ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - ষষ্ঠ পর্ব
ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র - লাদাখ পর্ব
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
~ লাদাখের আরও ছবি ~
শেষ পত্র
বন্ধুবর,
এবারের বেড়ানোর একেবারে শেষপর্বে চলে এসেছি। বেশ কিছুদিন বাইরে কাটিয়ে বাড়ি ফিরতে তো একরকম আরাম লাগেই। কিন্তু এত বড় একটা বেড়ানোর শেষে মনখারাপটাও যেন নিত্য সঙ্গী হয়ে যায়। আর কখনও আসা হবে কিনা জানা নেই।
কার্গিল থেকে শ্রীনগর দুশো কিলোমিটার। বছরকয়েক আগে সব খবরের কাগজেরই শিরোনামে থাকত কার্গিল। তখন এক তুমুল অস্থির পরিস্থিতি এখানে – গুলি গোলার শব্দ। এখন সব শান্ত। কাল সন্ধ্যেয় যখন পৌঁছলাম আলো-আঁধারিতেও বেশ বোঝা যাচ্ছিল বেশ জমজমাট একটা শহর। লেহ্ থেকে বেরোনোর পর এটাই একটা বড় শহরে এসে পৌঁছালাম। ব্যবসা বাণিজ্যেরও বড় জায়গা। তবে এখন দিনের বেলায় মনে হল শহরটা খানিক নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে - কারণ শীত এসে যাচ্ছে। আর কিছুদিন বাদেই লেহ্-কার্গিল-শ্রীনগর রোড বরফে ঢেকে যাবে - বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে লাদাখের সঙ্গে বাকী ভারতের সড়কপথে যোগাযোগ। লাদাখের ট্যুরিস্ট সিজন শেষ। হোটেলগুলো সবই খালি। আমাদের হোটেলেও আমরাই শুধু বাসিন্দা।
কার্গিল থেকে যাওয়া যেতে পারত আর্যগ্রাম - দা, হানু দেখতে। বলা হয় ওখানকার লোকজনের মধ্যেই এখনও খাঁটি আর্য রক্ত রয়েছে! আগের পত্রে খালাৎসে বলে একটা জায়গার কথা লিখেছিলাম না, সেখান থেকে দা, হানুতে রাত কাটিয়ে কার্গিল আসা যেত। আমরা তা না করে সরাসরিই চলে এসেছি হাতে সময় কম থাকায়। দেখা হল না জাঁসকর উপত্যকাও। তাতে আরও দু-তিনদিন লাগত অন্ততঃ। কার্গিল থেকে পারাচিক পাদুম হয়ে জাঁসকর নদীর পাশ দিয়ে জাঁসকর উপত্যকায়। শুনেছি অপরূপ সুন্দর নাকি সেই ভ্যালি। আর কিছুদিন পরেই শীতে যখন জাঁসকর নদী পুরো জমে যাবে তখন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা আসবে প্রবল শীতে সেই বরফ জমাট নদীর উপর দিয়ে 'চাদর ট্রেক' করতে। অবশ্য ওখানকার লোকজনের কাছে ওটাই তখন স্বাভাবিক যাতায়াতের পথ। বিখ্যাত ট্রেকার রতনদা – রতনলাল বিশ্বাস একাধিকবার এই চাদর ট্রেক করেছেন। কলকাতার নন্দন প্রেক্ষাগৃহে দেখেছিলাম সেই যাত্রার স্লাইড শো। জাঁসকর না গিয়ে কার্গিল ছেড়ে আসার সময় মনে পড়ছিল সেই মাইনাস দশ থেকে ত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় দিনের পর দিন হাঁটার, একটা গোটা জলপ্রপাত যেন জাদুমন্ত্রে হঠাৎ থমকে স্তব্ধ হয়ে থাকার ভয়ঙ্কর সুন্দর ছবিগুলোর কথা।
কার্গিল থেকে রওয়ানা দেওয়া হল সকাল নটা নাগাদ। সকালবেলায় রোদ্দুর বেশ ঝলমল করছে। সঙ্গী পথের পাশে নীলরঙা সুরু নদী। নদীর পাড় ঘেঁষে রঙিন গাছপালার সারি আর মাথার ওপরে ন্যাড়া পাহাড়। পৌঁছালাম কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়ালে। আশপাশটা ফাঁকা ফাঁকা, পিছনে পাহাড় দিয়ে ঘেরা, দূরে ছড়ানোছিটানো রঙিন রঙিন বাড়ি। কয়েকজন বাচ্চা ছেলে-মেয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে।
২২/১০/২০১৫
সকাল ১০ টা, কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল
সামনে বড় সবুজ চত্ত্বর পেরিয়ে ডানহাতে মিউজিয়াম। সামনেই রাখা আছে দুটো হাউটজার কামান, একটা মিগ প্লেন। মিউজিয়ামের মধ্যে কার্গিল যুদ্ধের স্ট্রাটেজিক পয়েন্টগুলো থ্রি-ডি মডেলের মাধ্যমে দেখানো আছে। রয়েছে বিপক্ষের সৈন্যদের থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র। জঙ্গিদের পরিচয়পত্র। সবুজ মাঠের মাঝে রয়েছে বিজয়স্তম্ভ। ঘন নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে পতপত করে উড়ছে ভারতের জাতীয় পতাকা। একজন সেনা দেখাচ্ছিলেন পিছনের পাহাড়গুলির কোনটা টাইগার হিল, কোনটা টলোলিং - ওখানেই যুদ্ধ হয়েছিল। কয়েক বছর আগেই এই নামগুলো খবরের কাগজ-টিভির সৌজন্যে লোকের মুখে মুখে ঘুরত – ট্রামে-বাসে-ট্রেনে, চায়ের আড্ডায়। পাহাড়গুলো একদম চোখের সামনে ওয়ার মেমোরিয়ালের ব্যাকগ্রাউন্ডে। চত্ত্বরের পেছনের দিকে সারসার সমাধি।
সেলুলার জেল দেখে যে অনুভূতি হয়েছিল, খানিক যেন তেমনই মনে হল। ভারতবর্ষের কোথায় কোথায় এদের বাড়ি ছিল, মা ভাই বোন বন্ধুরা ছিল, প্রিয়তমা ছিল, আর কতদূরে পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে রইল। পেটের দায়ে চাকরি করতে আসা, মাথার মধ্যে চারিয়ে যাওয়া দেশাত্মবোধ...। অথচ যার জন্য এই লড়াই সেই দেশ আসলে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মাপা যায় কি? যারা এই লড়াই জিইয়ে রাখে সেই নেতা-মন্ত্রীদের গায়ে কি একটাও আঁচড় পড়ে? এখনও ২০০০০ হাজার ফুট উঁচুতে বিশ্বের সব্বোর্চ সামরিক ঘাঁটি সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে দুই পক্ষের সেনানী পরস্পরের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে নিয়ত পাহারায়।
সমাধির ওপর ঠান্ডা হাওয়ায় জাতীয় পতাকা ওড়ে। ওই যে ছেলেটি মূর্তির মত স্থির হয়ে 'অপারেশন বিজয়' লেখা স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে আছে অথবা ওই যে জওয়ানেরা ব্যস্ত কথায়-কাজে তারাও সবাই জানে এভাবেই একদিন হয়তবা জাতীয় পতাকা উড়বে তাদের সমাধির ওপরেও। মনে পড়ে গেল -
"When you go home tell them of us and say for your tomorrow we gave our today."
দুপুর সাড়ে বারোটা, দ্রাস
দ্রাস গ্রামে পৌঁছালাম। ভারতের শীতলতম জায়গা যেখানে মানুষের বসতি আছে। গড়ে মোটামুটি মাইনাস কুড়ি-পঁচিশ ডিগ্রিতে নেমে যায়। পথের দুপাশে রঙিন রঙিন বাড়িঘর-দোকান। ফলসবজির পসরা নিয়ে বাজার বসেছে। মাত্র বারোশো লোকের বাস, যার বড় অংশই মুসলিম। ভাবি অক্টোবরের মাঝামাঝি হয়ে গেছে, আর কিছুদিন পরেই বরফে ঢেকে যাবে চারদিক। সব জায়গাতেই দেখে এসেছি লোকজনে কাঠকুটো জমাচ্ছে, আসন্ন শীতের দিনগুলোর জন্য।
যুদ্ধের সময় কার্গিলের মত দ্রাস নামটাও পরিচিত হয়ে উঠেছিল বারবার খবরের কাগজে বেরোনোর সুবাদে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ছেলেটির বাড়ি আদতে দ্রাস-এই। ও-ই বলছিল যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনি গ্রাম ফাঁকা করে স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এখন সবাই বেশ নিশ্চিন্ত। সামনে একটা মসজিদ। খানিকটা নীচে নেমে গেট পেরিয়ে বড় চত্ত্বর। সেখানে ঢুকলাম। বাচ্চারা খেলা করছে চত্ত্বরে। ইমাম সাহেব আমাদের মুঠোভর্তি লজেন্স দিলেন প্রসাদ হিসেবে।
সকালে তাড়াহুড়োতে কার্গিল থেকে জলখাবার খেয়ে আসা হয়নি। দ্রাস থেকে কেক, কলা, সামোসা, মিষ্টি কিনে গাড়িতে খেতে খেতে যাচ্ছি। এতক্ষণ রঙিন রঙিন বাড়িঘর চোখে পড়ছিল। এখন সব উধাও। সামনে উইন্ডস্ক্রিনজোড়া বরফের পাহাড়। বাকিটাও বেরঙিন। রাস্তা বেশ খারাপ - পাথুরে আর কাঁচা, ধুলো উড়ছে। বাঁহাতে পাহাড়ের নীচটা জলাভূমির মতো। মার্শল্যান্ড।
পৌনে বারোটা, জোজিলা ওয়ার মেমোরিয়াল
বরফের পাহাড়ে উঠে এসেছি আবার। গুমরি পেরোলো। তাড়া থাকায় জোজিলা ওয়ার মেমোরিয়ালে বেশিক্ষণ থাকিনি। ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে যেসমস্ত ভারতীয় সেনারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে গুমরিতে এই ওয়ার মেমোরিয়ালটি তৈরি করা হয়।
পৌনে একটা, জোজি লা
এবার সেই ভূগোল বইয়ে পড়া জোজি লা পৌঁছালাম। ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ে পড়া সেই গিরিপথ। যুগে যুগে এই গিরিপথ পেরিয়েই ভারতে এসেছিল যাযাবর গোষ্ঠীর নানান দল – মোগল, পাঠান, হুন, শক, আর্য। একে একে সবাই লীন হয়ে গেছে সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শস্যশ্যামলাং এই ভারতবর্ষে। জোজি লা এই পথের সবচেয়ে নীচু পাস। কিন্তু বরফ বরফ শুধুই বরফ। বরফে চারপাশ একেবারে সাদা হয়ে আছে। রাস্তায় সার সার গাড়ির লম্বা লাইন। জোজিলায় বরফের খবর পেয়ে দলে দলে লোকজন যারা কাশ্মীর বেড়াতে এসেছে, শ্রীনগর থেকে চলে এসেছে গাড়ি নিয়ে। সবাই হইচই করে বরফ নিয়ে খেলছে। আমরাও কিছুক্ষণ বরফ নিয়ে মজা করলাম সকলে মিলে। ভাবতেই অবাক লাগছিল যে এর আগে আঠারো হাজার ফিট ওপরে চ্যাং লা, খারদুং লা পেরিয়েছি, তখনও এত বরফ পাইনি আর এদিকে জোজি লা মাত্র এগার হাজার পাঁচশ ফিট, অথচ এরকম বরফে ঢাকা!
স্নোম্যান বানানোর খেয়াল চেপেছিল মাথায়। সেই স্নোম্যান যে জীবন্ত হয়ে উঠবে যেন গল্পের মত। কিন্তু চেহারাটা হল গিয়ে খানিক বুদ্ধের আদলের। নিজের বানানো স্নো বুদ্ধকে ফেলে আসতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু যেতে যেতেই তো গলে যাবে। তার চেয়ে একটা বরফের স্তূপ দেখে বুদ্ধকে বসিয়ে রেখে এলাম একটু মনখারাপ করেই।
জোজি লা থেকে বেরোনো হল। আমাদের ড্রাইভার বলল যে, আসল জোজি লা কিন্তু এটা নয়। খানিকটা এগিয়ে একটা জায়গায় দেখাল এটাই হল আসল পাস, দুটো পাহাড়ের মাঝের সরু রাস্তাটা।
পথে এখন অনেক গাড়ি – বড় বড় লরি, মিলিটারি ট্রাক, টাটা সুমো, কোয়ালিস। মাঝেমাঝেই রাস্তা বেশ খারাপ, সারানোর কাজ চলছে অবিরত। মাঝে মাঝেই বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়াতে হচ্ছে সেইজন্য। এখনও চারদিকে রুক্ষ পাহাড়, কিন্তু লাদাখের সেই নির্জনতাটা যেন কমে আসছে ক্রমশঃ। এরপরেই গাড়ি একটা মোড় নিল আর হঠাৎ করে পাহাড়গুলো বদলে গেল – বড় বড় সবুজ গাছ – চেনা হিমালয়ের আদল। আসলে লাদাখ হিমালয়ের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পড়ে, ফলে ওদিকটা অমন রুক্ষ। পাহাড়ের একই উচ্চতায় এই জায়গাটায় কিন্তু সবুজ গাছ।
হঠাৎই ভূপ্রকৃতিটা বদলে গেল। বরফ, কিন্তু পাইন, চিনারের সারি পাহাড়ের গায়ে। আমরা লাদাখ থেকে বেরিয়ে এসেছি। এবারে কাশ্মীর - যেখানে লোকে সাধারণত যায়, ঢুকে পড়েছি ভূস্বর্গের সেই জায়গাটায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে সোনমার্গ। সেখান থেকে শ্রীনগর - কাশ্মীরের পরিচিত বেড়ানোর রুট। আমাদের এবারের বেড়ানোর পরিকল্পনায় সেই চেনা কাশ্মীর নেই। একটা দিন শ্রীনগর-ডাল লেক-গুলমার্গে বুড়িছোঁওয়া করে উড়ে যাব দিল্লি – সেখান থেকে ফিরে যাওয়া সেই চেনা বাড়ি চেনা মাঠ চেনা নাগরিক জঙ্গলে।
এখন আশপাশের গাছপালা সব সবুজ হয়ে গেছে। লাদাখের সেই অদ্ভুত রুক্ষ নির্জনতা, সেই সব হলুদ, বাদামী, তামাটে পাহাড় এখন অতীত। জানিনা আর কখনও ফিরে আসব কি না।
গাড়ির জানলা দিয়ে অমরনাথ যাত্রাপথের বালতাল ট্রানজিট ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে নীচে।
(শেষ)
~ লাদাখের আরও ছবি ~
লেখালেখি, বেড়ানো, নানা রকম বই পড়া, ন্যাশনাল লাইব্রেরি আর কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় যাওয়া, কখনোবা গলা ছেড়ে গান গাওয়া এইসবই ভালো লাগে 'আমাদের ছুটি'-র সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্তের।