এবার ভুটান
দেবাশিস বসু
~ ভুটানের তথ্য ~ ভুটানের আরও ছবি ~
এবার গেছিলাম ভুটানে। ব্যবস্থাপনায় মুম্বাইবাসী বন্ধু শ্রীমান রুদ্র ও তার সহযোগীরা। দলের নাম 'মিলন মঞ্চ ট্র্যাভেলস।' মুম্বাই, দিল্লি, বেংগালুরু ও কলকাতা থেকে সমাগত দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই প্রবীণ-প্রবীণা, মোট তেইশজন। ২৬ মার্চ ২০১৬ শেয়ালদা থেকে রওনা হলাম; দুপুরে পৌনে দুটো নাগাদ, তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে। আমরা যে সবাই একসূত্রে বাঁধা পড়ে ছিলাম ও তা এখনও অটুট আছে, আর হয়তো থাকবেও, তার কারণ সবাই বেড়াতে ভালবাসি। সকলেই প্রবীণ হলেও কিন্তু হৈ-চৈ কম হয় নি।
পরের দিন ২৭ মার্চ সকালে নিউ আলিপুরদুয়ার পৌঁছালাম। আকাশ সামান্য মেঘলা থাকলেও দলের সদস্যেরা মানসিকভাবে তারুণ্যে ভরপুর। বেড়ানোর আনন্দে, কারও পোষা হাঁটুর ব্যথা, কারও কোমর ব্যথা, কারও মাথা ঝিমঝিম কিম্বা কারও বুক ঢিপঢিপ - সব বেমালুম গায়েব। আমাদের জন্য একটা বাস ও একটা গাড়ি নিয়ে হাজির তিনজন সদাহাস্যময়, মিশুকে ও পরিশ্রমী ভুটানি যুবক। গাইড শ্রীমান বিষ্ণু, বাসচালক শ্রীমান সুরেশ ও ট্যুর অপারেটর সংস্থার মালিক এবং গাড়ির ড্রাইভার শ্রীমান কেলভিন। ওদের সঙ্গ ও ব্যবহার খুবই আনন্দদায়ক হয়েছিল আমাদের কাছে।
যাই হোক, সকাল পৌনে আটটা নাগাদ নিউ আলিপুরদুয়ার রেলস্টেশন থেকে রওনা হলাম। পথে পড়ল হাসিমারা, জয়গাঁও - এই অবধি ভারতবর্ষ, এরপরে ভুটানে ঢুকব। একটা সুন্দর পাকা তোরণ পেরোলাম – এটাই ভুটানের প্রবেশপথ। ওপারে ফুন্টশোলিং। তোরণ পেরোবার মিনিট তিন-চার পরে, সকাল সাড়ে নটা নাগাদ পৌঁছালাম হোটেল অর্কিড-এ। খানিক আড্ডা, খাওয়া দাওয়া আর একটু বিশ্রাম নিয়ে শহর দেখতে বেরোলাম।
হিমালয়ের দক্ষিণাংশে সবুজ গাছ-গাছালি, তুষারাবৃত রজতশুভ্র শৃঙ্গরাজি, দুরন্ত পাহাড়ি নদী, ঝরনা, সাইপ্রাস, পাইন, চেরি, আপেল ইত্যাদি গাছের সমারোহ, আর ঝকঝকে নীল আকাশ, রাতে তারাদের চাঁদোয়া এইসব নিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছবির মত দেশ, ভারতের প্রতিবেশী, পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া, ছোট্ট ভুটান।
বেরোতে বেরোতে প্রায় বেলা দেড়টা বেজে গিয়েছিল, আবহাওয়া কিঞ্চিদধিক গরমের দিকেই। রাজপরিবারের অন্যতম প্রাসাদ, একটি গুম্ফা আর ঘড়িয়াল প্রজনন ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র ঘুরে, বিকেল সাড়ে তিনটেয় হোটেলে ফিরলাম। ঘন্টা দুয়েকের সান্ধ্যবাসরে জড়ো হলাম এরপরে, একে অপরের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হওয়ার জন্য। আলাপ-পরিচয় সারা হলে হট ড্রিংকসের সঙ্গে গান, কবিতা, ম্যাজিক ইত্যাদি নিয়ে আসর সরগরম হয়ে গেল।
২৮ মার্চ ২০১৬, সোমবার। আবহাওয়া শেষ রাত্তির থেকে বেশ খারাপ - প্রবল ঝড় আর সেইসঙ্গে বৃষ্টি। আকাশ গুরুগম্ভীর আর তার প্রতিফলন আমাদের মুখেও। আজ যেতেই হবে ইমিগ্রেশন অফিসে পারমিটের জন্যে। যাইহোক শেষপর্যন্ত আকাশের মুখ প্রসন্ন হল, সেই সঙ্গে আমাদেরও। ভিড় থাকলেও বেলা এগারটার মধ্যেই পারমিট মিলল সকলেরই। হোটেলে ফিরে বাসের মাথায় লাগেজ তুলে, ফুন্টশোলিংকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে প্রথমেই রিনচেনডিং ইমিগ্রশন চেকপোস্টে পারমিট দেখাতে হল। গেদুতে টি ব্রেক। ডিলাক্স টু কিং রেস্তোঁরায় লাঞ্চ শেষ হতে হতে বিকেল তিনটে বেজে গেল। ছাপছা পেরিয়ে তালালুং চেক পোস্টে ফের ফের একবার পারমিট চেকিং-এর পালা মিটিয়ে থিম্পুর হোটেলে ঢুকতে সন্ধে ছটা বেজে গেল। সান্ধ্যআসর, ডিনার সেরে বিশ্রামের পালা।
২৯ মার্চ, মঙ্গলবার। সকাল সাড়ে নটায় ব্রেকফাস্ট সেরে থিম্পু্ থেকে বেরোনো হল। প্রথম গন্তব্য পাহাড়ের ওপর কুয়েনসেল ফোদরং নেচার পার্ক। এখানে হংকং-এ তৈরি ব্রোঞ্জের ভুটানি গঠনশৈলীর বিশ্বের অন্যতম উঁচু বুদ্ধমূর্তিটি (৫১ মিটার ) দেখে দারুণ লাগল। সূর্যের আলোয় সোনার মতো চকচক করছে মূর্তিটি। এই বুদ্ধমূর্তির বেদীতে ব্রোঞ্জের প্রচুর ছোট ছোট বুদ্ধমূর্তি আছে, গাইডের কথানুসারে ৮ ইঞ্চি মূর্তির সংখ্যা ১ লক্ষ ও ১২ ইঞ্চির ২৫ হাজারটি। ৩১০০ মিটার উঁচু দোচুলা পাস-এ পৌঁছালাম দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ। ছবির মতো দৃশ্য চারপাশের। চলার পথে কুমার রেস্তোঁরায় দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারা হল। পরবর্তী গন্তব্য পুনাখা জং। পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে এল। এই জং ভুটান দেশটির প্রতিষ্ঠাতা জাহবদ্রুং রিমপোচে নগয়াং নামগিয়েল ১৬৩৭ সালে তৈরি করান, ফো-চু ও মো-চু দুই নদীর সঙ্গমস্থলে এটির অবস্থান - পোশাকি নাম পুংতাং ডেচেং ফোতরাং। এখানে একটি সুন্দর সোনার বুদ্ধমূর্তি আছে।
৩০ মার্চ, বুধবার। সকাল সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। পথেই ব্রেকফাস্ট। ২৮৮৫ মিটার উঁচু পিলে লা পাস পৌঁছে শুধু প্রকৃতির দিকে চেয়ে মুগ্ধ হওয়া। পথে ধ্বসে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাস্তায় দুবার আটকা পড়লাম। পথের শেষে আরেকটা নাম না জানা পাস-এ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফেরা।
৩১ মার্চ, বৃহস্পতিবার। আজকের প্রথম গন্তব্য জাম্বে লাখাং - ভুটানিদের উপাসনাস্থল। সপ্তম শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন তিব্বতী রাজা সংগতসেন গাম্পো। মন্দিরের বাইরে নানান ভুটানি হস্তশিল্পসম্ভার বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে নানা মাপের বিশেষ ধাতুর বাটি আর তার সংগে কাঠি। বাটির ধারে ঐ কাঠি ছুঁইয়ে আস্তে আস্তে ঘোরালে সুন্দর মিষ্টি আওয়াজ শোনা যায়, যার সঙ্গে মিল আছে "ওম্ মণিপদ্মে হুম" মন্ত্রোচ্চারণের। এরপর কুর্জে লাখাং। কথিত আছে গুরু রিমপোচে এখানে তপস্যা করেছিলেন ও তাঁর পদচিহ্ন সংবলিত পাথরটি প্রতিষ্ঠিত। এখানে সব মিলিয়ে তিনটি বৌদ্ধ মন্দির। আরও জানা গেল, কাছের একটি জলাশয়ও গুরু রিমপোচে তৈরি করেন। যার জল স্থানীয় অধিবাসীরা খুব পবিত্র বলে বিশ্বাস করেন। পরের গন্তব্য তামসিং লাখাং ও তারপর এখানকার বিখ্যাত চিজ ও ওয়াইন ফ্যাকটরি এবং বিক্রয়কেন্দ্র। পথে লাঞ্চ সেরে পৌঁছলাম বার্নিং লেক, যাকে ভুটানি ভাষায় বলে 'মেবার শো (Mebar Tsho)'। কথিত আছে যে ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে টের্টন পেমা লিংপা নামের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দেখতে পান যে শত শত বছর আগে গুরু রিমপোচে এই জলাশয়ে কিছু পবিত্র সম্পদ লুকিয়ে রেখে গেছেন। স্থানীয় শাসক ও বাসিন্দারা তাঁর কথা বিশ্বাস না করায় সন্ন্যাসী জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে ওই জলাশয়ে ডুব দেন। কিছুক্ষণ পরে একটি মূর্তি, পুঁথি ও মড়ার খুলি নিয়ে জল থেকে উঠে আসেন। তখনও জ্বলছিল সেই প্রদীপ। তারপর থেকে জলাশয়টির এইরকম নামকরণ হয়। ভুটানিদের অন্যতম তীর্থ এই লেক।
আজ বেশ কিছু নতুন শব্দের অর্থ জানলাম। লাখাং (Lhakhang) – বৌদ্ধ মন্দির বা উপাসনাগৃহ। গুম্ফার চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ছোট। চোর্তেন - বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর স্মৃতিতে নির্মিত বিশেষ আকৃতির স্থাপত্য। জং(Dzong) - প্রশাসনিক দপ্তর, ভুটানিদের উচ্চারণে জোংখা (Dzongkha)।
১ এপ্রিল ২০১৬, শুক্রবার। সকাল আটটা নাগাদ বুমথাং থেকে রওনা হলাম। পথে একটি হস্তশিল্পের দোকানে ঘুরে দেখে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। কেউ কেউ কিছু কেনাকাটাও সেরে নিলেন। আশেপাশে প্রচুর সাদা ও ম্যাজেন্টা রং-এর চেরিফুলে গাছ ভরে আছে। ছোট জনপদ ট্রোংসাতে ছোট্ট একটা বিরতি হল পথে, পারমিট চেক হল। সোয়া ছটা নাগাদ পৌঁছালাম ফোবজিখা ভ্যালির হোটেল তাশিলিং-এ।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। অক্টোবরের শেষের দিকে তিব্বত থেকে আসা পরিযায়ী পাখিদের শীতের ঠিকানা এই জায়গা। যার মধ্যে অন্যতম প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে আসা ব্ল্যাক নেকড ক্রেন(Black-necked crane)। ভুটানের রাজার তত্ত্বাবধানে ও জাপান সরকারের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশান অফ নেচার-এর পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। চারধারে সবুজ পাহাড় ঘেরা, সুদূর বিস্তৃত সবুজ এই উপত্যকা, মাঝে দুটি পাহাড়ি নদীর শীর্ণ ধারা - নাকে চু আর ফাগ চু। এই ভ্যালি-পাহাড়, নদী, বাড়িঘর, সবুজের নানা শেড নিয়ে যে ল্যান্ডস্কেপ, তা নাকি সুইৎজারল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডের চেয়েও সুন্দর, এই রকম শোনা গেল কয়েকজন সহযাত্রীদের কাছে। এই মরসুমে ভর সন্ধ্যেবেলায় অবশ্য আমরা একটাও জ্যান্ত পাখি দেখতে পাইনি। খোলা আকাশের নিচে ব্ল্যাক নেকড ক্রেনের একটা প্রতিমূর্তি দেখেই সন্তুষ্ট হতে হল। তবে সবচেয়ে ভালো লাগল ছোট একটা অডিটরিয়ামে দেখা পরিযায়ী পাখিদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ওপর সুন্দর ডকুমেন্টারি ফিল্মটি।
২ এপ্রিল - শনিবার। সকালে কাছেই এক বুদ্ধমন্দির থেকে ঘুরে এসে, জলখাবার সেরে রওনা হলাম। আবার পথ চলা, যদিও হেঁটে নয়, বাস ও গাড়িতে। রাস্তা যথেষ্ট ভাল, আশপাশের প্রকৃতিও খুব সুন্দর। তবু পথের ক্লান্তি দূর করতে গাড়ির মাইকে গান, কবিতা, গল্পবলা ইত্যাদি চলতে থাকে। দুপুরে মেসিনা নামে একটা জায়গায় লাঞ্চ। প্রায় বেলা তিনটে নাগাদ দো-চু লা পেরোলাম। থিম্পুকে এড়িয়ে বাইপাস ধরে সোজা পারো এয়ারপোর্ট। উঁচু রাস্তার ডানদিকে পারো নদীর ধারে বেশ নিচে, ছোট হলেও খুব সুন্দর বিমান বন্দরটি। ঠিক যেন পিকচার পোস্টকার্ড কিংবা অত্যন্ত কুশলী হাতে সাজানো ঝুলনের দৃশ্য।
৩ এপ্রিল - রবিবার। হোটেলে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল। খানিক বাদেই যে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছালাম, তার নাম - কপার কালার মাউন্টেন। খানিকটা ঘেরা ঢাকা জায়গার নীচে কয়েকটা সিমেন্টের বেদীর মত করা আছে, যেমন অনেক বাজারে থাকে। সেখানে স্থানীয় হস্তশিল্পের নিদর্শনস্বরূপ পুঁথি ও পাথরের মালা, ধাতুর বুদ্ধমূর্তি এসব বিক্রি হচ্ছে। এর পরেই যে ট্রেকিং পথের শুরু তা যাবে তাকশাং মনাস্ট্রি বা টাইগার নেস্টে। অনেক উঁচুতে, বেশ দূরে এই মনাস্ট্রি দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পুরো মনাস্ট্রিটাই পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে বা ঝুলছে। শোনা যায়, দ্বিতীয় বুদ্ধ বলে খ্যাত অষ্টম শতকের ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মগুরু রিমপোচে বা গুরু পদ্মসম্ভব তিব্বত থেকে বাঘিনীর পিঠে সওয়ার হয়ে উড়ে এসেছিলেন ও এই জায়গাটিকে ধ্যান করার জন্য উপযুক্ত স্থান বলে বেছে নিয়েছিলেন। এই দুরূহ ও ভয়ঙ্কর সুন্দর সুপ্রাচীন মনাস্ট্রিটি গড়ে ওঠে ১৬৯২ খ্রীষ্টাব্দে। কিন্তু ১৯৯১ সালে এক বিধ্বংসী আগুনে তা ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে, তৎকালীন রাজা জিগমে সিগমে ওয়াংচুক, সাত বছর ধরে ১৩৫ মিলিয়ন নগুলত্রাম (ভুটানি টাকা) খরচ করে আবারও তৈরি করান। ২০০৫ সাল থেকে আবার দর্শনার্থীদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়। ভুটানে এসে এই স্থান অবশ্যই দ্রষ্টব্য, কিন্তু পথ মোটেই সহজ নয়। একদিকে প্রায় সবটাই গভীর খাদ, অন্যপাশে খাড়া পাহাড়, মাঝে শীর্ণ রাস্তা বা সিঁড়ি। মনের জোর, বুকের জোর আর পায়ের জোর যথেষ্ট বেশি থাকলে, তবেই চেষ্টা করা ভাল। উঠতে অন্তত ঘন্টা তিনেক ও নেমে আসতে আরও ঘন্টা দুয়েক লাগতেই পারে। আমাদের মধ্যে চারজন সাড়ে দশটায় রওনা হয়ে, ফিরেছেন সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ। পারোর উচ্চতা মোটামুটি ২২০০ মিটার, মনাস্ট্রিটি আরো প্রায় ৯০০ মি উঁচুতে।
দলের বাকি যারা যাইনি বা যেতে পারিনি, তারা সারাদিনে অন্য কয়েকটা জায়গা ঘুরে নিলাম। প্রথমে গেলাম দ্রুকগিয়েল জং। এই জং-টি তৈরি করান ভুটান দেশটির প্রতিষ্ঠাতা জাহবদ্রুং রিমপোচে নগয়াং নামগিয়েল, ১৬৪৯-এ। এটিও আগুনে পুড়ে যায় ১৯৫১-য়, পরে সংস্কার করা হয়। পরে আরেকটি জং-এ যাওয়া হল - নাম মনে নেই, খুব সম্ভব রিনপুং জং। এখানে বাইরের চত্বরে চেরি ও অন্যান্য খুব সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ আছে। ভেতরের চত্বরে বা উঠোনে, ফুলগাছের পাশাপাশি কমলালেবু গাছও আছে আর তাতে ফলও ধরেছে। এখান থেকে গেলাম তা-জং বা ন্যাশনাল মিউজিয়াম দেখতে। এটি একটি গোলাকার স্থাপত্য, অনেকটা দুর্গের দেওয়ালের কোণে যেমন থাকে। আসলে এটি তৈরি হয়েছিল রিনপুং জং-কে রক্ষা করা ও নজরদারির জন্য। ১৯৬৭তে একে দ্বিতীয় সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করা হয়। অন্যান্য মিউজিয়ামে যা যা থাকে, এখানেও মোটামুটি তা-ই আছে। যেমন প্রাচীন মূর্তি, পোষাক পরিচ্ছদ, অস্ত্রশস্ত্র আর অতীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র। বিকেল সোয়া চারটে নাগাদ হোটেলে ফিরে ট্রেকিং টিমের জন্য অপেক্ষা করা। তারা ফিরে এলে সান্ধ্যআড্ডাটা বেশ জমে উঠল।
৪ এপ্রিল, সোমবার। হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে, ৪০ কিমি. পথ পেরিয়ে, পৌঁছালাম চেলে-লা বা চেলে পাস, উচ্চতা ৩৮৮৮ মিটার। বেশ জোরে ঠান্ডা হাওয়া, যথেষ্ট গরম জামা ভেদ করে, হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। এবার ২৮ কিমি পথ পেরিয়ে হা জনপদে পৌঁছালাম। উচ্চতা ২৫০০ মিটার। থাকা হোটেল রিসুম রিসর্টে। এখানে এসেছি আমরা বেলা দেড়টায়। লাঞ্চের পরে বেরিয়ে পারো নদীর ধারে গেলাম। এখানে একটা ঝোলা ব্রিজ আছে, আর একটা ছোট টাওয়ার - যার ওপর উঠে আশপাশের দৃশ্য দেখা যায়। প্রায় সামনে রাস্তার উল্টোদিকে খেলার মাঠ ও কয়েকটি বিল্ডিং নিয়ে বিশাল কমপ্লেক্সে একটি কো-এড স্কুল রয়েছে। আর আছে ছোট একটি বাজার।
৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার। আজ আমাদের দীর্ঘ পথ - ২৩৩ কিমি যেতে হবে। তাই ভোর সাড়ে পাঁচটাতেই রওনা দিলাম। মনটা বেশ খারাপ, ভুটান বেড়ানো প্রায় শেষ। চলার পথে, সকাল নটা নাগাদ আধ ঘন্টার বিরতি প্রাতঃরাশ ও চা-এর জন্য। আবার একটা চেক পোস্ট। গেদু পেরোলাম পৌনে বারোটায়। রিনচেনডিং চেকপোস্টে পৌঁছতে দুপুর একটা বাজল। ফুন্টশোলিং-এ সেই হোটেল অর্কিডে পৌঁছে গেলাম তার পরেপরেই। মিনিট দশেকের বিরতির পরে ভুটানকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম।
জয়গাঁও-এ বৃষ্টি আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। লাঞ্চ খেয়ে রওনা। গ্রীন টাচ ডুয়ার্স ইকো রিসর্টে পৌঁছতে বিকেল হল। সুন্দর ব্যবস্থা, চারদিকে চা বাগান। এবারকার বেড়ানোর অদ্য শেষ রজনী, তাই সান্ধ্যআসর আরও জমজমাট। রাতে ভুরিভোজের ব্যবস্থাও ছিল।
শেষে কিছু জরুরি তথ্য জানিয়ে রাখি –
১) ভুটানের প্রবেশপথ সড়কপথে পশ্চিমবঙ্গের জয়গাঁও বা জয়গাঁ দিয়ে, অথবা আকাশপথে পারো দিয়ে।
২) ভারতীয়দের ভুটান যেতে পাসপোর্ট লাগে না, তবে লাগে পারমিট বা অনুমতিপত্র। এই পারমিট পাওয়া যাবে ফুন্টশোলিং-এর ইমিগ্রেশন অফিস থেকে। পারমিটের জন্য জমা দিতে হবে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ পাসপোর্ট/ভোটার আই ডি কার্ডের ফটোকপি ও দুটি সদ্যতোলা পাসপোর্ট সাইজ ছবি। সঙ্গে অবশ্যই রাখতে হবে অরিজিনাল পরিচয়পত্রটি। এই পারমিট পাওয়া যাবে কলকাতার ভুটান কন্স্যুলেট অফিস, টিভোলি কোর্ট, ১ এ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের অফিস থেকেও। কিন্তু কলকাতার পারমিট থাক বা নাই থাক, ভুটানে পৌঁছে যাত্রীকে ইমিগ্রেশন অফিসে বায়োমেট্রিক টেস্টের জন্য যেতেই হবে। ফুন্টশোলিং-এ পারমিট দেওয়া হয় সোম থেকে শুক্র, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা ও দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা (ভুটান সময় - যা ভারতীয় সময় থেকে আধঘন্টা এগিয়ে)। পারমিট মুখ্যত থিম্পুর জন্য। থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিসে সেটি দেখিয়ে, পুণাখা, হা, বুমথাং ইত্যাদি জায়গার জন্য পারমিট করাতে হবে, তবে, এর জন্য বেশি সময় লাগে না। ছবি ও পরিচয় পত্রের কয়েকটি বাড়তি কপি সঙ্গে রাখা ভাল।
৩) পারমিটের জন্য দরখাস্তে, ভুটানে কতদিন থাকতে চাই জানিয়ে যে তারিখ লিখতে হয়, তাতে ওখানে থাকার সময় ৫/৭ দিন বাড়িয়ে লেখা ভাল, কারণ উল্লিখিত তারিখ পেরিয়ে গেলে জেল বা বড় রকমের আর্থিক জরিমানা হতে পারে।
৪) ভারতীয় টাকা ও ভুটানি নগুলত্রাম সমান। মুদ্রা বিনিময়ের দরকার নেই। সব জায়গায় ভারতীয় টাকা চলে।
৫) ভুটানে প্রায় সর্বত্র পলিথিন প্যাকেট ব্যবহার ও ধূমপান নিষিদ্ধ।
৬) ভুটানে ভারতীয় মোবাইল সিম কাজ করে না, প্রয়োজনে ভুটানি সিম কার্ডের জন্য গাইডের পরামর্শ নিন।
৭) কোথাও ফটো তোলা যাবে কি যাবেনা তার জন্যও গাইডের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
সড়ক দূরত্ব -
ফুন্টশোলিং - থিম্পু - ১৭৬ কিমি, থিম্পু - পুনাখা - ৭৭ কিমি, পুনাখা - বুমথাং - ২০৮ কিমি, বুমথাং - ফোবজিখা - ৬৮ কিমি, ফোবজিখা - পারো - ২৫৩ কিমি, পারো - চেলে লা - ৪০ কিমি, চেলে লা – হা - ২৮ কিমি, হা - ফুন্টশোলিং - ২৩৩ কিমি
~ ভুটানের তথ্য ~ ভুটানের আরও ছবি ~
রেলের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দীর্ঘদিন পরও ঊনআশি বছরের তরুণ দেবাশিস বোসের একটা বড় সময় কাটে ভ্রমণেই।