দিন তিনেকের ভুটান
সম্পত ঘোষ, সায়ন্তিকা ঘোষ
~ ভুটানের তথ্য ~ ভুটানের আরও ছবি ~
ভুটান সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ ছিল দীর্ঘদিনের। হিমালয়ের কোলে ছোট্ট একটা দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রশান্তি মুগ্ধ করে। কোনও জনজাতির জীবনধারণ সম্পর্কে জানার আগ্রহ অসীম, তবে ভুটান দেশটার যা সবথেকে বেশি টানে সেটা হল এদেশে উন্নতির মাপকাঠি জিডিপি বা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাকশনে নয় বরং নাকি গ্রস হ্যাপিনেস ইনডেক্সে মাপা হয়। এ তো গেল আমাদের একজনের কথা। আর অন্যজনের টানটা হিমালয়ের ভূতত্ত্বে। আকর্ষণের ক্ষেত্র আলাদা হলেও গন্তব্যটা মিলে গিয়েছিল। কাজেই মাত্র পাঁচদিনের ছুটিতে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে দুজনে বেরিয়ে পড়েছিলাম ভুটানের উদ্দেশ্যে।
ফুন্টশোলিং (Phuentsholing) যখন পৌঁছলাম, বেশ রাত্রি হয়ে গেছে। ওপার থেকে যারা দিনে কাজ করতে বা কোনও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ফিরে গেছেন দিনান্তে, নিরাপত্তারক্ষীদের ব্যস্ততাও অনেক কমে গেছে। ছোট্ট কিন্তু ভীষণ ব্যস্ত আর হট্টগোলে অভ্যস্ত একটা জনপদ এখন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরাও, বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে ফুন্টশোলিং পৌঁছতে প্রায় পাঁচ ঘন্টা সময় লেগেছিল। ট্যাক্সিচালক বিপুলের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হোটেলে উঠলাম। আমাদের আজকের ঠিকানা হোটেল ডামচেন।
ভুটান নামটার উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। তিব্বতী আর এখানকার অধিবাসীদের কাছে এটি অনেক নামে পরিচিত ছিল যেমন লো য়্যুল (Lho Yul - যার অর্থ দক্ষিণের দেশ, কারণ এটি তিব্বতের দক্ষিণে অবস্থিত), মেন জং (Men Jong - ওষধি ভূমি), মঁয়্যুল (Mon Yul - অন্ধকারের দেশ কারণ এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম তখনও বিশেষ প্রচার পায়নি), লো মঁ খা-জি, সেনদেন জং (Lho Mon Kha -zhi, Tsenden Jong - এসেন্স বা ধূপের ভূমি)। তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে ভুটান কথাটি এসেছে ভারতীয় শব্দ 'ভুটিয়া' (Bhutia/Bhutea) কিংবা নেপালি শব্দ 'ভোটে' (Bhotay) থেকে। কিছু ভারতীয় এবং অ-তিব্বতীয় লেখায় 'ভোতান্তা' (Bhotanta) কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে কিছু ভুটানি বিদ্বজ্জন মনে করেন ভুটান নামটি এসেছে বুমথাং (Bumthang) থেকে। বুমথাং ভুটানের মধ্যভাগে অবস্থিত। গাওয়াং নামগিয়াল (Ngawang Namgyal)-এর পূর্ববর্তী সময়ে তিব্বতীয় লেখায় ভুটান (Bhutan) বা ড্রুক য়্যুল (Druk Yul)-এর কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়না বরং বুমথাং-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। দীর্ঘ রেফারেন্স আর ইতিহাস হাতড়াতে হাতড়াতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেও পারিনি।
অনেক ভোরে ঘুম ভাঙল। ভুটানের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে এই ফুন্টশোলিং। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ভারত থেকে ভুটানের প্রবেশপথ, তবে ভারতীয়দের ফুন্টশোলিং অবধি যেতে ভিসা কিংবা পারমিট দরকার হয়না, এর আগে যেতে গেলে লাগে। আমরা যাব থিমফু (Thimphu), তাই ফুন্টশোলিং থেকে পারমিট বের করতে হবে। ইমিগ্রেশন অফিস সামনেই। ফর্ম পূরণ করে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হল। সাহায্য দরকার মনে হতেই পেয়ে গেলাম অবনীশকে, বায়োমেট্রিক ইত্যাদিতে আর বেশি সময় লাগল না, পারমিট হাতে এবার গাড়ি খোঁজার পালা। অবনীশ যোগাযোগ করিয়ে দিল অনিলদার সঙ্গে। অবনীশ, অনিলদা দুজনেই নেপালি, বাংলাও ভালো বলতে পারে, গেট পার হয়েই জয়গাঁওতে বাড়ি। ভারত আর ভুটান সীমান্তে অবস্থিত জয়গাঁও ভারতের প্রান্তীয় জনপদ, পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্গত। মূলত বাঙালি আর নেপালি জনবসতি। থিমফুর উদ্দেশ্যে আমাদের রওনা হওয়ার কথা বেলা একটায় আর এখন এগারটা বেজে গেছে। ব্রেকফাস্ট করা হয়নি, স্নান সেরে লাঞ্চের অর্ডার দিলাম। খাওয়ার সময় ছিলনা, তাই বেঁধে নিয়ে রওনা হলাম থিমফুর উদ্দেশ্যে। পরোটা, তন্দুরি চিকেন আর রায়তা। অনিলদা একটু লেট করেছিল। রওনা হলাম তখন প্রায় দেড়টা।
তোর্সা নদীর পাশ দিয়ে গাড়ি চলল, রাস্তাটা পিচের নয়, কাঁচা। কাজেই গাড়িও চলল হেলতে দুলতে। তোর্সা স্থানীয় লোকেদের কাছে আমু ছু (Amo Chhu) নামে পরিচিত। তিব্বতের চুম্বি ভ্যালি থেকে তোর্সার উৎপত্তি। মোট ৩৫৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ১১৩ কিমি পথ চিনের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত আর ১৪০ কিমি ভুটানের মধ্যে দিয়ে। আমু ছু খুব সুন্দর, অনেকটা ছবির মতন, তবে বেশ খরস্রোতা। আমাদের গাড়ির পারমিট বের করতে হবে যদিও সেটা অবনীশ আর অনিলদার দায়িত্ব। গাড়ি থামিয়ে শুরু হল তোর্সার সঙ্গে আমাদের ফোটোসেশন। যতটা পারা যায় ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করা। একটু দেরি হল, তা হোক, কিন্তু তোর্সার স্মৃতি সঙ্গে নেবনা সেটাতো আর হয়না। এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তা শেষ হল, পৌঁছলাম ভুটান সরকারের অফিসে। গাড়ির পারমিট বের করতে প্রায় আধঘন্টা লাগল। অবনীশকে বিদায় জানিয়ে এবার পিচরাস্তা ধরল গাড়ি।
আমাদের সঙ্গে খাবার আছে, আর সকাল থেকে আপেলের জুস ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। তোর্সা বেশ ভুলিয়ে রেখেছিল। অনিলদা কিছুই খেতে চাইল না, শেষপর্যন্ত একটু নিল। খাওয়া, গল্প আর গান শোনা - পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগলাম উঁচুতে। লিথোটেক্টোনিক ম্যাপ, মেটামরফিক অবসেরভেশন, সেডিমেন্ট সিরিজ ইত্যাদি নানান তথ্য উঠে এল পথ চলতে চলতে। একজন শ্রোতা, আর একজন বক্তা। ভূতত্ত্ববিদেরা গবেষণায় জানিয়েছেন যে মিয়োসিন যুগের লিউকোগ্র্যানাইটের (Leucogranite) চাদরটি দক্ষিণ তিব্বতীয় বিচ্যুতির সঙ্গে সংযুক্ত, কিন্তু ভুটান দেশের দক্ষিণভাগে সেটা ধীরে ধীরে কমে গেছে। ভুটানের ভূতত্ত্বের সঙ্গে ইতিহাসের বেশ কিছুটা সাদৃশ্য পেলাম। ভুটানে বৌদ্ধধর্ম প্রধানত তিব্বত থেকেই প্রচার পায়, ভুটানকে ধর্মীয় ও শিক্ষিত করে এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে গড়ে ওঠার অনুপ্রেরণা দেয়। পরবর্তীকালে সতেরোশো শতকে অন্তত চারবার তিব্বত মোঙ্গলদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আক্রমণ করে ভুটানকে, যদিও চারবারই তারা জহাবদ্রুং (Zhabdrung) এর সৈন্যদের কাছে পরাজিত হয়।
পাহাড়ের রাস্তার বাঁকে এক বয়স্ক মহিলা কমলালেবু বিক্রি করছেন, প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে ভরে রাখা। সাইজ অনুযায়ী দাম। আমরাও একটা টুকরি কিনলাম দুশো টাকা দিয়ে। ভুটানে ভারতীয় মুদ্রা চলে। এটা অবশ্য হোটেলেও দেখছি। আমরা এখনও পর্যন্ত ভারতীয় মুদ্রাই দিয়েছি, তবে ব্যালান্সটা ভুটানী টাকায় (Bhutanese ngultrum) ফেরত দিয়েছে সব জায়গায়। দুটো মুদ্রার বিনিময় মূল্য এক, তাই কোনও অসুবিধা হয়নি। কমলালেবু খেতে খেতে চললাম তিনজনে। খোসাগুলো রাস্তায় ফেলিনি, প্রকৃতি তার সৌন্দর্য্যের ডালি সাজিয়ে রেখেছে। মুগ্ধ হচ্ছি আমরা। অনিলদা হাতের তালুর মতন চেনে ভুটান, তবুও প্রতিবারের মতন এবারেও সে আবার প্রেমে পড়ছে। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে ফটো তুলছি, অনিলদারও কোনও ক্লান্তি নেই।
আঁধার হয়ে আসছে। একটু তাড়াতাড়িই সন্ধে নেমে এল। আগেই হোটেলে ফোন করে রিজারভেশন করে রেখেছিলাম। একটু মুশকিল হল হোটেল 'ওসেল' খুঁজতে। আসলে খুব পুরোনো নয় বলেই অসুবিধাটা হল। বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ হল না আর আমাদের ইন্টারনেট আর ফোনটাও চলছিল না। শেষে ল্যাপটপে সেভ করে রাখা ঠিকানাটা দেখে পেয়ে গেলাম। অনিলদার ঠিকানা আলাদা। আমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। এবার আজকের মতন ডিনার সেরে ঘরে ঢুকে বিশ্রাম। রেড রাইস আর জাসা মারু (Jasha Maru) আমাদের ডিনার। এই রেড রাইস হল একধরণের weedy রাইস। ভুটানের নিম্ন উচ্চতায় ইন্ডিকা আর উচ্চ উচ্চতায় জাপোনিকা ধানের চাষ হয়। শুনলাম, রেড রাইস-এর ঔষধি গুণ আছে। জানি রেড রাইস বেশি মাত্রায় মিনারেল ধারণ করে যা শরীরের জন্যে সাধারণত ভালো, কিন্তু অধিক তথ্য জানা নেই। হোটেলের শেফের কাছে শুনলাম এটি তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়, টেস্টটা দুজনেরই খুব ভালো লেগেছিল। জাসা মারু হলো মশলাদার চিকেন।
ঘুম ভাঙল যখন, নরম রোদ বিছানায় এসে পড়েছে। উঠতে হবে। ব্রেকফাস্ট করে লাউঞ্জে এসে দেখি অনিলদা ঠিক সময়ে এসে গেছে। সেই আমাদের গাইড। প্রথমেই গেলাম ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্তেন । ভুটানের ভাষা Dzongkha, বাংলায় উচ্চারণ দাঁড়ায় 'জনক্যা'। Dzongkha ভাষায় চোর্তেন কথাটার অর্থ বৌদ্ধ স্তুপ বা বৌদ্ধ মন্দির। ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্তেন শহরের দক্ষিণ-মধ্যভাগে দোয়েবুম লাম (Doeboom Lam)-এর ওপরে অবস্থিত। ফলকের লেখা তথ্য থেকে জানলাম ১৯৭৪ সালে মহারানি ফুন্টশো চোদেন ওয়াংচুক (Phuntsho Choden Wangchuck) ও তাঁর পুত্র তৃতীয় ড্রুক গিয়ালপো (Druk Gyalpo) মহারাজা জিগমে দোরজি ওয়াংচুক (Jigme Dorji Wangchuck ১৯২৮-১৯৭২)-এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এটি স্থাপন করেন। বর্তমান ভুটানের জনক এঁকেই বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কস্থাপনে বিশেষ লক্ষ্য দিয়েছিলেন জিগমে দোরজি ওয়াংচুক। ভুটানের দূরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামগুলিকে সড়কপথে যোগ, দূরাভাষ-এর মাধ্যমে যোগাযোগ, সংবাদ মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন।
তারপর কুয়েনসেলফোদরাং নেচার পার্ক (Kuenselphodrang Nature Park)। এর একদম হিলটপে স্থাপিত বৌদ্ধস্তূপ, এটি বুদ্ধ দর্দেনমা নামে পরিচিত। সোনার জলকরা ব্রোঞ্জের শাক্যমুনির মূর্তিটি উচ্চতায় সাড়ে একান্ন মিটার।
খুব খারাপ লাগল যে আমরা টাকিন প্রিজার্ভ সেন্টারটি দেখতে পেলাম না। শুনলাম কিছুদিন আগে কোনো অজ্ঞাত কারণে বেশ কয়েকটি টাকিন মারা গিয়েছে, তাই কর্তৃপক্ষ কিছুদিনের জন্য সেন্টারটি বন্ধ রেখেছেন। টাকিন ভুটানের জাতীয় পশু। টাকিনকে নিয়ে বিভিন্ন কাহিনির প্রচলন আছে, যেমনটা থাকে নানান দেশে - মিথ। তার সত্য মিথ্যা যাচাই করা নিতান্তই অহেতুক। প্রাণীটির বর্তমান অবস্থা সংকটজনক। কিছু করার নেই, বাকি থেকে গেল দেখা।
ন্যাশনাল টেক্সটাইল মিউজিয়াম। এটি রয়্যাল টেক্সটাইল একাডেমির একটি অংশ। মিউজিয়ামটি নরজিন ল্যামে - আমাদের হোটেলের থেকে হাঁটা পথে, তাই লাঞ্চ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম। ছবি তোলা নিষেধ। জাতীয় টেক্সটাইল মিউজিয়ামের গ্রাউন্ড ফ্লোরটিতে রয়েছে রাজপরিবারের ব্যবহৃত পোশাক আর ওপরের ফ্লোরে আধুনিক উইভিং টেকনিকের প্রদর্শন। ছেলেদের পোশাকের নাম 'ঘো' (Gho), জাপানি পোশাক কিমোনোর সঙ্গে বেশ সাদৃশ্য আছে তবে ঘো লম্বায় শুধু হাঁটু পর্যন্ত হয়ে থাকে আর ঐতিহ্যপূর্ণ বেল্ট যার স্থানীয় নাম 'কেরা' (Kera) দিয়ে কোমরের কাছে বাঁধা থাকে। মেয়েদের পোশাকের নাম 'কিরা' (Kira) যা লম্বায় গোঁড়ালি পর্যন্ত আর কিরার ওপরে যে জ্যাকেট থাকে তার ওপরের লেয়ারকে তেগো আর নিচের লেয়ারকে ওজু বলা হয়। এটিই ভুটানের জাতীয় পোশাক। জং (Dzong - যার মূল অর্থ fortress বা দুর্গ, সাধারণভাবে সরকারি কার্যালয় অর্থে ব্যবহৃত হয়) বা প্রশাসনিক কার্যালয়ে প্রবেশ করার সময়ে এঁরা স্কার্ফ পরেন। ছেলেদের স্কার্ফ 'কাবনে' (Kabney) আর মেয়েদের স্কার্ফ 'রাচু' (Rachu) নামে পরিচিত তবে রাচু কাঁধ থেকে ঝোলানো থাকে যা কাবনের থেকে অনেকটা আলাদা। কাবনের রং প্রশাসনিক পদ বা গুরুত্ব অনুযায়ী হয়ে থাকে। রাচু বেশ রংবেরঙের ও কারুকার্যসমন্বিত হয়। শুনেছি পূর্ব ভুটানের কিছু জনজাতি যেমন ব্রামিস কিংবা ব্রোকপা সম্প্রদায়ের মানুষ আলাদা ধরণের পোশাক যা প্রধানত চমরিগাই বা ভেড়ার লোমের তৈরি, ব্যবহার করেন। তবে আমাদের হাতে একেবারেই সময় না থাকার জন্যে যাওয়া হয়নি এবার।
বিকেলে স্থানীয় বাজার দেখতে গেলাম। লঙ্কার আচার, কমলালেবুর শুকনো খোসা আর আদার ক্যান্ডি আর কোর্ডিসেপ্স টি (Cordyceps Tea) এই তিনটি জিনিস ছিল আমাদের কেনাকাটার তালিকায়।
হোটেলে ফিরে ডিনার। নতুন কিছু স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সামু দাতসি (Shamu datshi), এমা দাতসি (Ema datshi), কেয়া দাতসি (Kewa datshi) ইত্যাদি ভুটানি ডিশ। 'দাতসি' কথাটির স্থানীয় অর্থ চীজ, যেমন সামু দাতসি হলো মাশরুম চীজ , এমা দাতসি চিলি চীজ আর কেয়া দাতসি হলো আলু চীজ। প্রায় নয় ধরনের মাশরুমের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলো মাৎসুতাকে (Tricholoma matsutake), স্থানীয় ভাষায় যার নাম সাঙ্গে শামোং (sangey shamong, Shamong এর অর্থ মাশরুম)। বুনো মাশরুম সংগ্রহ আর বিক্রি স্থানীয় জনজাতির একটি অন্যতম আয়ের উৎস। যাইহোক, আমরা ভালোই উপভোগ করলাম ভুটানি ডিশ। এমনকি শেফের কাছ থেকে শিখেও নিলাম সামু দাতসি-র রেসিপি আর বানানোর কৌশল।
ঘুম থেকে তাড়াতাড়িই উঠে পড়লাম। অনেক ভেবেছি সারারাত। নাহঃ, পারো (Paro) ঘুরেই যাব। হয়ত দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা হবেনা, সে নাই হোক, প্রকৃতিকে তো অনুভব করা যাবে। অনিলদার একটি মহৎগুণ যে, খুব সময়ানুবর্তী। ব্রেকফাস্ট সেরেই তাকে জানালাম পারো যাবো, অনিলদা রাজি। কালবিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়লাম। থিমফু ছাড়িয়ে গাড়ি চলল পারোর দিকে। পাহাড়ের চরিত্র পাথুরে, বেশিরভাগই ন্যাড়া। উচ্চতা অনুযায়ী ছ রকমের অ্যাগ্রো-ইকোলজি জোন দেখা যায় ভুটানে। অ্যালপাইন (> ৩৫০০মি), কুল টেম্পারেট (২৫০০-৩৫০০ মি), ওয়ার্ম টেম্পারেট (১৮০০-২৫০০মি), ড্রাই সাবট্রপিকাল (১২০০-১৮০০ মি), হিউমিড সাবট্রপিকাল( ৬০০-১২০০ মি) আর ওয়েট সাবট্রপিকাল (১৫০-৬০০ মি)। তবে আমরা শুধু থিমফু (উচ্চতা ২৩৩৪ মিটার) আর পারো (উচ্চতা ২১৯৫ মিটার) ঘুরেই চলে যাব এবার। বাকিটা তোলা থাকল ভবিষ্যতের জন্যে। চলতে চলতে চোখে পড়ল পেলহিল স্কুল (Pelkhil School), অনেকটা হলিউডের স্টাইলে পাহাড়ের গায়ে লেখা।
কখন আমাদের চলার পথে সঙ্গী হয়ে গেছে পারো ছু (Paro Chhu)। পারো ছু -র উৎপত্তি তিব্বতের চোমো লারি (Chomo Lhari)-র দক্ষিণ ভাগ থেকে। অনিলদা গাড়ি রাখল নদীর পাড়ে, কী ঠান্ডা জল! অনেকেই নেমেছেন দেখলাম, আলাপ হল এক বাংলাদেশি দম্পতির সঙ্গে। ওঁরা এসেছেন ফ্লাইটে পারো বিমানবন্দরে। ভুটানে একটিই বিমানবন্দর আর সেটা পারোতে। বিমানবন্দরের জন্যে একলপ্তে অতটা সমতল ভূমি পাওয়া বোধহয় থিমফুতে সম্ভব নয়। প্রথম এটি গড়ে ওঠে ১৯৬৮ সালে, ভুটান সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় আর্মি হেলিকপ্টার ওঠানামা করত, পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে এটিই পুরোমাত্রায় এয়ারপোর্ট হিসেবে কাজ শুরু করে। ভুটান সরকার সিভিল এভিয়েশন ডিপার্টমেন্ট স্থাপন করে ১৯৮৬ তে, এয়ারপোর্টটিও আয়তনে বাড়ে। এখন শুনলাম ভুটান এয়ারলাইন্স, ড্রুক এয়ার, বুদ্ধা এয়ার, তাশি এয়ার - এরা অপারেট করে। ওঁদের বিদায় দিয়ে আমরা ফিরে এলাম গাড়িতে। হাতে আমাদের সময় যে বড়ই অল্প। ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ড্রুকগিয়াল জং (Drukgyel Dzong) কোনোটাই আমাদের দেখা হলোনা। তাকসাং মনাস্ট্রিও (Taktsang Monastery) বাদ থেকে গেল, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩১২০ মিটার উচ্চতায় এই মনাস্ট্রি। উপরে ওঠার সময় পেলাম না, নীচ থেকেই ফিরে আসতে হল, আলো পড়ে যাওয়ার আগে ফুন্টশোলিং পৌঁছতে হবে। পরেরবার এলে পারোকে কেন্দ্র করেই কাটাবো দু-তিন দিন। পথে ভালোলাগা একটা হোম স্টের যোগাযোগ নম্বর নিয়ে এসেছি। পাহাড়ের উপত্যকায় চাষ আবাদ হয়, শুনলাম এখানেই রেড রাইস চাষ হয়, বাইরেও রফতানি হয়। খুব খিদে পেয়েছে। শহরের প্রায় মধ্যভাগে একটি পরিবার রেস্তোরাঁ খুলেছেন, একদম ঘরোয়া, বুফে। আমরা যখন পৌঁছলাম তখনও রেডি হয়নি। একটু অপেক্ষা করলাম। ভাত, চিকেন, স্কোয়াশ আর ব্রকোলি সিদ্ধ, আলুভাজা ইত্যাদি ছিল। অনেক রাত হল ফুন্টশোলিং পৌঁছতে। অনিলদা খুব দক্ষ গাড়িচালক। প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছিল রাস্তায়। জীবনের অনেকটা সময় ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে কাটিয়েছি, প্রচন্ড বৃষ্টিতে প্রায়ই পাহাড় ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, এ অভিজ্ঞতা অনেক আছে। তবে এবার কোনও অসুবিধা হয়নি। শুধু একটু সময় বেশি লাগল। পারমিটের কাগজ জমা দিয়ে আমরা ঢুকলাম ফুন্টশোলিং। এবার বিশ্রাম, আবার ঠিকানা দামচেন। আসতে আসতে যতটা রাত বলে মনে হচ্ছিল ততটা নয়, মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। কাজেই আজকের ডিনার জয়গাঁওয়ে।
আজ অন্তিম দিন ভুটান ঘোরার। আমাদের গন্তব্য ঘড়িয়াল সংরক্ষণ প্রকল্প। এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট মিনিস্ট্রির অধীনে ডিপার্টমেন্ট অফ ফরেস্ট অ্যান্ড পার্ক সার্ভিসের তত্ত্বাবধানে এটি কাজ করে। জানলাম ১৯৭৬ সালে খুব ছোট ভাবে এটি তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে ২০০৩ সালে নেচার কনসারভেশন ডিভিশন আর ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তত্ত্বাবধানে এর উন্নতিসাধন হয়। ছোটো ছোটো পুকুরে তাদের রাখা হয়েছে, মোটা তারজালির বেড়া দিয়ে ঘেরা। ব্রিডিং করিয়ে বড়ো করে তবে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় প্রাকৃতিক বাসস্থানে। যদিও ১৯৯৮ সালের তথ্য, ভুটান এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সর্বাগ্রে যারা সবথেকে বেশি অনুপাতে জমি বরাদ্দ করেছিল প্রোটেক্টেড এরিয়ার জন্যে, মোট ভূভাগের প্রায় ২৬.৩ শতাংশ জাতীয় উদ্যান (National Park) আর সংরক্ষিত অরণ্যের (Sanctuary) জন্যে ব্যবহার হয়।
এবার ফিরতে হবে। হোটেল থেকে বেরিয়ে একজন ভুটিয়ার সঙ্গে দেখা হল। প্রশ্ন করলাম, তার 'ঘো' তে যে বর্তমান রাজা জিগমে খেসর নামগিয়াল ওয়াংচুক (Jigme Khesar Namgyel Wanchuck - পঞ্চম ড্রুক গিয়েলপো) আর রানি গিয়েলতসুয়েন জেতসুন পেমা ওয়াংচুক (Gyeltsuen Jetsun Pema Wangchuck)-এর ছবিওলা ব্যাজ লাগানো সেটা কি নিয়ম? উত্তরে সে বলল যে সে এটা তার রাজার প্রতি ভালোবাসা থেকে লাগিয়েছিল। এই একই প্রশ্ন আমার মনে অনেকবারই এসেছিল রাস্তায়, দোকানে, হোটেলে রাজা-রানির অনেক ফটো দেখে, করেওছিলাম, উত্তরের ভিন্নতা পাইনি, খুব ভালো অনুভূতি হল।
তাশি দোরজির (Tashi Dorji) একটা লেখা 'দ্য স্টোরি অফ আ কিং, আ পুওর কিং, আ পুওর কান্ট্রি অ্যান্ড রিচ আইডিয়া' ('The story of a king, a poor country and rich idea' http://earthjournalism.net/stories/6468), লিঙ্কটা দিলাম যদি কারোর পড়তে ইচ্ছে করে। এখান থেকেই জানি যে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস আইডিয়াটা বর্তমান রাজার বাবা চতুর্থ ড্রুক গিয়েলপো জিগমে সিংজে ওয়াংচুকের (Druk Gyelpo Jigme Singye Wangchuck)।
মাত্র তিন দিনের ভুটান সত্যি মনের অনেকটা জায়গা নিয়ে নিয়েছে আর তাই হয়ত সাত মাস পরে যখন লেখাটার সময় পেলাম তখন মনে করতে হলনা কিছুই, ছবিগুলো এমনিই ভেসে উঠল চোখের সামনে। এবারের মতন বিদায়, কিন্তু আবার আসব। হ্যাপিলি।
~ ভুটানের তথ্য ~ ভুটানের আরও ছবি ~
ভূ-তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন সায়ন্তিকা ঘোষ, সুযোগ পেলেই পাহাড়ের হাতছানিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতন সাড়া দেন। ভালোবাসেন রান্না করতে আর ফটো তুলতে। সম্পত ঘোষ আগ্রহী বিভিন্ন জনজাতির জীবন আর জীবিকা বিষয়ে জানতে। ভালোবাসেন সাইকেল চালাতে, বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করতে আর প্রবন্ধ পড়তে।