রূপকথার দেশ লাচুং

দেবতোষ ভট্টাচার্য


~ লাচুং-ইয়ুমথাং-এর তথ্য ~ লাচুং-ইয়ুমথাং-এর আরও ছবি ~

পাহাড় না সমুদ্র? না, বলতে চাইছি - পাহাড় ভাল লাগে না সমুদ্র?

ভ্রমণপিপাসু বাঙালীকে এই প্রশ্ন করা বৃথা৷ এ অনেকটা সেই ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগানের মত ব্যাপার – খানিক চিৎকার চেঁচামেচিই হবে, সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই৷ তা চ্যাটার্জীদার গোল-বারান্দায় বসে সেদিন এই নিয়েই কথা চলছিল৷ হঠাৎই চায়ে লম্বা এক চুমুক দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন – আগেরবার গরমে তো সোজা সমুদ্রে নিয়ে ফেলেছিলে, এবার কি থর মরুভূমি নাকি হে? বলা বাহুল্য, প্রশ্নটা আমাকেই করা – কারণে অকারণে এই খোঁচা দেওয়ার স্বভাবটা আর গেল না৷ রেগে-মেগেই বললাম, নাহ, চলুন এবার ঘুরে আসি বরফের দেশে৷

ঝোঁকের মাথায় বলে তো ফেললাম, কিন্তু এই গরমে কোথায় যে বরফ পাই! থাকি দক্ষিণ ভারতে, আর এই ঘাট পর্বতমালায় মাথা খুঁড়লেও যে বরফ মিলবে না তা বিলক্ষণ জানি৷ অতএব ভরসা উত্তরের হিমালয়৷ কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না – তার ওপর ছিল চ্যাটার্জীদার প্রতিনিয়ত হুমকি৷ গিরিরাজ হিমালয়ের অপরূপ শোভা প্রত্যক্ষ করতে হলে যেসব জায়গার নাম মনে আসে, তার একদম প্রথমেই থাকবে সিকিম৷ হঠাৎই একদিন খুঁজতে খুঁজতে এক ব্লগে পেলাম বীচু গ্রামের উল্লেখ৷ ব্লগের লেখক লাচুং-এর ভূমিপুত্র, কিন্তু কর্মসূত্রে গ্যাংটকেই থাকতে হয় তাঁকে৷ প্রায় সারা বছরই দেশি বিদেশি ট্যুরিস্টদের নিয়ে ট্রেকিং-এ যেতে হয়৷ স্বর্গের মত সুন্দর তাঁর জন্মভূমি, তা ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা ছিল সে লেখার প্রতি ছত্রে৷ সবাইকে বারংবার অনুরোধ করেছেন তাঁর সেই পাহাড়ে ঘেরা গ্রামে একবার অন্তত পা রাখার – যেখানে কান পাতলেই শোনা যায় লাচুং-চুর ক্লান্তিহীন পথ চলার মিষ্টি সঙ্গীত আর নাম নাজানা হরেক পাখির যেচে গান শোনানোর আকুলতা৷ চতুর্দিকে সাদা ধবধবে বরফে ঢাকা পাহাড়, তারই মাঝে সবুজ নরম ঘাসের গালচেতে পা ছড়িয়ে গল্প করার লোভ সামলানো কঠিন৷ পুরো দৃশ্যটা চোখ বুজে একবার কল্পনা করলেই মনে হবে – হ্যাঁ, এইতো স্বর্গ! তাঁর যন্ত্রণা যেন মনেপ্রাণে অনুভব করতে পারলাম – এ দেবভূমি ছেড়ে থাকা বাস্তবিকই বড় কষ্টকর!

লাচুং যেতে হলে আগেভাগে দুটো জিনিসের বন্দোবস্ত করে রাখা খুব জরুরী – গাড়ি এবং পারমিট৷ আর সেজন্য দ্বারস্থ হতেই হবে ওখানকার রেজিস্টার্ড ট্যুর অপারেটরের৷ ব্যাঙ্গালোরে বসেই ইন্টারনেটে অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে মনোমত অপারেটরের সন্ধান পাওয়া গেল৷ পরিচয়পত্র এবং ফটো আগে থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই পারমিট পেতে কোন অসুবিধা হয়নি৷ সেসব তো হল, এবার থাকা হবে কোথায়! নাহ, তার সন্ধানও দেওয়া ছিল সে ব্লগেই৷ ওঁরই এক তুতোভাই হোমস্টে চালান সেখানে – বীচু হোমস্টে৷ ফোন করে ঘরের বন্দোবস্ত করতে কিছুমাত্র সমস্যা হল না৷

দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন এসে গেল৷ সিকিমের যেদিকেই যাওয়া হোক না কেন, গ্যাংটককে কেন্দ্র করে প্ল্যান করাই ভাল৷ তাই আমরাও নিউ জলপাইগুড়ি হয়ে গ্যাংটকের দিকে রওনা হলাম৷ মে মাস, এই সময় গ্যাংটকে খুব একটা ঠাণ্ডা থাকার কথা না৷ কিন্তু সেদিন বিকেলে হঠাৎই প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হওয়ায় গায়ে মোটা কিছু চাপাতেই হল৷ শুধু চ্যাটার্জীদা সোয়েটার পরতে কিছুতেই রাজি হলেন না – শরীরকে নাকি ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে! ভয় হল, জ্বরটর না বাধিয়ে বসেন আবার৷

একরাত্রি বিশ্রাম নিয়ে পরদিন সকালে সবাই রওনা হলাম লাচুং-এর উদ্দেশ্যে৷ সারারাত বৃষ্টির পর আকাশে ঝকঝকে রোদ৷ রাস্তা ভালই বলতে হবে, বিশেষ করে চারিদিকে এত সবুজের নরম মোলায়েম সৌন্দর্য যে ছোটখাটো ঝাঁকুনি অনায়াসে ভুলে থাকা যায়৷ ডানদিকের পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট ঝোরা রাস্তা পেরিয়ে নেমে গেছে বাঁদিকের ঢাল বেয়ে৷ বিশেষ তাড়াহুড়ো নেই, দিব্যি হেলে-দুলে চলা আর কী৷ দেখতে দেখতে এসে গেল মংগন, উত্তর সিকিমের জেলা সদর৷ মংগন পেরিয়ে যত এগোচ্ছি তত সবুজের নানা বাহার চোখে পড়তে লাগল৷ আরও চোখে পড়ল, দূরে দুষ্টু মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতে ওঠা নাম না জানা পাহাড়ের চূড়োগুলো৷ তারা অবশ্য কখনোই সেভাবে যেচে ধরা দেয়নি৷ মাথায় বরফের মুকুটে রোদের ঝিলিকই যা চিনিয়ে দিচ্ছিল৷ চ্যাটার্জীদা ঝিমুচ্ছিলেন, হঠাৎ চোখ খুলেই সামনে বরফেঢাকা পাহাড় দেখে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন – কাছেপিঠেই এভারেস্ট নাকি হে! ড্রাইভার তাশি তাঁকে কোনমতে নিরস্ত করল সে যাত্রা৷

চুংথাং থেকে আমরা ডানদিকের লাচুং-এর পথ ধরলাম৷ চুংথাঙ-এর জলাধারটি ওপর থেকে দেখতে ভারি ভাল লাগে৷ গাঢ় সবুজ পাহাড়ের প্রতিবিম্ব এসে পড়েছে জলে৷ লাচেন-চু ও লাচুং-চু, এই দুই নদী এসে মিশেছে চুংথাঙ-এ৷ এখান থেকেই আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হল লাচুং-চু, যেন অতিথিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা তার দায়িত্ব৷ কোনোমতেই চোখের আড়াল হতে দেয়নি সে৷ স্থানীয় ভাষায় চু মানে নদী, বাস্তবিকই লাচুং-এর প্রাণ এই নদী৷ বহুপথ পাড়ি দিয়ে লাচুং-চু গিয়ে মিশেছে তিস্তায়৷ নদীর গভীরতা তেমন নয় বটে, তবে বেশ খরস্রোতা৷ তাশিকে গাড়ি থামাতে বলে একটু এগিয়ে গেলাম তার দিকে৷ এই অনর্গল ঝমঝম শব্দটার বোধহয় কোন সম্মোহনী শক্তি আছে – পায়ে পায়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলাম৷ সম্বিত ফিরল তাশির চিৎকারে, পাশের ভাঙা পাথরগুলো বেশ বিপজ্জনক – আর না এগোনোই ভাল৷ তবে ওই যে বললাম, এই একটানা ছলছল কলকল শব্দ যেন বেঁধে রাখে পা দুটো, মন আত্মসমর্পণ করতে চায় পরমাসুন্দরী প্রকৃতির কাছে৷

হঠাৎই লক্ষ্য করলাম পাহাড় বেশ রুক্ষ হয়ে আসছে৷ যত এগোচ্ছি তত সবুজের ঠাণ্ডা ভাব কমে আসছে যেন৷ কিছু জায়গায় রাস্তা বেশ খারাপ, বা বলা যায় রাস্তার কোনও অস্তিত্বই নেই৷ তাশির কথায় জানতে পারি, বর্ষায় অনবরত ধ্বস নামে এসব জায়গায়৷ ডানদিকে তাকালেই বোঝা যায় সে কী ভয়াবহ দৃশ্য হতে পারে৷ সুন্দর সবুজ খাতার কিছু জায়গা প্রকৃতি যেন রবার দিয়ে মুছে দিয়েছে, এতটাই প্রকট এবং বিসদৃশ লাগে চোখে৷ এ যেন তার বহুদিনের জমে থাকা রাগ-ক্রোধ-ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ৷ প্রায় ঘণ্টাখানেক পর খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে – প্রকৃতি যেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে পাহাড়ের সেই স্নিগ্ধ ঢেউ খেলানো সবুজ৷ ঘন ঘন বাঁক নিতে থাকে তাশি৷ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ছবিতে দেখা সেই রূপকথার দেশে - বীচু গ্রাম৷

লাচুং মূলত: চারটি গ্রাম নিয়ে গঠিত – বীচু(Beechu), শিংরিং(Shingring), ফাখা(Phakha) ও শার্চক(Sharchok)৷ জানিনা লিখন ঠিক ওদের উচ্চারণমত হল কিনা! প্রায় নয়হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত লাচুং একদম ভারত-তিব্বতের সীমান্তে৷ এখানকার মূল জনগোষ্ঠী আসলে তিব্বতি - ভারতবর্ষে এদের পরিচয় ভুটিয়া৷ বহুযুগ আগে সিকিমের আদি জনগোষ্ঠী লেপচাদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন এই ভুটিয়ারা৷ ভুটিয়া রাজা কাবি লুঙচকে ও লেপচা ধর্মগুরু এই মর্মে তাঁদের দীক্ষা দেন৷ সেইদিন থেকেই দুই প্রাচীন জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ ভাবে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে৷ বর্তমানের এই হানাহানির যুগে ব্যাপারটা বেশ বিস্ময়কর! কাবি লুঙচকের ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যের জন্যই কিনা জানিনা, জায়গাটা বেশ নিঝুম – যেন কথা বলতেও দ্বিধাবোধ হয়৷ মনে হয় যে কোনও আওয়াজ বড়ই বেমানান এই স্থানে, চিরন্তন শান্তির ব্যাঘাত ঘটায়৷

উচ্চতার দরুণ লাচুং-এ অক্সিজেন কম, বয়স্কদের হয়ত শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে৷ তবে আমরা নিয়মিত কোকা-৩০ খেয়েছিলাম বলে তেমন অসুবিধায় পড়তে হয়নি৷ আশেপাশে প্রচুর বার্লির ক্ষেত চোখে পড়ে, এছাড়া নানারকম শাকসবজির সঙ্গে আপেল গাছেরও দেখা পেলাম৷ নাহ্ আপেল এখনো হয়নি বটে, তবে ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছগুলো৷ তাশির মুখে শুনলাম, অনেক আগে নাকি এখানে ভালই আপেলের চাষ হত৷ পরবর্তীকালে জলবায়ুর পরিবর্তন ও অত্যধিক রসায়নিকের প্রয়োগে আপেলের ফলন একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়৷ বর্তমানে স্থানীয় কিছু মানুষের একান্ত চেষ্টায় আবার আপেলের চাষ শুরু হয়েছে – ফলেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে৷ এই প্রচেষ্টাকে সত্যিই সাধুবাদ জানানো দরকার৷

বীচু হোমস্টের গৃহকর্তা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন৷ সত্যি বলতে কী, লেখায় যা পড়েছিলাম জায়গাটা তার থেকে অনেক বেশি সুন্দর৷ একদম সামনেই রূপসী লাচুং অপরূপ ছন্দে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে ঘন সবুজ উপত্যকার বুক চিরে৷ নীচে নরম ঘাসের চাদরে মোড়া বিশাল মাঠ৷ ইতস্ততঃ ছড়ানো ছিটানো কিছু বসতি, বাড়িগুলোর কাঠের গড়ন যেন একদম এই পরিবেশের সঙ্গে মানানসই৷ সেই মাঠেই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আর কি - হঠাৎই চ্যাটার্জীদা ইয়া বড় একটা হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ সেই বিহ্বল দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখতে পেলাম তাকে৷ সাদা মেঘের আড়াল থেকে কখন যেন উঁকি মেরেছে তুষারাবৃত Shari Kida Ngen Chung শৃঙ্গ৷ এত কাছে তিনি মাথা উঁচু করে দিব্যি দাঁড়িয়েছিলেন, অথচ মেঘের জন্য একদম বোঝাই যায়নি৷ এ দৃশ্য দেখার অনুভূতি ভাষায় বোঝান অসম্ভব৷ বুঝতে পারি, কোন আকর্ষণে জীবনের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে বারংবার অভিযানে বেরোন পর্বতারোহীরা৷ সত্যি, এ যেন ভয়ঙ্কর সুন্দর৷

বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল, চ্যাটার্জীদা পর্যন্ত দেখি একটা লাল মাঙ্কিটুপি পরে ঘুরছিলেন৷ হিশেজী, মানে বীচু হোমস্টের গৃহকর্তা নিজেই রান্না করে খাওয়ালেন রাত্রে৷ ওপর থেকে দেখছিলাম, ঘাড়ের ওপর প্রিয় বেড়াল আলুস-কে নিয়ে ক্ষেত থেকে শাকসবজি এক ঢাউস ব্যাগে ভরছিলেন৷ সত্যি বলতে কি, হিশেজী যেন সাক্ষাৎ মাস্টারশেফ – ডিনারে ছিল তাঁর বানানো অনবদ্য কিছু পদ৷ সেসব খাবারের নাম বা প্রণালী না জানলেও, চিকেনের রেসিপিটা লিখে নিয়েছিলাম৷ পরে একবার বাড়ী ফিরে চেষ্টাও করেছিলাম – তবে চ্যাটার্জীদার ঠিক পছন্দ হয়নি৷ ভাল খাওয়াদাওয়া আর সেইসাথে জার্নির ক্লান্তি, দুচোখ যেন বুজে আসছিল৷ পরদিন সকালে ইয়ামথাং যাওয়ার কথা, তাই আর রাত না করে ঘুমিয়ে পড়লাম৷

লাচুং-চুর ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম – ঘুম ভাঙল বৃষ্টির আওয়াজে৷ তখনও পুরো ভোরের আলো ফোটেনি৷ বাইরে বেরিয়ে আর সেই Shari Kida Ngen Chung দেখতে পেলাম না, বরং আরও কাছের পাহাড়গুলো বরফে ঢেকে গেছে৷ হিশেজী ভবিষ্যদ্বাণী করলেন – আজ ইয়াম-সামডঙ-এ নির্ঘাত স্নোফল হবে৷ সবার তৈরি হতে নটা বেজে গেল৷ গন্তব্য ইয়ামথাং৷

রডোডেনড্রনের কথা অনেক গল্প কবিতায় পড়েছি, চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি কোনোদিন৷ পুরো ইয়ামথাং-এর রাস্তার দুধারে কত রঙের যে ফুল ফুটে আছে থরে-থরে! রঙের পরিবর্তনটা লক্ষ্য করার মত – কিছুদূর পর্যন্ত কমলা, তারপর লাল, এরপর বেগুনী৷ এতরকম সব রঙ যে বর্ণনা করা মুশকিল৷ তাই বোধহয় এর আরেক নাম 'ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস'৷ খানিক যেতেই হঠাৎ দেখলাম, এক হিংস্র দানব যেন সাজানো বাগান ভেঙে তছনছ করে দিয়ে গেছে৷ বহুদূর পর্যন্ত রডোডেনড্রন গাছগুলো ডানদিকে নুয়ে পড়ে আছে, পাইন গাছের শুধু গোড়াটাই কোনমতে টিকে আছে৷ যেন ভয়াবহ এক যুদ্ধের সাক্ষী এরা৷ পরে হিশেজীর কাছে শুনেছিলাম, ২০১৪ সালে এক প্রচণ্ড ধ্বস নামে এ অঞ্চলে – সবকিছু একেবারে লন্ডভন্ড করে দেয়৷ প্রায় মাস তিনেক রাস্তা বন্ধ থাকে৷ ভাবা যায়, প্রায় চার বছর পরেও গাছগুলো প্রকৃতির এই ভয়াবহ আক্রমণের স্মৃতি ভুলতে পারেনি!

তখনও টিপ-টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল৷ ঠিক হল আবহাওয়া আরও খারাপ হওয়ার আগে ইয়াম-সামডঙ ঘুরে আসা হবে৷ ইয়ামথাং থেকেই সবাই বরফে চলার উপযোগী জুতো আর গ্লাভস ভাড়া করলাম৷ চ্যাটার্জীদার প্রবল আপত্তি স্বত্বেও ওনাকেও পা গলাতেই হল৷ বলে রাখা ভাল - ইয়াম-সামডঙ যেতে হলে কিন্তু আলাদা পারমিটের প্রয়োজন৷ পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ধীরেই ওপরে উঠছিল৷ পাশেই তিব্বত, তাই লাল চিনের ওপর নজর রাখতে পাহাড়ের মাথায় ছোট ছোট ওয়াচ টাওয়ার চোখে পড়ল৷ রঙে এবং আকারে চুড়োর সঙ্গে একদম মিশে গেছে, ঠাহর করা কঠিন৷ হাতে ক্যামেরা থাকলে লোভ সম্বরণ করা যায়না – কিন্তু চ্যাটার্জীদা নিষেধ করলেন৷ দেশের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিরস্ত হলাম৷

উচ্চতা যখন ১৩,০০০ ফুট পেরোল, শরীরে একটু অস্বস্তি হতে লাগল৷ অনেকটা ওই এরোপ্লেন ওঠার সময় যেমন লাগে আর কী! এখান থেকেই চোখে পড়ল পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সাদা ধপধপে বরফের চিহ্ন৷ অনেক নীচে লাচুং-চু কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আপন মনে এগিয়ে চলেছে – তার উৎপত্তিস্থল কাছেই৷ ১৪,০০০ ফুট ওঠার পর রাস্তার পাশেই ছোট ছোট বরফের কুচি দেখতে পেলাম৷ বুঝতে পারলাম পৌঁছেই গেছি প্রায়৷

আসলে ইয়াম-সামডঙ-এ মূলত: লোকে বরফ দেখার লোভেই আসে৷ উচ্চতা প্রায় ১৫,০০০ ফুট হওয়ার দরুণ সারাবছরই এখানে বরফে ঢাকা৷ শীতকালে এদিকের রাস্তা বরফ পড়ে মাঝেই মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়৷ প্রচণ্ড ঠান্ডা – ছবি তোলার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও আঙুলগুলো বার করতে হল গ্লাভসের ভেতর থেকে৷ কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই হাতে আর কোন সাড় পাচ্ছিলাম না৷ বহুদূর বিস্তৃত শুধু বরফ আর বরফ – তবে খুব দূরে যাওয়া বিপজ্জনক৷ পাথর আর ঝুরঝুরে বরফ, সাবধান না হলেই বিপদ৷ কেন জানিনা, চ্যাটার্জীদা সবসময় আমাকেই পরম শত্রু মনে করেন – প্রথম সুযোগেই একতাল বরফের গোলা ছুঁড়ে আক্রমণ করে বসলেন৷ টাল সামলাতে না পেরে আমিও ধপাস করে পড়ে গেলাম৷ পড়তে পড়তেই বিদ্রূপটা কানে এল – তোমরা আজকালকার ছোকরারা বড়ই নড়বড়ে হে!

হিশেজী ঠিকই বলেছিলেন – কিছুক্ষণের মধ্যেই তুষারপাত শুরু হয়ে গেল৷ আবহাওয়া দ্রুত খারাপ হয়ে আসছিল, আশপাশের ছোট ছোট দোকানগুলো সব ঝাঁপ গুটিয়ে পালাল৷ যাই হোক, একটা দোকানে তখনও কিছু খদ্দের বসে ছিল – আমরাও ঢুকে পড়লাম৷ স্থানীয় কিছু মহিলা সেখানে সেদ্ধ ছোলা, কফি, ম্যাগি ইত্যাদি বিক্রি করছিল৷ দক্ষিণী কায়দায় তাদের আম্মা বলে সম্বোধন করায় তারা হেসেই গড়িয়ে পড়ে আর কী! এক ঠোঙা ছোলা নিয়ে বসে পড়লাম – শুনেছি এতে নাকি পাহাড়ে অক্সিজেনের অভাব অনুভব হয় না৷ কিন্তু ঠান্ডায় চ্যাটার্জীদার দাঁত ঠকঠকানি যেন কিছুতেই থামতে চাইছিল না৷ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকায় বাধ্য হয়ে সবাই একটু করে ব্র্যান্ডি খেয়ে নিলাম৷ এবং তারপরই পাতে পড়ল গরম ধোঁয়া ওঠা অমৃতসম ম্যাগি৷ যাইহোক, কিছুক্ষণ এই তাণ্ডব চলার পর প্রকৃতি যেন একটু সদয় হল৷ তুষারপাত পুরোপুরি বন্ধ না হলেও অনেকটাই কমে এসেছিল৷ আমরাও বেরিয়ে এলাম আম্মার তাঁবু থেকে৷ দৃশ্যমানতা বেশ কমে আসায় প্রমাদ গুনলাম৷ আর দেরি না করে ফিরে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ৷

মেঘে ঢাকা পাহাড়ি রাস্তায় পাক খেতে-খেতে নামছিলাম৷ বেশ ভয়ই করছিল, তবে প্রায় হাজার দুয়েক ফিট নামার পর আবহাওয়া অনেক ভাল হয়ে গেল৷ কিছুপরেই দিব্যি রোদের দেখা পেলাম৷ মনের ওপর সূর্যের অসীম প্রভাব – সবার মন একসাথে প্রফুল্ল হয়ে উঠল৷ নামবার সময় গাড়ি বেশ জোরেই চলছিল, বড় তাড়াতাড়ি যেন চলে এলাম ইয়ামথাং৷

যদি জানতে চাওয়া হয়, হঠাৎ কাউকে অবাক করে দেবার বহু পরীক্ষিত পদ্ধতিটি কি? চোখ বন্ধ রেখে যেই সে পাতা মেলবে, দেখতে পাবে সামনেই তার আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটি৷ আর হ্যাঁ, অবশ্যই একদম অপ্রত্যাশিতভাবে৷ প্রশ্ন, হঠাৎ এখন একথা কেন? ইয়ামথাং-এ সকালে একবার এসেছিলাম, টিপ-টিপ বৃষ্টি পড়ছিল তখন৷ রাস্তার দুধারে নানা রঙের বাহার, প্রকৃতি যেন রডোডেনড্রনের ডালি সাজিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে তার অতিথিদের৷ কিন্তু সে ফুলের বাগানের ওপারে কি আছে তা দেখা ছিল বারণ৷ কারও গোপন নির্দেশে হালকা মেঘ সন্তর্পণে সাদা চাদরে ঢেকে রেখেছিল চতুর্দিক৷ ফিরলাম যখন, সে মেঘরাশি ফিরে গেছে – হয়ত তাদের কোনও কাজ মনে পড়ে গেছে৷ ঝকঝকে নীল আকাশ আর চতুর্দিকে ঝলমল রোদ৷ কিন্তু... এ কী? এত কাছে? হাত বাড়ালেই যেন স্পর্শ করা যায়! রাস্তার একেবারে পাশেই যে সাদা তুলোর মত বরফে ঢাকা পাহাড়ের অস্তিত্ব রয়েছে, তা বোঝা যায়নি আগে একেবারেই৷ এ যেন অদ্ভুত এক ম্যাজিক৷ আলাদিনের সেই দৈত্য কোন্ ফাঁকে এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে এই তুষারাবৃত পর্বতমালা, এক ফুঁয়ে সরিয়ে দিয়েছে নাছোড়বান্দা মেঘের চাদর৷

এখানে লাচুং-চু বেশ চওড়া, অগভীর – সমতল উপত্যকা বলে গতিও যেন মন্থর৷ কিছুটা জায়গায় নদীর ধার এখানে বাঁধানো, দিব্যি নীচে নেমে স্পর্শ করা যায় সে জলধারা৷ সবুজ মখমলের মত নরম ঘাস নদীর দুধারে৷ মাঝে মাঝে কিছু নাম-না-জানা বেগুনী ফুল৷ চতুর্দিকে সারি সারি পাইন গাছ, ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বরফে ঢাকা পাহাড়৷ নদীর পাড় ধরে হাঁটতে বেশ লাগছিল৷ এক জায়গায় কে যেন পরপর পাথর সাজিয়ে রেখেছে৷ এদিকে রডোডেনড্রনের রঙ কিন্তু গাঢ় বেগুনী৷ চ্যাটার্জীদা দেখি নদীর পাড়ে বসে গান ধরেছেন – ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে! বলো কোথায় তোমার দেশ...তোমার নেই কি চলার শেষ? তাশি বারবার কাটাও ভ্যালি যাওয়ার তাড়া দিলেও চ্যাটার্জীদা গান শেষ না করে উঠবেন না জানতাম৷ দোষও দেওয়া যায় না, এত অপরূপ জায়গায় একবার এসে তার রূপ-রস-গন্ধ নিংড়ে না নিয়ে ফেরা অসম্ভব৷ তবে কাটাও না যেতে পারলেও দুঃখ পাইনি মোটেও৷ যা দেখেছি তাতেই আমাদের ভাণ্ডার একেবারে পরিপূর্ণ৷

পরদিন সকালে ফিরে আসার পালা৷ ব্রেকফাস্টে ছিল হিশেজীর হাতের অপূর্ব প্যানকেক, লোভে পড়ে একটু বেশীই খাওয়া হয়ে গেল৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে৷ রাস্তার ধারে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রামগুলো যেন স্কটল্যান্ডের কথা মনে পড়িয়ে দেয়৷ এখনও ঘণ্টা তিনেক লাগবে গ্যাংটক পৌঁছতে৷ একটু ঝিমুনি এসেছিল, হঠাৎ চ্যাটার্জীদা ড্রাইভারের পাশ থেকে বলে উঠলেন – বেশ ছিলাম হে! আবার প্যাচপ্যাচে গরমে না ফিরলেই নয়? কী যে বলি! উত্তর সবারই জানা, তাই চুপ থাকাই শ্রেয়৷

~ লাচুং-ইয়ুমথাং-এর তথ্য ~ লাচুং-ইয়ুমথাং-এর আরও ছবি ~

প্রবাসী বাঙালি দেবতোষ ভট্টাচার্য কর্মসূত্রে আজ বহু বছর বাঙ্গালোরের বাসিন্দা। ফোটোগ্রাফির প্রবল নেশা - আর এই নেশার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায়ই তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হয় ঘর ছেড়ে। অবসর সময়ে অল্পবিস্তর লেখালেখির বদভ্যাস আছে। 'আমাদের ছুটি'তেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম ভ্রমণ কাহিনি। লেখার মাধ্যমে যদি একবার বেড়াবার নেশাটি কাউকে ধরিয়ে দেওয়া যায় তবে সেটাই হবে তাঁর মস্ত পাওয়া।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher