বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।
[বিভিন্ন সূত্র থেকে শ্রী রামলাল সিংহ সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য পেয়েছি তা হল - পাটনানিবাসী বি-এল উপাধিধারী শ্রী সিংহ ছিলেন প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিক। নব্যভারত পত্রিকার ১৩০২ সালের বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ সংখ্যাদুটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ে পত্রিকার সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী শরীর সারানোর উদ্দেশ্যে মাসখানেক রাজগিরে কাটান ও ফিরে এসে তিনিও পরবর্তীতে পত্রিকায় রাজগির নিয়ে একটি দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখেন। সেই দিক থেকে লেখাটির একটা অন্য গুরুত্বও রয়েছে। সেইসময়ের হিন্দু বাঙালির তীর্থভ্রমণের এই কাহিনিটিতে ধর্ম এবং জাতিবোধের কিছু প্রাবল্য থাকলেও ভ্রমণের বর্ণনা আকর্ষণীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাঙালির তীর্থভ্রমণ কাহিনি শাখাটি কিন্তু সম্পূর্ণতই পুরুষ লেখকদের নির্মিত। সেকালের বাঙালি নারীর ভ্রমণকাহিনিতে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভিন্নগোত্রের। তবে যে কোনও লেখাকে তার সমকাল দিয়ে বিচার করাই ভালো।
এই লেখায় উল্লিখিত 'সরস্বতী' নদীটি আসলে 'শর্বতী' নদী। স্থানীয় মানুষদের উচ্চারণ অনুধাবনে লেখক হয়তো ভুল করেছিলেন। ভুলটি নজরে এনে আমাদের ধন্যবাদার্হ করেছেন 'আমাদের ছুটি'-র বন্ধু হিমাদ্রী শেখর দত্ত।]
রাজগৃহ বা রাজগিরি দর্শন
শ্রী রামলাল সিংহ
গিরি-ব্রজগিরিসঙ্কট - এমন রমণীয় স্থান আর দেখি নাই। দুই পার্শ্বে অত্যুচ্চ পর্ব্বত মালা, মধ্যে সঙ্কীর্ণ গিরিপথ। সেই সৌম্য শান্ত অটল অচল মধ্যবর্ত্তী গিরিপথ দিয়া স্বচ্ছসলিলা বাণগঙ্গা লজ্জা-নম্র বধূসম ধীরে ধীরে বহিয়া চলিয়াছে, সেই ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীর উভয় তট শ্বেত রক্ত হরিদ্রা বর্ণ মিশ্রিত মসৃণ প্রস্তরাচ্ছাদিত। আমাদের পাণ্ডা বলিলেন, এইখানেই "গজদ্বার' ছিল। এক সময়ে এই গিরি-সঙ্কট যে সুদৃঢ়রূপে রক্ষিত ছিল, তাহার স্পষ্ট প্রমাণ দেখিতে পাইলাম। নিম্নদেশে স্থানে স্থানে প্রবেশ দ্বারের ভগ্নাংশ সুচারু সজ্জিত প্রস্তর রাশি এখনও বর্ত্তমান; উভয় পার্শ্বস্থিত পর্ব্বতোপরি ১৩ ফুট প্রস্থ পাষাণ-প্রাচীর বহুদূরাবধি অজগর সর্পের ন্যায় শায়িত রহিয়াছে। আমরা পশ্চিমদিকের পর্ব্বতে উঠিয়া এই প্রাচীরের উপর দিয়া বহুদূর গেলাম, কিন্তু কোথায় শেষ হইয়াছে, তাহা দেখিতে পাইলাম না। এই গিরিসঙ্কটের দক্ষিণেই বিস্তৃত উর্ব্বর ধান্যক্ষেত্র, পূত-সলিলা বাণগঙ্গা, গিরিব্রজ গিরির দক্ষিণ পাদ বিধৌত করিয়া, সেই ক্ষেত্র রাশির মধ্য দিয়া পূর্ব্বাভিমুখে প্রবাহিত হইয়া, পঞ্চানন নদে মিশ্রিত হইয়াছে। পুরাকালে গিরিব্রজপুরের বহির্দ্দেশে, ঐ গিরিসঙ্কটের দক্ষিণ দিকে, শস্য-শালিনী সমতল ভূমিতে যে সমৃদ্ধশালী গ্রামাদিতে পরিপূর্ণ ছিল, তাহারও চিহ্ন দেখিলাম। সে গ্রাম নাই, সে সৌধমালা নাই, আছে শুধু সেই প্রাসাদাবলির প্রস্তর খণ্ডের স্তূপরাশি! পাঠক, একবার এইখানে আসিয়া ভারতের লুপ্ত-গৌরবের কঙ্কাল রাশি দর্শন কর। এই গিরিসঙ্কট দেখিতেই বেলা দ্বিপ্রহর হইল, জঠরানল জ্বলিয়া উঠিল, সকলে ক্ষুধায় কাতর হইয়া পড়িলেন। আমাদের বাসা সেখান হইতে প্রায় তিন ক্রোশ, নিকটস্থ গ্রাম এক ক্রোশের অধিক লক্ষিত হইল, সকলেই চিন্তিত হইলেন। এমন সময়ে জনৈক ব্যাপারী বলদ পৃষ্ঠে ছালা লইয়া তথায় উপস্থিত হইল, সে গিরিসঙ্কট পার হইয়া দক্ষিণাভিমুখে যাইতেছে। তাহাকে জিজ্ঞাসা করা গেল – বাপু হে, তুমি বলদ পৃষ্ঠে কি লইয়া যাইতেছ, আমাদের কিছু আহারীয় সামগ্রী দিতে পার? সে বলিল, আমি মহাজনের চিঁড়ে লইয়া যাইতেছি আমার নিকট আপনাদের আহার-যোগ্য কিছুই নাই। আমাদের অবস্থা জানাইলাম, অনুনয় বিনয় করিলাম, তাহাতে তাহার হৃদয় আর্দ্র হইল না। ক্রমে দেখিলাম, বলদগুলি অতি সাবধানে মসৃণ প্রস্তরের উপর দিয়া বাণগঙ্গা পার হইল, ব্যাপারীও চলিয়া যায়, তখন অনন্যোপায় দেখিয়া আমাদের জনৈক বন্ধু ভয় প্রদর্শনার্থ সেই ব্যাপারীকে বলিলেন, তুমি হাকিমদের কথা শুনিতেছ না, তোমার বিপদ সমূহ দেখিতেছি। তখন সে রাজি হইল এবং আমাদের নিকট ১৪ টী গোলকপুরি পয়সা ছিল, তাহা লইয়া দুই অঞ্জলি উৎকৃষ্ট চিঁড়ে এবং কতকগুলি পানিফল দিল। আমরা তাহাকে শত ধন্যবাদ দিতে দিতে সেই শিলাতটে বসিয়া কিঞ্চিৎ জলযোগ করিলাম, এবং কতক চিঁড়ে সকলে আপনাপন পকেটে পূরিয়া লইয়া প্রত্যাবৃত্ত হইলাম।
আমরা যখন গিরিব্রজোপরি উঠিবার পথের নিকট আসিলাম, তখন বেলা দ্বিতীয় প্রহর অতীত হইয়াছে, সকলেই ক্লান্ত শ্রান্ত, কিন্তু গিরিশিখরস্থ মন্দির দর্শনাভিলাষ বড়ই বলবতী, কাজেই ধীরে ধীরে উপরে উঠিতে লাগিলাম, পথ মন্দ নয়, তবে আমরা অনেক পথ চলিয়াছিলাম বলিয়া একটু একটু কষ্ট বোধ হইতে লাগিল। আমাদের যে বন্ধুটি পূর্ব্বদিন বিপুলাচলের পাদদেশ পর্য্যন্ত যাইয়া প্রত্যাবৃত্ত হইয়াছিলেন, তিনি আজি সকলের ধিক্কারে লজ্জিত হইয়া আমাদের সঙ্গে পর্ব্বতোপরি উঠিতে লাগিলেন, কিন্তু তৃতীয়াংশ পথ উঠিয়াই ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন, আমরা কাজেই তাঁহাকে সেইখানে একাকী ফেলিয়া রাখিয়া উপরে উঠিলাম। শৃঙ্গস্থ মন্দিরে আসিয়া আমরা সকল ক্লান্তি ভুলিয়া গেলাম। এইখানে আসিয়াই গিরিব্রজপুরির যে পূর্ণ দৃশ্য দেখিবার জন্য লালায়িত হইয়াছিলাম, তাহা দেখিয়া মনে বড় আনন্দ হইল। মন্দিরের গঠন বাঙ্গালা দেশের মন্দিরের ন্যায়, মন্দির প্রাঙ্গন চতুর্দ্দিক উচ্চ ইষ্টক প্রাচীরে বেষ্টিত, এবং প্রাচীরের বহির্দ্দেশে প্রশস্ত চত্তাল, প্রাঙ্গনের চতুঃপ্রাচীরে চারিটি অর্দ্ধ-মন্দির বক্রভাবে নির্ম্মিত এবং প্রত্যেকের মধ্যে বুদ্ধদেবের যুগল পাদুকা কৃষ্ণ প্রস্তরে খোদিত। প্রধান মন্দির মধ্যে কৃষ্ণপ্রস্তর নির্ম্মিত শতফণী-উপরি উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্ত্তি, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম্ম-বিদ্বেষীদিগের হস্তে সে সুন্দরমূর্ত্তি স্থানে২ বিকৃতাঙ্গ হইয়াছে। মন্দির বহুদিনের যে পুরাতন, তাহা দেখিয়া বোধ হইল না। পাঠক, যদি কখন রাজগৃহে যাও, তবে গিরিব্রজগিরির শিখরদেশে উঠিয়া পঞ্চগিরি ব্যুহস্থিত জরাসন্ধের লীলাভূমির ভগ্নাবশেষ দেখিও, সেই পর্ব্বতের কটিদেশে দণ্ডায়মান হইয়া পর্ব্বতকন্দর প্রতিধ্বনির শতকম্পন শ্রবণ করিও, প্রাণ পুলকিত হইবে।
আমাদের মন্দির দেখিয়া নীচে নামিতে বেলা প্রায় ১টা হইল। ফিরিয়া আসিতে পথে গিরিব্রজগিরির মধ্য-উপত্যকা ভূমিতে, বৈভার, রত্নাচল, রত্নগিরি এবং বিপুল মধ্যস্থিত বিস্তৃত সমতল ভূমিখণ্ডের মধ্যভাগে চন্দ্রাকার দুর্গ-প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ বনবৃক্ষাচ্ছাদিত হইয়া আজও দণ্ডায়মান রহিয়াছে দেখিলাম। পাণ্ডা বলিলেন, ইহা এক অতি প্রাচীন দুর্গের ভগ্নাবশেষ, ইহা 'সূর্য্যদ্বার' হইতে 'গজদ্বার' অবধি যে পথ এবং গৈরিক গিরিশৃঙ্গ হইতে জরাসন্ধের রাজপ্রাসাদ অবধি যে পথ ছিল, তাহারই সন্ধিস্থলে স্থিত। যাহাতে কোন শত্রু রাজপ্রাসাদে গুপ্তভাবে প্রবেশ করিতে না পারে, সেইজন্য এই দুর্গ নির্ম্মিত হইয়াছিল। কথাটা বড় অসম্ভব বোধ হইল না। কিন্তু আমরা পাণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, এই উপত্যকার স্থানে স্থানে যে সকল প্রাচীর-বেষ্টিত স্থান দেখিলাম, উহা যদি জরাসন্ধের সময়ের হয়, তবে ত সে আজি সার্দ্ধ তিন সহস্র বৎসরের কথা, মৃত্তিকা নির্ম্মিত প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে, আর পাষাণময় সৌধমালার চিহ্ন বিলুপ্ত হইল? আর সেই পঞ্চগিরি-বেষ্টিত বিপুল সৈন্যে রক্ষিত উপত্যকা ভূমিতে দ্বিতীয় দুর্গ নির্ম্মাণের আবশ্যক কি ছিল? পাণ্ডা বলিলেন, সে সৌধমালা, সে প্রস্তর-নির্ম্মিত রাজপ্রাসাদাদি বিজেতা ও বিধর্ম্মীদিগের হস্তে বিদ্ধস্ত হইয়া, প্রকৃতির সহিত এতকাল যুদ্ধ করিয়া ভূমিসাৎ হইয়াছে; আর আজি যে প্রাচীর মৃত্তিকাময় দেখিতেছেন, তাহা এক সময়ে প্রস্তরাচ্ছাদিত ছিল, এবং উহাদের প্রতি এত মনুষ্য অত্যাচার হয় নাই, তাই সেই সকল স্থানে স্থানে দণ্ডায়মান রহিয়াছে; পার্ব্বতীয় হিংস্র বন্যজন্তু হইতে আপনাদিগকে রক্ষা করিবার জন্য, রাত্রিকালে বন্য জন্তুর এবং গুপ্তশত্রুকুলের পথ অবরোধ করিবার জন্য উহা নির্ম্মিত হইয়াছিল, ইহা শাস্ত্রে লিখা আছে। আমাদের কেহ কেহ বলিলেন, বোধহয় উহা বৌদ্ধকালে নির্ম্মিত হইয়া থাকিবে। যখন মগধ রাজ্যের রাজধানী পাটলীপুত্র নগরে স্থাপিত হইল, যখন গিরিপথ সকল বিপুল সৈন্য দ্বারা রক্ষা করা অসম্ভব হইল, তখন বৌদ্ধ রাজন্যবর্গ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্গাদি নির্ম্মাণ করিয়া ঐ উপত্যকা ভূমিতে বাস করিতে লাগিলেন। এইরূপ তর্ক করিতে করিতে বেলা তিনটার সময় বাসায় ফিরিয়া আসিলাম, স্নান আহারাদি করিতে চারিটা বাজিল। সে দিন আর কোথাও যাওয়া হইল না, বাসায় বসিয়া কেহ তাস খেলিতে লাগিলেন, কেহ বা আমাদের পাণ্ডার সহিত শাস্ত্রালাপ লইয়া রহস্য আরম্ভ করিলেন। পাণ্ডা মহাশয় রাজগিরি মাহাত্ম্য সম্বন্ধে দুই চারিটী সংস্কৃত শ্লোক আওরাইয়া আপনার বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। তিনি জাতিতে ব্রাক্ষ্মণ, কিন্তু ব্রাক্ষ্মণের ব্রাক্ষ্মণত্ব হারাইয়াছেন। "শ্রুতিস্মৃতি ঢালিয়াছে বিস্মৃতির জলে, স্কন্ধে ঝুলে পড়ে আছে শুধু পৈতেখানা, তেজহীন ব্রাক্ষ্মণ্যের নির্ব্বিষ খোলস"। এখানকার পাণ্ডারা বলেন, তাঁহারা কান্যকুব্জ, মহারাষ্ট্রীয়, দ্রাবিড়ী, তৈলঙ্গী এবং কর্ণাটী ব্রাক্ষ্মণের বংশধর। কিন্তু আজি তাহারা অতি দরিদ্র, চরিত্র বড়ই দূষণীয় এবং নিন্দনীয়। আমাদের পাণ্ডা একটি কদর্য্য পীড়া ভোগ করিতেছেন দেখিতে পাইলাম।
বুধবারঃ—আজি প্রত্যূষে আমাদের মধ্যে তিন জন বাঁকিপুরে ফিরিয়া যাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন, আমরা কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া বৈভারাচল আরোহণ করিতে চলিলাম। সমতল ভূমি হইতে পাকা সিঁড়ি দিয়া কিঞ্চিৎ ঊর্দ্ধে উঠিয়াই বৈভারের পূর্ব্বপাদে সাতটি কুণ্ড বা উষ্ণ প্রস্রবণ দেখিতে পাওয়া গেল। যথা (১) সপ্তঋষি কুণ্ড বা সপ্তধারা কুণ্ড, (২) ব্রক্ষ্মকুণ্ড, (৩) গঙ্গা-যমুনা কুণ্ড, (৪) ব্যাসকুণ্ড, (৫) মার্কণ্ডকুণ্ড, (৬) অনন্তঋষি কুণ্ড, (৭) কাশ্যপঋষি কুণ্ড।
সপ্তঋষিকুণ্ড বা সপ্তধারাঃ—এই কুণ্ডটি দীর্ঘে পঞ্চাশ ষাট হাত এবং প্রস্থে দশ বার হাত হইবে, চতুর্দ্দিক উচ্চ ইষ্টক-প্রাচীরে বেষ্টিত। এই কুণ্ড মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাতটি পাথরের নল দিয়া অনবরত উষ্ণজল পড়িতেছে, পাঁচটি নল পশ্চিম দিকে এবং দুইটি দক্ষিণদিকে। পাণ্ডারা বলেন, এই সাতটি নল সাতটি পৃথক পৃথক প্রস্রবণের মুখ, কিন্তু আমরা বিশেষরূপে অনুধাবন করিয়া দেখিলাম যে প্রস্রবণ একটী এবং উহার জল পয়োনালা দিয়া বহিয়া গিয়া ৭ টি ভিন্ন মুখ দিয়া কুণ্ড মধ্যে পড়িতেছে; পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের নলের নিকটই প্রস্রবণের মুখ, সেই জন্যই ঐ নল হইতে প্রবলতমবেগে অধিকতর জল নির্গত হইতেছে। পূর্ব্বোক্ত পয়োনালায় কোনরূপ গোলযোগ হওয়াতে উত্তর-পশ্চিম কোণের নল হইতে জল পড়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এই কুণ্ডের জল মকদুমকুণ্ডের জল অপেক্ষা উষ্ণতর, কুণ্ড মধ্যে সদা সর্ব্বদা আন্দাজ আধহাত জল থাকে, অতিরিক্ত জল পয়োনালা দ্বারা বহির্গত হইয়া গিয়া সরস্বতীবক্ষে পড়িতেছে। জল পরিষ্কার রাখিবার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপল খণ্ড কুণ্ডের তলায় বিছান আছে। এই কুণ্ডের দক্ষিণ ভাগে একটি ক্ষুদ্র মন্দির মধ্যে গৌতম, ভরদ্বাজ, বিশ্বামিত্র, যামদগ্ন্য, দুর্ব্বাসা, পরাশর এবং বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিগণের কৃষ্ণ প্রস্তর নির্ম্মিত মূর্ত্তি। এই ঋষিদিগের নামে কুণ্ডের একটি একটি নলের নাম হইয়াছে, এবং সেইজন্যই ইহাকে সপ্তঋষিকুণ্ড বলে। আবার সপ্তধারায় জল পড়িতেছে বলিয়া সচরাচর লোকে সপ্তধারা কুণ্ড বলিয়া থাকে। এই কুণ্ডের জল মকদুমকুণ্ডের ন্যায় পর্ব্বত গাত্র হইতে নির্গত হইতেছে, জল অতি পরিষ্কার এবং ইহার ক্ষুধাকারী শক্তি অত্যন্ত অধিক। উষ্ণজল অল্পক্ষণ মাত্র মাটীর বাসনে রাখিলেই শীতল হইয়া যায় এবং খাইতে সুমিষ্ট।
ব্রহ্মকুণ্ডঃ - সপ্তধারার পার্শ্বেই ব্রহ্মকুণ্ড, ইহার জল অত্যন্ত উষ্ণ। যাত্রীদিগকে প্রথমে সপ্তধারায় স্নান করিয়া, অন্ততঃ কাপড় ভিজাইয়া, এই উষ্ণতর কুণ্ডে স্নান করিতে হয়। এই কুণ্ডের জল ভূগর্ভোত্থিত, কুণ্ডটি সাত আট হস্ত প্রস্থে এবং ঐরূপ দীর্ঘে হইবে, চতুর্দ্দিক উচ্চ প্রাচীরে বেষ্টিত। এই কুণ্ডে মুখ ধুইবার বা কুলকুচা করিয়া ফেলিবার অধিকার নাই। কুণ্ডমধ্যে জল বু্দ্বুদ্ অনবরত দেখিতে পাওয়া যায়। সদা সর্ব্বদা কুণ্ড মধ্যে এক গলা জল থাকে, অতিরিক্ত জল ক্ষুদ্র পয়োনালা দিয়া বহিয়া গিয়া সরস্বতী নদীতে পড়িতেছে, কুণ্ডে নামিবার সিঁড়িও আছে।
(৩) গঙ্গা-যমুনা কুণ্ডঃ - দুইটি পাশাপাশি নল দিয়া জল কুণ্ডেতে পড়িতেছে, একটি নল গোমুখী এবং অন্যটি মকরমুখী। পাণ্ডা বলিলেন, একটি ধারার জল শীতল এবং অন্যটির জল উষ্ণ বলিয়া গঙ্গা-যমুনা নাম হইয়াছে, আমরা নীচে নামিয়া ইহার পরীক্ষা করিলাম না, এই কুণ্ডের জল অপেক্ষাকৃত পঙ্কিল বলিয়া বোধ হইল। ব্যাসকুণ্ড প্রভৃতি অন্য চারিটী কুণ্ডের জল ভূগর্ভোত্থিত; কুণ্ডগুলি ছোট ছোট, ইহাদের জল বড় ব্যবহৃত হয় না। কেহ কেহ দেখিলাম শৌচক্রিয়ার্থ ঐ জল ব্যবহার করিতেছেন।
উপরে যে সকল কুণ্ডের কথা বলিলাম, তাহা পর্ব্বত সানুদেশ হইতে দশ পনর হাত নিম্নে, কুণ্ডে স্নান করিতে হইলে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া যাইতে হয়। উপরস্থ সমতল ভূমিতে দুইটি শিবমমন্দির দেখিলাম, একটি সপ্তধারা কুণ্ডের উত্তরদিকে এবং অন্যটি পূর্ব্ব-দক্ষিণ কোণে, পূর্ব্বদিকে একটি অসম্পূর্ণ মন্দির, ইহা গয়ার জনৈক হিন্দু তৈয়ার করাইতে ছিলেন, তাঁহার সহসা মৃত্যু হওয়াতে বিগ্রহ স্থাপিত হয় নাই। ব্যাসকুণ্ডের নিকট আমরা কামাখ্যা গুহা নামক একটি ক্ষুদ্রগুহা, এবং দণ্ডশ্রেয় মুনির সমাধি দেখিলাম। হিন্দু-বিদ্বেষী মুসলমানদিগের অত্যাচারের নিদর্শন সুদূর মগধের এই গিরি-প্রস্রবণের নিকটে বৈভারাঙ্কে আজিও অঙ্কিত দেখিলাম। পূর্ব্বোক্ত অসম্পূর্ণ মন্দিরের পুর্ব্বদিকে ইষ্টক প্রাচীরে বেষ্টিত মুসলমানদিগের নিমাজ পড়িবার স্থান। শুনিলাম মুসলমানেরা বৎসরান্তে বকরিদের সময় আসিয়া ঐখানে নিমাজ পড়িয়া থাকেন, অন্য সময়ে উহা বন্ধ থাকে।
বৈভারের পূর্ব্বপাদে এই উষ্ণ প্রস্রবণগুলি হিন্দু এবং জৈনদের পবিত্র তীর্থস্থান। প্রতি তিন বৎসরে হিন্দি মলমাসে এখানে বৃহতী হিন্দুমেলা হইয়া থাকে, বহুসংখ্যক হিন্দু নরনারী স্নানার্থ সমবেত হইয়া থাকেন। তাঁহাদের থাকিবার জন্য মৃত্তিকা ও প্রস্তরখণ্ড মিশ্রিত করিয়া ছোট ছোট কুটীর নির্ম্মিত হয়। জৈনেরা মাঘ মাস হইতে চৈত্র মাস অবধি এই সকল কুণ্ডে এবং সরস্বতী ও বাণগঙ্গা নদীতে স্নান, পঞ্চ-পর্ব্বতস্থিত মন্দির সকল দর্শন এবং বুদ্ধ 'পাদুকার' পূজা করিয়া থাকে। রাজগৃহ জৈনদিগের অতি প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান। স্ত্রী পুরুষ, বালক বালিকা, বৃদ্ধ যুবা সকল শ্রেণীরই লোক দেখিলাম রাজগৃহে আসিয়া থাকেন। যাঁহারা সবলকায় কিম্বা যাঁহাদের সঙ্গতি অতি অল্প, তাঁহারা পদব্রজেই রাজগৃহ –দর্শন এবং পর্ব্বতারোহণ করিয়া থাকেন, কেহ নগ্ন পদে কেহবা কাপড়ের জুতা পায় দিয়া পাহাড়ে উঠিয়া থাকেন, এবং যাঁহারা অক্ষম বা সঙ্গতি-সম্পন্ন, তাঁহারা ছোট ছোট ডুলিতে দুইজন, কখনও চারিজন বেহারা, উহাদিগের মায় ডুলি ভাড়া ২৷৷৴১০ দিলে তোমাকে পাঁচটি পাহাড়ের উপরে যতগুলি জৈনমন্দির আছে, সকলগুলি দেখাইয়া দিবে। ইহারা জাতিতে 'কাহার' – কৃষ্ণকায়, পার্ব্বত্য প্রদেশে থাকে বলিয়া যে বিশেষ হৃষ্টপুষ্ট তাহা নয়, তবে বড়ই কষ্টসহিষ্ণু এবং পর্ব্বতারোহণে বড় দক্ষ। ইহারা পিঠে করিয়া বালক বালিকা কিম্বা বৃদ্ধা স্ত্রীলোকদিগকে লইয়া উপরে উঠিতেছে, তাহাও দেখিলাম। হিন্দুরা পর্ব্বতশৃঙ্গস্থ মন্দির দেখিতে যান না। স্রোতস্বতী সরস্বতী হিন্দু ও জৈন উভয়ের নিকট সমান সমাদৃতা। পাণ্ডা বলিলেন, "কর্ম্মভ্রষ্টা যে লোকা, পতিতবেদ বিসর্জ্জিতা, শ্রুতি স্মৃতি বহির্ভূতা অস্তে যাং শুদ্ধে সরস্বতী" কিন্তু আমাদের ন্যায় নবোত্থিত হিন্দুধর্ম্মাবলম্বী নব্যবঙ্গ সম্প্রদায় ঐ সূত্রের অন্তর্গত হইতে পারেন না জানিয়া আমরা সরস্বতী নদীতে স্নান করি নাই। ইহাতে আমাদের পাণ্ডা বিশেষ কিছু যে ক্ষুণ্ণ হইয়াছিলেন, এমনও বোধ হইল না।
পূর্ব্বোক্ত কুণ্ড সকলের উপরে বিহারের জনৈক প্রসিদ্ধ জমিদারের অতিথিশালা, কিন্তু এখানে থাকিবার একটি অসুবিধা এই যে কোন ঘরের দরজা নাই। এখান হইতে ৬০ কিম্বা ৭০ ফিট উপরে উঠিয়াই একটি বৃহৎ পুরাতন প্রস্তর নির্ম্মিত প্রকোষ্ঠ দেখিলাম। ইহার চারিটি গবাক্ষ। ইহা এক সময়ে প্রবেশ দ্বার এবং পর্ব্বতস্থ প্রাচীর রক্ষার্থ প্রহরীদিগের থাকিবার স্থান ছিল বলিয়া বোধ হইল। এই প্রকোষ্ঠের উপরিভাগ প্রস্তরাচ্ছাদিত, ছাদের উপরে একটি মুসলমানি কবর দেখিলাম। ঐ প্রকোষ্ঠের কিঞ্চিৎ ঊর্দ্ধে উঠিয়া দক্ষিণ দিকে সোমেশ্বরনাথ মহাদেবের হিন্দুমন্দিরে যাইবার পথ। মন্দির এক্ষণে ভগ্ন অবস্থায়।
বৈভার পর্ব্বতোপরি আমরা পাঁচটি জৈন মন্দির দেখিলাম। প্রথমটি প্রায় চারিশত ফিট উচ্চে হইবে, মন্দির ইষ্টক নির্ম্মিত; মন্দির মধ্যে 'বুদ্ধ পাদুকা' অর্থাৎ এক প্রস্তর খণ্ডে ক্ষুদ্র চরণদ্বয় খোদিত। একপার্শ্বে বুদ্ধমূর্ত্তি খোদিত দুইটি ভগ্ন প্রস্তরখণ্ড পড়িয়া আছে। আরও খানিকটা উপরে উঠিয়া কাছাকাছি আরও তিনটি জৈন মন্দির দেখিলাম, উহার মধ্যে প্রথম মন্দিরটিতে একটি প্রস্তরখণ্ডে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু বুদ্ধদেবের মূর্ত্তি খোদিত। প্রবেশ দ্বারেও ওইরূপ মূর্ত্তি খোদিত দেখিলাম। মন্দিরে উঠিবার সিঁড়িগুলি কোন ভগ্নগৃহ বা মন্দিরের ক্ষূদ্র পাথরের থাম দিয়া তৈয়ারি। দ্বিতীয় মন্দিরটি চতুষ্কোণ, মন্দির বেষ্টনের জন্য চতুর্দ্দিক আচ্ছাদিত পথ, মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের ভিতর দিকে বুদ্ধমূর্ত্তি খোদিত। একদিকে 'নেমজিকা পাদুকা' নামক বুদ্ধ পদচিহ্ন প্রস্তরে অঙ্কিত। মুরসিদাবাদের জৈনেরা সম্প্রতি, ইহার জীর্ণসংস্কার করিয়াছেন। তৃতীয়টি কতকটা পিরামিডাকৃতি। ইহাকে প্রাণ বিবির মন্দির বলে। মন্দিরের দেয়াল প্রায় পাঁচফিট প্রস্থ, প্রাঙ্গনের চতুর্দ্দিকে পাথরের থামওয়ালা বারাণ্ডা। এখান হইতে প্রায় দুই শত ফিট উচ্চে আসিয়া বৈভারের সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গস্থ জৈন মন্দির দেখিলাম। মন্দির মধ্যে আবার সেই বুদ্ধ পদচিহ্ন প্রস্তরে অঙ্কিত, দেখিলাম একজন জৈন-যাত্রী চাল এবং একটি বাদাম দিয়া চরণদ্বয়ের পূজা করিলেন। এই মন্দিরের নিকটে আসিয়া বড়ই প্রীতিলাভ করিলাম। মন্দিরের ১৫৷২০ হাত দক্ষিণেই পাহাড় একেবারে নামিয়া গিয়াছে। এইখান হইতে ঠিক নিম্নদেশে রাজগৃহ উপত্যকার পূর্ণ দৃশ্য দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, জরাসন্ধের সেই মল্লভূমি, সেই উপত্যকা মধ্যস্থিত তড়াগ, সেই নির্ম্মল কূপ, সেই মৃত্তিকা প্রাচীর বেষ্টিত উপত্যকা খণ্ড সবই সুন্দর দেখা যিতেছে। উপত্যকার মধ্যভাগে মেখলার ন্যায় শোভমানা ক্ষীণা সরস্বতী যুগ-যুগান্তের অতীত কথা বক্ষে ধারণ করিয়া প্রবাহমানা। অগণন গো মহিষাদি পিপিলিকা শ্রেণীর ন্যায় বিচরণ করিতেছে, মধ্যে মধ্যে তাহাদের গলদেশস্থিত ঘন্টার মধুর নিক্কণ শুনা যাইতেছে। কোথাও বা রাখাল বালকেরা খেলা করিতেছে, কোথাও বা কাঠুরিয়ারা গান গাহিতে গাহিতে দলে দলে কাঠ কাটিতে যাইতেছে। এই স্থানে অল্পক্ষণ বিশ্রাম করিয়া আমরা নীচে নামিতে লাগিলাম। উপরোক্ত পিরামিডাকৃতি মন্দিরের নিকটে ফিরিয়া আসিয়া, উত্তর দিকে নামিয়া গিয়া, বৈভারের উত্তরাঙ্কস্থিত দুইটি গুহা দেখিতে চলিলাম। পথ সঙ্কীর্ণ ও কন্টকাকীর্ণ, এক স্থানে একদিকে বৃক্ষলতাদিতে আচ্ছন্ন, অন্য দিকে পাহাড় সিধে নামিয়া গিয়াছে, একটু পদস্খলিত হইলেই সহস্র হস্ত নিম্নে পতিত হইতে হইবে। যাত্রীরা এখানে আসেন না, সাহেবরা কখনও কখনও এই গুহা দেখিতে আসিয়া থাকেন। আমাদের পাণ্ডা এ গুহা দ্বয়ের পথ জানিতেন না। আমরা আর এক দল পাণ্ডার (যাঁহারা সর্ চার্লসকে এই গুহা দেখাইয়াছিলেন) সাহায্যে সেই দুর্গম পথ দিয়া বৈভারের কটিদেশে উত্তরদিকে পাশাপাশি দুইটি বৃহৎ সুন্দর গুহায় উপস্থিত হইলাম। পূর্ব্বদিকের গুহাটির ভিতরে খানিকটা গিয়া দেখিলাম, বক্রভাবে বামদিকে বহুদূরাবধি গুহা চলিয়া গিয়াছে, পাণ্ডারা বলিলেন, উপরে (পিরামিডের ন্যায়) মন্দিরের নিম্নদেশে যে গহবর দেখিয়াছেন, তাহাই এই গুহার অন্যমুখ। কিন্তু গুহা অন্ধকার, অপরিষ্কার পূতিগন্ধময় বলিয়া বেশী ভিতরে যাইতে সাহস হইল না। পার্শ্বস্থ গুহাটিও খুব বড়, কিন্তু উহা তত দীর্ঘ নয়। অনেকগুলি শজারুর কাঁটা পড়িয়া রহিয়াছে দেখিয়া কুড়াইতে লাগিলাম, এমন সময়ে এক স্থানে দেখিলাম, টাটকা রক্ত চিহ্ন – বৃহৎ বৃহৎ হাড় পড়িয়া রহিয়াছে। আমাদের রাজগিরে পঁহুছিবার পূর্ব্বদিনে গুলি দ্বারা আহত একটি ব্যাঘ্র ঐ পর্ব্বতের পাদদেশে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছিল শুনিয়াছিলাম, তাই আমাদের মধ্যে দু একজন অত্যন্ত ভীত হইলেন, কাজেই আমরা তৎক্ষণাৎ সেই খান হইতে প্রস্থান করিলাম। বৈভারাচলে নীলবর্ণের একপ্রকার সুন্দর বনফুল দেখিলাম, সৌরভে মন মোহিত হইল। আমরা পাণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কৈ সাধু সন্ন্যাসী কৈ? তিনি বলিলেন, যদি ধ্যানস্থ সাধু সন্ন্যাসী দেখিতে চান, তবে তপোবনে যান। তপোবন রাজগৃহের প্রায় ছয় ক্রোশ দক্ষিণে। সেখানে আজিও সন্ন্যাসীগণ তপস্যানিরত আছেন দেখিতে পাইবেন। সেখানেও এইরূপ পাঁচটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। উহা হিন্দুর পবিত্র তীর্থ স্থান। আমাদের সময়াভাবে তপোবন দেখা হইল না। আমরা বৈভারের উত্তর গাত্রে প্রস্তর প্রাচীরের ভগ্নস্তম্ভের সারি উচ্চতম শৃঙ্গ অতিক্রম করিয়া পশ্চিমদিকে চলিয়া গিয়াছে দেখিলাম, মনুষ্য-হস্ত-পরিষ্কৃত অধিত্যকা ভূমিতে বহুসংখ্যক গৃহাদির ভগ্নাবশেষ দেখিলাম।
আমাদের বাসায় ফিরিয়া আসিতে প্রায় এগারটা হইল। বাসায় আসিয়া দেখি, আমাদের তিনজন বন্ধু আহারাদি করিয়া বিহারে চলিয়া গিয়াছেন, আমাদের জিনিষপত্র একজন পুলিশ সাবইন্সপেক্টর বাঙ্গালার বাহির করিয়া মাঠে ফেলিয়া দিয়াছেন, আমাদের চাকর- ব্রাক্ষ্মণদের তাড়াহুড়া দিতেছেন, শীঘ্র রান্নাঘর খালি করিয়া দাও। শুনিলাম, বেহারের সবডিভিজনাল ডিপুটীবাবু টুরে আসিতেছেন, সঙ্গে আত্মীয় স্বজনও রাজগির দেখিতে আসিতেছেন। একটা বৃহৎ তাঁবু পড়িয়াছে, কেহ মাছ আনিতেছে, কেহ দুগ্ধ দধি আনিতেছে, কেহ বেগার ধরা পড়িয়া জল আনিতেছে, স্তূপাকার কাষ্ঠও সঞ্চিত হইয়াছে, মহা হুলস্থূল পড়িয়া গিয়াছে। আমরা বেগতিক দেখিয়া তাড়াতাড়ি স্নান আহারাদি করিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলাম। কিন্তু এইখানে বলিয়া রাখি, আমরা বেহারে আসিয়া শুনিলাম, ডিপুটিবাবুর ইহাতে কিছুমাত্র দোষ নাই। তিনি যাহাতে আমাদের কষ্ট না হয়, সেই জন্য নিজের থাকিবার নিমিত্ত তাঁবু পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।
আমরা পাণ্ডাকে একটাকা বিদায় দিয়া, রাজগৃহ গ্রামের মধ্য হইয়া পূর্ব্বদিকে বিপুলাচলের পার্শ্বদেশ দিয়া 'গিরিয়াক্' গিরি দর্শনার্থে যাত্রা করিলাম। রাজগৃহ গ্রামের দুই তিন মাইল পূর্ব্বে বিপুলাচলের একাংশের নাম সোণা পাহাড়, সোণা পাহাড়ের তলদেশে কল্যাণপুর গ্রাম। ভূতপূর্ব্ব কল্যাণপুর গোল্ড মাইনিং কোম্পানির বাঙ্গলা শূন্য পড়িয়া রহিয়াছে দেখিলাম। রাজগৃহ গ্রাম হইতে প্রায় তিন ক্রোশ পূর্ব্বদিকে আসিয়া কিছুদূর দক্ষিণদিকে গিয়াই গিরিয়াক্ গিরির সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। রত্নকূট এবং বিপুলাচল সম্মিলিত হইয়া যে শৃঙ্গমালা উঠিয়াছে, তাহারই নাম গিরিয়াক গিরি। এই পর্ব্বতের অধিকাংশ প্রস্তর গৈরিক বর্ণের, বোধহয় সেই জন্য ইহাকে গৈরিক গিরি বলিত এবং গিরিয়াক্ গৈরিক্ গিরির অপভ্রংশ মাত্র। সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গোপরি ইষ্টক নির্ম্মিত একটী বৃহৎ স্তম্ভ, উহার পরিধি ৬৮ ফিট এবং উচ্চতা প্রায় ৫৫ ফিট। ইহা জরাসন্ধের বৈঠক বলিয়া প্রসিদ্ধ। অত্রস্থ প্রাকৃতিক শোভা বড়ই মনোরম, পশ্চাতে গৈরিক গিরির অভ্রভেদী শিখরমালা, সম্মুখে বিপুল বৈভার প্রভৃতি পঞ্চগিরির নির্ঝরিণী বারি বক্ষে ধারণ করিয়া পঞ্চানন নদ গিরিয়াক্ গিরির পূর্ব্বপাদদেশ বিধৌত করিয়া দক্ষিণদিকে বহিয়া চলিয়াছে। ভীম অর্জ্জুন এবং পার্থ সখা শ্রীকৃষ্ণ এই পঞ্চানন নদ পার হইয়া, গৈরিকগিরি উল্লঙ্ঘন করিয়া, গুপ্তবেশে জরাসন্ধের রাজপুরীতে প্রবেশ করিয়াছিলেন। প্রতি বৎসর সহস্র সহস্র নরনারী এই পঞ্চানন নদে স্নান করিয়া, আপনাদের জীবন পবিত্র করিয়া থাকেন। পঞ্চানন নদ এখন পঞ্চনেহ বা পঞ্চানা নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ইহার অপর পারে গিরিয়াক্ গ্রাম। গিরিয়াক্ গ্রামের সমুখস্থ পর্ব্বতাংশের নিকটে আসিয়া গৈরিক গিরি শৃঙ্গস্থ স্তম্ভ দেখিতে যাইবার পথ খুঁজিতে লাগিলাম। এখানে মেলার সময় ভিন্ন অন্য সময়ে যাত্রীরা বড় আসেন না বলিয়া পাণ্ডারা এখানে থাকেন না, রাজগিরির পাণ্ডারাই যাত্রীদিগকে সঙ্গে লইয়া আসিয়া থাকেন। আমাদের সঙ্গে পাণ্ডা না থাকাতে আমরা উপরে উঠিবার পথ খুঁজিয়া পাইলাম না, আন্দাজি একটী পথ ধরিয়া উঠিতে লাগিলাম, তৃতীয়াংশ পথ উঠিতেই তিনটা বাজিয়া গেল, অবেলায় আর উপরে উঠা যুক্তিসঙ্গত নয় বুঝিয়া আমরা নীচে নামিয়া আসিলাম। কিন্তু স্থানে স্থানে দেখিলাম, পুরাকালে যে সকল উঠিবার পথ ছিল, তাহার চিহ্ন বর্ত্তমান রহিয়াছে। পূর্ব্বোক্ত স্তম্ভশালী শিখরের কিঞ্চিৎ উত্তরদিকে সমতল ভূমি হইতে ৬০ কিম্বা ৭০ ফিট উচ্চে একটি বৃহৎ গুহা দেখিলাম। গুহার বহির্দ্দেশে মধুচক্রাকৃতি প্রায় ২০ ফিট দীর্ঘ এক প্রকাণ্ড প্রস্তর খণ্ড শৈলগাত্র হইতে বহির্গত হইয়া প্রবেশদ্বারের উপরিভাগে অবস্থিত রহিয়াছে। নীচে কোন রূপ সাহায্য নাই, মনে হয় উহার তলায় গেলে মাথায় পড়িবে। কিন্তু কতকাল হইতে যে উহা ঐরূপ শূন্যে রহিয়াছে, কে বলিতে পারে? গুহাটি বিলক্ষণ প্রশস্ত, মধ্যভাগের উচ্চতা ১২ ফিটের কম নয়। ইহার দুইটি প্রবেশপথ দেখিলাম, একটি পূর্ব্বদিকে, অন্যটি পূর্ব্ব উত্তর কোণে। কিন্তু শেষোক্তটি অতি ছোট। এই গুহা দেখিতে যাইবার পথ একটু কষ্টকর, আমরা জুতা খুলিয়া ধরাধরি করিয়া কোন ক্রমে উপরে উঠিয়াছিলাম। যাত্রীরা এই গুহাতে আসিয়া পূজাদি করিয়া থাকেন, বোধ হইল। গুহার প্রবেশ পথে সিন্দূরের ফোঁটা এবং গুহার ভিতরে ছোট ছোট গোল গোল আলতা মধ্যভাগের পাথরে আঁটা রহিয়াছে দেখিলাম। অতঃপর অপরাহ্ন হইয়া আসিল দেখিয়া আমরা পঞ্চানন নদ পার হইয়া গিরিয়াক্ গ্রামাভিমুখে চলিলাম। পঞ্চানন নদেতে জল এক হাঁটুর কিছু বেশি। কিন্তু পাহাড়ে উঠিতে হইলে আমাদের ধূতি পরা দেশিবেশই সুবিধাজনক দেখিয়া আজ প্রায় সকলেই ধূতি পরিয়া, এক জন কেবল মাত্র পেন্টুলান পরা, কাজেই তাঁহার নদ পার হইতে অসুবিধা হইল। এক্কাগুলিও অনায়াসে পার হইয়া গেল। আমাদের গিরিয়াক্ গ্রামের নিকট একজন মুসলমানের সহিত দেখা হইল। সে বলিল, আমরা যে দিক দিয়া গৈরিক গিরিশৃঙ্গোপরি উঠিতেছিলাম, তাহার কিঞ্চিৎ দক্ষিণ দিকেই উপরে উঠিবার আসল পথ। পথটি গিরিয়াক্ গিরির উচ্চতম শৃঙ্গস্থ স্তম্ভ অবধি গিয়াছে, দেখিলাম। মধ্য পথে ঋষি আসন মাইর মন্দির। গিরিয়াক্ গ্রামের এক ক্রোশ দক্ষিণে গিরিব্রজগিরি এবং গৈরিকগিরি মধ্যস্থিত গিরিসঙ্কটে রাজগৃহে প্রবেশের যে পূর্ব্বদ্বার ছিল, শুনিলাম তাহার ভগ্ন চিহ্ন বর্ত্তমান আছে। যদিও ডাকবাঙ্গালা ও ইন্সপেক্সন্ বাঙ্গালা নিকটেই ছিল, তত্রাচ সময়াভাবে আমরা সেখানে না থাকিয়া গিরিয়াক্ গ্রামের মধ্য দিয়া বেহারাভিমুখে ফিরিলাম। বেহারে আসিবার পথ পাকা ও প্রশস্ত, এবং দুই পার্শ্বে বৃক্ষরাজি। গিরিয়াক্ গ্রাম পাটনা জিলার সীমান্তে অবস্থিত, বেহার ঐখান হইতে ১১ মাইল। আমরা পথে আসিতে আসিতে জৈনদিগের প্রধান তীর্থ স্থান পাণ্ডপুরী দেখিতে পাইলাম। বিস্তৃত মাঠের মধ্যে স্থানে স্থানে সুন্দর মন্দিরাদি দণ্ডায়মান রহিয়াছে। বেলা পাঁচটার সময় বেহারে পঁহছিলাম। সেই বেলিসরায়ে আবার রাত্রি যাপন করিয়া প্রত্যূষে মেলকার্ট করিয়া বখতিয়ারপুরে আসিয়া, এবং সেখানে এক আত্মীয়ের বাটীতে আহারাদি করিয়া সন্ধ্যার গাড়ীতে বাঁকীপুরে ফিরিয়া আসিলাম।
বাল্যকালে চারুপাঠে পড়িয়াছিলাম যে, "যে প্রদেশে আগ্নেয়গিরি আছে, অথবা পূর্ব্বে কোনকালে ছিল, কিম্বা যেখানে অগ্নিঘটিত অন্য কোন প্রকার নৈসর্গিক উৎপাতের ঘটনা হইয়াছিল, সেই সেই প্রদেশেই অনেক উষ্ণপ্রস্রবণ দৃষ্ট হইয়া থাকে।" কিন্তু আমরা রাজগৃহে আগ্নেয়গিরি কিম্বা অগ্নিঘটিত অন্য কোন নৈসর্গিক উৎপাতের নিদর্শন দেখিতে পাইলাম না।
পাঠক! রাজগৃহে ভারতের বিগত বিপ্লবাবলীর তরঙ্গলেখা সেই শৈল উপত্যকার, সেই শেখরমালার অঙ্কে অঙ্কে অঙ্কিত দেখিয়া মুগ্ধ হইলাম। সেই শৈলমালার অধিত্যকা ও উপত্যকা ভূমিতে যে সকল প্রাসাদ এবং দুর্গাদির ভগ্নচিহ্ন দেখিলাম, পর্ব্বতোপরি সুদৃঢ় প্রস্তর প্রাচীর ও প্রাচীর-স্তম্ভের যে ভগ্নাবশেষ দেখিলাম, সুরক্ষিত প্রবেশদ্বারের যে নিদর্শন দেখিলাম, তাহাতে প্রতীতি জন্মিল যে, রাজগৃহ এক সময়ে প্রবলপরাক্রান্ত বহু অনীকিনীশালী নৃপতির রাজধানী ছিল। তবে জিজ্ঞাসা করিতে পার, সে নৃপতি কে, এবং তাঁহার আবির্ভাবকালই বা কবে? যদি মহাভারতের আখ্যায়িকা সত্য বলিয়া মান, তবে সেই নৃপতির নাম জরাসন্ধ, এবং তিনি যুধিষ্ঠির-প্রমুখ পাণ্ডবদিগের সমসাময়িক। সে আজ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বৎসরের কথা। মহাভারতে দেখিতে পাই, যখন যুধিষ্ঠির রাজসূয় মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠানের নিমিত্ত শ্রীকৃষ্ণের স্মরণাগত হইলেন, শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, যিনি সকলের প্রভু ও অখণ্ডভূমণ্ডলের অদ্বিতীয় অধিপতি, তিনিই কেবল রাজসূয় যজ্ঞে অধিকারী হইতে পারেন। যতদিন জরাসন্ধ বর্ত্তমান থাকিবে, ততদিন রাজসূয় যজ্ঞ করা কঠিন। জরাসন্ধ যাবতীয় নরপতিকে পরাজয় করিয়া একাধিপত্য করিতেছে। অপরিমিত বলশালী যবনাধিপতি ভগদত্ত তাহার প্রিয়ানুষ্ঠানে ব্যাপৃত, পুরজিৎ তাহার অনুগত, বঙ্গ, পুন্ড্র ও কিরাত দেশাধিপতি পৌণ্ড্রক তাহার শরণাপন্ন, পৃথিবীর চতুর্থাংশের অধিপতি ভীষ্মকও আত্মীয় স্বজন ছাড়িয়া তাহার অনুগত। দক্ষিণ পাঞ্চালস্থ ও পূর্ব্বকোশল নিবাসী রাজন্যবর্গ ও অন্যান্য নৃপতিমণ্ডলী স্ব স্ব রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া কুন্তিদেশে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। এমনকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকেও জরাসন্ধের ভয়ে মথুরাপুরী পরিত্যাগ করিয়া রৈবতক শৈলে পরিশোভিত কুশস্থলী নাম্নী পুরীতে গিয়া বাস করিতে হইয়াছিল। শিশুপাল সেনাপতি, অমরতেজা অস্ত্রের অবধ্য হংস ও ডিম্বক ভ্রাতৃদ্বয় জরাসন্ধের পার্শ্বরক্ষক। সেই দুই ভ্রাতা ও জরাসন্ধ মিলিত হইয়া যুদ্ধ করিলে কেহ তাহাদের সম্মুখে অস্ত্রধারণ করিতে সক্ষম নয়। তিন অক্ষৌহিণী সেনা তাহার বশবর্ত্তী। সমস্ত দেব দানব একত্রিত হইয়া যুদ্ধ করিলেও সম্মুখসমরে জরাসন্ধকে পরাজয় করা অসম্ভব। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, গোপন ভাবে জরাসন্ধগৃহে প্রবেশপূর্ব্বক তাহাকে বধ করিয়া ষড়-অশীতি নৃপতিদিগকে উদ্ধার করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করা বিধেয়। শান্তিপ্রিয় যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের বাক্যে নীতিশাস্ত্রের বশবর্ত্তী হইয়া ভীম অর্জ্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এই কার্য্যের ভার অর্পিত করিলেন। পুণ্ডরীকাক্ষ শ্রীকৃষ্ণ এবং ভ্রাতৃদ্বয় মিলিত হইলেন, - জ্ঞানবল, বাহুবল এবং নীতিবলের সংযোগ হইল। অনন্তর কুরুদেশ হইতে যাত্রা করিয়া ক্রমশঃ কুরুজাঙ্গাল, পদ্মসরোবর, কালকূট অতিক্রম করিয়া গণ্ডকী, মহাশোণ ও সদানীরা নদী উত্তীর্ণ হইয়া সরযূসরিৎ পার হইয়া পূর্ব্বকোশল দেশ অতিক্রম করিয়া, মালা, পরে চর্ম্মন্বতী নদী পারে উপস্থিত হইলেন। তৎপরে গঙ্গা ও শোণনদ পার হইয়া বীরত্রয় কিয়দ্দূর পূর্ব্বাভিমুখে গমন পূর্ব্বক মগধরাজ্যের সীমায় পদার্পণ করিলেন। অনন্তর তাঁহারা সলিল সমাকীর্ণ, গোধনপূর্ণ ও মনোহর বৃক্ষরাজি বিরাজিত গোরখ নামক পর্ব্বতের অধিত্যকা দেশস্থ মগধরাজার নগরী সন্দর্শন করিলেন। তদনন্তর চৈত্যকশৃঙ্গ ভেদ করিয়া রাজগৃহে প্রবেশ পূর্ব্বক ভীম জরাসন্ধের সহিত ত্রয়োদশ দিবস বাহুযুদ্ধ করিয়া তাহাকে বধ করিলেন। "জরাসন্ধের অদ্ভুত কৌশল, - কারামুক্তি, রাজমেধ যজ্ঞ-নিবারণ বিনাযুদ্ধে কৌশলে হইল সাধিত।" পাঠক! তুমি ইহা কবি-কল্পনা বলিতে পার। তুমি বলিতে পার, মহাভারতের রচনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বহুকাল পরে হয় নাই কে বলিল, জরাসন্ধ যে আধুনিক কোন নৃপতি নন, তাহারই বা প্রমাণ কি? মহাভারতের গিরিব্রজপুরীর পুর্ব্বোক্ত ভৌগলিক বিবরণের সহিত আধুনিক রাজগৃহ উপত্যকার কি সমতা হইতেছে না, মহাভারতের গিরিব্রজপুরী কল্পিত স্থান নহে, আধুনিক রাজগৃহই যে সেই পঞ্চগিরিমধ্যস্থিত গিরিব্রজপুর, তাহা কি আর বিস্তারিতরূপে বুঝাইতে হইবে? তবে জরাসন্ধ যুধিষ্ঠিরের বহু পরবর্ত্তী কোন 'ঐতিহাসিক পুরুষ' কি না? হন্টার, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রভৃতি ঐতিহাসদিগের মতে সে অনুমান ১০০০ খ্রীষ্ট পূর্ব্বাব্দে মহাভারত রচিত হয়, তাহা হইলে দেখাইতে পার, তিন সহস্র বৎসর পূর্ব্বে কোন 'ঐতিহাসিক পুরুষ' কোন মগদেশাধিপতি অখণ্ডসাম্রাজ্যের অধিপতি হইয়া ঐ পঞ্চগিরিব্যূহ মাঝে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন? যদি বল জরাসন্ধ কল্পিত পুরুষ, যে ভগ্নরাশি দেখিলে তাহা বৌদ্ধকালে নির্ম্মিত দুর্গ প্রাচীরাদির অবশিষ্টাংশ। কিন্তু বৌদ্ধনৃপতিগণ যে সময়ে মগধদেশে প্রবল প্রতাপান্বিত, তখন তাঁহাদের রাজধানী ঐ পঞ্চগিরিমধ্যস্থিত উপত্যকা ভূমিতে নয়, বিম্বিসারের রাজত্বকালে খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৫০৭ হইতে ৪৮৫ অব্দ মধ্যে, যে দুর্গ নির্ম্মিত হয়, তাহা বৈভারের উত্তরদেশে সমতল ভূমিতে, হাউনস্যাং মগধ পরিদর্শনকালে ৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে যাহার ভগ্নাবস্থা দেখিয়াছিলেন, তাহা আজও বর্ত্তমান; চন্দ্রগুপ্ত ও অশোকের রাজধানী পাটলীপুত্র নগরে। আর মহাভারতে বলে জরাসন্ধ বিনাযুদ্ধে কৌশলে বিনষ্ট হন, তোমার ইতিহাসও বলেনা যে এই পঞ্চগিরিস্থ পর্ব্বতপ্রাচীরমালা, রাজপ্রাসাদাবলী কোন ঘোরযুদ্ধকালে বিনষ্ট হইয়াছিল। তাই পুরাবৃত্ততত্ত্ববিৎ পণ্ডিতমণ্ডলীকে জিজ্ঞাসা করি, সেই সুদৃঢ় প্রাচীরমালা, প্রবেশ দ্বারাদি কত কালে প্রকৃতির সহিত যুদ্ধ করিয়া অযত্নে এই অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে? আমরা এই ভারতেই বুদ্ধগয়া এবং বারাণসীর নিকটে সারনাথে দেখিয়াছি, দুই সহস্রবর্ষাধিক ইষ্টক নির্ম্মিত বৌদ্ধমন্দির শত্রুহস্তে বিদ্ধস্ত হইয়াও দণ্ডায়মান আছে, ইহা হইতেও অনুমান করা যায়, কতকাল রাজগৃহের সুদৃঢ় প্রস্তর প্রাচীর এবং দ্বারদেশগুলি এই ভগ্ন অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে। তাই বলি, মহাভারতের জরাসন্ধ কল্পিত পুরুষ নহে। পঞ্চগিরিমধ্যস্থিত গিরিব্রজপুর কল্পিত স্থান নহে। তবে নিয়তির গতি অপ্রতিহত। সেই পঞ্চগিরি এখনও উন্নত, সেই সরস্বতী এখনও ধাবিত, সেই সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মগধভূমি এখনও বিস্তৃত, নাই শুধু সেই পূর্ব্বগৌরব। জরাসন্ধের যে সুন্দরীপুরী একদিন নাট্যশালাসম উজ্জ্বলিত ছিল, আজি তাহা নিয়তির বলে মহাশ্মশানে পরিণত হইয়াছে, বন্য হিংস্র জন্তুর চর-ভূমি হইয়াছে। আজি রাজগৃহের বীর্য্যসাক্ষী ঊষ্ণ প্রস্রবণ ভারতের শোক-প্রস্রবণে পরিণত হইয়াছে, আজি মগধের বিপুল ও বৈভার নেত্রদ্বয়ে তপ্তশোক-অশ্রুধারা অনর্গল বহিতেছে।
পাঠক! যদি মহাভারতে অবিশ্বাস হয়, যদি ঐ ভগ্নরাশি বৌদ্ধকালে নির্ম্মিত প্রাচীরাদির ভগ্নাবশেষ বল, তবে সেও তো অল্প দিনের কথা নয়। দুই সহস্র বৎসরের পূর্ব্বে নির্ম্মিত দুর্গ প্রাচীরাদির ভগ্নাংশ দেখিতে কি বাসনা হয় না? উত্তরভারতে বহু হিন্দুতীর্থ স্থান দেখিয়াছি, রামের জন্মস্থান অযোধ্যা নগরী দেখিয়াছি, শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি মথুরা-বৃন্দাবন দেখিয়াছি, হিন্দুর পবিত্র তীর্থ কাশী, হরিদ্বার দেখিয়াছি, কিন্তু রাজগৃহে আসিয়া যে সুখলাভ করিলাম, তাহা কুত্রাপি হয় নাই। সেই ভগ্নাবশেষ দেখিয়া প্রতীতি জন্মিল যে, যে সময়ে ঐ দুর্গ প্রাচীরাদি নির্ম্মিত হইয়াছিল, তখন মগধদেশ আর্য্যসভ্যতার আলোক আলোকিত, তখন ভারতবর্ষে যুদ্ধ ও স্থপতি বিদ্যার উন্নতিকাল। মনে হইল, প্রবাদ যে বিশ্বকর্ম্মা ইন্দ্রপুরী নির্ম্মাণান্তর ব্রক্ষ্মার আদেশানুসারে জরাসন্ধের পুরী নির্ম্মাণ করেন, তাহা বড় মিথ্যা নয়। পাঠক! যদি পার্ব্বত্যসৌন্দর্য্য দেখিবার বাসনা থাকে, যদি মহাভারতের গাথা কবিকল্পনা নহে, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখিতে চাহ, যদি উষ্ণপ্রস্রবণে স্নান করিয়া তাপিত হৃদয় শান্ত করিতে চাহ, তবে একবার রাজগৃহে আসিও। যদি বনফুলের আঘ্রাণে, বনবিহগের মধুর কূজনে, পর্ব্বত কন্দরের প্রতিধ্বনি-কম্পনে প্রাণ পুলকিত করিতে চাহ, যদি অধিত্যকা উপত্যকাভূমি গিরিগুহা একস্থানে দেখিতে চাহ, তাহা হইলে একবার এই ঐতিহাসিক পুরীতে আসিও। একবার রাজগৃহে আসিয়া ভারতের লুপ্তগৌরবের স্মৃতিচিহ্ন শৈলমালার অঙ্কে অঙ্কে অঙ্কিত দেখিও। যদি তুমি ভক্ত হিন্দু হও, তাহা হইলে রাজগৃহ পবিত্রতীর্থস্থান; যদি অসুস্থ হও, তবে তোমার দার্জ্জিলিঙ্গ মধুপুর, বৈদ্যনাথ যাইবার আবশ্যক নাই, শীতকালে রাজগৃহে আসিয়া সপ্তধারায় স্নান কর, তাহার জল পান কর, সকল তাপ দূর হইবে; আর যদি তুমি প্রত্নতত্ত্ববিৎ হও, তবে এই শৈলমালায়, ঐ উপত্যকাভূমিতে অনেক প্রত্নতত্ত্ব কথা জানিতে পারিবে। আর যদি ঘোর বিষয়ী হও, তাহা হইলে বলিব যে রাজগৃহ ডেয়ারি ফারমিংয়ের প্রশস্ত স্থান, ওয়াটার মিল স্থাপনের উপযুক্ত ভূমি।
( - সমাপ্ত - )
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ
[ মূল বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]