সবুজ পাহাড়িয়া 'দয়ারা'

দেবলা ভট্টাচার্য


~ দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকরুট ম্যাপ ~ দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকের আরও ছবি ~

মাথার পাশে রাখা হাতঘড়িটা পিঁ-পিঁ শব্দ করে জানান দিল তিনটে বাজে। চটকা ভেঙে চোখ কচলে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা আবছা সাদা আলোর বলয়। আর একটা খুব নরম, কুয়াশার মত আলো আমাদের এই ছোট্ট তিনকোনা বাসাটাকে পরম আদরে ঘিরে রেখেছে যেন। গত তিন রাত ধরেই ঠিক এই সময়টায় ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। প্রথম রাতে ছিল শুধুই প্রকৃতির ডাক। পরের দুই রাতে যেন চাইছিলামই যে ঘুমটা ভেঙে যাক আর তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে এসে দেখতে পাই জোছনায় ভেসে যাওয়া চরাচর। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। ঘুম ভাঙতেই পাশে তাকিয়ে দেখি কর্তা স্লিপিং বাগের ভিতর সেঁধিয়ে, আপাদমস্তক মুড়িয়ে, দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। আলতো হাতে "কিগো! যাবে নাকি বাইরেটায়?" বলে মৃদু ধাক্কা দিতেই কর্তা মশাই "উঁহু!! সাবধানে যাও" বলে পাশ ফিরে শুলেন এবং নাসিকাগর্জন পুনরায় শুরু করলেন। এই ঘটনাক্রমেরও গত তিন রাত ধরে পুনরাবৃত্তি ঘটছে। যেটা পুরনো হচ্ছে না সেটা হল, আমার শেষরাতের চাঁদের আলো সারা গায়ে মেখে, রুপোলি গঙ্গোত্রী হিমালয়ের মধুরতা আস্বাদন। এটা এমন একটা সময় যেটা আর কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে হচ্ছে না। সহযাত্রীরা নিজের নিজের তাঁবুতে নিদ্রামগ্ন। আমাদের যাত্রাসঙ্গী খয়েরিমুখো কালো সারমেয়টি, যার নাম আমরা দিয়েছি "শেরু", সেও কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যার মুখে মুখে যে পাগলপারা ঝড় আসে রোজ, আমাদের অস্তিত্বসুদ্ধু উড়িয়ে নিয়ে যাবে যেন, সেও ক্ষণিকের বিরাম নিয়েছে। খুব খেয়াল করলে, আমার নিজের মৃদুমন্দ শ্বাসের ওঠাপড়া ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই। পশমের টুপিটা টেনেটুনে কান-মাথা ঢেকে গুটিগুটি পায়ে এগোলাম বিশ ফুট দূরের ওই ছোট ঢিপিটার দিকে। যার মাথায় বসে কিছু সময় কাটাবো নিজের সঙ্গে, চাঁদের আলোয় ঝকঝক করতে থাকা বান্দেরপুঞ্ছ, কালানাগ, দ্রৌপদী কা দাণ্ডা আর শ্রীকণ্ঠকে সাক্ষী রেখে।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, পাহাড় নিজেকে চিনতে শেখায়। আমাদের মনের অতল গহ্বরে, আনাচেকানাচে যে সূক্ষ্মানুভূতিগুলোতে জং ধরে যায় কংক্রিটের জঙ্গলে থাকতে থাকতে, পাহাড় সেগুলোকেই আবার জাগিয়ে তোলে কোনও জাদুকাঠির ছোঁয়ায়। দেরাদুন রেলস্টেশনের বাইরের পার্কিং থেকে আমাদের ন'জন পাহাড়প্রেমীকে নিয়ে গাড়িটা যখন মুসৌরি ছোঁব ছোঁব করছে, তখনই টের পেলাম পেটের ভিতর প্রজাপতির ওড়াউড়ি। ভোর সকালের নরম আলো, বৃষ্টিভেজা চনমনে সবুজ প্রকৃতি টনিকের মত কাজ করছে। মাথার জট ছাড়তে সুরু করেছে। আধখোলা জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে অকলুষিত হিমেল হাওয়া একেবারে বুকের ভিতর টেনে নিচ্ছি যতটা সম্ভব।

গন্তব্য রইথাল। উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার একটি ছোট্ট পাহাড়ঘেরা ঘুমজড়ানো গ্রাম, যেখান থেকে আগামীকাল আমরা যাব দয়ারা বুগিয়াল। গাড়োয়ালি ভাষায় বুগিয়াল মানে তৃণভূমি। উত্তরাখণ্ডের গুজ্জর মেষপালকরা শীতের মরসুম বাদে প্রায় সারা বছরই গরু-ভেড়া চরাতে নিয়ে যায় ওই বুগিয়ালগুলোতে। সেরকমই এক দয়ারা নামের বুগিয়াল, আমাদের আগামী চারদিনের ঠিকানা। দুপুর আড়াইটা নাগাদ রইথাল পৌঁছে দেখি আকাশের মুখ ব্যাজার। রাত্রিবাস ছিমছাম একটি হোমস্টেতে। বাহুল্য নেই, কিন্তু অতিথি আপ্যায়নে আন্তরিকতার কোনও কমতি হল না। পোশাক পালটিয়ে একথালা ধোঁয়াওঠা মোটা চালের ভাত আর কলাইয়ের ডাল নিয়ে বাড়ির চাতালে পা ছড়িয়ে বসলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির ছাঁট হাতে মুখে মাখতে মাখতে গরমাগরম ডাল-চাওল যেন অমৃতসমান। খেতে খেতেই আলাপ হল দলের বাকি সদস্যদের সঙ্গে। বাঙ্গালুরু থেকে পাঁচ বন্ধুর একটি দল, গুজরাতের বদোদরা থেকে দুই বোন, এবং আমরা স্বামী-স্ত্রী প্রবাসী বাঙালি দিল্লি থেকে – মোট ন'জনা, আগামী চারদিন একসাথে পথ চলব। আমাদের দলের সঙ্গে আছেন দুজন ট্রেকলিডার আর একজন গাইড। মালপত্র বওয়ার জন্যে পোর্টার আর রাঁধুনিদল আলাদা। রইথাল থেকে যাত্রা শুরু, তারপর গুই গ্রামে প্রথম রাত্রিবাস, দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাত্রি দয়ারা বুগিয়ালে, চতুর্থ দিনে আমরা বারসু গ্রামে নেমে যাব ফিরতি পথ ধরতে। আমাদের দলের প্রত্যেকটি মানুষ কোনও না কোনওভাবে একে অপরের থেকে আলাদা – তা সে ভাষা, পেশা, সখ, বয়স যাই হোক না কেন। তবুও যেন এক অদৃশ্য সুতো আমাদের ন'জনাকে বেঁধে রেখেছে আর সেটা বোধ হয় আমাদের সবার পাহাড়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। খাওয়াদাওয়া গল্প গুজব সারতে সারতে বৃষ্টিটাও ধরে এল। গাইডের কথামত ধড়াচুড়ো (অর্থাৎ তিনস্তরে জামা, জ্যাকেট, পনচো, দস্তানা, পশমের টুপি, মোজা, গাবদা জুতো, ট্রেকিং-উপযোগী লাঠি ইত্যাদি) পরে গ্রাম দর্শনে বেরোনো হল।

আকাশ মধ্যেমধ্যেই গুরুগম্ভীর ধমক দিচ্ছে। বৃষ্টির পরে তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেশ নীচে নেমে গেছে। কনকনে হাওয়া চারস্তর পোশাক ভেদ করেই হাড়ে ঠকঠকানি লাগাচ্ছে। পাথরবাঁধানো পিচ্ছিল রাস্তায় সাবধানে পা ফেলে ফেলে ঘণ্টাখানেকের ঝটিকা সফর সেরে ফেলা হল। দেখলাম একটি মাতার মন্দির, আশেপাশের পাঁচ গাঁয়ের লোক যাকে মানে, সরলমতি কৌতূহলী কচিকাঁচার দল, গরু-বাছুর-ছাগল-ভেড়া ছানাপোনা সমেত বৈকালিক হাওয়া, ইয়ে ঘাস, খেতে বেরিয়েছে। পাথরে বাঁধানো ছাদ, আর উঠোনে ফুলের মেলা নিয়ে বাড়িগুলি ছবির মত সুন্দর। আর দেখলাম একটি ৩০-৩৫ ফুট উঁচু, পুরনো পাঁচতলা কাঠের বাড়ি, যে কিনা ছয়শো বছর ধরে ঝড়-জল-ঝাপটা মায় ১৯৯১ সালের ভূমিকম্পকেও পাত্তা না দিয়ে, আজো ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে। কাঠের দেওয়ালে অপরূপ কারুকাজ। তবে সদরদরজা মেরেকেটে তিন ফুটের বেশি হবে না। কারণ শুধোতে গাইড দাদা বললেন - "পাহাড়িরা ঘরকে মন্দির বলে মানে। যে যত বড় হোক না কেন, মন্দিরে ঢোকার আগে তাকে নতজানু হতেই হবে।" পাহাড়ও আমাদের সেটাই শেখায় না কি! তার গরিমা আর বিশালত্বের কাছে আমরা সবাই অতিনগণ্য। গাঁ ঘোরার পালা সাঙ্গ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেছে। পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে চুপটি করে। হাজার তারার চুমকিবসানো একটা কালো চাদর জড়িয়ে পাহাড়ি গ্রামগুলো ঘুমে ঢলে পড়ে। আমরাও আর বিলম্ব না করে রাতের খাবার সেরে লেপের তলায় সেঁধোলুম। কাল থেকে চরৈবেতি, চরৈবেতি।

যদিও আশা করেছিলাম পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আড়মোড়া ভাঙব, আদতে ঘুমটা ভাঙাল ডেলিভারি গাড়ির প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ। মিনিট দশেক এপাশ-ওপাশ করার পরও যখন প্রভাতীরাগ শেষ হবার কোনও সম্ভাবনাই দেখা গেলো না, "ধুত্তোর! নিকুচি করেছে" বলে উঠেই পড়লাম। জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ মেলতেই মুখটা হাসিহাসি। গতকালের মেঘের লেশমাত্র নেই। শ্রীকণ্ঠ, দ্রৌপদী কা দাণ্ডা আর জন লিকে নিয়ে গঙ্গোত্রী হিমালয়ের স্পষ্ট অবয়ব দেখা যাছে কমলা-ফিরোজা রঙের আকাশের প্রেক্ষাপটে।

ফুরফুরে মন নিয়েই প্রাতরাশ সেরে, গোছান-গাছান করে, আবার সেই ধড়াচূড়ো দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে হাঁটা শুরু করার জন্যে আমি তৈরি। আজকের গন্তব্য গুই ক্যাম্পসাইট, রইথাল থেকে চার কিলোমিটার। সিমেন্ট আর কুচো পাথরে বাঁধানো রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে হারিয়ে গেছে গভীর জঙ্গলে। বিশ পা না এগোতেই হৃৎপিণ্ড ঘোড়দৌড় লাগিয়েছে, ফুসফুসের জিভ বেরিয়ে গেছে আর পায়ের চালচলন দেখলে বোধহয় কচ্ছপও লজ্জা পেয়ে যেত। সে যাহোক, এগিয়ে চলার প্রেরণা মাথার ওপর ঝকঝকে নীল সামিয়ানা, চনমনে রোদ, মিঠে হাওয়া, গাঢ় সবুজ বনানী আর হিমালয়ের হাতছানি। কিছুদূর চড়াই ভাঙার পরই জঙ্গলের রাস্তা শুরু হল। ওক আর রডোডেনড্রন গাছেরই প্রাধান্য। মরশুমে লাল-গোলাপি ফুলে ছেয়ে যায় অরণ্য। এখন শেষ মরশুমে স্বল্প উচ্চতার গাছগুলিতে ফুল বিশেষ নেই, তবে গাইডদাদা আশ্বাস দিলেন,ওপরের দিকের গাছগুলিতে গোলাপি রডোডেনড্রন এখনও পাওয়া যাবে। মাথার ওপর এখন ডাল-পাতার জাফরি। রোদ চুঁইয়ে পড়ে পথের বাঁকে আলোছায়ার লুকোচুরি। পায়ের নীচে ঝরা পাতার গালিচা, ঝিমধরানো বুনো সোঁদা গন্ধ আর গাছ-বাতাসের ফিসফাস আমাদের পথ চলার সঙ্গী। হাঁচোড়পাঁচড় করে ঘণ্টা তিন-সাড়ে তিন চলার পর, বিনোদদা, আমাদের গাইড দেখি পাথুরে রাস্তা থেকে নেমে একটা মাটির শুঁড়ি পথের গোড়ায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ডাকছে। "এসে গেলাম নাকি গো?" সম্মতি জানিয়ে সে দিক নির্দেশ করল আমাদের রাতের ঠিকানার দিকে। ঢেউখেলানো সবুজ, জঙ্গল আর পাহাড়ঘেরা গুই ক্যাম্পসাইট। মুখ তুলে তাকালেই বাম দিকে বান্দেরপুঞ্ছ আর সামনে শ্রীকণ্ঠ এবং গঙ্গোত্রী ১,২,৩ শৃঙ্গ সমূহ। একনিমেষে ক্লান্তি উধাও। কাঁধের মিনি গন্ধমাদন, ট্রেকিং পোল আর গাবদা জুতোজোড়া এদিক ওদিক খুলে ফেলে সটান শুয়ে পড়লাম ঘাসের বিছানায়। ছোটবেলার খেলাধুলার দিনগুলো মনের দরজায় কড়া নাড়ল। লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ি, খো খো, কবাডি খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এভাবেই লম্বা দিতাম আমাদের খেলার মাঠটাতে। অকারণে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়া, কথায় কথায় ঠোঁট ফুলিয়ে বন্ধুর ওপর অভিমান, আবার দুদণ্ড পরেই গলা জড়িয়ে ভাব, সন্ধ্যে ঘোর হয়ে এলেও যতক্ষণ না কান টানতে টানতে হিড়হিড় করে বাড়ি না নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, খেলা চলতেই থাকবে। মুচকি হাসতে হাসতে স্মৃতিচারণ করছি আর রোদচশমা চোখে এঁটে পায়ের উপর পা তুলে নীল সমুদ্রে কালো-সাদা মেঘের ভাসাভাসি উপভোগ করছি। হঠাৎই বিনোদজির হাঁকডাক "লাঞ্চ রেডি!!! এসে যাও সবাই!!" পেটের ভিতর ছুঁচোর দল অনেকক্ষণ ধরেই সমবেত সঙ্গীত গাইছিল। তড়াক করে উঠে কিচেন টেন্টের দিকে দৌড় লাগালাম। সবজি দিয়ে ডাল, ভাত, সেঁকা পাঁপড় আর সালাড হালুম হুলুম করে সাঁটিয়ে তবে শান্তি। অনিল আর অমিত, আমাদের দুই ট্রেকলিডার, পই পই করে বারণ করেছে দিনের বেলায় ঘুম না লাগাতে। তাতে অ্যাক্লিমাটাইজেসনে অসুবিধা হয়। তবে বাঙালি বলে কথা! পেট পুরে খেয়ে একটু ভাতঘুম না দিতে পারলে যে খাবার হজমই হবে না! "এই তো জামা কাপড় বদলিয়েই চলে আসছি তাসের আড্ডায়" বলে মিয়াঁ-বিবি টুক করে কেটে পড়লাম। লেপের থলির ভেতর নিজেদেরকে পোরা মাত্র কে যেন আকাশের কল খুলে দিল। সে কী ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি! তাঁবুর মাথায় যেন দাদরা-কাহারবা বাজছে। আধহাত দূরত্বে থেকেও একে ওপরের কথা শুনতে পাচ্ছি না। আকাশের বুক চিরে মেঘেদের হুঙ্কারে বুক কেঁপে ওঠে। "কতদিন এমন বৃষ্টি দেখি না" বলে তাঁবুর বাইরে মুখ বাড়াতেই ঠং করে নাকের ওপর কে যেন পাথর ফেলল!! 'আঁই বাপ' বলে তাকিয়ে দেখি "ওমা! এতো শিল পড়ছে! তাই এত আওয়াজ!!" পলকে ঘুম উধাও। পটাপট দুচারটা শিল তুলে টকাটক মুখের ভেতর চালান! সেই ছোটবেলার মতনই। মায়ের চোখপাকানোটাই মিসিং শুধু। ঘণ্টাখানেক ধরে চলল গ্যালন গ্যালন জল ঢালা। তারপর সেই কল বন্ধ করতেই হুট করে থেমে গেল বৃষ্টি। প্রকৃতি আবার শান্ত, স্নিগ্ধ, শ্যামল! বাইরে বেরিয়ে আলু পকোড়া আর চা সহযোগে শরীর চাঙ্গা করে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে বেরোনো হল। খানিক উঁচুতে আরেকটি খোলা তৃণভূমি। সেখানে কয়েকটি ছড়ানো ছিটানো কুঁড়েঘর, একটি ছোট্ট পুকুর আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গেস্টহাউস। ঢেউখেলানো বুগিয়ালটির সবচাইতে উঁচু টিলাটায় উঠে পিছন ফিরে চাইতেই চোখের সামনে প্রকৃতির নিজের হাতে আঁকা পেইন্টিং। যতদূর চোখ যায় সবুজ ঘাসের গালিচা। হলুদ, সাদা আর বেগুনি রঙের ফুলে ছেয়ে আছে পুরো বুগিয়াল। হাল্কা হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কী জানি কী এত কথা নিজেদের মধ্যে! বুগিয়ালের সীমানা পেরিয়েই হিমালয়ের প্রাচীর। শ্রীকণ্ঠ শিখরে সূর্যাস্তের অস্তরাগ। রঙের খেলা শুরু হতে না হতেই কোথা থেকে একদল হিংসুটে মেঘ এসে টেনে দিল যবনিকা। অগত্যা কী করা। ফেরার পথ ধরলাম। ক্যাম্পে ফিরে স্যুপ, তারপর কয়েক রাউন্ড তাস পিটনো, অতঃপর চাইনিজ নৈশাহার। সব মিলিয়ে সন্ধ্যেটা মন্দ কাটল না।

আজ পূর্ণিমার আগের রাত। কিন্তু মেঘের দল যে জোছনার পথ আটকে বসে। একটু মনখারাপ নিয়েই শুলাম কিন্তু ঘুম আসতে দেরি হল না। রাত তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙল প্রকৃতির ডাকে। অনিল আর অমিতজীর কথা মত নিজেকে হাইড্রেটেড রাখতে গিয়ে সারাদিনে পিপেসমান জল খেয়েছি। এ তারই পরিণাম। একবার স্লিপিং ব্যাগের ওম চাখার পর, ধড়াচুড়ো পড়ে রাতবিরেতে টয়লেট অভিসারে যাবার জন্যে কতটা যে মনের জোর লাগে, যারা ভুক্তভোগী তারাই জানে। প্রায় আধঘণ্টা নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করে যখন আর চেপে রাখলে কেলেঙ্কারি হতে পারে, তখনি উঠলাম। ঠেলা গুঁতো মেরে নাকডাকানি বরটাকেও ওঠালাম। "আমি একলা যাবো নাকি? ভালুক ধরে যদি??!!!" উনি জুলজুল করে তাকাচ্ছেন। কিন্তু প্যাকিং খুলে বেরোনোর কোন তাগিদই দেখা যাচ্ছে না। "কুঁড়ের বাদশা! গোল্লায় যাও তুমি" জাতীয় কিছু বাছা বাছা বিশেষণে ভূষিত করে, গজগজ করতে করতে একাই বেরিয়ে এলাম হেডল্যাম্প মাথায় বেঁধে। বেরোতেই বিস্ময়! কোথায় গেল সেই মেঘের দল? আকাশ জুড়ে যে তারাদের ঝিকিমিকি! জ্যোৎস্নার আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পচত্বর। চাঁদ বুঝি পাহাড়ের আড়ালে। কিন্তু তার আভায় উদ্ভাসিত হিমালয়। চারিধারে কেউ কোথাও নেই। আর এই অপার সৌন্দর্য, শেষরাতের ভেজা হাওয়া চোখে মুখে মাখতে মাখতে আমি একাই উপভোগ করছি। বেমালুম ভুলেই গেছিলাম কী কাজে বেরিয়েছি। সম্বিত ফিরল কর্তার ডাকে। অনেকক্ষণ ফিরছি না দেখে, আমি সত্যিই ভালুকের খপ্পরে পড়লাম কিনা দেখার জন্যে তাঁবুর বাইরে মুখ বাড়িয়েছে সে। "আসছি" বলে কৃতকর্ম সেরে, মন না চাইলেও তাঁবুতে ফিরলাম। আধো ঘুম আধো জাগানির মধ্যে সকাল হয়ে গেল। শুরু হল আজকের পথ চলার প্রস্তুতি।

আজ যাব দয়ারা বুগিয়াল। সাড়ে তিন-চার কিলোমিটার হাল্কা চড়াই উতরাই পথ জঙ্গলের বুক চিরে। আজ সঙ্গ ধরেছে একটি সারমেয়। সকালে আমাদের হাত থেকে গুডডে বিস্কুট সহকারে প্রাতরাশ করে সে যারপরনাই আনন্দিত। লাফাতে লাফাতে, কখনও আগে, কখনও পিছে, "শেরু"ই আজ আমাদের পথ প্রদর্শক। আজকের রাস্তাটি ভাষাতীত সুন্দর। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বুগিয়াল, সেখানে শয়ে শয়ে ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে, মেষপালক শিস দিয়ে দিয়ে তাদের পরিচালনা করছে। ফুল, পাতা, ব্যাঙের ছাতা যাই দেখছি, স্ফূর্তি উপচে উঠছে। গতকালের তুলনায় হাঁটার তেজও বেড়ে গেছে আজ। যত ওপরে উঠতে লাগলাম, জঙ্গল ধীরে ধীরে পাতলা হতে থাকল। আজ রডোডেনড্রন গাছগুলিতে গোলাপি ফুল ফুটে রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে। পথে পড়ল একটা পাহাড়ি ঝরনা। দুধসাদা মিষ্টি সেই জল পেট পুরে খেয়ে, নিজেদের যথেচ্ছ ভিজিয়ে আবার হাঁটা শুরু। তিন ঘণ্টারও কম সময়ে আজ গন্তব্যে পৌঁছানো গেছে।

হাজার হাজার হলুদ, সাদা ফুলের পশরা সাজিয়ে, সবুজ সে বুগিয়াল আজ আমাদের বসতবাড়ি। যার উঠোনে মেঘেদের আনাগোনা। আর চাইলেই হিমালয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আসা যায়। শ্রীকণ্ঠ আর গঙ্গোত্রী শৃঙ্গগুলির সাথে সাথে বান্দেরপুঞ্ছ আর কালানাগ শৃঙ্গও একদম চোখের সামনে দণ্ডায়মান। মধ্যাহ্নভোজন সেরে আজ আর গড়াগড়ি নয়। ট্রেক লিডারদের কড়া নির্দেশ যে নিজেকে ব্যস্ত, সচল রাখতে হবে। তাহলেই ১১,১০০ ফিট উচ্চতায় শরীর নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে। অন্যথা AMS হওয়ার ক্ষীণ আশঙ্কা থেকে যায়। সাধ করে কে আর মাথা ব্যথা (AMS-এর একটি উপসর্গ) ডেকে আনে! তাই যে কাজটি করতে আমি সবচাইতে ভালবাসি অর্থাৎ খই ভাজা, তাই করতে বসে গেলাম, মনের মত একটা জায়গা বেছে নিয়ে। ঘাসের উপর শুয়ে গড়িয়ে, "শেরু"র সাথে খেলে, ভেড়ার পিছনে ছুটে দিব্যি ক'ঘণ্টা কেটে গেল। বিকেল হতে না হতেই গতকালের মত কালো কোটপরা হোমরা চোমরা মেঘের দল, হুম হাম করতে করতে এসে হাজির। তবে হম্বতম্বিই সার। আজ আর বৃষ্টি হল না। আগামীকাল যেহেতু ভোরে বেরোতে হবে ১২,১০০ ফিট-এ বাকারিয়া টপের মাথায় উঠতে, সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে যে যার তাঁবুতে সেঁধিয়ে গেলাম। তবে ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে টয়লেট অভিযান এবং চাঁদের আলোয় একাকী নিশিচারণার কোনও ব্যতিক্রম ঘটল না।

ট্রেকের তৃতীয় দিনের "কল টাইম" ছিল ৫-৬-৭ ঘটিকা। অর্থাৎ, পাঁচটায় চা, ছটায় প্রাতরাশ, সাতটায় দুগগা দুগগা। আজ বেশ অনেকখানি হাঁটা। তিন-সাড়ে তিন কিলোমিটার চড়াই, আবার একই পথে ক্যাম্পসাইট ফিরতে হবে মধ্যাহ্নভোজনের আগেই। পরিজ, ছোলাসেদ্ধ আর ম্যাগির ব্রেকফাস্ট নাকে-মুখে গুঁজে আমরা রেডি "সামিট ক্লাইম্ব" করার জন্যে। ইতিমধ্যেই সোনালি রং ধরেছে বান্দেরপুঞ্ছের চূড়ায়। কালানাগও বাদ গেলেন না। শ্রীকণ্ঠের পিছন থেকে ঠিকরে বেরচ্ছে সূর্যকর।

দেখতে না দেখতেই চোখ ধাঁধিয়ে উঠল সেই কতকালের পুরনো চেনা সূর্য, জন্ম দিল একটা নতুন দিন। সকালের কুসুম আলো গায়ে মেখে শুরু হল পথ চলা। এক কিলোমিটার মত পাথুরে রাস্তা, তারপর নামতে হবে বুগিয়ালে। বুগিয়াল ছোঁয়া মাত্রই রাস্তা বলে কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় ঢেউ খেলানো সবুজ ঘাসের সমুদ্র। বামদিকে ক্রমশ ছোট হতে থাকা ওক, রডোডেনড্রনের জঙ্গল আর ডানদিকে সঙ্গ দিচ্ছে বান্দেরপুঞ্ছ, কালানাগ। ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে তিন ঘণ্টা, কিন্তু মনে হয়েছিল যেন অনন্তকাল চলার পর, অবশেষে বাকারিয়া টপের দেখা পেলাম। চূড়ায় উঠে জল-বিস্কুট খেয়ে, একটু ধাতস্থ হয়ে চারদিকে চোখ বোলালাম। সে সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করার মত শব্দসম্ভার আমার নেই। সে শুধুই অনুভব করা যায়। দিগন্তজোড়া হিমালয় আর আমাদের মধ্যে এখন আর কোন আড়াল নেই। পেঁজা তুলোর মত মেঘের খেয়ানৌকা ভাসতে ভাসতে আসর জমাচ্ছে পর্বতচূড়াগুলির উপর। হাত বাড়ালেই যেন ছুঁতে পারব তাদের। শ্বেতশুভ্র হিমালয় আমি যতবারই খুব কাছ থেকে দেখি, এক অদ্ভুত পাঁচমিশালি অনুভূতি হয়। ভালোলাগা, ভয়, শ্রদ্ধা, উত্তেজনা আর কষ্টমেশানো একটা অনুভূতির বুদবুদ উঠতে থাকে মনের ভিতর। সেদিন বাকারিয়া টপে দাঁড়িয়েও চেনা বুদবুদটাকে বেশ টের পাচ্ছিলাম।

এরকম ভাবে কত সময় কেটেছে খেয়াল নেই। গাইডদাদার ডাকে ঘোর ভাঙল। এবার নামার পালা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেঘেদের আমদানিও বেড়ে যায়। বৃষ্টি নামার আগেই ঘরে ফিরতে হবে। হাওয়ার জোরও বেড়ে গেছে খুব। শ্রীকণ্ঠের চূড়া ছুঁয়ে আসা হিমেল হাওয়া কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলাম। চূড়ান্ত ভালোলাগার পাশাপাশি একটা খারাপলাগার চোরাস্রোতও বইছে বুঝি। হিমালয়কে বিদায় দেওয়ার সময় প্রায় হাজির। শুধু আজকের রাতটা। কালই তো ফিরতে হবে চেনা ছকেবাঁধা জীবনে। তাই আজ আর তাড়াহুড়ো নয়। প্রত্যেকটা মুহূর্ত সেই ছোটবেলার, মায়ের চোখ বাঁচিয়ে লুকিয়ে রাখা ললিপপটার মতই, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে ক্যাম্পসাইট পৌঁছালাম বৃষ্টি নামার ঠিক আগে। বিশেষ দিনের মেনুও বিশেষ – রাজমা, চাওল আর গুলাবজামুন! কালকেই ফিরে যাওয়া বলে বোধহয় দলের নেতারা একটু ঢিল দিয়েছে। খেয়েদেয়ে গুটি গুটি তাঁবুতে ঢুকতে দেখেও কিছু বলল না। আর তখনি উপরওলা বুঝি মুচকি হাসলেন। একটু ভাতঘুম দেবার আশায় স্লিপিং ব্যাগের ভিতর আঁটোসাঁটো হতেই শুরু হল তুমুল ঝড়বৃষ্টি।

প্রকৃতির ওরকম রুদ্ররূপ শেষ কবে দেখেছি বা আদৌ দেখেছি কিনা বলতে পারি না। হাজার কালবৈশাখীর গতি নিয়ে সেই ঝড় আছড়ে পড়ছে খেলনাঘরগুলোর ওপর। আওয়াজে কানে তালা লেগে যায় যেন। কী করা উচিত ভাবতে ভাবতেই তাঁবু উপড়ে নেমে এল মুখের ওপর, আর আমরাও "বাবারে মারে" করে এক লাফে বাইরে। এক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালিয়ে প্রকৃতি যখন ক্ষান্ত দিলেন, আমাদের তাঁবুগুলোর অবস্থা ঠিক ঝড়ের মুখে পরা ওই মগডালের পাখির বাসাটার মতন। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে মেরামতি করতে করতে অন্ধকার নেমে এল। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটাকে টেনে কোনমতে নৈশাহার সেরেই ঘুমের অতল গভীরে তলিয়ে গেলাম। তারপর ঠিক তিনটেয় ঘুম ভেঙে আমার পাহাড়ের রোজনামচার গল্প তো গোড়াতেই শুনিয়েছি।

পাততাড়ি গুটিয়ে ফেরার দিন হাজির। অদ্যই শেষ রজনী বলে কিনা জানি না, গত চারদিনের সমস্ত ক্লান্তি আজ ভর করেছে শরীরে। ছয়-সাত কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে বারসু গ্রাম, সেখান থেকে গাড়ি চেপে দেরাদুন। নামার সময় ফুসফুস বাবাজির তো মেজাজ খুশ, কিন্তু হাঁটু আর পা প্রকৃত অর্থেই বেঁকে বসছে কিছুদূর যেতে না যেতেই। একেক সময় এমন কনকনানি ধরছিল হাঁটুতে, যে ভাবছিলাম এই বয়সেই গেঁটে বাত বাঁধালাম নাকি! দু কিলোমিটার মত জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নামার পর পৌঁছালাম দয়ারা বুগিয়ালেরই একটি ছোট সংস্করণ বারনালা বুগিয়ালে। একটা বড় পুকুর আর নাগদেবতার মন্দির আছে সেখানে। বারসু থেকে যাঁরা দয়ারা যান, প্রায়শ একরাত বারনালাতে কাটান। একটু জিরিয়ে নিয়ে, হাঁটুর মাথায় হাত বুলিয়ে, বাবা বাছা বলে রাজি করিয়ে শেষমেশ ওঠা গেল বাকি পাঁচ কিলোমিটার উতরাই পেরতে। ধুঁকতে ধুঁকতে বারসু পৌঁছে অপেক্ষারত টেম্পো ট্রাভেলারটার সামনে যখন এসে দাঁড়ালাম, ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে! ঘড়ির দশা তখন আমাদেরও! রুটি, আলুভাজা আর ওমলেট গোগ্রাসে গিলে গাড়িতে উঠে সিটের উপর সেই যে শরীর ছেড়েছি, তারপর আর কিছু মনে নেই। তবে এত ঘটনাবহুল চারদিন কাটানোর পর, ফেরাটা একেবারে নিরামিষ হবে তা কি হয়! ফলস্বরূপ আবার এক দামাল ঝড় এবং ষোলোকলা পূর্ণ করতে দু-দুবার টায়ার পাংচার। ড্রাইভারটি ফচকে ছোঁড়া। বলে কিনা "দাদারা এবং দিদিরা! যা হাল দেখছি, পনচো বার করে হেঁটে দেরাদুন পৌঁছানো ছাড়া আপনাদের আর গতি নেই।" হাতি কাদায় পড়লে মশারাও মশকরা করে আর কী! তবে গতজন্মের পুণ্যের ফলে সে দুর্গতি সইতে হয়নি। যথাসময়ে গাড়ি চেপেই দেরাদুন পৌঁছান গেছে। ভারতীয় রেলওয়েও তার সুনাম বজায় রেখে পাক্কা ছ'ঘণ্টা লেট করিয়ে রাজধানীতে পৌঁছে দিল পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ। আর সেইসঙ্গেই, নটে গাছ মুড়িয়ে আমার গল্পও ফুরোলো।

~ দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকরুট ম্যাপ ~ দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকের আরও ছবি ~

দেবলা ভট্টাচার্য উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের বাসিন্দা। তবে কাজের সুবাদে এবং বিবাহসূত্রে গত ছয়বছর ধরে দিল্লিপ্রবাসী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যা নিয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। এখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নীতি আয়োগে কর্মরতা। গল্পের বইয়ের পোকা। ভালবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। ট্রেকিং-এর দুনিয়ায় সবেই পা রেখেছেন। আর লেখার দুনিয়ায় এই প্রথম।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher