ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - চতুর্থ পর্ব

আগের পর্ব – তৃতীয় পত্র


ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র - লাদাখ পর্ব

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

~ লাদাখের আরও ছবি ~

চতুর্থ পত্র


বন্ধুবর,

মাঝে পত্র দিতে পারিনি, শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না, খবরটা পেয়েছ বোধহয়। আর এই মূহূর্তে মন একেবারে ভালো নেই। আজ তোমাকে যখন বুদ্ধের দেশের গল্প বলব, তখন আর এক বুদ্ধের দেশ মায়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। আর আমাদের এই 'ধর্মনিরপেক্ষ দেশ'-এ ধর্মের উন্মাদনার বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য নিহত হচ্ছেন গৌরীরা।
এ কোন পৃথিবীতে বেঁচে আছি বলো তো?
এই জন্যই তো বারবার ফিরে আসি প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতিই আমার প্রকৃত শিক্ষক। মানুষ কেবল লোভের বশে তাকে ধ্বংস করতে করতে নিজের মৃত্যু তরান্বিত করে। আসলে প্রকৃতির রাজ্যে মানুষই একমাত্র খিদে ছাড়া অন্যকে মারে। তার একটাই খিদে – লোভ। যার লক্ষ্য ক্ষমতা এবং মুখোশ অথবা হাতিয়ার ধর্ম।
আমাদের এবারের গন্তব্য লাদাখ পাহাড়ের আর এক লেক সো মোরিরি। আর এই পথের সব থেকে আকর্ষণ আমার কাছে লেগেছিল সেই ছেলেবেলার ইতিহাসের সিন্ধুনদের পাশ দিয়ে যাওয়া। বলছি দাঁড়াও।

১৮/১০/২০১৫
সকাল সোয়া আটটা, লেহ
সো মোরিরির দিকে রওনা। আজও ঝকঝকে সকাল। তবে দীপের শরীরটা খারাপ, হাঁপ ধরছে মাঝেমাঝে। কারু অবধি একই রাস্তা দিয়ে যাওয়া। 'কানট্রি রোডস টেক মি হোম' – মোবাইলে বাজছিল। বাইরে অনাবিল প্রকৃতি; পাহাড়, নদী আর গাছের রঙে। প্রকৃতির সীমাহীন অনন্ত রাজ্যে দেশ নামক সীমারেখা বসিয়েছে মানুষ। আর প্রকৃতিকে ধ্বংস করে গড়ে তুলেছে নগর – তার বাসস্থান। আসলে দেশ বা বাসভূমি সত্যি কি ভিন্ন ভিন্ন হয়? ওই যে পাহাড়ের গায়ে যে রঙিন বাড়িটা দেখা যাচ্ছে দূরে, অনেকটা দূরে, ওর মধ্যেও তো এক চেনা গেরস্থালি আছে মানুষের; সেও কি আমার আপনজন নয়?
বাইরের দৃশ্য দেখলে ঠিক বিদেশি সিনেমার কোনও পটভূমির ভেতর দিয়ে চলেছি মনে হচ্ছে। পথের পাশে একটা ইয়াক চোখে পড়ল। নীল আকাশে ম্যাজিক কার্পেটের মতো এক খণ্ড মেঘ।

সিন্ধুর পাশে পাশে চলা। কেবল মনে হচ্ছে গাড়ির থেকে নেমে দু দণ্ড ওর পাশে বসে একটু গল্প করে আসি। সে যে আমার কতকালের চেনা আপনজন। অথচ এই প্রথম দেখা। তাই যেন দেখে দেখে আশ মেটে না আর।

সোয়া নটা, উপসি
সিন্ধুর গাঘেঁষা জমিতে লাল হলুদ ঝোপের মতো গাছ, যেন তার নীল শাড়ির ঝলমলে পাড়। আবার রুক্ষ্ম পাহাড়ের গায়ে এসে নিজেই রঙ বদলায় সে; এবারে গাঢ় সবুজ আর বহরেও চওড়া বেশ। এক জায়গায় স্রোতের বেগ খুব। বর্ষায় সিন্ধু প্রবল রূপ ধরে ভেঙে দিয়েছিল মানুষের বানানো পথ। চলেছি নতুন বানানো কাঁচা পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে। ডান হাতে সিন্ধুকে রেখে। হলুদ পাহাড়ের ছায়া পড়েছে তার নীল-সবুজ জলে। ডানদিকের পাহাড়ে প্রকৃতির আপন স্কাল্পচার আর বাঁদিকের পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে লেগে রয়েছে সবুজ ঘাসের গুচ্ছ।
পৌনে দশটায় লিম্টসে পেরোনো। মাঝে মাঝে সেই লাল-হলুদ-সবুজ গাছেদের ভিড়। আবার কখনও ঘাসে ছাওয়া কখনওবা একেবারেই নেড়া পাহাড়। সিন্ধু সঙ্গী সততই। পথের পাশে কোথাও নজরে পড়ে পাহাড়িয়া জীবনের নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততার এক ঝলক। সেখানে জলসংগ্রহের কাজে বাপের সঙ্গী ছোট্ট ছেলেও। এর ঠিক পরেই তারচিক থেকে শুরু হল ব্রিজ পেরোনো। তিনটে ব্রিজ পেরিয়ে রানিডাগ-এ। এখানে থ্রি ইডিয়টসের শুটিং হয়েছিল। অতএব 'অল ইজ ওয়েল।' এবারে বাঁদিকে সিন্ধুকে রেখে এগিয়ে চলি আমরা। হায়ামিয়াতে ব্রিজ পেরিয়ে আবার নদীর ওপারে।

পৌনে এগারটা, তিরি গ্রাম
এখনও পর্যন্ত সিন্ধু ডান হাতেই রয়েছে। তার গা ঘেঁষে রঙিন গাছপালার বাহার বেড়েছে। গতকাল বরফের গায়ে রোদ্দুর পড়ে ক্রিস্টালগুলো চিকচিক করছিল। আজ নদীর জলে রোদ ঝিকমিক করছে। তবে লিখতে খুব আলসেমি লাগছে... ক্লান্ত।
আরও চার কিলোমিটার পরে গাইক গ্রাম। পথে বেশ কটা পাহাড়ি মোনাল চোখে পড়ল। এখন সিন্ধুর কোল থেকে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছি।

সোয়া এগারটা, কিয়ারি
মিলিটারি এলাকা দিয়ে যাচ্ছি এখন। ডানহাতে সিন্ধু। সিন্ধুর এপাড়-ওপাড় বরাবর কোথাওবা রঙিন ফ্ল্যাগ লাগানো। দুদিকেই এবার কালচে লাল রঙের পাহাড়। নদীর পাড়েও গাছের রঙ লাল। শুধু সিন্ধু একাই নীল। সিন্ধু নদী নয়, নদ। তবু নদী শব্দটা বেশি সুন্দর যে। তাই লেখায় সেটাই আসছে।
ডান হাতে লাল পাহাড়। বাঁ দিকে সবুজ আর কালো। কালো পাথরের গা ঘেঁষে লাল রঙের গাছেরা আলো করে আছে যেন। লাল ঝোপের পাশাপাশি সিন্ধুর তীরে হলুদ-সবুজ ঝোপেরাও ভিড় বাড়িয়েছে। আর সেই লাল-সবুজ গাছেদের ভিড়ে লাল-হলুদ চালের বাড়িগুলো যে কী মিষ্টি কী মিষ্টি। খালি মনে হচ্ছিল এক ছুট্টে চলে যাই অমন কোনো বাড়ির উঠোনে। কিন্তু আমরা যে এখানে কেবল যাত্রী-ই। যার সামনে শুধু বদলায় দৃশ্যপট।
পাহাড়ে এমনিতেই গাড়ির ড্রাইভারদের মধ্যে কম্পিটিশন হয় না। এখানে যেন তারা আরওই বন্ধু পরস্পরের। উলটো দিক থেকে গাড়ি এলে হয় দু-চার কথা বিনিময়, আর নয়তো নিদেনপক্ষে হাত নাড়া আর সেই চেনা সাদর সম্ভাষণ – 'জুল্লে।'
কালো পিচের মসৃণ রাস্তা। অফসিজনে পথে গাড়ির সংখ্যা খুব কম। মাঝে মাঝে এক-একটা মিলিটারি ট্রাক যাচ্ছে। লাল-সবুজ পাথরের পাহাড় দেখে মনে হচ্ছে কে যেন গুঁড়ো রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে।

পৌনে বারোটা, কিদমা

সিন্ধু এখানে প্রচণ্ড – পাথরে পাথরে নেচে চলেছে। ডানদিকে কালো পাহাড়। বাঁদিকে পাহাড়ের রঙ অদ্ভুত; চন্দনদা বলল, পাথরের মধ্যে সোডিয়াম সিলিকেট আছে। আমার কৌতূহলের উত্তরে আরও জানালো, লাল পাহাড়ে ম্যাঙ্গানিজ বা কোবাল্ট, সবুজ রঙের পাহাড়ে ক্রোমিয়াম অথবা কপার। বাঁ দিকের পাহাড়ের রঙ বদলে বদলে যাচ্ছে। ডানদিকে ওই কালচে বা কালচে লাল রঙের পাহাড়ই দৃশ্যমান।
চুমাথাং পৌঁছে দুপুরের খাওয়া সারা হলো। এখানের হট স্প্রিং থেকে বোতলে করে গরম জল ভরে এনেছিল বীরেন। গাড়িতে বসে কোমরে সেঁক দিতে দিতে চলেছি। বাইরের দৃশ্য বদলে বদলে যাচ্ছে। ঘরের সামনে পাহাড়ের ধাপকাটা জমি পেরিয়ে তারের বেড়ার গায়ে দরজা। আর সেই দরজার বাইরের এক চিলতে ঘাসের মাঠে চড়ছে পোষা ঘোড়ার দল। কোথাওবা সিন্ধুর কোল ঘেঁষে এক চিলতে গ্রামের কয়েকখানা বাড়ি। এমন কত টুকরো টুকরো জীবনছবি।

সোয়া একটা, মাহে
সিন্ধু এখন বেশ চওড়া। তবে এপথে সিন্ধুর পাশে পাশে চলা এখানেই শেষ। নদী পেরিয়ে অন্য রাস্তা ধরলাম। এখন দুপাশেই শুধু পাহাড়। ডানদিকে তার রঙ লাল আর বাঁ দিকে কালো। লাল পাহাড়ের গায়ে লাল রঙের ছোট ছোট গাছের ঝাড়ও। কালো পাহাড়ের গায়ে কোথাও অল্প অল্প সবুজ ঘাস লেগে রয়েছে। হলুদ মসেরা উঁকি দিচ্ছে কালো পাথরের ফাঁকে ফাঁকে।


পৌনে দুটো, সুমদো
একটা বড়সড় স্কুল চোখে পড়ল। গোটা দুয়েক ঘোড়াও। ঘুঘুর মতো দেখতে তিনটে পাখি রাস্তা পেরোচ্ছিল।
সুমদোর পর অনেকটা মসে ঢাকা জমি পেরিয়েছি। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠেও এসেছি অনেকটা। এখন একটা বিরাট মাঠে যেন, দূরে দূরে পাহাড় আর মাটির গায়ে হলুদ রঙের ঘাস। সামনে নীল-সবুজ জলের একটা লেক। কিয়াগার সো। হলুদ মাটি, পেছনে কালো-হলুদ পাহাড়ের গা কোথাও কোথাও বরফ জমে সাদা হয়ে আছে। ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের কারুকাজ। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। যতদূর দেখা যায় - আর কেউ নেই, কিছু নেই - আমরা ছাড়া! অবিশ্বাস্য নির্জনতা।
কিন্তু মাথাটা খুব ধরেছে। ঠান্ডা না অক্সিজেনের খামতি?
মূল রাস্তা ছেড়ে গাড়িটা শর্টকাটে অনেকটা ওপরে উঠে এল বেশ তাড়াতাড়িই। পথের দুপাশে ছড়ানো হলুদ রঙের উপত্যকা। ডানপাশে ঘোড়ার একটা বড় দল চড়ছে। বাঁ দিকে বহুদূরে একটি মানুষ।
দুটো কুড়ি নাগাদ পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে প্রথমবার সো মোরিরিকে দেখা গেল।

অবশেষে পৌঁছালাম। 'সো' মানে হ্রদ সে তো জানাই আছে, 'মোরিরি' মানে পাহাড় – অর্থাৎ পাহাড়ি হ্রদ। নীল জলের সো মোরিরিকে দূর থেকে খুব চওড়া লাগছে না। জলে হালকা ঢেউ আছে। দূরের দিকটায় হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। পেছনে অনেক দূরে বরফ পাহাড়। দুপাশে পাহাড়ের রং হলুদে বাদামিতে মেশানো। পাড়ে বালি। পাহাড়গুলোকেও দূর থেকে দেখে কেমন বালির বলে মনে হচ্ছে। প্রবল ঠান্ডা হাওয়া জবুথবু করে দিচ্ছে।
আরও এগোতে সো মোরিরি তার শরীর মেলতে শুরু করল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে লেকের অন্য পাড় অনেক দূরে। পাড়ে বালির ফাঁকে ফাঁকে হলুদ হয়ে আসা ঘাস, ছলাৎ ছলাৎ করে পা ছুঁয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ সবজে-নীল জল, তার সাথে ভেসে এসেছে পাড়ের কিনারে জলজ গুল্ম। আর কিছু দিনের মধ্যেই তুষারের চাদরে ঢাকা পড়ে যাবে সব। বালি-পাহাড়ের হলুদের মাঝে নীল জল, ওপরে নীল-সাদা আকাশ, জলে ভাসা হাঁসের দল, আকাশে তাদেরই ক'জনের উড়ে যাওয়া... এ যেন অন্য এক পৃথিবীতে এসে পড়েছি। এই নিস্বর্গের ভেতরে একটা অপার শান্তি আছে।
ট্যুরিস্ট সিজনের শেষে সো মোরিরিতে পর্যটক শুধু আমরাই এখন। আসার পুরো রাস্তাটাতেই ক্কচিৎ কদাচিৎ দু-একটা মিলিটারি গাড়ি ছাড়া আর কোনও যানবাহন চোখে পড়েনি। বেশ কিছুক্ষণ পরে মালবাহী একটা ছোট ট্রাক এসে দাঁড়াল দূরে। ড্রাইভার আর খালাসি নেমে লেকের পাড়ে গিয়ে ফোন বের করে ছবি তুলতে শুরু করল। লেকের অন্যদিকে কোরজোক গ্রামে থাকা যায়। কিন্তু আবার আগের দিনের মতো বুইয়ের শ্বাসকষ্ট হলে রাতে সমস্যা হবে ভেবে আমরাই রাজি হলাম না। চুমাথাং-এ ফিরেই রাতে থাকা হবে ঠিক হল।

১৯/১০/২০১৫
সকাল সোয়া নটা, চুমাথাং
হটস্প্রিংয়ের পাশে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে লিখছি। বেশ লাগছে একা একা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। ভোরের দিকটায় মেঘলা ছিল। এখন বেশ রোদ্দুর উঠেছে। হাওয়া দিচ্ছে। রাতে তো আরও জোরে বইছিল। হট স্প্রিং-এর ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। তবে ব্রিজের নিচটায় জল খুব নোংরা। চারপাশেই হলুদ পাহাড়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অনেকটা জায়গা জুড়ে লালপাতার গাছের ঝোপ। সো মোরিরিতে গতকাল খুব কাছ থেকে দেখেছি, এগুলো আসলে কাঁটাগাছ।
কাল লামইং গেস্টহাউসে ছিলাম। কোরজোকের তুলনায় উচ্চতা কম এবং হটস্প্রিং থাকার দরুন চুমাথাং-এ শীতের প্রকোপ কম; তায় আবার এখানে ঘর গরমের এলাহি বন্দোবস্ত। গোটা দুয়েক রুম হিটার দেওয়াল জুড়ে। ঘরটা অতিরিক্ত গরম হয়ে বোধহয় অক্সিজেনে টান পড়েছিল। কাল রাত্তিরে আমারও অক্সিজেন লেগেছে কিনা, ওদের দুজনের সঙ্গে। বাপরে, কী হাঁসফাস লাগছিল… তারপর ওই রাত্তিরে দীপ জানলা খুলে দিলে তবে শান্তি হল।

পৌনে এগারোটা, সিন্ধুর তীরে
বেশ কিছুক্ষণ হল বেরিয়েছি। গাড়িতে বসে ঘুমাতে ঘুমাতেই ফিরছিলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে আজ।
সো মোরিরি থেকে ফেরার সময় আরেকটা সুন্দর পাহাড়ি লেক সো কার দেখে লাদাখ অঞ্চলের আরেক গিরিপথ ট্যাংলাং লা (১৭৪৮০ ফু.) পেরিয়ে লেহ ফেরার কথা ভাবা ছিল। কিন্তু কোরজোক গ্রামে না থেকে ফিরতি পথে এগিয়ে এসে চুমাথাং-এ থাকায় আবার বেশ অনেকটা রাস্তা উল্টো পথে গিয়ে সো কারের রাস্তা ধরতে হবে। আমাদের সারথি তুন্ডুপের এলাকায় আজ ভোট। এই ক'দিন যখন যেখানে গাড়ি দাঁড় করাতে বলা হয়েছে থামিয়েছে, কিন্তু আজ আমাদের তাড়াতাড়ি লেহ পৌঁছে দিয়ে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে বেচারি। সরল সাধাসিধে লোকটার ভোট দিলে সমস্যার সমাধান হতে পারে এই আশায় আগ্রহী মুখটা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ওর সুবিধেমতই ফেরা হবে। অতএব সো কার অদেখাই রয়ে গেল।
তবু এ পথে আমার সবথেকে ভালো লেগেছে সিন্ধুকে। অনেকক্ষণ ধরেই সিন্ধুর পাশে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল। অতএব পথের মাঝে ধসে ভেঙে পড়া রাস্তা সারাইয়ের জন্য যখন গাড়িটা আটকেই গেল অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, ডায়েরি, পেন, মোবাইল ও যাবতীয় ধড়াচূড়াসহ ধপাস করে বসে পড়লাম পথের পাশে একটা চ্যাপটা পাথরের ওপর। সিন্ধু যদিও এখানে অনেকটা নিচে। আমি যে পাহাড়ের ওপর পথে বসে আছি, ওপরে তাকালে মালুম হচ্ছে যে এ পাহাড়ে মাটির ভাগ বেশি। নিচে সিন্ধুর পাড়ের দিকে তাকালে আবার অজস্র বড় বড় বোল্ডার চোখে পড়ছে। অনেক পাথর আবার আটকেছে পাহাড়ের গায়ে মাঝপথেও। আসলে রাস্তা সারাইয়ের লোকজন ওপর থেকে পাথর ফেলছে। এখানে রাস্তা সারানোর পদ্ধতি এটাই। বেশির ভাগ পাহাড়ই ঝুরো পাথরের। জায়গায় জায়গায় সাইনবোর্ড-ও লাগানো – ঝুরো পাথর, ধস নামতে পারে, গাড়ি থামাবেন না। কোথাও ধস নেমে রাস্তা ভেঙে গেলে বি.আর.ও.-র লোকেরা সেখানে জমে যাওয়া বোল্ডারগুলো বুলডোজার দিয়ে ঠেলে পাশের খাদে ফেলে দেয় আর অন্যপাশের পাহাড়ের নিচের দিকটা আরও খানিক কেটে দেয়। এইজন্যই পাহাড়ে অনেক জায়গায় দেখা যায় যে রাস্তার ওপরে পাহাড়টা একটা ক্যানোপি তৈরি করেছে।
রোদ উঠেছে, তবে বড্ড ঠান্ডা। নীল আকাশে অনেক সাদা মেঘ ছড়ানো।
ডায়েরি থামিয়ে সিন্ধুর দিকে তাকিয়ে বসে থাকি এবার চুপ করে। এখানে ওর প্রবল তেজ নেই। উপচানো রূপ নেই। তবু এই শান্ত তিরতিরে নীল জল আমার ভালো লাগে। ওর সঙ্গে কল্পনায় চলে যাই ছেলেবেলার ইতিহাসের পাতায়। নদীর ওপাড়ে চোখ যায়। পশমিনা ছাগলের একটা বড় দল নিয়ে চরাতে যাচ্ছে একজন। সেই প্রাচীন সিল্ক রুটের সময় থেকেই এই পশমিনা উলের কদর সারা দুনিয়ায় – মনে একটা প্রশ্ন জাগে হঠাৎ, পশমিনা থেকেই কি পশম শব্দটার উৎপত্তি?

বেলা একটা, হেমিস গুম্ফা
কারু আর উপসির মাঝে বড় একটা জায়গা জুড়ে হেমিস গুম্ফা। লেহ থেকে দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। প্রচুর গল্পকথা আছে এই প্রাচীন মনাস্ট্রিকে ঘিরে। এগার শতকের আগেও এই মনাস্ট্রির অস্তিত্ব ছিল। তান্ত্রিক যোগী তিলোপার শিষ্য নারোপার কাহিনিতে এই মনাস্ট্রির কথা পাওয়া যায়। নারোপার জীবনীগ্রন্থটি এই মনাস্ট্রিতে রাখা আছে। তাতে নারোপাকে বিহারের নালন্দা বৌদ্ধবিহারের প্রধান গুরু রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত তুর্কি ও আফগান আক্রমণের সময় নারোপা সেখান থেকে হেমিসে চলে আসেন। হেমিসে এসে নারোপা তান্ত্রিক গুরু ঘন নীল রঙের চেহারার তিলোপার সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁকে বারোটি বড় কাজ ও বারোটি ছোট কাজ দেন যা নারোপাকে সবকিছুর ভেতরের অন্তর্লীন শূন্যতা এবং মায়াকে চিনিয়ে আলোকপ্রাপ্ত করবে। এবং তাঁরা দুজনেই সেইসময়ের মগধের একটি মনাস্ট্রি ওতন্ত্রতে (বর্তমান ওদন্তপুরী) যান। নারোপাকে বৌদ্ধ ধর্মের কাগয়ু-সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। হেমিসও তাই এই সম্প্রদায়ের একটি মূল গোম্ফা।
হেমিস মনাস্ট্রিকে নিয়ে আরও একটি চমকপ্রদ কাহিনি আছে। ১৮৯৪ সালে রাশিয়ান সাংবাদিক নিকোলাস নোতোভিচ হেমিস ভ্রমণ করে এই তথ্য তুলে আনেন। যিশু খ্রিস্টের অজানা কাহিনি 'দ্য লাইফ অফ সেন্ট ইসা, বেস্ট অফ দ্য সনস অফ মেন'-এর উৎস তাঁর ভারতবর্ষে গোপনে থাকার সময়ে এই হেমিস মনাস্ট্রিই। নোতোভিচ বলেন যে, সেই পুঁথি এই মনাস্ট্রিতে রক্ষিত আছে, তা নিজের চোখে দেখেছেনও। হেমিস ভ্রমণের কথা লিখতে গিয়ে পরবর্তীকালে স্বামী অভেদানন্দও তাই লিখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে অনুসন্ধান করে এই দুই কাহিনিরই কোনও সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। যদিও প্রাচীন রেশমপথ ধরে তুর্কি, পারস্য হয়ে যিশু ও মেরির কাশ্মীরে আসা ও বসবাস নিয়ে বছর কয়েক আগে হোলগার কার্স্টেনের বেস্টসেলার গ্রন্থ 'জেসাস লিভড ইন ইন্ডিয়া'-ও বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তবে সত্যি আমারও খুব মনে হয় যে, পুরোনো মনাস্ট্রিগুলোর আলো-আঁধারিতে আলমারির কাচের আড়ালে থরে থরে রাখা প্রাচীন পুঁথিগুলোর ভেতরে কত যে কাহিনি আর রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে তা কে জানে!
গুরু পদ্মনাভ-র জন্মদিবস উপলক্ষে হওয়া দুদিনব্যপী হেমিস উৎসব দেখার মত। জুন মাসের শেষের দিকে এই উৎসবের সময়। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ লামাদের মুখোশ নৃত্য।
বেশ অনেকটা হেঁটে পাহাড় বেয়ে উঠে দেখি দুপুর হয়ে যাওয়ায় হেমিস গুম্ফা বন্ধ। স্থানীয় মেয়েদের একটা দল গল্প করতে করতে নিচে নামছে। এতদূর এসে এমন বিখ্যাত একটা মনাস্ট্রি না দেখেই চলে যাব? অতএব অপেক্ষা। বিশাল চাতালে শুধু আমরা ক'জন। মনাস্ট্রির বাসিন্দাদের কাউকেও দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর যখন প্রায় হাল ছেড়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছি, অবশেষে দরজা খুলল। ওপরতলায় গুরু পদ্মসম্ভবের বিশাল একটি মূর্তি। হাতে মেডিসিন বুদ্ধগুলির মতোই ওষুধের পাত্র। পায়ে জুতো। মূল মন্দিরে বুদ্ধমূর্তিটি বেশ অদ্ভুত। মাথায় তিব্বতি স্টাইলে টুপি। চেহারাও অন্যরকম। হাতে পদ্মফুল। তলায় কাচের পাত্রে সম্ভবত ওষুধ। বাঁ হাতে কালো রঙের একটি অদ্ভুত ধরণের মূর্তি। গুম্ফার ছাদে গিয়েছিলাম। ওখানে একটা কালীমন্দির আছে। বন্ধ ছিল। রুক্ষ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অনেকটা জায়গা জুড়ে ইতিউতি ছড়িয়ে আছে মনাস্ট্রির ঘরবাড়িগুলো। সামনে পাথুরে পাহাড়ের সারি স্তরে স্তরে – নিচে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে কারু। ওপর থেকে চারপাশটা দেখতে ভারী ভালো লাগছিল। কিন্তু বড্ড ক্লান্তও।
বিকেল এগিয়ে আসছে। তুন্ডুপ তাড়া দিচ্ছে এবার – ফিরতে আরও দেরি হলে ভোট দেওয়া হবে না ওর! আবার সেই চেনা পথে লেহ ফিরে এলাম।
..................................
মিলিটারি এলাকা পেরিয়ে আসি। তবু তারপরেও যেন
মনে হয়, অন্য এক পৃথিবীতে বেঁচে আছি, অন্য কোথাও -
যেখানে হানাহানি নেই, অযথা হত্যার দরকারও নেই কোনও।
রাজনীতির অঙ্ক বা ধর্মের চালও নিষ্প্রয়োজন।
নীল জলে সাদা পাখির দল, ওই দেখো, আকাশে হাত বাড়ায়।
সাদা মেঘ নিয়ে খুব নিচু হতে হতে আকাশও নেমে আসে হলুদ বালি পাহাড়ের কাছে।
এই পৃথিবীতেই দূরে, খুব নির্জনে একা একা বেঁচে থাকে এক হ্রদ - নীলবসনা
সো মোরিরি।

(ক্রমশ)

আগের পর্ব – তৃতীয় পত্র


~ লাদাখের আরও ছবি ~

 

লেখালেখি, বেড়ানো, নানা রকম বই পড়া, ন্যাশনাল লাইব্রেরি আর কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় যাওয়া, কখনোবা গলা ছেড়ে গান গাওয়া এইসবই ভালো লাগে 'আমাদের ছুটি'-র সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্তের।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher