ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - অন্তিম পর্ব
থোড়া অ্যাডজাস্ট কর্ লিজিয়ে
কাঞ্চন সেনগুপ্ত
হিমাচলের তথ্য ~ হিমাচলের আরও ছবি
একাদশ অবস্থানঃ স'বাবুর রেস্ট-ডে। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও ট্রাভেল এজেন্টের ড্রাইভারকে রাজি করানো গেলো না ভোর ভোর আসার জন্য। অবস্থাটা বুঝুন। ন'হাজার টাকার সাড়ে চারহাজার অলরেডি অ্যাডভান্স দিয়ে বুকিং করা গাড়ি আমাদের! দেরী করে বেরোনোর পিছনে যুক্তি হল, যেহেতু আমাদের গাড়ির পার্মিট আজকের দ্বিতীয় পর্যায়ের, অর্থাৎ চেকিং পয়েন্টে সাড়ে নটার আগে পৌঁছে লাভ নেই, তাই গাড়ি এল, আমরা বেরোলাম সকাল সাড়ে সাতটা। খানিক গিয়েই সেই বিশেষরকম পোশাক ভাড়া করার দোকানগুলো। বাছাবাছি করে পড়ে নিলাম সবাই। এবার পার সেট ছশো টাকা। ভেতরে পাতলা কার্গো প্যান্ট আর পরনে সেই বটল্-গ্রীন ফুল-স্লিভ গেঞ্জি। তার ওপর ন্যাকার-বোকার। বেশ গরম লাগছে। তবু আমিই বাকিদের সাবধান করলাম। পড়ে নাও, ওপরে কন্কনে ঠান্ডা।
তারপর গাড়ি আরও কিছুটা মানালি থেকে দূরে, কী সোলাং-এর দিকে যাওয়ার রাস্তাটাও বেশ কিছুটা পেরিয়ে, এক ঝকঝকে সিনারিওয়ালা প্রেক্ষাপটের বুক চিরে যাওয়া সকালের ধোপদুরস্ত রাস্তার বাঁপাশে জলখাবারের রেস্তোরাঁর উঠোনে ঘোঁত করে দাঁড়িয়ে পড়ল। অস্পষ্ট বিড়বিড়ানিতে ড্রাইভার বলে গেল টিফিন করেই চলে আসছে দশ মিনিটে। এতো সকালে বেরিয়েছে যে ঘরে টিফিন করতে পারেনি। এর-ওর মুখ চাওয়াচায়ি করে গাড়ির মধ্যে গোঁজ হয়ে বসে রইলাম, কী এদিক সেদিক ক্যামেরা নিয়ে 'কিলিক্ কিলিক্'। কিন্তু কাঁহাতক। ঘড়ির কাঁটা আরও আধ ঘন্টা পার করে গেল। ওইসব ধড়াচূড়া পড়ে অসহ্য গরম লাগছে, দেখতে পাচ্ছি সাঁ সাঁ করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। আরও কত গাড়ির পিছনে পড়ে যাচ্ছি আমরা। এইসব সময়ে উত্তর-না-জানা এমন সব প্রশ্ন সবার মেজাজ জুড়ে চলতে থাকে যে কারও কারও মাথা গরম হয়ে যায়, আর কারও কারও মাথা ব্যথা। বেশ রেগেমেগেই রেস্তোরাঁর ভেতরটায় ঢুকে চোখ বোলালাম, ওমা! কোথায় সে? দেখলাম সিঁড়ি চলে গেছে নীচের দিকে। ইতস্ততঃ করে সেদিকে নামছিলাম, দেখি দন্তকৌমুদিবিকশিত করে তিনি উঠে আসছেন...হাতে রাংতায় মোড়া কিছু একটা। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ওপর প্যাকেটটি রাখা হল। আমাদের সবার মনেই সন্দেহ, খায়নি তো এতক্ষণ কী করছিল...? কিন্তু কোনোরকম বার্তালাপই করতে ইচ্ছা করছিল না ড্রাইভারের সঙ্গে। আরও কিছুদূর এগোতেই কয়েকটা ফেরত গাড়ি দেখতে পেলাম। কোনও কোনও বাঁকে সেজন্য দাঁড়াতেও হল, জায়গা দিতে হল। গোলাবা ক্যাম্পিং জোন শুরু হওয়ার কিলোমিটার খানেক আগে থেকে জ্যাম। রাস্তার বাঁ-দিক ধরে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল, তখন প্রায় দশটা। সামনে কতদূর অবধি গাড়ির সারি বোঝা যাচ্ছে না, বা যতদূর দেখা যাচ্ছে ততদূরই গাড়ি। পিছনেও এক এক করে গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আমাদের কপালের ভাঁজে বিরক্তিমাখা জিজ্ঞাসা চিহ্নগুলো হয়তো ঠাহর করতে পেরে ড্রাইভার গলাটা যতদূর সম্ভব উদাসীন করে একবার বলল, "ইয়ে তো রোজ কা হ্যায়..." আমি খুব সংযত হয়ে বুঝতে চেয়েছিলাম ড্রাইভারের থেকে, যে গাড়িগুলির এন্ট্রি পারমিশন সাড়ে নটায়, সেই গাড়িগুলি যদি সাড়ে নটায় গোলাবার চেকিং পয়েন্টের মুখে থাকতে চায় (এই চাওয়াটা, এই আগ্রহটা খুব জরুরি এবং সেটা ড্রাইভারের মধ্যে থাকা প্রয়োজন), তাহলে সেই গাড়িকে মানালি ছেড়ে কটায় বেরোতে হবে? যদি ধরেই নেওয়া যায় যে এমন ঘন্টা দুয়েকের জ্যাম থাকবেই। বিশ্বাস করুন, খুব ভালো নাহলেও যেটুকু হিন্দী জানি তাতে আমার এই জিজ্ঞাসাটুকু ভালোই ব্যক্ত করতে পেরেছিলাম। শালা, কিচ্ছুত্তেই বুঝল না! র্যাদার বুঝতে চাইল না, কারণ বুঝে উত্তর দিলে, ওর উত্তর হতে হত ভোর পাঁচটা; যে বেকায়দা জায়গাটায় ও আসতে চাইল না কিছুতেই। ওই সেই, ইনিয়ে-বিনিয়ে একই চর্বিত চর্বণ, "অ্যায়সা তো হোতাই হ্যায়", "জ্যাম ইধরকা রোজকা হ্যায়", "সাড়ে ন'কা পহলে আ গয়ে তো ইঁহা খঢ়া হোনা নেহি দেতে"... আর এখন আমাদের সামনে অন্তত ঘন্টা দুয়েকের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চেক-পয়েন্টে পৌঁছতেই বারোটা বাজবে। রাগের মাথায় ওই হাইটেও টান মেরে খুলে ফেললাম জাবদা ন্যাকার-বোকার। ধুর ধুর! ঠান্ডা না ছাই। সূর্যটাই পাল্টে গেছে আজকের গোলাবার। সেই কামড় বসানো হাওয়াটাও পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও। এদিকে শুধু অসহিষ্ণু ইঞ্জিনের গর্মি।
আগেই বলেছি এই পাহাড়টায় রাস্তা পাহাড় পেঁচিয়ে যায়নি, বরং এদিককার ঢালের ওপর s-এর মত এঁকে-বেকে বিছিয়ে আছে। ঠায় দাঁড়ানো গাড়িগুলো থেকে অনেকেই নেমে পড়ে, ঢাল বেয়ে, রাস্তা পেরিয়ে, আবার ঢাল বেয়ে, আবার রাস্তা পেরিয়ে ক্রমশঃ উঠে চলেছে। মনে হয় গাড়ির আগেই চেকিং পয়েন্টে পৌঁছে নিজ নিজ গাড়ির জন্য অপেক্ষা করবেন তাঁরা। এক বাবা হাঁটা দিলেন, তার পেছন পেছন 'বাবা, বাবা' করতে করতে তাঁর বালিকা কন্যাও চড়াই ভাঙতে লাগল। গরমে, ঘামে গাড়ির মধ্যে সেদ্ধ হওয়ার থেকে প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে এই পড়ে পাওয়া 'খেলনা-ট্রেক' অনেক অনেক বেশি উপভোগ্য। আমাদের গাড়ি থেকেও দুজন নেমে বাঁকে বাঁকে হারিয়ে গেল এমনি ভাবেই। আমরা গড়িয়ে গড়িয়ে লক্ষ্যে পৌঁছলাম সেই বারোটায়। দু-তিন মিনিটের কাজ। রাস্তার পাশে বেশ কিছুটা জায়গা পাহাড় কেটে সমতল করে নিয়ে গাড়ি পার্ক তথা পারমিট-প্রদর্শনের জায়গা। গাড়ি সেখানে ঢুকে এক চক্কর খায়। তার মধ্যেই ছাপ্পা লাগানোর কাজ সারা। আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে পাঁই পাঁই রোহতাং-এর দিকে।
অল্প সময়েই পেরিয়ে গেলাম মাঢ়ী। এখন দাঁড়ানো নয়। আগে বরফ ছুঁয়ে আসি। মাঢ়ীতে এখন সবুজ ঘাস। এবার এসে দেখলাম মাঢ়ীর কাছাকাছি এক জায়গায় ড্যাম তৈরি হচ্ছে মনে হল। দেখতে দেখতে সেই কাদা-মাখা রাস্তা চলে এল চাকার তলায়। সামনে বহু বহু গাড়ি আগে থেকেই এসে পড়ায় আগেরবারের মত যে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়তে পারছি পেঁচানো রাস্তা ধরে, তুষারাবৃত পর্বতের কোলে কোলে, তা নয়। ড্রাইভার যেভাবে গাড়ির গতি কমিয়ে আনছে আর ইতিউতি তাকাচ্ছে, আমি সন্দিহান হয়ে উঠলাম। আগে থেকেই বলতে লাগলাম, আমরা কিন্তু টপ পর্যন্ত যাব। ড্রাইভার এসব কথায় খুব যে কান দিল তা নয়। রাস্তার দুপাশে বরফ সরিয়ে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। বরফের দেওয়াল দেখতে পেলাম, তবে লক্ষ্যণীয় ভাবে অত উঁচু নয়। আমার বিশ্বাস আরও একটু এগিয়ে রাস্তাটা বাঁদিকে বেঁকে বেশ খানিক গোলাকৃতি টার্ন নিয়ে, এই পর্বতমালারই সামনের ওই ভাঁজটার পেট ধরে রাস্তাটা চলে গেছে আমাদের বর্তমান অবস্থানের সামনে দিয়ে আরও আরও ডানদিকে। যত এগোচ্ছি রাস্তাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। ওই দিকে চলে গেলেই এখান থেকে কিলোমিটার খানেক আরো গেলেই পেয়ে যাব রোহতাং জিরো। সামনে যতদূর দেখা যাচ্ছে রাস্তা, বরফ দু'পাশে সরানো। কিন্তু আমাদের এক্কেবারে হাতের কাছেই রাস্তার ডান দিকে আরো বেশ কিছুটা জায়গার বরফ চেঁছে তুলে ফেলে বানানো হয়েছে কার-পার্কিং। ড্রাইভার এই মওকাটিই খুঁজছিল। 'আগে গাড়ি যানে নেহি দেগা' বলেই সেই খুব চেনা কথাটা বলল, এইতো রোহতাং, আবার কোথায় যাবেন?
নেমে পড়লাম। একবার মনে হল হেঁটে বাকিটুকু চলে যাই। কাদা-মাখা রাস্তায় এখনও যেটুকুতে পিচ, সেটুকুই খুব পিচ্ছিল। রাস্তার পাশে তখনো ব্যাক-হো-লোডার চালিয়ে চালিয়ে চাং চাং কাদামাখা জং-পড়া বরফ সরিয়ে সরিয়ে রাস্তার পাশে scoop-আকৃতি করে রাখা চলছে। সেসব আলগা বরফে পা-ধ্বসিয়ে টালমাটাল আমরা পাশের ঢালু উপত্যকায় গড়িয়ে গেলাম বলা যায়। আমাদের না-পাওয়াটুকুও গড়িয়ে দিলাম ঢালে। অপরিমিত প্রাণ-ঢালা লাফালাফি, ছোঁড়াছুঁড়ি, নানান পোজে-পস্চারে ফটো তোলাতুলি, স্লাইড করা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রায় ঘন্টাখানেক। গ্লাভস্, জুতো, এমনকি জোব্বার ফাঁক-ফোকর দিয়েও বরফ কুচি ভেতরে ঢুকে গেল। একবার তো জোব্বার পকেটে লেন্স-ক্যাপ রেখে ফ্যাসাদে পরে গেলুম। পকেটে হাত গলিয়ে দেখি, আমি চেষ্টা করলে হাত পা-অবধি প্রসারিত করতে পারি। পকেটে 'গর্ত'!
এরপর আমরা হাঁফিয়ে গেলাম। ভেতরে ভেতরে ঘেমে গেলাম। খাদের গহ্বর থেকে শন্ শন্ পবন আসছে ঠিকই, তবে না তা অতোটাও 'তুফানি', আর না তা অতোটাও কন্কনে যে দাঁত ফোটাবে হাড়ে-মজ্জায়। প্যারাস্যুট কাপড়ের জোব্বাটা পড়ার যুক্তি দাঁড়াল যে, বরফের ওপর গড়াগড়ি খেয়েও আমাদের পোশাক ভিজল না। যদি রোহতাং-এ গিয়ে পণ করে থাকেন যে আপনি বরফে হাত দেবেন না, তাহলে আজকাল আর আপনি গ্লাভস, জোব্বা ভাড়া না-করলেও পারেন। ক্লাইমেটের কথা যদি বলেন, তবে আমরা কী করলাম শুনুন। গাড়ির কাছে এসে ড্রাইভারের পরামর্শ মত জোব্বা, জুতো, মোজা সব ওখানেই খুলে ফেললাম। ড্রাইভার সেগুলোকে গাড়ির ছাদে মেলে দিয়ে বেঁধে রাখল। ফেরত দেওয়ার আগে শুকিয়ে যাবে। সেই সময় রোহতাং-এ আমার পরনে ছিল, ওই যে বলেছি, ফুল-স্লিভ বটল গ্রীন টি-শার্ট আর কার্গো প্যান্ট। পায়ে কিটো। মাত্র সাত বছর আগে এভাবে ভাবা যেত না। হতেই পারে আগেরবার ছিল সকাল আটটা আর এবার বেলা বারোটা, তবু...
এমনি এমনি গ্রীন ট্রাইবুনাল নড়েচড়ে বসেনি। আগেরবার চোখের আন্দাজে যা বুঝে ছিলাম, দিনে রোহতাং-এ হাজার পাঁচেক গাড়ি যায়ই যায়। এবারেও, এত শত রেস্ট্রিক্শন, আর লাগাম ছাড়া ট্রাভেল কস্ট বাড়িয়ে ফেলেও, সেই চোখের আন্দাজেই যা বুঝলাম গাড়ির সংখ্যা... মাত্র বারোশো গাড়ি তো মনে হল না কোনো মতেই। কী করে সম্ভব? (যে প্রশ্ন আমার মনেই তোলপাড় করছে, সেসবের উত্তর আমার কাছে চাওয়া অমানবিক)। ফিরতি পথে গাড়ি চালু হল। আমার মনে হল পরে কখনও এদিকে এলে, রোহতাং নিয়ে আর আদেখলাপনা করব না। যদি প্ল্যান করি, তবে কেলং-এর প্ল্যান করব। ওয়ান নাইট হল্ট। শুনছি কেলং-এর পারমিট পাওয়া এতো ঝামেলার নয়, আর অনেক অনেক সস্তা! তখন যাওয়ার পথে রোহতাং টপে নেমে মন-পুরিয়ে, মন-ভাসিয়ে উপভোগ করা যাবে এই বরফ-বাগানকে।
নামার পথে মাঢ়ীতে নামলাম টয়লেটের নিমিত্ত। বায়ো-টয়লেট পাশাপাশি বেশ কয়েকটা। নিয়মিত সাফ-সুত্রো হয়। তখন সেই কাজই চলছিল। বেলা প্রায় তিনটে। বুঝলাম আজকের লাঞ্চও মিস্ হয়ে গেল। বাকি রাস্তা নেমে এলাম সরসরিয়ে। সোলাং-এর পথ যেদিকে বেঁকে গেছে, তাকে ডাইনে রেখে অল্প এগিয়েই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। বিশ্বাস করুন, আবারও এই দুর্বিষহতা নিয়ে লিখতে আমারও বিরক্তি ঘুলিয়ে উঠছে! সূর্য পশ্চিমে হেলে উচ্চাবচ দিগন্তরেখার ফাঁক-ফোকর দিয়ে তির্যক নিপাতনে সিদ্ধ করে দিচ্ছে গাড়ির ভেতর। পেল্লায় এক আস্ত কোলাব্যাঙ গিলে যেভাবে পরে থাকে ঢ্যামনা সাপ, সেভাবে গাড়ির সারি পাহাড়ের গা-ধরে এঁকে-বেঁকে স্থির। খুব সামান্য নড়াচড়া। আর সাপের লেজ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে বিষয়টা আমাদের সহ্যের দরজাটা খুলে 'চল-দেখি-কী-ব্যাপার'এর রাস্তায় নামতে বাধ্য করল, তা হল এর মধ্যেই কিছু গাড়ি পিছন থেকে এসে লেন-ব্রেক করে সামনে এগিয়ে আসছে। উল্টো দিক থেকে গাড়ি এলেই অসম্ভব যানজট দেখা দেবে। এই গাড়িগুলো তখন আগে গিয়ে আমাদের লাইনে ঢুকে পড়ার জন্য গোঁতাগুঁতি করতে থাকবে। আর আমরা আরও পিছনে পড়ে যাব। মনে হয় এসবই হচ্ছে সামনে, তাই জ্যাম ছাড়ছে না কিছুতেই। নেমে পড়ে এগিয়ে গেলাম হেঁটে হেঁটে। আমাদের গাড়ি থেকে তিনজন। দেখাদেখি, এদিক সেদিক থেকে দু'একজন। লাইনভাঙা গাড়িগুলির ওপর প্রথমেই চোটপাট। তাদের সাফাইতে খুব একটা কিছু বলারও ছিলনা। সব শুনে 'কিছু শুনছে না' টাইপ মুখ করে গাড়ি কোনও মতে ফাঁক বুঝে লাইনে নিয়ে এল। আমরা গাড়ি থেকে নেমেছি যেখানে, তার অল্প দূরেই বশিষ্ঠের দিকে চড়াইয়ের রাস্তাটা। হাঁটতে হাঁটতে সেটাও পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি মানালির দিকে। এভাবে নেমে পড়াটা কাজে দিল। এর মধ্যে এক দারোগা, সঙ্গে এক কনস্টেবল নিয়ে খাদের ধারে বসে পড়ল চালান কাটতে। নিয়মভাঙা গাড়িগুলির নাম্বার টোকা হচ্ছে আর পটাপট চালান কাটা হচ্ছে। এখন যে গাড়ির চালান কাটা হচ্ছে, সে এসে দাঁড়িয়েছে কাগজপত্র নিয়ে নিতান্ত ভালো মানুষের মত, আর আমার বন্ধু পুলিশের সামনেই উচ্চগ্রামে নিয়ম-নীতি-লজিক কপচে চলেছে। গড়ানে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি অনেকটা। এর মধ্যে দেখি রাস্তার ডানপাশের খাদের ধারে সামান্য চ্যাটালো এক খোলা জায়গায় কয়েক বস্তা মাল আনলোড করে একটা টেম্পো সাঁ করে গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াল, মানালির দিকে যাওয়ার লাইনের মাঝে জায়গা করে নিতে চায় সে। আমি তার গাড়ির সামনে। ড্রাইভারের দিকে চোখাচোখি হতেই হাত ঘুরিয়ে আমায় কৈফিয়ত দিল, "কেয়া করে, অব উধর জানে কে লিয়ে কেয়া ছ্যে'ঘন্টা পিছে লাইন মে যাকে গাড়ি লগায়ে?" ভেবে দেখলাম, হক্ কথা। নিজেই লাইনের আগেপিছের গাড়িকে হাত দেখিয়ে, বুঝিয়ে, টেম্পোটাকে লাইনে জায়গা করে দিলাম। ওদিকে আমার বন্ধু আটকেছিল এক প্রাইভেট কারকে। ড্রাইভারের জানলায় মুখ রেখে গরম নিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল, পুরো রাস্তা আটকে গেলে ভালো হবে? গাড়ির ভেতরে প্যাসেঞ্জার ছিলেন তিনজন মধ্যবয়সী মহিলা। তাঁরা বলে ওঠেন, "আমরা স্কুলটিচার, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। এই জ্যাম তো রোজকার ভোগান্তি।" বন্ধু পরে বলেছিল, সে তাঁদের তখন বুঝিয়েছিল যে তাঁরা স্কুলটিচার হয়ে যদি নিয়ম না-মানেন... তাঁরাও দ্বিরুক্তি না করে ড্রাইভারকে গাড়ি লাইনে নিয়ে যেতে বলেছিলেন; কিন্তু আমাদের কাছেও এর উত্তর ছিল না যে, যাঁরা মানালির স্থানীয়, সারাদিনে নানান প্রয়োজনে যাঁদের ওই রাস্তাটা ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই, তাঁদের পক্ষে কি সম্ভব প্রতিনিয়ত ৩ কী ৪ কী ৫/৬ ঘন্টা ধরে ওভাবে রাস্তায় যানজটে আটকে থাকা? আমরা শুনলাম কোন্ দিক থেকে যেন ফোর-লেন রোড হচ্ছে, দেখলামও সোলাং থেকে রোহতাং সুড়ঙ্গ হচ্ছে, কিন্তু মানালির দোরগোড়ায় এই পাহাড়-প্রমাণ সমস্যার কোনো আশু ফলপ্রদ চেষ্টা নজরে এল না। মাঝখান থেকে বন্ধুদের পিছনে গাড়িতে ফেলে, জ্যামের কোথায় শুরু দেখতে গিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে মানালি ব্রীজে পৌঁছে গেলাম।
দ্বাদশ অবস্থানঃ টুকরো অবস্থান সমূহ!
কুটুম বাড়িঃ আমাদের মধ্যে দুজন, এর আগেরবার যখন মানালি এসেছিল, বশিষ্ঠের কাছাকাছি, প্রকৃতির ল্যাপটপে রাখা এক পাহাড়ি বসতির কোনও এক ধাপে ফল-ফুল-সবজি বাগানসম্বলিত এক আস্তানায় ছিল। আতিথেয়তা আর আন্তরিকতায় সম্পৃক্ত দুজনেই সেবারই সেই হোম-স্টে'র মালকিনের সাথে কুটুম পাতিয়ে গিয়েছিল। এবার মানালিতে পা-দেওয়ার পরেই সেখানে খবর চলে যায় এবং আমরা আজকের সন্ধ্যেটা রেখেছিলাম তাঁর আমন্ত্রণের জন্য। হেঁটে হেঁটে তো একাই হোটেলে ফিরে এলাম, কিন্তু আমার জন্য আটকে পড়ল বন্ধুরা। তারা ভেবেছিল একেবারে সেই হোম-স্টে থেকে ঘুরে এলেই হয়। আমার সঙ্গে, পোড়ার কপাল, যোগাযোগও করতে পারা যাচ্ছে না, কারণ ফোন ফেলে এসেছি গাড়িতেই। এসব পরে জানতে পেরেছিলাম হোটেল থেকে ওদের ফোন করে। তারপর শুরু করলাম আবার হাঁটা বশিষ্ঠের দিকে। আমায় তখন হাঁটায় পেয়েছে। আর অল্প দূর গিয়ে গিয়েই অজানা লোকের থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে ফোন করে করে ওদের সঠিক অবস্থান জানার চেষ্টা করছি। এমনকি হিচ্-হাইক করে লিফ্টও নিলাম এক স্থানীয় তরুণের মোটর-বাইকে। খুব এন্জয় করছিলাম সেই সময়টা। বন্ধুরা অবশ্য তা নয়। দেখা হতেই সেটা বেশ টের পেলাম।
সদাহাস্যমুখ নির্ভেজাল এক মাতৃমূর্তি, আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে নিয়ে বসালেন। দেখলাম ঘরের মাঝখানে মেঝেতে আসন পাতা, সামনে সামান্য উঁচু জলচৌকি। শীতল পানীয় জল এলো। আমরা সেদিন খেলাম স্টীম্ড সৌফ্লে। আমার বিদ্যায় বুঝিয়ে বলতে হলে, বলতে পারি, আমিষ / নিরামিষ পুর দেওয়া ভাপা পিঠে। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গতে আঞ্চলিক চাটনি। খাসা খেতে। তবে আমাদের আপ্যায়নে গৃহকর্ত্রী যে বিশাল মাপের এক-একটা বানিয়েছিলেন, একটার বেশি কেউ খেতে পারিনি। দুপুরে তেমন দানা-পানি পড়েনি পেটে, তবু অপ্রাপ্তি ও হয়রানির অবসাদে শরীর-মন সবারই কিঞ্চিৎ অবসন্ন ছিল। এ জিনিস সম্ভবত কালিম্পঙেও খেয়েছি, তবে সেটা ছিল ফ্রায়েড, আর মাংসের পুর দেওয়া। আজকেরটা ছিল নিরামিষ। নানা প্রকার সবজির মিশ্রণে অদ্ভুত স্বাদের এক পক্ওয়ান!
বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম যখন, বাইরে ভালোমতো অন্ধকার। অন্ধকার ধাপে ধাপে, ঘরে ঘরে, আঙ্গিনায় নিভু নিভু বালব কী সিএফএল। বেশিরভাগ অন্ধকারটা, এই ছোট্ট ছোট্ট আলোগুলোকে যেন চেপে ধরেছে। আসলে হোটেল এরিয়ায় বাড়ি হলে তো এমন খানিক হবেই; জল, গ্যাস, ভোল্টেজ পর্যটনের মাইলেজ।
হোটেলে ফিরে রাতের খাওয়া সারার আগে ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়া। আগামীকালের মুসাফিরনামা হিড়িম্বা থেকে গায়ত্রী মন্দির থেকে ট্রাউট ফিশারি থেকে নগ্গর রাজবাড়ি থেকে নিকোলাস রোয়েরিখের স্টুডিও ও সংগ্রহশালা থেকে কুল্লু।
কুল্লুতে রিভার র্যাফটিং আর শপিং, তারপর সোওজ্জা মান্ডীতে গিয়ে নাইট স্টে।
হিড়িম্বা মন্দিরঃ হিড়িম্বার পথে যেতে যেতে এক জায়গায় রাস্তা দ্বিখন্ডিত হয়ে একটা প্রান্ত চলে গেছে মনু টেম্পলের দিকে। আমরা ভুলবশতঃ সেই রাস্তাটাই ধরলাম ও কিছুদূর এগিয়ে যখন ভুলটা বোঝা গেল তখন আর পিছনে ফিরে আসার অর্থ হয় না। স'বাবু অপ্রথাগত পথে গাড়ি ঘোরালেন। এ পথ মানালি থেকে হিড়িম্বা যাওয়ার প্রচলিত পথ নয়। বেশ কিছু গৃহস্থের পাড়া। এবং তা বেশ সরু। উল্টো দিক থেকে গাড়ি এলে আটকে পড়তে হতে পারে। তবে তেমন কিছু হয়নি, বরং প্রথাগত রাস্তায় গেলে আমরা লম্বা গাড়ির লাইনের পিছনে পড়ে যেতাম। এক্ষেত্রে আমরা একেবারে মন্দিরের দোরগোড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। তবে এটা মন্দিরের খিড়কির দোর বলা যায়। এটা হিড়িম্বা মন্দির না-হয়ে যদি নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ বা সুরুচি সঙ্ঘের 'দুগ্গোপুজো'র প্যান্ডেল হত, তবে এই যে রাস্তায় এলাম, তার মুখটাতেই দেখতাম, নো-এন্ট্রি ব্যারিকেড দিয়ে কলকাতা পুলিশ বসে আছে। আমার বন্ধু বেশ ভাববার মতো একটা প্রশ্ন তুলেছিল। আচ্ছা, পুজোর সময় বড় রাস্তায় মানুষের ঢল আর গাড়ি-বাস চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে কলকাতা পুলিশ সক্রিয় ভূমিকা নেয়, এটা তারিফযোগ্য। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট পুজো কমিটির প্যান্ডেলের পিছন দিয়ে লোক বেরিয়ে কোন্ পাড়া, কোন্ গলি দিয়ে যাবে আর কোথায় ব্যারিকেড বসবে, এই কাজে কেন কলকাতা পুলিশের কর্মীরা নিয়োজিত থাকবে? সেতো সেই পুজো কমিটির দায়িত্ব, তারা গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে সিকিউরিটি পার্সন বা পাহারাদার মোতায়েন করব ভিড় নিয়ন্ত্রণার্থে, তদুপরি দর্শনার্থীদের পথ দেখাবে! আপনারাও একবার ভেবে দেখতে পারেন।
যাক্গে, আমরা প্যান্ডেলের... সরি, মন্দিরের পাশের একটা সরু গেট পেরিয়ে, কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে মন্দির প্রাঙ্গণে উঠে এলাম।
আগেরবার যে পড়ন্ত বেলায় এসেছিলাম সেসময় মন্দিরে ভিড় বেশি ছিল না। দিনের পুজো হয়ে গিয়েছিল। মনে হয় সন্ধ্যারতির তখনও বাকি ছিল... তবে আজ বেলা প্রায় দশটা। মন্দির ও প্রাঙ্গণ উপচে পড়ছে। নারকেল, চেলি, সেল্ফি, মন্দির পেঁচানো লাইন, থেকে থেকে ঘন্টার আওয়াজ (হ্যাঁ আওয়াজ, ঘন্টাধ্বনি নয়); ইয়াক্, লোমশ মন্ত্রপূত ভেড়া, বুড়ির চুল, সাবুর পাঁপড় ইত্যাদি সঙ্গে জুলজুল তাকিয়ে থাকা স্থানীয় বালক-বালিকা, এমনকি একটা আস্ত বিয়ে... ইত্যকার ব্যস্ততায় ব্যতিব্যস্ত 'হিড়িম্বা-মা।' একপাশে নিজের মনে কাদা-মাটি (সিঁদুর) মেখে খেলে চলেছে পেটের ছেলে ঘটোৎকচ, মায়ের নজর দেওয়ার সময় কই! তবে আগেরবারের মতো এবারও, এত কোলাহলের মধ্যেও এই মন্দিরের কাছে এসে দাঁড়ালে আমি বুনো বুনো গন্ধ পাই। যদিও মন্দিরের চারদিক দিয়ে পিচ বাঁধানো রাস্তা দাপিয়ে হর্ন বাজিয়ে হুড়মুড় করে এসে পড়ছে ভিড়, তবু বিশাল বিশাল পাইন ঘেরা এই প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে অনুভূতিগুলিকে অল্প চেষ্টায় যদি এই ভিড়ের উর্দ্ধে নিয়ে যাওয়া যায়, বিশ্বাস করুন, এই মন্দিরের গঠন, গায়ের রঙ, কারুকার্য, আশপাশ সমস্তটা নিয়ে বেশ একটা গা-শিউরানো ব্যাপার আছে। দেখলাম পিছনের পার্কটায় যাওয়ার গেটটায় তালা মারা। আগেরবার অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম এখানটায়। সেদিন হাতে ছিল একটা এস এল আর ফিল্ম ক্যামেরা (আহ্লাদী মিনোল্টা)। এবার আর সে ছিল না কিন্তু ক্যামেরা ছিল অনেক রকমের, অথচ বেশিক্ষণ মন টিকল না।
ট্রাউট ফিশারিঃ অস্বীকার করে লাভ নেই, বেড়াতে গিয়ে...বিশেষ করে ঠান্ডার জায়গায় বেড়াতে গিয়ে অং বং চং এদিক-সেদিক খাওয়া-দাওয়া হয়েই থাকে। মহামান্য শিব্রামের কথায়, হাওয়া বদল মানে তো আর হাওয়া বদল নয়; হাওয়া আবার বদলাবে কি? একই তো হাওয়া, আসল কথা হল গিয়ে 'খাওয়া বদল।' এই সুবাদে গায়ত্রী মন্দির ঘুরে নগ্গর রোড ধরে নগ্গর রাজবাড়ি যাওয়ার পথে 'হরিপুর নালা' ঘেঁষে এক হঠাৎ ঠেকে এসে ঠেকল আমাদের সাফারি। রাস্তার ডান দিকের ঢাল ধাপে ধাপে নেমে অতি-চঞ্চলা কোনো-এক নালার খাঁইয়ে গিয়ে মিশেছে। এই নাতিদুর্গম খানিক প্রশস্ত পাহাড়ি ধাপ-সিঁড়িগুলিকে ঘিরে ফেলে, সাজিয়ে গুছিয়ে, ভীষণ প্ল্যান মাফিক তৈরি হয়েছে হিমালয়ান ট্রাউট ফিশ ফার্ম, মানালি। পোস্ট- হরিপুর, তহ্সীল- মানালি, জিলা- কুল্লু।
মাছের সাইজ স্ট্যান্ডার্ড রাইস্-প্লেটের পরিধি ছাড়াবে না। সেদিক থেকে ছোটই বলা চলে। মোট তিন প্রকারের ট্রাউট আর রেসিপি মোটামুটি ভাপা, ভাজা আর ঝোলের। সঙ্গে বেশ রেস্তোরাঁচিত কায়দার পরিবেশন। তবে পরিবেশনটা মুখ্য নয়; মুখ্য হল পরিবেশটা। চারদিক উন্মুক্ত ছাউনির নীচে খেতে দিয়েছে। কোল ঘেঁষে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ঝমঝম উল্লাসে এই ছোট্ট পরিসরের সমস্তটুকুকে মাতিয়ে দিয়ে যাচ্ছে হরিপুর নালা। এর নির্ঘাত কোনো মনকাড়া নাম রয়েছে। যদি না থাকে তবে এখনই রাখা উচিত।
ওই অশান্ত ঝোরা থেকে আপনার লেন্স ফার্মের অভ্যন্তরে ফেলুন, দেখবেন বিভিন্ন ধাপে ধাপে পাশাপাশি লম্বালম্বি অনেকগুলি পুল। যার মধ্যে অবিরাম খলবল করে চলেছে অসংখ্য ট্রাউট। প্রাকৃতিকভাবে জলের সরবরাহ, ভারি মুন্সিয়ানার সঙ্গে নিজেদের মাছের বাগানের জলাধারগুলোর মধ্যে দিয়ে বইয়ে দিয়ে, ছিমছাম শৃঙ্খলিত উপায়ে ঝোরার জল ঝোরাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ফার্মটি। সদ্যজাত ফোটোগ্রাফারদের জন্য এ যেন এক স্বর্গোদ্যান। এই মৎসোদ্যানের উচ্চাবচ ধাপগুলির ওপর দিয়ে ক্যামেরা হাতে ছটফট করে চলেছি এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, যেন আমিই এক পাগলপারা পাহাড়ি ঝোরা!
গায়ত্রী মন্দিরঃ মাছ নিয়ে এমন মেতে গেলাম যে বলতে ভুলেই গেছি, নগ্গরে ঢুকে প্রথমেই গিয়েছিলাম গায়ত্রী দেবীর মন্দির দেখতে। মুখোমুখি একটি বড় একটি ছোট মন্দির (ঠিক মুখোমুখি না, গিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন), আর একটি বাচ্চাদের স্কুল, আর একটি দুর্গা দালান-কাম-নাটমঞ্চ, আর গোটাকয় বৃক্ষ... হাত ধরাধরি করে বেড় দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একই খোলা চত্ত্বরে। সকালের রোদ তখন গাছ-পাতা-মন্দিরের কার্ণিশ ছুঁয়ে তির্যক; মাটিতে আলো-ছায়ার আলপনা।
মন্দির দুটির একটি শিবের মন্দির আর অপরটি গায়ত্রী দেবীর (বড়টি)। পাথরের তৈরি শিব মন্দিরটিই প্রাচীনত্বের দাবীদার, যদিও সম্পর্কিত কাহিনি লতিয়েছে কাঠ ও পাথরে তৈরি অপেক্ষাকৃত নব্য ভাবধারার গায়ত্রী মন্দিরকে জড়িয়ে। সে কাহিনি আমার মনেও আছে কতক আবছা... ঘুরে-ফিরে সেই পঞ্চপান্ডবেরই গল্প (আদি), সেই অজ্ঞাতবাসের দিনগুলি। এমন হাড়-কাঁপানো পাহাড়ি ধু ধু জঙ্গলে, পোড়ার কপাল সারাদিনে না তেমন ভিক্ষা জুটেছে, না তেমন ফল-মূল।
(আমি জানি, আমি জানি আপনারা, তীর-ধনুক-শিকার-ঝলসানো হরিণের মাংস এসব ভেবে ফেলেছেন, তাইতো?)
আমায় যে ব্যক্তি গল্পটা বলেছিলেন, ওসব তিনি বলেননি, আমিও জানতে চাইনি। কি দরকার বাবা, রাত-বিরেতে জঙ্গলের মাঝে আগুন জ্বালিয়ে হরিণের মাংস ঝলসাতে গেলে যদি অজ্ঞাতবাসের বারোটা বেজে যায়!
(ও! আমি ভুল ভেবেছি, আপনারা আসলে ওসব কিছুই ভাবেননি? ও বাবা, বলেন কি!) গল্পটা আপনাদের জানা?
তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। জানেনইতো পান্ডবরা সামান্য ভিক্ষা নিয়ে এসে, সারাদিন পর ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত... এতটাই যে চুলা বানিয়ে সামান্য দুটো ভাতে-ভাত ফুটিয়ে নেবে, সে তাকত আর অবশিষ্ট নেই দেহে। লুটিয়ে পড়ছেন এ-ওর গায়। শুনেছি এভারেস্ট সামিট করতে যেসব পর্বতারোহীরা আজ অবধি গিয়েছেন, অভিযানের একেবারে শেষ পর্যায়ে, ওই চরম প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে, প্রায় কোলাপ্স ক'রে আসার মতো অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে অনেকেরই। অনেকেই তখন, ব্যাখ্যারও অতীত, অথচ তাঁদের কোনো সাথী বা বন্ধু-প্রিয়জন বা 'পরে তার কথা মনেই পড়েনা' এমন কাউকে হ্যালুসিনেট করেছেন। আর সেই সব কাল্পনিক চরিত্ররা, অকল্পনীয়ভাবে এই হারতে বসা মানুষটিকে হাত বাড়িয়ে ডেকে তোলেন, একেবারে তলিয়ে যাওয়ার আগে। নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলেন তার পায় পায়। প্রায় সংজ্ঞাহীন অভিযাত্রীটি যেন এক ঘোরের মধ্যে সামিট অ্যাচিভ করে ফেলেছেন এমনও শোনা গেছে! আর অবধারিত, তারপর আর সেই মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। পান্ডবদের কথা বলতে বসে... ভুল হল, দেবী গায়ত্রীর কথা বলতে বসে এরূপ অবতারণা একেবারে প্রসঙ্গহীন নয়। সেই 'ঘোর' সন্ধ্যায়, সেই পান্ডববর্জিত (sorry) গহীন বনে, এক বালিকা, একা কোথা থেকে যেন উদয় হয়! কুন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলে, "মা দে, তোর ছেলেরা আজ কী এনেছে দে, আমি রেঁধে আনি।" বালিকার কথা শুনে দ্রৌপদী উঠে আসতে চেয়েছিল, (মনে হয় হেল্প করতে), সেই পাকা মেয়ে তাকেও বলে দিল, "থাক না দিদি, খানিক জিরোয় নে। তোরওতো শরীর নাকি! খাটনিতো তোরও কিছু কম যাচ্ছে না।" আদরের এই কথাকটি শুনেই দ্রৌপদী আরামে গা এলিয়ে দেয় ভূঁয়ে। ওই তো পর্ণ-কুটীর, ওটাই হোম, ওটাই হেঁসেল। ঝটিতে রান্না বসল। দেখতে দেখতে মাটির হাঁড়ি ভরে উঠল। মাঝরাত্তিরে ফকিরের কুঁড়েতে যেন, ভাত নয়, ভোরের শিউলি ফুটে উঠল। নিরন্ন হতোদ্যম মানুষগুলো প্রাণান্তকর খিদে দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছিল দিগবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে! যখন হুঁশ এলো, ততক্ষনে পেট মন দুইই ভরে গেছে। আর তখনই খোঁজ পড়ল সেই আশ্চর্য বালিকার! কিন্তু তাকে আর পাওয়া গেল না! বিমূঢ় শিশুদের মন ঘোরাতে মা কুন্তী জোড়-হাত কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন, "সাক্ষাৎ মা গায়ত্রী এসেছিলেন গো, আমাদের উদ্ধার করে দিয়ে গেলেন!" বাকি সবাইও মায়ের দেখাদেখি কপালে হাত ঠেকিয়ে গড় করল মা-গায়ত্রীর উদ্দেশ্যে। শুধু ভীম তখনও বিড়বিড় করে চলেছে, "আমি যে পষ্ট শুনলুম আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলে গেল সেই মেয়ে, 'আজ ভাগে একটু কম হল তোমার, তাই না? আজ এট্টু অ্যাডজাস্ট করে নাওনা বাপু!'
কপর্দকশূন্য হলে কী হবে, রাজা রাজাই। তার ওপর ইয়া ইয়া বীর সব, অচিরেই দেবী গায়ত্রীর নামে কাঠ আর পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি হল এক মন্দির, যা এই পরিবেশের সঙ্গে ভারি মানানসই। এই একটা মস্ত ব্যাপার, পরিবেশের-প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই হয়ে চলা। তা-নাহলে, মন্দির তো ব্যাওসাদাররাও বানায়। আজো সেই মন্দিরের কাঠের কারুকাজের পরিচ্ছন্নতা আর কাঠামো দেখলে মনে প্রশ্ন জাগবেই 'কাঠই তো?'
শিবের মন্দিরটিও একইসাথে তৈরি কিনা আমি বলতে পারব না, তবে এ মন্দিরটা আ-কাঠ; শুধু পাথরের।
পরবর্তীতে নগ্গর রাজার রাজবাড়িটিও দেখলাম। দেখতে দেখতে পায় পায় বাঁকে বাঁকে পলকে পলকে অপলক হয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে, পাশের খাদের ওপর প্রায় ঝুলে থাকা প্রশস্ত কোর্ট-ইয়ার্ডের রম্যতা অত্যন্ত আধুনিক আর তার চারপাশের কাঠের দেওয়াল দেখলে মনে হবে পালিশ এখনো শুকায়নি!
তখন বেলা দ্বিপ্রহর। এইখানে আকাশ-জুড়ে কালো মেঘ। পেইন্টার-কাম-বিজ্ঞানী রোয়েরিখের অত্যাশ্চর্য বাড়ি-পরিবর্তিত-সংগ্রহশালা অধরা রেখে গাড়ি ঘোরালাম কুল্লুর দিকে।
অ্যাডভেঞ্চারঃ বলতে বিপাশায় র্যাফটিং। খুব যে রাজি ছিলাম আমরা দুজন তা নয়। একে ভয়, দুয়ে বাজেট। তবে বন্ধুরা শেষমেষ আমাদের রাজি করিয়ে ছেড়েছিল। তুল্যমূল্য বার্গেনিং-এর পর সম্ভবতঃ পার হেড নশো টাকায় রফা হয়েছিল। আমরা ছজন, একটা হাওয়ার-ভেলা, সঙ্গে একজন ড্রাইভার। নয় কিলোমিটার গড্ডলিকায়। বারোশো টাকা এক্সট্রা চাইছিল পুরো জার্নিটা রেকর্ডিং করে সিডি-তে দিয়ে দেবে। প্রথমে আমরা রাজি হইনি। জলে নেমে, চলতে শুরু করে মনে হলো, এসবটা ধরে রাখলে বেশ হোতো। আমাদের বোট-চালক মনে হয় মাইন্ড-রিড করতে পারেন। প্রস্তাব এল ছ'শো টাকায় রেকর্ডিং হয়ে যাবে। আমরা এক কথায় রাজি। ডাঙায় যা বারোশো, জলে ছ'শো। জলে বস্তুর ভার হালকা লাগে জানতাম, তাই বলে... এ সমস্তই অ্যাডভেঞ্চার শুরুর আগের বকবক। তারপর আমরা বাক্যহারা! যা এক্সপেরিয়েন্স করেছি তার জন্য চিরকাল বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। বরফ ঠান্ডা জল, গায় আঁট করে বাঁধা লাইফ-জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট... আর উর্দ্ধশ্বাস কিছু দুর্ধর্ষ মূহূর্ত!
এখন আপনি যদি আমার কাছে আবদার করেন গোলবাড়ির কষা মাংস কেমন খেতে বর্ণনা করে বোঝাতে, সেও কি সম্ভব?
ফেরা-র ফেরারীঃ আপনার যেমন-বেনী-তেমনি-রবে-চুল ভেজাবেন না, তাহলে কিন্তু ওয়াটার র্যাফটিং আপনার জন্য নয়। সর্ব্বাঙ্গ ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবে। সঙ্গে এক্সট্রা জামা-কাপড়, আর গামছা সোয়েটার ইত্যাদি ডাঙ্গায় মজুত থাকে যেন। যেখানে র্যাফটিং শেষ হবে, সেখানেই চেঞ্জ-রুম আর ক্যামেরা থেকে সিডি করার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের স'বাবুও সেই অবধি গাড়ি নিয়ে এসে আমাদের অপেক্ষা করছিলেন। এবার যাব কোনো একটা শাল ফ্যাকট্রি। পর্যটকদের শপিং ডেস্টিনেশন। তারপর ফেরার শুরু। আজ রাতটা কাটাব মান্ডীর কোনো পান্থশালায়। কিছুটা এগিয়ে থাকা আর কী। কাল সকালে একটু দেরী করে রয়ে-সয়ে বেরোলেও চলবে। ট্রেন তো সেই রাতে।
আজ সকাল থেকেই স'বাবু মাঝে মাঝেই গাঁই-গুঁই শুরু করেছেন, আমরা এক্কেবারে ঢিলে দিচ্ছি না। সকালের দিকে বলে চলেছেন - ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা করে অনেকটা দেরী হয়ে যাবে, আপনারা কুল্লুতে থেকে যান। কুল্লুতে আমার জানা ভালো হোটেল আছে। কাল সকাল সকাল রওনা হয়ে যাব। আমরা পাত্তা দিইনি। যখন দেখা গেল কুল্লুতে সব কিছু ভালোমত সেরেও আমাদের হাতে যথেষ্ট দিনের আলো আছে মান্ডী পৌঁছে যাওয়ার মতো, তখন থেকে ওনার আরেক বায়না, "মান্ডী যাকে কেয়া করেঙ্গে, চেইল্ চক্ চলিয়ে" (এ চেইল্ সিমলার চেইল্ নয়)। এতো আচ্ছা বিপদ! দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে রাখলাম - আমরা মান্ডীই যাচ্ছি, কোনো প্রবলেম? এরপর আর কথা চলে না। স'বাবুও নিশ্চুপে গাড়ি ছোটালেন।
সময় বিকেল (কটা হবে?) সাড়ে চারটেঃ গাড়ি বিয়াসকে বাঁহাতে রেখে কুল্লু ছাড়ালো। এখান থেকে মান্ডী আশি কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তা ভালোই। মোটামুটি নদীর পাশেপাশেই যাব। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ব্রীজ দিয়ে নদীটাকে টপকাবো, তবে মোটের ওপর বিয়াসের তীর ধরে চললেই ঘন্টা আড়াই, বড়জোর তিনেকের মধ্যে মান্ডী বাস স্ট্যান্ড। নেমে এদিক ওদিক একটু খুঁজলেই কোনো একটা চলনসই মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে যাব সিওর। আজ রাতটুকুই তো...
সময় তখন (প্রায়) সাড়ে পাঁচটাঃ গাড়ি চলার পর থেকে বেশ কিছুক্ষণ আমরা র্যাফটিং ছেড়ে বেরোতে পারিনি। এবং বিয়াস। অপরূপা। এই নদীটির (বিশেষতঃ কুল্লু বরাবর) অপ্সরা গুণ রয়েছে বিশ্বাস করুন, আবিষ্ট করে রাখে। বিয়াসের ঢেউয়ে ঢেউয়ে এসে পড়ল সবে সবে পেরিয়ে আসা দিনগুলির স্মৃতি। আমরা রোমন্থিত।
সময় (গড়িয়ে) সাড়ে ছটাঃ আশপাশটা এবার কেমন যেন মনে মনে পড়ে যাচ্ছে। ওই তো ওই ব্রীজটা পেরিয়ে এবার ডান দিকে বেঁকতে হবে... আসার সময় বাঁ দিকে বেঁকেছিলাম... এইসব নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছি। স'বাবু স্টিয়ারিং-এ অবিচল। প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পথ পেরিয়ে এসেছি বলা যায়। অনুভূতিতে 'এসে গেছি প্রায়'রকমের হাল্কা আভাস পাচ্ছি। ঝকোমকো হাসি-খুশির মুহূর্তগুলোকে গলাছাড়া গানে পেয়ে বসল আর আমরা গেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলাম এ-ওর গায়। বিশেষ করে আমরা যে দুই বন্ধু গাড়ির একদম পিছনের সীটে ছিলাম। মাঝের সীটে তিনকন্যা, আমাদের সাথে সাথ দিচ্ছিল, আর সামনের সীটে আরেক বন্ধু স'বাবুর পাশের সীটটায়, বলা যায় আমাদের এই সফরের কান্ডারী।
গাড়ি কখন যে চেনা চেনা পথটাকে ডাইনে ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে বেঁকে অন্য একটা পাহাড়ি রাস্তা নিয়ে নিল, ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি। সামনের বন্ধুটি একবার কৌতূহলী হল; স'বাবুর থেকে খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর এলো, "ইয়ে শর্ট-কাট হ্যায়।" পিছনের সীটে, আমরা আবার মশগুল হয়ে গেলাম। মাঝের সীট থেকে একবার আমাদের নাড়া দেওয়া হল, "তোমরা কি বুঝতে পারছ, আমরা একটা সম্পূর্ণ আনকোরা রাস্তায় ঢুকে পড়েছি?" তবু হুঁশে আসতে সময় নিচ্ছিলাম আমরা।
আলো ততক্ষণে বেশ কমে এসেছিল, এবার হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসাতে গাড়ির হেডলাইট জ্বালাতে হল। নিস্তব্ধতায় পেয়ে বসল আমাদের। কারো মুখে কথা সরছে না। এ কোন্ জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছি! আরও যে গভীরে চলে যাচ্ছি। খানিক আগের অল্প আলোতেও নীচের খাদে বা পাহাড়ের গায় গ্রামের খেলনা খেলনা বাড়িগুলো দেখে আমোদিত হচ্ছিলাম। এখন সব উধাও। গাড়ির আলোর বাইরে নিকষ অন্ধকারের চাপ। সেই চাপ মনের ভেতর পর্যন্ত চারিয়ে যাচ্ছে।
"মতলবটা কি?" সত্যিই এটা শর্ট-কাট? কোথাকার শর্ট-কাট? বহুক্ষণ না পিছন থেকে, না সামনে থেকে, কোনো গাড়ি পাস্ করেছে। এ রাস্তায় কোনো কাঠুরিয়া কী গ্রামের লোকজন চোখে পড়ছে না। আক্ষরিক অর্থেই শুনশান রাস্তা তার পিঠ থেকে আমাদের গাড়ির হলুদ আলো ফেলে দিচ্ছে অন্ধকার খাদে, আর তুরন্ত্ বাঁক নিয়ে নিচ্ছে অল্প সময় পরপরই। পিছনের সীট থেকেও দিব্যি মালুম হচ্ছে স'বাবুর চোখের মণিগুলো এখন পাথরের মতো নিশ্চল আর ঠান্ডা। কটা বাজে মোবাইলে দেখতে গিয়ে আবার চমকে উঠলাম, সর্বনাশ! এ রাস্তায় টাওয়ার থাকছে না সবসময়। সাতটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ! এ কী ধরনের শর্ট-কাট? স'বাবুর ছোট্ট উত্তর, "বস্ আ গয়ে।"
উল্টো দিক থেকে নিভু নিভু আলোয় গোটা তিনেক মোটর বাইক ক্রশ করে গেল আমাদের গাড়ি। স'বাবু খুব করে ডিপার-ডিমার দিয়ে আলো কাঁপালেন। ভয় পেলাম 'পূর্ব নির্ধারিত ইশারা নয়তো?' একটু পরেই ভুল ভাঙ্গল। কোথাও কোথাও জঙ্গল খানিক পাতলা হলে এক-আধটা আলোর ফুলকি দেখা যাচ্ছে খেয়াল করলে। কিন্তু আমরা তখন সবাই নানান রকম ভাবে একই কথা ভেবে চলেছি, 'বদলা নেবে নাকি?' 'কিভাবে?' 'খাদে ফেলে দেবে গাড়িটা?' 'ওর তো নিজের গাড়ি নয়!' 'তাই যদি হয়, গাড়ি থেকে বাইরে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য ক'সেকেন্ড সময় পাব? কে কীভাবে ঝাঁপাব? নাকি কোনোভাবে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায় নিজেদের হাতে?' বিশ্বাস করুন, এখন আড্ডায় বসলে সেই সময়ের কথা ভেবে হাসাহাসি করি, কিন্তু তখন শুকিয়ে গিয়েছিল - প্রাণবায়ু!
টাওয়ার পেলাম। মাথায় এলো একজনের নাম, এই অকুল-পাথারে একমাত্র লাইট-হাউস যশবন্ত। ফোন করলাম। ভাব করলাম যেন এমনি একটি বিদায়ী ফোন। তানা-বানা-বাহানায় আমাদের বর্তমান ছেড়েদেমাকেঁদেবাঁচি অবস্থা ব্যক্ত করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বিধি(নেটওয়ার্ক)বাম। অগত্যা টেক্সট। সিরিজ অফ এসএমএস। আমার গার্লফ্রেন্ডকে প্রেমে পড়ে এত ভালো করে গুছিয়ে বড় বড় এসএমএস করিনি, সেদিন প্রাণভয়ে যশবন্তকে যা যা করেছি। এখনও রাখা আছে আমার কাছে সেগুলি।
অদ্ভুত হল, আমার এসএমএস-এর প্রবাহ থামল। গাড়ি আরও একটা আলতো বাঁক নিল, স'বাবু হাত বাড়িয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে ইশারায় দেখালো, 'উঁহা মেরা ঘর।' আর তারপর গাড়ি আর বিশ মিটার মতো গড়ালেই দেখলাম আলো ঝলমলে একটা হোটেল, নাম চেইল্ রিসর্ট। তাহলে 'মতলবটা' এই। আজকের রাতটাও স'বাবু বাড়ির বিছানায় কাটাবেন, আর তাই চেইল চক।
রাত তখন (প্রায়) আটটাঃ নয় নয় করে আমরা প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা ওই জংলী পাহাড়ি আঁকা বাঁকা পাকদন্ডীতে পাক খেয়েছি। মানসিক ও শারীরিক ধকলে আমরা তখন বিদ্ধস্ত।
গাড়ি থেকে নেমেই এ-ওর মুখ চাওয়াচায়ি করলাম, 'এবার তো যা-খুশি তাই রেট চাইবে!' মাথার শিরা দপদপ করলে কেমন অনুভূত হয় আমি মনে হয় প্রথম টের পেলাম। এমন সময় দেখি স'বাবু পিছন থেকে তার মোবাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, 'লিজিয়ে সর্, বাত কিজিয়ে, কেয়া সাবজি আপ ভি কাহা কাহা কেয়া বোলে...' ফোনটা কানে দিয়ে বুঝলাম যশবন্ত। আমার এসএমএসগুলো পেয়ে এদিক সেদিক ফোন করেছে। খোঁজ পেয়েছে ওদের বন্ধু ড্রাইভারের তুতোদাদা এই স'বাবু। আমায় বলল, কোনও চিন্তা নেই, ওকে চিনি, যেখানে নিয়ে গেছে সেটাও ভালো জায়গা, নিশ্চিন্তে থাকুন, কোনও অসুবিধা হবে না, আমি বলে দিয়েছি। মরুভূমিতে কয়েক ফোঁটা শীতল জলের মত কথাগুলো। আমরা একটু হলেও ধাতস্থ হলাম।
সোজা চার্জ করলাম, মান্ডী না নিয়ে গিয়ে এখানে কেন নিয়ে এলে? উত্তর শুনবেন? 'ইয়েভিতো মান্ডী হ্যায় সাব। মান্ডী জিলা মে হি তো হ্যায়, পাস্ মে মেরা ঘর হ্যায়, সুবহ আপ যব চাহো নিকলেঙ্গে...' আমরা তখন ফিউরিয়াস। তুমি জানো আমাদের মান্ডীতে কি প্ল্যান ছিল? এটা কোথায় একটা গন্ডগ্রাম। আমরা কোথায় মান্ডীর বাজার পাব এখানে। আবার সেই গা-জ্বালানে কুল অ্যাটিচিউড, "আরে সাব, মান্ডীমে কুছ নেহি হ্যায়। ইয়ে মেরা দোস্তকা হোটেল হ্যায়। কল্ আপকো মান্ডী ঘুমাতে হুয়ে লে জায়েঙ্গে" বেটাচ্ছেলে এমন জায়গায় এনে ফেলেছে, ছাই কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না, কোন দিকে মান্ডী বাস স্ট্যান্ড, কালকাই বা কতদূর... ধুচ্ছাই! এক বন্ধু বলল একবার ঘর গুলো দেখে আসি। গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাউঞ্জ থেকে সর্পিলাকার সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। হোটেলের রুম দেখে আমাদের চৈতন্য ছানাবড়া! পান্ডববর্জিত গোবিন্দপুরে ময় দানবের প্রাসাদ! এহ্ লুটে নেবে একেবারে! এক বন্ধু ফস্ করে জ্বলে উঠল, 'ইয়ার্কি? বেশি চাইলে থাকব না। বলব সস্তার জায়গায় নিয়ে চলো। যত রাতই হোক'। নীচে নেমে আসতেই বেশ কাঁচুমাচু মুখ করে স'বাবু, "আজ রাত ইঁহা সেট হো যাইয়ে সাবজি। আজ থোড়া অ্যাডজাস্ট কর লিজিয়ে"। আমরা ঝোপ বুঝে কোপ, বললাম সাতশ টাকার এক পয়সা বেশি দিতে পারব না। আপনি আপনার হোটেলিয়ার বন্ধুকে ম্যানেজ করুন। খুব বেশি ম্যানেজ করতে হল না, এগারোশোর ঘর সাড়ে সাতশোয় রফা হোয়ে গেল। আমরাও হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। পরে দেখেছিলাম, আমাদের গোটা ট্রিপের সবচেয়ে ভালো হোটেল আমরা সবচেয়ে কম দামে শেষের রাতটায় পেয়েছিলাম।
চেইল্ রিসর্টে একরাত ও বলার মতো ঘটনা সমূহঃ নিঝুম নিশ্চিহ্নপ্রায় গ্রামে চাঁদের পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে রিসর্টটি। যদিও এক্ষেত্রে আমাদের এখানে আসার কোনোরূপ বাসনাই ছিল না। স'বাবুর থেকেই পরে শোনা, ক্রমে ক্রমে রাস্তা চওড়া করে এটাও একটা এন.এইচ. হয়ে যাবে। তখন এইসব গেঁয়ো জমির দাম চড়ে যাবে। তখন এই রিসর্টের চাহিদাই অন্যরকম হবে। আর এসব হতে চলেছে সামনের কয়েক বছরের মধ্যেই। আমরা অবিশ্বাস করিনি একটা কথাও। খালি ভাবছিলাম উন্নয়নের আগের অবস্থার ছবি তুলে রাখা হল না। কী কী হারাতে চলেছি যদি ধরা থাকত! যদিও এখানে আসার সময় মারাত্মক মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম, তবু বলব, ওই যে পান্দোহ্ নামক এক অচেনা জায়গা থেকে ডাইনে মান্ডী যাওয়ার বাঁকটা মিস করে, গাড়িটা স'বাবুর কথা মত শর্ট-কাট নিয়েছিল, যার জন্য আমরা প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার শর্ট-কাট জঙ্গুলে পাহাড়ি রাস্তায় পাক খেয়েছিলাম, ওই রাস্তার আশে-পাশের পাহাড়, প্রকৃতি, গ্রাম, গাছপালা সমস্তটা নিয়ে জায়গাটা কিন্তু রোমাঞ্চিত করে। বুঁদ হয়ে যাওয়ার মতো ল্যান্ডস্কেপ। রাস্তার বাঁ-পাশ দিয়ে খাড়া খাদ বেশ কিছুটা নেমে যাওয়ার পর বেখেয়ালে ঢেউ খেলে ঢিবির মতো হয়ে আবার ঢিবির ওপাশের ঢাল খাড়া নেমে গেছে কোনো ঝোরার গায়। অবিরাম তোড়ে বয়ে চলা সেই ঝোরা জানান দিয়ে যাবে শব্দে, অথচ তাকে দেখতে পাওয়ার জো-টি নেই। রাস্তার ওপর থেকে বাঁ-দিকে তাকালে ওইইই নীচে সবুজ ঢিবির গোল তালুর ওপর খান চারেক খেলনা দো'চালা, রূপকথার মতো, গাঢ় সবুজের ছায়ায় ছায়ায়। ঘোর লেগে যায় কোথায় এলাম! সেদিন সেভাবে উপভোগ করতে পারিনি। আপনারা করবেন প্লিজ!
মোশন লুজ: মনের ভিতর নানা দুশ্চিন্তার ঘুরপাক, আর সেই ঘুরপাক ভেতরে নিয়ে প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে পাহাড়ের পাকে পাক খেয়ে খেয়ে অবশেষে এই দুর্বিপাকে পড়তে হল আমাদের দলের একজনকে...তিনি আমার স্ত্রী। হোটেলের রুমে ঢুকেই সাফ জানিয়ে দিল তার সব ঘুলিয়ে পাকিয়ে আসছে, রাতে আর কিছু খাবে না। নুন-চিনির জল অগত্যা... আমরা খাওয়া-দাওয়া করেছিলাম, এবার সেই পর্যায়ে যেতে হবে তাই আবার এই লুজ মোশনে সময় মতো ফিরে আসব কথা দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেলাম।
ধরা যাক তার নাম বন্ধুঃ আসলে স'বাবুর বন্ধু, আমাদেরও বন্ধু, সত্যি বলছি ভদ্রলোকের নাম এখন মনে পড়ছে না। বন্ধু মানুষটিকে এক কথায় বর্ণনা করতে গেলে একটা কথাই মাথায় আসে...মিলিটারি। আপনাদের সবার অভিজ্ঞতাতেই থাকবে নিশ্চয়ই, কিছু চেহারা আছে একেবারে দড়ি-পাকানো-পেটাই গঠন, চেহারার সঙ্গে মানানসই চৌকো-পাড়া মুখ, নিষ্ঠুর চোয়াল, কোটরোগত শুকনো চোখ-জোড়া, মাথা-মোড়ানো মিহি কদম-ছাঁটের রেশম, চোখা নাকের নীচ থেকে ওপরের ঠোঁট ঢাকা পুরুষ্টু গোঁফ। এইসব লোক কথা বললে স্বস্তি পাওয়া যায়। গলার টোন শুনে বোঝা যায়, না-রেগে-নেই, নর্ম্যাল আছে। ইনি আবার তার ওপর দরদর করে ঘামছেন। এ লোকের হাতে রান্নাঘরের খুন্তিও বেয়োনেটের মতো লাগবে।
আমাদের রুমগুলোয় জগে রাতের জন্য খাওয়ার জল দেওয়ার ছিল, একটা রুমে মেঝেতে জল পড়ে ছিল সেটা মোছার ছিল, আর আমাদের ডিনার করা বাকি ছিল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বুঝে গেলাম, এই বন্ধু আসলে এই চেইল্ রিসর্টের মালিক-কাম-ম্যানেজার-কাম-কুক-কাম-রুমসার্ভিস-কাম-সুইপার-কাম... মানে মানে ইনিই হলেন এখানকার কামদেব (এই 'কাম' হোলো গিয়া 'কাম সারসে'...ওই কাম আর কী)! আমরা ডিনার টেবিলে বসলাম, মেনুকার্ডও পেলাম কিন্তু ওই 'হঠাৎ' রাত্তিরে এমন একজন 'সকল কামের কাজি'কে দেখে খানিক অনুকম্পায়, খানিক ক্লান্তিতে এবং বাকিটা 'কোনো অপশন না থাকায়' আমরা পরম আনন্দে আলুজিরা রুটি (নাকি ভাত ছিল?) আর ডাল দিয়ে সেরে নিলাম ডিনার। এ'কদিনে এটুকু অ্যাডজাস্ট তো আমরা শিখে গেছি করতে। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো এ-প্লেট ও-প্লেট হাতড়ে মরছি, যদি কয়েক টুকরো এমন আলুও পাওয়া যায় যেকটা খেতে পারার মতো সেদ্ধ হয়েছে অ্যাটলিস্ট। একটু হতাশই হলাম কিন্তু ধৈর্যচ্যুত হইনি। সকালে সব ভালো ভালো হবে ভেবে জল আর এট্টুস আড্ডা খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
ব্যাক টু মোশন লুজ: সকালে যেটা দরকার পড়ল সবার আগে তা হল ORS আর মুড়ি। গতরাতে আরো বার চারেক যেতে হয়েছে। পেটে কিছু না পড়লে খুব দুর্বল হয়ে যাবে শরীর। এখানে ডাক্তার দেখানোর কথা এখন ভাবছি না। ভোরের দিক থেকে ঘুম হওয়াতে আগের থেকে ফ্রেশ। বাইরে বেরিয়ে চেইল্ চক্-এ গেলে বা খোঁজ করলে একটা-না-একটা ওষুধের দোকান তো পাবই। ওষুধ আমাদের কাছেও আছে কিছু কিন্তু ORS... মুশকিল হল মুড়ি পাই কোথায়। এখানে মুড়িকে কীনামে চেনে? ঘরের বাইরে বেরোতেই সামনে পড়ে গেল সেই বন্ধু। দোনোমোনো করেও মানুষটাকেই জিজ্ঞেস করতে গেলাম; আমার হিম্মতটা বুঝুন একবার। শুধু মুখের ভাষায় নয়, হাত নেড়ে অনেকরকম ভাবে জানাতে বোঝাতে চাইলাম আপনাদের কাছে মুড়ি আছে বা এখানে কোথায় পাওয়া যেতে পারে? ভুরু-টুরু কুঁচকে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করলেন বন্ধু বাবু... তারপর ভুরুদুটো আরো কুঁচকে, কপালে ভাঁজ ফেলে, মাথাটা ইষৎ হেলিয়ে তিরিশ সেকেন্ডের একটা ড্রামাটিক পজ নিলেন, তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে আমার থেকেই জানতে চাইলেন, "মেনুকার্ড মে হ্যায় কেয়া?" আমি হতভম্ব! কোনো মতে মনে হয় মাথা নড়ে গিয়েছিল, 'না'! "তব তো নেহি হ্যায়" বলেই চকিতে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন।
বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল হাঁটা দূরত্বে চেইল্ চক্। চার রাস্তার মোড়। বাজার এরিয়া। আধাঘন্টার মধ্যে ওষুধ, ORS আর হ্যাঁ, মুড়ি বগলদাবা করে ফিরলাম। (ঠোঙায় দিল। প্লাস্টিক চলে না। শেখবার মতো।) এও জানতে পারলাম লোকালি মুড়িকে বলে "খিল্লে"। প্রধানতঃ ব্যবহৃত বিভিন্ন পাহাড়ি দেবদেবীর প্রসাদ রূপে। সে মুড়ি ফটফটে সাদা, যেন বেশ কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে। তবে হ্যাঁ, তখন তাই একমাত্র সম্বল। মৃত মুড়ি জল দিয়ে খেয়ে বেশ জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল আমার বৌ। বেলা দশটা নাগাদ সস্তা রিসর্টের দামী খাবারের বিল মিটিয়ে আমরা রওনা হলাম এবারের মতো। খাওয়ার বিল মেটানোর সময় অনুচ্চারে অসেদ্ধ আলুর কথা উঠেছিল। কড়ায়-গন্ডায় হিসেব বুঝে নিতে নিতে বন্ধু বলেছিল, "এক আলু খাকে যব আপকো কচ্চা লগা তো বাকি প্লেট ঝুটা কিঁউ কিয়া, আপকো বোলনা চাহিয়ে থা, খানা নেহি চাহিয়ে থা।" এই বাণী শোনার পর নিজেদেরকে নিজেরাই বললাম ঠিকই তো, লজিক, 'খায়ে কিউ?' আরে ভাই, আপ 'আয়েহি কিউ?' আয়ে হো তো অ্যাডজাস্ট করো, পুরা প্যায়সা দো ঔর চলতে বনো। আমরা আর দাঁড়ালাম না, তড়িঘড়ি গাড়ির ছাদে মাল তুলে দিলাম।
কি বুঝলেন স্যার?
* সিমলা-কুল্লু-মানালি-রোহতাং অবশ্যই বেড়াতে যান কিন্তু হোটেল আগে থেকে (বিশেষতঃ অন লাইনে) বুক করে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। YES সিজনেও না। (যদি খুব বিলাসিতা করে থাকতে চান, তাহলে বলতে পারব না)
* পুরো ট্রিপের জন্য এক লপ্তে গাড়ি-ভাড়া না করলেই ভালো। হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিমের যে সমস্ত বাস আছে সেগুলি যথেষ্ট পরিমানে লাক্সারি (হিমাচল ট্রান্সপোর্টের বাসগুলো নয় কিন্তু)
* সিমলা বা মানালি থেকে একটু আউটস্কার্টে কোনো হোম-স্টে থাকার জন্য বাছতে পারেন, যদি দুটো জায়গায়ই আপনি একাধিক দিন থেকে জায়গা দুটোকে ঘুরে দেখতে চান।
* বরফের সময় না-হলে কুফরি বা ফাগু যাওয়া অর্থহীন, বরং আবারও বলছি নালদেহ্রা যান।
* কম খরচে রোহতাং ঘোরার উপায় হল, হাতে দিন দুই সময় বেশি রাখুন। মানালি থেকে হালকা চালে কেলং-এর জন্য ওয়ান নাইট স্টে পারমিট নিয়ে ফেলুন। যখন তখন পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ি নিয়ে সোজ্জা কেলং চলে যান। যাতায়াতের পথে দু'বার করে ভাল্লো-টি করে রোহতাং-কে দেখে নিন। (তবে অবশ্যই আগে ঠিকঠাক খবর নিয়ে নেবেন, কারণ এবেলা-ওবেলা নিয়মকানুন পাল্টাচ্ছে ওখানে)।
* সিমলা ম্যালের মতো, যতদিন না মানালি ম্যালের ওপর দিয়েও যান চলাচল নিষিদ্ধ হচ্ছে, ততদিন কিন্তু মানালি বেড়াতে গেলে, আর মানালি থেকে এদিক সেদিক বেড়িয়ে মানালি ফিরতে গেলে অকল্পনীয় যানজট ভোগ করতে হবে।
* যদি মে-জুনে যান, বাক্স বোঝাই করে মোটা মোটা সোয়েটার জ্যাকেট ইত্যাদি একদম নিয়ে যাবেন না। চাদর, গ্লাভস, মাফলার, হাফ সোয়েটার এই জাতীয় টুকিটাকি নিয়ে যাবেন। গিয়ে খুব ঠান্ডা লাগলে ওখান থেকে কিছু একটা কিনে নিতে পারেন। ফালতু ফালতু ভূতের বোঝা বইবেন কেন?
* আর কী, শেষ করলাম, ভালো থাকবেন।
- সমাপ্ত -
হিমাচলের তথ্য ~ হিমাচলের আরও ছবি
কাঞ্চন সেনগুপ্তের ছেলেবেলা কেটেছে ইস্পাতনগরী দুর্গাপুরে। কর্মসূত্রে কলকাতায়। ২০০০ সাল থেকে বেসরকারি কনস্ট্রাকশন ফার্ম সিমপ্লেক্সের সঙ্গে যুক্ত। ভালো লাগে লেখালেখি, ছবি তোলা, বেড়ানো। আবার কখনোবা সময় কেটে যায় ছবি আঁকা বা টুকিটাকি হাতের কাজে।