রাজ কাহিনি
তপন পাল
রাজস্থানের তথ্য ~ রাজস্থানের আরও ছবি
তৃতীয় দিন -
সকালের জলখাবার খেয়ে পথে। জয়পুর শহর গড়ে তোলেন মহারাজা সওয়াই জয় সিং (০৩-১১-১৬৮৮ থেকে ২১-০৯-১৭৪৩)। মাত্র এগার বছর বয়সে পিতা মহারাজা বিষণ সিঙের মৃত্যুর পর মহারাজা হওয়া এই মানুষটি আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে সওয়াই,অর্থাৎ অপরাপর বাড়ির লোকজনেদের চেয়ে এক চতুর্থাংশ বেশি,উপাধি পান। ১৭০৭এ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ্ তাকে আরও অনেক উপাধি টুপাধি দিয়েছিলেন। দিল্লি আগ্রা জয়পুর নিয়ে ভারতের পর্যটন মানচিত্রের সোনালি ত্রিভুজ। তার তৃতীয় কোণ জয়পুর দিল্লির দক্ষিণ-পশ্চিমে ৩০০ কি.মি.দূরে,আগ্রা থেকে পশ্চিমে ২০০ কি.মি. দূরে। শহরের তিনদিকে আরাবল্লী পর্বতমালা, দুর্গ আর মিনার। পুরো শহর জুড়ে গোলাপী রং; যেন গোলাপের উৎসব; রোজই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে। রাজা দ্বিতীয় রামসিং গোলাপী রং ভালবাসতেন, তাই জয়পুর পিঙ্ক সিটি। নামটা বজায় রাখতে এরা মরিয়া; বাধ্যতামূলকভাবে সব বাড়ির রং গোলাপী। তবে শহর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন শুধু শহরের কেন্দ্রীয় অংশই গোলাপি। শহরটি বেশ ছড়ানো – অনেক ফাঁকা জায়গা এখানে ওখানে; গাছ গাছালি, তাতে বিকালে জল দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, সরকারি অফিস ভবন... স্থাপত্য অতীব মনোরম; চোখের আনন্দ।
সিটি প্যালেস অষ্টাদশ শতকে অম্বরের কচ্ছওয়াড়া রাজপুত রাজা মহারাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের নির্মাণ। মার্বেলের কারুকার্য, স্তম্ভ, জালি বা জাফরি কাজ খচিত অভ্যন্তর। জালেব চক্ ও ত্রিপোলিয়া গেট এই প্রাসাদের প্রবেশপথ। জয়পুরের বর্তমান (আনঅফিশিয়াল) রাজামশাই, কুড়ি বছর বয়স্ক সওয়াই পদ্মনাভ সিং আপাতত বিদেশে; প্রাসাদে থাকেন তাঁর মাতা, বর্তমানে এম.এল.এ. দিয়া কুমারী - জয়পুরের শেষ (অফিশিয়াল) মহারাজা ব্রিগেডিয়ার সওয়াই ভবানী সিংয়ের (১৯৩১ – ২০১১) একমাত্র সন্তান ও তদীয় মাতা পদ্মিনী দেবী। প্রসঙ্গত রাজকুমারী দিয়া কুমারী নব্বইয়ের দশকে তাঁদের পারিবারিক ট্রাস্টের হিসাবরক্ষককে বাড়ির অমতে গোপনে বিবাহ করে সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। প্রাসাদশীর্ষে আজও জয়পুর স্টেটের পতাকা উড্ডীন। স্থাপত্যে মুঘল, রাজপুত এবং ইউরোপীয় ছাপ। বিশেষ আকর্ষণ রুপোর তৈরি গঙ্গাজলি, গঙ্গাজল রাখার দৈত্যাকার পাত্র। মহারাজা দ্বিতীয় মধু সিংহ এগুলি তৈরি করান যাতে সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় তিনি স্নানের জন্য গঙ্গাজল নিয়ে যেতে পারেন।
হাওয়া মহল রাজ পরিবারের মহিলাদের জন্য; সম্ভবত মুসলমানদের দেখাদেখি, রাজপুতরাও মহিলাদের জন্য কঠোর পর্দাপ্রথা চালু করেছিলেন। আটতলা প্রাসাদটিতে জানলা আছে প্রায় ন'শো! মরুভূমির দেশে হুহু করে হাওয়া বয়, সঙ্গে মহিলাদের ঘরে বসে বাইরের জগত দেখার সুযোগ। ১৭৯৯ সালে মহারাজা সওয়াই প্রতাপ সিং দ্বারা নির্মিত।
অ্যালবার্ট হল্ যাদুঘর জয়পুরে রামনিবাস বাগানের অভ্যন্তরে, লন্ডনের আলবার্ট যাদুঘরের আদলে নির্মিত। রান্নার বাসনপত্র, গানবাজনার সরঞ্জাম, সাজগোজের জিনিস থেকে শুরু করে অস্ত্রশস্ত্র, পোষাকপরিচ্ছদ সবই সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে এখানে।
আম্বের (আমের) দুর্গ জয়পুর শহর থেকে জলমহল পেরিয়ে পাহাড়ে উঠে এগারও কিলোমিটার গিয়ে একটি টিলার মাথায়। সাদা মার্বেল আর লালপাথরে মুঘল ও রাজপুত স্থাপত্যের যুগলবন্দী, রাজা মান সিং-এর তৈরি। রাজস্থানের কেল্লাগুলি নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ের ওপরে তৈরি; প্রকৃতপক্ষে এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর। নামার আগে সারথি মহোদয় বললেন গাইড বলবে বাইশটি দর্শনীয় স্পট, কিন্তু আসলে চারটি - গণেশ পোল (পোল = দরজা), শিশ মহল, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস। আর এগুলো দেখার জন্য গাইড নেওয়ার কোনওই মানে হয় না কারণ সবজায়গাতেই বোর্ডে ইতিহাস প্রাঞ্জলভাবে বিবৃত।
মান সিং ছিলেন সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত, তাঁর নবরত্ন সভার একজন, এবং খুব সম্ভবত যোধাবাঈ তাঁর পিসি। নিম্নবর্গীয়রা চিরকালই উচ্চবর্গীয়দের অনুকরণ করে; তাই মান সিং কেল্লার মধ্যে মুঘলদের আদলে দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস তৈরি করাবেন এটাই স্বাভাবিক। বাংলার বারোভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের বিশ্বস্ত অনুচর কমলখোজা ইছামতী নদীর তীরে জ্যোতি দেখতে পান। তিনি মহারাজাকে জানালে প্রতাপাদিত্য সেই বাদাবন পরিষ্কার করে দেবীর অঙ্গশিলা প্রাপ্ত হন ও প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর রাজা প্রতাপাদিত্যের যশোবৃদ্ধি ঘটে, তিনি উৎকল আক্রমণ করে উৎকলেশ্বর শিব ও গোবিন্দ মূর্তি হরণ করে নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। অপরদিকে আকবরের শাসনকালে রাজা মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের রাজ্য আক্রমণ করে দেবী সতীর অঙ্গশিলা জয়পুরে নিয়ে আসেন। তদবধি দেবী যশোরেশ্বরী এই দুর্গে আসীনা। ভোরবেলায় বলি দিয়ে পূজা শুরু হয়। দেবীপূজার ভার বারোভুঁইয়ার অন্যতম কেদার রায়ের পুরোহিত মহেশানন্দ ভট্টাচার্য্যের বংশধরদের হাতে।
শিশমহল বিভিন্ন আকারের ছোট বড়ো আয়না দিয়ে তৈরি। কেল্লার ওপর থেকে দেখা যায় পাশের মাওতা লেক; হ্রদের মাঝখানে চমৎকার উদ্যান। দূরে দেখা যায় পাহাড়, সেইসঙ্গে ফোর্টের পাঁচিল। সূর্যাস্তকালে কেল্লার হলুদ-কমলা পাথরে দিনমণির শেষ আভা অতীব মনোরম।
আমের দুর্গে বংশপরম্পরায় রাজপরিবারের যে সকল পেশাভিত্তিক কর্মচারীরা কাজ করতেন, তাঁরা এখন দুর্গের বাইরে পাহাড়ের কোলে গ্রামে থিতু হয়েছেন। তাঁদের দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা হতেই – তাঁদের এক সমবায় সমিতিতে হাজির। সেখানে প্রাকৃতিক রঙে হাতে কাপড় রাঙানো হচ্ছে, দামি ও স্বল্পদামী পাথর কাটা হচ্ছে; সে এক হইহই রইরই কাণ্ড। বিক্রি হচ্ছে রাজস্থানী রেজাই (কাঁথা সদৃশ), কুর্তা, মূর্তি, শাড়ি, চুড়িদার, স্মারক, উপহার সামগ্রী। পণ্য বিক্রির সময় পণ্যের আধিভৌতিক গুণাবলীর সঙ্গে এনারা আধিদৈবিক কিছু গুণাবলী যোগ করে দেন; যথা ঘরে দুমুখো গণেশমূর্তি রাখলে ধনসম্পদ দ্বিগুণ হবে, উটের চামড়ার জুতো পরলে পায়ের কড়া বা গোড়ালির ব্যথা বশে থাকবে, পিতলের কাটা প্রদীপ বাড়ির নৈর্ঋত কোণে রাখলে বাড়ীতে কারও সংক্রামক রোগ হবে না, পশমিনা রেজাই গায়ে দিয়ে ঘুমোলে স্নায়বিক ও অস্থিসম্পর্কিত আধিব্যাধি পালাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাকে পেশ করা হল এক জ্যোতিষীসমীপে; তাঁরা বংশপরম্পরায় রাজজ্যোতিষী, অর্থাৎ রাজ পরিবারের জ্যোতিষী, এবং অদ্যাবধি মহারাজার ট্রাস্টের বেতনভুক, তাই তিনি বিনা পয়সায় কোষ্ঠী বিচার করেন ও হাত দেখেন। লোকটিকে দেখে ভক্তি হল, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের দেখে যেমনটি হয়। যেহেতু তাঁর ও আমার মধ্যে কোন আর্থিক সম্পর্ক নেই, আশা করা যায় তিনি সত্যই বলবেন; তা যতই অপ্রিয় হোক না কেন!
এবং খুব আশ্চর্যজনকভাবে লোকটির প্রতিটি কথা মিলে গেল! আমার ও শ্রীমতী পালের পেশা, পেশাগত সমস্যা, আধিব্যাধি, সন্তানসন্ততি, তাদের শিক্ষা, কর্মজীবন, আমাদের বর্তমান উদ্বেগের কারণ, এমনকি শ্রীমতী পালের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অতীত ওঠাপড়া সম্বন্ধে তিনি যা বললেন, শুনে আমি চিত্তির। কলকাতা হলে ভাবতাম লোকটি বুঝি গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী! তাঁকে টাকা দিতে গেলাম; নিলেন না। বললেন দেহের সমওজনের সরষের তেল দীপাবলিতে গরিব দুঃখীর মধ্যে দান করে দিও। শুনে আমি হতবাক! তিয়াত্তর কিলো সরষের তেলের বর্তমান বাজারদর তো প্রায় দশ হাজার টাকা। পাবো কোথায়? আর অত তেল বিলি বন্দোবস্ত করার মত অত গরিব দুঃখীই বা পাবো কোথায়! সরকার বাহাদুর একশো দিনের কাজ চালু করার পর গরিব কোথায়?
পর্যটনকে কিভাবে তুলে ধরতে হয়, কিভাবে পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণেশের কর্মসংস্থান করতে হয় - বাঙালির কাছে তার প্রাথমিক উদাহরণ যদি হয় পুরী, তবে মাধ্যমিকতম উদাহরণ নিঃসন্দেহে রাজস্থান। এখানকার জনগণ ভ্রমণার্থীনিবেদিত প্রাণ, তাঁদের জন্য এদের হৃদয়ের দরজা সদা-উন্মুক্ত। যে হোটেলে ছিলাম, বাঙালি বুঝতে পেরে রবিবার সকালের জলখাবারে পাঠালেন ফুলকো নুচি – তাতে টুসকি মারলে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর ধনেপাতা দিয়ে মাখোমাখো করে আলুর দম। আহারে! কতদিন পর নুচি খেলাম! তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া। রাজপথ দিয়ে যাচ্ছি, টোলপ্লাজায় গাড়ির সারি, কোথা থেকে একজন ছুটে এসে টাকা নিয়ে ছাপানো কুপন দিয়ে গাড়ি পার করে দিল – আপ টুরিস্ট হায় সার! সৌরজগত নিয়ে মানুষের ধারণা সতত পরিবর্তনশীল; একসময় ভাবা হত পৃথিবীই সৌরজগতের কেন্দ্রে, বর্তমানে ভাবা হয় সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে, গ্রহরাজি তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। তবে পর্যটক হয়ে রাজস্থানে এলে মনে হয় আমিই সৌরজগতের কেন্দ্রে, সবকিছু আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। কোন দোকানদার ছেঁড়াফাটা নোট নিতে ঝামেলা করেন না, খুচরো দিন বলে কেঁদে ককান না, বরং না চাইতেই মশলা চা খাওয়ান। তাঁদের প্রতিভা বিস্ময়কর – সাইবেরিয়ায় আইসক্রিম বা সাহারায় ওয়াটার হিটার যে তাঁরা অবলীলাক্রমে বেচে ফেলতে পারবেন, সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিত।
শিশোদিয়া রানি কি বাগ জয়পুর শহরের সর্ববৃহৎ উদ্যান, তাঁর দ্বিতীয় রানি উদয়পুরের রাজকন্যা শিশোদিয়াকে মহারাজা সওয়াই জয় সিংয়ের ( ১৬৮৮ – ১৭৪৩) উপহার। রাজকন্যা শিশোদিয়া মৎসগন্ধা সত্যবতীসমা। মহারাজা সওয়াই জয় সিংয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহের শর্তই ছিল অগ্রজ রাজপুত্রদের বঞ্চিত করে তাঁর সন্তানকেই রাজা করতে হবে। তবে তেমনটি হয়নি। মহারাজা সওয়াই জয় সিংয়ের মৃত্যুর পর রাজা হন তাঁর প্রথমা স্ত্রীর পুত্র সওয়াই ঈশ্বরী সিং। সুসজ্জিত উদ্যানটির রক্ষণাবেক্ষণ অতি উত্তম। রাজকার্যের ঝক্কি সামলিয়ে রাজামশাই সময় পেলেই রানিকে নিয়ে চলে আসতেন এই প্রমোদ উদ্যানে। সেইজন্যেই রাজপুত ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর উদ্যানটির দেওয়ালে দেওয়ালে রাধাকৃষ্ণের উপাখ্যান বিবৃত। দোতলা এক প্রাসাদ। তার বিস্তৃত বারান্দা, যতদুর চোখ যায় বিস্তৃত ভূমিচিত্র।
মোতি দুংরি (মুক্তোর পাহাড়)-এর উপর স্কটিশ ধাঁচের মোতি দুংরি প্রাসাদ, সেখানেই মস্ত কারুকার্যমণ্ডিত মোতি দুংরি গণেশ মন্দির। মেওয়ারের রাজা গরুরগাড়িতে চাপিয়ে গণেশদাদাকে আনছিলেন, সেই গরুরগাড়ি এই পাহাড়ের গোড়ায় এসে থেমে গিয়েছিল, কালক্রমে (১৭৬১) এখানেই মন্দির। রাজা জয় সিং জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য দিল্লী, উজ্জয়িনী, মথুরা, বেনারস ও জয়পুরে পাঁচটি মানমন্দির স্থাপন করেন, তার একটি যন্তর মন্তর। সূর্যের অবস্থান থেকে ঋতু, দিনের সময়, রাশি ইত্যাদি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করার নানাবিধ যন্ত্র দেখার জন্য গাইড নিয়েছিলাম; তবে তারপরে দেখলাম জ্যোতির্বিজ্ঞান আমি তাঁর থেকে বেশি বুঝি!
জলমহল মানসাগর নামে এক বিশালকায় হ্রদের মধ্যে এই মহল মহারাজা জয় সিংয়ের নির্মাণ। জলমহলে যাওয়া যায় না,হ্রদের পাড় থেকেই দেখতে হয়। হ্রদের জল অতীব নোংরা – সারা শহরের বর্জ্য মানসাগরে এসে পড়ে।
চতুর্থ দিন
জয়গড়,নাহারগড় আর আম্বের ফোর্ট যাওয়ার রাস্তা অনেকটা একই। রাস্তাটি পাহাড়ি; নিষ্পত্র অরণ্যের বুক চিরে; হনুমান ময়ূরে ভরপুর। সারথি মহোদয় আশ্বস্ত করলেন একবার বর্ষা আসতে দিন। দেখবেন শাখায় পত্রে ওরা পল্লবিত হয়ে উঠবে। দিনটি চমৎকার! মেঘলা, দুর্গের চত্বর থেকে দেখা যাচ্ছে দুরের জয়পুর শহর। দুর্গপ্রাকার থেকে দূরে দেখতে দেখতে চোখে পড়লো চড়াইয়ের চেয়ে একটু বড় আকারের (৭ সেন্টিমিটার), Brown Rock Chat (Indian Chat: (Cercomela fusca)। শরীরের উপরিভাগ গাঢ় বাদামি, ডানা ও লেজ কালচে বাদামি, পেট হালকা বাদামি, ডাক দ্রুত লয়ের শিস, প্রজাতিটি দুর্লভ না হলেও গাঙ্গেয় অববাহিকায় তার দেখা পাওয়া ভার, মূলত মধ্য ও উত্তর ভারতেই তার বিচরণ। ইনি পাথুরে ডাঙ্গাজমি পছন্দ করেন, জোড়ায় জোড়ায় ঘোরাফেরা করেন, এবং মাটি থেকে পোকামাকড় ধরে খান। ইতোপূর্বে একবার ভাদোদরায় পথিপার্শ্বে এনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। দিগন্তে ধোঁয়ার মত কুয়াশা অত বেলাতেও, তাপমাত্রা ছত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কলকাতায় তখন চল্লিশ। তবু শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলবেন গরমে কেউ রাজস্থান যায়,পাগল ছাড়া! জয়গড় কেল্লা রাজা জয় সিং-এর তৈরি। জয়গড় কেল্লা তৈরি করা হয় আম্বেরের বিকল্প রাজধানী রূপে। কেল্লার সবচেয়ে উঁচু জায়গায় এক মস্ত কামান - নাম 'জয়বাণ' - ওজন ৫০ টনের মতো এবং দৈর্ঘ্য ৬ মিটারের কিছু বেশি। কেল্লার ভেতরে অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহশালা আর সেইসঙ্গে কবে কোথায় কার সঙ্গে কোন রাজপুত রাজার যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধের ফল কী হয়েছিল, তার ফিরিস্তি। আম্বের কেল্লা আর জয়গড় কেল্লা একই রাজপরিবারের সম্পত্তি ছিল।
বর্তমানে জয়গড় কেল্লা রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি; তিনি টিকিট কেটে দেখার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। জয়গড় কেল্লায় রাজার কর্মচারীরা কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণও করে আবার গাইডও বটে। এরকম একজন আমাদের কেল্লাটা ঘুরিয়ে দেখালেন, এবং আশ্চর্যজনকভাবে টাকা দিতে চাওয়া সত্ত্বেও নিলেন না। গ্রিলের গেট দেওয়া একটা বন্ধ দরজা, তার ওপারে আম্বেরের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। জয়গড় দুর্গটি বিশাল – দেড় হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত মনন যতখানি বিশালতা ভাবতে পারে, তার চেয়েও বিশাল। তবে এই বিশালত্ব মুগ্ধ আপ্লুত বিমূঢ় করে না; ক্ষুব্ধ করে। কী বিপুল অপচয়! আমরা তো জানি এই দুর্গনির্মাণ, সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ, গণ্ডা গণ্ডা রানির বিলাসিনী জীবনযাপন – অর্থের উৎস কী ছিল। এই টাকা তো এসেছিল ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের হাত মুচড়ে।
জয়গড় থেকে নাহারগড় মিনিট দশেক। চারিদিকে জঙ্গলে ঢাকা এই পাহাড়ি দুর্গে দরজা অবধি গাড়ি যায় এটাই রক্ষে। ছোট কেল্লাটি রাজা জয় সিং-এর সময়ে তৈরি। সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজ মহিলারা নিরাপত্তার জন্য নাহারগড় দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নাহারগড়ের মাধবেন্দ্র প্রাসাদটি দোতলা, এবং সাতশো ফুট উঁচুতে। রাজা সওয়াই রাম সিং এটি তৈরি করেছিলেন তাঁর নয়জন রানির জন্য; ভেতরে ন'টি একই রকমের মহল। আয়তাকার ফাঁকা জায়গা ঘিরে নির্মাণ, সামনে বরাবর বারান্দা। আয়তক্ষেত্রের এক বাহুতে থাকতেন রাজামশাই; বিপরীত বাহুতে প্রধান রানিমা। দুদিকের দুই লম্বা বাহুতে চারজন চারজন করে আট রানীর বারান্দামুখি মহলগুলি। রাজামশাই যখন রানিদের ঘরে যেতেন তখন সব মহলের দরজা বন্ধ থাকতো। রাজামশাইয়ের যে রানির ঘরে যেতে ইচ্ছে হত সেই রানির ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়তেন, অন্য রানিরা জানতেও পারতেন না রাজামশাই আজ কার ঘরে পাত পাড়লেন। ন'টা মহল আলাদা আলাদা করে দেখা যায়, তবে যেহেতু একইরকম তাই আর আগ্রহ জাগেনি। প্রাসাদটি দেয়ালচিত্রে অতিশয় সুসজ্জিত। তবে রাজার মহল এখন রেস্তোঁরা।
জলমহল তিন দিকে পাথরের পাহাড় আর মাঝখানে ছয় কিলোমিটার লম্বা বিশাল নীল জলের হ্রদ। হ্রদের মাঝখানে জলমহল নির্মাণ করেন মহারাজ প্রতাপ সিং। মহলের তিন দিকে হ্রদের পাশে উঁচু পাহাড়। আরেক দিকে পর্যটকদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র; সেখানে নাচ-গানের আয়োজন। সবুজ পাহাড়ের গায়ে হলুদ রঙের এই মহল থেকে হ্রদে নামার একাধিক সিঁড়ি।
সাততলা চন্দ্রা মহল ভবনটি জয়পুরের মহারাজার ঘর হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিটি তলা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি। একেবারে ওপরের তলায় 'মুকুট মহল' বা 'ক্রাউন প্যালেস' প্যাভিলিয়ন।
জলমহলের কাছেই মহারানি কি ছত্রি, রাজ পরিবারের মহিলাদের দাহক্ষেত্র তথা স্মৃতি উদ্যান। ছত্রি শব্দটির অর্থ স্মৃতিস্তম্ভ (cenotaph)। স্মৃতিস্তম্ভের সংস্কৃতিটিও রাজপুতরা সম্ভবত মুঘলদের থেকে নিয়েছিলেন। রাজপরিবারের মহিলাদের স্মৃতিতে অসংখ্য ছত্রি, কিছু শ্বেতপাথরের, কিছু স্থানীয় পাথরের, প্রতিটিই সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত; ছত্রির আকার ও আয়তন স্বাভাবিকভাবেই প্রয়াতা মহিলাটির সামাজিক অবস্থানের দ্যোতক। সংশ্লিষ্ট রানিটি যদি রাজামশাইয়ের আগে পরপারে গিয়ে থাকেন, তাহলেই তার স্মৃতিস্তম্ভে ছাদ থাকবে, নচেৎ তোমার স্মৃতিস্তম্ভ অসমাপ্ত পড়ে থাকবে, রাজামশাই নেই, কে আর উদ্যোগ নেবে তোমার ছত্রি শেষ করতে; রোদে পুড়বে তুমি, বৃষ্টি তোমাকে ভেজাবে।
নাহারগড় দুর্গের কাছেই, নাহারগড় পাহাড়ের পাদদেশে কনক উপত্যকায় মহারাজা সওয়াই জয় সিং (১৬৮৮ – ১৭৪৩) নির্মিত মহীশুরের মূল বৃন্দাবন উদ্যানের আদলে কনক বৃন্দাবন উদ্যান। উদ্যানটির রক্ষণাবেক্ষণ অতি উত্তম। দুর্লভ গাছ গাছালি, প্রচুর পাখ পাখালি, দূরে আরাবল্লি, ঝর্না, ছত্রি, জালি অলঙ্করণ, ভিতরে গোবিন্দদেব আর নটবরদেবের মন্দির।
জয়পুর শহরের উপকণ্ঠে অনেকখানি অরণ্যচেরা পথ পেরিয়ে পাহাড় ঘেরা গোলাপি রঙের অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত গলতাজি মন্দির, প্রচুর বাঁদরের উপস্থিতি ও তাদের উদ্ভাবনী বাঁদরামোর জন্য বান্দর মন্দির নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। রঙিন দেওয়াল, বাঁকানো ছাদ আর আলঙ্কারিক স্তম্ভের মন্দিরটি বৈষ্ণব রামানুজপন্থীদের আশ্রম, সারা বিশ্বে তাদের শিষ্যকুল বিস্তৃত, তাই সম্পন্নতা চোখে পড়ে। সত্যযুগে গালব মুনি ষাট হাজার বছর তপস্যার পর রাজপুতানার জলসঙ্কট সমাধানে গোমুখ থেকে মা গঙ্গাকে নাকি এখানে নিয়ে এসেছিলেন, সেই থেকে মা গঙ্গা গলতা কুণ্ডে রয়ে গেছেন, তাই এই কুণ্ডে বছরভর জল থাকে; আরও অনেক কুণ্ড, প্রাকৃতিক ঝরনা মন্দিরপ্রাঙ্গণে। তবে গালব দেবতার বরে অক্ষয় কুমারীত্বের অধিকারিণী যযাতিকন্যা মাধবীকে দিয়ে যে সব কাজকর্ম করিয়েছিলেন, তাতে তার প্রতি ভক্তি রাখা দুষ্কর। শ্রীমতী পাল তো ঢুকতেই চাইছিলেন না। প্রতি কার্তিক পূর্ণিমায় নাকি ব্রহ্মা বিষ্ণু আর মহেশ্বর একসাথে এখানে বেড়াতে আসেন। মন্দিরটির স্থাপত্য দর্শনীয়।
জয়পুরের মহারাজাদের দাহক্ষেত্র তথা স্মৃতি উদ্যান গাইতোড়, অনেক স্মৃতিস্তম্ভ থাকার সুবাদে লোকমুখে গাইতোড় কি ছত্রি। সেই ১৭৩৩ সাল থেকে জয়পুরের কচ্ছওয়াহা মহারাজাদের শেষকৃত্য এখানে হয়ে আসছে, ব্যতিক্রম মহারাজা সওয়াই ঈশ্বরী সিং, তার শেষকৃত্য এখানে না হয়ে হয়েছিল নগর প্রাসাদচত্বরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য কারুকার্যমণ্ডিত ছত্রি, কিছু শ্বেতপাথরের, কিছু লালপাথরের; স্থাপত্যে মুঘল প্রভাব সুস্পষ্ট। ছত্রিগুলিতে ধর্মীয় ও সামাজিক উপাখ্যান বিবৃত, যথা শিকারের দৃশ্য, রাজসভার দৃশ্য, হাতি, ময়ূর, বংশীবাদনরত শ্রীকৃষ্ণ, রাম রাবণের যুদ্ধ, ইত্যাদি। রাজাদের জীবনদর্শনে মৃত্যু তাহলে জীবনের সমাপ্তি নয়, তার পরেও রয়ে যাওয়ার, যারা রইলো নিজেকে তাদের মনে পড়ানোর কী মর্মান্তিক প্রচেষ্টা! প্রাঙ্গণটি তিন ভাগে বিভক্ত, কাছেই পাহাড়ের মাথায় গণেশ মন্দির, আর রাস্তার ওপারে টাইগার ফোর্ট।
পঞ্চম দিন
উড়োজাহাজ ধরতে বিমানবন্দর। আমাদের এবারের যাত্রা ছোট উড়োজাহাজে; আটাত্তর আসনের কিউ ৪০০ বম্বারদিয়ার দ্যাশ আট। ভারতে আশির কম আসনের উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং ফি লাগে না। সাবেকি ধরনের উড়োজাহাজ, দুই ডানায় দুটো পাখা লাগানো; ডানাগুলি বিমানের মূল শরীরের (fuselage) ওপরের দিকে, নচেৎ পাখা মাটিতে ঠেকে যাবে। ২৭০০০ ফুট অবধি উঠতে পারে,তবে সাধারণত পনের থেকে ষোল হাজার ফুট দিয়ে যায়। এক উড়ানে ১১০০ নটিক্যাল মাইল অর্থাৎ ২০৪০ কিলোমিটার অবধি যেতে পারে। ছোট (১৫০০ মিটারের কম) রানওয়েতেও দিব্যি নামতে উঠতে পারে। এই বছরেরই বারোই মার্চ কাঠমান্ডুতে US-Bangla সংস্থার BS 211 ঢাকা কাঠমান্ডু উড়ানের যে উড়োজাহাজটি ভেঙে পড়েছিল,সেটি ছিল এই গোত্রের। পাখা লাগানো উড়োজাহাজে (Turboprop) শেষ উঠেছি ১৯৬৪তে, International Control Commission (ICC) এর Douglas DC-6এ। ফলে মনে একটু অস্বস্তি ছিলই।
জয়সলমির বিমানবন্দরটি মূলত সামরিক, তার একপাশে সিভিল এনক্লেভ। শহরের দক্ষিণ পূর্বে শহর থেকে সতের কিলোমিটার দূরে অনেকখানি জায়গা নিয়ে। ন'হাজার ফিটের একটিমাত্র রানওয়ে, পর্যটনের অফ সিজনে সারাদিনে একজোড়া মাত্র উড়ান; স্পাইসজেটের এস জি ২৯৮১ তিনটে পঁচিশে জয়পুর ছেড়ে চারটে চল্লিশে জয়সলমির, ফের পাঁচটায় জয়সলমির ছেড়ে জয়পুর ছটা দশে। আমাদের উড়োজাহাজটি বারাণসী থেকে জয়পুর এসে ঝিমোচ্ছিলেন, আমাদের নিয়ে উড়লেন। আকাশ থেকেই চোখে পড়ছিল বালি আর বালি, মধ্যে মধ্যে হাওয়াকল (windmill)। আমরা সমুদ্রবিলাসী, বালি দেখলেই জল খোঁজা অভ্যাস। এখানে জল নেই, পুরোটাই বালি। নামার সময় ঘুরে বাঁক নিয়ে নামলেন, ভূমিস্পর্শের পর গড়িয়ে গড়িয়ে অনেকখানি; দেখা গেল সামরিক বিমানবহর ও উপকরণাদি। টার্মিনাল ভবন থেকে শ ছয়েক ফুট দূরে উড়োজাহাজ দাঁড়ালো; আমরা নেমে হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম।
ষষ্ঠ দিন
জয়সলমির বাঙালির কাছে অনেকটা লন্ডন বা প্যারিসের মত, একবারও না গিয়ে, শুধু পড়েই পড়েই, শহরটা অনেকখানি চেনা। প্রথম গন্তব্য সোনার কেল্লা। গাইডদাদা বাঙালি বুঝতে পেরে বললেন সত্যজিৎ বাবুকে নমস্কার; তাঁর দৌলতেই করে খাচ্ছি; আমাদের নব্য সারথিটিও দেখলাম ঘাড় নাড়লেন। ১৯৭১-এ 'সোনার কেল্লা' পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত জয়সলমির বাঙালির কাছে ছিল মাচুপিচু বা লা দান্তা, এল মিরাদোর মত। আছে ওই অবধি, ব্যস! আর জানতে চেয়োনা বাপু। তারপর চুয়াত্তরে সিনেমা করার সময় সত্যজিতবাবু প্রামাণ্যভাবে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে যেতে হয়। ফেলুদা তোপসে হাওড়া থেকে তুফান এক্সপ্রেস ধরেছিলেন, প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে তুফান এক্সপ্রেস ছাড়ার সময়টিও নিখুঁতভাবে দেখানো হয়েছিল।
১১৫৬ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ রাওয়াল জয়সল নামের এক ভাট্টি রাজপুত দুর্গটি তৈরি করেন। আলাউদ্দিন খিলজি এক কাফেলার উপর ভাট্টি রাজপুতদের আক্রমণে ক্ষুব্ধ হয়ে নয় বছর দুর্গটি অবরোধ করেন। পরিশেষে পরাজয়, মহিলাদের জহরব্রত, তারপর দুর্গটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল বহুদিন। তারপর ভাট্টি রাজপুতদের একটি গোষ্ঠী দুর্গটি দখল করেন, তাদের উত্তরসূরিরা, সংখ্যায় প্রায় চার হাজার, আজও এই দুর্গে বাস করেন - জয়সলমির কেল্লা তাই 'Living Fort'। এই দুর্গ শিল্পে স্থাপত্যে এমনই অনন্য যে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার। ইংরেজ আমলে জয়সলমির ছিল এক বাণিজ্যিক শহর, তাই শহর ও কেল্লাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ব্যবসায়ীদের অসংখ্য হাভেলি। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় জয়সলমিরের সব বাসিন্দা এই দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কেল্লার ভিতর খানকয়েক জৈন মন্দির। মন্দিরগুলি কিন্তু কেল্লার ভিতর বানানো হয়নি, দুর্গ বানানোরও অনেক বছর আগে মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতাবদলের নানা পর্বে জৈন সম্প্রদায় মহারাজার কাছে আবেদন জানান মন্দিরগুলি কেল্লার ভিতর প্রতিস্থাপন করার জন্য যাতে মুসলমান আগ্রাসনকারীরা এগুলি ধ্বংস করতে না পারে। তদনুযায়ী মন্দিরগুলির প্রতিটি পাথর খুলে নিয়ে আসা হয় কেল্লার ভিতরে এবং সেখানে পুনরায় জোড়া লাগানো হয়। মন্দিরের নকশায় ব্যবহৃত রং সবই পরিবেশবান্ধব, কোন না কোন সবজি থেকে আহরিত; এবং অদ্যাবধি উজ্জ্বল। মন্দিরের ভিতরের জল নিষ্কাশন নালা ছয়টি প্রাণীর সমন্বয়ে, শরীর হাতির, পা খরগোসের, মুখের অর্ধেক কুমীরের - পিছনের অর্ধেকে পারাবত, আর পিঠের উপর ময়ূর। হাতির শক্তি খরগোসের গতি কুমীরের ক্ষিপ্রতা পায়রার আর ময়ূরের প্রখরতা আশ্লিষ্ট এর নিরাপত্তায়।
দুর্গে হাজার চারেক লোকের বাস, প্রায় একটি শহর। স্বতশ্চলশকট, দ্বিচক্রযান, ঘরগেরস্থালি। সবাই নিজের জায়গাটুকু নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে, ফলে দুর্গের ছাদে জলের ট্যাঙ্কি, দেওয়ালে উইন্ডো এসি, ছাদে ডিশ এন্টেনা। ছোটখাট নির্মাণকাজও চলছে এখানে ওখানে – কারণ এটিই সময়, পর্যটনের অফ সিজন। বর্ষা এসে গেলে এই লোকগুলিরই আর নাওয়া খাওয়ার সময় থাকবে না। সব গেরস্থেরই ঘরের সামনে একফালি করে দোকান; চা বিস্কুট থেকে শাড়ি, রেজাই থেকে জামা কাপড়, উটের চামড়ার জুতো থেকে পিতলের গণেশমূর্তি, স্মারক থেকে স্মরণিকা।
জয়সলমির শহরের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ হাভেলি ১৮০৫ সালে গুমনচাঁদ পটওয়া নির্মিত। পটওয়াজির পাঁচ পুত্রের জন্য পৃথকভাবে ছোট ছোট পাঁচটি হলুদ বেলেপাথরের হাভেলির - পটওয়াজি কি হাভেলি, এক সরু গলির শেষে; বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অফিস। টিকিট কেটে ঢুকতে হল, ঢুকে মনে হল না ঢুকলেই ভাল ছিল, রক্ষণাবেক্ষণ মর্মান্তিক। তার মধ্যেই দেওয়ালের কারুকাজ, ঝরোখা ইত্যাদি। প্রচণ্ড গরম, তাপমাত্রা প্রায় চল্লিশ, তেমনি চোখ ঝলসানো রোদ। কিন্তু ভিড় এড়িয়ে রাজস্থান দেখতে হলে এই সময় ছাড়া উপায় কী! তার মধ্যেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে ইউটিউব খুলে আমি একবার বেহালায় বিঠোফেনের Moonlight Sonata শুনে নিলাম। গরম আর ততটা অসহনীয় মনে হচ্ছিলো না।
নাথমলজি কি হাভেলি তৈরি হয়েছিল জয়সলমিরের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী দিওয়ান মোহতা নাথমলের জন্য। দুই স্থপতি ভাই একইসঙ্গে দুদিক থেকে কাজ আরম্ভ করেছিলেন, শেষে আর মেলাতে পারেন নি। তাই হাভেলির চেহারায় কিঞ্চিৎ অসঙ্গতি, তবে হাভেলিটি জব্বর। দেওয়ালে ও স্তম্ভের গায়ে কারুকাজ, ঝরোখা, এখানে ওখানে হাতি, ঘোড়া, বাঘের মুর্তি।
রেলস্টেশনের কাছে সেলিম সিং কি হাভেলি গড়ে উঠেছে সতেরো শতকের একটি ভাঙাচোরা হাভেলির উপর। সেলিম সিং তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী, তাঁদের পরিবার তখনকার জয়সলমিরের সর্বাপেক্ষা ধনী ও প্রভাবশালী পরিবার। হাভেলির ছাদ ময়ূরাকৃতির, সবমিলিয়ে হাভেলিতে আটতিরিশটি বারান্দা, এবং সামনে থেকে দেখতে হাভেলিটি জাহাজের মত। নাচ ঘরটির নাম মোতি মহল।
বিকাল, বা বলা ভালো দুপুর, সাড়ে পাঁচটায় বেরোনো হল। প্রথম গন্তব্য কুলধারা, শহর ছাড়িয়ে পশ্চিমে রাস্তা, মূলত সামরিক প্রয়োজনে নির্মিত, পনেরো কিলোমিটার গিয়ে দুশো বছর ধরে পরিত্যক্ত এক গ্রাম। ঘরবাড়ি, পাতকুয়ো, মন্দির, পথ...। সবই আছে; নেই শুধু লোকজন। মরুভূমির এই গ্রামের পত্তন ১২৯১ সালে, যোধপুরের পালি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণদের হাত ধরে। ১৮২৫ সালের রাখীপূর্ণিমার রাতে রাতারাতি ফাঁকা হয়ে যায় কুলধারা এবং তার লাগোয়া তিরাশিটি গ্রাম; আর তার হাজার দেড়েক মানুষ; ঘর গেরস্থালির সবকিছু যেমনটি তেমনটি ফেলে রেখে। অদ্যাবধি পালি ব্রাহ্মণ পরিবারে রাখীপূর্ণিমা পালিত হয় না। সেই থেকে নানা কাহিনির উদ্ভব। জায়গাটি দেখার ইচ্ছা বহুপুরাতন।
ক্ষুধিত পাষাণ গ্রামটি দেখা হল, পুরো চত্বরে আমি একা, কেউ কোত্থাও নেই – শুধু দীর্ঘশ্বাসপ্রতিম হাওয়া কান ঘেঁসে বয়ে যায়, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় যুদ্ধবিমান। সূর্যাস্তের পর থাকার অনুমতি মিলল না। রাতে নাকি শোনা যায় আর্ত চিৎকার, তাপমাত্রা কমে যায় হঠাৎ হঠাৎ, সকালে নাকি গাড়ির গায়ে দেখা যায় শিশুদের হাতের ছাপ। এটিকে পর্যটনকেন্দ্ররূপে গড়ে তোলার কাজ চলছে, মরু পর্যটনে আগামী সংযোজন ভূত পর্যটন। ফিরে এসে দেখি সারথি মহোদয় দুটি শীর্ণ ঘিয়েভাজা কুকুরকে জল খাওয়াচ্ছেন। এটি নাকি এখানকার অবশ্যকর্তব্য। গ্রাম থেকে একটি পাথর কুড়িয়েছিলাম, সারথি মহোদয় বললেন 'ফেক দো। ইয়ে কোই ঘর লেনে যানেওয়ালা চিজ হ্যায়?'
ভগ্নমনোরথে মরুভ্রমণে; যার পোশাকি নাম 'ডেজার্ট সাফারি'। শ্রীমতী পাল উটের পিঠে উঠতে রাজি হলেন না, উটের গাড়িতেও নয়। অগত্যা জিপগাড়িতে আমরা দুজন, সে আমাদের মরু অভ্যন্তরে তিরিশ কিলোমিটার নিয়ে যাবে ও সূর্যাস্ত দেখাবে, এমনটাই বোঝাপড়া। মাহিন্দ্র থর জিপ যথেষ্ট শক্তপোক্ত ও মহার্ঘ্য – কিন্তু বালির মধ্য দিয়ে সে এমন নাচতে নাচতে চলল যে কিলোমিটার পাঁচেক গিয়েই শ্রীমতী পাল সারথিকে বললেন 'বাবা তুই ঘর চ। সূর্য আমাদের ওখানেও ডোবে, রোজই ডোবে; তোকে আর তা দেখাতে হবে না'। কিন্তু সারথি শুনবে কেন? সে পয়সা নিয়েছে, তার তো একটা দায়বদ্ধতা আছে। বলল এখানে দাঁড়িয়ে তোমরা সূর্যাস্ত দেখো, তারপর মুখে আওয়াজ করলো, দিগন্ত থেকে নেমে এল এক বালক উটের পিঠে চেপে। আমরা তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম, বালিতে হাওয়ার স্বাক্ষর দেখলাম – পাশ দিয়ে তিন জিপ ভর্তি কমবয়সি ছেলেপিলে হইহই করে চলে গেল।
সেখান থেকে এক ডেজার্ট পার্কে। সেখানে কিঞ্চিৎ বিনোদনের ব্যবস্থা, ঘণ্টা আড়াই রাজস্থানী নাচগান, তৎপরে নৈশাহার। অনেকখানি ছড়ানো জায়গা, চেয়ার পাতা। একটি আয়তাকার ক্ষেত্রে নাচগান হচ্ছে, তার তিনদিক ঘিরে বসার ব্যবস্থা। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে, তাপমাত্রা একচল্লিশ থেকে সাতাশ, তারারা একে একে জ্বলে উঠল। রাতে আমার দুধ খাওয়া অভ্যাস, এখানে উটের দুধ খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই ব্যবস্থা হল। উটের দুধ রাখা যায় না, গরম করলে কেটে যায় – ফলে দোহনের অনতিবিলম্বেই খাওয়া দস্তুর। খেয়ে ভারি মজা হল, এবং কোন শারীরিক বিপর্যয়ও হয়নি। হোটেলে প্রত্যাবর্তন মধ্যরাত্রের পর।
সপ্তম দিন
ফেরার পালা। আমাদের ফেরার কথা ছিল স্পাইসজেটে দিল্লি হয়ে, কিন্তু জুনের সাত তারিখে স্পাইসজেট কর্তৃপক্ষ সবিনয়ে জানালেন যে উড়ান সারণি পরিবর্তিত হয়েছে এবং পরিণামে দুটি উড়ানই পরিত্যক্ত হয়েছে। ভাড়ার টাকা তাঁরা ফেরত দিচ্ছেন, কারণ, অন্যতর ব্যবস্থা করতে তাঁরা অপারগ। শুনে আমার মাথায় হাত। ফোন করে গালমন্দ করে (তুই আমার টাকাটা বিনা সুদে তিনমাস আটকে রাখলি কেন?) গায়ের জ্বালা কিছুটা মিটলো।
নতুন করে টিকিট কাটা হল। জয়সলমির থেকে স্পাইসজেট এসজি ২৯৮২; সেই কিউ ৪০০ বম্বারদিয়ার দ্যাশ আট; বিকেল পাঁচটায় উড়ে জয়পুর বিকেল ছটা পাঁচে; তারপর জয়পুর থেকে ইন্দিগো ৬ই ১৭৫, এয়ারবাস এ ৩২০ তে রাত নটা পঞ্চাশে উড়ে কলকাতা রাত বারোটা দশে। পরিবর্তনের ফলে আমি তিনটে জিনিস হারালাম; (১) সাড়ে তিন হাজার টাকা, নতুন করে টিকিট কাটতে বেশি লাগল; (২) দিল্লি বিমানবন্দরে ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা ও কফি খাওয়ার সুযোগ; (৩) বোয়িং গোত্রের উড়োজাহাজে চাপার সুযোগ। বোয়িং বিমানে আমার খুব একটা ওঠা হয় না। পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল যাত্রী পরিবহনকারী জেট বিমানপোত কিন্তু এদেরই, ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৯ অবধি তৈরি হওয়া বোয়িং ৭০৭। মাঝারি আয়তনের, লম্বা সফরের সরু চেহারার চার ইঞ্জিনের এই সেভেন ওহ সেভেন এক কিংবদন্তী; পরবর্তীকালে এর হাত ধরেই এসেছে ৭২৭,৭৩৭,৭৪৭, ৭৫৭,৭৬৭, ৭৭৭,৭৮৭। ষাট সত্তরের দশকে আকাশ দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই বোয়িং ৭০৭। রাজারহাট রোড ধরে চিনার পার্ক ছাড়িয়ে যে দশদ্রোণ গ্রাম, সেখানে লস এঞ্জেলেস থেকে রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে স্বল্প দৃশ্যমানতায় ভিসুয়াল অ্যাপ্রোচে কলকাতা নামতে গিয়ে গাছে ধাক্কা মেরে রানওয়ের ১১২৮ মিটার আগে ভেঙে পড়েছিল Pan Am Flight 1, Clipper Caribbean, বোয়িং ৭০৭ – ৩২১, ১৯৬৮র বারোই জুন। আমার মনে আছে কারণ পিসেমশায়ের হাত ধরে মাঠ পেরিয়ে আমি উড়োজাহাজ ভেঙে পড়ার মত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা দেখতে গিয়েছিলাম; আমার পিসিমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল এরোপ্লেনভাঙ্গা দিয়ে বাসন তৈরি হয়। সেটা ষাটের দশকের গোড়া, তদবধি মধ্যবিত্তের হেঁসেলে কলঙ্কমুক্ত ইস্পাত তো দূরস্থান, তার গরীব খুড়তুতো ভাই হিন্দালিয়াম অবধি ঢোকেনি। সাবেকি লোহার বাসনের জায়গা সবে নিচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম; জনমানসে তাইই এরোপ্লেন ভাঙ্গা। এরোপ্লেনভাঙ্গা আনতে পিসেমশায় হাতে করে একটা রেশন ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলেন তাও মনে আছে।
সোয়া তিনটেয় হোটেল থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর; আদিগন্ত ঊষর মাঠ। সাড়ে চারটেয় উড়োজাহাজটি নামলেন, লোকজন মালপত্র নামলো, তেল ভরা হল। আমরা উঠে পড়লাম। আসন সামনের সারির ডান দিকে। অনেক নিচু দিয়ে উড়ে জয়পুর। তারপর তল্পিতল্পা নিয়ে আগমন লাউঞ্জ দিয়ে বেরিয়ে আবার নির্গমন লাউঞ্জে। জয়পুর ছোট বিমানবন্দর বলে রক্ষে, এই ব্যায়াম অন্যত্র করতে হলে পা ব্যথা হয়ে যেত। আবার চেক ইন, বোর্ডিং পাস নেওয়া। টার্মিনালে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া ও হিমশীতল কফিপান। আমাদের উড়োজাহাজ (VT IHG) বেঙ্গালুরু থেকে হায়দ্রাবাদ হয়ে এসে নামলেন রাত নটা কুড়িতে। তার আজকের নির্ঘণ্টে কলকাতাই শেষ গন্তব্য। তিনি এলেন, আমরাও উঠে বসলাম। আসন প্রথম সারির বাঁদিকে, জানালার পাশে। তিনি মেঘের দেশে যাওয়ার আগেই আমরা ঘুমের দেশে। কিন্তু শান্তি নেই, বিমানবালা খেতে ডাকলেন। একবার দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরছিলাম রাত দুটোর উড়ানে। মাঝরাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে বিমানসখির খাওয়ার জন্যে ঝুলোঝুলি; বলেন তুমি না খেলে নিয়ে যাও। এবারেও সেই জ্বালা! তারপর দমদম।
পুনঃ - অনেকেই বেড়াতে যাওয়ার আগে সম্ভাব্য খরচের একটি ধারণা পেতে চান। তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, এরোপ্লেন ভাড়া ৩৩৫১৫, হোটেলভাড়া ৯৬৮০, খাইখরচ চা মিনেরাল ওয়াটার লস্যি ৬৭০৩, গাড়িভাড়া ১৯০৮০। কেনাকাটা ও পূজার খরচের তো কোন উর্দ্ধসীমা হয় না।
- সমাপ্ত -
রাজস্থানের তথ্য ~ রাজস্থানের আরও ছবি
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা। সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন 'আমাদের ছুটি'-র সঙ্গেও।