বলেছে 'অসাধারণ' বললে কিছুই বোঝা যায়না।
জলে পাহাড়ের ছায়া। পরিযায়ী হাঁসেরা ভাসছে। মোবাইলে কিশোর বাজছে, 'দিল কেয়া করে যব কিসিসে কিসিকো প্যার হো যায়…'। এই প্রকৃতির রূপের মধ্যে একটা নিষ্ঠুরতা আছে, তবু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে – রুক্ষ পাহাড়, তার গায়ে হলুদ-লাল-সবুজ ঝোপ, কোথাও একটু জলে টলটল করছে প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি।
একই পথে ফিরছি, দৃশ্য তো সব একই। কিন্তু শেষ দুপুরের বিষন্নতার সঙ্গে সকালে নীল-সাদা নদীর জলে রোদের ঝলমলানির পার্থক্য যে অনেক বেশি।
আকাশে আজ অনেক মেঘ – সাদাই বেশি, কখনও বা আবছা কালোয়।
রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছে। পিচের গন্ধ উঠছে। সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। আমরাও থামি।

দুপুর ১২-৪৫। খালসার
বারোটা নাগাদ খালসার পেরিয়েছি। মেঘলা করে আসছে। রোদ মরে ঠান্ডা বাড়ছে হু হু করে। খালসারেই দুপুরের খাওয়ার পাট মেটানো হল।

দুপুর ২-৩০। নর্থ পুল্লু
একদিকের বরফ পাহাড়ের মাথায় রোদ্দুর ঝলসাচ্ছে। উল্টোদিকের বরফেঢাকা পাহাড় মেঘে মেঘে বিষণ্ণ।
পথে অনেক বাইকার দেখলাম। লাদাখের পাহাড়ে এই বাইক ভ্রমণ দিনদিন এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। সকাল থেকে অনেকবার ব্লু ম্যাগপাই চোখে পড়ল। গতকাল যাওয়ার সময়ও দেখেছিলাম, তবে অনেক কম। পথে স্থানীয় লোকজন কমই চোখে পড়ছে গতকাল থেকেই।
'আজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে, কাঁহা শুরু কাঁহা খতম...' – লতার মনকেমন করা কন্ঠস্বরে পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যাচ্ছি।
সামনের দুপাশের পাহাড় যেন বরফে ভেসে গেছে।
নর্থ পুল্লু চেকিং পয়েন্ট। খানিক আগেও বরফপাত হয়েছে। পাস বন্ধ। রাস্তা ওয়ান ওয়ে করে দেওয়া হয়েছে। সাউথ পুল্লু থেকে গাড়িরা না এসে পৌঁছালে এপাশ থেকে ছাড়বে না আর্মিরা। কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে!
*ডায়েরির এই অংশে আগে যা যা লেখা হয়নি সেগুলো লিখে রেখেছিলাম। ভ্রমণকাহিনি লিখতে বসে আগের কথা আগেই লিখেছি। শুধু যেটুকু লেখা হয়নি সেটাই বলি।
সেটা গতকাল সকালের একটা মজার ঘটনা। হুন্ডারের জন্য রওনা দেওয়ার ঠিক আগে। আসলে বীরেনকে আপেলে পেয়েছে অথবা আপেল বীরেনকে। হোটেল বিমলার আপেল গাছে অজস্র আপেল দেখে বীরেন কাউকে বলে, না বলে থেকে থেকেই পাড়ছে, কিম্বা ধনগিরিকে দিয়ে পাড়াচ্ছে সবার জন্যই। আমরা বিনা পরিশ্রমে আপেল ডায়েটেই আছি। মানে মোর দ্যান ওয়ান অ্যাপেল আ ডে। যাইহোক, ঘটনাটা বলি এবারে। বীরেন বেরোনোর আগে ধনগিরিকে তিনটে আপেল পাড়তে বলেছিল। মালকিন দেখতে পেয়ে বলল, কুড়ি টাকা লাগবে আপেলের জন্য। ধনগিরি গেল খেপে। বলল, তোমার কত আপেল পাখিতে খেয়ে যায়, কত আপেল পড়ে নষ্ট হয়, আর তুমি তিনটে আপেলের দাম চাইছ? তোমার বাড়িতে কোনও অতিথি আসবে না। তুমি মানুষ না বনমানুষ? এরপর অবশ্য মালকিনের সঙ্গে টুসির গল্প জমে উঠল। গল্পের তোড়ে কুড়ি টাকা কোথায় ভেসে গেল কে জানে! পরে বীরেনের মুখে পুরো কাহিনিটা শুনলাম। আসলে পাহাড়ি মানুষ এরকমই সরল মনের হন সে বহুবারই দেখেছি।
দুপুর ২-৪৫
উলটো দিক থেকে বেশ কয়েকটা বরফে ঢাকা গাড়ি এল। কিন্তু এখনও এদিক থেকে গাড়ি ছাড়ছে না। ঠান্ডা এত বাড়ছে যে গ্লাভস খুলে ডায়েরি লেখাই খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়ছে বাইরে। বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এই প্রথম চোখের সামনে বরফ পড়া দেখে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। ক্রমশ চারদিক সাদা হয়ে আসছে। গাড়ির মাথাগুলো ঢেকে যাচ্ছে নরম বরফে। যেন কোন রূপকথার রাজ্যে বসে রয়েছি। আর -
শুধুই তুষার ঝরছে, শুধুই তুষার।

পৌনে তিনটে বেজে গেছে ঘড়িতে। এতক্ষণে গাড়ি ছাড়ল। এখনও বরফ পড়েই যাচ্ছে। ওদিকে রোদ্দুরও উঠেছে। বরফের গায়ে গায়ে রোদের ঝলক। পড়তে থাকা বরফ কুচির গায়েও রোদের ঝিকিমিকি। রাস্তার ওপরেও জায়গায় জায়গায় বরফ জমেছে, সেনারা পরিষ্কার করে ফেলছেন জরুরি তৎপরতায়।
একেবারে মাথার ওপরে নীল আকাশে সূর্য। নীচের মেঘ তুলনায় কালচে রঙের। আরও নীচে বরফ পাহাড়ের মাথা যে মেঘ ছুঁয়েছে তার রঙও সাদা। সেই ভয়ানক খারাপ রাস্তাটায় আবার প্রবল ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোচ্ছি।

বিকেল ৩-২৫
পথের পাশেই পাহাড়ের গা মোড়া নরম রোদে। ঝুরো বোল্ডার সরিয়ে রাস্তা সারানোর কাজ চলছে জায়গায় জায়গায়। অনেকটা উপরে উঠে এসেছি, পথের উপর হালকা বরফের আস্তরণ। হঠাৎ আমাদের গাড়ি থমকে দাঁড়াল, সামনে একটা ছোট মালবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে। আমাদের ড্রাইভার তুন্ডুপ বলে উঠল – ফাস গয়া শালা। কী হল জিজ্ঞেস করতে বোঝা গেল, বরফের আস্তরণে রাস্তা এমন পিছল হয়ে আছে যে সামনের গাড়িটার চাকা রাস্তায় গ্রিপ করতে পারছেনা, স্লিপ করে যাচ্ছে। সেটা না সরলে এগোনো যাবে না। ওই গাড়ির হেল্পারের সঙ্গে পথের দু-একজন লোকও গাড়িটা ঠেলতে শুরু করেছে। আমাদের গাড়ি থেকেও কেউ কেউ নেমে ঠেলায় সাহায্য করতে গেল। শক্তি থাকলে ঠেলে দেখতাম হয়তো। কিন্তু একটুও নড়াতেও পারব না জানি এবং শেষে আবার আমাকেই ঠেলতে লোক লাগবে। গাড়িতে বসেই দেখছি আর লিখছি চুপচাপ। আমি আর বুই বাদে সকলেই নিচে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে। টুসি গাড়ি ঠেলার মুভি তুলছে হ্যান্ডিক্যামে। কোনওক্রমে ঠেলে ঠেলে কিছুদূর এগোনোর পর গাড়িটা স্টার্ট নিয়ে বেড়িয়ে গেল।
এবার আমাদের গাড়ি এগোল, এবং আগের গাড়িটার জায়গায় গিয়ে আমাদের গাড়িটাও থেমে গেল। তুন্ডুপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ম্যায় ভি ফাস গয়া। তার মানে আমাদের গাড়িও এবার ঠেলতে হচ্ছে!
একটু আগেই দীপের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। যদিও অক্সিজেন নিচ্ছেনা বারবার বললেও। গাড়ি ঠেলাতেও হাত লাগিয়েছে।
খানিক ঠেলার পর গাড়ি স্টার্ট নিল। সামান্য এগিয়ে বাঁক নিতেই দেখি, আরে আমরা তো এতক্ষণ খারদুং লা-র মুখেই ছিলাম। প্রায় ১৮০০০ ফিট উচ্চতায় টেম্পো ট্র্যাভেলারের মত বড় গাড়ি ঠেলতে পেরে সবাই দারুণ উত্তেজিত!
এখন খারদুং পাসে বরফের পরিমাণ আরও বেশি। খানিকক্ষণ থামার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এমনিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই নেমে একটু পায়চারি করে আবারও দুচারটে ছবি তুলে রওনা দেওয়া হল।

বিকেল ৩-৫০। সাউথ পুল্লু
রাস্তা পুরো বরফে ঢাকা। গাড়ি তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে চাইছে যাতে আর না আটকায়। ঠেলার লোকও মিলবে না এরপর।
সন্ধে ৫-১৫। লেহ
বহুক্ষণ একটা মিলিটারি কনভয়ের পেছন পেছন যেতে হল। তার বেশিটাই আবার কামানের মুখে। মানে সামনেই কামানের গাড়ি। অলিখিত নিয়ম হল, ওরা পাশ না দিলে সিভিলিয়ান কোনও গাড়ি মিলিটারি গাড়িকে ওভারটেক করতে পারবে না। যাত্রার এই অংশটাই ছিল সবচেয়ে ধীর আর বিরক্তিকর। ক্লান্তও লাগছে সকলেরই। তবু কোনও উপায়ই নেই। এইমাত্র ছাড়ল আর গাড়িও গতি নিল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
অন্ধকার হয়ে আসছে ক্রমশ। তবে লেহ শহরে ঢুকে গেছি প্রায়।

(ক্রমশ)

আগের পর্ব – প্রথম পত্র


~ লাদাখের আরও ছবি ~

 

'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত নেশায় লেখক, ভ্রামণিক, ভ্রমণসাহিত্য গবেষক। প্রকাশিত বই - 'অবলা বসুর 'ভ্রমণকথা', 'আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত - ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গমহিলাদের ভ্রমণকথা' (সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত)

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher