রাঁচি (Ranchi) - ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজধানী হওয়ার অনেক আগে থেকেই রাঁচি বিহারের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির অন্যতম। শহরের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,১৪০ ফুট। শহরের কেন্দ্রে রাঁচি হিল। পাহাড়ের মাথায় শিবমন্দিরটি শহরের বিভিন্ন দিক থেকে নজরে পড়ে। এই মন্দিরে শিবরাত্রি ও শ্রাবণ মাসে প্রচুর ভিড় হয়। গর্ভনর হাউসের পাশে নক্ষত্রবন। পার্কে মিউজিক্যাল ফাউন্টেন ছাড়াও আছে প্রচুর ওষধি গাছগাছড়া।
শহর থেকে কিছুটা এগিয়ে কাঁকে ড্যাম (Kanke Dam)। এখান থেকে শহরে জলের যোগান যায়। এর পাশেই পাথুরে টিলার ওপর কৃত্রিম ঝরনা, মূর্তি, বাচ্চাদের খেলার জায়গা নিয়ে সাজানো বাগান রক গার্ডেন অসাধারণ।
১৯০৮ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রাঁচিতে বেড়াতে আসেন। এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মোরাবাদী হিলে কিছুটা জায়গা কিনে নির্জন পাহাড়ের ওপর বাড়ি বানান। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। তাঁর স্মৃতিতে নাম হয়েছে টেগোর হিল। পাহাড়ের নিচুতে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। এখানেই ট্রাইবাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট মিউজিয়ামটি।
শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে স্বাস্থ্যকর স্থান নামকুম। নামকুম থেকে রাঁচি-টাটানগর সড়কপথে ২৬ কিলোমিটার এগিয়ে ডানহাতি রাস্তায় আরও ৯ কিলোমিটার দূরে কাঞ্চি নদীর জলপ্রপাত দশম (Dassam Falls)। ১৪৪ ফুট উঁচু থেকে কাঞ্চি নদীর জল দশধারায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে সুবর্ণরেখার বুকে। জঙ্গল-পাহাড় মিলিয়ে অনন্যসুন্দর।
রাঁচি থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে হুড্রু জলপ্রপাত (Hundru Falls)। জনপ্রিয় পিকনিক স্পট। এখানে সুবর্ণরেখা নদী ৩২০ ফুট ওপর থেকে ঝরনা হয়ে নেমে এসেছে নীচে। পথে পড়বে বেতলসুদ ড্যাম।
জোনা প্রপাতের (Jonha Falls) আরেক নাম গৌতম ধারা। রাঁচি থেকে দূরত্ব ৩৮ কিলোমিটার। কাঞ্চি নদী এখানে ঝরনা ধারায় নেমে এসে মিশেছে সুবর্ণরেখায়।প্রায় ৫০০ সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছে যাওয়া যায় জলের কাছে। গাছপালা, নির্জনতা নিয়ে এক অনন্য জগৎ। জোনার কাছেই সীতা প্রপাত (Sita Falls)।
মরসুম-বছরের যে-কোন সময় রাঁচি যাওয়া যায়। বসন্তকালে রাঁচি এবং তার আশেপাশের এলাকা পলাশ ফুলের অপরূপ সাজে সেজে ওঠে।
থাকাঃ- ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজমের হোটেল বিরসা বিহার। রাঁচির এস টি ডি কোডঃ- ০৬৫১।
যাওয়া- নিকটতম রেলস্টেশন রাঁচি। সড়কপথেও যোগাযোগ রয়েছে অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে।
নেতারহাট (Netarhat)- শাল, মহুয়া, পলাশ, ঝাউ আর পাইনে ছাওয়া আদিম প্রকৃতি আজও অমলিন। পালামৌ-এর পাহাড়ি জনপদ নেতারহাটের মূল খ্যাতি অপরূপ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের জন্য। ৩,৭০০ ফুট উঁচুতে এই পাহাড়ি বসতি ‘ছোটনাগপুরের রানি’ নামে পরিচিত। লাতেহার জেলায় অবস্থিত নেতারহাটের দূরত্ব রাঁচি থেকে ১৫৪ কিলোমিটার। লেক, ঝরনা আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আঁকাবাকাঁ পাহাড়ি পথের আকর্ষণ অনন্য। ট্যুরিস্ট বাংলো থেকে পাহাড়ের মাথায় অসাধারণ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত। নেতারহাট থেকে ১০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে খানিকটা নীচে নেমে ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট। সূর্যাস্তে বিন্ধ্য পর্বতের কোল থেকে ধীরে ধীরে সূর্য নেমে যায় উপত্যকায়। এই পথেই কোয়েল ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা যাবে পাহাড়ের বাঁকে বয়ে যাওয়া কোয়েল নদী। পাইনে ঘেরা প্রায় ৪ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে নেতারহাট ড্যাম ।
৬ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে ঘেরা আপার ঘাঘরি জলপ্রপাত। নেতারহাট ড্যামের জল ছোটখাটো ঝরনা হয়ে বয়ে চলেছে। নেতারহাট থেকে ১২ কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছে যাওয়া যায় লোয়ার ঘাঘরি। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথ হঠাৎ পৌঁছে দেবে ৩২০ ফুট ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া এই ঝরনার কাছে। জঙ্গল এখানে এত ঘন যে সূর্যের আলো ঠিক মতো পৌঁছয় না।
রাঁচি থেকে নেতারহাট যাবার পথে ২৫ কিলোমিটার আগে কোয়েল নদীর ধারে বানারি বসতি। নেতারহাট থেকে ১০ কিলোমিটার ট্রেক করেও নেমে আসা যায় এখানে। নদী ছাড়াও এখানে পাঁচটি পাহাড় আছে। কথিত আছে, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা কিছুদিন এই পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অরণ্যের মধ্যে আদিম লোধ ঝরনা।
যাওয়া- সবথেকে কাছের স্টেশন রাঁচি, ১৫৪ কিলোমিটার। নিয়মিত বাস যাচ্ছে রাঁচি, বেতলা, ডালটনগঞ্জ থেকে। এছাড়া রাঁচি থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়েও যাওয়া যায়। নেতারহাট থেকে ভাড়া গাড়িতে বা বাসে সরাসরি বেতলা যাওয়া যায়। এই পথটি গেছে মহুয়াটাঁড় হয়ে। এছাড়া নেতারহাট থেকে কুরু হয়ে ডালটনগঞ্জ যাওয়া যায়। ডালটনগঞ্জ থেকে বেতলার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।
থাকা- ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজমের হোটেল প্রভাত বিহার, পালামৌ ডাকবাংলো, ফরেস্ট রেস্টহাউস, পি ডব্লু ডি ইনস্পেকশন বাংলো, আরও কিছু প্রাইভেট হোটেল আছে এখানে। নেতারহাটের এস টি ডি কোডঃ ০৬৫৬৯
বেতলা (Betla) - রাঁচি থেকে প্রায় ১৫৬ কিলোমিটার দূরে শাল, মহুয়া, পলাশ, শিশু, কেন্দু গাছে ছাওয়া বেতলা ন্যাশনাল পার্ক (Betla National Park)। পালামৌ জঙ্গলের প্রায় আড়াইশো বর্গকিলোমিটার অংশ নিয়ে গড়ে ওঠা এই অরণ্য প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। বেতলার জঙ্গল হাতি, হরিণ, সম্বর, বাঘ ও বাইসনের বিচরণক্ষেত্র। আর নানা ধরনের পাখির জলসাঘর। সন্ধ্যার দিকে ওয়াচটাওয়ারের কাছে হাতি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। তবে বাঘ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। তারজন্য জঙ্গলের মধ্যে সল্টলিক পয়েন্ট আর জলাশয়ের আশেপাশে ওয়াচটাওয়ারে অপেক্ষা করতে হবে। দিনে দুবার পর্যটকদের প্রবেশাধিকার মেলে। সকাল ৬টা থেকে ১০টা এবং দুপুর ২টো থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত। বেতলা ন্যাশনাল পার্কের তোরণকে ডানপাশে রেখে সোজা একটু এগিয়ে বামদিকে এঁকেবেঁকে পথ গিয়েছে প্রাচীন কেল্লার দিকে। সুবিশাল এই কেল্লার বেশিরভাগটাই এখন জঙ্গলের গ্রাসে। কয়েকটি পিলার আর তোরণগাত্র এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল প্রাকার, মসজিদ, তোরণ সর্বত্রই মুঘল স্থাপত্য রীতির ছাপ স্পষ্ট। অরণ্যে বেড়ানোর পাশাপাশি প্রাচীন ঐতিহাসিক এই কেল্লার ধ্বংসস্তূপ দর্শন বেতলা ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখবে।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র দৃশ্যের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে ঘুরে নেওয়া যায় বেতলা থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কোয়েলের কাছে কেচকি(Ketchki)।
যাওয়া- নেতারহাট থেকে ভাড়া গাড়িতে বা বাসে সরাসরি বেতলা যাওয়া যায়। এই পথটি গেছে মহুয়াটাঁড় হয়ে। এছাড়া নেতারহাট থেকে কুরু হয়ে ডালটনগঞ্জ যাওয়া যায়। ডালটনগঞ্জ থেকে বেতলার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।
থাকা- ঝাড়খণ্ড পর্যটনের হোটেল বনবিহার। এছাড়া রয়েছে টাইগার প্রজেক্ট বাংলো।
হাজারিবাগ (Hazaribag) - রাঁচি থাকা ৯৫ কিলোমিটার দূরে ছোটনাগপুরের পাহাড়ি অধিত্যকায় ছবির মতো শহর হাজারিবাগ। ‘হাজারবাগ’ থেকে হাজারিবাগ নামের উপৎত্তি। স্বাস্থ্যকর জায়গা বলেও এর খ্যাতি রয়েছে। প্রধান আকর্ষণ হাজারিবাগ জাতীয় উদ্যান (Hazaribag National Park)। বসন্তের শুরুতে শাল, শিমূল, পলাশের ফুলে আলো হয়ে থাকে চারদিক। শহর থেকে আশেপাশে দেখে নেওয়া যায় সুন্দর কিছু জায়গা। প্রায় শহরের মাঝেই কানহেরি পাহাড় বা ক্যানারি হিল। এই পাথুরে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত অবজারভেশন টাওয়ার থেকে হাজারিবাগ শহরের দৃশ্য ভারি সুন্দর। একদিকে ছোটনাগপুর রেঞ্জের উঁচুনিচু পাহাড়, মালভূমি আর অন্যদিকে সবুজ বনাঞ্চল। শহরের মধ্যে সবুজে ছাওয়া বিস্তীর্ণ হাজারিবাগ লেক। মাঝে মাঝে সুন্দর অর্ধচন্দ্রাকৃতি ঘাট। রয়েছে বোটিং-এর ব্যাবস্থাও। জলাশয়ের কিনারা বরাবর পথ গিয়েছে। হাজারিবাগ লেকের একদিকে কৃত্রিম জলাশয়, ফোয়ারা, মজার মজার জীবজন্তুর মূর্তি, টয়ট্রেন এবং বিবিধ খেলাধুলোর সামগ্রী নিয়ে গড়ে উঠেছে পিকনিক স্পট স্বর্ণজয়ন্তী উদ্যান।
শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে হাজারিবাগ জাতীয় উদ্যান। জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, তৃণভোজী প্রাণী পুনর্বাসনকেন্দ্র ও মোট ১০টি অবজারভেশন টাওয়ার। শাল, মহুয়া, শিশু, পলাশ ও আরও নানান গাছের এই সংরক্ষিত অরণ্যের বাসিন্দা সম্বর, চিতল, বনবিড়াল, ভালুক, শেয়াল, অজগর ইত্যাদি প্রাণী আর ময়ূর, বাজ, ময়না, কিংফিশার ইত্যাদি নানা ধরনের পাখি। অরণ্যের ১০ কিলোমিটার গভীরে রাজদেরওয়া ট্যুরিস্ট লজ আর পাহাড়ি নদীকে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা সুন্দর একটি জলাশয়। ডানদিকে আরও বেশ কিছুদূর বনের মধ্যে গিয়ে ৭ নম্বর টাওয়ার। তার ওপর থেকে নিঝুম অরণ্যে সূর্যাস্তের দৃশ্য ভোলার নয়।
যাওয়া- নিকটতম স্টেশন হাজারিবাগ। স্টেশন থেকে বাস বা গাড়িতে হাজারিবাগ শহর। কোডারমা স্টেশনে নেমেও বাসে যাওয়া যায়।
থাকা- হাজারিবাগে ঝাড়খণ্ড পর্যটন দপ্তরের উরুমান ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স। বনবিভাগের রেস্টহাউসগুলিতেও থাকা যায়। হাজারিবাগের এস টি ডি কোডঃ ০৬৫৪৬।
দলমা (Dalma) - জামশেদপুর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে ছোট বড় পাহাড়ের মাঝে ঝাড়খণ্ডের একটি পরিচিত অভয়ারণ্য দলমা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উঁচুতে ১৯,৩২২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে আছে এই অরণ্যভূমি। চারিদিকে গভীর নিস্তব্ধতা আর পাখির কূজন, চড়াই -উতরাই পাহাড়ি পথে শুধু সবুজের সমাগম, সূর্যের আলো কখনো কখনো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পথটাকে আরও মায়াবী করে তোলে। শাল সেগুন মহুয়া গাছের গভীর জঙ্গলের মাঝে অতি সন্তর্পণে ছোট বড় পাথর টপকে ওপরে ওঠা। এই সব মিলিয়ে দলমার জঙ্গলে ট্রেকের অভিজ্ঞতা এককথায় দারুণ রোমাঞ্চকর। তবে একা পায়ে হেঁটে বেড়াতে গেলে সাবধান - বুনো হাতির সামনে পড়তে পারেন।
যাওয়া - নিকটতম স্টেশন জামশেদপুর। এখান থেকে ভাড়ার গাড়িতে দলমা যেতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগে ।
থাকা – রাত্রিবাসের জন্য ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের দুটি বাংলো আছে - পিণ্ডারবেরা আর মাকুলাকোচা। বুকিং হয় রাঁচি ডি.এফ.ও. অফিস থেকে।
(তথ্য সহায়তা – সিন্টু ভট্টাচার্য)
ঘাটশিলা-গালুডি (Ghatshila-Galudi) - কাছে-দূরে সবুজ পাহাড়। শাল-পলাশের জঙ্গল। বাতাসে মহুয়ার গন্ধ। ঝিঁঝির ডাক। সুবর্ণরেখা নদী আর আদিবাসী জনজীবন। গোধূলিতে কনে-দেখা আলো আর জ্যোৎস্নায় মোহময়ী রাত। অরণ্যের দিনরাত্রির ঠিকানা ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা আর গালুডি। টাটানগর থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরে ঘাটশিলা। বাঙালির স্বাস্থ্যোদ্ধারের চেনা জায়গা। আর ঘাটশিলার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট শহর গালুডির পরিচয় তার সবুজ নির্জনতা আর নির্মল পরিবেশ। সুবর্ণরেখার বালুচরে আজও নাকি সোনা মেলে। সোনাঝরা সন্ধ্যায় বা ভোরের অপরূপ আলোয় তা যেন সত্যি হয়ে ওঠে। সুবর্ণরেখাকে কেন্দ্র করেই ঘাটশিলা আর গালুডির জীবনযাপন। নদীর চরে বসেই কেটে যাবে সারাদিন। এই লালমাটির রাস্তা, সুবর্ণরেখার তীরেই কত অপরূপ সন্ধ্যা-রাত্রি-সকাল কাটিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। ঘাটশিলায় পায়ে পায়ে ঘুরতে ঘুরতেই দেখে নেওয়া যায় বিভূতিভূষণের ভিটে গৌরীকুঞ্জ। পৌঁছে যাওয়া যায় ফুলডুংরি টিলার মাথায়, অপরূপ এক সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করতে। জাতীয় সড়কের ধারে শাল-মহুয়া মোড়া ফুলডুংরি টিলা থেকে ভারি সুন্দর লাগে ঘাটশিলাকে। আরও ৯-১০ কিলোমিটার এগোলে বুরুডি ড্যাম(Burudi Dam)। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে টলটলে জল। জলের মাঝে মাঝে জেগে রয়েছে সবুজ গাছে ভরা টিলা। পাহাড়ের গা বেয়ে ড্যামকে বেড় দিয়ে ধারাগিরি জলপ্রপাত(Dharagiri Falls)-এর পথ। শেষ ২ কিলোমিটার পাথুরে রাস্তায় ট্রেকিং। ছায়াঘেরা আলো-আধাঁরিতে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে জলধারা। চারদিকে শুধু সবুজ আর নির্জনতাকে ঘন করা ঝিঁঝির ডাক। ঘাটশিলা থানার কাছে জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী দেবী রুক্মিনীর মন্দির। দেবীমূর্তি কালীর। শোনা যায়, এখানে নাকি একসময় নরবলি হত। গালুডিতে ড্যামের ধারে করা যায় পিকনিকও। শাল-পলাশ-মহুয়া-আমলকির জঙ্গলে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যায় আদিবাসী গ্রামে। গালুডির ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে বেশ কয়েকটি আদিবাসী গ্রাম। লাল মেটে রঙের কাঁচা বাড়িগুলির দরজা পেরোলে গোল উঠোনে খেলে বেড়ায় হাঁস-মুরগি। খানিক আধুনিকতার ছোঁয়া পৌঁছলেও গ্রামীণ মানসিকতা আজও অটুট। তাদের সুরে লেগে রয়েছে লালমাটির সোঁদা গন্ধ। সকাল-সন্ধেয় বাজার বসে গালুডিতে। বাজারের ভেতর হেঁটে-ঘুরেও স্বাদ নেওয়া যায় স্থানীয় জীবনযাপনের। সন্ধেবেলায় গরম তেলেভাজা আর চায়ের গ্লাস হাতে কাঠের বেঞ্চিতে বসে চলতে পারে আড্ডাও। শাল-আমলকিতে ছাওয়া দহিজোড়া-মোসাবনির পরিবেশও দারুন সুন্দর। এই পথেই পড়বে জাদুগোড়া মাইনস্। কুমারমঙ্গলম সেতু পেরিয়ে রাতমোহনার চর। গালুডিতে এলে রাতমোহনার চরে বেড়াতে যেতেন বিভূতিভূষণ। সন্ধের সোনামাখা আলোয় রাঙা হয়ে ওঠে সুবর্ণরেখা আর রাতমোহনার চর।
হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসা যায় ধলভূমগড়, চাণ্ডিল ড্যাম, দলমা পাহাড়, জামসেদপুরের জুবিলি পার্ক ও হাডকো লেকের মতো কাছে-দূরের আরও কয়েকটি জায়গা থেকেও।
পঃ বঙ্গের পুরুলিয়ার দুয়ারসিনি (Duarsini),ভালপাহাড়(Bhalopahar) জায়গাগুলিও গালুডি হয়ে যাওয়াই সুবিধেজনক।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ঘাটশিলা ও গালুডি। টাটানগর থেকে গালুডির দূরত্ব ৩৩ কিমি। কাছেপিঠে ঘোরাঘুরির জন্য গাড়িভাড়া করে নেওয়া যায়। হোটেলে বা স্থানীয় বাজার এলাকার খোঁজ করলে টাটা সুমো, মারুতি বা জিপ পাওয়া যায়।
থাকা-ঘাটশিলায় ঝাড়খণ্ড পর্যটনের হোটেল বিভূতি বিহার। এছাড়া দু’জায়গাতেই বেসরকারি হোটেল আছে। অল্পদিন থাকার জন্য বাড়িভাড়াও পাওয়া যায়।
ভ্রমণ কাহিনি - || বিভূতিভূষণের ঘাটশিলায় || ঘাটশিলার জঙ্গল-পাহাড়ে ||
শিমুলতলা -দেওঘর(Simultala-Deoghar)- সাঁওতাল পরগণার যেসমস্ত অঞ্চলগুলি একসময় বাঙালির স্বাস্থ্যোদ্ধারের ঠিকানা ছিল তারমধ্যে শিমুলতলা আর মধুপুর অন্যতম। লালমাটির পথের বাঁকে ভাঙ্গাচোরা কাঁটাঝোপ আর জঙ্গলে ঘেরা বাড়িগুলি এখনো সেইসব দিনের কথা বলে। পাহাড়ি টিলা, শাল, মহুয়ায় ঢাকা এই ছোট্ট শহরের জলহাওয়া এখনো খুবই স্বাস্থ্যকর। এখানকার মূল আকর্ষণ নলডাঙার রাজবাড়ির ভগ্নস্তুপ আর গাছপালায় ছাওয়া লাট্টুপাহাড়। স্টেশনের কাছে লীলাবরণ ঝোরা আর আরেকটু এগিয়ে হলদি ফলস।
শিমুলতলা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে জসিডি। আর জসিডি থেকে বাস, ট্রেন, অটো, ট্রেকার যাচ্ছে হিন্দুতীর্থ বৈদ্যনাথধাম তথা দেওঘর। কিংবদন্তি বলে কৈলাস থেকে শিবকে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার পথে দেবতাদের ছলনায় এখানেই নামিয়ে রাখেন রাবণ। দেবতাও অনড় হয়ে থেকে যান। মন্দির চত্ত্বরে শিব ছাড়াও জয়দুর্গা, অন্নপূর্ণা, কেদারনাথ, ইন্দ্রেশ্বর, মহাকাল প্রভৃতি নানান দেবদেবীর মন্দির রয়েছে। কথিত আছে বৈদ্যনাথধামে সতীর হৃদয় পড়ে-তাই এটিকে ৫১ পীঠের মধ্যেও গণ্য করা হয়। কাছে অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে তপোবন, নওলাক্ষি মন্দির, কুণ্ডেশ্বরী মন্দির, ত্রিকূট পাহাড় প্রভৃতি।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন শিমুলতলা। দেওঘর যেতে গেলে জসিডিতে নামতে হবে।
থাকাঃ- দুটি জায়গাতেই প্রচুর বেসরকারি হোটেল ও হলিডে হোম আছে। দেওঘরে বেশকিছু ধর্মশালাও রয়েছে। দেওঘরে ঝাড়খণ্ড পর্যটনের হোটেল নটরাজ বিহার ও বৈদ্যনাথ বিহার।
মধুপুর-গিরিডি (Madhupur-Giridih) - বাঙালির হাওয়াবদলের আরেক ঠিকানা মধুপুর। স্থানীয় দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে কপিল মঠ, ধর্মমন্দির, পাতরোলের কালীমন্দির প্রভৃতি। মধুপুর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে গিরিডি ঝাড়খণ্ডের একটি জেলা শহর। এখন প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ, যোগীন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখের স্মৃতিধন্য কুঠিগুলি বর্তমান। কাছেই খাণ্ডোলি পাহাড় আর শিরশিরা ঝিল। ঝিলের জলে বোটিংও করা যায়। গিরিডি থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে উশ্রী নদীর ঝরনা (Usri Falls)। ২৪ কিলোমিটার দূরে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত কারমাটার (Karmatar)। বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর। গিরিডি থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে পরেশনাথ পাহাড় (Pareshnath Hill)। পথে পড়বে তোপচাঁচি লেক(Topchanchi Lake)।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন মধুপুর দেওঘর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। গিরিডিতে পৌঁছতে হলে মধুপুর দিয়েই আসতে হবে। সড়কপথে এই সবকয়টি জায়গার সঙ্গেই ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।
থাকাঃ- দুটি জায়গাতেই প্রচুর বেসরকারি হোটেল ও হলিডে হোম আছে।
সারাণ্ডা/ কিরিবুরু-মেঘাতাবুরু – ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িষার সীমান্ত ছোঁয়া ৫০০ বর্গ কিমি ব্যপী শাল-সেগুন-জারুলের অরণ্যে ছাওয়া সারাণ্ডায় একই পাহাড়চূড়ায় পাশাপাশি ছোট দুই শহর কিরিবুরু আর মেঘাতাবুরু। বুরু মানে জঙ্গল। একসময় সত্যিই মেঘের মতো জমাট বাঁধা এই জঙ্গলে ছিল হাজাররকমের ‘কিরি’ অর্থাৎ পোকাদের বাস। সভ্যতার রথ আজ অনেকখানি অরণ্য আগ্রাস করলেও তার আদিমতাকে পুরোপুরি মুছে দিতে পারেনি। চেনা-অচেনা গাছপালা, ফুল-পাখি, হাতি, বন্য কুকুর, চিতার মতো জন্তু আর বিরহড়, হো প্রভৃতি আদিবাসী মানুষেরা বেঁচে আছে অরণ্য-পাহাড়ের বুকে পাশাপাশি। অন্যদিকে বোকারো স্টিল কারখানা আর কিরিবুরু আয়রন ওর কোম্পানিকে ঘিরে বেড়ে উঠছে শহর। কিরিবুরুতে প্রতি মঙ্গলবারে আদিবাসীদের হাটে দিনভর চলে বিকিকিনির পালা।
কিরিবুরু থেকে বেড়িয়ে আসা যায় চারঘন্টার দূরত্বে সারাণ্ডার গভীরে। হাতে সময় থাকলে থাকা যেতেই পারে থলকোবাদে একরাত্রি। বড়াজামদা থেকে থলকোবাদ ৫০ কিমি; আর অচেনা অরণ্য কুমডি ৩০ কিমি। এই দুই অরণ্যেই দেখা মিলতে পারে বুনো হাতি,কুকুর, বাইসন, শম্বর, চিতা প্রভৃতি নানান বন্যপ্রাণীর। থলকোবাদের বাংলো থেকে ৫ কিমি দূরে টোয়েবু ঝরনা। থলকোবাদ থেকে সিমলিপালের দূরত্ব ৪০ কিমি।
বড়াজামদা থেকে ৬ কিমি দূরে সারাণ্ডার প্রধান প্রবেশপথ – স্যাডেল পয়েন্ট। কারো নদীর সেতু পেরিয়ে বরাইবুরু টিলার মাথায় সবুজের মাঝে ডাকবাংলো। ডানহাতে গুয়া পাহাড়, বাঁয়ে কিরিবুরু। থলকোবাদ থেকে ৪০ কিমি দূরে কোয়েনা রেঞ্জে কারো নদী মিলেছে কোয়েনার সঙ্গে। নদীর ধারে চিড়িয়া মাইনস।
যাওয়াঃ কিরিবুরুর নিকটতম স্টেশন গুয়া এবং বড়াজামদা। বড়াজামদা থেকে যাতায়াতের সুবিধা বেশি। টাটা-বারবিল লাইনে বড়াজামদা স্টেশনটি পড়বে। ঘাটশিলা থেকে বাসেও সরাসরি বড়াজামদা আসা যায়। টাটা থেকে ট্রেনে মনোহরপুর হয়েও সারাণ্ডা পৌঁছানো যায়।
থাকাঃ থাকার জন্য রয়েছে মেঘাতাবুরু স্টিল প্ল্যান্ট গেস্ট হাউস ও হোস্টেল । থলকোবাদ ও কুমডিতে ফরেস্ট রেস্টহাউস আছে। মনোহরপুকুরে রয়েছে বননিবাস এবং কিছুটা দূরে সাইলেন্ট ভ্যালি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্পের সারাণ্ডা রিসর্ট। কোয়েনা রেঞ্জে রয়েছে সালাই বাংলো। বনবাংলোগুলিতে থাকতে হলে বড়াজামদা থেকে রেশন সঙ্গে নিতে হবে।