ঘাটশিলার জঙ্গল-পাহাড়ে

তপন পাল


~ ঘাটশিলার তথ্য ~ ঘাটশিলার আরও ছবি ~


-১-
ঘাটশিলা আমি হামেশাই যাই। কিন্তু সে তো শুধু শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা। বাউড়িয়া থেকে সকাল দশটা বত্রিশে ৬৮০০৩ মেমু (Mainline Electric Multiple Unit - শহরতলি ও গ্রামীণ এলাকার জন্য ভারতীয় রেলের গণপরিবহন ব্যবস্থা) ধরে, জানালার পাশে বসে, দুপুর একটা পঞ্চাশে ঘাটশিলা পৌঁছানো; তারপর মিনিট পনের দাঁড়িয়ে, এপাশের জানালা থেকে ওপাশের জানালায় গিয়ে, ওই গাড়িতেই ফিরে আসা। ঘাটশিলা দুপুর দুটো পাঁচ, বাউড়িয়া পাঁচটা উনিশ, গাড়ির ক্রমিক ৬৮০০৪। তবে এই যাত্রাটা আমি খুব উপভোগ করি। প্যাসেঞ্জার গাড়ি, ভাড়া কম, কানা দামোদর, দামোদর, রূপনারায়ণ পেরিয়ে খড়গপুর। খড়গপুরের পর গাড়ি সব স্টেশনে থামে, স্থানীয় লোকজন ওঠে নামে, ভিড়ের চরিত্র ক্রমে বদলে যায়। কেলেঘাই কংসাবতী পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম। তারপর থেকে ভূচিত্র বদলায়। মাটির রং বদলে লাল। জানালায় সমতল, বাড়ি-ঘরের ওয়ালপেপারের পরিবর্তে আসে পাহাড় ও জঙ্গল, কাজলা গাং, ডুলুং নদী পেরিয়ে গিধনি, কানি মোহুলি; নিচু প্ল্যাটফর্ম বিলীন হয়ে গেছে দিগন্তে - জঙ্গল টাঁড় পেরিয়ে। চাকুলিয়া কোকপাড়া ধলভূমগড় পেরিয়েই ঘাটশিলা। তবে ওই আর কি, কে বলে 'যাও যাও'– আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া। ঘাটশিলা শহরটিকে ও তার পারিপার্শ্বিককে পাপচক্ষে দেখা হয়ে ওঠেনি মোটে। আর এজন্য বাড়িতেও মধ্যে মধ্যে গঞ্জনা শুনতে হয়, কারন পুত্র ভূতাত্ত্বিক এবং ছাত্রাবস্থা থেকেই ঘাটশিলার সঙ্গে তার প্রগাঢ় সখ্য।
তাই যখন জানা গেল যে ২০১৭-র ১০ই মার্চ থেকে ১২০২১ /১২০২২ হাওড়া-বরাবিল-হাওড়া জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ছমাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ঘাটশিলায় থামবে, যাওয়ার পথে সকাল নটা তেরোয় এবং ফেরার পথে বিকেল পাঁচটা একচল্লিশে, তখন আমার যে কী আনন্দ হল বলার নয়। যাক বাবা, উপরওয়ালা মুখ তুলে চেয়েছেন, এবারে আমার ঘাটশিলা দর্শন হবে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন এই ট্রেনটি চালু হয় তখন আমি থাকতাম হাওড়ার দানেশ শেখ লেনের এক সরকারি আবাসনে। রেলগাড়িটিকে দেখতে এক সকালে পুত্রকে নিয়ে মৌরিগ্রাম গিয়েছিলাম, তখন ইনি ছিলেন শতাব্দী; ছ কামরার।
তদনুযায়ী রবিবার দোসরা এপ্রিল সক্কালবেলা হাওড়া। ১২০২১ হাওড়া বরাবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস নতুন ঘাঁটিতে লম্বায়মান। আঠারো কামরার গাড়ি, ইঞ্জিন, এস এল আর, ডি ১ থেকে ডি ১১, ডি আর ১, তারপর সি ১ থেকে ৪, আবার এস এল আর। এই প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি যে কোন রেলগাড়ির রেকে উচ্চশ্রেণীর কামরাগুলির অবস্থান কোথায় হবে তা নিয়ে রেল কোম্পানির নির্দিষ্ট নীতি আছে। দেখতে হবে রেলগাড়িটির রেক কোন জোনের। সেই প্রান্তে উচ্চশ্রেণীর কামরাগুলি থাকবে। ১২৮৬০ গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস দক্ষিণ-পূর্ব রেলের গাড়ি, কিন্তু তার রেকটি পূর্বতট রেলপথের, তাই হাওড়া থেকে ছাড়ার সময় উচ্চশ্রেণির কামরাগুলি সামনের দিকে থাকে। প্রতিতুলনায়, ১২৩৪৫ সরাইঘাট বা ১২৩১৩ শিয়ালদহ রাজধানী পূর্বরেলের গাড়ি, রেকদুটিও পূর্ব রেলপথের, তাই যথাক্রমে হাওড়া বা শিয়ালদহ ছাড়ার সময় উচ্চশ্রেণীর কামরাগুলি পিছনের দিকে থাকে। আর এস এল আর মানে Seating Cum Luggage Rake যাতে গার্ড সাহেব থাকেন, লাগেজ ভ্যান থাকে বুক হওয়া মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য, আর কিছুটা জায়গা থাকে অসংরক্ষিত মহিলা এবং/ অথবা প্রতিবন্ধীদের বসার জন্য। এই কামরাগুলিতে পাঁচ জোড়া দরজা থাকে, তাই সহজেই গোচরযোগ্য। ভারতীয় রেলে সাধারণত প্রতি রেলগাড়িতে দুটি করে এস এল আর কামরা থাকে; একটি ইঞ্জিনের পরেই, অপরটি সবার শেষে।
জীবনস্মৃতিতে বালক রবীন্দ্রনাথ তাঁর হিমালয় বাসের কথা স্মরন করেই লিখেছেনঃ 'আমার যৌবনারম্ভে এক সময় আমার খেয়াল গিয়াছিল আমি গরুর গাড়িতে করিয়া গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরিয়া পেশোয়ার পর্যন্ত যাইবো। আমার এই প্রস্তাব কেহ অনুমোদন করেন নাই এবং ইহাতে আপত্তির বিষয় অনেক ছিলো। কিন্তূ আমার পিতাকে যখনই বলছিলাম তিনি বলিলেনঃ "এ তো খুব ভাল কথা, রেলগাড়িতে ভ্রমণ কে কি ভ্রমণ বলে।"' কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিক হলেও এই প্রসঙ্গে বলি, ঠিক এইরকমটাই আজকাল মনে হয় বিমানভ্রমণ প্রসঙ্গে। দেশে অভ্যন্তরীণ বিমানভাড়া এখন খুবই কম, ক্ষেত্র বিশেষে বাতানুকুলিত দ্বিতীয় শ্রেণীর চেয়েও কম। এর সঙ্গে সময় সংক্ষেপের ব্যাপারটাতো আছেই। তাই অফিসের কাজে অথবা বেড়াতে দূরে কোথাও গেলে আজকাল বিমানেই যাওয়া হয়। রেলগাড়িতে গেলে দেখি কিভাবে সময় ও অতিক্রান্ত দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে সহযাত্রীদের পোশাক-আশাক, মুখের ভাষা, খাবার দাবার, এমনকি চায়ের ভাঁড়ের আকার ও আকৃতিও বদলে যাচ্ছে। নতুন নতুন স্টেশনে গাড়ি থামছে, উঠছে সেখানকার বিখ্যাত খাবাররা, বর্ধমানের সীতাভোগ, মালদার আমসত্ত্ব, মেচেদার শিঙ্গাড়া। ছুটন্ত রেলগাড়ির জানালায় বসে গলা বাড়িয়ে না-থামা রেলষ্টেশনের নাম পড়তে পড়তে অদ্ভুতদর্শন নাম পেলে হেসে ওঠার অভিজ্ঞতা আমাদের সবায়েরই অল্পবিস্তর আছে। কালা বকরা বা ইব, সিঙ্গাপুর রোড বা চিঞ্চপক্লি, টুং বা ঘুম... রেলষ্টেশনের এমন নাম দেখলে কার না হাসি পায়? Llanfairpwllgwyngyllgogerychwyrndrobwllllantysiliogogogoch, নামে বিলেতে (ANGLESEY) একটি রেলষ্টেশন আছে বলে শুনেছি; তবে এ জীবনে তা দেখা হয়ে ওঠে নি। বিমানভ্রমণে সেসব কিছুই নেই, হুশ করে উঠল আর নামিয়ে দিল।
রেল মানে শুধুই দুটো লোহার পাতের ওপর দিয়ে ছুটে চলা এক গাড়ি নয়; উপমহাদেশে রেল সামাজিক প্রগতির অগ্রদূত। রেলব্যবস্থা যদি সামাজিক উন্নয়নের catalyst হয়, তবে ঐতিহাসিক পারম্পর্যটি বোঝার জন্য রেল ও বৃহত্তর সমাজের interface টি বোঝা অতীব জরুরি; বোঝা দরকার কিভাবে তারা একে অপরকে প্রভাবিত করেছিল ও একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো। বাঙালিকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে রেল বলা চলে। সহজ থেকে সহজতর হয়েছে যোগাযোগ রেলগাড়িতে। শান্তিলতা দেবীর তাই রেলপূর্ব সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গচিহাটায় যেতে লাগতো আড়াই দিন আর রেলগাড়ি হওয়ায় তা লাগল পাঁচ থেকে ছ'ঘন্টা। হিন্দু মুসলমান বৈষম্য ভেদাভেদ দূর করে রেল বাঙালিকে এনেছিল এক সুতোর মালায়। জাতিভেদ দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল রেলগাড়ির কামরা - তাইতো আঠারবাড়ি রেলষ্টেশনে ট্রেনের কামরায় শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী যখন কমলালেবু খেতে শুরু করেন সহযাত্রী মুসলমানের সামনে তখন হিন্দু যুবকের বারণ আর "কমলালেবুর জল আছে সেজন্য জলচরার নিয়মের অন্তর্ভুক্ত;" তা মানেননি।
আমাদের (গৌরবার্থে বহুবচন, নচেৎ এ অভাগা সঙ্গী পাবে কোথায়?) সংরক্ষিত বাতানুকুল শ্রেণির টিকিট। উঠে বসা গেল জানালার ধারে। যথাসময়ে (ছটা পঁচিশে) রেলগাড়ি ছাড়ল। পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে, পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া। যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া। তা আনন্দগান বড়ই জমজমাট, গাড়িটিতে ভক্ষ্য আহার্যের বড়ই পারিপাট্য। ঝালমুড়ি, মোচার চপ, সিঙ্গাড়া, টক দই, মিষ্টি দই, আমদই, ভুট্টাপোড়া, রসগোল্লা, স্যান্ডউইচ, ডিম টোস্ট, মাখন টোস্ট, নরম পানীয়, ফলের রস..., জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ। কিন্তু মানবজীবন ধন্য আর হল কই? ছোটবেলা থেকেই খেতে ভালবাসি, খাইও। কিন্তু সম্প্রতি দাঁত নিয়ে বিড়ম্বিত। দাঁত তো আর হৃৎপিণ্ড অথবা ফুসফুসের মত একটি দুটি নয়, গুনে গুনে বত্রিশটি। বিস্তর আর্থিক ও শারীরিক কষ্টস্বীকার করে একটি মেরামত করলে পাশের জন জানান দেয়, আমি আছি। তাকে মেরামত করলে তার পাশের জন; এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা যায় ডাক্তারবাবুরাও বিগতস্পৃহ হয়ে যান, ও কিছু না, বয়স হলে তো হবেই একটু। ছাত্রজীবন বা শুরুর কর্মজীবনের অনেক পরিচিত বন্ধু এখনও আমাকে মনে রেখেছেন খাওয়ার পরিমাণের জন্য। তারা এখন আমাকে দেখে আশ্চর্য হন। সেদিন কলেজের পুনর্মিলনে যখন একটি আইসক্রিম দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম, তাঁদের অনেকেই আক্ষেপ করছিলেন। তা সে যাকগে! চল্লিশ পেরলে সবারই তো একটি করে পোষা রোগ থাকে, আমার নাহয় পঞ্চান্ন পেরিয়ে দাঁত!! তবে কালোমেঘের অন্ধকারেও তো রুপালি রেখা থাকে। দাঁত নিয়ে বিড়ম্বিত হয়ে আমার ওজন অনেক কমে গেছে; আর তাইতে আমার ডাক্তারবাবু, আত্মীয়পরিজনরা খুব খুশি হয়েছেন।
ক্রিয়া যোগ, পুরী সাঁতরাগাছি, সম্বলপুর হাওড়া, শ্রী জগন্নাথ, সমরসত্ত, শিরোমণি, স্টিল, ইত্যাদি নানাবিধ রেলগাড়ি পেরিয়ে, চেনা পথ বেয়ে অবশেষে ঘাটশিলা। ঘড়িতে তখন সকাল নটা তের। খড়গপুরের পর থেকেই রেলগাড়িতে নিরাপত্তার আধিক্য চোখে পড়ছিল, ঘাটশিলায় রেলগাড়ি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তড়াক করে নেমে প্রতিটি দরজার মুখে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন; আমি ভাবলাম আমাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে বুঝি। সমুদ্রতলের ১০৩ মিটার উঁচুতে এই ষ্টেশন, তিনটে প্ল্যাটফর্ম, আর দুটোর কাজ চলছে। অপরদিকের প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছু লোক টাটানগর খড়গপুর মেমুর জন্য অপেক্ষারত আমাদের প্ল্যাটফর্মে ইস্পাতের জন্য।

-২-
ঘাটশিলায় পর্যটন পরিকাঠামোর অবস্থা ভয়াবহ। ষ্টেশনে গাড়িভাড়া পাওয়া গেলনা; বাতানুকূল গাড়ি তো দূরস্থান। অগত্যা এক অতিকায় অটো। আমার অভ্যাস আছে কোথাও বেড়াতে গেলে হোটেল থেকে কার্ড চেয়ে চেয়ে আনা, এবারে ছ'টা হোটেলে চেষ্টা করে মাত্র একটায় কার্ড পাওয়া গেল, তাও সেটা দু বছরের পুরনো; ঘরভাড়া ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে অনেকখানি। বাকিরা তো কার্ড চাই শুনে আকাশ থেকে পড়ল; কেন? কার্ড কী হবে? ঘর লাগলে বলুন! হোটেলগুলিতে হোটেলসুলভ ঝাঁ-চকচকে ভাবটাই নেই; গেরস্ত বাড়ির আটপৌরে ধূলিমলিনতা মাখা তার সর্বাঙ্গে। দুপুরের খাওয়া যা জুটলো সেটি আমি বলে খেতে পারলাম, আপনারা হলে পারতেন না। তবু, তবুও... ঘাটশিলা আমার খুব ভাল লেগেছে। কেন জানেন? সেখানে আর কেউ নেই বলে। যেখানে যাচ্ছি, আমিই সেখানে একতম পর্যটক। বাঙালি পর্যটকের দল কোত্থাও নেই, কেউ গুটখা খেয়ে থুথু ফেলছেনা; কেউ উচ্চৈঃস্বরে গান শুনছেনা, চেঁচিয়ে কথা বলছেনা, কেউ অটোওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করছেনা। আহা! কী যে শান্তি!

প্রথম বিরতি সুবর্ণরেখা রিভারপয়েন্ট। পাথর জেগে উঠেছে, এই এপ্রিলে জল কম। তার মধ্যেই প্রচুর নারীপুরুষ স্নানরত। শহরে জলাভাব, লোকজন গাড়ি, দ্বিচক্রযান নিয়ে চলে এসেছেন রবিবারে স্নান সারতে। সেখানে দাঁড়ানো গেল না, ফেরার পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মস্ত মস্ত ইঁদারা, রাজবাড়ি, রণকিনী কালীমন্দির। পুজো চলছে, বলির ব্যবস্থা আছে; এবং বলির পাঁঠাগুলি কালীঘাটের সহভাগ্যশালীদের মত কালো নয়, পাটকিলে বা বাদামি। সেখানেও দাঁড়ানো গেল না; দাঁত নিয়ে বিড়ম্বিত হয়ে ইস্তক বলি-তে আগ্রহ হারিয়েছি। অগত্যা রামকৃষ্ণ মিশন। দেখা গেল তীর্থস্থান না হলেও বাঙ্গালির সব ব্র্যান্ড সেখানে সগৌরবে উপস্থিত; রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, বাবা লোকনাথ... ।
অপুর পথ বেয়ে গৌরীকুঞ্জ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ - ১ নভেম্বর ১৯৫০) ভদ্রাসন। ১৯১৯ সালে হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়ায় দ্বারকানাথ হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাখ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পরই গৌরী দেবী কলেরায় মারা যান। অনেক পরে ১৩৪৭ সালের ১৭ অগ্রহায়ণ (ইংরেজি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৪০) তারিখে ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীকে বিয়ে করেন বয়সের বিপুল ব্যবধান সত্ত্বেও। তাঁদের পুত্র তারাদাসবাবু শ্যামনগরে আমাদের স্কুলে সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দী ও তার অব্যবহিত পরবর্তী যুগের বাংলার এ এক অদ্ভুত প্রহেলিকা। যে সেলেব্রিটিদের ততটা সামাজিক পরিশীলন ছিল না, ছিল না মেমসাহেব অথবা নিদেনপক্ষে বিদুষী রূপবতী স্ত্রী অথবা বান্ধবী, তারা কেউই কলকাতার অভিজাত সমাজে কল্কে পান নি; চলে যেতে হয়েছে দূরে। শরৎবাবু দেউলটি গিয়ে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন; বিদ্যাসাগর মশাই অথবা বিভূতিবাবুকে শান্তি ও সান্ত্বনা খুঁজতে হয়েছে আদিবাসীসঙ্গে।

সেখান থেকে রাতমোহনা। সুবর্ণরেখার তীরে এক উন্মুক্ত প্রান্তর যেখানে জ্যোৎস্না নাকি জোনাকির মত চিকমিকায়। এখানেও জল কম। পাথর জেগে উঠেছে। এবং যথারীতি নারীপুরুষ স্নানরত। চারদিকে বৈচিত্রময় পাথর ছড়ানো। ওই পাথরেই নাকি জ্যোৎস্না পড়ে ঝিকমিক করে! কৌতূহল হল, একটি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে কলকাতায় এসে এক ভূতাত্ত্বিককে দেখালাম। তিনি বললেন micaschist, এতে অভ্র আছে, তাই জ্যোৎস্না পড়ে ঝিকমিক করে। সন্দেহভঞ্জন হল, কিন্তু দুঃখ রয়েই গেল। এখন ঘাটশিলার যা পরিস্থিতি তাতে নাকি কেউই রাতে শহরের বাইরে ওই চরে যেতে সাহস করছেন না। তবে মনশ্চক্ষে দেখে নিলাম ওই বিস্তৃত প্রান্তরে, নীচে জল আর ওপরে আকাশকে রেখে, ছড়ানো পাথরে জ্যোৎস্না কতখানি মায়া বুনে দিতে পারে।
সেখান থেকে শহর পেরিয়ে অগণন টিলা আর জঙ্গল পার হয়ে বাসাডেরা গ্রাম। সারা রাস্তা আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো। অটো আর যাবে না, এখান থেকে আদিবাসী গাইড নিয়ে চড়াই পথে জঙ্গল চিরে আধঘণ্টা হাঁটলে ধারাগিরি জলপ্রপাত। বর্ষীয়ান আদিবাসী গাইডটি সকাল থেকেই মহুয়ামাতাল, সস্নেহে ডেকে বললেন, 'রোদে পুড়ে এসেছিস, আগে ইঁদারার হজমি জল খা! তোর বয়স কত রে?' বললাম ষাট, আটান্ন যদি না বোঝে! শুনে সে বলল, তার বয়স আশি। বিশ্বাস হল না। তবে সে সাবধান করে দিল, কাল রাতেও হাতি বেরিয়েছিল। হাতির মুখোমুখি পড়লে কী করতে হবে তাও সে বিমানবালিকাদের সিকিউরিটি ড্রিলের মত পাখি পড়া করে বুঝিয়ে দিল, ঝাঁপ দিয়ে পাশে সরে যেতে হবে, কোনক্রমেই হাতির যাত্রাপথে থাকা চলবে না। শুনে অপার নিস্পৃহতায় আমি হাসলাম; বিমানবালিকাদের অঙ্গভঙ্গি আমি কোনদিন দেখি না, বকবকানি শুনি না। আমি ঠিকই করে নিয়েছি যে কিছু হলে সিটেই বসে থাকব, যা হওয়ার হোক। যেদিন থেকে আমার পুত্র চাকরিতে ঢুকেছে সেদিন থেকে আমি সার সত্য বুঝে গেছি, যে আমার মৃত্যু কারোকে বিড়ম্বিত বিব্রত করবে না। তারপর পৌত্রীটি আসতে ফের বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয় বটে, তবে কে না জানে যে আমরা এমনই এসে ভেসে যাই –. আলোর মতন, হাসির মতন, কুসুমগন্ধরাশির মতন, হাওয়ার মতন, নেশার মতন, ঢেউয়ের মতন ভেসে যাই।

তবে হাঁটাপথটি ভারি উপভোগ করলাম। বনস্পতিময় অরণ্য চিরে, দিনের বেলাতেও অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে চড়াই পথে যাওয়া। ঝোপের ভিতর দিয়ে নীচু হয়ে উড়ে যায় বউ কথা কও (Black hooded Oriole, Orilus xanthornus), শ্যামা (White-rumped shama , Copsychus malabaricus)। বিগত রাত্রির নাদা নাদা হাতির টাটকা পুরীষ পেরিয়ে, এক পাথুরে অবয়বের সামনে। গ্রীষ্মে জল নেই, তবে বোঝা গেল বর্ষায় জায়গাটির রূপ খোলে, জল আছড়ে পড়ে প্রায় পঁচিশ তিরিশ ফুট ওপর থেকে। পায়ের কাছে একটি কুণ্ডের মত, তাইতে কিঞ্চিৎ জল; শোনা গেল সেটি বছরভরই থাকে। গাছের ছায়ায় ঘেরা জায়গা, রোদ খুব একটা আসে না, স্যাঁতসেঁতে ভাব, প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে শয়ে শয়ে, কমন মরমন (Papilio polytes) প্রজাতির, পুরুষ আছে, আর ওই প্রজাতির স্ত্রীর তিনটি বর্ণ বিন্যাসই (polymorphic), Cyrus, Romulus ও Stichius। অরণ্য, পাথর, জল, স্যাঁতসেঁতে ভাব, এইসব দেখে এক প্রজাতির জন্যে মন কেমন করতে লাগলো; এইই তো তাদের স্বাভাবিক আবাস, সেই যারা বুকে হেঁটে চলে। কোবরা গোত্রের সাপ এখানে না থাকাটাই আশ্চর্যের!
কুণ্ডের পাশে অবধারিত মন্দির, সিন্দুরলেপা চৌকো পাথর, ধর্মরাজের পোড়ামাটির ঘোড়া দুটি। গেরুয়া পরা এক সাধু। তিনি ঘুরঘুর করছিলেন তার মন্দির নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে। কৌতূহলবশে তাঁর আস্তানায় উঁকি দিতেই দেখা গেল ঠিক যা ভেবেছি তাই; ডগাবাঁকা একটি লাঠি। চেপে ধরতে স্বীকার করলেন গোখরো (Spectacled cobra , Naja naja) সেখানে আছে, এমনকি মধ্যে মধ্যে শঙ্খচূড়েরও (King cobra , Ophiophagus hannah) দেখা মেলে। সেখান থেকে ফিরে, বুরুন্ডি লেক। চার দিকে পাহাড়, মাঝে জলাধার, হু হু করে হাওয়া, জলের কাছাকাছি বলে গরমও বেশ কম। চারপাশে কেউ কোথাও নেই। কিছুক্ষণ বসে রইলাম, তারপর শহরে।

মধ্যাহ্নভোজন। জাতীয় সড়ক চওড়া হচ্ছে, পথিপার্শ্বস্থ হোটেল সব ভাঙা পড়েছে। সরে এসে তারা কায়ক্লেশে দিন কাটাচ্ছে। রাস্তার কাজ শেষ হলে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে বসবে। তারপর জাতীয় সড়কের গায়েই ফুলডুংরি টিলা, ঝরাপাতা মাড়িয়ে ঘুরে ঘুরে টঙে ওঠা। শুকনো পাতায় খড়খড় শব্দ তুলে রাস্তা পেরচ্ছিলেন এক সর্পদেবতা। প্রথমে ভেবেছিলাম দাঁড়াশ। কিন্তু ইনি দাঁড়াশের মত সোজা পথের পথিক নন, ইনি চলেন এঁকেবেঁকে (Lateral Undulation locomotion)। খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিত হলাম, ইনি খেতমেটে (Banded Racer; Argyrogena fasciolata)। এই প্রজাতিটি আমার চেয়েও দুর্ভাগা। নির্বিষ হওয়া সত্ত্বেও ইনি কিঞ্চিত আগ্রাসী এবং ফণা আছে; তাই অনেকেই এনাকে গোখরোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন ও পিটিয়ে মারেন। ইনি শুকনো জায়গায় থাকতে ও ইঁদুর খেতে বড়ই ভালোবাসেন।

সেখান থেকে গালুডি বাঁধ সুবর্ণরেখার ওপর। জল অল্প, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাথর। বিকেলের রোদ্দুর পড়ে জল চিকচিক করছে, দেখা যাচ্ছে জলের নীচের পাথরের স্তর; কুচো মাছের দল খেলা করছে, লোক মাছ ধরছে। জলে পানকৌড়ি , ডার্টার, লিটল গ্রেব, জলের পাশের পাথরে পন্ড হেরন, ইগ্রেট আর খঞ্জনের মেলা। দূরে গিরিরাজিনীলা। ফেরার পথে মহুলিয়ায় শ্রীমদ বিনয় দাস বাবাজির 'প্রাচীন' রণকিনী মন্দির। রণকিনীর মূল মন্দিরটি যদুগোড়ায়।

-৩-
ঘুরেফিরে সেই স্টেশনেই। তখন ঘড়িতে পাঁচটা। ফেরা সেই বরাবিল হাওড়া জনশতাব্দী এক্সপ্রেসেই। বিস্তৃত প্ল্যাটফর্ম জনহীন, শুধু এক নম্বরে কিছু লোক খড়গপুর টাটানগর মেমুর জন্য অপেক্ষারত। তুমুল আওয়াজ তুলে গীতাঞ্জলী চলে গেল, তারপর গেল মেমু। সে চলে যেতেই স্টেশনটি ঘুমিয়ে পড়ল। সূর্য ঢলল, বেলা গড়াল, গাছেরা আন্দোলিত; উত্তপ্ত মধ্যাহ্নের পর কিঞ্চিৎ শীতল অপরাহ্ণ। আমি প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে লম্বা হলাম। দূর থেকে ভেসে এল মাঘরেবের আজানের ডাক। অলস বিকাল, জগত সংসারে কারো কোনও তাড়া নেই; জীবন গড়ায় ঢিমেতালে; শুধু অবিশ্রান্ত হুসহাস করে চলে যায় সতত চলমান মালগাড়িরা।
কিঞ্চিৎ বিলম্বের রেলগাড়ির সংরক্ষিত বাতানুকুলে উঠেই ঘুম। বয়স হলে শুনি অনেকেরই ঘুম কমে যায়, আমার কিন্তু বাড়ছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল, 'সব কিছুর জন্য মম্ দায়ী।' পিছন থেকে উত্তেজিত কন্ঠে ভেসে এল - এক মেয়ের কন্ঠস্বর। চমকে উঠে ফিরে তাকালাম। রেলগাড়ির এই উজ্জ্বল আলোয় মোমবাতি জ্বালাল কে!! ট্রেনে কেক কাটতে গিয়ে বোধহয় মোমের আগুনে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে!! ভাল করে খেয়াল করতে গিয়ে বুঝলাম, ব্যাকডেটেড হয়ে গিয়েছি, বয়স হয়ে গেছে আমার। মোমবাতি নয়, 'মম্', মা জননী। মা। আচ্ছা, এই মম্ আর মায়ের কোলের উষ্ণতার কোনো পার্থক্য আছে কি? বন্ধন মায়া ভালবাসায়? পার্থক্য তো থাকার কথা নয়। তবু কেন আমি ভাবছি আছে?
জ্ঞান হয়ে দেখেছি কিশোরী মাকে; আমার বাউন্ডুলে বাপ তখন দেশের বাইরে। আমরা মামার বাড়ি; জনা তিরিশেক লোক, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, টিয়াপাখি, ধান সেদ্ধ করার আর ময়লা জামাকাপড় ভাটি করার মস্ত লোহার কড়াই ও ভূমধ্যপ্রোথিত উনান; এইসব নিয়ে দিদিমার ভরা সংসার। আমি ও আমার মা দুজনেই সেখানে কাচ্চাবাচ্চার দলভুক্ত; মাকে গুরুজন বলে না ভেবে খেলার সাথি ভেবেই বড় হয়েছি। বস্তুত মাকে তুই বলাটা যে শোভন নয় সেটা বুঝে অভ্যাস বদলেছি অনেক দেরিতে, পনের ষোল বছর বয়সে। তবু তো কখনও মার ওপর চোটপাট করার সাহস হয়নি, এই অতিক্রান্ত আটান্নেও নয়। সেটা কি শাসনের ফল, নাকি আমাদের স্বভাবটাই অমনতর! ভাবা দরকার!

সাঁতরাগাছি নটা কুড়ি।

পরিশিষ্ট -
শান্তিলতা রায় ১৩০০ সনের ২৩শে মাঘ শ্রীহট্ট শহরের একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ নাগাদ। তিনি দুটি বিশ্বযুদ্ধই দেখেছেন । জন্মের পর তিনি তাঁর বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসেন। তাঁর পিতা সেখানে একজন উকিল ছিলেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের গচিহাটায় । ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাংলাদেশের একটি জেলা। আর গচিহাটা হল কিশোরগঞ্জের একটি গ্রাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও গচিহাটার মধ্যবর্তী দূরত্ব আমি সঠিক জানি না।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী বর্ণনাটি তাঁর "আমার দেবোত্তর সম্পত্তি " গ্রন্থে পাবেন।

কৃতজ্ঞতা -
তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বাংলাদেশি রেল বন্ধু জনাব মাকসুদুল আলম (ময়মনসিংহ) ও জনাব মাহবুব কবির মিলন (ঢাকা); এবং ONGCর ভূতাত্ত্বিক শ্রীমান তড়িত্বান পাল (কারাইক্কাল)।

~ ঘাটশিলার তথ্য ~ ঘাটশিলার আরও ছবি ~


পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher