ইতিহাসও কথা বলে

দেবাশিস মজুমদার

~ মুর্শিদাবাদের তথ্য ~ || ~ মুর্শিদাবাদের ছবি ~

রাতের লালগোলা প্যাসেঞ্জার যখন মুর্শিদাবাদ স্টেশনে পৌঁছোল তখন প্রায় ভোর ছ'টা। সবেমাত্র আলো ফুটেছে। নির্জন স্টেশনে নামতেই ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা আমাদের স্বাগত জানাল তার হিমশীতল স্পর্শে। কুয়াশাচ্ছন্ন স্টেশনের চারিদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন এক মায়াপুরীর দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছি। এই দরজার ওপারেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে সুবা বাংলার নবাবী ইতিহাসের প্রাণকেন্দ্র।

চার বন্ধু মিলে ডিসেম্বরের শীতে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে মুর্শিদাবাদ বেড়াতে এসেছি। আইডিয়াটা অবশ্য আমারই। ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে বাংলার নবাবী আমলের রাজধানীকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছাটা অনেকদিনের, কিন্তু হয়ে ওঠেনি এর আগে।

স্টেশনের বাইরে এসে কোনও যানবাহন দেখতে পেলাম না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই রহস্যময় কুয়াশার বেড়াজাল কেটে একটা টাঙ্গা এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। দরদাম করে চারজনে তাতেই উঠে পড়লাম। টাঙ্গা চলল লালবাগের ইয়ুথ হোস্টেলের উদ্দেশে। সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা আছে। বড়দিনের ছুটি পড়তে প্রায় সপ্তাহখানেক বাকি, তাই ইয়ুথ হোস্টেল এখন একদম ফাঁকা।

হোস্টেলের লনে এসে দাঁড়াতে চোখ চলে গেল নির্জন প্রান্তর জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল ইমামবাড়ার দিকে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হল নবাবী যুগের ইতিহাসের এক অনন্য সাক্ষ্যকে তার কাঁধে নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বৃদ্ধ ইমারতটি।

Bada Imamabara

সকালে যে টাঙ্গায় চড়ে হোস্টেলে এসেছিলাম সেটাকেই সারাদিনের জন্য ভাড়া নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কাছেই এক দোকানে জলখাবার সেরে নিয়ে টাঙ্গায় চড়ে রওনা দিলাম মুর্শিদাবাদ দর্শনে।

মুর্শিদাবাদে নবাবী শাসনের পত্তন হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র আমলে। ইতিহাসের শুরু থেকেই শুরু করলাম আমাদের ভ্রমণ। কাটরা মসজিদের পেছনেই রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র সমাধি। বিশালব্যপ্ত কাটরা মসজিদের অসাধারণ শিল্প কারুকার্য মন ভরিয়ে দিল আর মুর্শিদকুলি খাঁ এর সমাধিস্থলের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল যেন সশরীরেই ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করছি।

কাটরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে চললাম দ্বিতীয় গন্তব্যস্থল - ফুটি মসজিদ বা স্থানীয় ভাষায় ফুটা মসজিদ। দেখি চরম অযত্নে প্রায় ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক প্রকান্ড ইমারত। শোনা যায়, নবাব সরফরাজ খান তাঁর অক্ষয়কীর্তি হিসাবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন এই মসজিদটিকে। তাই তিনি নাকি এক রাত্তিরের মধ্যেই বিশাল এই মসজিদ বানানোর চেষ্টা করেন। যদিও এ দাবির কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তবে কিংবদন্তী অনুসারে সেই রাত্রেই আলিবর্দি খাঁ-র চক্রান্তে খুন হতে হয় সরফরাজ খাঁ-কে, আর মসজিদ নির্মাণও তাই রয়ে যায় অসমাপ্তই।

আমাদের টাঙ্গা এবার ছুটে চলল বিখ্যাত কাঠগোলা বাগানের দিকে। শীতের সকালে রাস্তার দুধারে সর্ষে খেতের পীত ছটার মাঝে প্রকৃতি যেন রূপের বন্যায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। সেই মনমোহিনী রূপের হাতছানিতেই বোধহয় নিজেও কিছুটা হারিয়ে গিয়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরল কাঠগোলা বাগান কমপ্লেক্সে পৌঁছে।
এখানকার পরিবেশ সত্যিই চমৎকার। কাঠগোলা বাগানেও প্রকৃতি তার রূপরেখা মেলে ধরতে কোনও কার্পণ্য করেনি। মধ্যে মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা শ্বেত পাথরের মানবমূর্তিগুলো যেন সেই রূপলাবণ্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এখানকার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল বাগানের মাঝে আদিনাথের জৈনমন্দিরটি। বাগান ও মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে আসার সময় চোখে পড়ল শ্বেত পাথরে নির্মিত এক পুরুষমূর্তির দিকে। এটি এক হার্মাদের মূর্তি। হার্মাদ অর্থাৎ পর্তুগিজ জলদস্যু। বেপরোয়া এই বিদেশি হানাদারেরা একটা সময় বাংলার নবাবী শাসনের সামনে প্রভূত বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছিল।

কাঠগোলা বাগান থেকে বেরিয়ে টাঙ্গা রওনা দিল লালবাগের অভিমুখে। না এখনই হোস্টেলে ফিরছি না। এবার গন্তব্য নশিপুর রাজবাড়ি। রাজবাড়ির চাকচিক্য এখন ম্রিয়মান আর অবস্থাও ভগ্নপ্রায়। তবে এককালে যে এরও অসাধারণ জৌলুস ছিল তার সাক্ষ্য রয়েছে সর্বত্রই। ইতিহাস বলে এই বংশের আদিপুরুষদের পেশা ছিল দস্যুবৃত্তি - পরে তারাই হন জমিদার। কিংবদন্তী আজও সেইসব নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনি বহন করে চলেছে স্থানীয় লোককথায়।

মুর্শিদকুলি খাঁ-র বড় মেয়ে আজিমউন্নিসার সমাধিস্থল - এটিও একটি অভিশপ্ত জায়গা। শোনা যায় এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ক্লিষ্ট আজিমউন্নিসাকে এক কবিরাজ চিকিৎসার উপায় হিসাবে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সি একশোটি শিশুর কলিজা খেতে বলেছিলেন। রাজকুমারীর প্রাণ বাঁচাতে বহু নিষ্পাপ শিশুকে বলিদান দেওয়া হয়। আজিমউন্নিসার সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সেইসব শিশুর করুণ আর্তনাদ যেন কানে বাজতে লাগল, যেন শুনতে পাচ্ছিলাম সন্তানহারা মায়েদের আর্ত চিৎকার। স্থানীয় লোকেরা এই অভিশপ্ত জায়গাটিকে রাক্ষুসে বেগমের সমাধিস্থল নামেই অভিহিত করে।

- এবার কিন্তু খিদে পাচ্ছে।
সমাধি দেখে বেরিয়ে স্বগতোক্তি করল সৌরভ। এতক্ষণে টের পেলাম, খিদেটা আমারও মন্দ পায়নি। অতএব আর কথা না বাড়িয়ে সোজা চলে এলাম লালবাগের একটা হোটেলে। দুপুরের খাওয়া সেরে সামান্য একটু জিরিয়ে নিয়েই চারজনে বেরিয়ে পড়লাম হাজারদুয়ারি দর্শনে।

Hazarduariহাজারদুয়ারি দর্শনের অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন কাজ। আক্ষরিক অর্থেই এ এক ঐতিহাসিক জাদুঘর। নবাবী আমলের অস্ত্র থেকে শুরু করে তার শিল্প, স্থাপত্য, চিত্রকলা, ঐতিহাসিক দস্তাবেজ প্রভৃতি সবকিছুরই অসাধারণ সব নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এই জাদুঘরে। পাশাপাশি কিছু উৎকৃষ্ট পাশ্চাত্য শিল্প নিদর্শন এবং ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরও কিছু বিশিষ্ট নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এ দেখার যেন কোনও শেষ নেই। যতই দেখি ততই দেখার ইচ্ছা, জানার ইচ্ছা যেন আরও বেড়ে যায়। শেষমেশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরিয়ে আসতেই হল। হাজারদুয়ারির সামনেই বাচ্চেওয়ালি কামান। সব দেখে ইয়ুথ হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে নেমে এল। এতক্ষণে যেন শরীরটা একটু ক্লান্ত লাগল। সন্ধেটা চারজনে ইয়ুথ হোস্টেলেই গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিলাম।

রাত সাড়ে দশটায় ডিনার সারতে বেরোলাম। যে হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরেছিলাম ঠিক করলাম রাতের খাবারও সেখানেই খাব। ইমামবাড়ার পাশ দিয়েই হোটেলে যাওয়ার পায়ে চলা পথ। সকালে যাকে ইতিহাসের ভারে ভারাক্রান্ত এক বৃদ্ধ ইমারত বলে মনে হয়েছিল নির্জন মায়াবী পূর্ণিমা রাতে তাকে মনে হচ্ছিল এক মায়াপুরী। সেই বিশাল ইমারতের পাশের নির্জন প্রান্তর দিয়ে আমরা চারজনে হেঁটে চললাম সদর রাস্তার দিকে। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। বেশিক্ষণ লাগল না। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরই পাকা রাস্তা পৌঁছে গেলাম। সামনেই আমাদের খাবার হোটেল। খাওয়াদাওয়া সেরে হোস্টেলে ফিরে যে যার ঘরে শুতে চলে গেলাম । ঘুম আসছিলনা। নবাবী যুগের ইতিহাস যেন বার বার ফিরে ফিরে আসছিল আমার মনে।

পরদিন সকাল নটার মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম জাহানকোষা কামান দেখতে। এই কামানটি পলাশি যুদ্ধের সাক্ষী। সেখান থেকে জিপ ভাড়া করে ছুটে চললাম কিরীটেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশে। কিরীটেশ্বরী মন্দির হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান। এতক্ষণ যেসব জায়গায় ঘুরেছি সেসব জায়গার থেকে এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। এই মন্দিরের মাহাত্ম্য ইতিহাসে নয়, পুরাণে এবং ভক্তিতে। বলা হয় সতীর ৫১ পীঠ তীর্থস্থানের অন্যতম হল এই কিরীটেশ্বরী মন্দির।

সাড়ে তিনটে নাগাদ স্থানীয় হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা দিলাম খোশবাগের পথে। পড়ন্ত বিকেলের গোধূলি আভায় খোশবাগে এসে নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌলার সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে এক অনির্বচনীয় উপলব্ধির সাক্ষী হলাম। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের সমাধির পশ্চাদপটে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ইতিহাসও কথা বলে।

Sunset at Khosbag

~ মুর্শিদাবাদের তথ্য ~ || ~ মুর্শিদাবাদের ছবি ~

ইতিহাসের শিক্ষক দেবাশিস ভালোবাসেন ভারতের ঐতিহাসিক স্থানগুলিতে ঘুরে বেড়াতে। কলকাতার ঔপনিবেশিক ইতিহাস তাঁকে বিশেষ আকর্ষণ করে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher