ভূস্বর্গ কিন্নরে

সুদীপ্ত ঘোষ


~ কিন্নরের তথ্য ~ কিন্নরের আরও ছবি ~

রোজকার শহুরে কোলাহল, দশটা-পাঁচটার লড়াইয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একরকম দুম করেই। গন্তব্য কিন্নর, হিমাচল প্রদেশ। সময়টা অক্টোবরের মাঝামাঝি, সেই হিসাবে ভরা মরসুম। ট্রেনের রিজার্ভেশন তখন অলীক কল্পনা। অগত্যা শেষ মুহূর্তে কিছু টাকা বেশি গচ্চা দিয়ে ফ্লাইটের টিকিট বুক করা হল, আর হোটেলের জন্য রেকং পেও-নিবাসী বন্ধুর স্মরণাপন্ন হতে হল। ভরা মরসুমে মৌখিক আশ্বাস সম্বল করেই যাওয়া ঠিক হল। নেহাতই দায়ে পড়ে। কী আশ্চর্য ! এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও শেষ মুহূর্তে সহধর্মিণী ছাড়াও আরও দুই সঙ্গী জুটে গেল, বন্ধু জিনিয়া আর কাকিমা। সব মিলে চারজনের ছোট্ট একটা গ্রুপ। অতঃ কিম, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে 'দুগগা' বলে বেরিয়ে পড়লাম। জয়পুর থেকে আকাশপথে চণ্ডীগড়। চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টে থেকে ইনোভা, সঙ্গে সারথি বিট্টু। চণ্ডীগড় থেকে কল্পার দূরত্ব বেশি হওয়ায় এবং ফ্লাইটের সময় সুবিধাজনক না হওয়ায় মাঝে রাতটা কুফরিতে কাটাবো ঠিক হল।

কুফরি

চণ্ডীগড় থেকে কুফরি সড়কপথে ১৩০ কিলোমিটার। সময় লাগে চার ঘণ্টার মতো। কিন্তু চণ্ডীগড় থেকেই শুরু হল জ্যাম। শম্বুক গতিতে শুরু করে পঞ্চকুলা, পিঞ্জর পেরিয়ে জাতীয় সড়ক-৫ ধরে ছুটে চললাম। কিন্তু বিধি বাম, মাঝে মধ্যেই রাস্তা মেরামতির কাজ চলছে। বেশ কিছু জায়গায় জ্যাম কাটিয়ে, লাইনে দাঁড়িয়ে, ঠোক্কর খেতে খেতে সিমলা যখন পৌঁছালাম রাত আটটা বেজে গেছে। প্রাচীন ব্রিটিশ শৈলশহর তখন ঘুমের চাদরে ঢাকা। ইতিউতি দু-চারটে দোকান খোলা। যার মধ্যে বেশিরভাগই রেস্তোরাঁ। সিমলা থেকে কুফরি খুব কাছে, ১৫ কিলোমিটারের মতো। পাহাড়ি রাস্তায় আরও একঘণ্টা। পাহাড়ের মাথায় ছিমছাম এক শহর। সিমলার মতো কংক্রিটের জঙ্গল এখনও থাবা বসায় নি। কুফরি হলিডে রিসর্টে পৌঁছে মনটা খুশিতে ভরে গেল। বেশ সুন্দর হোটেল। চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা। রাতের ডিনার বুফে হলেও আয়োজন খুব ভালো। ভেজ, নন ভেজ দুরকমই আছে। তবে মন জয় করে নিল শেষ পাতের গরমাগরম জিলিপি আর রাবড়ি। একদম পারফেক্ট শো-স্টপার।

ঘুম ভাঙল ভোরে। এখনও ঠাণ্ডাটা জমিয়ে পড়েনি। কুফরি শীতকালের হিলস্টেশন হিসাবে বিখ্যাত। তাই অক্টোবরে ট্যুরিস্টের তেমন ভিড় নেই। হাল্কা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে হিমালয় জানলার বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে ঘুমভাঙা পাখির দল সকালের আলাপচারিতায় ব্যস্ত। কে জানে কিসের এত ব্যস্ততা। একটু পরে পাহাড়ি পথ বেয়ে লাইন দিয়ে উঠে এলো ঘোড়া, সামনে সহিস। হোটেলের সামনেই ওদের আস্তানা। পাহাড়ি রাস্তায় সওয়ারির অপেক্ষায়। খানিক বাদেই হাজির একের পর এক টুরিস্ট বোঝাই গাড়ি। দলবেঁধে চলল সওয়ার হতে। আমাদের কুফরির মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। সিমলা থেকে কল্পার দুরত্ব ২৫০ কিলোমিটারের মতো, পাহাড়ি রাস্তায় আট ঘণ্টার ধাক্কা। তাই বেরিয়ে পড়লাম। জলযোগটা পথেই সেরে নিতে হবে।

কল্পা

কুফরি থেকে ফাগু, থিয়গ, নারকান্ডা, রামপুর, ওয়াংটু, টাপরি, কারছাম পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় রেকং পেও। রেকং পেও এর ঠিক ওপরেই (৭ কিলোমিটার) অবস্থিত কিন্নরের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম কল্পা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ২৯৬০ মিটার। রেকং পেও থেকেই কিন্নর কৈলাস রেঞ্জ দেখা যায়। রেকং পেও পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল। পশ্চিম থেকে গোধূলির আলো পুরো রেঞ্জে পড়েছে। কল্পা থেকে কিন্নর কৈলাস রেঞ্জের সৌন্দর্য তো অবিশ্বাস্য। তুষারশৃঙ্গগুলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। হোটেল সাংগ্রিলা আমাদের গন্তব্য। হোটেলে যখন পৌঁছালাম তখনো সূর্যাস্ত হয়নি। লাগেজ রেখে পৌঁছালাম পাঁচ তলায়। এটা হোটেলের অ্যাটিক কাম লাইব্রেরি। নানা রকম বইয়ে ঠাসা। কলকাতা নিয়ে শ্রদ্ধেয় নিমাই ভট্টাচার্যের বই চোখে পড়ল। এছাড়া বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন বিষয়ের বই চোখে পড়লো। পুরো সংগ্রহটা রীতিমতো তারিফযোগ্য। লাইব্রেরির লাগোয়া ব্যালকনি, যেখান থেকে রেঞ্জটা করমর্দনের দূরত্বে। পড়ন্ত বিকেলের হলুদ আলোয় পুরো রেঞ্জটা কল্পনাতীত সুন্দর হয়ে ওঠে। সূর্যাস্ত দেখে একটু ফ্রেশ হয়ে আবার এসে বসলাম লাইব্রেরিতে। মিউজিক সিস্টেমে লো ভল্যুমে বেজে চলেছে ভগবান বুদ্ধের মন্ত্রধ্বনি। পাশে ধ্যানমগ্না বিদেশিনি। আলমারি থেকে স্নো লেপার্ডের ওপর লেখা একটি বই টেনে নিলাম। কয়েকটা পাতা সবে পড়া হয়েছে, এমন সময় বাকিরা এসে হাজির। সঙ্গে কফি মগ। জিনিয়ার আবার ক্রসওয়ার্ড, স্ক্র্যাবেলের এর নেশা। স্ক্র্যাবেল বোর্ড পেতেই শুরু হল খেলা। ডিনারের ডাক পেয়ে খেলা যখন সাঙ্গ হল, দেখা গেল জিনিয়াই জিতেছে।

খুব সকাল সকাল উঠে পড়লাম সানরাইজ দেখতে। চারদিকে আপেল বাগানের মাঝে আমাদের হোটেল। গাছ থেকে তখন আপেল পাড়া চলছে। দিনের আলো ভালো করে ফোটেনি। রেঞ্জটা তখনও আলো-আধাঁরিতে ঢেকে। ক্যামেরা বাগিয়ে ট্যুরিস্টের দল বিভিন্ন হোটেলের ছাদে, ব্যালকনিতে তৈরি। সুয্যি মামা উঁকি দিলেই পাকড়াও করবে। সূর্য মুখ দেখানোর আগেই আকাশ জুড়ে শুরু হয়ে গেল হোলিখেলা। বরফে ঢাকা রেঞ্জের পিছনে কে জানি মস্ত টর্চ জ্বেলে ধরেছে। সকালের গোলাপি আলোয় শৃঙ্গগুলো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে। অবশেষে সূর্যদেব উঁকি দিলেন। কল্পা থেকে কিন্নর কৈলাস রেঞ্জের আরেকটি আকর্ষণ হল শিবলিঙ্গ দর্শন। শিবলিঙ্গটি আদতে একটি ৭৯ ফুট দীর্ঘ পূর্ণ শৈলখণ্ড (মোনোলিথ)। যেটা দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যের আলোয় বিভিন্ন রঙে ধরা পড়ে। আলোকরশ্মির আপাতন কোণের ওপর নির্ভর করে সারাদিন ধরে চলে এই রঙের খেলা। হোটেলের লাইব্রেরির ব্যালকনিতে রাখা দূরবীনে চোখ লাগিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম সেই আপাত অলৌকিক অভিজ্ঞতা। সানরাইজ দেখে বেরিয়ে পড়লাম। চারিদিকে শুধু আপেলের বাগান। গ্রিন আপেল, গোল্ডেন আপেলও কম নেই। বেশ কিছু জায়গায় আপেল প্যাকিংপর্ব চোখে পড়ল।

ব্রেকফাস্ট করে চললাম রোঘি ভিলেজ। কল্পা থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরত্বে প্রকৃতি তার ঝুলি উপুড় করে দাঁড়িয়ে আছে আপনার অপেক্ষায়। কিন্নরী জীবনযাত্রার একঝলক আপনার মন ভরিয়ে দেবে। যাওয়ার রাস্তাও কম রোমাঞ্চকর নয়। একদিকে খাড়াই পাহাড় তো আরেক দিকে গভীর খাত। সুইসাইড পয়েন্ট-এর বাঁকে ফোটোগ্রাফারদের ভিড় এড়িয়ে গিয়ে পড়লাম গ্রামে। চারদিকে অখণ্ড শান্তি। আর পাঁচটা পাহাড়ি আটপৌরে গ্রামের মতই। বাহুল্য বর্জিত। ছোট মন্দির, পাকদণ্ডী, কাঠের বাড়ি, আর হিমালয়। আপেল বাগান, পাইনের জঙ্গলের ফাঁক গলে একঝলক হিমালয়। বরফ তো চূড়াগুলো থেকে হাত বাড়িয়েই তুলে নেওয়া যায়। গ্রামে ঢোকার মুখেই বাঙালি কাকু আপেলের দরদাম নিয়ে ব্যস্ত চোখে পড়ল। আমরাও দলে ভিড়ে গেলাম। গোল্ডেন আপেল, গ্রিন আপেল সব কিছুই চেখে দেখা হল ।

একে একে ঘুরে নিলাম নারায়ণ-নাগিনি মন্দির, হু-বু-লান-কার মনাস্ট্রি। এছাড়া ঘুরে নিলাম ছবির মতো সুন্দর শহর রেকং পেও। রেকং পেও থেকে ৩ কিলোমিটার দূরের কোঠি গ্রাম এবং চণ্ডিকা দেবীর মন্দির।

বিকেলে রেকং পেও থেকে ফিরে কফি মগ হাতে আড্ডা শুরু হল লাইব্রেরিতে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও আড্ডা জমছিল না। গম্ভীর মুখে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিলাম। ঘটনাটা নেহাত হেলাফেলার নয়। আজ পুরো দিন চেষ্টা করেও নাকোতে যোগাযোগ করা যায়নি। এতদূর এসে নাকো না গিয়ে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয়না। কিন্তু বুকিং ছাড়া নাকোর মতো আপাত দুর্গম জায়গায় গিয়ে পড়লে কপালে বিড়ম্বনা লেখা থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে যোগাযোগের চেষ্টা চলছিল। কিন্তু কোনও আশার আলোর দেখছিলাম না। সেই সময়েই দেখা পেলাম আমাদের এক শুভানুধ্যায়ীর, তিনি আর কেউ নন স্বয়ং দলাই লামা। না, স্বশরীরে নয়। দেওয়ালে ঝোলানো পোর্ট্রেট থেকে তাঁর হাস্যমুখের ছবি আর আশ্বাসবাণী আমাদের বরাভয় দিল। 'মেডিটেশন অন ডাইং।' "আজ নয় কাল, হয়তো বা পরবর্তী মুহূর্তেই সব কিছু ছেড়ে যেতে হবে এটা নিশ্চিত জেনেও আমরা সব কিছু আঁকড়ে ধরি। এটা ভেবে, যেন আদি অনন্তকাল জীবিত থাকতে এসেছি।" তাই এই স্বল্পায়ু জীবনের বাকি দিনের কথা চিন্তা না করে আবার পথে নামাই ঠিক হল। জীবনের মুহূর্তগুলোকে আরও একটু উপভোগ্য করে তুলতে।

রাতে ডিনারের জন্য বাইরে বেড়িয়ে পড়লাম। একটু স্বাদবদলের জন্য। বাইরে ঠাণ্ডাটা বেশ মনোরম। কাকিমা শাল জড়িয়ে বেশ পরিপাটি। একটু এগোতেই চোখে পড়লো 'হোটেল শিবালিক।' বাঙালি হোটেল। ম্যানেজার স্বপন চট্টরাজ মশাই খুব আন্তরিক। পাত পেড়ে ভাত, ডাল, আলুপোস্ত আর আলু দেওয়া খাসির মাংস। তোফা রান্না। রাঁধুনির হাত যেন সোনায় বাঁধানো। সেই স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে। ভুরিভোজের পর পরবর্তী দিনের জন্য দুশ্চিন্তাটা অনেকটা কমে গেলো। আর কে না জানে ভরপেট খাওয়ার পর মুখে পান নিয়ে বাঙালি আজীবন বিশ্বজয় করে এসেছে। সুতরাং এবারও তার অন্যথা হয় কেন।

নাকো

কল্পা থেকে নাকোর দুরত্ব ১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। কল্পা থেকে নীচে নেমে রেকং পেও হয়ে ৫নং জাতীয় সড়ক ধরে আরও উত্তরের দিকে চলতে হবে। পথের অধিকাংশ সময় সঙ্গ দেবে সাটলেজ অর্থাৎ শতদ্রু। কল্পা থেকে সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলাম। শতদ্রুকে ডান দিকে রেখে চলতে শুরু করলাম। একে একে আকপা, স্পেলো, পোহ ফেলে রেখে পৌঁছালাম স্পিতি আর শতদ্রূর সঙ্গমে। পথের বর্ণনা দিয়ে আর লেখাটা দীর্ঘায়িত করব না। তবে এটুকু বলতে পারি না গেলে জীবনে অনেক কিছু না দেখা থেকে যেতে পারে।

'খাব' গ্রামের রাস্তা থেকে কিছুটা এগিয়ে লোহার সেতু পার হয়ে প্রবেশ করলাম স্পিতি ভ্যালিতে। রাস্তার পাশে সবুজ বোর্ড আপনাকে লাহুল স্পিতিতে স্বাগত জানাতে তৈরি। রাস্তা এখানে আরও ভয়ঙ্কর এবং আরও সুন্দর। পাহাড়ের গা বেয়ে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। তার পাশে কোথায় লাগে রোলার কোস্টারের উত্তেজনা। এক দিকে সুউচ্চ পাহাড় তো আর এক দিকে অতল খাদের হাতছানি। গাছপালা ক্রমে কমে এলো, শুরু হল কাঁটাঝোপের মরুপ্রান্তর। কোল্ড ডেসার্ট। চারিদিকে বোল্ডারময় কর্কশ, ন্যাড়া পাহাড়। অদূরে পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে এসেছে বরফের হাল্কা আস্তরণ। তারই মাঝে সর্পিল রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলেছে। এখানে এক ফাঁকে বলে রাখি, কল্পা থেকে নাকোর পথে কিন্তু কোনো পেট্রল পাম্প নেই। তাই যাত্রা শুরু করার আগে রেকং পেও থেকে তেল ভরিয়ে নিতে ভুলবেন না।

নাকো তখনও চার কিমি, সূর্য তখন ঢলতে শুরু করেছে। রাস্তার ধারে একটা ধাবার দর্শন পেলাম। জনমানবহীন ধু ধু প্রান্তরে চা এর আশা জেগে উঠলো। কালক্ষেপ না করে গাড়ি থামিয়ে চা এর অর্ডার দেওয়া হল। ক্লান্ত ঠোঁটে চা এর কাপ, নীচে সুগভীর স্পিতি ভ্যালি, চারিদিকে আদিগন্ত হিমালয় ... সব মিলিয়ে বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম রোম্যান্টিসিজিম। যেখানে প্রেম, প্রকৃতি সব মিলে মিশে একাকার।

নাকো যখন পৌঁছালাম সূর্যদেব পশ্চিমাকাশে। বিকেলের মনকেমনকরা মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে স্পিতি ভ্যালি তখন স্বর্গীয়, অনির্বচনীয়। হিমালয়ের কোলে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা জনপদ 'নাকো', মধ্যে ছোট্ট একটি লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৩৬৬২ মিটার। ছবির মতো সুন্দর। হয়তো সৌন্দর্যের দিক থেকে সো মোরিরি বা প্যাংগং লেকের রমণীয় সৌন্দর্যের পাশে নেহাতই নাবালক। কিন্তু গ্রাম্য কিশোরীর মতো তার নিষ্পাপ রূপ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। নয়নাভিরাম দৃশ্য কোন শিল্পীর অলীক কল্পনাকেও হার মানায়। ইঞ্চি মেপে প্রতিটা গাছ, পাহাড়, আকাশ যেন শিল্পীর ক্যানভাস থেকে তুলে আনা। ব্যাকড্রপে গ্রাম্য ঘরবাড়ি যেন ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা কোনও প্রাচীন সভ্যতার পরিচয়বাহী। ফটোগ্রাফার হওয়ার প্রয়োজন নেই, যেদিকে প্রাণ চায় ক্যামেরা ফ্রেম করুন, হলফ করে বলতে পারি আপনার তোলা ছবি টেবিলে রাখা ক্যালেন্ডারকেও হার মানাবে। তুষারশৃঙ্গ ছুঁয়ে নেমে আসা হিমেল হাওয়ার স্রোত পড়ন্ত বিকেলে হাড় কাঁপিয়ে দিল। দেখতে দেখতে পাহাড়ের গা বেয়ে, উইলো আর পপলার গাছের হলুদ পাতা ছুঁয়ে মন কেমন করা সন্ধ্যে নেমে এল।

আমাদের আস্তানা কিন্নর ক্যাম্প। পাহাড়ের গা ঘেঁষে সারি দিয়ে সতেরোটা স্যুইসস্টাইল লাক্সারি টেন্ট। সঙ্গে মাল্টিকুইজিন রেস্টোরেন্ট। প্রতিটা টেন্ট আলাদা আলাদা শৃঙ্গের নামে নামাঙ্কিত। তাঁবুর পিছন থেকেই ধাপে ধাপে উঠে গেছে খাড়াই পাহাড়। প্রতিটা ধাপে সার দিয়ে আপেল গাছ। কোমর সমান উঁচু গাছগুলো আপেলের ভারে নুয়ে পড়েছে। সন্ধ্যে আঁধার একটু ঘন হতেই শুরু হল হাওয়ার দাপট। হাওয়ার দাপটে তাঁবুর তখন নাভিশ্বাস উঠছে। বাইরে পারদ তখন হিমাংক ছুঁয়েছে। একটু পরে হাওয়ার দাপট কমে এলে বাইরে এলাম। চারদিক পাহাড় ঘেরা ঝকঝকে আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ। দূরে পাহাড়ের চূড়ার বরফ জ্যোৎস্না মেখে দাঁড়িয়ে আছে। কাজকালো আকাশে ফুটে উঠেছে লক্ষ কোটি তারা। নক্ষত্রমন্ডলের ভিড়ে আকাশগঙ্গাও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। অপার্থিব সেই দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে বহু মাইল হাঁটা যায়। ক্যাম্পের মালিক শান্তা নেগীজি ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করে ফেলেছেন। গিটারটা প্রচণ্ড মিস করছিলাম। গাইতে বা বাজাতে না জানলেও শ্রোতা হিসাবে আমার বেশ নামডাক। কুছপরোয়া নেই, কাকিমাই উদ্যোগী হয়ে শুরু করে দিলেন অন্ত্যাক্ষরী। একে একে সবাই তাতে যোগ দিয়ে গলা মেলালাম। জিনিয়া আর সোহিনীর রবীন্দ্রসঙ্গীত যখন জমাটি হতে শুরু করেছে তখনই ডাক পড়ল ডিনারের। ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁয়েছে। ডাইনিং রুমে গিয়ে 'সাঙ্গা'র দেখা পেলাম। শান্তাজীর পোষ্য সারমেয়। জাতে কুলীন ম্যাস্টিফ। আকারে প্রকাণ্ড কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে নেহাতই গোবেচারা। নিতান্তই নিষ্পাপ। খাওয়ার আয়োজন মন্দ নয়, ভাত, রুটি, ডাল ফ্রাই, মিক্স ভেজ, চিকেন কারি আর শেষপাতে ফ্রুট কাস্টার্ড। বাঙ্গালির মান রাখতে ঐ শীতেও ভাতটা খেলাম। আর চিকেনটা এক কথায় অসাধারণ। খোঁজ নিয়ে জানলাম রাঁধুনি আর কেয়ারটেকার ভদ্রলোক আমাদের বঙ্গদেশের। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ডাইনিং রুমের অধিকাংশ অতিথিই বাঙালি। ডিনার করে বাইরে দাঁড়াতে ঠাণ্ডাটা দাঁত, নখ বের করে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে যে যার টেন্টে ঢুকলাম। খানিক বাদে ক্যাম্পের অল ইন অল, দেবাশিসদা প্রত্যেকের জন্য গরম জলের ব্যাগ নিয়ে হাজির। বলল কোনো চিন্তা নেই, দরকার হলে আরও ব্যাগ পাওয়া যাবে। যাই হোক দুটো কম্বল নেওয়ার পর,একটা করে হট ওয়াটার ব্যাগেই ঠাণ্ডাটা বাগে এসে গেল।

গোলাপি আলো ছড়িয়ে দিয়ে সূর্যদেব পরদিন সকালে যথাসময়ে হাজির। ঝকঝকে নীল আকাশে ধ্যানমগ্ন তুষারশুভ্র হিমালয়ের রঙবদল গোটা উপত্যকাকে মায়াবী করে তুলল। আগের দিন বিকালে নাকোর স্নিগ্ধ রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু সকালের তন্দ্রাচ্ছন্ন উপত্যকার মাঝে লেকের শান্ত নীল জলে হিমালয়ের পপলার, উইলোর হলুদ পাতার প্রতিবিম্ব পৃথিবী সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে নরম সূর্যের আলোয় তারিয়ে তারিয়ে সকাল হওয়াটা উপভোগ করলাম। আড়মোড়া ভেঙে ছোট্ট গ্রামটা জাগছে। বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে করেই ক্যামেরা নিলাম না। মনের ক্যামেরায় বন্দী করব বলে। আমি সাহিত্যিক নই, কিন্তু হিমালয়ের এক স্বল্পখ্যাত ছোট জনপদের সেই সকাল আজ কলম ধরতে বাধ্য করল। জানি না ক্যামেরা না নেওয়ার ক্ষতিটা এই লেখা দিয়ে উসুল করতে পারব কিনা।

ক্যাম্পে যখন ফিরলাম তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। বাকিরাও ফ্রেশ হয়ে রেডি। আরেক রাউন্ড চা শেষ করে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। ব্রেড, বাটার, জ্যাম, টোস্ট, অমলেট ইত্যাদি ছাড়াও একটা করে আলু পরোটা গলাধঃকরণ করা হল। এরপর ফ্রুট স্যালাড দিয়ে তখনকার মতো প্রাতরাশের যবনিকা টানা হল। এরপর ক্যাম্পের গা বেয়ে মেঠো পথ দিয়ে নেমে গেলাম লেকের কিনারে। ইতঃস্তত, উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো। কখনও গ্রামের পথে। সরু পাথুরে রাস্তায়। শহুরে থ্রি জি, ফোর জি ইন্টারনেট দৌড়ের থেকে অনেকদূরে। আরেক দিকশূন্যপুরে।

ট্রেকিং-এ আগ্রহীরা ক্যাম্প থেকে ঘুরে আসতে পারেন তাশিগাং, সমাং মনাস্ট্রি, নাকো ফলস, নাকো পাস। এছাড়াও আছে কাছাকাছি গ্রামগুলো যেমন লিও, চাঙ্গি, ইয়াংথাং। ট্রেকিং-এর যাবতীয় বন্দোবস্ত করে দেন ক্যাম্পের মালিক শান্তা নেগী। হাঁটাপথে ঘুরে নিলাম নাকো মনাস্ট্রি, পদ্মসম্ভবের পদচিহ্ন। এখানে বলে রাখি, নাকো খুব ছোট জায়গা, তাই আগে থেকে বুকিং না করে গেলে অসুবিধায় পড়তে পারেন। মোবাইলেরর টাওয়ার বিএসএনল ছাড়া পাবেন না।

সাংলা – ছিটকুল

নাকোর পাট চুকিয়ে রওনা হলাম সাংলার দিকে। নাকো থেকে দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা। যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই ফেরত চললাম। ব্রেকফাস্ট করে ফেরার পথ ধরলাম। স্পিতি ভ্যালির সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ আবার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। ৫০৫ নং জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে ইয়াংথাং গ্রামের রোড কাট থেকে এগিয়ে দেখি বিধি বাম। রাস্তা চওড়া করার জন্য ডিনামাইট ব্লাস্টিং করা হচ্ছে। অগত্যা এক ঘণ্টার অপেক্ষা। কিছু পরে জানা গেলো ব্লাস্টিং এর ফলে পাহাড়ে ধ্বস নেমেছে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা এগোতেই দেখা গেল এক পেল্লায় পাথর রাস্তা জুড়ে পড়ে আছে। ছোট বড় পাথরের টুকরো তখনও পড়ে চলেছে। আমাদের গাড়ি থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ২০০ মিটার। ধ্বসের বহর দেখে বুঝলাম গতিক বিশেষ সুবিধের নয়। গাড়িতে ফিরে দেখলাম। পিছনে লম্বা লাইন, ফেরার পথও বন্ধ। উপায়ান্তর না দেখে গাড়িতেই বসতে হল। যাইহোক আরও তিন বার ব্লাস্টিং-এর পর পে লোডার দিয়ে রাস্তা সাফ করে যান চলাচলের যোগ্য করতে করতে ছ ঘণ্টা কেটে গেল। সেও এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। রাস্তা খুলে দেওয়ার পর যখন ধ্বসপ্রবণ জায়গাটা অতিক্রম করছি, তখনও গাড়ির ছাদে টুপটাপ পাথর ঝরে পড়ছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি বিপজ্জনকভাবে বেশ কিছুটা অংশ ঝুলে রয়েছে। ছ-সাত ঘণ্টা রাস্তায় অকারণ নষ্ট হওয়ায় শিডিউল কাটছাঁট করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

রেকং পেও যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সাতটা বাজে। অন্ধকার নেমে এসেছে। এখনও দেড় ঘণ্টার রাস্তা। আরও এগিয়ে কারছাম-এ বাঁধের কাছে শতদ্রুর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে বাম দিকে সাংলা-ছিটকুল রোড ধরলাম। শুরু হয়ে গেল সাংলা ভ্যালি। হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট এর চৌহদ্দি পেরনোর পর রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুটা এগিয়ে বাসপা নদীকে ডানদিকে রেখে গাড়ি চলতে লাগল। পাশে অন্ধকার পাহাড়ের পাশ দিয়ে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় চতুর্দিক বানভাসি। পিছনের পাহাড়ে রেকং পেও শহরটা আলোর মালা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব ইচ্ছে করছিল গাড়ি দাঁড় করিয়ে জ্যোৎস্না দেখার কিন্তু ঘড়ির কাঁটা সে আশায় জল ঢেলে দিলো। সাংলা যখন পৌঁছলাম রাত তখন নটা। ঠাণ্ডা নাকোর থেকে বেশ কম। উপভোগ্য। সারাদিনের ধকলের পর কোনোরকমে ডিনার সেরে শরীরটা নরম বিছানায় এলিয়ে দিতেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে। ফ্রেশ হয়ে জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে বাইরে বেরলাম। সকালের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। বাসস্ট্যান্ডে লোকজন আসতে শুরু করেছে। চারদিক পাহাড়ঘেরা ছোট শহর সাংলা, পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে বাসপা নদী। তিব্বত বর্ডার খুব কাছে হওয়ায় ১৯৮৯ সাল অবধি এখানে আসতে ভারতীয়দের ইনার লাইন পারমিট নিতে হত। এখন অবশ্য সেই ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয়না।

সকালে আলুর পরোটা, আচার, দই সহযোগে ব্রেকফাস্ট সারলাম। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরমাগরম চা। চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাসপা। খরস্রোতা নদীর কুলকুল শব্দে নিস্তব্ধ উপত্যকা মুখরিত। কাছেই ঢঙ ঢঙ শব্দে ঘণ্টা বাজল। কানে ভেসে এল স্কুলের প্রার্থনাসঙ্গীত। এগিয়ে গিয়ে স্কুলটাও দেখা গেলো। ইউনিফর্মপরা এক ঝাঁক কচিকাঁচা। জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে প্রার্থনাপর্ব শেষ হতেই লাল সোয়েটারপরা খুদের দল গুটিগুটি ক্লাসে ঢুকে গেল। আর সারাদিনের জন্য মনের সুরটা বেঁধে দিয়ে গেল। জলযোগ শেষ করে আবার যাত্রা শুরু। গন্তব্য ছিটকুল। প্রাচীন ভারত-তিব্বত বাণিজ্য সরণীর সীমান্ত গ্রাম। সাংলা থেকে দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। গাড়িতে সময় লাগে ঘন্টাখানেক। সরকারি বাসও পাওয়া যায়।

সাংলা থেকে দেখে নিতে পারেন সাংলা মনাস্ট্রি, কাম্রু দুর্গ (হিমাচল প্রদেশের অন্যতম প্রাচীন দুর্গ), বেরিং নাগ টেম্পল, বাতসেরি ভিলেজ এবং ছিটকুল।

সাংলা ভ্যালি প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গ। উঁচু উঁচু পাইন, সিডার এর জঙ্গল চিরে কুলকুল করে বয়ে চলেছে বাসপা। পাহাড়ের মাথা বরফের টুপি পরে দাঁড়িয়ে। উদ্দাম স্বচ্ছ জলরাশি ছোট বড় বোল্ডারে ধাক্কা খেয়ে উপত্যকা জুড়ে এক সঙ্গীত মূর্ছনার সৃষ্টি করছে। প্রকৃতি এখানে কবিতার মতো। ঝরঝরে। স্বপ্নিল। ছিটকুল, রাকছাম, বাতসেরি, থেমগারাং, কাম্রু আর সাপ্নি গ্রাম নিয়ে সাংলা ভ্যালি। অধিবাসীরা সবাই কিন্নরী। উপত্যকা জুড়ে আপেল, গোল্ডেন আপেল, অ্যাপ্রিকট, ওয়ালনাটের বাগান। হিমবাহের বরফগলা জলে পুষ্ট উপত্যকা জুড়ে শুধু সবুজের সমারোহ। সাংলা বাস স্ট্যান্ড পেরিয়ে ব্রিজ পার হতেই, মাইলস্টোন জানান দিল সাংলা জিরো কিলোমিটার। ব্রিজ পেরোতে সামান্য যে শহুরে কংক্রিটের জঙ্গল ছিল তা কমতে শুরু করল। আশপাশের বাড়িঘরে গ্রাম্য স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। চলতে চলতে রাস্তার বাম দিকে বনিং শেরিং, শেরিং চে এর মতো ছোট ছোট গ্রাম পেলাম। তারপরে এলো বাতসেরি। এখানে দেখে নিতে পারেন বদ্রিনারায়ণ টেম্পল। এরপর এলো তুলনামূলক বর্ধিষ্ণু গ্রাম রাকছাম। গোটাদুই ছিমছাম হোটেলও চোখে পড়ল।

রাকছামের পর প্রকৃতি আরও অকৃপণ। পাহাড়চূড়াগুলো আরও কাছে, আরও শুভ্র। হিমবাহগলা জল ছোট, বড় ঝরনা বা প্রবাহ হয়ে মিশেছে মূল নদীতে। উপত্যকায় কিছু দূরে দূরে বেশ কয়েকটা নেচার ক্যাম্প, ভ্রমণবিলাসীদের জন্য। ছিটকুল-এর সামান্য আগে চোখে পড়ল, এক বাঙালি হোটেল শারদীয় শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। ছিটকুল ঢোকার মুখে লোহার কাঠামোর তৈরি গেট জানিয়ে দিল ইন্দো-টিবেট বর্ডারের শেষ গ্রামে এসে গেছি। এখানেও বাঙালিদের সদম্ভ উপস্থিতি। কোনও এক 'গোপাল দা'-কে তার বাড়ির লোকজন খোঁজাখুঁজি করছেন। ছিটকুল এর বিশেষত্ব কোনও এক ব্লগে সুন্দর লেখা আছে। ব্লগার এর নামটা মনে না পড়ায় এখানে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যার মূল বক্তব্য ছিল 'ছিটকুল সম্পর্কে কোন ধারণা তার ছবি দেখে উপলব্ধি করতে পারবেন না, কারণ যত ভালই ক্যামেরা হোক, ছিটকুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে অপারগ।' মনে মনে ব্লগার কে কুর্নিশ জানালাম। কাঠের কারুকাজ করা পাহাড়ি বাড়িঘর, দিগন্ত প্রসারিত নী-লা রেঞ্জ, কাগ্যুপা টেম্পল প্রাপ্তির ভাঁড়ার কানায় কানায় পূর্ণ করে দিলো। ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে যান বাসপা নদীখাতে। চঞ্চলা নদীর কাঁচের মতো টলটলে জলে পা ভিজিয়ে নিন। সামনে আদিগন্ত ঘাস জমিতে চরে বেড়াচ্ছে গবাদি পশুর দল। বাতাস কানে কানে যেন ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে 'ওম মণি পদ্মে হুম।'

দুপুরের খাওয়াটা ছিটকুলেই করা হবে ঠিক হল। বাঙালি হোটেল দেখে দ্বিতীয় সম্ভাবনার কথা চিন্তা করাও অস্বাভাবিক। মেনু খুব সিম্পল। ভাত, ডাল, আলুপোস্ত আর ডিমের ঝোল। রান্নাও আহামরি নয়। কিন্তু প্রবাসীর কাছে তাই অমৃত। খাওয়া শেষ করে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে আপেলবাগানে ঢুঁ মারলাম। সাংলা বাজারে নেমে সামান্য কেনাকাটা সেরে হোটেলের পথ ধরলাম। ভোজনবিলাসীরা এখানে ট্রাউট মাছের ফ্রাই ট্রাই করতে পারেন। যদিও সুস্থতার গ্যারান্টিটা নিজেকেই নিতে হবে।

সারাহান

সাংলা পর্ব সাঙ্গ করে আবার পথে নামলাম। সাংলা থেকে সিমলার দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার। আমাদের গন্তব্য সিমলা হলেও ৯০ কিলোমিটার গিয়ে জিয়োরি থেকে সারাহান হয়ে ফিরব। জিয়োরি থেকে সারাহান ১২ কিলোমিটার। সাংলা – ছিটকুল রোড ধরে সাংলা থেকে কারছাম পর্যন্ত এলাম। কারছাম থেকে ৫নং জাতীয় সড়ক ধরে টাপরি, ওয়াংটু, শুরু হয়ে পৌঁছাতে হয় জিয়োরি। জিয়োরি বাজারের আগেই বাম দিকে একটা রাস্তা পড়বে যেটা আপনাকে শর্টকাটে সারাহান পৌঁছে দিলেও, রাস্তার অবস্থা কহতব্য নয়। সুতরাং জিয়োরি পৌঁছে জিয়োরি-সারাহান রোড ধরাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

হিমাচলের বাকি গ্রামের মতই সারাহানও সুন্দর এবং ছিমছাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ২,৩১৩ মিটার। পাইন, ওক, দেবদারুর জঙ্গলে মোড়া, প্রাচীন বুশহর রাজবংশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম ভীমাকালী মন্দির সারাহানের মুখ্য আকর্ষণ। দেবী এখানে রাজবংশের কূলদেবী হিসাবে পূজিতা। কথিত আছে দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর কান এখানে পড়েছিল। মন্দিরের অপরূপ গঠনশৈলী শতাব্দীপ্রাচীন ইন্দো-টিবেট সংস্কৃতির মৈত্র্য-এর সাক্ষ্য বহন করে। মন্দিরের কাঠের কারুকার্য, রুপোয় মোড়া প্রবেশদ্বার মনোমুগ্ধকর। পাশাপাশি দুটি মন্দির, একটি নতুন ও আরেকটি আটশো বছরের পুরনো। পুরনো গর্ভগৃহে অবশ্য সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। ধর্মবিশ্বাস প্রবল না হলেও, সারাহান পৌঁছে মন্দির দর্শনের লোভ সামলাতে পারলাম না। কাকিমা আমাদের হয়ে মন্দিরে পুজো দিয়ে দিলেন। পুজোপর্ব সাঙ্গ করে মন্দিরের সামনের মেলায় গেলাম। গরম গরম জিলিপি দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। ঠোঙা ভর্তি জিলিপি নিমেষে সাবাড়। প্রথমে ঠিক ছিল ফেরার পথে নারকান্ডায় দুপুরের খাওয়া সারা হবে। কিন্তু মন্দির থেকে গাড়িতে ফেরার সময় নাকে এলো বাঙালি রান্নার গন্ধ। জিনিয়া বলল অবশ্যই মাছের ঝোল বানাচ্ছে। জিনিয়ার ওপর ভরসা রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লাম গন্ধের উৎসসন্ধানে। বেশিদূর যেতে হল না। রাস্তার পাশেই বাংলা হরফে বড় করে লেখা। অমায়িক ম্যানেজার বাঙালি দেখে চটজলদি বন্দোবস্ত করে দিলেন। ভাত, ডাল, আলুপোস্ত আর ধোঁয়াওঠা চিকেনের ঝোল দিয়ে রাজকীয়ভাবে লাঞ্চ সারলাম। তারপর আবার পথচলা।

সিমলা

হিমাচল প্রদেশের রাজধানী, আর ভারতবর্ষের ব্রিটিশ আমলের শৈলশহর সিমলা আমাদের শেষ গন্তব্য। সিমলা অন্যতম প্রাচীন শৈলশহর হওয়ায় আর নতুন করে বলার কিছু নেই। দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যাল রোড, চার্চ, টাউন হল, পাবলিক লাইব্রেরি, মিউজিয়াম। দেখে নিন কালকা-সিমলা ন্যারোগেজ ট্রেন। ঘুরে আসতে পারেন ঝাকু হিল। হোটেল থেকে কন্ডাক্টেড ট্যুরের বন্দোবস্ত করে দেয়। রিজ, লোয়ার বাজার, লক্কড় বাজার কেনাকাটার জন্য আদর্শ। হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম। যদিও সাড়ে নটা বেজে গেছে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে লিফটে করে পৌঁছালাম ম্যাল রোডে। সকালের হলুদ রোদ তখনও ঠাণ্ডা পুরো কাটাতে পারেনি। দোকানিরা সদ্য দোকান খুলছে। ম্যাল রোডে মর্নিং ওয়াকারদের ভিড়। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম টাউন হলের সামনে। যাব 'ওয়েক এন্ড বেক কাফে' তে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ক্যাফেতে পৌঁছালাম। পছন্দসই টেবিল পেয়ে অর্ডার দেওয়া হল। স্মাশড পোটাটো, স্ক্রাম্বল্ড এগ, সসেজ, ব্রেড দিয়ে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট। সঙ্গে ক্রেপস, ওয়াফেল এবং অ্যাপল পাই। শেষে হ্যাজেল নাট লাতে। ব্রাঞ্চ দিয়ে সকাল শুরু করার পর ম্যাল রোডের বেঞ্চে বসে আয়েশ করে নিউজপেপারে চোখ বোলালাম। বাকিরা ততোক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শপিং-এ। সিমলা একাধিকবার ঘোরা হওয়ায় ঝাকু হিল, গলফ কোর্স ইত্যাদির জন্য কারো বিশেষ হেলদোল দেখা গেলো না।

ক্যামেরা হাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর পর আবার ক্লান্ত হয়ে রোদে পিঠ দিয়ে বসে পড়লাম। খানিক পরে বাকিরা কয়েকটা ঢাউস ব্যাগ নিয়ে হাজির। চললাম সিমলা কালীবাড়ি দর্শনে। ম্যাল রোড থেকে এগিয়ে বিএসএনএল-এর অফিস ফেলে রেখে এগোতেই চোখে পড়ল ভগ্নপ্রায় এক ব্রিটিশ বাংলো, 'শার্লেভিল ম্যানসন।' বেশ একটা গা-ছমছমে ব্যাপার। ক্যামেরাবন্দী করার সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না। গেটের বোর্ড থেকে জানা গেল এখন জনৈক ভদ্রলোকের সম্পত্তি, সঙ্গে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। কালীমন্দির দর্শন করে ফেরার পথ ধরলাম। পরিত্যক্ত বাংলোর গায়ে তখন বিকেলের রোদ। বাংলোর কাঁচের জানালায় একটা ছায়ামূর্তি থাকলে ভূতবাংলোর তকমা দেওয়া যেত। এইসব হাসিমস্করায় বাকি পথটা কেটে গেলো। টাউন হলের রাস্তা ধরে নিচের দিকে নেমে খাদি ভবনের সামনে 'হানি হাট'-এ মধু দিয়ে চা খেয়ে বিকালের চা-পর্ব শেষ করলাম। এবার হোটেলে ফেরার পালা। হোটেলে ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত চলল ভূতের গল্প। পরদিন সকালে রওনা হয়ে গেলাম চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে নিয়ে চললাম অসংখ্য টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজ। আগামীদিনের পাথেয়।

পুনশ্চঃ - চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টে ফ্রি ওয়াই ফাই-এর সদ্ব্যবহার করছিলাম। কৌতূহলবশত সার্চ করলাম 'হন্টেড হাউস ইন সিমলা।' সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্ক্রিনে ভেসে উঠল 'শার্লেভিল ম্যানসন'। তার উল্লেখ নাকি রুডইয়ার্ড কিপলিং এর লেখাতেও পাওয়া যায়।

~ কিন্নরের তথ্য ~ কিন্নরের আরও ছবি ~

পেশায় জিওলজিস্ট সুদীপ্ত ঘোষ বর্তমানে 'জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'-এর জয়পুর অফিসে কর্মরত। কাজের জন্য বছরে ছয় মাস পাহাড়ে, জঙ্গলে। ফিল্ডে অবসর সময় কাটে বই পড়ে। ক্রাইম থ্রিলার আর ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ পছন্দ। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখাও পছন্দের তালিকায় নতুন সংযোজন। ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে। পাহাড় আর জঙ্গল দুইই বিশেষ প্রিয়। এছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া অন্যতম পছন্দের কাজ। লেখালিখির অল্পবিস্তর চর্চা থাকলেও কোন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠানোর দুঃসাহস আগে হয়নি।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher