ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - দ্বিতীয় পর্ব

থোড়া অ্যাডজাস্ট কর্‌ লিজিয়ে

কাঞ্চন সেনগুপ্ত

হিমাচলের তথ্য ~ হিমাচলের আরও ছবি

পূর্বপ্রকাশিতের পর -

ষষ্ঠ অবস্থানঃ সিমলা থেকে মানালি। বিগ ডিল। সিমলা থেকে মানালি যাব, তারপর মানালিকে কেন্দ্র করে আশেপাশের ডে ট্রিপ। মোটামুটি একটা হিসেব কষে বুঝলাম সার, ছ'জন আছি, যদি একটা গাড়ি লগে-লগেই থাকে তবে একবারে সিমলা থেকে মানালি ঘুরে রোহ্‌তাং ঘুরে সোলাং ঘুরে বশিষ্ঠ ঘুরে হিড়িম্বা-মনু-মণিকরণ-নগ্‌গর-কুলু সমস্তটা ঘুরে, একরাত মান্ডিতে কাটিয়ে সোওওজা কালকা পৌঁছে যাওয়া যাবে, সুবিধাও হবেক আর সস্তাও হবেক মনে হয়। এই ধরনের প্রি-ডমিনেন্ট 'মনে হওয়া'কে সাইডে রেখে সিমলা-মানালি আসুন, কেননা থোড়া থোড়া করে আরও অনেক অ্যাডজাস্ট করা বাকি এখনও!
নালদেহ্‌রা থেকে সোজ্জা ম্যালে। ও হো, না না, একবার হনুমান মন্দিরে ঢুঁ মেরেছিলাম। ম্যালের পিছনের পাহাড়ের চুড়োয় গেরুয়া বজরংবলীর সুবিশাল মূর্তি সিমলা এলেই দেখতে পাবেন। বাকি থাকে শুধু পৌঁছে যাওয়া। ভয়ানক রকমের বাঁদরের উৎপাত। মন্দির, মন্দিরসংলগ্ন বাগান কিচ্ছু উপভোগ করতে পারবেন না। ফিরে আসবেন কিষ্কিন্ধ্যাবাহিনীর কিছু গাজ্বালানে কারনামা নিজের মেমোরিতে স্টোর করে। কারণ মোবাইল বা ক্যামেরা কোনোটাই তো বের করতে পারেননি, আর যদি করে থাকেন তবে অক্ষত অবস্থায় সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেননি নির্ঘাত! অবস্থা এতোটাই খারাপ। আমাদের সামনে একটি ছেলের ক্যামেরার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ছেলেটা ক্যামেরাটা বাঁচাতে পেরেছে, চোখের চশমাটা পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে চশমাটা মাঝামাঝি দু'টুকরো করে ওখানেই বসে রইল। এত দ্রুত হল ঘটনাটা যে ছেলেটা তাকিয়ে আছে ভাঙা চশমাটার দিকে। বাঁদরটাও নড়ছে না। আমরা চারপাশের লোকজন থমকে দেখছি কান্ডটা। ছেলেটার পেছনে দাঁড়ানো এক লোকাল 'পাব্লিক'-এর উক্তি চশমা হারানো ছেলেটাকে উল্লেখ করে, 'হম্‌ লা সক্‌তে হ্যায় ও চশমা; দোসো রুপয়া লগেগা'! ছেলেটা পেছন ফিরে একবার লোকটাকে দেখে, একবার বাঁদরটাকে, আবার লোকটাকে, আবার বাঁদরটাকে। বোধ করি বুঝে উঠতে পারছিল না কে বেশি বাঁদর! ঠিক এই মুহূর্তে সর্বাঙ্গ চিড়বিড় করে ভেতর থেকে যে সপাট চড়টা উঠে আসছে হাতের তেলোয়, সেটা কার গালে বসানোটা যথাযথ হবে?

সেদিন ম্যালে পৌঁছতে বেশ সন্ধেই নেমে এল। বাকিরা একটু এদিক-সেদিক, আমরা দুই বন্ধু গাড়ির খোঁজে আতিপাতি। তাই বলে যে বাসের খোঁজ নিইনি একেবারে তা নয়। ম্যালের গোড়াতেই HPTDC-র বুকিং অফিস। এই বন্ধ হব হব করছিল। জানলাম সাড়ে পাঁচশো টাকা পার হেড টিকিট। সকালের একটাই বাস। আর ছটা টিকিটই পড়ে আছে। পিছনের দিকে। এক্ষুনি কাটতে হবে। আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। ম্যালে যত্রতত্র ফ্লাইং প্যাসেঞ্জার, ফ্লাইং ড্রাইভার, ফ্লাইং এজেন্ট, ফ্লাইং গাড়ির মালিকরা... আমরা কোলাইড করলাম মালিকের কর্মচারীর সঙ্গে। মোট সতের হাজার টাকায় পাঁচ দিন সিমলা থেকে ফাইনালি কালকা স্টেশন। এখানে বড় গাড়ি বলতে ট্যাভেরা নয় বোলেরো নয় ইনোভা। ঠিক করে বলতেই পারল না কোন্‌ গাড়ি দেবে। কর্মচারীর হাত ধরে মালিকের হাতে পড়লাম। সা-জোয়ান, স্টাইলিশ, কানে দুল, দাড়ি-পাগড়িরোহিত এক জাঠ। চোখে-মুখে তৎপরতা। নড়া-চড়ায় এমন একটা চাপা ব্যস্ততা যে কোথাও একটা খুব জরুরি কাজ পড়ে আছে, শুধু আপনার জন্য নেহাতই অদরকারি এই গাড়ি-বুকিং-এর কাজটায় রফা করে দিতে এসেছে, কারণ তার কর্মচারী এটুকুও করে উঠতে পারছে না। এটা রফা হলেই সে তার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজটায় শিফট করে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে আমরাও কি-অহেতুক তাড়াহুড়ো করতে থাকি। যেন আমরাই অন্যায়রকমভাবে আটকে রেখেছি ওনাকে! ফলে যা হওয়ার তাই হল। পাঁচ দিনের ট্যুর ডিটেইলটা নেওয়ার পরই, ম্যালের রাস্তায় যেটা সতের হাজার ছিল, সোওয়া একতলা বাড়ির দুয়ের'তিন অংশ নীচে রেস্টুরেন্টের জন্য ফেলে রেখে, এই যে একের'তিন অংশে ঘাড় ব্যাঁকা করে কোনোমতে দাঁড়াতে পারা যায় একচিলতে বুকিং অফিস, সেখানে এসে ওই সতের হাজারটাই এক ধাক্কায় হয়ে গেল আঠারো হাজার! কেমন মজা! কিন্তু আপনার কর্মচারী যে বলেছিল... "ও কিস্‌স্‌সু zaaনে না"। ব্যাস্‌, রফা দফা। দুই বন্ধু মুখ চাওয়া-চায়ি করে সাব্যস্ত করলাম, তাও আঠারো হাজার-ও কমই, অন্য জায়গায় তো পঁচিশ বলছিল! এখানে আবার নো কার্ড বিজনেস্‌। নগদা নগদি এবং এক্ষুনি আট হাজার টাকা লাগবেই লাগবে, বুকিং অ্যামাউন্ট। আমি বসে রইলাম। বন্ধু গেল ক্যাশ তুলতে। টেবিলের ওপাশে মালিক মোবাইলে সিরিয়াস। আগে জানতাম না, এখন জানি ওইরকম সিরিয়াস মুখ নিয়ে ম্যাচিওর লোকেরা মোবাইলে গেম খেলে থাকে। বন্ধু ফিরে আসার পর অ্যাডভান্স দিয়ে স্লিপ নিয়ে বাইরে বেরোতে যাব, ঝমঝম ঝমঝম অঝোর ধারায়। অগত্যা খানিক্ষণ সেই অপারগ ম্যাজেনাইন ফ্লোরের অফিস ঘরটায় আমরা তিনজন। কথায় কথায় চা-ও এলো। একথা-সেকথা, সিমলায় ভিড়, গাড়ির হাই রেট, রোহতাং-এর বুকিং ব্লা ব্লা ব্লা... এই নিছক সময়-কাটানো গুলতানি থেকে যে দুটো বিষয় আপনাদের সবিস্তারে বলার, তার এক নম্বর হল -

সিমলায় গাড়ি ভাড়াঃ "আপ কলকাত্তা মে ট্যাক্সি করতে হো..." এই ভাবে শুরু করে সেই বুকিং মালিক ওখানে আমাদের বসিয়ে যা বলল, বাংলায় তার ভাবার্থ দাঁড়ায়, কলকাতায় ট্যাক্সি ড্রাইভারেরা আপনাদের থেকে গরীব। ওদের 'মজবুরি' যে আপনি যেমন চাইবেন তেমন পাবেন। এখানে, সিমলায়, গাড়িওয়ালারা বেশিরভাগ নিজেরাই হোটেল বা অন্য কোনো ব্যবসার মালিক। ফ্রী টাইমে গাড়ি চালায়। ওরা ওদের মর্জিমত চার্জ নেয়। পোষালে যায়, না-পোষালে বলে দেয় 'নেহি যানা।' সিমলায় যে রোজগার করে তার না পয়সার 'কমি' আছে, না কাস্টমারের। এই হল বাণিজ্য নগরী সিমলা। আমরা শুনে গেলাম। মুখ ফুটে বলতে পারলাম না আর, কলকাতার ট্যাক্সি ড্রাইভারদের কোনও গোপন রোজগার আছে ভাই জানি না, তবে চিত্রটা কলকাতাতেও ভিন্ন নয়। আমাদের অবস্থা... ... থাক বেড়াতে এসে এই অন্‌জান নাদানকে আর কী বলব আমাদের কথা। ছাতা মাথায় দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম, যদিও বৃষ্টি ছাতায় মানছিল না, কিন্তু রাত এবং ঠান্ডা দুই-ই বাড়ছে। আজ রাতটুকু সিমলায় শেষ। কাল সকাল সাতটায় হোটেল থেকে গাড়ি; সোজা মানালি। আজ তাই রেস্টুরেন্টে ডিনার। যা বৃষ্টি, লোক কমে আসছে বন্ধ না করে দেয়। বাকিদের সঙ্গে দেখা করে মনমতো রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম হুড়মুড়িয়ে। ওরা সুবিশাল মেনুকার্ড থেকে অর্ডার দিতে থাকুক, আমি ততক্ষনে আপনাদের বলে নিই দু'নম্বর কথাটা...

রোহতাং জটঃ জটই বটে! ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনালের ফতোয়া অনুযায়ী সারাদিনে মোট বারোশো গাড়ি পারমিট পাবে মানালি থেকে রোহতাং যাওয়ার। যতদূর খেয়াল আছে, এই বারোশোর মধ্যে চারশো ডিজেল গাড়ি (ট্যুরিজমের বাস সহ) আর আটশো পেট্রল গাড়ি। পারমিট অনলাইন। যে-কেউ, যে-কেউ এখন গাড়ির পারমিট বুক করতে পারে, শুধু গাড়ির ডিটেইলটা থাকলেই হবে। কী-দারুণ ব্যাপারখানা! যেদিনের পারমিট চাই, তার আগের দিন যথাবিধি সময় মত পি.সি. বা ল্যাপটপ বা মোবাইল নিয়ে তৈরি থাকতে হবে, সঙ্গে গাড়ি ও ড্রাইভারের ডিটেইল। গাড়ি হিমাচল প্রদেশের হতে হবে। গাড়ির সমস্ত কাগজপত্র 'ওকে' থাকতে হবে। বুকিং সারাদিন দুবার খোলে। একবার বেলা ১২টায় আর একবার বিকেল পাঁচটায়। ট্যুরিজমের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ফর্ম ফিলাপ করে বুকিং নিতে হয় (কেমন চেনা চেনা লাগছে না?)। আজ বেলা বারোটার স্লটে কপাল যদি খোলে তবে কাল ভোরের স্লটে আপনার গাড়ি রোহতাং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারে, কারণ সকাল সাড়ে নটার মধ্যে গোলাবা চেক-পোস্টে আপনার পারমিটে সীলমোহর পড়ে যাওয়া চাই। আর আজ বারোটার বুকিং মিস্‌ করে যদি বিকেল পাঁচটার বুকিং-এ কেল্লা ফতেহ্‌ করতে পেরেছেন, তবে কাল সকালে হোটেল থেকে খানিক রয়েসয়ে বেরোলেও পারেন, কারণ আগের লপ্তের গাড়ি নিম্নমুখী না-হতে থাকলে তো আর আপনারা যাওয়ার জায়গা পাবেন না। গোলাবাতে আপনাদের ঘড়ি সেই মোতাবেক সেট রয়েছে। ম্যাগাজিনের এই পাতাটিকে যদি কোর্ট পেপার ধরে নিতে পারেন, তবে আমি খুব দায়িত্ব নিয়ে, আমার মাতৃভাষায় বোল্ড আর ক্যাপিটালে লিখে দিচ্ছি আপনারা নিজেদের চেষ্টায় কোনও বুকিং-ই করে উঠতে পারবেন না! সিস্টেমটা কিন্তু ভেরি সিম্পল্‌, যেদিন রোহতাং যাওয়া প্ল্যানে আছে তার আগের দিন সময় মতো বুকিং সাইট খুলে গাড়ি বুক করে নিন, সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন পারমিট আপনার মোবাইলে, সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ুন সময় মতো...ব্যস্‌! রোহতাং ঘুরে চলে আসুন। এই তো ব্যাপার! সেটা এই লেখার পাতায়। বাস্তবতা ক্রমশঃ প্রকাশ্য।

ব্যাক-টু সিমলা থেকে মানালিঃ সিমলা থেকে কোনো গাড়ি আমাদের রোহতাং-এর কথা দিতে পারেনি; কেউ না! বাকি সব ঘুরিয়ে দেবে কিন্তু রোহতাং... জানা গেল এ মরসুমে উপরে বৃষ্টি হতে থাকায় রোহতাং এখনো খোলেনি তবে আগামী কাল-পরশুর (২২/২৩ মে ২০১৭) মধ্যে যেকোনো দিন খুলে যাবে।
প্রসঙ্গতঃ বলে নিই সাত বছর আগে যখন দু'জনে এসেছিলাম সেবারও যেই সন্ধে বেলা মানালি পৌঁছেছিলাম তার পরের সকালে সেই মরসুমের জন্য প্রথম গাড়ি চলেছিল রোহতাং-এর উদ্দেশ্যে। এক অভিজ্ঞ ভ্রামণিক বন্ধুর পরামর্শে ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়েছিলাম হোটেল থেকে। রাজযোটক একেই বলে মনে হয়, আমাদের ছোট্ট অল্টো গাড়িটির চালক হিসেবে পেয়েছিলাম এক বড় দিলওয়ালা মানুষকে। মানালি থেকে রওনা হয়ে, সেই সকালে আমাদের গাড়ি থেমেছিল যেখানে, সেখানে নেমেই প্রথম চোখে পড়েছিল "রোহতাং-০" মাইল ফলক। সব্বার আগে। সে মরসুমের টাটকা তুষারঢাকা ভার্জিন ভ্যালি! আমরা সেবার রোহতাং-এ অবগাহন করেছিলাম। সকাল আটটা থেকে পৌনে নটা পর্যন্ত থাকার পর গালের হনুদুটো, নাকের ডগা, ঠোঁট ব্যথা করতে শুরু করল ঠান্ডায়। ফিরে আসতে আসতে দেখলাম সারি সারি গাড়ি। দেখে আফশোস হচ্ছিল, আমরা যতদূর যেতে পেরেছিলাম তার কত্তো নীচে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়ে ওদের ড্রাইভারেরা বলছে, 'এ-হি উতর যাইয়ে, এ-হি রোহতাং আগয়া, আগে অউর নেহি যায়গা'!
বেপথু হয়ে এই অভিজ্ঞতাটুকু বলে নিলাম এটুকু বোঝানোর জন্য যে, আমাদের ভেতরে এবারও তেমন ভাবে রোহতাং আস্বাদনের ইচ্ছা... বন্ধুদের ঘোরানোর ইচ্ছা।
সিমলার গাড়িওয়ালারা খুব পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, রোহতাং ঘুরিয়ে দেব, এই পয়সাতেই ঘুরিয়ে দেব, আপনি খালি বুকিংটা নিয়ে নেবেন। ওটা আমাদের দায়িত্ব নয়। আমরা তবু গাড়ি বুক করলাম পাঁচ দিনের জন্যই। এখন মনে হয় ভুল করেছিলাম। সেই ঝমঝম বৃষ্টি ভেজা সিমলা ম্যালে কথা হোলো পরের দিন সকাল শার্প আটটায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে হোটেলের সামনের রাস্তায়। "সাবজি, আপ জলদি আকে সাইড মে খঢ়া হো যাইয়েগা, নেহিতো উঁহা পুলিশ স্ট্যান্ড করনে নেহি দেতা!" ভালো কথা। গাড়ি বা ড্রাইভারের ফোন নাম্বার দেওয়া গেল না অজানা কোনো কারণবশতঃ (আসলে বুকিং-এর টাকাটা পকেটে ভরে ফেললে কি হবে, ওই মারকাটারি বাজারে না ড্রাইভার পেয়েছে, না গাড়ি। কানে ফোনটা লাগিয়ে খুব একখানা তৎপরনাস্তি ভাবসাব দেখাচ্ছে আমাদের সামনে)। পাওয়ার মধ্যে পেলাম ফিল্ড-অ্যাসিস্ট্যান্টের মোবাইল নাম্বার, কাল সকালে যার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যিনি আমাদের গাড়িওয়ালার জিম্মায় করতে সকাল সাড়ে আটটায় পঞ্চায়েত ভবনের ঠিক সামনেটাতে মোতায়েন থাকবেন।

সকাল সোয়া আটটায় ফোনে কনফার্মেশন পাওয়া গেল মালপত্র নিয়ে 'রাস্তায় এসে দাঁড়ান', গাড়ি রওনা হয়ে গেছে, বাসস্ট্যান্ডের কাছে গাড়ি জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে। দশ মিনিটে এসে পড়বে। আমরাও 'ধুত্তেরি, আর আসব না এই ঠাঁয়ে' মেজাজ নিয়ে, সদা হাস্যমুখ বিগলিত মিথ্যুক ম্যানেজ মাস্টারের সঙ্গে বাকি দেনা-পাওনা নিয়ে অল্প-খানিক চিক্‌চিকে বিতন্ডা করেই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ভারি ভারি ব্যাগ পিঠে নিয়ে সর সর সিড়ি বেয়ে উঠে গেলাম রাস্তায়। পঞ্চায়েত ভবনের সামনের রেলিংটার সামনে ফালিমতো ফুটপাথ (আসলে ড্রেনের ওপর স্ল্যাব ফেলা)। রাস্তার পাশে এই জায়গাটাই যাহোক দাঁড়াবার মতো। দেখেশুনে এক ভদ্রলোক ট্যুরিস্টের পাশেই গিয়ে পরের পর আমাদের সাত-আটটা ঝোলা এমন ভাবে রেখে দাঁড়ালাম যেন ব্যাস্‌, আর কেউ না, এই জায়গাটুকু আমাদেরই লাগবে। যেন ব্যাস্‌, আর থাকব না এখানে। আমাদের গাড়ি আসবে আর আমরা হুস্‌ করে চলে যাব মানালি। যেখানে ঘিঞ্জি নেই, গরম নেই, লোক-ঠকানো নেই। পরীর মতো সুন্দর এক দেশ। গায় চাপিয়ে নিয়েছি বাহারি জ্যাকেট। এবার তো বুঝবে ভায়া ঠান্ডা কাকে বলে? এই বানিজ্যনগরী থেকে বেরোনো মাত্রই গাড়ির কাঁচ নামাতে পারবে না! একবার গাড়িটা আসুক। ঘড়িতে পৌনে নটা। বাস স্ট্যান্ডের দিক থেকে যত গাড়ি এলো, তাতে ধারনা হল অন্তত দু'কিলোমিটার রাস্তা তো সাফ হয়ে যাওয়ার কথা! একটা করে ট্যাভেরা বোলেরো সামনে দিয়ে যায় আর আমদের ছ'জোড়া চোখ শকুনের মতো ফলো করতে থাকি যতক্ষণ দেখা যায়। নাঃ, এটাও না। ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্টকে এতো ফোন করেছি, সে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। দাঁড়াতেই বোঝা গেল, এই শর্মা আসলে আমাদের পাশের সেই ভদ্রলোক ট্যুরিস্টটির জন্যও এসেছে...

বাই দ্য ওয়ে, এত্তো ডিটেলে কেন বলছি বলুন তো? কখন থেকে রগড়ে যাচ্ছি, এখনও কিন্তু সিমলা থেকে বেরোতে পারলাম না! যাঁরা প্ল্যান করছেন সিমলা-মানালি তাঁদের জন্য ডিকোডিফাই করে রাখছি, যাতে আফশোসে গা না কামড়ায়...অতিরিক্ত অর্থব্যয়ে, অহেতুক সময়ব্যয়ে। সে যাকগে, যা বলছিলাম -

একটু পরে, দু'পক্ষের চাপে ফিল্ড অফিসারটি আর ওখানে টিকতে পারল না। এদিক সেদিক পান-বিড়ির দোকানে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকছে আর অনবরত ফোন করে যাচ্ছে। আমরা ভাবছিলাম গাড়িওয়ালাকে ফোন করছে, একটু পরে বুঝতে পারলাম সেই মালিক বাবুকে ফোন করছিল নিজে সামাল দিতে না-পেরে। মালিক এসেছে, তার সাথে এক সিরিঙ্গে চামচা এসেছে। তার তিড়িং-বিড়িং মালিকের থেকে বেশি, কারণ তার হাতে ফোন নেই। বুঝতেই পারছেন তার কাছে তাই ফোনের নিশ্চিন্ত আড়ালটুকুও নেই। একথা ওকথা দু'কথা চালাচালি হতেই বেরিয়ে পড়ল, আমাদের ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্টটি আসলে এই মালিকেরই ছোট ভাই, পার্ফেক্ট একটি 'অকম্মার ঢেঁকি!' আমরা বলিনি, তার দাদাই স্বীকার করছে। আমাদের সামনে নিজের ভাইকে খুব একচোট বকে-চোকে (বেশ পাকা টাইপের বকা পরিমাণমত কাঁচা শব্দের ব্যবহারে) যে সীনটা প্রস্তুত করা হল তার মর্মার্থ বুঝতে আমাদের এতটুকু অসুবিধা হোলো না। আমরাও তো কলকাতা থেকে গেছি, নাকি! তখন প্রায় সাড়ে নটা। ফোন চলছে, কোনও গাড়িই আমাদের জন্য সেই ফোনের পরিষেবা সীমার মধ্যে পড়ছে না। অকষ্মাৎ হুস্‌ করে একটা ট্যাভেরা গোছের কিছু এসে দাঁড়াল! এইত্তো! ওমা! ভেতরে যে আরও লোক বসে। জানা গেল এটাও আমাদের গাড়ি নয়। এটা এসেছে পাশের সেই ট্যুরিস্ট ভদ্রলোকের জন্য। এবার বুঝলাম। তিনি আর তাঁর বৌ শেয়ারে এই গাড়িতে মানালি যাবেন। গতকালই এই মালিকের ভাইকে টাকা দিয়ে সিট বুক করে রেখেছেন, কিন্তু এখন দেখছেন তাঁদের জন্য সামনের যে সিটের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেই সিট দিতে পারছে না গাড়িওয়ালা। ভদ্রলোক আমাদের থেকেও কমবয়সী এক যুবা। একেতো দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় ঘন্টা দুই, এই রোদে-গ্যাঞ্জামে, আর এখন দেখছেন পেছনের সিটে জায়গা। পরিষ্কার বলে দিলেন 'টাকা ফেরৎ দিয়ে দিন, আমরা যাব না।' তা কি হয়? টিউব থেকে একবার পেস্ট বেরিয়ে গেলে আর কি টিউবে তা ঢোকানো যায়? ভদ্রলোকের এককথা (মালিকের ভাইকে দেখিয়ে) 'ওনাকে আমি টাকা দিয়েছি, উনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন সামনের সিট দেবেন।' পঞ্চায়েত ভবনের পাশটাতেই পাশাপাশি কতগুলি দোকান আর এটিএম আছে, তবে সেগুলি রাস্তা থেকে ১৪/১৫ টা সিঁড়ি ওপরে। আমাদের ফিল্ড অফিসারটি বেগতিক দেখে এক্কেবারে ওপরের সিড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে...নাগালের বাইরে। আর সিড়ির নীচ থেকে তার মালিক-দাদা একবার উর্দ্ধ 'সা'-এ ভাইকে গাল পাড়ে আর পরক্ষণেই খাদের 'সা'-এ কাস্টমার কে রাজি করাতে চায়। তবে কিনা জাঠ বেওসাদার তো, উদারা-মুদারা-তারা সব সপ্তকেই একই রুক্ষ্ম কর্কশ ঝাঁজ থাকে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। পুলিশ বারবার বলছে গাড়ি সরিয়ে নিতে। এর মধ্যেই সিড়িঙ্গে চামচাটি গাড়ির অন্য প্যাসেঞ্জারদের বলে-কয়ে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলেছে মাঝের সিটের জানলার ধার থেকে দুটো জায়গা। এবার মালিক-চামচা দু'জনেই ট্যুরিস্টকে একটু চাপ দিতেই থাকল, "থোড়াতো অ্যাডজাস্ট করনা হোগা, থোড়াতো অ্যাডজাস্ট কর্‌ লিজিয়ে।" ভদ্রলোকেরও কিছু করার নেই। যেতেও হবে। টাকাও দেওয়া হয়ে গেছে। মালিকের হাতে গোছকরা যে টাকার বান্ডিল মালিক তলোয়ারের মতো বাগিয়ে আছে, তাতে হয়তো ওনার টাকাও রয়েছে। শেষ একবার বললেন, 'এভাবে হয় না। (সিঁড়ির ওপরে থাকা মালিকের ভাইকে দেখিয়ে) উনি টাকা নিলেন, কথা দিলেন, আর এখন..." এর বেশি বলতে পারেননি ভদ্রলোক। চামচাটি গন্ধকঠাসা তুবড়ির মতো চিড়বিড় করে বলে উঠল, "আরে ছোড়িয়ে উসকা বাত্‌, উ বুরবক্‌ হ্যায়। উসকো কুছ নেহি আতা। দেখিয়ে ক্যায়সা উপর চঢ়কে খঢ়া হ্যায়!" আর সঙ্গে সঙ্গে আবার দাদার খ্যাচানি। এতোটা দেখে, ওই চুড়ান্ত বিরক্তিকর অবস্থায়ও আমরা হেসে ফেললাম। ভদ্রলোকও আর কিছু না-বলে, মনে হয় বৌকে ডাকতে গেলেন। আমরা মালিককে ছেঁকে ধরলাম আমাদের গাড়ির জন্য। তার একহাতে ফোন আর এক হাতে টাকার গোছা...তলোয়ারের মতো করে ধরা।

আর বেশিক্ষণ নয়, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি এসে গেল। ট্যাভেরা নয় ইনোভা। বাসস্ট্যান্ডের দিক থেকে নয়, ঠিক উল্টো দিক থেকে এসে দাঁড়াল। বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে উঠে পড়লাম। ওখান থেকে কিছুটা বাসস্ট্যান্ডের দিকে গিয়ে খালি জায়গায় সাইড করে দাঁড়াল গাড়ি। দু'একজন নেমে পড়ে মালপত্র ছাদে ও ডিকিতে তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ড্রাইভার উঠে গেলেন ছাদে। এটুকু আসতে আসতে ড্রাইভার জেনে নিয়েছেন আমাদের সঙ্গে আঠারো হাজারে রফা হয়েছে এবং তাতে তিনি স্পষ্টতঃই অখুশি। আমরা আট হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছি আর দশ হাজার দেব কালকায় একথাও পরিষ্কার করে নিলাম। আর আমরা জেনে গেলাম যে, গাড়িটির মালিকই গাড়ি নিয়ে এসেছেন। ওনার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। সকাল আটটার সময় ফোন করে ওনাকে পিড়াপিড়ি করা হয়। উনি এই কড়ারে রাজি হয়েছেন, আমাদের এখান থেকে তুলে উনি মানালির পথে এগিয়ে দেবেন মান্ডি অবধি। মান্ডিতে ওনার ড্রাইভার আমাদের মিট করবেন। তার পরের পাঁচ দিন সেই ড্রাইভার থাকবেন আমাদের সঙ্গে। গাড়ির মালিকের বোনের কোনও অপারেশন আছে দু'দিন পরে। এখানেও গাড়ির মালিক আর ট্রাভেল মালিকের মধ্যে অত্যন্ত প্রত্যাশিত বচসা। নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। সেই জাঠ্‌ বেওসাদার সব্বাইকে টুপি-টাপা পড়িয়ে শেষবারের মতো আমাদের গাড়ি চাপড়ে দিয়ে যখন চোখের আড়ালে চলে গেল, আর আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল মানালির পথে, তখন ঘড়িতে দশটা। মন-মরা ড্রাইভারকে আমরাই বললাম, "কেয়া কিজিয়েগা, থোড়া অ্যাডজাস্ট কর লিজিয়ে!" বাহারি জ্যাকেট খুলে ফেলেছি। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ফেলেছি। বানিজ্যনগরী সিমলা আর বানিজ্যনগরী কলকাতার মধ্যে এখন পার্থক্য হল শুধু রাস্তার একদিকে পাহাড়ের গা, আরেকদিকে শূণ্য। সিমলার জ্যাম পেরিয়ে গাড়ি যখন খানিক স্বচ্ছন্দ গতিতে, একটু পরেই গাড়ির কাঁচ তুলে দিতে হল। ভাবছেন ঠান্ডা কনকনে পাহাড়ি হাওয়া দিল বুঝি। না মশাই, না। লেখার শুরুতেই সাবধান করেছিলাম এ-বিষয়ে। সিমলা নগরী ও তার পার্শ্ববর্তীতে যানজটের সমস্যা মেটাতে হিমাচল সরকারের তারিফ করার মতো পদক্ষেপ, রাস্তা চওড়া করা। মাইলের পর মাইল, পুরোনো রাস্তার ধারের পুরোনো পুরোনো গাছগুলি কাটা হচ্ছে। সারা রাস্তা ধুলোময়। তাই কাঁচ তুলে দিলাম। জ্যাকেটের পর ভেতরের ফুল-স্লিভ টী-শার্টটাও খুলে ফেললাম। পাতলা ফিনফিনে একটা গোলগলা টী পরনে। মাথা ভাবতে শুরু করেছে, গরম জামা-কাপড়ের এই ভূতের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে নাকি! মন তখনও নিজের মনেই আলাপ ঝালছে, 'মানালি তো বাকি, কুলু তো বাকি'...

সপ্তম অবস্থানঃ গাড়ি হাতবদল হল মান্ডি পেরিয়ে। আমাদের সারথি একশ শতাংশ স্থানীয়। বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। যেখান থেকে দায়িত্ব নিলেন তার অদূরেই তাঁর বাসস্থান। আবার নগ্‌গরের পথ ধরে মানালি ঢুকলে, মানালি পৌঁছানোর অল্প আগেই তাঁর আরও একটি বাসস্থান যেটি নির্মীয়মান। ওনাকে আমরা এর পর থেকে স'বাবু বলে সম্বোধন করে থাকব, কেমন? ওপরের বর্ণনা থেকে হাল্কা অনুমান করতেই পারছেন, সচরাচর বিয়াসের যে পাড় ধরে এসে বেশিরভাগ গাড়ি সিমলা থেকে মানালি ঢোকে এবং সোজা ঢুকে এসে থামে মানালি বাসস্ট্যান্ড, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড তথা ম্যালের দোর-গোড়ায়, স'বাবু আমাদের সে-পথে নিয়ে যাবেন না। স'বাবু যেই শুনলেন মানালিতে আমাদের হোটেল নদীর অপর পাড়ে, উনি বেশ কিছুটা ঘুরপথে এসে ওনার নির্মীয়মান বাড়িতে মিনিট কয়েকের হল্ট দিয়ে, আমাদের মানালি ঢোকালেন বাঁ-হাতে বিয়াস, বাঁ-হাতে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্স্টিটিউট (মানালি), বাঁ-হাতে ঘড়িতে সাড়ে সাতটা ইত্যাদি রেখে, রাস্তার ডান হাতে আমাদের হোটেল...

মানালি ঢুকতে ঢুকতে গাঢ় সন্ধে। মানালি ঢুকতে ঢুকতে ঘেমে-নেয়ে-ঘাম-বসে আমার বাঁ-নাক বন্ধ, ডান নাক দিয়ে কাঁচা জল গড়াচ্ছে। মানালি ঢুকতে ঢুকতে রাস্তায় একবার বেলা বারোটায়, আবার একবার বিকেল পাঁচটায় একাধিক মোবাইলে জোড়া জোড়া হাত চোখ ক্রেডিট কার্ডে সাধ্য মতো তৎপর হয়েও পরের দিনের রোহতাং বুকিং ধরা যায়নি। রেলের রিজার্ভেশনের চেয়েও দীর্ঘ ফর্ম। সাতান্ন রকমের খোপ। সব পেরিয়ে যেতে পারলেও, পেমেন্টের জায়গা থেকে মিনিটখানেক ঘুরিয়ে (চক্র) ঘুরিয়ে বের করে দেওয়া, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সব বুক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি চেনা প্রতিবন্ধকতাগুলি তো আছেই, যা অচিরেই আপনাকে ঘাড়ে ধরে বুঝিয়ে ছাড়বে 'এভাবে সম্ভব না'। তাহলে কিভাবে সম্ভব? ধীরে...এখনো তো আজকের রজনী বাকি। মানালি ঢুকতে ঢুকতেই প্ল্যান করে ফেললাম, কালকের দিনটা তবে সোলাং-বশিষ্ঠ ও অন্যান্য।

আগেরবার ছিলাম হোটেল বিয়াসে। তখনই বিয়াসের পাশের সেতু পেরিয়ে অপর পাড়ের এই রাস্তাটা দেখেছিলাম; বেশ লেগেছিল! গুটিকয় হোটেল নিয়ে একটা সরু পথ কোথায় যেন উধাও! এবার তাই নেট ঘেঁটে হোটেল বুকিং-এর সময় দৈবাৎ বিয়াসের অপর পাড়ে হোটেল পেয়েই ভেতরে বাড়তি একটা উদ্দীপনা ছিল। এবার আগেরবারের সেই উধাও রাস্তাটারই উধাও প্রান্তের দিক হতে ঢুকে এসেছি। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে রাস্তার এদিক-ওদিক দেখছি। অলক্ষ্যে আমার চোয়াল ঝুলে গেছে। এই রাস্তাটির সামনের-মাথায় একটি কাঠের পুল। ভালো করে নজর করলে বোঝা যাবে, চঞ্চলা বিয়াসের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে ভোলা-ভালা রাস্তাটা চলে গিয়েছে। বিয়াসই হঠাৎ খুনসুটি করে নিজের পাড় ভেঙ্গে অল্প একটু জায়গা জুড়ে রাস্তাটির নীচের মাটি খেয়ে নিয়ে চলে গেছে। ঠিক যেভাবে বাংলার কোনো কোনো গ্রামে রাস্তা কেটে হাঁ করে দিয়ে আন্দোলন জানানো হয়। ওই হাঁ-এর ওপর দিয়ে কাঠের পুলটা; ভারি রোমান্টিক, কিন্তু রোমান্স চটকে যাবে যেহেতু ওর ওপর দিয়ে দিনের ও রাতের বেশির ভাগ সময়টা সিঙ্গল্‌-ওয়ে ট্রাফিক। ফল আমাদেরও পেতে হল। দেশপ্রিয় পার্কের দুর্গাপূজাকে হার মানায় যানজট। আর আমি ঝোলা চোয়াল নিয়ে ভাবছি এতো গাড়ি এলো কোত্থেকে? সাত বছর আগে দেখা সেই একপাশে পড়ে থাকা রাস্তাটার দুপাশ ধরে এই প্রাসাদোপম হোট্টেলিকার সারি, উঁচু উঁচু পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝে ছোট্ট মানালিতে ঝুপ করে নেমে আসা সাঁঝকুয়াশার ঢাকা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে হাজার হাজার ওয়াটের ঝলমলানি! গাড়ির ধোঁয়া খেতে খেতেই খুঁজে পেয়ে গেলাম আমাদের বুক করা হোটেলটি। এখানে নাম নিচ্ছি না, তবে আমরা সন্তুষ্ট। পাঁচ দিনের জন্য গাড়ি নিয়েছি অর্থাৎ গাড়ি আমাদের সঙ্গেই থাকবে, সঙ্গে ড্রাইভার। কিন্তু দশ মিনিটের দূরত্বে যদি ড্রাইভারের নিজের বাড়ি থাকে তবে? স'বাবু জানতে চাইলেন সকালে কটার সময় আসবেন। আমরা তাকে টাইম বলে মাল নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। দুই আর তিন তলা মিলিয়ে তিনটে রুম পেয়েছি। আগামী কাল অন্য রুম খালি হলেই এক ধাপ নামিয়ে আনার ম্যানেজারোচিত সুভব্য আশ্বাস নিয়ে নিজেদের রুমে গেলাম। অভ্যাসমত পর্দা সরিয়ে সরিয়ে ওই অন্ধকারেই আন্দাজ করে নিলাম কোন্‌খান থেকে কেমন ভিউ পাব সকালে। বেশ বুঝতে পারলাম তিন তলায় ওঠা-নামা কষ্টকর হলেও, বাইরে হোটেলগুলোর যা গা-রেষারেষি হাইট তাতে হোটেলের চুড়োয় অবস্থান না করলে সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে মানালির বরফটুপি পড়া প্রকান্ড পাহাড়গুলোর চুড়োয় প্রত্যূষ দেখতে পাওয়া সম্ভব হবে না। আবার উল্টো দিক দিয়ে এটাও সত্যি, হোটেলের সংখ্যাধিক্যর দরুণই হয়তো এমন মনমত হোটেল সিমলার থেকে অনেক কম দামে পেলাম।

অষ্টম অবস্থানঃ গত সন্ধেয় হোটেলে ঢোকার পর, গরম জলে সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে, গরম গরম দু-দু'কাপ চা খেয়ে যখন আগামী কালের রুট প্ল্যানিং চলছে, তখনই প্রায় রাত নটা বাজে। হেঁটে মিনিট পনেরো, ম্যালে আর যেতে ইচ্ছা করছে না শরীরে ধকল এতোটাই। খিদেও পেয়েছে। প্ল্যান তো চলতেই থাকবে; বুফে খাওয়ার তাড়নায় চলে গেলাম নীচে ক্যাফেটেরিয়ায়। বেশ ভালো। রুমে ফিরে আসতে আসতে ভরা পেটে শরীর ভারি হয়ে এলো। বিছানায় শুয়েছি যখন তখনও নাক দিয়ে কাঁচা জল গড়াচ্ছে। কম্বল গায়ে নেওয়া যাচ্ছে না। চাদরই যথেষ্ট। মানালি, মে মাসের ২৩ তারিখ, রাত সাড়ে দশটা। শুধু কলের জলটা যা কনকনে! ঘুমিয়ে পড়লাম দশ বছর আগেকার হি হি ঠান্ডার কথা ভাবতে ভাবতে।

মানালি গেলে কেউ মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের ভেতরটা ঘুরে দেখতে যান কিনা জানি না। আগেরবার আমিও যাইনি। এবার সুযোগ হল। আমার বন্ধু এখানকার প্রাক্তন ট্রেনি একজন। তাই 'প্রবেশ নিষেধ' এলাকায় যদি কোনও জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ি তবে উদ্ধার করার জন্য বন্ধু আছে। তারই উৎসাহে সকালের চা শেষ করেই হেঁটে হেঁটে আমাদের হোটেল থেকে মাত্র পঁচাশি মিটারখানেক দূরে পৌঁছে গেলাম ইন্সটিটিউটের গেটে। বিয়াস নদীর তীর ধরে প্রায় একর কুড়ির মত জায়গা ঘিরে অটল বিহারী বাজপেয়ী হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট। হাট করে খোলা সাদামাটা লোহার গেট পার করে পিচবাঁধানো রাস্তা ধরে আলগা চালে প্রবেশ করলাম। রাস্তার ঢাল নেমে গেছে। নিশ্চল পাহারাদারের মত দাঁড়িয়ে থাকা সটান গাছের গুড়ির ফাঁক দিয়ে দিয়ে সকালের তেরছা রোদ গায় মেখে মেখে আমরাও গড়িয়ে নামছি। কই কোথাও কোনো 'কাঁহা জায়েঙ্গে আপলোগ' এগিয়ে এলো না তো? প্রবেশ-গেট থেকে গুনে গুনে সতেরো পা ভেতরে ঢুকলেই অনুভব করবেন গাড়ি-বাড়ি-হোটেল-দোকান-শব্দ-দুষণ-ঘড়ির কাঁটা ফেলে রেখে প্রকৃতির নিজস্ব সাধের বাগানবাড়িতে ঢুকে পড়েছেন! অধুনা গেট দিয়ে ঢুকেই প্রবেশপথের বাঁপাশ দিয়ে খান চার/পাঁচ হোটেল/গেস্ট হাউস ভেতরেও রয়েছে। খানিকটা হলেও স্বরোজগার যোজনা। একবার মনে হল, ইস্‌স্‌ এখানে কেন থাকলাম না। আপনাদের জন্যই বলা, যদি মানালি যান, থাকার জায়গা হিসেবে ইন্সটিটিউটের অতিথিনিবাস বেছে নিতে পারেন। থাকার খরচায় এমন কিছু ফারাক নেই বাইরের হোটেলের থেকে। ভেতরে হোটেল হওয়ার কারণেই হয়তো আমরা এখনো কোনও রকম বাধার সম্মুখীন হইনি। বন্ধু আমাদের দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলেছে কোথায় ট্রেনি হোস্টেল, কোথায় অডিটোরিয়াম, কোথায় ডাইনিং হল; কোথাও গাছের থেকে টায়ার ঝুলছে, কোথাও আঁকা-বাঁকা সরু কাঠের বিমের ওপর দিয়ে চলা, তারপরেই ঝাঁপ দিয়ে নেমে গুঁড়ি মেরে আড়াআড়ি রাখা প্রতিবন্ধকতার নীচ দিয়ে বুকে হেঁটে যাওয়া, তারপর আবিষ্কার করে ফেলা বুক দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাটির যে-জায়গাটা দেবে গেছে, পরশুর বৃষ্টির জল এখনো অল্প জমে আছে সেখানে, আশ্চর্য! রোদ ঠিক মতো পৌঁছতে পারেনি এখানে। এখানে জমা জলের পাশে শ্যাওলা, শ্যাওলার ওপর বাহারি একটা প্রজাপতি এসে বসেছে। বুকে হাত রেখে স্বীকার করুন আপনি প্রজাপতি ভুলতে বসেছিলেন। যাও বা মনে ছিল, তা হয় হাল্কাআআআ ফিনফিনে সবুজ বা হলুদ বা ধুসর এক-কালারের। অনেক অনেকক্ষণ পর যেন ভেতর থেকে টের পেলাম, 'হ্যাঁ বেড়াতে এসেছি।' দৈনন্দিন থেকে বাইরে কোথাও এসেছি। আর এই এতো এতো কিছু যে বললাম...হোস্টেল, লাইব্রেরি, মিউজিউয়াম, বাগান (উফফফ! বাগান সেকি বাগান! অপার্থিব সারল্যে ভরা) এ সমস্ত কিছু অগাধ প্রকৃতির ঘোমটায় আড়াল। এক অপরিমেয় প্রকৃতি ছাড়া কোনো কিছুই জাহির নয় ইন্সটিটিউটের এই বিশ একর জায়গাটুকুতে! আধঘন্টার ওপর এখানে আছি। বন্ধু আছে বলে আরও বেশি মজা পাচ্ছি, ও গাইড করছে। এক প্রশস্ত জায়গায় দেখলাম প্রায় শ'খানেক ট্রেনি দাঁড়িয়েছে, আমরা যেমন স্কুলে প্রেয়ার গ্রাউন্ডে দাঁড়াই। সঙ্গে রয়েছে গ্রুপ অফ ইন্সট্রাক্টরস্‌। কিশোর-কিশোরী থেকে নবযুবা পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের ট্রেনি তথা ইন্সট্রাক্টর চোখে পড়ল। শুনেছি চল্লিশ বছর বয়সের ব্যক্তিও ট্রেনিং নিতে পারেন। আবার এও শুনেছি একমাত্র এখানেই বয়সের উর্দ্ধসীমা দু-এক বছর শিথিলও করা হয় সবিশেষ অনুরোধে। এসব আপনাদের জন্য, যাঁরা ভাবছেন ইস্‌স্‌ সময় চলে গেছে!

আমরা এখন রোদের সঙ্গে, গাছের ছায়া, ভেজা মাটির গন্ধ, ফুলের রেণু, আর পাতলা রোমাঞ্চ মেখে বুঁদ হয়ে আছি। এখন সারাদিনের কর্মসূচি ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছোটদের দল যাবে নদীর ধার ধরে জঙ্গলে জঙ্গলে ট্রেক করতে। আর তুলনামূলক বড়দের দল রওনা হল সোলাং অভিমুখে। এই ফুরসতে আমাদের বন্ধুর দেখা হয়ে গেল তার ট্রেনারের সাথে। সামান্য অমায়িক কুশলবিনিময় ও রোমন্থন হল। তারপর আমরা ছোটদের সারিবদ্ধ বড়-সড় দলটার সঙ্গে পায় পায় চলে এলাম নদীর পাড়ের অংশটায়। ছোটদের নির্ঘাত আলাদা আলাদা হাউস আছে, কারণ এক এক দল এক এক রঙের জ্যাকেট পড়ে আছে। উজ্জ্বল ফ্লুরোসেন্ট কালার। ওদের লাইনটা চৌহদ্দির একেবারে শেষ সীমায় এসে, পাঁচিলের এক ফোকোল গোলে বাইরের বিস্তৃত জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। আমরা এখানেই থমকে গেলাম। বিয়াসের শব্দ আসছে কানে। এতো ঘন পাইনের বন আপনি এ-তল্লাটে পাবেন না। ইন্সটিটিউট বুক দিয়ে আগলে রেখেছে এই জঙ্গলটুকুকে। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হবেই "হেথা উর্দ্ধে উঁচায়ে মাথা দিল ঘুম...যত আদিম মহাদ্রুম।" অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়াচ আমাদেরও খানিক লাগল। দেখলাম প্রায় দুই মানুষ উঁচু আর পাঁচ/ছয় মানুষ হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালে বেড় দেওয়া যাবে এমন দুটো বিশালাকৃতি পাথর (ওয়ান পিস্‌) পাশাপাশি হাত চারেকের ফারাকে রাখা। বন্ধু বলল, একটাতে উঠে আরেকটায় লাফ দিয়ে আসতে হয়েছিল ট্রেনিং-এর সময়। একটায় ওঠার চেষ্টা করলাম খুব উৎসাহের সঙ্গে। আর পাথরগুলোর এমন গড়ন নীচে দাঁড়িয়ে মনে হবে একটু ঝাঁপালেই উঠে পড়ব। আদতে করতে গিয়ে দেখা গেল বন্ধু পেছন থেকে না ধরলে সেই ফিচেল পাথর আমায় সরসরিয়ে গড়িয়ে ফেলে দিত তার মসৃণ গা থেকে। বন্ধুর সাপোর্টে অর্ধেক উঠে গেলাম, তারপর পা-গুটিয়ে বসে আছি...এবার নামব ক্যামনে! ওমনি পটাপট আমার অসহায়তার ছবি উঠে গেল মোবাইলে মোবাইলে। কোথা দিয়ে যে ঘন্টা কাবার বোঝাই গেল না। ওদিকে স'বাবু এসে পড়বে এবার। ফেরার পথে চোখে পড়ল, গাছে গাছে হ্যামক টাঙ্গানোর ব্যবস্থা। আর দুটো টেন্টও। অ্যাডভান্সড ট্রেনিং পর্যায়ে এসব থাকে। চোখে পড়ল একটা দোতলা সমান বেয়াড়া দেওয়াল, যার গায় নানাভাবে সিমেন্টের গুট্‌কা লাগানো। মক্‌ রক ক্লাইম্বিং ট্রেনিং-এর জন্য। ওটা আর ট্রাই করার সাধ হয়নি। ফেরার পথে চোখে পড়ল ইন্সটিটিউটের বেড়া, ঝোপ, মোটা মোটা গাছের গুড়ির ফাঁক দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে বরফচুড়ো বলছে 'বেলা হয়ে গেছে, এবার বেরিয়ে পড়।' ফেরার পথে চোখে পড়ল, আমরা বেরোচ্ছি আর ট্রেনিদের একটা দল (ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে-মেয়েরা) সামনের পাহাড় থেকে রক-ক্লাইম্বিং করে ফিরছে, তাদের সারা গায়ে শ্রান্তি ও উল্লাস!

নবম অবস্থানঃ সকালের জলখাবার। পরের দিন ভোরবেলা যদি রোহতাং-এর গাড়ি পাওয়া যায় - ছান্‌বিন্‌। শুনতে পেলাম গতকালও নাকি মাঢ়ী পর্যন্ত পার্মিশন মিলেছে। আজ খুলছে রোহতাং-এর বুকিং। আবার এই মরসুমের প্রথম দিন আমরা যাব রোহতাং...পাব ভার্জিন ভ্যালি! ঘুপচি দোকানে আলুর পরোটা বলে দু'জন গেলাম একদিকে, আরেকজন গেল আরেক দিকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কালকের রোহতাং-এর ইন্তেজাম করে ফেলতে হবে। স'বাবুর তো পোয়াবাহান্ন... কাল সারাদিন শুয়ে-বসে বাড়ির অন্ন। আমরা এদিকে হেদিয়ে মরছি। আরও কত এক্সট্রা গচ্চা যাবে কে জানে! সাত তাড়াতাড়ি গেলাম ম্যালের ওপর ট্যুরিজম্‌-এর অফিসে। অফিসের দরজায় তালা। বারান্দায় এক প্রায় প্রৌঢ় কর্মচারী খাতাপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে বসছেন। বুকিং শুরু হবে কিন্তু বারোটায়। বেলা বারোটার সময়ও যদি আমরা মানালিতে পড়ে থাকি তবে তো... আর ভাবতে ভালো লাগছে না। ওনাকে বললাম আমাদের ছ'জনের ভাড়া আগাম রেখে দিন। জবাব এলো, "নিয়ম নেহি।" রিকোয়েস্ট করলাম, টেবিলের এই ফোন নাম্বারটা দিয়ে দিন, আমরা যেখানেই থাকি, বারোটায় ফোন করব, ম্যালে পৌঁছেই বুকিং অ্যামাউন্ট দিয়ে দেব। "নিয়ম নেহি।" অপারগ হয়ে ওনার সামনে প্রায় ককিয়ে উঠলাম, 'তাহলে আপনিই কোনো উপায় বলুন, কাল না-হলে আমাদের আর যাওয়া হবে না!' "নিয়ম নেহি।" স্যার, কাল আপনাদের বাস যাচ্ছে তো রোহতাং? "হম্‌হে ভি নেয়ি মালুম বুকিং মিলেগা কি নেহি। বাহার সে গাড়ি লে লিজিয়ে।" কোথায় এসে পড়লাম? স্বাভাবিকটা এতটাই অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ যে অস্বাভাবিকটা কত স্বাভাবিক মনে হচ্ছে! সরকারের বাসে আর আমাদের যাওয়া হচ্ছে না এটা স্পষ্ট। উন্মাদের মত ম্যালের দু'পাশের প্রায় সবকটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে ঢুঁ মারছি। থরে থরে কম্পিউটার সাজিয়ে বসে আছে টানটান। যেন অলিম্পিক...হান্ড্রেড মিটার স্প্রিন্ট...ফাইনাল। লক্ষ্য করে দেখুন, কেউ চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। শুধু কানে শুনছে, "ভাইয়া রোহতাং জানা হ্যায়, সিক্স পার্সনস, কল্‌কে লিয়ে গাড়ি মিলেগা?" মর্মান্তিক সাইলেন্স। আপনি যখন ভাবছেন আপনার কথা আদৌ শুনল কিনা, ভাবছেন না-থাক বেরিয়ে যাই, তখন উত্তর আসবে, "হাঁ মিলেগা।" আবার পজ্‌। বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বা কথার টোনে আপনি কিন্তু ভরসা পাবেন না। সেই মানালি আর নেই। হাঁ মিলেগা, জরুর মিলেগা, কিঁউ নেহি মিলেগা, আপকো তো বঢ়া গাড়ি লগেগা। ট্যাভেরা দে দেঙ্গে। সুবহ বোলিয়ে কিতনে বজে নিকলেঙ্গে। জলদি নিকলনেসে আরাম সে ঘুমায়েঙ্গে, মাঢ়ী হোকে রোহতাং, লৌটনেকে টাইম মাঢ়ীমে খানা খা সক্‌তে হো, ফির সোলাং, ফির বশিষ্ঠ, ফির গলফ্‌ ক্লাব, ফির টাইম রহনে সে হিড়িম্বা ঘুমা দেঙ্গে... বড় গাড়ি আড়াই হাজার, ছোট গাড়ি দুহাজার, আমি নিজে দরাদরি করে সতেরশোতে ঘুরেছি। মহাশয়, জেনে রাখুন, সেই দিন আর নেই। যে গাড়ি সকালে রোহতাং যাবে সে আর কোত্থাও নিয়ে যাবে না আপনাকে। আর আপনার যদি বরফ-চাপা কপাল হয়, তবে তো সুব্‌হান-আল্লাহ্‌! মাঢ়ী থেকে তিন-চার কিলোমিটার রোহতাং-এর দিকে গিয়ে যদি বরফে সব ঢাকা থাকে সত্যিই তো গাড়ি বেচারা কি করবে! তখন আমরা ট্যুরিস্টরাই গাড়ি থেকে নেমে "কত দূর...আর কত দূর...রোহতাং" বলতে বলতে থপ থপ করে হাঁটব বরফের ওপর দিয়ে। হাফেরও হাফ ফার্লং যেতেই হাঁফ ধরে আসবে। তারপর ওখানেই 'এই তো বরফ, এই তো রোহতাং' বলে বেশ নাচানাচি করে নেব, ব্যাস্‌। ফিরে এসে হয়ে যাব বেচারা। ভাড়া সেই রোহতাং-এরই গচ্চা যাবে রে! 'গাড়ি তো মাঢ়ী সে আগে গয়া না! আভি রস্তা খুলা নেহি হ্যায় তো হম্‌ কেয়া করেঙ্গে সাব্‌জি? আমরা ওই জন্য খুব পার্টিকুলার ছিলাম। খুব ভালো করে জেনে নিয়াছিলাম যে কাল গাড়ি রোহতাং টপ যাবে কিনা। ২০১০-এ যত অবধি গিয়েছিলাম ওইখানে পৌঁছতেই হবে। তারপর বন্ধুদের নিয়ে স্লিপ কেটে নামব ভার্জিন ভ্যালিতে।

মাছের বাজারে পদ্মার ইলিশ এলে বড় দোকানের বড় দোকানি সবাইকে এক ঢং-এ মাছের দাম বলে না, দেখবেন লক্ষ্য করে। আবার খরিদ্দারের পকেটের জোর থাকুক না থাকুক একবার না একবার ইলিশের দরটা জানা চাইই। দোকানি ঠারেঠোরে তাকিয়ে যদি দ্যাখে পোটেনশিয়াল বায়ার নয়, তাহলে দেখবেন কেমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাজার বা পনেরোশো বলে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। ওতে আপনি দমে গেলেন তো একরকম, আর চেগে গেলেন তো দোকানির মুনাফা! আমরা চেগেই ছিলাম, কিন্তু রথের কারবারিরা এমন দর হাঁকতে লাগল, আঠারা...চৌদা...সাড়ে বারা... আমরা দমেই গেলাম। জাস্ট ভাবতে পারছিলাম না, শুধু মানালি থেকে রোহতাং যাব আর ফিরব বারো হাজার টাকা? দোকানিদের মুখের রেখায়ও সেই মাছবাজারিদের তাচ্ছিল্য হুবহু। এখনও আজকের রোহতাং ট্রিপের বুকিং সেশন শুরু হয়নি, কিন্তু ওরা নির্বিকার...কনফিডেন্ট। আসলে উল্টো দিকের চিত্রটাও সমান করুন। যে-গাড়ি আজ বুকিং পাচ্ছে, সে আগামী সাত-দশ দিনের মধ্যে আর বুকিং পাবে না। তার টার্ন আসবে ঘুরে। এই সাত-দশ দিন সে, তার পরিবার খাওয়া-দাওয়া করবে না? তাই তাদের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না আড়াই হাজার টাকায় রোহতাং ও সংলগ্ন জায়গা ঘুরিয়ে আনা। তারাও মওকা বুঝে যে-যা পাচ্ছে দর হাঁকছে। ভাড়ার কোনো উর্দ্ধসীমা নেই। পর্যটক যোগানেরও তো কোনো বিরাম নেই! দিনে গড়ে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার ট্যুরিস্ট আসছে মানালিতে। দিনপ্রতি মাত্র বারোশো গাড়িতে কতজন আর রোহতাং গিয়ে উঠতে পারছেন। বাকিরা অপেক্ষা করে থাকছেন সেকেন্ড চান্সের জন্য। এর মধ্যে পরের দিনের আরো নতুন সাত হাজার এসে পড়ছে। গ্রীন ট্রাইবুনাল এসব নিয়ে ভাবছে না। ওদের ভাবার কথাও না। HPTDC এই সমস্যা নিয়ে ঠিক কি ভাবছে সে-এক রহস্য! সিন্ডিকেটের রেট পাঁচ হাজার টাকায় বেঁধে দিয়ে বাকিটা যেন দৈবের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ভাবছেন সিন্ডিকেটে যাচ্ছি না কেন! সেখানে বুকিং-এর কোনো গ্যারান্টি নেই। একটা গাড়িও বুকিং না পেতে পারে।

মোটামুটি হার মেনে পরোটার দোকানে ফিরে এসেছি যখন, আরেক বন্ধু খবর আনল, এক জায়গায় পাওয়া গেছে নয় হাজার টাকা। মনে হল সস্তা। মনে হল ঠিক আছে হোয়াইট ওয়াটার র‍্যাফটিংটা তবে বাদ। কেনাকাটা তো আগেরবার করেছিলাম। এবার না-হয়... মনে হল এতদূর এসে রোহতাং যাব না? আমাদের জন্যই তো কাল রোহতাং খুলছে... রইল পরোটা, ছুটলাম তিনজনে। অর্ধেক অগ্রিম। সামান্য আপত্তি জানিয়েছিলাম। আমাদের উদ্ধারকর্তার গোসা হয়ে গেল। 'ছোড়িয়ে, আপকো জানা নেহি হ্যায়' বলেই দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে আবার সাধ্য সাধনা করে ঘরে ফিরিয়ে...থুড়ি তার দোকানে ফিরিয়ে আনা গেল। হাতে গুনে গুনে টাকা দেওয়া হল। আবার এও শুনতে হল যে কাল বা আজ রাস্তায় মিলিটারি বা যে-কেউ যদি জানতে চায় কত টাকায় ভাড়া করেছি গাড়ি, তাহলে যেন বলি পাঁচ হাজার টাকা। "আপ হম্‌কো দেখিয়েগা, হম্‌ আপকো দেখেঙ্গে" এরূপ বাণী বেরিয়ে এল আমাদের তৎকালীন মসিহার মুখ থেকে। বাধ্য ছেলের মত মাথা নেড়ে, হোটেলের নাম ঠিকানা দিয়ে, বারবার করে ড্রাইভারের নাম্বার দিতে বলে আমরা পরোটা খেতে গেলাম। একে অপরকে হাতে তালি দিয়ে বললাম, তব্বে, অ্যাটলাস্ট রোহতাং যাওয়া হচ্ছে! বাইরে বাইরে ঝলমলে করে রাখলাম মুখমন্ডল, কিন্তু আমার কথা বলতে পারি, ভেতরে আর সেই স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যম অনুভব করছি না। যেন অপচয় হয়ে গেল আকাঙ্ক্ষার। পরোটা শেষ করে ম্যালের চত্ত্বর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, শুনতে পেলাম সিন্ডিকেটের মাইকে রেকর্ডেড ভয়েসে ঘোষণা হয়ে চলেছে, 'দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকদের উদ্দেশ্যে HPTDC-র পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে হার্দিক শুভকামনা। যাত্রীদের কাছে অনুরোধ কেউ যদি আপনাদের থেকে নির্ধারিত ভাড়ার বেশি ভাড়া চায় তবে আমাদের দপ্তরে এসে অভিযোগ জানাতে পারেন। সকল পর্যটকদের উদ্দেশ্যে... ...' বন্ধু আমার বাঁ কনুইয়ের কাছটা খামচে ধরে বলল, "বল্‌, ইচ্ছা করে না গিয়ে এই রসিদ দেখিয়ে নালিশ করে দিই, নয়তো থাবড়া মেরে এদের এই মাইকবাজি ঘুচিয়ে দিই?" আমি পাক্কা বানিজ্যিক ভাষায় বন্ধুকে শান্ত করে দিলাম, "থোড়া অ্যাডজাস্ট কর লে, ইয়ার!"

দশম অবস্থানঃ মূলতঃ রাস্তায়। মানালি ও তৎসংলগ্নর পথে পথে। উপভোগ(আন্তির) অতিশোয়াক্তি না করে নিতান্ত শর্টে ও সাঁটে এই বেড়ানোটুকুর বর্ণনায় যাব। স'বাবুকে বলে রাখাতে ম্যালের কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিলেন। আমরা রওনা হোলাম সোলাং-এর দিকে। রাস্তা, রাস্তার পাশে নদী, তার ওপাশে ঢেউ-খেলানো পাহাড়, তার ফাঁকে ফাঁকে বরফ চূড়া - এই মোটামুটি মানালির ভূ-ভঙ্গীমা। আর সামনে কালো মসৃণ পিচ-বাঁধানো... এপথে চলতে চলতে যদি এক পাল ভেড়া এসে আপনার পথ আগলায়, আপনি কি খুব অসন্তুষ্ট হবেন পান্থ? মনে হয় না। বরং আপনা হতেই আপনার মুখে হাসি আর হাতে ডি.এস.এল.আর. চলে আসবে (বা মোবাইল ক্যামেরা)। আমাদেরও এসব ধরতে করতেই দেখলাম সোলাং চলে এল। দেখলাম ভ্যালিটির থেকেও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ভ্যালিতে প্রবেশপথের পাশে যে দৈত্যাকার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ চলছে, সেটি। এই সুড়ঙ্গ যাবে রোহতাং পাস। মানালি থেকে গাড়ি নিয়ে পাঁই পাঁই চালিয়ে রোহতাং পৌঁছনো যায় তিন ঘন্টায় (যদি না যানজট...)। এই সুড়ঙ্গ পথে শুনছি কুড়ি-নাকি-চল্লিশ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সেখানে। সে এক প্রকান্ড কর্মকাণ্ড। গাড়ি থেকে যেখানে নামলাম, চারিদিকে থিক থিক করছে গাড়ি। খুব স্বাভাবিক। শুধু কি আমরাই সোলাং দেখতে আসব নাকি! মধ্যে মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ধাতব শুঁড়ওয়ালা এক্সক্যাভেটর, হাইড্রা ইত্যাদি। এই দিকটায় যে গুটিকয় সুউচ্চ পাইন এখনো মাথা তুলে খাড়া রয়েছে তাদের একাকীত্ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ২/৩ খানা প্যারাশ্যুট পাক খাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চশমার কাঁচে এক ফোঁটা জল পড়ল। চোখ নামিয়ে নিলাম। বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। এই দিকটায় পুরোটাই রাবিশ্‌ এখন। রাবিশের ওপরই কার-পার্কিং। এখান থেকে দেখলে মনে হচ্ছে সোলাং ওটি-তে হাফ-সার্জারি অবস্থায়। অমন মনোমোহিনী রূপের অধিকারিণীকে এমন অবস্থায় দেখতে ভালো লাগছে না। আমরা ভেতরে গেলাম।

সোলাং-এর মুখ্য আকর্ষণ বোধহয় এখন প্যারাগ্লাইডিং! তারপর রোপওয়ে। পাহাড়চূড়োয় শিবমন্দির। তারপর বিশালাকার বলের মধ্যে ঢুকে লুটোপুটি খেতে খেতে গড়িয়ে যাওয়া! তারপর খাওয়া-দাওয়া। আর এসবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে ছবি তোলা। বরফজমা সময়ে না গেলে এই মোটামুটি দস্তুর। এছাড়া ঘোড়াও আছে পাহাড় চড়ার জন্য, তবে এবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কম চোখে পড়ল তারা। যাহোক, এসবের মধ্যে একটা ব্যাপার মিস্ হয়ে যায় প্রায়শই এবং মনের খুব তলায় চলতে থাকে, 'আর কী? আর কিসের জন্যে ছুটে এসেছি এখানে? এটাই কি সোলাং ভ্যালি ঘোরা? কিছু কি বাদ যাচ্ছে?' হতেই পারে এরকমটা মনে, কারণ সত্যিই একটা কিছু বাদ যাচ্ছে, যার জন্য এখানে আসা। আর তা হল, জায়গাটা নিজে। যদি পারেন, নিজেকে এই কোলাহল থেকে সরিয়ে উপত্যকার মাঝটায় গিয়ে দাঁড়ান। মনে মনেই দাঁড়ান, কারণ সশরীরে যেতে পারবেন না ওখানে। ওখানটা ঘেরা আছে, তাও আবার একপাশ কাঁটাতার দিয়ে। ঘেরা জায়গাটায় প্যারাগ্লাইডাররা লাফ দিয়ে পড়ছে। সুতরাং... (আমাদেরই কে-যেন বলল, আচ্ছা আহাম্মকের মতো কাঁটাতার দিয়ে ঘিরেছে কেন জায়গাটা? ওই ওপর থেকে যে নীচে আসছে অনেক সময়ই এদিক ওদিক হচ্ছে। এমনকি ঘেরা জায়গার বাইরেও পড়তে দেখলাম। ওই কাঁটাতারের ওপর যদি পড়ে কি হবে? এর উত্তরে আমাদের মধ্যেই কে একজন বলল, "দাঁত কেলিয়ে বলে দেবে, থোড়া অ্যাডজাস্ট কর লিজিয়ে"। আমরা সবাই সেটা মেনেও নিলাম।)

বাদ দিন, আপনাকে সোলাং দেখাই। মনে মনে মাঝটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এবার যেদিক থেকে প্যারাশ্যুটগুলো রওনা হচ্ছে সেদিক থেকে দেখতে থাকুন, আর ধীরে ধীরে নিজের ডানদিকে ঘুরতে থাকুন। সময় নিন, সময় নিন। ঘোরাটার ওপর নয়, দেখাটার ওপর সময় দিন। ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরার পর অদ্ভুত এক উপলব্ধি হবে। সামনের পাইন আর পাহাড় - জোড়া দৃশ্যের মন্তাজ তো মন ভরাবেই। যে অনুভূতিটুকু আপনার রোমে রোমে রোমাঞ্চ জাগাবে, তা হল আপনার আবিষ্কার। আপনি আবিষ্কার করবেন ছোটবেলায় ক্যালেন্ডারের ছবি দেখে কতবার ভেবেছেন ওর মধ্যে ঢুকে যাই যদি... আবিষ্কার করবেন সত্যিই আপনি তেমনই এক স্বপ্নময় সিনারির অংশ হয়ে গেছেন। এটাই সোলাং। এটাই হারিয়ে যাচ্ছে। এই মজাটাই মাঠে মারা যাচ্ছে ফুর্তিবাজির চক্করে। প্রকৃতির থেকেও বড় প্রশ্ন "মানুষ খাবে কি?" না না, আপনি আপনার মতো ঘুরুন বাপু, আমরা বেরোলাম সোলাং থেকে। বৃষ্টিও হঠাৎ হঠাৎ কয়েক ঝলক। এক প্লেট করে কাটা ফল, এক গ্লাস করে জুস্‌ খেয়ে রওনা হলাম বশিষ্ঠ অভিমুখে। বেলা তখন দুপুর গড়াবে গড়াবে। ঠিক হল বশিষ্ঠে মধ্যাহ্নভোজ।

এখানে অধুনা মানালির মূল সমস্যাটা নিয়ে বলে রাখা দরকার। মানালি যাঁরা গেছেন তাঁরা সহজেই ধরতে পারবেন, যাঁরা যাননি তাঁদের জন্য ছবিটা বোঝাবার চেষ্টা করি। মনে করুন মানালি ম্যালটা আসলে আপনার বাড়ি। একতলা হাত-পা ছড়ানো এবং চারিপাশে বাগান সম্বলিত এক সুরম্য বাসস্থান। এবার কল্পনা করুন, আপনার বাড়ির বারান্দা থেকে নামলে বাগান, বাগান পেরোলে ছোট গেট, গেট পেরোলে সামনে দিয়ে চলে গেছে পুরসভার হাই-ড্রেন। আর এই হাই-ড্রেনটা পেরোনোর জন্য আপনার বাড়ির গেটের নাক বরাবর পেতে দেওয়া আছে ঢালাই সিমেন্টের স্ল্যাব। ড্রেন পেরোলেই ড্রেনের সমান্তরাল রাস্তা। সহজেই অনুমেয় যে, আপনি রাস্তা ধরে ডান দিকেই যান বা বাঁ-দিকেই যান, রাস্তায় উঠতে গেলে আপনাকে ওই স্ল্যাবের ওপর দিয়ে ড্রেনটা পেরোতেই হবে। এবার কল্পনা থেকে নেমে আসুন প্লি-z। আপনার সাজানো বাগানওলা বাড়ি ভুলে যান। বারান্দা, গেট ইত্যাদি ভুলে যান। বিপাশার মতো মায়াবী নদীকে পুরসভার হাই-ড্রেনের সঙ্গে তুলনায় টানার জন্য আমায় ক্ষমা করে দিন। আপনার বাড়ির জায়গায় মানালি ম্যালটিকে বসান। ম্যালের যে পাশ দিয়ে বিয়াস বয়ে চলেছে, সেদিকে এসে বিয়াস টপকে যে রাস্তায় আপনি পড়বেন, সেই রাস্তাটিই বাঁ দিকে চলে গেছে বশিষ্ঠ, সোলাং, রোহতাং, উধাও... আর ডান দিকে বাঁক নিলে আমাদের হোটেল, মাউন্টেনিয়ারিং ইন্‌স্টিটিউট, নগ্‌গর, উধাও... যাক্‌গে! আশাকরি চলনসই মতো বোঝানো গেছে। বুঝতেই পারছেন যেদিকেই যান, নদীটি পেরোতে হচ্ছে। এখানে সিমেন্টের স্ল্যাব নয়, রয়েছে লোহা-লক্করে বাঁধা দুটি সেতু। পাশাপাশি। খুব জোর ফিট-দশেক চওড়া হবে। একটি দিয়ে ম্যাল থেকে নদী টপকাতে হবে, আর অপরটি দিয়ে নদী টপকে ম্যালে প্রবেশ। সমস্যা এখানটাতেই। বাঁদিকে কোন্‌ সে উধাও থেকে, রোহতাং থেকে, সোলাং থেকে, বশিষ্ঠ থেকে, আরো কত ইত্যকার জায়গা থেকে সারি সারি গাড়ি সাঁ সাঁ করে ছুটে চলে আসছে মানালি, এরা সব সকালে বেরিয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের গাড়ি তো আছেই। আবার ডানদিকেও কোন্‌ সে উধাও থেকে, কত কত গাড়ি কাতারে কাতারে এসে পৌঁছচ্ছে মানালি। বিয়াস পেরিয়ে ম্যালে ঢুকতে গেলে ওই একটি পুল। আর গোটা দুই কন্‌স্টেবল্‌। বালি ঘড়ির পেটের মতো অবস্থাটা। ব্রিজের ওপর দিয়ে ধীরে নড়ে-চড়ে যতক্ষনে একটি গাড়ি পার হল, ততক্ষনে আরও সাতটা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল ইঞ্জিন বন্ধ করে লম্বা যানজটের পিছনে। গাড়ির সারি হয়তো ছাড়িয়ে গেছেএএএ...

আমাদের কথাই ধরুন না। সোলাং থেকে এক প্লেট ফল খেয়ে বেরোলাম, বশিষ্ঠে লাঞ্চ করব ভেবে। সোলাং থেকে দু'পা যেতে না যেতেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে গাড়ির লাইনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন স'বাবু। এবার মানালি বেড়াতে গিয়ে দেখে এলাম, দু-তিন ঘন্টার জ্যাম আম বাত্‌। দিনবিশেষে বা কপালবিশেষে ছ'ঘন্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে। সোলাং থেকে বশিষ্ঠ মন্দির মাত্র বারো কিলোমিটারের মত রাস্তা। মানালির দিকে আসতে আসতে, মানালি ঢুকবার কিলোমিটার দেড়েক আগে রাস্তাটা বাঁদিকে তেরছাভাবে বেয়াড়ারকম চড়াই ভেঙে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। গাড়ি যায়, তবে জায়গায় জায়গায় রাস্তা বেশ সরু। মুখোমুখি গাড়ি এলে এপাশে ওপাশে সরে কোনোমতে জায়গা দিতে হয়। রাস্তা কিন্তু খুব বেশি পাকদন্ডী না-খেয়ে মোটামুটি চড়াই। দুপুর প্রায় একটা। মে মাসের অসহ্য গরম মানালিতে। তার ওপর আকাশে মেঘ থাকায় খানিক গুমোট। গাড়ি যানজটে ধুঁকে ধুঁকে বশিষ্ঠ যাওয়ার রাস্তার মুখটা পেল যখন, একটু হাফ ছেড়ে গা এলিয়ে দিলাম সিটে। মাথা গরম করে দেওয়া খিদে পেয়েছে। রাস্তার ধারের কুলকুল বিয়াস, তার পাশে ফ্রেমে বাঁধানো অপার্থিব সিনারি কিছুই শান্তি দিচ্ছে না। জ্বরে পান্‌সে হয়ে যাওয়া মুখের স্বাদের মতো ফালতু রসিকতায় মজিয়ে রাখতে চাইছি একে-অপরের তিরিক্ষে মেজাজ! এই অবস্থায় বেশ খানিকটা চড়াই উঠে বাঁ-দিকে খাদের ধার ঘেঁষে আবারো দাঁড়িয়ে পড়লেন স'বাবু। সামনে যতদূর চোখ যায় ইয়া ইয়া ট্যাভেরা, ট্রাভেলার বাসগুলো, ছোট গাড়িও আছে। সব স্ট্যান্ড স্টিল। উল্টো দিক থেকে ফিরতি গাড়িগুলো কোনোমতে পাহাড়ের গায় হয়ে থাকা আগাছা ছেঁচড়ে তাও নীচে নেমে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের লাইনটি নট্‌ নড়ন-চড়ন। গাড়ি থেকে এক বন্ধু নেমে গেল। অবশ অনুভূতি নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি বেচারা কি অক্লান্ত চেষ্টা করে চলেছে সামনের জগদ্দল পাথরগুলোকে নড়াবার। একটু নড়ে, আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। এ বলে 'উসকো বলিয়ে অ্যাডজাস্ট করনে, ম্যায় পিছে কিউ লুঁ', তো ও বলে, 'পিছেওয়ালা অ্যাডজাস্ট কিজিয়ে না!' কী যে হল, গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। উষ্ণ প্রস্রবণ নয়, শালা এই জ্যামের উৎস কোথায় আজ দেখেই ছাড়ব। গাড়ির সারি পেরিয়ে পেরিয়ে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যার আগে আর গাড়ি নেই। লাইনের এক্কেবারে প্রথম গাড়িটি রাস্তার কিছুটা বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার আর নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। গাড়ির অ্যাক্সেলটি গেছে ভেঙে। মিস্ত্রি এসে তারই মেরামতের কাজ করে চলেছে। এখনও বহু বাকি। লাইনের দ্বিতীয় গাড়িটি হল একটি ট্রাভেলার বাস। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়েছিল, কারণ উল্টোদিক থেকে গাড়ি নীচে নামছিল। এবার ফাঁকা হয়েছে, অথচ এখনো সে সামনের গাড়িটিকে পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারছে না। বাসটি অকেজো গাড়িটিকে বাঁদিকে রেখে তার ডানদিক দিয়ে ওভারটেক করার চেষ্টা করে এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এবার আর একচুলও এগোলে বাসটির পেছন অংশের সঙ্গে গাড়িটির পেছন অংশের ঘষা লেগে যাবে। আর গাড়িটিকে বাঁচাতে বাসটি যে আরো কিছুটা ডানদিকে সরবে তারও উপায় নেই। রাস্তার ধার ঘেঁষে বাড়ি। বাড়ির সিঁড়ির রেলিং তবে নির্ঘাত ভাঙ্গা পড়বে। এমতাবস্থায় রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ। ওপর থেকে বেশ কিছু বাইক নেমে এসেছে, তারা অপেক্ষা করছে আর গর্জন করছে। সমতলে কী পাহাড়ে, বাইকের অ্যাটিচিউড হল, জ্যাম-ফ্যাম আমরা পরোয়া করব না, একটু ফাঁক পাই সাইড গলে যাব... তারপর দুনিয়া ভাঁঢ় মে...

আমি দেখলাম, বিশালদেহী ফ্রেঞ্চকাট এক পালোয়ান গোছের স্থানীয় ছেলে, হাত নেড়ে নেড়ে গাইড করে বাসটিকে কোনোমতে আবার তার আগের অবস্থান, ওই অকেজো গাড়িটির পেছনে এনে দাঁড় করাল। আমিও ভাবছি এবার কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই। ওমা! ছেলেটি বলল, "অব ইয়হি উতরকে পয়দল্‌ চলে যাইয়ে"। মানে? হতচকিত ড্রাইভার বলে বসল, "ক্যায়সে যায়ে?" ছেলেটি হাত নেড়ে যা বলে গেল তার মানে - 'তইলে zaaমর্জি করুন গে।' বলেই, খাদের পাশে তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নিজের বাড়িতে সেঁধিয়ে গেল বিলকুল!

হতভম্ব আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম এই চত্ত্বরটুকুতে এই মুহূর্তে আমিই একমাত্র যে কলকাতা থেকে এসেছি। মাথা এমনিতেই গরম ছিল। রোখ চেপে গেল। কলকাতা মোডে চলে গেলাম। প্রথমেই দেখলাম লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরপর গাড়িগুলোর মধ্যে দু'হাত / আড়াই হাত করে ফাঁক। খুব ডাঁটের সঙ্গে ওই আটকেপড়া বাসের পিছনের গাড়ির ড্রাইভারগুলোকে পিছু হটাতে সচেষ্ট হলাম। গাঁইগুঁই করলেও দেখলাম অল্প অল্প পিছোলো। আমার বন্ধুও চলে এসেছে এরই মধ্যে। আমাদের দেখাদেখি আরো দু'এক জন। আর ওই অকেজো গাড়ির অনুতপ্ত ড্রাইভার তো ছিলেনই। এসব সিচুয়েশনে বটল্‌ গ্রীন কালারের ফুল স্লিভ টি-শার্ট আর মিলিটারি জংলা টুপি মনে হয় বেশ কাজে দেয়। আপনারা ট্রাই করে দেখতে পারেন। সে যাইহোক, মিনিট দু'য়েকের মধ্যেই বাসটিকে বেশ কিছুটা পিছনে পিছোনো গেল জায়গা করে। এবার বাসটি পুরোপুরি রাস্তার ডান অংশটা নিয়ে সোজাসুজি দাঁড়াল। এরই মধ্যে সুড়ুৎ সুড়ুৎ গলে যাওয়া বাইক ও পথচারী তো আছেই। তাও একসময় অল্পক্ষণের জন্য থামানো গেল তাদের। এবার বাসটি একদম সোজা আসবে রাস্তার রাইট সাইড ধরে, যাতে বাঁপাশের অকেজো গাড়ি বা ডানপাশের বাড়ির রেলিং কোনোটাই ক্ষতিগ্রস্থ না-হয়। শেষমেস আমরা সফল হোলাম, আর সর্‌সর্‌ করে সব মৃত গাড়িগুলি খোঁয়াড়ি ভেঙ্গে জ্যান্ত হয়ে উঠে একে একে ওপরে উঠতে শুরু করল। আমরা ফিরে এলাম আমাদের গাড়িতে। ভাবতে অবাক লাগে, এই যে এতোগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল, প্রায় সবকটিই স্থানীয় গাড়ি, ট্যুরিস্ট নিয়ে এসেছে। চালকেরা সবাই স্থানীয় এবং বেশিরভাগই কম বয়সী। অথচ কেমন হাত-গুটিয়ে বসে থাকতে পারে!

বশিষ্ঠ মন্দিরের পথের শেষটুকু হেঁটে পৌঁছতে হয়। গাড়ি পার্ক করার পর নেমেই দু'দ্দাড় করে এগিয়ে গেলাম প্রথম যে খাওয়ার দোকানটা খোলা পেলাম, সেদিকে। তখন বাজে প্রায় বেলা তিনটে। সেদিন লাঞ্চে ছিল গরম হাত-রুটি, স্বাদু আলু-জিরা আর ব্রহ্মতালু অবধি খিদে। অতুলনীয়!

পাহাড়ে আলো তাড়াতাড়ি কমে। তবে এখনো বেশ পরিষ্কার। অল্প চড়াই পিচরাস্তাটা সো-ও-জ্জা উঠে গেছে নাক বরাবর। দুপাশের হরেক-মালের পসার দেখতে দেখতে চলেছি। মানালি ট্যুর প্ল্যানে শপিং থাকলে, বাজেটের বেশ কিছুটা বশিষ্ঠের জন্য তুলে রাখা যায়। এ জায়গা হতাশ করবে না। আমরা আটকালাম, আবার চললাম হেলেদুলে। মন্দিরের দোরগোড়ায় রাশিকৃত জুতো। বাইরে থেকে মন্দিরের ভেতরের পরিসর যেরূপ ঠাহর হচ্ছে, তাতে এত লোক ঢুকেছে কোথায়! কালো, শীতল, গম্ভীর ও মসৃণ পাথরের মেঝে আর অঢেল কারুকার্যমন্ডিত আজো জেল্লাদার কাঠের প্রথাগত মন্দির। এছাড়া, সত্যি বলছি, খুব একটা নজর করে দেখিনি। জুতোমোজা খুলে রেখে ঢুকে পড়লাম। মন্দিরের ভেতরে স্বল্প পরিসরে ছাদখোলা প্রাঙ্গণ। খোলা প্রাঙ্গ্ণে আবালবৃদ্ধবণিতার ভিড়। আমার আগ্রহাদি সেদিকে ছিল না। অনুসন্ধিৎসু এক কোণায় দেখতে পেল বেশ সরু এক দোরপথ, সাবধানে, এপথে হাফ-চৌকাঠ; পাথরের (তবে কি চৌপাথর বলা সমীচীন হবে)। সরু প্যাসেজ গ'লে ডানহাতেই বিশালাকৃতি পাথর বাঁধানো চৌবাচ্চা। তাতে সামান্য ঘোলাটে উষ্ণ জল। সিস্টেম ভারি সুন্দর। চৌবাচ্চার তিন দিক ধরে হাঁটা যায়। চতুর্থ বাহু দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো। সেই দেওয়াল উঁচু হয়ে প্রায় কুড়িফুট উঁচু প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে। চৌবাচ্চার যে বাহু প্রথমেই চোখে পড়ে মন্দিরের ভেতর দিয়ে এলে, সেদিকটায় বেশ কিছুটা জায়গা আছে চৌবাচ্চার আগে। শান বাঁধানো নীচু মেঝেতে সেখানে হাতির শুঁড়ের মতো ধারায় জল পড়ছে চৌবাচ্চার এদিকের দেওয়ালে করা পাশাপাশি তিন-তিনটে ছিদ্র পথে। এ-জল কুণ্ডেরই জল। চৌবাচ্চায় নামার আগে যাতে স্নানার্থীরা পদযুগল পরিষ্কার করে নেন, তার জন্য এই ব্যবস্থা। স্নানার্থীদের জন্য আরও ব্যবস্থা আছে। চৌবাচ্চার বাকি দুপাশের দেওয়ালও যথেষ্ট উঁচু এবং সেখানে জামা-কাপড় ঝুলিয়ে রাখবার হেতু আংটা লাগানো আছে। তেল-সাবানটা না-মাখাই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু কে বলে দেবে? কেউ না বলে দিলে তো আমরা... এদিকটা ছেলেদের। দেওয়ালের ওপারে মেয়েদেরও আছে। আমি হাঁটু অবধি প্যান্ট গুটিয়ে নিলাম। পা ধুয়ে নিলাম হাতির শুঁড়ের ফোয়ারায়। তারপর গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলাম এক পাশে। ভেজার ওপরই বসলাম। ওটুকু ভিজুক। কত লোক! সবাই প্রায় ল্যাঙ্গট বা জাঙ্গিয়া পড়া। যাঁরা চৌবাচ্চার ভেতর নেমে পড়েছেন, তাঁরা ওপরের লোকেদের নেমে পড়ার জন্য উস্কাচ্ছেন। এক বাঙালি ভদ্রলোক তার দশ/বারো বছরের ছেলের সঙ্গে নেমে পড়েছেন চৌবাচ্চায়। কেউ কেউ যেন প্রায়শই আসেন। যেন নিজের ঘরের স্নানঘরের মতোই চেনা। তৎপরতার সঙ্গে পা ধুচ্ছেন, জামা-প্যান্ট খুলে টাঙ্গিয়ে রাখছেন যেন প্রতিদিনই রাখেন, পৈতে পেঁচিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে মন্ত্র বিড়বিড় করলেন এবং নেমে পড়লেন। এমন ভঙ্গিমা, যেন এখানে যেমন-তেমন ভাবে স্নান করলেই হল না, স্নানেরও একটা গাইড বুক আছে। কেউ কেউ স্নান করে উঠেই ধুপ জ্বেলে মাথা ঠেকাচ্ছে চৌবাচ্চার ওদিকের দেওয়ালের একটা কুলুঙ্গিতে। ওখানে কোনো ঠাকুর আছেন, আমার এখান থেকে ভালো ঠাহর হচ্ছে না। আমি পা ডুবিয়ে বসেই আছি নিশ্চল। ভালো লাগছে এভাবে থাকতে। একই সঙ্গে এক পরম আরাম আর নিবিড় অবসন্নতা পেয়ে বসছে আমায়। সূর্যের আলো কমে আসছে দ্রুত...

কিন্তু মোবাইলের নয়। যথার্থ নাম এই বস্তুটির। দু'দুটো বিশ্বযুদ্ধও মনে হয় জগৎসংসারের প্রতিটি হোমো সেপিয়েন্সকে এতোটা অস্থির করে তুলতে পারেনি! অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎই চটকা ভাঙ্গল চৌবাচ্চাস্থিত বাচ্চাটির বাবার হুঙ্কারে। হুঙ্কারের অভিমুখ লক্ষ্য করে দেখি, ওপাশের দেওয়ালের কুলুঙ্গির সামনেটায় যে চিলতে দাঁড়ানোর জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে এক চোস্তা জিন্স, নিজের সঠিক সাইজের থেকে দু'সাইজ ছোট, প্রায়-এয়ারটাইট কালো জামা, কপালের ওপর ঝুঝকো চুল তামাকের-ধোঁয়া-লাগা-লাল; আমাদের দিকে পেছন ফিরে, হেলে, উর্দ্ধে উঁচায়ে স্মার্ট মোবাইল সেল্‌ফি তুলতে উদ্যত। প্রথমে জল ছিটিয়ে ও পরে সমবেত হুঙ্কারে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া গেল ওই চৌহদ্দি থেকে। আমিও গুটি গুটি উঠে এলাম। আগের মতোই হেলেদুলে, পশলা বৃষ্টি গায়ে মেখে আমরা যখন গাড়ির স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে পাঁচটা পাঁচ (জানিনা কিভাবে মনে আছে টাইমটা)। গাড়ি বশিষ্ঠ ছেড়ে নামতে শুরু করতেই 'আবার কাল আসব' বলাবলি করে নিয়েই স'বাবুকে বলা হল, এবার তবে হিড়িম্বা চলুন। স'বাবুর হাতদুটো স্টিয়ারিং থেকে খুলে কাঁধের দু'পাশে ঝুলে পড়ল। এই অ্যাটিচিউডটা দেখেই আমাদের মেজাজ জ্বলে গেল। এই প্রায়ান্ধকারে ওই মন্দিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না, এটা কি আমরা বুঝি না? নাকি আমরা এখনো বুঝিনি মানালির জ্যাম কী বস্তু। আমরা তো হাড়ে হাড়ে জানি এখন, এই বশিষ্ঠ থেকে নেমে মানালির ওই ব্রীজের মুখ অবধি পৌঁছতে লেগে যেতে পারে দু'ঘন্টা! কিন্তু এটা কিরকম, কড়কড়ে আঠেরো হাজার টাকা গুনে দিয়ে দিন-রাতের জন্য গাড়ি ভাড়া নিলাম ড্রাইভার সমেত, আর সাঁঝ হতে-না-হতেই স'বাবু বলেন 'বাড়ি যাই, বাড়ি যাই।' খানিক বিতন্ডাই হল গাড়ির মধ্যে। ভালোই হল, গড়িয়ে গড়িয়ে ব্রীজের মুখে চলে এলাম। স'বাবুকে রেহাই দিয়ে আমরা হেঁটে চলে এলাম ম্যালে। সন্ধ্যার মানালি ম্যাল গমগমে, জমজমাট। দেখা হোলো এক পুরোনো বন্ধুর সাথে। যশবন্ত সিং।

ওর একটা অল্টো আছে। সাত বছর আগে যখন শুধু আমি আর আমার বৌ এসেছিলাম, তখন রোহতাং যাওয়ার জন্য গাড়ি বুকিং করেছিলাম সিন্ডিকেটে। বলেছিলাম ভোর পাঁচটায় পাঠাবেন। আমাদের এক ভ্রমণ বিশারদ কলিগ-কাম-বন্ধু আগেই সাবধান করে দিয়েছিল। বলেছিল, দ্যাখো রোহতাং যাওয়ার দিন আলসেমি করবে না। বুকিং-এর সময় ড্রাইভার বলতেই পারে, মাত্র ৫২ কিলোমিটার রাস্তা ৩ ঘন্টার বেশি লাগবে না পৌঁছতে, ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে কী করবেন ঠান্ডায়। তবু তোমরা জেদ ধরবে, ভোর পাঁচটাতেই রওনা দিতে হবে, নতুবা রোহতাং পাসের শেষ সীমায় যেতে পারবে না। এতো গাড়ি যায়, দেরীতে বেরোলে অনেক নীচেই থেমে যেতে হবে। রাস্তা ধরে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে। ড্রাইভার হেসে হেসে বলবে, এইত্তো রোহতাং, যান ঘুরে আসুন।

হ্যাঁ সে-সময় বলার মতো ঠান্ডা পড়ত মানালিতে। তবু লেপের তলা থেকে বেরিয়ে গিজারে জল গরম করে স্নান করেছি। এটা প্রতি সকালে করতাম। স্নান করে নিলে ঠান্ডা অনেক কম লাগত, ঝরঝরে থাকতাম। আর সঙ্গে রাখতাম কেক, ডিম, ড্রাই ফ্রুটস্‌ যেকোনও লং ড্রাইভে। কারণ দূরের রাস্তার মাঝে মাঝে ওয়েসিসের মতো খাবার জায়গাগুলো মোলায়েম করে গলা কাটে। হাই অল্টিচিউডে তো কথায় নেই... যাক্‌গে, সেবারের সেই ভোরে আপার-লোয়ার উলিকট, তার ওপর জিন্স, গায়ে মোটা জামা, ফুলহাতা সোয়েটার, মাফলার ইত্যাদি পড়ে রেডি ছিলাম হোটেলের লাউঞ্জে। গাড়ি এলো সোয়া পাঁচটায়। হোটেল বিয়াস থেকে বেরিয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে ব্রীজ পেরিয়ে বাঁ দিকে মোড় ঘুরে গাড়ি যখন রোহতাং পানে, দূরের বরফ চুড়ার গা-থেকে রাতের পুরোটা নীল তখনো মুছে ফেলতে পারেনি সোনালী রঙ। আমি বললাম, পাঁচটায় বলেছি আর পাঁচটাতেই চলে এলেন! আপনার নাম কি ভাই? মিতভাষী হাসিমুখ ছেলেটি বলেছিল, "ইয়শওয়ান্ত্‌ সিং! আপ লোগভি তৈয়ার খঢ়ে থে, দেখকে আচ্ছা লগা, লোগ টাইম দেকে লেট করতে হ্যায়, সোচতা হ্যায়, ড্রাইভার হ্যায়, প্যায়সা দিয়া হ্যায়, ওয়েট করেগা।" ব্যাস, যশবন্তের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। (লেখার বাকিটুকুতে যশবন্তের প্রসঙ্গ এলে 'যশবন্ত'ই লিখব বুঝলেন, আর আপনারা পড়ার সময় উচ্চারণ করবেন 'জ-শো-ব-ন্তো', কেমন? তা নাহলে আনন্দবাজার রাগ করতে পারে।) গাড়ির কাঁচ নামালেই মোটা মোটা জামাকাপড় ভেদ করে ঠান্ডা হাওয়া কামড়ে বসছে হাড়ে। আর যশবন্ত পড়ে আছে একটা খয়েরি ট্রাউজারের ওপর প্রায় 'বিবর্ণ কালারের' একটা ফুলহাতা জামা, আর তার ওপর ঘিয়ে রঙের হাতে বোনা, হাফ হাতা সোয়েটার। ভুলে যাবেন না, একথা বলছি মাত্র সাত বছর আগের মে মাসের মানালির। আর আমরা যাচ্ছি রোহতাং। আরো খেয়াল করবেন আজ এই মরসুমে প্রথম রোহতাং যাওয়ার রাস্তা খুলেছে এবং বাস্তবিকই, আমাদের গাড়ির সামনে রোহতাং অভিমুখে আর কোনো গাড়ি চোখে পড়ছে না।
কিছুদূর যেতেই পথে এক জায়গায় পরপর সার দেওয়া অস্থায়ী দোকান ঘরের একটির সামনে দাঁড় করাল গাড়ি। এখান থেকে সেই বিশেষ নিকার-বোকার ভাড়া নিতে হবে, যা আমাদের তিন হাজার নশো আটাত্তর মিটারে জমে থাকা ওই বরফ-ঠান্ডার সঙ্গে যুঝতে সাহায্য করবে। সঙ্গে রবারের গামবুট আর রবারের দস্তানা। এক এক সেট যতদূর মনে পড়ছে তিনশ টাকা করে ভাড়া করেছিলাম। যশবন্তের জন্য ভাড়া করতে গেলাম তো ও বলল, "ম্যায় তো গাড়িসে নেহি উত্‌রুঙ্গা"। আমার খুব ভালো মনে আছে, আজ থেকে মাত্র সাত বছর আগে, আমরা আমাদের সমস্ত পরিধানের ওপর দিয়ে ওই ডাবল্‌ সাইজ প্যারাস্যুট কাপড়ের নিকার-বোকার পড়ে নিয়েছিলাম, সঙ্গে জুতো আর গ্লাভ্‌সও, তবু আমাদের গরম লাগেনি!

রোহতাং যেরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্যমন্ডিত, রোহতাং-এ পৌঁছবার রাস্তাও সেইরূপ স্বপ্নালু। সুবিশাল পাহাড়ের গায়ে চুলের মতো জড়িয়ে থাকা পথের শত শত বাঁক বেবাক বিস্ময়ে পেরিয়ে যাচ্ছি আর সামনে (কী পাশে) অন্তঃকরণ খালি হয়ে আসা খাঁ খাঁ খাদ, আবার কোন অতল থেকে মাথা তুলে চরাচর ঢেকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই সামনে আরও এক বিস্তৃত পর্বতশ্রেণী হয়ে। তাদের প্রায় কোলের কাছে সঞ্চরণমান টুকরো আদুরে সাদা মেঘেদের ছায়া পড়েছে গায়। যেন দাওয়ায় বসে হাসিমুখে মা তাকিয়ে আছেন উঠোনে আদুল গায়, টলোমলো পায়, অবোধ শিশুর ধুলো-খেলার দিকে। বিশেষত যখন রোহতাং আর মাত্র পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার দূরে, তখন যে অঞ্চল দিয়ে গাড়ি পেরোলো, তার ঘাসের রঙ, গাছের পাতা, ছোট ছোট নাzuক বাঁক নিয়ে র‍্যাটেল-স্নেকের ভঙ্গীমায় পাহাড়ের গা-বেয়ে হারিয়ে যাওয়ার সফর, আর সকালের সূর্য... দেখে মনে হবেই এখানে যেন সূর্যও পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। অদ্ভুত এক মায়াবী আলো ঢেলে দিয়েছে ঢালে ঢালে। মনে হবে, নির্ঘাত চাঁদের রাতে পরীরা নামে এ-রাজ্যে। যেমন তার রূপ, তেমন তার মিষ্টি নাম গুলাবা। যশবন্তের কাছে শুনেছিলাম, জায়গাটি নাকি সিনেমাওয়ালাদের খুব পছন্দের। অনেক শ্যুটিং হয়। দুঃখ করছিল, মানালির নানান জায়গায় শ্যুটিং করে সিনেমায় দেখায় কাশ্মীর ব'লে। আরো বলছিল কোন্‌ কোন্‌ সিনেমা আর্টিস্টকে দেখেছে। আমি তখন গুলাবার সৌন্দর্যে বেহুঁশ প্রায়। একবার কাঁচ নামিয়েছিলাম ফটো তোলার জন্য (আসলে সূর্যের আলো কাঁচে রিফ্লেক্ট হয়ে লেন্স ধাঁধিয়ে দিচ্ছে)। দু'একটা ক্লিক করেই তড়িঘড়ি কাঁচ তুলে দিলাম আবার (মাত্র সাত বছর আগে)।

রোহতাং আর ষোলো কিলোমিটার, এলো মাঢ়ী। এখনও বরফ নেই পায়ের নীচে। তবে বরফ-শীতল হাওয়া। গুটিকয় চা-জলখাবার-ডাল-রুটির দোকান। যশবন্ত চায়ের অর্ডার দিল তিনজনের জন্যই। আমরা দু'জনেই চা খাই না, তবে ওই ঠান্ডায় গরম চায়ের গ্লাসটাকে দু'হাতের তালুর মাঝে নেওয়ার জন্যও চায়ের অর্ডার দেওয়া সঙ্গত বলে মনে হবে। চা দিতে দিতে আমি রাস্তা পেরিয়ে সামনের উঁচু ঢিবিটার ওপর উঠে পড়লাম সিঁড়ি বেয়ে। মাথার ওপর একটা মন্দির, যার ওপাশের বারান্দা প্রায় ঝুলন্ত সামনের খাদে। ওখানে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হল হাওয়ার তোড় আমায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে ফেলতে পারে। তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। মাঢ়ী থেকে গাড়ি ছাড়ল তখন সকাল সাতটা হবে।

রোহতাং যখন আর দশ কিলোমিটার, সেই প্রথম অল্প ভাঙাচোরা রাস্তা পেয়েছিলাম। তারপর রাস্তার সঙ্গে মিশতে লাগল কাদা। এখন চারপাশে তুষার-শৃঙ্গ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। সামনের কাদায় একমাত্র মিলিটারি ট্রাকের টায়ারের দাগ। বর্ডারের থেকে এই রাস্তা পর্বতমালায় আগলে রাখা। লেহ্‌ পর্যন্ত সৈনিকদের রসদ পৌঁছতে এর থেকে ভালো বিকল্প পাওয়া মুশকিল। তাই এই রাস্তার বেশ যত্ন-আত্তি করে থাকে মিলিটারি। এখন রাস্তার দু'পাশে দু'মানুষ সমান বরফের পাঁচিল। জানলাম এখানেই 'যব উই মেট' সিনেমার ওই জনপ্রিয় গানটির কিছু অংশের শ্যুটিং হয়েছিল। (হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন করিনা কাপুর জাস্ট একটা ক্যাপ্রি পরে নাচছিলেন, পিছনে সাহিদ কাপুর জিপ চালিয়ে... ভাবা যায় না)। আর একটা কথা যশবন্ত বারবার বলছিল, "ইঁহা তক্‌ কোই নেহি লাতা, ইঁহা তক্‌ কোই নেহি লাতা।" বলতে বলতে যে বরফ-বিছানো উপত্যকার সামনে ও গাড়ি ঘুরিয়ে দাঁড় করালো, আমরা নেমে দেখলাম সেই স্পটেই একটা মাইল ফলক শোয়ানো আছে, তাতে লেখা, ' ROHTANG 0'। আমি ওই রাস্তার ভিডিও করছিলাম গাড়ি থেকে নামার একটু আগে থেকেই। ভিডিও শেষ করেছিলাম গিয়ে ওই মাইল ফলকে। সুতরাং প্রমাণ আছে।

এরপর যশবন্ত যেটা করেছিল সেটা অভাবনীয়। তাই মনে হয় আজো আমরা যদি মানালি যাই তবে আমাদের ট্যুর প্ল্যানে ওই মানুষটির সঙ্গে দেখা করা থাকে। তার সন্তানের জন্য উপহার নিয়ে যাওয়া থাকে। প্রথমে আমাদের বলেছিল বসে পড়ুন রাস্তার পাশেই বরফের ঢালে ভ্যালির দিকে পা ছড়িয়ে। আমরা বাধ্য ছেলে-মেয়ের মতো বসে পড়লাম। তারপরই, 'আব স্লাইড কর যাইয়ে।' আমরা হতভম্ব! ওতো দূর ঢালু গড়ানে স্লিপ খাইনি তো কখনও। বললাম কী করে? ও আমাদের পিঠ ধরে ঠেলে দিল একে একে। আমরা গিয়ে থামলাম একেবারে বাটির তলদেশে। উঠে যখন দাঁড়ালাম, মনে হোলো পৃথিবী নয়, অপার্থিব কোনো বরফচাপা শীতল যজ্ঞকুণ্ডে এসে পড়েছি। চারিদিকে ঘিরে আছেন স্থিতধী প্রাজ্ঞ সব মহর্ষিরা সেই কোন অজানা কাল থেকে। উঁচু আর ছুঁচোলো তাদের মাথা অতীত অভিজ্ঞতায় সাদা। ওই ওপরে গাড়িটাকে মনে হচ্ছে খেলনা। তার পাশে দাঁড়িয়ে যশবন্ত হাফ সোয়েটার পরে। দৃষ্টিগোচর চরাচরে আর একজনও মনিষ্যি নেই। আমরা হাত নাড়লাম। আমাদের আরও অবাক করে যশবন্ত স্লাইড করে নেমে এল আমাদের কাছে। আমরা খুব চিন্তিত ভাব নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "এতো ঠান্ডায়, এই অবস্থায় তুমি নেমে এলে কেন? গাড়িতে থাকবে বললে যে!" খুব সিরিয়াস ভাব নিয়ে বলল, "ম্যায় নেহি আতা তো আপ লোগোকা ফোটো কৌন্‌ লেতা?" বলে আমার হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে আমাদের দুজনের ছবি তুলতে থাকল। আবার বলতে লাগল, "থোড়া অ্যাকশন কিজিয়ে, ফোটো আচ্ছা আয়েগা"। ওই জনমানবশূ্ণ্য ভার্জিন ভ্যালিকে সাক্ষী রেখে আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে, বরফে গড়িয়ে নানা পোজে ছবি তুলেছিলাম। P.C. Sri Yashwant Singh। পরনে হাফ-সোয়েটার। একসময় বলতেই হল আর পারছি না ঠান্ডা লাগছে যে। তখনো ও বলে চলেছে, "অউর একঠো, অ্যায়সে, বরফমে লেইট্‌ কর। থোড়া তো অ্যাডজাস্ট কিজিয়ে। অচ্ছা ফোটো আয়েগা"।

ভ্যালিতে নেমেছিলাম ঠিক সকাল আটটায়। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেই গালের হনু, ঠোঁট, ফোটো তোলার জন্য গ্লাভ্‌সের ভেতর থেকে বের করা আঙ্গুলগুলো টন্‌টন্‌ করতে শুরু করল। এরপর উঠে এসেছিলাম। তখন দেখেছিলাম স্কি-স্কুটার নিয়ে দু'একজন অন্য দিক থেকে ভ্যালিতে ঢুকে পড়ল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অল্প এগোতেই দেখতে পেলাম পাহাড়ের অন্য পাশে, পিছনে ফেলে আসা ভ্যালির থেকে খানিক নীচে পাহাড়ের গা-বেয়ে টায়ার চেপে স্লাইড করছে অনেকে। ছোঁড়াছুড়ি করছে বরফ। সার সার... সার সার... সার সার গাড়ি এসে এসে ভিড় করছে রাস্তার পাশে। সকাল আটটাতেই নামার সময় আটকে গেলাম জ্যামে। গাড়ি আর গড়াতেই চায় না। আমরা যত অবধি গিয়েছিলাম, তার থেকে অনেক অনেক নীচে, লম্বা লাইনের পিছনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভাররা ট্যুরিস্টদের বলছে, "লো জি আ গয়ে রোহতাং।" আমরা মানালি থেকে ভোর পাঁচটায় রওনা হয়ে রোহতাং পৌঁছেছিলাম সকাল আটটায়। ফেরার পথে রোহতাং থেকে রওনা হয়ে মাঢ়ী পৌঁছতে বেলা বারোটা বেজে গিয়েছিল সেবার।

আজ সাত বছর পর আবার দেখা হল যশবন্তের সঙ্গে। ওর অনেক গল্প করেছি বন্ধুদের কাছে, তাদের সঙ্গেও পরিচয় করালাম। বন্ধুদের কাছে তো সিমলা, মানালি,সোলাং-এরও অনেক গল্প করেছিলাম। এক সিমলা ম্যাল আর যশবন্ত ছাড়া পুরোনো সবাই হতাশ করেছে এবার। যশবন্ত আমাদের সবাইকে চা খাইয়ে আতিথেয়তা করল (আসলে আরও কিছু খাওয়াতে চাইছিল, কিন্তু চা ছাড়া আর কিছু ভালো লাগছিল না)। চা খেতে খেতে গল্পে গল্পে যশবন্তের হালচাল জিজ্ঞেস করতেই করুন ছবিটা আরো পরিষ্কার হল। আর কিছুদিনের মধ্যেই এই গাড়ি চালানো ছেড়ে দেবে। নিজের বাড়ি মান্ডিতে ফিরে যাবে। ট্রাভেল এজেন্সি খুলবে ভাইয়ের সঙ্গে। এখন ইনকামের আর সিওরিটি নেই। আজ ডেট পাওয়া গেল, আবার কতদিন পর বুকিং পাওয়া যাবে কোনও ঠিক নেই। বুঝলাম, কিন্তু যশবন্তের মত ড্রাইভাররা কমে গেলে শুধু স'বাবুতে ভরে যাবে তো! সেই আশঙ্কায় বলে ফেললাম, "থোড়া অ্যাডজাস্ট করকে কুছ নেহি হো সক্‌তা? মাহল বদল ভি সক্‌তা হ্যায়!" যশবন্ত সুলভ হাসি ঠোঁটে রেখে বলল, "অর অ্যাডজাস্ট নেহি হো পাতা, দাদা!"

(ক্রমশ)

হিমাচলের তথ্য ~ হিমাচলের আরও ছবি

কাঞ্চন সেনগুপ্তের ছেলেবেলা কেটেছে ইস্পাতনগরী দুর্গাপুরে। কর্মসূত্রে কলকাতায়। ২০০০ সাল থেকে বেসরকারি কনস্ট্রাকশন ফার্ম সিমপ্লেক্সের সঙ্গে যুক্ত। ভালো লাগে লেখালেখি, ছবি তোলা, বেড়ানো। আবার কখনোবা সময় কেটে যায় ছবি আঁকা বা টুকিটাকি হাতের কাজে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher