হিম মরুর নীল অতলে

সুপ্রতিম ঘোষ

~ তথ্য- লাদাখ ~ সোমোরিরি ~ || ~ সো-মোরিরির ছবি ~ লাদাখের ছবি ~

মাস কয়েক আগের কথা; B.B.-র সাথে একটা সিনেমা হলে; মাল্টিপ্লেক্স নয়, নেহাত সাদামাটা - উত্তর কলকাতার ফিলিম ঘর বলাই বরং ভালো। একটানা হাউসফুল সিনেমার রহস্যটা জানার কৌতূহল হয়েছিল - কিন্তু এ কী! সিনেমা যে গোটা হল জুড়েই শুরু হয়ে যাবে এমনটা তো আশা করিনি - শুরু থেকেই সিটি আর জেন-নেক্সটের নেত্য! সে কথা থাক। বিজ্ঞাপন আর প্রতিবাদী নায়ক চরিত্রের দৌলতে হিট ফিলিম একেবারেই ভুষি! তবে, একটা নাচের সিকোয়েন্সে চোখটা আলটপকা আটকে গেল। সেই গুম্ফা, সেই নীল আকাশ, বৌদ্ধমঠ, খয়েরি-ধূসর লাদাখি পাহাড়- এতো বহু চেনা ছবি - হল থেকে বেরিয়ে B.B.-র সাথে বসে জমাটি গপ্পো শুরু হল এবার। লাদাখের সাতসতেরো। ফকিরামন সেই যে একছুট দিলো - তা-র-প-র, সোজা এই লেখার ছবিতে ল্যান্ডিং। সঙ্গের প্রিয় মানুষ থাকুক না হয় সঙ্গোপনে - My Journey to Ladakh শুরু হল আরও একবার - ফিরে দেখার তাগিদেই।
গিরিবর্ত্মের দেশ। সেখানে গেলে নীল আকাশ আরও বেশি নীল। রুক্ষ পাহাড় উপত্যকার শুখা হলুদ রংটায় নানান শেডস্‌, ল্যান্ডস্কেপের দুনিয়া। সিন্ধুতীরে বসে ভারতের আদি কথার গপ্পোরাজ্যে মনের অজান্তেই স্মৃতির খোঁজ।
কারাকোরামের বধ্যভূমি পেরিয়ে আফগান বাণিজ্যপথে এখন আর কোনও উটের দল হাঁটে না - জোব্বাধারির দল নদীর পাড়ে কোনও গাঁয়ে তাঁবুও ফেলে না। হিমশীতল মরুপাহাড়ের বুকে এপাহাড় ওপাহাড় ডিঙিয়ে রোজ সূর্যটা সাঁঝ-বিকেলে আঁধার ঘরে ডুব দেয় শুধু। Bada Imamabaraওখানেই ৯০০ বছরের পুরোনো লামায়ুরু গুম্ফা, ওখানেই সাগরঢেউয়ের ছোঁয়াচলাগা প্যাংগং, ওখানেই স্টোক কাংড়ির বরফদেহ ছুঁয়ে থাকা শহর লে - হেমিস, থিকসে, শ্যে, শঙ্কর গুম্ফা আর সিন্ধুনদের উচ্ছলতা - সঅব আছে। দূরে পড়ে থাকা নুব্রা, সো মোরিরি কিম্বা দা, হানুর মতন সুপ্রাচীন আর্যগ্রাম সেসবই আছে লাদাখে। আমার কাছে লাদাখ খুব সুন্দর, কেন জানি না - ভীষণ সুন্দর একটা রূপকথার দেশ।
লে শহর প্রান্তে ঠিক যেখানে শ্যে প্রাসাদটাকে মাথায় করে মেটেরঙা পাহাড়টা বেঁকে উঠেছে - সামনেই রাস্তা, সবুজ জলা, চারণরত ঘোড়ার দল। গুম্ফার নীচে বিরাট উঁচু তিন চোর্তেন, মাঝে রাস্তা, সবুজ ছায়ামাখা সেই রাস্তার ধারেই দু দন্ড বিশ্রামের মুহুর্তে কানে ভেসে আসা পাহাড়িয়া ঝোরার শব্দ আর সেই শব্দস্নাত মনের কোনে ঐ পাহাড় গায়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া কোনও পরবাসী তরুণীর মিস্টিক ফ্রেম।
আগের দিনই লে পৌঁছেছি। আরেক সাতসকালে সো মোরির পথে কোয়ালিস যাত্রা। মাঝে ফেলে আসা সিন্ধুদর্শন ঘাট, থিকসের মতন প্রাচীন বৌদ্ধমঠ, শ্যে প্রাসাদ ইত্যাদি। সে সবও দেখেছি - দুচোখ ভরে। ছবির দুনিয়ায় নতুন করে আমার ছবিগুলোকে ফ্রেমে বাঁধতে চেষ্টা করেছি। পারিনি - যে ছবিকে যেমনি করে দেখতে চাইলুম, তেমনি সহজিয়া রংপ্লাবনে নিকিয়ে নিতে পারলুম না আমার শহুরে ক্যানভাসটাকে। বোধহয় এমনিই হয়। প্রকৃতিকে কোনও রঙে-রেখায় বাঁধা যায় না যে! আমিও কেমন বেআক্কেলে, বেওকুফের মতন ভাবছিলুম বলুন?

Hazarduariমিলিটারি বেস কারু তারপর সিন্ধু তীরের রাস্তা ধরে সোজা উপসি। একটা ছোট্ট গঞ্জ। ডানদিকে সিন্ধুর গর্জ(Gorge)। সকালের ভারি ব্রেকফাস্টটা এই উপসিতে সারতে হবে। পরের রাস্তা-মাঝের রেস্তোরাঁর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না আর সো-মোরিরি পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যায়।
একটা গাঁ, গোটা চল্লিশেক ঘর ইতিউতি ছড়ানো পাহাড়ের ঢালে ঢালে, শুষ্ক বালির মাঠ। কনকনে হাওয়ার দাপট আর বরফ পাহাড়ের হিমছোঁয়া। এনিয়েই একটা স্বপ্নময় জগৎ। যেখানে তিব্বতী যাযাবর রূপকথার মেয়েটা নীল জলে ভেসে বেড়ায় আজও। ব্যাকুল ইচ্ছেডানায় ভেসে কোনও এক ফাঁকে ঢুকে পড়েছিলাম ওদের সীমানায়। মনের ঘর খুললো এবার। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও এ্যাতোকাল ওকে পাইনি। আসলে কোরজোক গ্রামটা ভারি অদ্ভুত। সো-মোরিরি হ্রদ ছোঁয়ানো তস্য ছোট্ট একটা বসতি বলা যায় একে। শীতের দিনগুলোতে আর্মি রিলিফ আসে সপ্তাহান্তে। আবহাওয়া খুব খারাপ থাকলে সে রিলিফও বন্ধ। তবু ওরা বাঁচে। লড়াই, বেঁচে থাকার যুদ্ধে সব পাহাড়িরাই পারঙ্গম। কিন্তু কোরজোকের গ্রাম্য চাংপারা শতেক তিব্বতী পাহাড় ডিঙানো এক উপজাতি - এরা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও বাঁচার তরিকা জানে। শুকনো, রোদেসেঁকা মাংস আর বার্লি সঙ্গে লোকাল বিয়র। আট মাসের শীতটাকে ফি বছর ঘরে বসেই কাটিয়ে দেয় এরা।Sunset at Khosbag
লে থেকে মাহে, তার ঠিক পরেই সিন্ধু ব্রিজ টপকে রূপসু উপত্যকার পথ। আসলে চুমাথাং পেরনো মাহে থেকে দুটো রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে। একটা গিয়েছে নোমার পথে তিব্বতের দিকে, আরেকটা এই রূপসু। সেখানেই সোমোরিরি। তিব্বতীয় যাযাবরদের মেয়ে সো-মোরিরি এখানে রূপকথার গল্পের ছোট্ট নায়িকা। তার ছিল পোষা এক গাধা। সপরিবারে এ পাহাড়-সে পাহাড়, বরফে ঢাকা মাঠ, নদী-ঝরনা পেরিয়ে যেতে যেতে কখন খেলার ছলে দুই বন্ধুতে মিলে হারিয়ে গেছিল ওরা দুটি প্রাণী। শোনা যায়, বরফ ঝড়ের মধ্যে পড়ে পাক খেতে খেতে সো-মোরিরি আর তার অবলা বন্ধু দিশা হারায়, তারপর বহু বছর কেটে গেছে – কেউ ওদের খুঁজেও পায় নি। লোকবিশ্বাস, এই নীল অতলে, হিমেল ঢেউতোলা সরোবরের নিচে আজও শীতঘুমে আছে ওরা।
লে থেকে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায় সো-মোরিরি। পৌঁছবার বেশ কিছুটা আগেই রাস্তা পাশে সবুজ ঘাসজমির দিকে তাকিয়ে থাকলে ধূসর-খয়েরি রঙা, বুনো খরগোশের মতন চেহারার প্রাণীর দেখা মিলবে। জাঁসকারের উচ্চতম উপত্যকা অঞ্চলের এই প্রাণীদের মারমেট বলা হয়। পুবদিকে তিব্বত আর পশ্চিমদিকে জাঁসকার উপত্যকা - মধ্যিখানে রূপসু উপত্যকায় সো-মোরিরি। সবুজ-নীল রঙা হ্রদ, ওপারে চাংসের কাংড়ি আর লুংসের কাংড়ির বরফচূড়া। সো-মোরিরি হিমহাওয়ার রাজ্যপাট। Tso Moriri
আসলে আদিম, শীতল মরুময় এই পাহাড় অঞ্চল, উপত্যকার প্রান্তে ইচ্ছেমতন ঘুরে বেড়ানো যায়। আবার যায়ও না। সুন্দরী, রূপসী, পাহাড়িয়া প্রকৃতি এখানে টানে – চরৈবতির আকর্ষণ যাঁরা কোনও মতেই এড়াতে পারবেন না, তাঁরাই পৌঁছোবেন এই প্রান্তীয় হিমশীতলের কোলে। জোরে হাওয়া বইলে শ্বাসের বড় কষ্ট। অক্সিজেনের অভাব। ক্ষণে ক্ষণে রক্তে অক্সিজেন মাত্রা কমে। ভালো থাকার দাওয়াই একটু একটু জলপান। এমনই কিছু তথ্য, কয়েকটা গল্পের প্লট আর অবাধ প্রকৃতির টানে সো-মোরিরি-তে পৌঁছেছিলাম জুলাই মাসের শেষে।

তারপর দুটো দিন দুটো রাতের মুগ্ধ হওয়ার রঙিন বৃত্তান্ত। একটা মেটে মনাস্ট্রি - প্রাচীন কোরজোক। দোতলায় উঠে আধো অন্ধকারে অনুপম বুদ্ধমূর্তি। বাইরে গ্রাম রাস্তায় প্রেয়ার হুইল ঘোরায় শহর ফিরতি মানুষ। সিনেমায় দেখা রঙের বদলে সো-মোরিরির রংবাসর আরো উজ্জ্বল, অনেক অনেক জীবন্ত। প্রাণ চঞ্চল চাংপা মেয়ের মধ্যে সো-মোরিরি নামের মেয়েটাকে খুঁজেই পেলাম না। সে বোধহয় আমারই ভুল। বরং সে রূপকথায় হারিয়েই থাকুক পরীরানির মতন। আপনি খুঁজবেন তাকে আনমনে অন্যমনে। আমি খুঁজবো অন্য ছুটিবন্ধুকে লেখায়, ছবিতে - লাদাখি গল্পের ছবিঘরের বাইরে।

Sunset at Khosbag


~ তথ্য- লাদাখ ~ সোমোরিরি ~ || ~ সো-মোরিরির ছবি ~ লাদাখের ছবি ~

বর্তমানে ট্রাভেল ছুটি পত্রিকার সম্পাদক ও ট্রাভেল ছুটি ভ্রমণ সংস্থার কর্ণধার সুপ্রতিম তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে যুক্ত থেকেছেন ভ্রমণ, সানন্দা, বর্তমান সহ বিভিন্ন প্ত্রপত্রিকা ও সংবাদ চ্যানেলের সঙ্গে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher