অচেনা উটি

সুমিত চক্রবর্তী

~ উটির তথ্য ~ || ~ নীলগিরির হ্রদের ছবি ~

সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে যখন চেন্নাই থেকে রওনা দিলাম তখন ম্যাপটা দেখতে দেখতে আমার মাথায় স্রেফ একটা কথাই ঘুরছিল যে কীভাবে এক যাত্রাতেই নীলগিরির উঁচু থেকে নীচুতে ছড়িয়ে থাকা আটটা হ্রদকে দেখে ফেলা যায়। এই আটটা হ্রদ হল আপার ভবানী, পশ্চিম হ্রদ ১,২,৩, পোর্তিমুন্ড, অ্যাভেলাঞ্চ, এমেরাল্ড আর পারসন ভ্যালি।
দুরন্ত এক্সপ্রেসে চেন্নাই থেকে কোয়েম্বাটোর পৌঁছালাম বেশ আরামেই -জিভে জল আনা রকমারি ভাজাভুজি খেতেখেতে। কোয়েম্বাটোর স্টেশনে আমাদের ড্রাইভার মি. কুমার অপেক্ষা করছিলেন -মুখে চেনা হাসি, এইভেবে যে আরেকদল ট্যুরিস্ট এল, এদের নিয়ে উটি যেতে হবে। আমিও মুচকি হেসে তাকালাম। মনে মনে বললাম -বাছাধন, অনেক লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে তোমায়
আমার স্ত্রী অবশ্য আমায় যতদূর চিনেছে, জানতোই যে এই বান্দা শুধু শুধু উটি যাবেনা, যদিনা কোন উদ্ভট জায়গার খোঁজ পেয়ে থাকে। যাইহোক, প্রাথমিকভাবে উটি যাওয়াই স্থির হল। হোটেল অলকাপুরীতে উঠলাম। তুলতুলে নরম কুলচা আর ধোঁয়া ওঠা ডাল ফ্রাই দিয়ে ভুরিভোজটা ভালোই হল। বাইরে তখন কনকনে ঠাণ্ডা আর মুষলধারে বৃষ্টি।
৪ তারিখ সকাল থেকেই মেঘলা। হোটেল ম্যানেজারও দেখলাম খুব একটা কিছু জানেননা হ্রদ্গুলোর ব্যাপারে। পরিষ্কার বলেই দিলেন বনদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। দুগ্‌গা দুগ্‌গা করতে করতেতো রওনা দিলাম। Way to Upper Bhabaniউটি থেকে আপার ভবানী ৬০ কিলোমিটার।পরিষ্কার পিচের রাস্তার গায়ে চাবাগানের সবুজ ক্যানভাস।কয়েকটা বাঁক ঘুরে আমরা পাহাড়ের ওপরে পৌঁছালাম। দৃশ্য বদলে গেছে, চারপাশে এখন কুয়াশাঘেরা ঘন জঙ্গল।

রাস্তাটা এবারে হঠাৎ করেই বেশ এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। কুয়াশার  আঁধারে গাড়ি চালানোও বেশ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমিতো ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি টুকু (আমার স্ত্রী) আর কুমারের (গাড়িচালক) আত্মবিশ্বাস চাঙ্গা রাখার জন্য। আমার নিজেরও অবশ্য গন্তব্য সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট কিছু ধারণা নেই। আবহাওয়া মিনিট দশেক অন্তর অন্তরই খারাপতর হচ্ছে, চারপাশের কালোটা আরও গাঢ় হয়ে আসছে। কয়েকটা বুনো ঝরনা পড়ল পথে, আমাদেরতো মনে হল জলপ্রপাত। বেলা ১১টা বাজে মোটে, এখনই রাস্তা ঘন কুয়াশায় মোড়া। কোনমতে এগিয়ে যচ্ছিলাম। স্থানীয় কয়েকটা ছেলের সঙ্গে দেখা হল -তারাও আপার ভবানী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলতে পারল না। এপথে আমরাই একমাত্র যাত্রী।
ঘন্টা কয়েক দুর্ধর্ষ সব বাঁক পেরিয়ে শেষ অবধি পৌঁছালাম আপার ভবানী বাঁধে। আমরা দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি। কুমারের মুখ দিয়েও বেরিয়ে এল একটাই শব্দ নাল্লা (তামিলে যার অর্থ অসাধারণ)। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, পাতলা ধোঁয়ার মত কুয়াশা ধীরে ধীরে উপরে উঠছে আর তার থেকে জলবিন্দু ঝরে পড়ছে লেকের নীল জলে। কুয়াশার মায়া চাদর সরিয়ে নিজেকে যেন মেলে ধরছে নীলসায়র। সত্যিই অপূর্ব! আমার তো ভাবতেই অবাক লাগে যে কেন লোকে এত টাকা পয়সা-সময় খরচ করে বিদেশে বেড়াতে যায়! এদেশে কিছুরই অভাব নেই বন্ধু -শুধু দেখার চোখ মেলতে হবে। মনে পড়ল, যখন এখানে আসার পরিকল্পনা করছিলাম, আমার প্রতিবেশী বলেছিলেন, সুমিত, ওয়েস্টার্ন ক্যাচমেন্ট, পোর্তিমুন্ড আর আপার ভবানী মিস কোরোনা কিন্তু। মনে মনে তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। কিছুক্ষণ সত্যিই নির্বাক হয়েছিলাম। টুকু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। ওর এই ভঙ্গী আমার চেনা। আমি সর্বস্ব বাজী ধরতে পারি যে ও অসম্ভব খুশি হয়েছে।Upper Bhabani Lake
খানিকক্ষণের জন্য জগৎটা বদলে গেছে জল, কুয়াশা আর সবুজে। চারপাশে যাকিছুই দেখছি সবই যেন কুয়াশার মায়াজালে ঘেরা।  তামিলনাড়ুর ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হল। তারাও অবাক এই কয়াশার মধ্যেও ট্যুরিস্ট এসেছে দেখে। পারস্পরিক কুশল বিনিময় হতে ক্যামেরার কথা হঠাৎ খেয়াল পড়ল আমার। এদিকে পুরো এলাকাটাই কিন্তু কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়ে, ছবি তোলা একেবারেই বারণ, ধরা পড়লেই শাস্তি। কিন্তু সরকার ও TNEB-র প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হয়েও নিয়ম ভেঙ্গে দু-একটা ছবি না তুলে পারলাম না। TNEB-র কর্মীরা প্রতিশ্রুতি দিলেন পরের বার এলে ওঁদের ইনস্পেকশন বাংলোয় রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। একেবারেই ইচ্ছে করছে না, তবু ফিরতেতো হবেই।  দুচোখ ভরে শেষ বারের মত দেখে নিলাম আপার ভবানীর অপার সৌন্দর্য। তারপর একইপথে ফিরে এলাম উটি। চেনা রাস্তায় সময় সবসময়ই কম লাগে তাইনা? আমাদেরও ঠিক তাই হল মাত্র কয়েক ঘন্টাতেই পৌঁছে গেলাম উটির জমজমাটে।
পাঁচ তারিখ তিন আর চারের মাঝামাঝি। সূর্য লুকোচুরি খেলছে মেঘের ফাঁকে। তাড়াতাড়িই রওনা দিলাম অ্যাভালাঞ্চ আর এমেরাল্ডের উদ্দেশ্যে। আমি বেশ নিশ্চিতই ছিলাম যে এক যাত্রাতেই এই দুজায়গা ঘুরে নেওয়া যাবে। কুমারও আমাদের পছন্দ-অপছন্দ বুঝে গেছে। কোথাও কোনো ভালো দৃশ্যের সম্ভাবনা থাকলেই ওর সাদা ঘোড়া ট্যাভেরা-কে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। উটি থেকে অ্যাভেলাঞ্চের দূরত্ব মোটামুটি ২০ কিলোমিটার -পিচের রাস্তা। পৌঁছাতে কোনো অসুবিধেই হলনা। সরু একটা সেতু দিয়ে হ্রদ দুটো জুড়ে রয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে অ্যাভেলাঞ্চের তীরে দাঁড়ালাম-অসাধারণ! স্ফটিক নীল স্বচ্ছ জলের ভেতর দিয়ে বহুদূর অবধি দেখা যাচ্ছে।Lake Emerald টুকুতো আনন্দে আত্মহারা। ওর হাসিতে সারামুখে ছড়িয়ে পড়ছে সেই খুশির আলো। ব্রীজ পেরিয়ে ওপারে এমেরাল্ড দেখা হল। সবুজে ঘেরা এমেরাল্ডের পান্নাসবুজ জলের দিকে তাকিয়ে মনে হল সত্যিই এর নামকরণ সার্থক।
পরিকল্পনা মতো ৫ তারিখ বেলার দিকে রওনা দিলাম মুদুমালাই আর ওয়েনাডের উদ্দেশ্যে -সেখান থেকে গন্তব্য কোচি। মুদুমালাই আর ওয়েনাডে -দুজায়গাতেই দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে ট্যুরিস্ট কেরালা যাচ্ছে -ওনামে যোগ দেওয়ার জন্য। প্ল্যান বদলে উটিতে ফিরে যাওয়াই মনস্থ করলাম। টুকুর মুখ বেজার। বেচারির দীর্ঘদিনের শখ কোচি আর মুন্নারে ওই আমার গাইড হবে। পথে সূচিপাড়া জলপ্রপাত দেখে ওর মুখে হাল্কা একটা খুশির আভা এলেও বেশ বুঝতে পারছিলাম যে মেঘ এখনো কাটেনি। আটই উটিতে পৌঁছে আবার হোটেল অলকাপুরীর সেই চেনা ঘর। আমার যদিও মনে মনে একটু আশা জেগেছে যে, পোর্তিমুন্ড ও পারসনভ্যালি এ যাত্রায় তাহলে বাকী থাকছে না। তবে এ নিয়ে কিছু না বলাই শ্রেয় মনে হল।

নয় তারিখ সকাল থেকেই মেঘলা -মাঝে মাঝে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি। কুমার যখন জিজ্ঞাসা করল আজকের প্ল্যান কি, কিছু না ভেবেই বলে বসলাম -পোর্তিমুন্ড আর পারসনভ্যালি। টুকু ভুরু কুঁচকে তাকাল, দৃষ্টিতে প্রশ্ন -কোথায় সেগুলো জানো আদৌ কিছু? আমিও তাকালাম ওর দিকে, ভাবটা এই -এতবছর ধরে যেমন বিশ্বাস করছ, তেমনি বিশ্বাস রাখ। কুমার বারবার প্রশ্ন করছে -রাস্তা কেমন, কোন পথে যাবে -এই সব। আমি উত্তর দিলাম,অ্যাভেলাঞ্চের মতোই। ঘন্টাখানেকের কিছু বেশি সময় লাগল পারসনভ্যালির ফরেস্ট চেকপোস্ট পোর্তিমুন্ডে পৌঁছাতে। শুরুতেই ব্যাপারটায় মাথা গলালেন উপস্থিত বনবিভাগের আধিকারিকটি। আমাদের কাছে লেক যাওয়ার পারমিট নেই জেনে অবিলম্বে ফেরত যেতে বললেন। কুমারও বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। অতএব শেষ পর্যন্ত আমাকেই মঞ্চে নামতে হল। এসবক্ষেত্রে যা করতে হয় আর কি, এতবছর দরকারে যা করে আসছি -একটা সমঝোতার চেষ্টা। টুকুতো গজগজ করেই চলেছে - আমি অবশ্য সেসব গায়েই মাখছিনা। আধিকারিক ভদ্রলোকটিতো (নাম প্রকাশ করছি না স্বাভাবিক কারণেই) কিছুতেই মানবেন না, আর আমিও নাছোড়বান্দা। শেষে তুরুপের তাস প্রয়োগ করলাম -ওঁকেই বললাম রক্ষক হিসেবে আমাদের সঙ্গী হতে। শেষ অবধি বরফ গলল -উনি রাজি হলেন। যখন রক্ষক নিজেই পথপ্রদর্শক, তখন আর আমাদের পায় কে! ভদ্রলোক সামনের সিটে বসলেন, কুমার অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিল। ওনার প্রথম বাক্যেই অবশ্য আমরা একেবারে কুপোকাৎ। কোনমতেই গাড়ি থামাবেন না, বা নীচে নামার চেষ্টা করবেন না। শেষ গণনা অনুযায়ী এখানে ৩৬টা বাঘ আছে। কুমারতো সঙ্গে সঙ্গেই ওর পাশের জানলার কাচ তুলে দিল। টুকুর মুখে মুচকি হাসি-কিহে কিরকম বুঝছ? আমি মনে মনে ভাবছিলাম যদি একটাও দেখতে পাই আর ছবি তুলতে পারি! Misty Surpriseআধিকারিক ভদ্রলোক যেতে যেতেই এই বনের কোর এরিয়ার মধ্যের জায়গাগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ওঁর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা শুনছিলাম আমরা। কয়েকটা সম্বর, বার্কিং ডিয়ার চোখে পড়ল। বুনো মোষের একটা দলও দেখতে পেলাম আর একজোড়া নীলগিরি ব্ল্যাক মাঙ্কি (লাঙ্গুর)। পথের হাল সঙ্গীন, বরং রাস্তা বলেই কিছু নেই এটাই বলা ভালো। কুমার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল যতটা কম ঝাঁকুনি হয় তার জন্য। অনেক সময়ই বনরক্ষী ভদ্রলোকটি তাঁর সঙ্গীদের (আরও দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন উনি) নিয়ে গাছের ডালপালা সরিয়ে গাড়ি যাওয়ার জন্য রাস্তা সাফ করছিলেন। কয়েকটা পাগ মার্ক চোখে পড়ল  আর তারপরই দেখতে পেলাম একটা বুনো মোষের অর্ধভুক্ত দেহাবশেষ। বনরক্ষীদের মতে একেবারে টাটকা -ঘন্টা দুয়েকও হয়নি এখনো। ওই দৃশ্য দেখে কুমারতো দরদর করে ঘামছে -এ জায়গায় ও আগে তো কখনো আসেই নি-এমন অভিজ্ঞতাও জীবনে প্রথম। আরও ঘন্টা দুয়েক ঝাঁকুনি খেতে খেতে আর ঘামতে ঘামতে পৌঁছালাম পোর্তিমুন্ড ভ্যালি। বাকীগুলোর মতো এটাও অসাধারণ। কোনটা যে বেশি সুন্দর তা বলা মুস্কিল। প্রত্যেকটা হ্রদেরই তার চারপাশের বন্যতা নিয়ে একটা নিজস্ব অনন্য সৌন্দর্য আছে। যার জন্য একটার সঙ্গে অন্যটার তুলনা করার কোন মানেই হয় না। Lake draped in Mist

গাড়িটা দাঁড় করিয়ে আধমাইল হেঁটে পৌঁছালাম পোর্তিমুন্ড হ্রদের তীরে। কুমারও এবার গাড়ি থেকে নেমে আমাদের সাথে সাথে এল। একা গাড়িতে থাকতে সাহস হচ্ছিল না ওর। আমাদের আর কিছুই খেয়াল ছিল না, সুন্দরের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেদের। কেউ একজন ফিসফিসিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক য়ু -আমি জানি সে কে। অন্ধকার নেমে আসছিল, পারসন ভ্যালির হ্রদের দিকে গাড়ি এগিয়ে চলল। পূর্বপাড়ে সবে পৌঁছেছি, আমাদের বনরক্ষী বন্ধু চাপা স্বরে বললেন, ওপারে বাঘ। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা কনকনে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওপারটা প্রায় ৫০০-৬০০ফুট দূরে। আমি নিশ্চিত -ওপারে যে পশুটাকে দেখেছি তার গায়ে হলুদ ছোপছোপ। প্রাথমিকভাবে বাঘের কথাই মাথায় আসে -কিন্তু আঁধার কুয়াশায় এত দূর থেকে দেখে আমি এখনো দোলাচলে ওটা সত্যিই বাঘ ছিল কিনা। আমার ১০০০ মিটার রেঞ্জের বুশনেল বাইনোকুলারে আকার যা বুঝলাম, প্রাণীটা একটা শিশু - পূর্ণবয়স্ক নয়। নিকন ক্যামেরার সাধারণ জুম লেন্সে অতদূর থেকে কোনো ছবি তোলা কিছুতেই সম্ভব হল না। হয়তো আমায় ও একটা ছবি তোলার সুযোগ দিয়েছিল, আমি সেটা হারালাম।

(অনুবাদঃ রত্নদীপ দাশগুপ্ত)

~ উটির তথ্য ~ || ~ নীলগিরির হ্রদের ছবি ~

চেন্নাইতে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় সিস্টেম  অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সুমিত সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পড়েন অফবিট  জায়গায় রোমাঞ্চের খোঁজে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher