মিজোরামে নতুন বছর

সুবীর কুমার রায়


~ মিজোরামের আরও ছবি ~

পূর্বপ্রকাশিতের পর -

গাছপালা দিয়ে ঘেরা ট্যুরিস্ট লজটি মুখোমুখি দুটি ভাগে বিভক্ত। ডানদিকে লতাপাতা দিয়ে সাজানো সুন্দর দোতলা পাকা বাড়ি, আর বাঁদিকে শক্তপোক্ত প্লাই ও কাঠের তৈরি কয়েকটা কটেজ। কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কোথায় থাকতে চাই, ট্যুরিস্ট লজের মূল বাড়িতে না কটেজে। কটেজগুলোর ভাড়া সামান্য বেশি, কিন্তু দেখে আমাদের এত ভালো লাগল যে, মূল বাড়ির ঘরগুলো আর দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধও করলাম না। গাছপালা দিয়ে সাজানো তিনটে কটেজ নিয়ে নিলাম। মূল বাড়িতে রিসেপশন ও ডাইনিং। রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে যে যার কটেজে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে নিলাম। মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত, কিন্তু তবু তরুণের কটেজটায় গিয়ে সোফা, চেয়ার ও খাটে গুছিয়ে বসে বেশ কিছুক্ষণ গুলতানি করা হল, ছবি তোলা হল। আগামীকালের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করা হল। কাল সকালে সেই মায়ানমার বা বার্মার বর্ডার পেরিয়ে আমাদের হার্ট লেক দেখতে যাওয়ার কথা। যদিও আইজলের চাল্টলাঙ্গ-এ আলাপ হওয়া সেই অফিসারের কথা মতো, তাঁর সাহায্য ছাড়া ওই দেশে ঢোকা সাধারণ মানুষদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমাদের দেশে এটাই সবথেকে বড় অসুবিধা। দেড়শ কোটি ছুঁতে যাওয়া জনসংখ্যার, কয়েক হাজার, বেশ সংখ্যাটা নাহয় কয়েক লাখই হল, ভি.আই.পি. বা ভি.ভি.আই.পি.। এরাই একমাত্র দেশকে ভালোবাসে, বাকী সব অবিশ্বাসী চোর, ছ্যাঁচড়, জোচ্চোরের দল। আর যাই হোক এদের বিশ্বাস করা যায় না, উচিৎও নয়। ফলে যতকিছু সুযোগ সুবিধা ওইসব নেপোদের জন্য। বৃদ্ধ হোক, অসুস্থ হোক, বা পঙ্গু হোক, সাধারণ মানুষকে যেখানে কষ্ট করে হেঁটে যেতে হয়, ওনারা হেলিকপ্টার বা কোন বিশেষ ব্যবস্থায় যাতায়াত করেন। শুধু তাই নয় ওনাদের যাতায়াতের সময় সাধারণ মানুষ হেঁটে যাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়।

উল্টো দিকের দোতলা বাড়িতে খেতে গেলাম। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও, কিমা সাহেবকে কোথাও দেখলাম না। খাবার টেবিলে বসে খবর পেলাম কিমাবাবু খেয়ে নিয়েছেন। ওকে দোষ দেওয়াও যায় না, কারণ এখানে আমাদের মত এত রাত করে কেউ খায়ও না, জেগে বসেও থাকে না। অতি সাধারণ খাবার, কিন্তু সারাদিনের কেক-বিস্কুটের অত্যাচারে ও জায়গার গুণে, খেতে মন্দ লাগল না। খেয়ে উঠে দেখলাম ক্যান্টিনের পাশেই রান্নাঘরের একপাশে আগুন জ্বেলে কর্মচারীরা কাঠের আগুন ঘিরে বসে জল গরম করছে। ঠান্ডা আছে, তবে আগুন ঘিরে বসে থাকার মতো বলেতো আমার মনে হল না। ওরা আমাদের জিজ্ঞাসা করল ঘরে নিয়ে যাবার খাবার জলের সঙ্গে গরম জল মিশিয়ে দেবে কী না। মেয়েদের ইচ্ছামতো গরম জল মিশিয়ে খাবার জল নিয়ে যে যার ডেরায় ঢুকে যাবার সময় লক্ষ্য করলাম, অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এখন শুধু কিমাবাবু নয়, গাড়িটাও নেই।

সকালবেলাও কিমা এবং তার গাড়ির দেখা মিলল না। উনি এলেন অনেক পরে। জানা গেল ও অন্য কোথায় রাতে ছিল। সর্বত্র দেখেছি গাড়ির ড্রাইভারদের থাকার ব্যবস্থা হোটেল বা লজেই থাকে। এখানে এত বড় বাড়ি, এত জায়গা থাকতে ও গাড়ি নিয়ে অত রাতে কোথায় গিয়েছিল, কেনই বা গিয়েছিল বোঝা গেল না। আমরা হার্ট লেকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। লেকটির গঠন নাকি হার্ট বা হৃদয়াকৃতির, তাই হার্ট লেক নামে পরিচিত হলেও, আসলে লেকটির নাম কিন্তু রিহ ডিল (RIH DIL) - এক কিলোমিটার লম্বা ও সত্তর মিটার চওড়া। এখান থেকে প্রায় সাতাশ কিলোমিটার দূরে ZOKHAWTHAR ভারত-বার্মা বর্ডার। বর্ডার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে লেকটি অবস্থিত। বেশ কিছুটা পথ গিয়ে, কিমা তার গত রাতের রাত্রিবাসের আলয়টি দেখাল।
দূরত্ব বেশি নয়, আমাদের গাড়ি একসময় ভারত-মায়ানমার(বার্মা) বর্ডার গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। এখানে উল্লেখ করার মতো দুটি ঘটনা হল, বর্ডার পারের অধিকারটি একমাত্র আইজলের চাল্টলাঙ্গ গেস্টহাউসের সেই নামী বাঙালি অফিসারটি বা তাঁর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়, এবং এই প্রত্যন্ত মিজো এলাকাতেও পোলিও বুথ আছে। গেটের বাঁপাশে ইমিগ্রেশন অফিস, আমাদের গাড়ি ইমিগ্রেশন অফিসের পাশে দাঁড়ালে, গাড়ি থেকে নেমে তরুণ সেখানে পরিচিতিপত্র দেখানোর সাথেসাথেই ওপারে যাওয়ার অনুমতি মিলল। মিজোরামবাসীদের জন্য বোধহয় এই ব্যাপারে তেমন কড়াকড়িও নেই। জানা গেল এই পথ দিয়ে দুইদেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানিও প্রচুর হয়। ইমিগ্রেশন অফিসের একটি বোর্ডে ইংরেজিতে "Except illegal goods, all goods can be imported freely" (যদিও দ্বিতীয় goods টিতে good লেখা আছে) এবং মিজো ভাষায় "Sorkar khap tel to bungrua reng reng chu zalen takin luhphalan" লেখা আছে। গাড়ি থেকে নেমে আমাদের দেশের সীমানায় কিছুক্ষণ ঘুরে পায়ে হেঁটে একটা ব্রীজ পার হয়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখলাম। পিছন পিছন আমাদের গাড়িও এসে হাজির। এখানে একটা খুব বড় না হলেও, ভালোই বাজার আছে। সেখানে কী না পাওয়া যায়। বাজারটা একটু ঘুরে দেখে গাড়িতে উঠে বসলাম। আগের মতোই গাড়ি এগিয়ে চলল, শুধু পার্থক্য একটাই, এ দেশের নিয়ম অনুযায়ী গাড়ি রাস্তার ডানদিক দিয়ে চলছে।
রাস্তা যদিও খুবই খারাপ, তবে অল্পই রাস্তা। আমরা হার্ট লেক বা রিহডিল লেকের ধারে এসে পৌঁছলাম। একে মিজোরাম রাজ্যের সবথেকে বড় ও পবিত্র হার্ট লেক বলে বলা হয়ে থাকলেও, লেকটি মায়ানমারে অবস্থিত। মিজোরামের মানুষদের টামডিলে ছুটির দিনে ভিড় করে বনভোজন করতে যেতে দেখলেও, যেমন আমরা দিঘা, টাকি, ফুলেশ্বর, গাদিয়ারা, ইত্যাদি জায়গায় গিয়ে থাকি, আকৃতি বা সৌন্দর্যে প্রায় সমতুল্য হলেও পবিত্রতার ধারে কাছেও টামডিল স্থান পায় না।

হার্ট লেকে কিন্তু দর্শনার্থীর সংখ্যা অতি নগণ্য। সুরাপান নিয়ে কেলেঙ্কারি হলেও, এই রাজ্যে সুরাপান নিষিদ্ধ। কিন্তু নির্জন হার্ট লেকের পাশে গুটিদুই-তিন দোকান থাকলেও, সেখানে লজেন্স, বিস্কুট, সাবান, বাচ্চাদের খেলনার পাশাপাশি পরোটা, চাউ ও ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির দেশি ও বিদেশি (মায়ানমার-এ প্রস্তুত) সুরা বিক্রয় হয়। এখানে সুরা, পান বা বিক্রয় কোনটাই নিষিদ্ধ নয়, তবে ভারতীয় সুরার মূল্য অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা এখানে মোটর সাইকেল নিয়ে শুধুমাত্র সুরাপান করতেই আসে বলে মনে হল। জনবসতিহীন এই জায়গায় খাবারের দামও অত্যন্ত বেশি। যতদূর জানা যায়, মিজো উপজাতিদের পূর্বপুরুষরা কোন সময় এই বার্মা দেশ থেকে এসেই এখানে, অর্থাৎ বর্তমানের মিজোরামে বসবাস শুরু করে। তাই হয়তো মিজোরামের মানুষদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এই লেক-এ এসে আশ্রয় নেয়। মনে হয় শুধুমাত্র এই বিশ্বাসকে সম্মান দিতেই এই অঞ্চলে যাতায়াতের ওপর কোন বাধানিষেধ নেই। কেবলমাত্র গেট পার হয়ে ওদের দেশে প্রবেশ করে, রাস্তার ডানদিক দিয়ে গাড়ি চালালেই ওরা খুশি। অনেকভাবে চেষ্টা করেও, লেকটির সাথে হৃদয়ের সাদৃশ্য খুঁজে বার করতে পারলাম না। বেলা হয়ে যাচ্ছে, এবার ফেরার পালা। সূর্যদেব 'হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে' বলে এদেশের পাট চুকিয়ে অন্যত্র চলেছেন।
ফেরার পথে আগের মতোই বর্ডার গেটের কাছে গাড়ি থেকে নামা হল। দোকানগুলো থেকে মেয়েরা তাদের প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ব্রীজ পার হয়ে ফিরে আসার সময় মাঝ পথে একটি শববাহী দলকে হার্ট লেক উদ্দেশ্যে যেতে দেখলাম। ওদের সঙ্গে গিয়ে সৎকার অনুষ্ঠানটি দেখার ইচ্ছা থাকলেও, সময়াভাবে বাস্তবে সম্ভব হল না। জায়গাটা খুব নির্জন, শান্ত, সুন্দর ও দূষণমুক্ত। মৃত্যুর পরে ওখানে থাকার জন্য কোন অনুমতি লাগে কিনা, অথবা অগ্রিম বুকিং এর ব্যবস্থা আছে কিনা জানি না, তবে আমি ওখানেই চলে যাব স্থির করে ফেললাম। খাওয়ার খরচ একটু বেশি হলেও, থাকার খরচ নেই। আর কারও ইচ্ছা হলে জায়গাটা দেখে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই পারেন। অন্তত বাংলা ভাষায় সুখ-দুঃখের কথা বলে সময় কাটবে।

একসময় চামফাই গেস্টহাউসে এসে চায়ের খোঁজ করে, টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা হল। টেবিলে চা দিতে এসে ছেলেটি আমাদের একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলল। তার বলার ধরণ দেখে মনে হল, এখনই রাতের খাবার খেয়ে নিলে সে আরও খুশি হবে। চা খেয়ে ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, জমিয়ে বসে গুলতানি শুরু হল।
অনুরোধমত আজ বেশ তাড়াতাড়িই ডাইনিং হলে হাজির হলাম। তাছাড়া আজ সারাদিন সেই শুকনো খাবার ও লেকের ধারে দুর্মূল্য চাউ খানিকটা করে ভাগ করে খেয়ে কেটেছে। যদিও সেই চাউয়ের সিংহভাগই, কিমা চন্দ্রের উদরে স্থান পেয়েছে। তা যাক্, ছেলেটা ভালো এবং একটু খেতে, বলা ভালো বেশি খেতে বেশি ভালোবাসে। তবু সে-ই তো আমাদের সবকিছু দু'চোখ ভরে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আর আমাদের মতো পর্যটক বা কেউ ওর গাড়িতে ভ্রমণ করলে তবেই ওর ভাগ্যে এইজাতীয় খাবার জোটে, সে আর মাসে ক'টাই বা দিন।
ডাইনিং হলে টাঙানো বিরাট ম্যাপটা দেখে আগামীকালের থেনজল যাবার রাস্তা সম্বন্ধে একটা ধারণা করার চেষ্টা করছি, গাড়ি নিয়ে তিনজন এসে উপস্থিত হলেন। তাঁদের হাবভাব চেহারাই বলে দিচ্ছে, তাঁরা খুব সাধারণ লোক নন। আলাপ করলাম, আমরা মিজোরামে বেড়াতে এসেছি শুনে, তাঁরা প্রথমেই বিস্মিত হলেন। কথায় বোঝা গেল তাঁরা দেশের সিকিউরিটি সংক্রান্ত কোন বিভাগে কাজ করেন। অনেক রকম কথা হল। জানালেন, মিজোরামে, বিশেষ করে এই জাতীয় জায়গায় কোন চুরির ঘটনা ঘটে না। আমরা ঘরের দরজা খুলে রাতে ঘুমালেও, চুরি হবার কোন সম্ভাবনা নেই। একবার কোন ম্যাজিস্ট্রেটের মানিব্যাগ এই অঞ্চলের কোথাও পড়ে গিয়েছিল। তিনি এই গেস্টহাউসে আদৌ আসেননি, কিন্তু দরকারি কাগজপত্র, ক্রেডিট কার্ডসমেত ব্যাগ এই গেস্টহাউসের দরজার কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। অবশ্য কিছু টাকা বার করে নেওয়া হয়েছিল। আসলে খুবই গরীব অঞ্চল, অভাবের তাড়নায় হয়তো কিছু নিয়েছিল, তাই চুপিসারে এখানে রেখে গেছে, যাতে মালিককে সহজে ব্যাগটি ফেরৎ দেওয়া যায়। আমরা এখান থেকে থেনজল যাব শুনে তাঁরা আমাদের কোন দিক দিয়ে গেলে সুবিধা হবে ও পথে কী কী দেখার জিনিস পড়বে কিমাকে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন। আমি রাজনীতি করি না, পছন্দও করি না, হয়তো ঘৃণা করি বললেই ঠিক বলা হবে। যে মিজোরামের শাসন ব্যবস্থা, নিয়মিত গোলমাল, ইত্যাদি শুনে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হই, সেই মিজোরামের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আমাদের রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের বক্তব্য ও আমাদের রাজ্যের মানুষ কী করে সহ্য করে শুনে, এবং সর্বোপরি এ রাজ্যের মানুষের কী করা উচিৎ শুনে মনে হল, আমরা কী আমাদের নিজ রাজ্যে সত্যিই ভালো আছি, নির্ভয়ে আছি, ন্যায় বিচার ও সুশাসনে আছি? এঁদের কাছে আবার নতুন করে শুনলাম যে, চামফাই হচ্ছে মিজোরামের বৃহত্তম সমতলভূমির এলাকা।
খাবার দিয়ে গেল। নিজেরাই পাত্র থেকে খাবার নিয়ে খেয়ে, রাতের জন্য খাবার জল নিতে রান্নার জায়গায় গিয়ে দেখি একটা লোকও নেই। বাধ্য হয়ে নিজেরাই ভিতরে ঢুকে জল ভরে নিয়ে যে যার ঘরে গেলাম।
পরদিন সকালে উঠে জায়গাটা এক চক্কর ঘুরে দেখে, চা জলখাবার খেয়ে, গেস্টহাউসের বিল মিটিয়ে, গাড়ি নিয়ে থেনজল চললাম। বিদায় চামফাই, চিরকালের মতো বিদায়।

থেনজল নিয়ে মনের মধ্যে একটা চিন্তার জট প্রথম দিন থেকে রয়েই গেছে, কারণ আমাদের মধ্যে কথোপকথনটা কখনই দ্বিপাক্ষিক হওয়ার সুযোগ পায় নি। যাত্রা শুরুর আগে থেকে এখন পর্যন্ত কতবার যে ফোন করে কবে থেকে কবে, কোথায়, কত দিন, ক'টা ঘর, লোক সংখ্যা কত, বলতে গেলে ঠিকুজি কোষ্ঠী পর্যন্ত জানিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্ত প্রতিবার ওই একই মহিলা কন্ঠে একই উত্তর 'হ'। শেষে অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যে আমি ফোন করলেই সঙ্গীরা ঠাট্টা করে বলতো, "সুবীরদা ভদ্রমহিলার প্রেমে পড়েছে, তাই বারবার ফোনে প্রেমালাপ করছে। ব্যাপারটা সত্যিই প্রায় সেরকমই দাঁড়িয়েছে। কলকাতা থেকে, বাড়ি থেকে, আইজল থেকে, রেইক থেকে, এমন কী গত পরশু চামফাই থেকেও ফোনে কাটা রেকর্ড শুনিয়েছি, উত্তরও সেই এক 'হ', শুধু রেইক থেকে ফোন করলে, একটা কিনলে একটা ফ্রী-এর মতো সঙ্গে একটা ওয়েলকাম শব্দ যোগ হয়েছে মাত্র।
চামফাই থেকে থেনজলের দূরত্ব কত মনে করতে পারছি না, তাছাড়া কিমার কথায়, বা স্থানীয় কোন মাইলস্টোন থেকে সে তথ্য উদ্ধার করাও ভীষণ শক্ত। চাল্টলাঙ্গ বা চামফাই গেস্টহাউস থেকে সংগৃহীত তথ্যের মধ্যে কোন মিল নেই। স্থানীয় লোক বা দোকানদারদের মত আবার এদের থেকে আলাদা। ত্রিশ কিলোমিটারও হতে পারে, দু'শ ত্রিশ কিলোমিটারও হতে পারে - এরকম একটা অবস্থা। তার ওপর চামফাই গেস্টহাউসে ওই ভদ্রলোক অন্যপথে থেনজল যাবার কথা কিমাকে বলে দিয়েছেন, যাতে আমরা পথে দু'-একটা নতুন স্পট দেখার সুযোগ পাই। কিমা ভদ্রলোকের কথা অনুযায়ী রুটের সম্ভবত কিছু পরিবর্তন করে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কানু বিনা গীত নাই এর মত আমাদের কাছে এখন কিমা বিনা গতি নাই অবস্থা। যাহোক সে একটা জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জানাল যে, এটা একটা ভীষণ পবিত্র জায়গা। এই জায়গাটা আগে কেউ জানতোও না, কিন্তু দুর্গম এই জায়গায় সমস্ত কষ্ট উপেক্ষা করে কোন এক গরু একটি শাবক প্রসব করে। তারপরেও এই গল্পের অনেক পর্ব আছে। কিন্তু যে জায়গায় কেউ আগে কখনও আসেনি বা বসবাস করেনি, সেখানে গরু কোথা থেকে এসে হাজির হল, এবং মোটামুটি সমতল জায়গা ছেড়ে, যেখানে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি, অত কষ্ট করে দুর্গম চড়াই ভেঙে সন্তান প্রসবের জন্য অত উপরে উঠলই বা কেন কে জবাব দেবে? এক যদি মেজদাকে খুঁচিয়ে জানা যায়।

বেচারা কিমা আমাদের এ হেন তীর্থক্ষেত্র দেখাবে বলে রাস্তা পরিবর্তন করে এতদুর নিয়ে এসেছে, কাজেই কথা না বাড়িয়ে সপারিষদে গোশাবকের জন্মস্থান সন্দর্শনে চললাম। এবড়ো-খেবড়ো জঙ্গলের চড়াই ভেঙে বেশ কিছুটা পথ গিয়ে এক কাঁটা তারের বেড়া পড়ল। একটা নয়, ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত তিন-তিনটে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। অনেক চেষ্টা করেও মেয়েরা সেই তারের বেড়া গলে যাওয়ার চেষ্টায় বিফল হয়ে, আমাদের অযোগ্য স্বামী বিবেচিত করে, মার্চপাস্ট করতে করতে ফিরে গেল। আমরা তিনজন কাঁটাতার গলে, জামা ছিঁড়ে, আরও বেশ খানিকটা পথ চড়াই ভেঙ্গে, দ্রষ্টব্যস্থলে পৌঁছলাম। পাহাড়ি পথে একটু সমতল চাতাল মতো এলাকা, সেখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। SERCHHIP জেলার অন্তর্গত থেনজল শহরটি গভীর জঙ্গল ও বন্য পশু অধ্যুষিত এলাকা ছিল। ১৯৬১ সালের পর থেনজলকে মনুষ্য বাসযোগ্য করা হয়। গোটা থেনজলের লোক সংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার পাঁচশ' মতো। এই গোশাবকটির জন্মের সময় সেটা অনেক কম ছিল, এবং আজও এই জায়গাটি মনুষ্যবিহীন, তাহলে ঐ অসুস্থ গরুটির আব্রু রক্ষার্থে কেন অত কষ্ট করে ওপরে যেতে হয়েছিল, জানা গেল না। কাঁটাতারের বেড়াও সেই গরুই দিয়েছিল কী না, কিমাকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা থাকলেও করা গেল না।
নীচে নেমে এসে আর একপ্রস্থ মুখঝামটা ও হাসির খোরাক হলাম। তোমার কর্ম তুমি কর কিমা, লোকে বলে করি আমি। একটু সময় কাটিয়ে, টুকটাক কিছু মুখে পুরে এগিয়ে গেলাম। একটু দূরেই নতুন স্পট। চামফাইয়ের ভদ্রলোকের কথামতো কিমা গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের দেখে আসতে বলল। এইসব জায়গাগুলোর নাম হয়তো ভূগোলে নেই, কিমা জানবে কোথা থেকে। একটা মানুষ চোখে পড়ল না যে জিজ্ঞাসা করব। কোথাও কিছু লেখাও নেই, থাকলেও সেটা পালিভাষাসম দুর্বোধ্য। এখানে একই জায়গায় পরপর প্রচুর বিখ্যাত মিজো মানুষের সমাধিস্থল। এতো নির্জন জায়গায় সমাধিস্থ করার কারণ বোধগম্য হল না। হয়তো হার্ট লেকের মতো এখানেও কিছু উপাখ্যান আছে, কিন্তু জানার সুযোগ হল না। কিন্তু এটা খুব একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নয়। যেটা উল্লেখ করার বিষয় সেটা হল, অধিকাংশ ফলকেই জন্মসাল উল্লেখ করা থাকলেও, মৃত্যুর বছরটির জায়গা ফাঁকা রাখা আছে। মৃত্যুর পূর্বেই ফলক তৈরি করে রাখা হয় কী না বলতে পারব না। কোন একজন মানুষের জন্মসাল নাও জানা থাকতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর সাল না জানার কোন কারণ থাকতে পারে? তবে কি তাঁরা এখনও জীবিত? আমাদের এখানে জমি কিনে পাঁচিল দিয়ে রাখার মতো মৃত্যুর আগেই সমাধি তৈরি করে জমি দখল করে রাখা হয়েছে? মৃত্যুর পর নির্দিষ্ট সমাধিস্থল খুঁড়ে সমাধিস্থ করা হবে? উত্তর জানা নেই। সত্যি এদেশে কত কিছুই না জানা আছে, আমরা সে সব ছেড়ে বারমুডা ট্রাঙ্গেল নিয়ে পড়ে আছি।

গাড়ি আবার এগিয়ে চলল, আবার নতুন দ্রষ্টব্যস্থল। এটার নামও সঠিক জানা গেল না। জানা গেল না, কারণ অনেকটাই প্রায় আগের সেই একই অসুবিধা। তবে কিমা জানাল, এটা লাভার্স পয়েন্ট। সুইসাইডাল পয়েন্ট নাম বললেও আশ্চর্য হতাম না। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় একটি ঝুলন্ত বারান্দার মতো জায়গা আছে। তার একবারে কিনারায় বসে এক ব্যর্থ প্রেমিক তার অন্য পাহাড়ের চূড়ার প্রেমিকার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। এখানে কিছু দোকানপাট আছে। সেখানকার লোকজনেরা ওই প্রেমিকের বসার ভঙ্গীতে ওখানে গিয়ে বসে। প্রতিবার ওই একই ভঙ্গীতে প্রেমিকটি কেন বসত, বা ওই নির্দিষ্ট ভঙ্গী তারা জানলই বা কিভাবে, জিজ্ঞাসা করে আমাকে বিব্রত না করলেই খুশি হব। ভাবা যায়? এর কাছে স্বয়ং শাহজাহানের মুমতাজের প্রতি প্রেমও ম্লান হয়ে যায়। আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই স্ত্রীরা আছে, তাই নিষ্ফল জেনেও, ওই জায়গায় গিয়ে একটু বসলাম। কিমা জানালো থেনজল গেস্টহাউসের আগে আর কিছু দেখার নেই। আসার পথে যে তিনটি জায়গা দেখা হল, তা দেখে হয়তো কারও পছন্দ হল না বা হবে না, আমার কিন্তু মন্দ লাগল না। যে কোন নতুন জায়গা আমার সমান আগ্রহ নিয়ে দেখার অভ্যাস।
আমাদের গাড়ি থেনজল গেস্টহাউসের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল। অনেক্ষণ থেকেই মনটা চা-চা করছিল। অবশেষে বিখ্যাত 'সাংসাং হোটেল কাম টি স্টল' এ চা খেতে যাওয়া হল। এখানে CHAW, CHAU, CHHANG, THINGPUI, CHANA, ARTUI, BAWNGHNUTE, কী না পাওয়া যায়। দোহাই আপনাদের, দয়া করে জানতে চাইবেন না খাদ্যবস্তুগুলি কী। জানলে আমরাই তো খেতে পারতাম। চা খেয়ে গাড়িতে উঠলাম। আরও বেশ কিছুক্ষণের পথ পাড়ি দিয়ে এসে, গাড়ি দাঁড় করানো হল। জায়গাটা মোটামুটি বেশ বড়ই। একটা দোকানের, পেট্রল পাম্প বললেও বলা যেতে পারে, বোর্ডে দেখলাম 'KHAWBUNG' লেখা। সম্ভবত জায়গাটার নাম। এখানে কিছু খেয়ে নিয়ে একটু ঘুরে ফিরে জায়গাটা দেখলাম।
এখানকার ভাষা সমস্যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এদের নিজেদের ভাষাটা সম্ভবত মিজো, কিন্তু এদের কোন বর্ণমালা ছিল না। ব্রিটিশ মিশনারিদের কল্যাণে মিজোবাসী লিখবার সুযোগ পায়। যদিও স্ক্রিপ্টটির লিখিত বর্ণের মধ্যে অনেকগুলোই আবার ইংরেজি বর্ণমালায় নেই। তাই এইসব লেখা পড়ে তার পাঠোদ্ধার করা আমাদের কর্ম নয়। যাইহোক জায়গাটা বড়, এরপর অনেক্ষণের পথ, তাই মেয়েরা টয়লেটের খোঁজ শুরু করল। পাওয়াও গেল। আমাদের এখানকার মতো খানিকটা ঘেরা জায়গা মাঝখান দিয়ে পাঁচিল তুলে দু'ভাগ করা। একদিকে পুরুষদের, আর অপরদিকে মহিলাদের জন্য। কিন্তু এত সুব্যবস্থার মধ্যেও বাধা সেই ভাষা। টয়লেটের বাঁদিকে MIPA আর ডানদিকে HMEICHHIA লেখা, অর্থাৎ একটা পুরুষ ও অপরটা মহিলা বুঝেও টস্ করে কোনটা মহিলা কোনটা পুরুষ ঠিক করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শেষে স্থানীয় লোকের সাহায্যে আলোকিত হয়ে, মেয়েরা একে একে টয়লেট ঘুরে এল। এবার এগোতে হয়। বেলাও ক্রমশঃ বাড়ছে। ওখানকার এক অফিসকর্মী সোজা না গিয়ে, ডানপাশের বাইপাস ধরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, তাতে নাকি রাস্তা অনেকটাই কম হবে। ভদ্রলোক অন্য রাজ্যের বাসিন্দা, কর্মসূত্রে এখানে এসে মেসে থাকেন। অবস্থা দেখে কষ্ট হল। এর নাম চাকরি। ভদ্রলোক কিমাকে রাস্তাটা বুঝিয়ে দিলেন। আরও দু'একজন স্থানীয় মানুষও কিমাকে বুঝিয়ে দিল। আমরা সোজা না গিয়ে ডান দিকের সরু, অসমান, অপেক্ষাকৃত ভাঙা রাস্তা ধরলাম।

বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর একটা সবুজ চাষের জমির কাছে রাস্তাটা দু'ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকেরটা অপেক্ষাকৃত চওড়া। কিমা গাড়ি থেকে নেমে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল, কারণ একটা লোকেরও দেখা পাওয়া গেল না। শেষে বাঁদিকের রাস্তাটা হওয়ার সম্ভবনা বেশি মনে করে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চললো। মেঠো রাস্তাটা ঘুরপাক খেয়ে ক্রমশঃ নীচের দিকে নেমে চাষের জমিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখানে দু'তিনটে ভাঙা, পরিত্যক্ত মোটর গাড়ি একপাশে পড়ে আছে। কোথাও কারও দেখা মিলল না। এখানে কে ভাঙা গাড়ি রাখতে আসবে ভেবে পেলাম না। তবে কি আমাদের মতোই পথ হারিয়ে এখানে এসে আজ এই অবস্থা? আমাদের গাড়িও ভবিষ্যতে এর পাশেই স্থান পাবে কিনা ভাবছি, বহু কসরত করে কিমা গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল।
আবার সেই তিন মাথার মোড়ে এসে যেদিক থেকে এসেছিলাম, সেই ডানদিকের চওড়া পথে না গিয়ে সোজা সরু রাস্তা ধরলাম। এ রাস্তাটা অনেকটা এরাজ্যের গ্রাম্য মাটির রাস্তা, তবে সুবিধা একটাই, এঁটেল মাটির পথ নয়। যত সামনের দিকে এগচ্ছি, রাস্তা তত সরু হতে হতে প্রায় কোনমতে একটা গাড়ি যাবার মতো চওড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার বাঁদিকটা ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ পাঁচিলের মতো খানিকটা উঁচু পাথর, আর ডানদিকে সরু কঞ্চির মতো আকৃতির বাঁশ গাছের জঙ্গল, ধীরে ধীরে অনেকটা নীচে সমতল ভূমিতে নেমে গেছে। রাস্তার অনেক জায়গাতেই জল জমে কাদা কাদা হয়ে আছে। কতটা রাস্তা এরকম কে জানে, চিন্তা হচ্ছে উল্টো দিক থেকে কোন গাড়ি এসে হাজির হলে কী হবে। আলোর তেজ বেশ কমে এসেছে। আলো আঁধারি এই জঙ্গলে ঘেরা নির্জন রাস্তা যেন আর শেষই হতে চায়না। কিমার পাশে বসে নানারকম উদ্ভট সব চিন্তা শুরু হলো। এতক্ষণেও উল্টো দিক থেকে কোন গাড়ি আসতে দেখলাম না। ভিজে রাস্তায় গাড়ির চাকার দাগও আছে, তবু আমরা ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো? কিমা আবার এ রাস্তায় কোনদিন আসেও নি। রাস্তায় কেউ গাড়ি দাঁড় করালে কী করব? এরকম নির্জন জায়গায় জঙ্গীদের কবলে পড়ব না তো? কোন কারণে গাড়ি খারাপ হলেই বা কী করব? মেয়েদের দেখছি হাসি-ঠাট্টা বন্ধ হয়ে গেছে। গাড়ির সামনে বসে রাস্তার কিছু ছবি তুলছিলাম, থমথমে পরিবেশ সেটা বন্ধ করতে বাধ্য করল। এইভাবে আরও বেশ কিছুক্ষণ রূদ্ধশ্বাসে কাটার পর, বড় রাস্তায় উঠে এলাম। তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। কিমা জানাল সত্যিই অনেকটা রাস্তা শর্টকাট হয়েছে। গাড়ির ভিতর বর্ষা কেটে গিয়ে শরৎ, হেমন্ত, শীত টপকে একবারে বসন্তের আগমন লক্ষ্য করলাম।

এবার গাড়ি তীরবেগে ছুটল। কিমা জানাল আর ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে। গাড়ির ভিতর আবার হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। শরীরে কিছু ক্লান্তি অবশ্যই এসেছে, তবে আজকের মত নিরাপদ আরামদায়ক আশ্রয়ে প্রায় পৌঁছে গেছি জেনে সবাই খুশি। এমন সময় আমার মোবাইলে এই প্রথম থেনজলের গেস্টহাউস থেকে ফোন— 'আপনাদের আজ আসার কথা, আপনারা কি আজ আসছেন?' সঙ্গীরা ঠাট্টা শুরু করে দিল, "সবাই চুপ কর সুবীরদার প্রেমিকা ফোন করেছে।" আমি জানালাম আমরা রাস্তায় আছি, আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাব। অনেকক্ষণ সময় পার হয়ে যাবার পর আমরা একটা ছোট গঞ্জমত জায়গায় নেমে চায়ের দোকানে ঢুকলাম। মেয়েরা কেউ গাড়ি থেকে নামল না। চা খাচ্ছি, এমন সময় আবার ফোন, আসতে আর কতক্ষণ লাগবে? জানালাম আধঘন্টা মত। গাড়ি ছেড়ে দিল। রাত প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা থেনজল গেস্টহাউসের গেটে প্রবেশ করলাম। মেয়েরা গাড়িতেই বসে রইল, আমরা তিনজন এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকে দেখি দুজন যুবক বসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে ব্যস্ত। আমরা আমাদের আগমনের কারণ বলতে তাঁরা বললেন, বাইরে রিসেপশনে গিয়ে কথা বলতে। আমরা বাইরে আসতেই দুজন আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের কী প্রয়োজন। একজন যুবক ও আর একজন তার থেকে বয়সে কিছু বড়। আমাদের আজ এখানে তিনটি ঘর বুকিং আছে শুনে যুবকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি জানালেন আজতো এখানে কারও নামে ঘর বুকিং নেই, তাছাড়া কোন ঘর খালিও নেই। বাইরে রীতিমতো ঠান্ডা। তবু এই ঠান্ডাতেও ঘামতে শুরু করার মতো অবস্থা। তিনি আমাদের বুকিং-এর কাগজ দেখতে চাইলেন। আমরা জানালাম যে কলকাতা থেকে ফোনে আমাদের ঘর বুক করা আছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জায়গা থেকে এই ব্যাপারে ফোনে কথাও হয়েছে। এক ভদ্রমহিলা প্রতিবার আমায় ঘর বুকিং আছে বলে জানিয়েছেন। আজও আসার পথে উনি দুবার ফোন করেছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন "আপনার মোবাইলটা একবার দিন তো দেখি কোন নাম্বার থেকে আপনাকে ফোন করা হয়েছে। এই গেস্টহাউসে তো কোন ভদ্রমহিলা কাজ করেন না, আমিই তো এখানকার ম্যানেজার। আপনি বাংলায় কথা বলতে পারেন, আমি বাংলা বুঝি, বাঙালিও বলতে পারেন।"
আমার মোবাইল থেকে ফোন নাম্বার দেখে তিনি যা বললেন, তা শুনে তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। এই ফোন নাম্বারটা রেইক গেস্টহাউসের। যা বোঝা গেল, আমরা যে ভ্রমণ পত্রিকার মিজোরামের ওপর একটা লেখা থেকে ফোন নাম্বার জোগাড় করেছিলাম, লেখক সেখানে ভুল করে থেনজয়ালের ফোন নাম্বারটা রেইক-এর ফোন নাম্বার লিখেছিলেন। কিন্তু আমি ঐ নাম্বারে ফোন করার সময় কোনবারই থেনজল গেস্টহাউসের কথা উল্লেখ করতে ভুলিনি। ওখানে যে এস.এম.এস. করেছিলাম, তাতেও থেনজলের কথা উল্লেখ করে দিয়েছিলাম।
যুবকটি আমাদের বললেন, আপনারা আইজলে চলে যান, এখানে কোন ঘর খালি নেই যে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেব। আর একটা কোথাকার গেস্টহাউসের নাম করে বললেন, আপনারা এই গেস্টহাউসেও চলে যেতে পারেন, তবে এটা এখান থেকে অনেকটাই দূর।

জানুয়ারির প্রথম, খুব ঠান্ডার রাত, রাতও এই এলাকা অনুযায়ী অনেক হয়ে গেছে। বিপদের গুরুত্ব বুঝে এবার একটু রূঢ় হলাম। যুবকটিকে বললাম আইজল ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা এতটা পথ এত কষ্ট করে, পকেটের পয়সা খরচ করে আসিনি। ফোনটা নিয়ে ওই ভদ্রমহিলাকে সরাসরি গোটা ঘটনা জানিয়ে বললাম, এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। কিভাবে করবেন সেটা তাঁর ব্যাপার, তবে মেয়েদের নিয়ে এই শীতের রাত্রে আইজল ফিরে যেতে হলে, আমি তাঁর নামে রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী, প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও লিখিত অভিযোগ করব। আমার মোবাইলে এখনও প্রতিটা কলের ও এস.এম.এস. এর রেকর্ড আছে। ভদ্রমহিলা এবার তাঁর 'হ' ছেড়ে কী যেন বোঝাবার চেষ্টা করতেই, আমি ফোন কেটে দিলাম।

যুবকটিকে এবার বললাম যেভাবে পারেন কিছু একটা ব্যবস্থা করুন। যুবকটি উত্তরে বললেন এখানে কোন ঘর খালি নেই, একটা ভি.আই.পি. রুম খালি আছে বটে, তবে এখানে অনবরত ভি.আই.পি. দের আগমন হয়। বলা যায় না, যে কোন সময় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও এসে হাজির হতে পারেন। এরকম একটা সময় যুবকটির ফোন বেজে উঠলো। ও পক্ষের কথা শুনতে না পেলেও, যুবকটির কথা শুনে মনে হল আমাদের নিয়েই কথা হচ্ছে। ফোন ছেড়ে পুরনো প্রসঙ্গ তুলতেই তাঁকে বললাম, ওই ভি.আই.পি. রুমটাই আজ রাতের মতো দেবার ব্যবস্থা করুন। উনি এবার বললেন আর কিছু নয়, কাল সকালেই হয়তো কোন ভি.আই.পি. এসে হাজির হবেন, তখন আপনারা এবং আমি উভয়ই বিপদে পড়ব। এবার একটু রাগ দেখিয়েই বললাম কাল রবিবার, ছুটির দিন, কাল কেউ আসবেন না। তাছাড়া কাল সকালে আপনার মন্ত্রী আসার আগেই আমরা ঘর ছেড়ে দেব। যুবকটি আর কথা না বাড়িয়ে, সামনের একটি বাড়ির দোতলায় একটি ঘর দেখিয়ে বললেন এই ঘরটার জন্য হাজার টাকা লাগবে। ঘরটা বড়, একটা জানালার কাচ ফাটা, সেলোটেপ লাগানো। এ.সি. আছে, তবে চলে কী না বলা শক্ত, কারণ রিমোট নেই। কথা না বাড়িয়ে চারজন মহিলাকে সেই ঘরে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা কোথায় থাকব? যুবকটি খানিকটা দূরে অন্য একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, এটায় আপনারা থাকুন, ছশো টাকা ভাড়া লাগবে। রাজি হয়ে গেলাম, না হয়েও উপায় নেই। মালপত্র ঘরে তুলে, গেস্টহাউসের কাছাকাছি একটা চায়ের দোকান কাম হোটেলে খাবারের অর্ডার দিয়ে ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে খেতে গেলাম। গেস্টহাউসের বাইরে এটাই একমাত্র খাওয়ার জায়গা, এটা না থাকলে কী হত কে জানে। এখানেও শুয়োরের মাংসের অভাব নেই। কিমাকে দেখলাম ডেকচি থেকে একটা টুকরো তুলে মুখে ফেলল। আমরা চাপাটি, ডাল, একটা সবজি ও ডিম ভাজা, সঙ্গে গরম চা দিয়ে আহার সেরে, আমাদের ভি.আই.পি. মেয়েদের ভি.আই.পি. ঘরে পৌঁছে দিয়ে এলাম। সবার কাছেই মোবাইল আছে, প্রয়োজনে যোগাযোগ করে নেওয়া যাবে। আমরা আমাদের ঘরে চলে এলাম। এখানেও দেখলাম কিমার গাড়ি, গাড়ি রাখার জায়গায় নেই। দুর্যোগ কাটিয়ে দু'জনের শোওয়ার বিছানায় তিনজন শুতে গিয়ে দেখি আর এক বিপদ। থেনজলের উচ্চতা মোটামুটি পঁচিশ থেকে ছাব্বিশশো ফুটের মধ্যে হলেও, মাসটা জানুয়ারি, খুব ঠান্ডা। দুটো সরু সরু লেপ নিয়ে তিনজন শুলে, মাঝেরজনের নিউমোনিয়া কে আটকায়? সমস্যা, সমস্যা, আর সমস্যা, কোথাও এতটুকু শান্তি নেই। এতো দেখছি "যদি দেখি কোন পাজি বসে (পড়ুন শোয়) ঠিক মাঝামাঝি, কি যে করি ভেবে নাহি পাই রে— ভেবে দেখ একি দায়, কোন্ ল্যাজে মারি তায় (পড়ুন কোন লেপে ঢাকি তায়) দুটি বই ল্যাজ (পড়ুন দুটি বই লেপ) মোর নাইরে" গোছের সমস্যা! কিছু দূর অন্তর অন্তর সেফটিপিন লাগিয়ে, দুটো লেপকে একটায় পরিণত করে শুয়ে পড়লাম।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে, আবার উল্টো প্রক্রিয়ায় একটা লেপকে দুটোয় পরিণত করে বাইরে বেরলাম। ভি.আই.পি. রুমে গিয়ে দেখলাম মেয়েরা তৈরি হয়ে বসে আছে। একসাথে কালকের সেই দোকানে গিয়ে গরম গরম লুচি, আলু-মটরের তরকারি, ডিমসিদ্ধ আর চা খেয়ে গতকাল রাতের সব দুঃখ ভুলে গেলাম। অল্প কিছু পরে কিমা গাড়ি নিয়ে হাজির হল। জানা গেল তার ছেলে অসুস্থ। তার কথায় মনে হল সে বাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু সেটা বাস্তবে সম্ভবপর বলে মনে হল না। কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।

আজ রবিবার, মিজোরাম দেখলাম রবিবারটা সত্যিই ছুটির মেজাজে কাটায়। সকালে উঠেই আমরা চলে যাব জেনেও, গেস্টহাউসের কেউ টাকা নিতে হাজির হল না। কাউকে কোথাও দেখাও গেল না। কিমার খাওয়া শেষ হলে সমস্ত মালপত্র নিয়ে ভানতোয়াং জলপ্রপাত দেখতে চললাম।

এই জলপ্রপাতটি থেনজল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এবং এটি মিজোরাম রাজ্যের উচ্চতম জলপ্রপাত। প্রায় সাতশো পঞ্চাশ ফুট ওপর থেকে নেমে এসেছে। ভানতোয়াং জলপ্রপাত খুব একটা চওড়া নয়, বা ভীষণ বেগে ওপর থেকে জল নেমে আসছে, তাও নয়, তবু জলপ্রপাতটির একটি আলাদা সৌন্দর্য অবশ্যই আছে। সরু সরু কঞ্চির মতো বাঁশগাছের গভীর জঙ্গলে ঢাকা। বেশ খানিকটা দূরে, কিন্তু সরাসরি নীচে নেমে কাছে যাওয়া যায় না। ঠিক যেন অনেক ওপর থেকে কুয়োর মধ্যে জল পড়ছে। অন্য পথে যাওয়া যায়, সেখানে তৃতীয় বা চতুর্থ দফায় জল আছাড় খেয়ে পড়ে, একটা পুকুরের মতো সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আসা খুব কষ্টকর, ঝামেলাসাপেক্ষ ও বিপজ্জনকও বটে। মেয়েরা অনেকটা এসেও শেষপর্যন্ত জঙ্গল ও ভিজে এবড়োখেবড়ো পাথর ভেঙ্গে নামতে সাহস করল না। অথচ এখানে দেখলাম লোকে পিকনিক করতে আসে। কলাপাতা ও কাগজের তৈরি থালা বাটি ইতস্তত ছড়ানো। তবে জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর। গা ছমছমে নির্জন পরিবেশে জলের আছাড় খাওয়ার শব্দে একটা আলাদা মাধুর্য আছে।

এবার ফেরার পালা। সাবধানে জঙ্গল পেরিয়ে মাঝপথ থেকে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। আরও কিছু সময় কাটিয়ে গেস্টহাউস ফিরে চললাম। গেস্টহাউসে কাউকে দেখা গেল না। ভিজে গামছাগুলো শুকনোর জন্য মেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল, সেগুলো ব্যাগে পুরে, পুরনো চায়ের দোকানটায় চা খেতে ঢুকলাম। দোকানদার জানাল, আজ রবিবার ছুটির দিন, কেউ আসবে বলে মনে হয় না। আমার মনে হয়, কারও না আসার পিছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। হয় রেইকের সেই ভদ্রমহিলা ভয় পেয়ে এখানকার যুবকটিকে আমাদের একটা রাত থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলেন, যেটায় অফিসিয়ালি কোনও অসুবিধা ছিল। যুবকটি ষোলশ টাকা দাবি করলেও রসিদ দিতে পারবে না বলে পিছিয়ে গেছে। অথবা যুবক বা তার সহচর ছুটির দিনে কষ্ট করে গেস্টহাউসে আসে নি, বা আসতে ভুলে গেছে। এদের চাহিদা খুব কম, ফলে এরা একটু কুঁড়ে প্রকৃতির হয়।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আমরা আইজলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আইজল বাসস্ট্যান্ডে এসে জানা গেল, আজ কোন বাস শিলং-এর উদ্দেশ্যে যাবে না। রবিবার, ছুটির দিন, তাই বাসস্ট্যান্ড ফাঁকা। দূরপাল্লার বাস চলাচল প্রায় বন্ধ। আগামীকাল দুপুরে বাস পাওয়া যাবে। একটা বড় নীল রঙের বাস দেখলাম শিলং যাচ্ছে। ছুটি কাটিয়ে আইজলের বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী শিলং ও গৌহাটি ফিরবার জন্য বাসটা ঠিক করেছে। আজ না ফিরতে পারলে, আজ এবং আগামীকাল, দু-দু'টো দিন নষ্ট, তাই ড্রাইভার ও হেল্পারকে অনেক বুঝিয়ে ওই বাসেই যাওয়া পাকা করে নিলাম। মিজোরাম ভ্রমণ শেষে এবারের গন্তব্য শিলং - মেঘালয়। সে গল্প আবার কখনও।

- সমাপ্ত -


~ মিজোরামের আরও ছবি ~

অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। সেই ভ্রমণ কাহিনি তিন দশক পরে 'আমাদের ছুটি' পত্রিকায় প্রকাশের মারফত প্রথম পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু। এখন ভ্রমণ কাহিনি ছাড়াও গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লেখালেখি করছেন বিভিন্ন জায়গায়।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher