~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরও ছবি ~
~ প্রথম পর্ব ~
অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সমুদ্রভ্রমণের পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পেল। চাকরিসূত্রে দিল্লি আসার পর থেকে শুধুই হিমালয় চলছিল, এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়। কিন্তু এবার আন্দামান যাওয়ার তোড়জোড় বেশ অনেকদিন আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছিলাম। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিই আন্দামান ভ্রমণের সেরা সময়। অফিসে ছুটি নেওয়া থেকে টিকিট কাটা - সব নভেম্বরের মধ্যেই সেরে ফেলা গেল।
বিয়ের পর থেকে সব বেড়াতে যাওয়ার যাবতীয় ঝক্কি আমাকেই পোহাতে হয়। প্ল্যানিং থেকে হোটেল বা গাড়ি বুকিং সব দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে পতিদেবতাটি ঝাড়া-হাত-পা হয়ে গলায় সাধের ক্যামেরাটি ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এবার আমার শর্ত ছিল অভিষেককে সব দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু বেরোনোর আগের দিন দেখলাম দু-চারটে হোটেলের নাম টুকে রাখা ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থাই সে করতে পারেনি। হোটেল বুকিং করার ব্যাপারে একটা বাধা অবশ্য ছিল – ফেরি শিডিউল-এর অনিশ্চয়তা। অতএব শুধুমাত্র ফ্লাইট টিকিট এবং আমারই বানানো একটি দৈনিক ভ্রমণখসড়া হাতে নিয়ে রওনা হলাম সাগর পাড়ি দিতে।
৩০.১.২০১৭ :
কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট কাকডাকা ভোরে। অর্থাৎ জানলার পাশের সিটে বসে সূর্য আর প্লেনের আকাশে ওঠা একসঙ্গেই দেখা যায়। এরোপ্লেন থেকে সূর্যোদয় দেখা এক মজার অভিজ্ঞতা। দিগন্ত রেখার ওপরে বসে নিচে সুয্যিমামার ঘুম ভাঙতে দেখা যায়। সাদা মেঘের সমুদ্রে তখন ছড়িয়ে পড়ছে আরও একটা নতুন দিনের নতুন আশার ঢেউ। মন গুনগুন করে ওঠে – "আজ ম্যায় উপর, আসমাঁ নিচে!"
বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছি অথচ চোখের সামনে কেবলই মেঘের রাজ্য। অবশেষে এক সময় ডাঙার দেখা পাওয়া গেল। বিপুল জলরাশির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবুজে ঢাকা দ্বীপরাজি। এই সেই আন্দামান, ইতিহাসে যার উপস্থিতি অধিকাংশই কলঙ্কে মোড়া। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্বাসনের দ্বীপ, 'কালাপানি' নামের কালিমা ঘুচতে যার সময় লেগে গেছে অনেক বছর।
আমাদের ফ্লাইট নামল সেই কালাপানির বুকে। ছোট্ট একটা এয়ারপোর্ট। ততোধিক ছোট রানওয়ে। লাগেজবেল্টের সামনে প্রতীক্ষা। চিরকাল দেখেছি কোনও এক অলৌকিক মন্ত্রবলে আমাদের ব্যাগগুলোই আসে সবার শেষে ! সব যাত্রী যখন হোটেলে পৌঁছে গেল হয়ত, তখন হেলতেদুলতে তারা এল। বেরিয়ে এসেই পাওয়া গেল গাড়ি। আমাদের কোনও হোটেলে বুকিং নেই, অগত্যা সারথিই ভরসা এখন। ছেলেটির নাম পুগাল, আদতে তামিল, কিন্তু আন্দামানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা। 'আমি থাকতে আপনাদের কোনও চিন্তা নেই' – এই আশ্বাসবাণী অবলম্বন করে তার বাহনে চড়ে বসলাম। ছেলেটি যেন সরলতার প্রতিমূর্তি। অবশ্য আগামী কয়েকদিন আন্দামানে থাকতে থাকতে বুঝেছি, এটা বোধহয় এই জায়গাটারই গুণ। ক্রাইম-ট্রাইম এখানে হয়না বললেই চলে এবং হোটেল বা অন্যান্য সর্বত্র স্থানীয় লোকজন আমাদের যতটা বিশ্বাস করেছে, আমরা হয়ত নিজেদেরও ততটা করতে পারি না।
পোর্ট ব্লেয়ার আমার দেখা প্রথম জায়গা যেখানে এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহরের দূরত্ব খুবই কম। এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র পনেরো মিনিটের দূরত্বে একটি হোটেলে এনে গাড়ি দাঁড় করালো পুগাল। হোটেল "কোস্টাল ব্রিজ।" কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে ভীষণ ঘরোয়া এই হোটেলটি দেখেই মনে ধরে গেল। ব্যবস্থাপনারও কোনও ত্রুটি নেই। চেক-ইন করেই পুগালের সঙ্গে ঠিক করে নেওয়া হল আমাদের ভ্রমণের প্রাথমিক খসড়া। সে নিজেই দায়িত্ব তুলে নিল ফেরি টিকিট এবং প্রয়োজনীয় পারমিট-এর। অতএব নিশ্চিন্ত।
বেড়াতে এসে হোটেল বন্দী হয়ে থাকা আমার ঘোর অপছন্দের। স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা ঘুরে দেখতে। হোটেলটা একটু চড়াই অঞ্চলে। বেরিয়ে সামান্য নিচের দিকে হাঁটা দিতেই সমুদ্রের নীল ধরা দিল চোখে। রাস্তাঘাট ঝকঝকে তকতকে। ধুলো নেই-ই, তাই উড়ছেও না। আকাশও তাই যেন একটু বেশিই নীল এখানে। তখনও বুঝিনি আরও কত অজস্র রকমের নীল আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে এই গোটা ভ্রমণসূচীতে। হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ধারে এসে পৌঁছলাম। কাছেই আবেরডিন জেটি। কিছুক্ষণ জাহাজের আনাগোনা দেখে আর নীলচে-সবুজ জলের মুগ্ধতা নিয়ে এবার ফেরার পালা। মাথার ওপর সূর্যদেব ক্রমশই প্রখর থেকে প্রখরতর হয়ে চলেছেন। তাছাড়া দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেই ঘুরতে বেরোনোর প্ল্যান।
যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে পুগাল এসে গেল। আন্দামান এসে মাছ খাব না, তাও কি হয়? হোটেলের কাছেই 'আনন্দ' রেস্তোঁরায় ফিশ সিজলার সহযোগে লাঞ্চ সেরে নেওয়া গেল। (সদ্য ফেসবুকে 'আমাদের ছুটি'-র গ্রুপে সরিৎ চ্যাটার্জীবাবুর লেখা 'কালাপানি' ধারাবাহিকে এই রেস্তোঁরার উল্লেখ দেখে পুরোনো কথা মনে পড়ে মনটা বেশ ভালো হয়ে গিয়েছিল।) খাওয়ার পর্বের শেষে রওনা দিলাম সেলুলার জেলের উদ্দেশ্যে।
এই সেই সেলুলার জেল! কালাপানির কালান্তক ইতিহাসের প্রতিমূর্তি, রক্ত আর নৃশংসতার, অত্যাচার আর যন্ত্রণার সাক্ষী। সিপাহী বিদ্রোহের পর স্বাধীনতাসংগ্রামীদের জন্যে ব্রিটিশদের তৈরি 'পেনাল সেটলমেন্ট' - যেন এক মূর্তিমান নিষ্ঠুরতা। সেন্ট্রাল টাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া সাতটি বাহু (বর্তমানে তিনটিই আছে), প্রতিটি তিনতলা, সর্বমোট ৬৯৩ টি কারাকক্ষ। বাহুগুলির নির্মাণ আবার এমনই যে একটির সম্মুখভাগ অপরটির পশ্চাতভাগের মুখোমুখি, যাতে বন্দীরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারে। বন্দীদের জন্যে বরাদ্দ এক একটি ছোট ছোট খুপরি, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ঘড়ির কাঁটার শৃঙ্খলে। লম্বা টানা বারান্দা, লোহার দরজা, ফাঁসির দড়ি – সব কিছুই আজও ব্যক্ত করে চলেছে সেই কষ্টের ইতিহাস, চোখের জল এখানে বাঁধ মানে না। প্রতিটা ইট–কড়িকাঠে সোচ্চার হয়ে ওঠে সওয়াশো বছরের জমানো হাহাকার।
বুকের মধ্যে জমে ওঠা ভারি বোঝাটা হালকা হয়ে ওঠে জেলের ছাদ থেকে সমুদ্র দেখে। গাঢ় নীল জল, কোনও কোনও দিকে ডাঙা দেখা যাচ্ছে ঘন সবুজে ঢাকা। এই অপরূপ রূপশোভা কতদিন ঢেকে ছিল অত্যাচারের অন্তরালে। কষ্টগুলোতে লাগাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম এই রাষ্ট্রীয় স্মারক থেকে। বোঝাটা আরও হালকা হল করবিন'স কোভ বিচে গিয়ে। ছোট্ট বিচ, ধার দিয়ে সারি সারি নারকেল গাছ। ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে প্রবল গতিতে ছুটে চলা জেট-স্কি দেখেই রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। অভিষেক যদিও প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল, কিন্তু কান টানলে মাথার না এসে উপায় কী?
ওখান থেকেই আবার ফেরা সেলুলার জেলে, লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখতে। আলোর ব্যবহার তেমন আকর্ষক না হলেও জেলের প্রাচীন ইট-পাথর আর প্রাচীনতর অশ্বত্থ গাছের কথোপকথনের মাধ্যমে সব অত্যাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ চোখে জল এনে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
আজকের মত ঘোরাঘুরি এখানেই শেষ। এবার পালা হোটেলে ফেরার।
৩১.১.২০১৭ :
আন্দামানে এলে বাঙালিদের পরবাস বলে মনে হওয়া সম্ভব নয়। যেমন বাঙালি পর্যটকদের ভিড়, তেমনি প্রচুর বাঙালির বসবাস। আমাদের হোটেলের রিসেপশন স্টাফও বাঙালি, শ্যামলদা। এছাড়া এক বাঙালি প্রবীণ দম্পতিও এসে উঠেছেন এই হোটেলে। সকালে বেরোনোর আগে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব, বাইরে এসে মঙ্গলবারে নিরামিষ খাওয়ার বিড়ম্বনা, আগামীকাল সরস্বতী পুজো নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সবই চলল। পুগাল যথাসময়ে এসে গেছে। আজ আমাদের গন্তব্য রস আর নর্থ বে আইল্যান্ড। বোটের (এখানে যদিও ফেরি বলে) টিকিটের ব্যবস্থা পুগাল করে রেখেছে কথামত। বোটের নাম 'মুসাফির।' আজ এই বোটে উঠে সেই যে লাইফ জ্যাকেট পরার অশান্তি শুরু হল, সেটা চলল বাকি পুরো ট্রিপে, শেষ দিন পর্যন্ত। এটা পরে না যায় ঘাড় ঘোরানো, না যায় সাবলীল ভাবে বসা। লাইফ জ্যাকেট তো নয়, যেন গলায় মরণফাঁস!
রস আইল্যান্ড আবেরডিন জেটি থেকেই দেখতে পাওয়া যায়। পৌঁছে দেখলাম গোটা দ্বীপ জুড়েই নারকেল গাছের আধিক্য। এটি একটি ছোট দ্বীপ। প্রথমে এখানেই কারাগার তৈরির পরিকল্পনা হয়, পরে এটিই হয়ে ওঠে 'প্রাচ্যের প্যারিস।' এখন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। ব্রিটিশ, জাপানি, সবাই দখল করতে চেয়েছে। এখানেই প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা, নেতাজির হাত ধরে ১৯৪৩ সালে। এখন সেই যুগের খানিক ভগ্নাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সত্যি কি নেই কিছু? এর হাওয়া, নিরলস ভেঙে চলা সমুদ্রের ঢেউ তো কত গল্প শোনায়, যারা শুনতে পায়, তারা পায়। সেই গল্পের আশায় হাঁটা লাগলাম। সময় বরাদ্দ আছে দেড় ঘন্টা, তার মধ্যে যতটা ঘুরে নেওয়া যায়। হাঁটছি, দেখছি, মাঝে মাঝে মুগ্ধতা বন্দী হয়ে উঠছে মুঠোফোনে। কয়েকটা হরিণ আশ্চর্যজনক নির্ভীক ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করে চলেছে সব পর্যটকদের গা ঘেঁষে। দরকারমত মডেল হয়ে পোজও দিচ্ছে বেশ।
রস থেকে পাড়ি দিলাম নর্থ বে। স্কুবা ডাইভিং সকালেই বুক করে নেওয়া হয়েছে এখানের জন্যে, পোর্ট ব্লেয়ার থেকেই। 'জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা' সিনেমাটির অনেকগুলো অনুপ্রেরণার মধ্যে এটা অন্যতম। 'মুঝে আফশোস করনা নেহি আতা' আর 'করনা ভি নেহি চাহিয়ে' – ওই সিনেমার-ই এই দুই সংলাপ মনে এত দাগ কেটেছিল যে এখনও জীবনের সব ক্ষেত্রে এই জীবনদর্শন বজায় রাখার চেষ্টা করি। তাই, ছোট থেকেই জলে চূড়ান্ত ভীতি থাকা সত্ত্বেও আন্দামানে এসে স্কুবা না করার আফশোস যাতে বয়ে না বেড়াতে হয়, এটা আমি করবই। ওখানে পৌঁছে ধড়াচূড়া পরে জলে নামতেই দেখলাম ভয়-টয় সব কোন ফুসমন্তর বলে উধাও। এখানে স্কুবা ইন্সট্রাকটরও বাঙালি ছেলে। চশমা পরে জলের নিচে তাকাতেই মনটা এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরে গেল। ব্রিদিং পাইপ দিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া অভ্যেস করে জলের নিচে নেমে পড়া হল। সে এক অনাবিল প্রশান্তির জায়গা। কোনও শব্দই কর্ণগোচর হয়না, এবং এই প্রগাঢ় নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন আমি একা এক অন্য অচেনা জগতে। যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির প্রবাল। একের পর এক রং-বেরঙের মাছের ঝাঁক ছুটে আসছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে, অনুভব করতে পারছি তাদের আলতো দংশন। আমি যেন এই অলীক রূপকথার জগতে জলপরী। এ যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জায়গা, নিজের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জায়গা। সারা জীবনের জন্যে অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হল এক বিপুল ঐশ্বর্যের সম্ভারে।
জল থেকে উঠে লাঞ্চ সেরে হাঁটা দিলাম লাইট হাউসের দিকে। এ আমাদের সবার চেনা, ভারতীয় ২০ টাকার নোটে যে লাইট হাউসটি দেখা যায়, এটা সেটাই। বোটে আসার সময়েই দেখেছি একরাশ নারকেল গাছের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে লাল-সাদা বাতিঘর। কিছুটা চড়াই ভেঙে বাতিঘরের সামনে পৌঁছনো তো গেল, কিন্তু ওপরে ওঠার অনুমতি মিলল না। অগত্যা উল্টো পথে ফিরে চলা।
ফেরার পথে আবার আর এক প্রস্থ জলের ঝাপটা খেতে খেতে এলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর যাওয়া হল ফিনিক্স বে জেটি, সেখান থেকে আবার যাব রস আইল্যান্ড, লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখতে। সব আন্দামান ভ্রমণার্থীদের জন্যে আমার অনুরোধ, এটি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। বেশির ভাগ ট্যুর অর্গানাইজারদের ভ্রমণসূচীতে এটি থাকে না। কিন্তু এটি আমার দেখা সেরা আলোক-ধ্বনি প্রদর্শনী। দ্বীপের ইতিহাস অত্যন্ত সুচারুতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। সঙ্গে বাড়তি পাওনা গুলজার সাহেবের লেখনী আর শাবানা আজমির অনন্য বাচনভঙ্গি। দুধনাথ তেওয়ারির বিশ্বাসঘাতকতা, গ্রেট আন্দামানিজদের বিদ্রোহ, দ্বীপের প্রাচুর্যের দিন, সেখান থেকে গরিমা অবলুপ্তি - সব সুদক্ষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই উপস্থাপনাটিতে। কখন যে নিজেই হারিয়ে যাই সেই দেড়শ বছর পেছনে, কখন যে সংগ্রামের আগুন আমার বুকের ভেতরেও জ্বলে ওঠে, কখন যে সব বীর শহিদের আত্মত্যাগের মহানতা চোখ ঝাপসা করে দেয়! আর এই সব কিছুর সাক্ষী থেকে যায় আকাশের একফালি চাঁদ, তার সঙ্গিনী দুই উজ্জ্বল তারাকে নিয়ে।
১.২.২০১৭ :
বেড়াতে এলেই দেখেছি খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায়। আর এখানে সারাদিন বেশ গরম থাকলেও শেষ রাতে বেশ হালকা শীতের অনুভূতি হচ্ছে। আজ প্ল্যানমাফিক আমরা যাব মহাত্মা গান্ধী মেরিন ন্যাশনাল পার্ক। বেশ অনেকগুলি দ্বীপের ফ্লোরা আর ফনা-র সংরক্ষণের জন্যে এই পার্কটি তৈরি। তবে পর্যটকদের গতিবিধি মূলত: দুটি দ্বীপে সীমিত - জলি বয় (নভেম্বর – এপ্রিল) আর রেড স্কিন (মে – অক্টোবর)। আয়তনে রেড স্কিন অনেকটাই বড় জলি বয়-এর থেকে। জলি বয় অন্যান্য দ্বীপগুলোর থেকে অনেকটা দূরে, যেখানে জলের গভীরতা অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই বর্ষাপ্রবণ সময়ে সেখানে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি থাকে না। ওয়ান্ডুর বিচ-এর কাছে একটি জেটি থেকে বোট ছাড়ে। যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা।
বোটে উঠেই আবার সেই লাইফ জ্যাকেট পরার জ্বালাতন। তবে যাওয়ার পথটা খুব সুন্দর। দুদিকে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে মোড়া দ্বীপেদের সঙ্গী করে সুনীল জলে সাদা ফেনা তুলে এগিয়ে চলেছে আমাদের বোট। অবন ঠাকুরের 'কাটুম কুটুমের' সঙ্গে পরিচয় আমার সেই ছোট্টবেলায়, বাবার হাত ধরে। শুধু এটাই নয়, ছোট থেকে আমার যা কিছু বই পড়া, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে, সবটাই বাবার জন্য। তো সেই 'কাটুম কুটুম' মনের একটা বিরাট আগ্রহের জায়গা জুড়ে ছিল ছোট থেকেই। এখনও দেখলাম সেই উৎসাহে কোনও খামতি নেই। যখনই বোট কোনও দ্বীপের ধারে আসছে, পাড়ের গাছ-গাছালির গুঁড়ি দেখে মন কল্পনা করে নিচ্ছে বিভিন্ন পরিচিত আকৃতি। এদের মধ্যে যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল, সেটা হল – হাঁটু ভাঁজ করে জলে ডুবিয়ে রাখা কোনো যুবতীর দুধসাদা পদযুগল! কি নিখুঁত সেই আকৃতি। এই ছেলেমানুষিগুলো আমার বড় প্রিয়, মেঘ দেখেও এমন রূপকথা রচনা করি। এই কল্পনার রূপকথাই আমার জগৎ, এই পাগলামিমাখা ভালোলাগাগুলি বেঁচে থাকার অক্সিজেন, একাকীত্মের সঙ্গী।
জলি বয় আইল্যান্ডটি যেন নীলবসনা সুন্দরীর কপালে একটুকরো সবুজ টিপ। এখানে কোনও স্থায়ী জেটি নেই। বোট এসে দাঁড়ায় একটি রবার জেটির সামনে, সেখান থেকে নৌকো করে দ্বীপে পৌঁছতে হয়। যাওয়ার পথে একটি গ্লাস বটম বোট রাইড করানো হয়, কোনো অতিরিক্ত শুল্ক ছাড়াই। সেটা নিতান্তই একটা ট্রেইলার মাত্র। এরপর আলাদা করে ৪০-৪৫ মিনিটের আরেকটা রাইড করা যায়, মোট তিনটি কোরাল রিফ ঘুরিয়ে দেখানো হয়। কত বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল যে দেখলাম! কলিফ্লাওয়ার, মাশরুম, বোল্ডার – যেমন বিচিত্র তাদের নাম, তেমনই বিপুল তাদের বৈচিত্র। এর সঙ্গে নানারকম মাছ তো আছেই। নানা রঙের জেলি ফিশ, মুক্ত-ঝিনুক, সমুদ্রশসা, সী এনিমুন-এ লুকিয়ে থাকা ক্লাউন ফিশ- সব মিলিয়ে এ এক স্বপ্নের দেশ।
এখানেও সমুদ্রের রং দেখে দু'চোখ জুড়িয়ে যায়। নীল ও সবুজের যে কী অপূর্ব মিশ্রণ! চোখের সামনে যেন কোনও সম্মোহনের মায়াজাল বিছিয়ে দিয়েছে এক অদৃশ্য জাদুকর। ফেরার পথে তখন ভাঁটা চলছে। আসার পথে দেখা সেই যুবতীর পায়ের পাতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এখন।
ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে গেলাম ওয়ান্ডুর বিচে। সুয্যিমামা তখন দিনের পাট মিটিয়ে ছুটি নিতে উদ্যোগী। যাওয়ার বেলায় ঝুলিতে বেঁচে থাকা সব আবির যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের গায়ে। লাল, কমলা, গোলাপি - সব। নাকি বেলাশেষের বিদায়ী চুম্বনে প্রেমিকা আকাশ রেঙে উঠছে লজ্জায়? বিচটি বেশ নিরিবিলি। তাই নিজের মত করে প্রতিটা মুহূর্ত বাঁচার সুযোগও অনেক বেশি। এখানে ওখানে পড়ে আছে মৃত প্রবাল। সমুদ্রতটে ছড়ানো রং বেরঙের ঝিনুক, শামুক, আরও কত কী! সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালেই মনটা কী ভীষণ উদাস হয়ে যায়! সামনে এক অসীম, বিশাল শূন্যতা আর তার মাঝে আমি যেন একা। এই পৃথিবীতে এটাই যেন চিরন্তন সত্য - একাকীত্ম। নিরলসে ভেঙে চলা ঢেউ দেখতে দেখতে হেঁটে যেতে পারি আমি শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। অভিষেক তখন ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত, মুহূর্তগুলোকে বন্দী করতে। আমি শুধু সেগুলোতে বেঁচে নিই, প্রাণ ভরে। পান করি অমৃতসুধা। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারি আমি। এ যেন নিজের সবচেয়ে ভালবাসার মানুষটার মুখোমুখি বসে থাকা, চুপচাপ, শুধু চাহনিই কথা বলে যায়। ক্লান্ত হলে তার কাঁধে মাথা রেখে সব দু:খ ভুলে যাওয়া। আর লেখা হয়ে যায় কত অপ্রকাশিত প্রেমের কবিতা।
২.২.২০১৭ :
আন্দামানের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি ভিন্ন মত শোনা যায়। পবনপুত্র হনুমানের 'হন্ডুমান' বা 'অন্ডুমান' নাম থেকেই নাকি আন্দামান নামকরণ। কারও কারও মতে আন্দামান নামের অর্থ ভগবানের দেশ, আবার কেউ বলেন এ নাকি সোনার দেশ। তো নামের মানে যাই হোক, ক্রমেই আন্দামানের প্রেমে পড়ে চলেছি আমি। কী যেন একটা ম্যাজিক আছে এই জায়গাটায়। সবকিছুই যেন কেমন একটু বেশি ভালো লাগে। এমনকি সারাদিনের প্রখর রোদেও কষ্ট বোধ হয় না। বরং একটুখানি শীতল হাওয়ার স্পর্শেই যেন মন খুশিতে ভরে ওঠে। আজ আমাদের হ্যাভলক যাওয়া। আন্দামানের সবথেকে আলোচ্য ও সর্বাধিক জনপ্রিয় জায়গা। এখানকার রাধানগর বিচ বিশ্বের সেরা দশটি সমুদ্রসৈকতের অন্যতম। পোর্টব্লেয়ার থেকে সরকারি ফেরি ছাড়াও কয়েকটি প্রাইভেট সংস্থার বিলাসবহুল ফেরিও চলে। 'Makruzz' এদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের টিকিট এতেই। এখানেই অমৃতা, আমার ইস্কুলতুতো বোনের সঙ্গে দেখা। কী মিষ্টি ওর কন্যাটি। যদিও জ্বরে ভুগে বেচারি ভালো করে ঘুরতে পারছে না। অভিষেকের একটু সি-সিকনেস হল দেখলাম এই জাহাজে। আগেই গুগল-এ রিভিউ দেখেছিলাম যে অনেকেরই এই সমস্যা হয় আর তাই নিয়ে নিজেই খুব চিন্তিত ছিলাম। তবে আমার কোনও অসুবিধা হল না। দেড় ঘন্টার জায়গায় পৌঁছতে প্রায় দু'ঘন্টা সময় লেগে গেল। হ্যাভলক জেটিতে পুগালের বন্ধু কান্নানের গাড়ি নাম-লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষা করছে। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এখানকার দায়িত্বও পুগাল নিয়েছে। তার বন্ধুর গাড়ি ও হোটেল ঠিক করে রেখেছে। হোটেল কেমন হবে তা নিয়ে একটু ভাবনা ছিল, কিন্তু পৌঁছে খুব পছন্দ হয়ে গেল। এটি হ্যাভলক-এর বিজয়নগর বিচ (বিচ নং. ৫)-এ । এখানেও হোটেল কর্মচারীরা সবাই বাঙালি। খাওয়া-দাওয়াও খুব ভালো, একদম ঘরোয়া রান্না। পুরো হোটেল পরিসরটাই খুব সুন্দর। অসংখ্য নারকেল আর সুপারি গাছ। আর সবথেকে ভালো ব্যাপারটা হল হোটেলের ঠিক পেছনেই বিচ। প্রাইভেট বিচই বলা যেতে পারে এটাকে। যেকোনও সময় এই বিচে অবারিত দ্বার।
আমরা সকালে স্নান-টান সেরেই এসেছি। তাই এসেই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে শুরু করলাম বিচে এসে নারকেল গাছের ছায়ায় বসে। একটি বিদেশি দম্পতি এখানে একমাস থাকার প্ল্যান করে এসেছে! অবশ্য সুযোগ থাকলে আমারও তা করতে কোনও অসুবিধে নেই। জাহাজে আসতে আসতেই কিছুটা বুঝেছি, এখানে পৌঁছে আরও ভালো করে উপলব্ধি করলাম কেন হ্যাভলক নিয়ে ভ্রমণার্থীদের মধ্যে এত উন্মাদনা থাকে। কোনও এক সুদক্ষ চিত্রকর এখানকার সমুদ্রের ক্যানভাসে ইচ্ছেমত খেলা করেছে তার প্যালেট-এর নীল আর সবুজ রং নিয়ে। এই রং-এর কী নাম দেওয়া যায় আমি জানি না (যদিও নানা জায়গায় দেখেছি এটাকে Emareld Blue বলা হয়েছে, কিন্তু একে যেন কোনও নামে বেঁধে রাখা যায়না, এমনই তার বৈচিত্র্য)। খেলতে খেলতে কখন এক সময় রং ফুরিয়ে গেছে, তাই আর সমুদ্রতটে রং দিতে পারেননি শিল্পী। বালির রং তাই চোখে পড়ার মতো সাদা। আর এই যুগ্ম বৈপরীত্য রচনা করেছে এক অতুলনীয় ছবি। হ্যাঁ, পুরো জায়গাটা ছবির মতই সুন্দর। চোখের সামনে যেন কোনো এক বিশাল ক্যালেন্ডারের পাতা টাঙিয়ে দিয়েছে কেউ, অথবা এক সুবিশাল স্ক্রিনে ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ট্রাভেল শো চলছে! নাহলে বাস্তব কি এমন সুন্দর হতে পারে? এমন সৌন্দর্য ছেড়ে কেন কেউ বিদেশ ভ্রমণের কথা ভাবে?
সৈকতের নারকেল গাছগুলোর সঙ্গে সমুদ্রের জলের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। রোদে-ছায়ায়, আলো-আঁধারিতে তাদের গোপন প্রেমালাপ চলছে যুগ যুগ ধরে। সমুদ্র শীতল হাওয়ার মধ্য দিয়ে তার প্রেম নারকেল গাছকে নিবেদন করে, আর গাছ তার পাতার শনশন আওয়াজে সম্মতি জানায়। কখনও বা নিজেকে সমুদ্রের কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে ঝুঁকে পড়ে তার বুকে। ঢেউ এসে তাকে ছোঁয়, দিয়ে যায় চুম্বন। এই প্রেমকাহিনি দেখার জন্যে তো সারাদিন বসে থাকা যায়। কিন্তু এই কল্পনার জগত ছেড়ে বাস্তবে ফিরতে হয় খিদের টানে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিকেল হলে আমরা গেলাম 'কালাপাত্থর বিচ।' দিনের আলাদা আলাদা সময় সমুদ্র আলাদা আলাদা সাজে নিজেকে সাজায়। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় তখন তার পরনের বসনে অন্য রং। এখানে সমুদ্রতটের একদিকে প্রচুর মৃত প্রবাল। বিশাল বিশাল পাথরের মত ছড়িয়ে আছে। হয়ত সেই কারণেই বিচের নামকরণ। অন্য দিকে এদের আধিক্য তেমন নেই। বরং সাদা বালির বুকে মাঝে মাঝেই পড়ে আছে ভাঙা গাছের গুঁড়ি। এদের দেখেও নানারকম 'কাটুম কুটুম' কল্পনা করা যায়। কোনোটা যেন বীর শহিদ, প্রাণ ত্যাগ করেও হাতের মশালটা উঁচু করে ধরে রেখেছে। কোনটা আবার অলস ভঙ্গিতে এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলে শুয়ে থাকা কোনও মানুষ। ভাবনার পরিধি তো কোনো গন্ডিতে বাঁধা যায়না, মনকে যত উদার করা যায়, ভাবনা ততটাই বিস্তৃত। তাই যেমন ইচ্ছে ভাবি, আমার ভাবনার জগতটা তো শুধুই আমার। বাধা দেওয়ার জন্যে এখানে পর্যটকদের ভিড়ও নেই বললেই চলে। ভাবতে ভাবতেই হাঁটছি, সাদা ভেজা বালির বুকে সবুজ শ্যাওলা মাখা ছোট ছোট প্রবালগুলো রচনা করেছে এক নৈসর্গিক রূপ।
সারা আকাশ জুড়ে অস্তরাগের নেশা ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য আজকের মত বিদায় নিল। আকাশের মেঘগুলো পাঠশালার কচি কচি ছেলেগুলোর মত। হেডস্যার চলে যেতেই নিজেরা রং পেন্সিল নিয়ে দুষ্টুমি শুরু করে। আকাশে ছেলেমানুষি আঁকিবুঁকি কাটে। একসময় তারাও বিদায় নেয়। আকাশও ঘুমিয়ে পড়ে। আগামী দিনের আশা বুকে বাঁচিয়ে রেখে। আমরাও ফিরে আসি, চোখে অনেক মায়া, অনেক আলো মাখিয়ে।
৩.২.২০১৭ :
সকালে যখন ঘুম ভাঙল, বাইরে তখনও অন্ধকার। সামান্য আলো ফুটতেই বেরোলাম, পেছনের বিচটা থেকে সানরাইজ দেখা যায়। পৌঁছে দেখলাম তিন-চারজন বিদেশি ছেলে মেয়ে ধ্যান করছে সমুদ্রতীরে বসে। ভোরের প্রথম আলোয়, মৃদুমন্দ বাতাসে, ঢেউদের আনাগোনায় মন সত্যিই শান্তিতে ভরে ওঠে এখানে। রাত্রির আঁধারের আঁচল ছিঁড়ে সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি যখন দেখা দেয়, আকাশ রাঙিয়ে ওঠা লজ্জায় তখন বরণ করে নেয় আর একটি নতুন সকাল।
প্রাত:রাশ সেরে তড়িঘড়ি চলে এলাম জেটিতে। এলিফ্যান্ট বিচ যাওয়ার টিকিটের জন্যে ফর্ম জমা করে অপেক্ষা করছি বোটের। আমাদের নাম যখন ডাকা হল, টিকিট সংগ্রহ করে বোটের কাছে এসে দেখলাম আমাদের সহযাত্রী বেঙ্গালুরুর এক পরিবার, স্বামী-স্ত্রী আর দুই ছোট বাচ্চা। কনিষ্ঠটি তো সাংঘাতিক মিষ্টি! জেটি থেকে এলিফ্যান্ট বিচে পৌঁছতে প্রায় আধঘন্টা মত সময় লাগে। এখানে একটি অসাধারণ কোরাল রিফ আছে, তাও আবার খুব কম গভীরতায়। স্নর্কেলিং এর জন্যে আদর্শ এই বিচ। এখানেও বোট কর্তৃপক্ষ থেকে একটি কম সময়ের স্নর্কেলিং করানো হয়, টিকিটের দামের মধ্যেই এটা অন্তর্গত। তবে এতে স্বাদ মিটবে না। আলাদা করে আর একটি করা যায়, যেটাতে কোরাল রিফের বেশি আকর্ষণীয় অংশগুলো ঘুরিয়ে দেখানো হয়। একবার স্কুবা করে আমার সাহস এখন তুঙ্গে, আর রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশাও টগবগ করে ফুটছে। সুতরাং আবার নেমে পড়লাম জলে। স্নর্কেলিং-এ অবশ্য স্কুবার মত জলের নিচে ডুব দিতে হয়না। টিউবের সাহায্যে জলের ওপর ভেসে থেকে শুধু জলের নিচে দেখতে হয়। এখানেও বৈচিত্রের বিপুল সম্ভার। কতরকমের মাছ আর প্রবালই যে দেখলাম! অভিজ্ঞতার তূণীরে আরো একটি পালকের সংযোজন হল আজ।
এখানে সি-ওয়াকও হয়, কিন্তু সেদিন আর জায়গা ফাঁকা ছিল না। আমাদের তেমন ইচ্ছেও ছিল না আরও একবার জলে নামতে। ফিরতি বোটে ফিরে এলাম হ্যাভলক জেটিতে। সেখান থেকে রিসর্টে। ভেজা জামা কাপড় যদিও পাল্টে নিয়েছিলাম ওখানেই, কিন্তু সারা গায়ে তখনও বালি ভর্তি। ভালো করে স্নান সেরে নিলাম এসেই। আজ বিকেলে যাব সেই বহুচর্চিত রাধানগর বিচে। বেশ উত্তেজনায় ভরে আছে মন।
রাধানগর বিচে পৌঁছে কিন্তু উত্তেজনা বেশ খানিকটা দমে গেল। এত ভালো ভালো কথা শুনেছিলাম, এত ভালো ভালো রিভিউ পড়েছিলাম, এমনকি আমার বান্ধবী নিবেদিতাও তার আন্দামানের সামান্য কয়েকটি ভালো লাগার জিনিসের মধ্যে এটিকে রেখেছে, তাই হয়ত জায়গাটার থেকে প্রত্যাশা বেড়ে গেছিল অনেকটা। ততটা কিন্তু পেলাম না। হতে পারে সেটা অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে, বা অন্য কিছু – ঠিক বুঝিনি। কিন্তু কিসের যেন একটা অভাব অনুভূত হল। এই ক'দিনে বাকি জায়গাগুলো যতটা আপন মনে হয়েছিল, এখানে যেন সেই আত্মিক টানটা নেই। হয়ত আমারই অক্ষমতা, কিন্তু এই জায়গাটাকে আমি নিজের করে নিতে পারলাম না। তা বলে অবশ্য এর সৌন্দর্যকে ছোট করার কোনও অবকাশ নেই। অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকতটিতে সেই সাদা আর নীলের বৈপরীত্য। ভিড় এড়াতে আমি যথারীতি হাঁটা দিলাম প্রান্তের দিকে। সমুদ্রসৈকতে দূর থেকে দেখে মনে হয় ওই অর্ধচন্দ্রের ঠিক কোনাটাতে পৌঁছলেই সমুদ্রের মধ্যে চলে যাব। কিন্তু সেই কোণটা আর কখনই খুঁজে পাওয়া যায়না! যাওয়া, আসা সব সারা হয়ে গেল, সূর্য এখনও বেশ উঁচুতে, কড়া চোখে অতিউচ্ছ্বাসী জনগণকে নজরে রাখছে। আমি বসলাম একটা ছাউনির তলায়, অভিষেক গেল ডাব কিনতে। ঠিক এমন সময় চোখে পড়ল – একটা শিমুল গাছ। আগত বসন্তের বার্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার লাল বসনে। এই প্রথম রাধানগরকে ভালো লাগল, একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প যেন সেই ক্ষণিক মুহূর্তে লেখা হয়ে গেল গোপনে।
ডাব খেতে খেতেই দেখি সুয্যি পাটে নামছেন। আবার সেই মায়ার খেলা, সেই মায়াবী আলো, সেই রঙের নেশায় মাতোয়ারা চারপাশ। আরো একবার আচ্ছন্ন হয়ে ফিরে এলাম। কালকেই চলে যাব এখান থেকে। তাই ইচ্ছে করছে আরও একটু ছুঁয়ে থাকতে, আরও একটু গন্ধ মাখতে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরও ছবি ~
পছন্দের বই আর গান পেলে বাকী পৃথিবীকে আলাদা করে দিতে সময় লাগে না পর্ণা সাহানার। প্রিয় অবসর বিনোদন নানারকম রান্না আর হস্তশিল্প। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রালয়ে কর্মরতা। নিজের হাতে সংসার গোছানোয় বিশেষ যত্নশীল। মাঝে মাঝেই মুক্তির আনন্দে বেরিয়ে পড়া কারণ ছোটবেলা থেকেই পায়ের তলায় সর্ষে।