ফিরে দেখা ঝাড়গ্রাম
পার্থ দত্ত
~ ঝাড়গ্রামের তথ্য ~ ঝাড়গ্রাম-বেলপাহাড়ির আরও ছবি ~
ঠিক তিরিশ বছর আগে ১৯৮৭ সালে পুজো পড়েছিল ২০১৭ সালের মতই সেপ্টেম্বরের শেষে, ছুটি ছিল আট দিন। তার সঙ্গে কয়েকদিন ছুটি জুড়ে নিয়েছিলাম সাইকেলে চালিয়ে কাঁকড়াঝোড় যাওয়ার জন্য। তার আগে মুর্শিদাবাদ, বিষ্ণুপুর, বোলপুর-ম্যাসাঞ্জোর ইত্যাদি সাইকেল সফর করে মনেমনে বেশ তালেবর হয়ে উঠেছিলাম, তাই সেবার জঙ্গল যাত্রার আয়োজন। মনে আছে আমরা চারজন প্রথমদিন ভোর পাঁচটায় রওনা হয়ে বাগনান, উলুবেড়িয়া পার হয়ে কোলাঘাট পৌঁছাই প্রাকসন্ধ্যায়। রূপনারায়ণ নদের সেতু থেকে চাঁদের আলোয় ঝিকমিকিয়ে ওঠা জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম, ভুলেই গেছিলাম যে ইতিমধ্যে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমেছে। মেচেদার কাছে জাতীয় সড়কের পাশের এক ধাবায় চা-বিরতি নিতে গিয়ে তাদের আমন্ত্রণে বিচালির শয্যায় সেখানেই রাত্রিযাপন। ধাবার রেডিওতে বিবিধ ভারতীর গান ও রাস্তার ভারী যানবাহনের শব্দ বোধহয় ঘুমের অনুঘটকের কাজ করেছিল। পরদিন পাঁশকুড়া, খড়গপুর, কলাইকুন্ডা হয়ে সন্ধ্যার আগে লোধাশুলি মোড়ের বড় ধাবায় বসে চা খেতে খেতে যখন ভাবছি যে আর তো মাত্র ১৫ কি.মি. গেলেই ঝাড়গ্রাম, ঠিক তখনই হাইওয়ে প্যাট্রোল লেখা ডোরাকাটা জীপের পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন আমাদের গন্তব্য। উত্তরে ঝাড়গ্রাম শুনে তিনি লোধাশুলির জঙ্গলের পথে রাতে নিয়মিত ডাকাতি ও ছিনতাই হওয়ার কথা জানান। আমাদের কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখে উনি আশ্বাস দিলেন, "বেরিয়ে পড়ুন, আমরাও আসছি ওই পথে।" বিকেল সোয়া পাঁচটায় বেরিয়ে ঠিক ছ'টায় আমরা যখন ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকছি তখন পেছন থেকে আসা ওই অফিসার গাড়ি থামিয়ে আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। একটি ক্লাবের সদস্যদের সহযোগিতায় ঝাড়গ্রামের এক বাগান বাড়িতে সে রাত কাটিয়েছিলাম।
গতবছর পুজো শেষ হবার দুদিন পর স্মৃতির উজানে ডুব দেবার বাসনায় পুত্রকে সঙ্গী করে দুপুর নাগাদ ঝাড়গ্রাম পৌঁছে জানলাম যে এখানকার বনবাংলো আজ আমরা পাচ্ছি না, কারণ এক ভিভিআইপি-র সেদিন বাংলো ছেড়ে দেবার কথা থাকলেও তিনি সিদ্ধান্ত বদল করে থেকে যাওয়া মনস্থ করেছেন। অগত্যা আমদের রাতের আস্তানা হল লোধাশুলি পেরিয়ে খড়গপুরের রাস্তায় প্রায় ২৭ কি.মি. দূরের নির্বান্ধব বালিভাসা বনবাংলো। এই যাত্রায় গাড়িতে লোধাশুলির জঙ্গল পেরোতে পেরোতে সেই অন্ধকার জঙ্গলপথে সাইকেল যাত্রার রোমাঞ্চ মনে পড়ছিল ভীষণভাবে – সেই ক্লান্ত শরীরে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ১৫ কি.মি. পথ অতিক্রম করার সংকল্প।
পরদিন খুব সকাল সকাল বেরিয়ে ঝাড়গ্রাম পৌছানোর আগে বাঁহাতি পথে এগোলাম জামবনীর কনকদুর্গা মন্দিরের উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল ছোট্ট একটা গ্রাম কেন্দুয়া – এখানে কয়েকটি গাছে কয়েক মাসের জন্য পরিযায়ী পাখিরা এসে আশ্রয় নেয়। ডিম পাড়ে, শাবকরা স্বাবলম্বী হলে আবার ফিরে যায় নিজেদের জায়গায়। গ্রামবাসীরা চোখের মণির মত আগলে রাখে এই পক্ষীকুলকে। শুনেছিলাম আগেই, এখন দেখে আরও ভালো লাগল।
মূল রাস্তা থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে গাড়ি এগোল মন্দিরের দিকে। ডুলুং নদীর পাড়ে চিল্কিগড় সত্যিই প্রকৃতির জাদুঘর। অতীতের পঞ্চরত্ন মন্দিরটি ভাঙা ও পরিত্যক্ত অবস্থায় অজস্র গাছপালাকে আশ্রয় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে নতুন করে মন্দির হয়েছে অষ্টধাতুর দেবী কনকদুর্গার। এই সাতসকালে মন্দিরচত্বর একেবারে শুনশান। মন্দির খুললে লোকসমাগম হয় আর রামভক্তরাও প্রসাদের আশায় মন্দিরচত্বরে হানা দেয়। মন্দিরের থেকেও আমার কাছে বেশি ভালো লাগলো মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটি, পায়েচলা রাস্তার পাশে বর্ষা অরণ্যের মত ঘন গাছগাছালিতে ছাওয়া। ভেষজ গুণসম্পন্ন গুল্ম, লতা ও গাছ এখানে প্রচুর। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আঁতকে উঠি, পরপর দুটি দাঁতাল হাতি – যদিও পরক্ষণেই ভুল ভাঙে ওগুলি মনুষ্য নির্মিত। ডুলুং নদী পেরিয়ে চিল্কিগড়-এর সামন্তরাজাদের রাজবাড়ি, বর্তমানে তার কিছু অংশে শিশু বিকাশ প্রকল্পের দপ্তর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটি প্রাচীন মন্দির। আবার রওনা হলাম, গিধনি পার হয়ে পরিহাটি, সেখান থেকে ১৯ কি.মি. (PWD বোর্ড-এ ছিল ২৯ কি.মি.) গিয়ে পৌঁছালাম বেলপাহাড়ি। আমাদের সাইকেল ভ্রমণের বেলপাহাড়ি ছিল ছোট্ট একটি গঞ্জ, ভাতের হোটেল খুঁজে বের করতে হয়েছিল। রাস্তা ছিল অনেক নির্জন - ঝিম ধরা। মনে পড়ল বনবাংলোর হাতায় এক ইঁদারার জল তুলে আমাদের স্নান পর্ব সেরেছিলাম সেবার। এবার আমাদের অবস্থান হবে সেই বনবাংলোয় – সেই ইঁদারাটা কি এখনও আছে? দেখা যাক।
সকাল নটা – একটা দোকান থেকে সকালের খাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়া। বাঁশপাহাড়ির পথে এগোতেই আবার স্মৃতি রোমন্থন শুরু হল। সেবার এই জঙ্গলে ঘেরা রাস্তাটি ছিল অপ্রশস্ত আর গাড়িঘোড়ার সংখ্যাও ছিল নগণ্য। মজা করে আমরা রাস্তার মাঝে শুয়ে বিশ্রামও নিয়েছিলাম কয়েকবার। আর আজ ঝকঝকে প্রশস্ত রাস্তায় হু হু করে চলেছে আমাদের গাড়ি। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে মাথায় অথবা সাইকেলে কাঠের বোঝা চাপিয়ে চলেছে স্থানীয় মানুষজন অথবা গরু ও ছাগলের দলকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে লাঠি হাতে রাখাল। মূল রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ডানদিকের একটা কাঁচা রাস্তায় ঢুকে পড়লো। ইতিমধ্যে আশেপাশে ছোটো ছোটো পাহাড়ি টিলা চোখে পড়ছিল। উঁচু নিচু রাস্তায় খানিকটা গিয়েই বাঁদিকে একটা ছোট টিলার সামনে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা চড়াই ভেঙে টিলার উপর পৌঁছে দেখলাম লম্বা লম্বা মাঝারি মাপের কিছু পাথর প্রাকৃতিক কারণে একে অন্যের ওপর পড়ে মাঝে একটা অল্প দৈর্ঘ্যের গুহা সৃষ্টি হয়েছে। গুহাটি আহামরি কিছু নয় কিন্তু নির্জন টিলার মাথায় জঙ্গলঘেরা গুহার মুখে বসে নানা রকমের পাখির ডাক শুনতে শুনতে জায়গাটিকে বেশ ভালোই লাগল। লালজল গুহা নামে পরিচিত এই জায়গাটি।
টিলা থেকে নেমে কাঁচা রাস্তা ধরে ফিরে এসে মূল রাস্তায় পৌঁছে গাড়ি এগোল ভুলাভেদা, বাঁশপাহাড়ির দিকে - দুপাশে শালের জঙ্গলে ঢাকা এই রাস্তায় সেবার আমরা হাতির পু্রীষ দেখতে পেয়ে তাদের সশরীরে আবির্ভাব আশা করেছিলাম। সে আশা পূর্ণ হয়েছিল ভুলাভেদা থেকে কাঁকড়াঝোড় যাওয়ার মোরামফেলা জঙ্গলপথে, যখন আমাদের সামনে একসাথে দুটি হাতিকে দুলকি চালে নেমে আসতে দেখে সাইকেল নিয়ে চম্পট দিতে হয়েছিল প্রায় ভুলাভেদা অবধি। যদিও রেঞ্জ অফিসারের সৌজন্যে আমাদের সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসাবে থাকা বগলু মুড়াকে অনেক সাধ্যসাধনা করে, হেঁটে অনেক ঘুরপথ ধরে সাইকেল ঠেলে ঠেলে এবং শেষ পর্যন্ত সাইকেল ঘাড়ে করে কাঁকড়া ঝরনা পার হয়ে রাত দশটায় আমাদের গন্তব্যে পৌঁছেছিলাম।
এসমস্ত ভাবতে ভাবতে কখন ভুলাভেদা পার হয়ে এসেছি বুঝতে পারিনি, চাকাডোবা থেকে আমাদের গাড়ি বাঁদিকে বাঁক নিল, এখন এই পিচঢালা রাস্তাই চলে গেছে কাঁকড়াঝোড়। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, বাড়ির উঠোনে বাবুই ঘাসের দড়ি তৈরিতে ব্যস্ত হাত। একপাল গরু নিয়ে একরত্তি ছেলে- কিন্তু ঝকঝকে রাস্তা ও বিজলি বাতির কল্যাণে সেই ছেলের অবাকহওয়া চাউনি বেবাক উধাও। দুপাশে জঙ্গল, মাঝে মাঝে তার বুক চিরে চলে গেছে ছোট দু-একটা ঝরনা। এমন করে চলতে চলতে পৌছালাম কাঁকড়াঝোড়। সামনের ঢালাই রাস্তা চলে গেছে লাকাইসিনি পাহাড়ের দিকে, দূরে দেখা যাচ্ছে সেই পাহাড়চূড়া। সেবার মাঝবিকালে রথু মুন্ডাকে সঙ্গে নিয়ে ওই পাহাড়ের ওপর চড়ে ঘাটশিলার বিস্তীর্ণ অংশ দেখতে পেয়ে আপ্লুত হয়েছিলাম। দলমা পাহাড়ের থেকে হাতির পাল সভা বসাত এই পাহাড়ে – এমনটাই জানিয়েছিলেন রথু মুন্ডা। হাতির ভয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার বনপথ ধরে আমাদের গাইডের পিছু পিছু কত দ্রুত নেমে এসেছিলাম ভাবলে এখনও শিহরিত হই। কিন্তু... আমাদের সেই কাঁকড়াঝোড় কই? চারিদিকে এত পিচঢালা ও কংক্রিটের রাস্তার মাঝে কাঁকড়াঝোড়কে তো খুঁজে পাচ্ছি না!
মাহাতোর দোতলা মাটির বাড়িটি যদিও এখনও দাঁড়িয়ে আছে যা সে সময় হোম-স্টে হিসাবে ব্যবহৃত হত এবং আমার ধারণা এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম হোম-স্টে। গভীর রাতে সাইকেল ঘাড়ে করে যে ঝোরা পেরিয়ে আমরা এসেছিলাম – সেই কাঁকড়া ঝোরা কেমন করে যেন রঙ পাল্টে গেরুয়া হয়ে গেছে। খুঁজে খুঁজে সেবারের রাতের আস্তানাটা দেখতে চাইলাম – পেলামও, উইয়ের ঢিপি আর আগাছায় গ্রাস করা টিনের চাল দেওয়া ঘরটিকে দেখেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। ওটা ছিল তখনকার বিট অফিসারের ঘর – কিন্তু এমন হল কেন? উত্তর পেলাম না। একটু এগোতেই একটা খড়ের চালের ঘরে দুজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে বসে থাকতে দেখে আলাপ করতে এগোলাম। অল্প বয়সী দুটি ছেলে, এখানেই বাড়ি। তাদের সঙ্গে একথা সেকথা বলতে বলতে জানতে চাইলাম, আমাদের রাতের অন্ধকারে পথ দেখিয়ে কাঁকড়াঝোড় পৌঁছে দিয়েছিলেন যে বনকর্মী সেই বগলু মুণ্ডাকে চেনে কিনা। একটি ছেলে বললো, হ্যাঁ উনি তো আমার দাদু ছিলেন। ছিলেন...? হ্যাঁ এখন আর নেই, বছর কয়েক হল মারা গেছেন। সত্যিই তো তিরিশ বছরটাতো নেহাত কম সময় নয়! সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে আরও একবার লাকাইসিনি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ি ফিরে চলল আর আমার মনে পড়ল সেবার লাকাইসিনির মাথা থেকে দূরে ঘাটশিলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ঘাটশিলা হয়ে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে সরু পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে ঘাটশিলা যাবার পথে এক পদ্মফুল ফোটা দিঘির ধারে সাইকেলের চাকা লিক হয়ে গিয়েছিল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ভাবনায় ছেদ পড়ল, চাকাডোবা থেকে গাড়ি আবার ডানদিকে বাঁক নিয়ে ভুলাভেদার পথে চলেছে। ভুলাভেদার রেঞ্জ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল এই মোরামবিছানো পথেই আমরা সাইকেল নিয়ে কাঁকড়াঝোড়ের পথে গিয়েছিলাম।
আবার রওনা হয়ে গ্রামের পথ ধরে পৌঁছালাম খান্দারানি ড্যাম। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এই জলাধারটি ভারি সুন্দর, নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে অদ্ভুত এক ভালোলাগা। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা যেমন আসে তেমনই সেসময় পিকনিকের ভিড়ও হয় প্রচুর, যা শান্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। এখন রোদের তাপ বেশ চড়া, বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না। এবার আবার গ্রামের পথে পথে গাড়ি চলল, অল্প সময়েই গাড়ি থামল এক পাহাড়ের পাদদেশে একটি আশ্রমের সামনে। স্বামী যোগানন্দ ও লাহিড়ী মহারাজের অনুপ্রেরণায় গাড়রাসিনি পাহাড়ের কোলে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসে এখানে ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে এই একান্ত নৈঃশব্দের মাঝে ভক্তকুল ধ্যানের মাধ্যমে চিত্তশান্তির পথ খুঁজে পান। আশ্রমের থেকে সামান্য এগিয়ে পায়েচলা রাস্তা উঠেছে পাহাড়ের ওপর। পায়ে পায়ে চলা শুরু করলাম, বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষজনকে নেমে আসতে দেখলাম। পুত্র তার চলভাষ যন্ত্রকে ভিডিও ক্যামেরা হিসাবে ব্যবহার করে পুরো পথের ছবি তুলতে তুলতে আমার পিছনে চলেছে। প্রায় মিনিট পনেরো হেঁটে একটা সুন্দর মন্দিরের সামনে পৌঁছে গেলাম, অল্প বিশ্রাম করে আবার চলতে চলতে পাহাড়ের শীর্ষদেশে। এখানে একটি ছোট্ট শিবের মন্দির, যদিও পাহাড় চূড়ায় শিবের মন্দির বেশ বিরল। এই মন্দিরের পাশে এক বড় পাথর আর তার ওপর থেকে বিস্তীর্ণ সমতলভুমির দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। অন্যদিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে খানিক আগে ঘুরে আসা খান্দারানি জলাধার। এদিক ওদিক থেকে নানা রকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। দুপুর রোদে একটানা চড়াই ভেঙে ঘামে জামাকাপড় ভিজে জবজবে হয়ে গেছে, কিন্তু মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে আবার বেশ তরতাজা হয়ে গেলাম আর নেমে চললাম সমতলে যেখানে আমাদের বাহন অপেক্ষা করে আছে - এবার গন্তব্য বেলপাহাড়ি বনবাংলো।
বাংলোতে এসে স্নান করে দুপুরের খাওয়া সেরে বাংলোর আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে একটু দূরেই সেই ইঁদারার দেখা মিললো, সাইকেল সফরে এসে যেখানে আমরা দুদন্ড বিশ্রাম নিয়ে স্নান সেরেছিলাম। যদিও এখন সেটি পরিত্যক্ত হয়ে গেছে কিন্তু সেগুন, মেহগনির ছায়াঘেরা নিরিবিলি ইঁদারাটি যেন আমায় বলছে, "এত বছর পরেও তোমার মনে আছে আমায়?" চৌকিদার আমাদের খাওয়া হলে চলে গেছেন, পুত্র তার তোলা ছবির গুণাগুণ বিচারে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে এই বিশাল চত্বরে আর কেউ নেই, শুধু টিয়াপাখির ঝাঁক চিৎকার করে উড়ে যাচ্ছে এক গাছ থেকে অন্য গাছে।
একটু বেলা পড়তেই দেখি বনকর্মীরা রেঞ্জ অফিসারের নেতৃত্বে হাতি খেদাও অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম লালগড়ের জঙ্গলে প্রায় সত্তরটি হাতির একটি দল বেশ কয়েকদিন ধরে রয়েছে, গ্রামবাসীদের ক্ষয়ক্ষতি বাঁচিয়ে তাদের নিরাপদে দলমা ফেরত পাঠানোর চেষ্টায় গত তিনদিন ধরে বনকর্মীরা লাগাতার 'হুলা পার্টি' নিয়ে রাত জাগছেন। হাতি তাড়ানোর বিভিন্ন সরঞ্জামের মধ্যে হাত কামান গোছের একটা বস্তু এবং তার প্রয়োজনীয় বারুদও রয়েছে দেখলাম।
যাইহোক, আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম ঘাঘরা প্রপাতের উদ্দেশ্যে, দূরত্ব মাত্র ৬ কি.মি. হবে, তাই অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম গাছগাছালিতে ঘেরা পাথুরে ঝরনা ঘাঘরার কাছে। তারাফেনি নদী চলতে চলতে এখানে এক পাথুরে জায়গার উপর দিয়ে গেছে আর একটা ছোট প্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা এখনো পুরোপুরি বিদায় নেয়নি, ছোটো নদীতেও জলের পরিমাণ কম নয়। সাদা ফেনার তুফান তুলে কিছুদূর গিয়ে ঘাঘরা আবার শান্ত তারাফেনি নদীতে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরিবিলি এই ঝরনার পাশে কাটিয়ে এবার চললাম শেষ দ্রষ্টব্য তারাফেনি ব্যারাজ এর দিকে। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে তারাফেনি ব্যারাজে পৌঁছে মনটা উদাস হয়ে গেলো। বিশাল জলাধারের পিছনে উঁকি দিচ্ছে ছোটো ছোটো পাহাড়শ্রেণী আর অন্য দিকে ব্যারাজের গেট দিয়ে সশব্দে গড়িয়ে পড়ছে অতিরিক্ত জল। বেলপাহাড়ি অঞ্চলের পানীয় জলের প্রয়োজন মেটায় এই জলাধার আর এই জলাধারের জল আসে মূলতঃ মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে। পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম, সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে মাথা দুলিয়ে চলেছে অজস্র কাশফুল। সেই ঘনায়মান অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে মনে মনে ফিসফিস করে বললাম, আসব...আবার আসব...
~ ঝাড়গ্রামের তথ্য ~ ঝাড়গ্রাম-বেলপাহাড়ির আরও ছবি ~
এককথায় ভ্রমণপাগল পার্থ দত্ত পেশায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থ দপ্তরের আধিকারিক। ছাত্রজীবনে সাইকেল নিয়ে ভ্রমণের শুরু, আর চাকরিজীবনের প্রথম দিকে পাহাড়ের প্রেমে তার অন্দরমহলে পা ফেলা, যার মধ্যে আছে সান্দাকফু, পিন্ডারি-কাফনি হিমবাহ, হর-কি-দুন, রূপকুণ্ড, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ইত্যাদি। জানা-অজানা নির্জন প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে আর ছবি তুলতে ভালো লাগে। লেখালেখির অভ্যাস খুব একটা নেই, 'আমাদের ছুটি'-র জন্য এই প্রথম কলম ধরা।