বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।

 

['সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত' –এই ভ্রমণকাহিনিটি ধারাবাহিকভাবে বেরোত প্রবাসী পত্রিকায় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে। লেখক শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায় বিশেষ পরিচিত কোনও নাম নয়। আজকের ইন্টারনেট-গুগুল ম্যাপ-ইন্সটাগ্রাম-ফেসবুক লাইভ যুগের তরুণ-তরুণীদের জন্য এখানে রইল প্রায় একশো বছর আগের কয়েকজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি তরুণের ভ্রমণকথা।]

 

সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত

শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়


পূর্বপ্রকাশিতের পর -

বিহার


২৬শে সেপ্টেম্বর, শনিবার - সকাল ৬টায় রওনা হ'লাম। দূর থেকে ট্রাঙ্ক রোড বড় বড় গাছের সারির মধ্যে যেন একটা প্রকাণ্ড অজগরের মতন দেখাচ্ছে। মাইল আট আসার পর বরাকর নদীর পুলের ওপর এসে পড়লাম। এখানকার দৃশ্য বেশ সুন্দর। রাস্তার দু'দিকে যতদূর দেখা যায় বেশ ফাঁকা, মাঝে-মাঝে শাল-পলাশের বন আর দূরে নীল পাহাড়ের সারি। বরাকর নদী বাংলা ও বিহারের সীমানা। নদীর এপারে এসে আমরা বাংলা মাকে নতি জানিয়ে কিছুদিনের মতন বিদায় নিলাম।

দৃশ্য ক্রমেই বদ্‌লাতে সুরু হয়েছে। ঢেউ-খেলানো রাস্তার ওপর দিয়ে অতিকষ্টে সাইকেল চালাচ্ছি। আর বাংলার সেই আকাশতলে-মেশা হরিৎক্ষেত্র নেই, রাস্তার পাশের বাঁশ ঝাড় ও নারিকেল-গাছের শ্রেণীও অদৃশ্য হ'য়ে গেছে। লাল রঙের মোটা থানের কাপড় পরা বিহারী মেয়েরা কোথাও কুয়া থেকে জল তুলছে, কোথাও বা পুরুষদের সকল কাজে সাহায্য কর্‌ছে। শক্ত মাটির মেয়ে ব'লে শক্ত কাজের মধ্য দিয়েও এদের স্বাস্থ্য হ'য়েছে অটুট।

ঘন্টাখানেক পর নির্সাচটী ব'লে একটা ছোট চটীতে পৌঁছলাম। চটীর সঙ্গে এই আমাদের প্রথম পরিচয়। এখানকার একমাত্র বাঙ্গালী শ্রীযুত তিনকড়ি দত্ত মশায়ের সঙ্গে আলাপ হ'ল ও এইখানে প্রাতরাশ সারা গেল। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে বরাবর পাঞ্জাব অবধি আট দশ মাইল অন্তর চটী দেখ্‌তে পাওয়া যায়। চটীতে মোটামুটী রকমের খাওয়া-দাওয়ার জিনিষ-পত্র মেলে ও ভাল জলের বন্দোবস্ত আছে। এছাড়া রাস্তার ধারে ধারে কিছুদূর অন্তর কুয়াও দেখা যায়। প্রত্যেক চটীতেই প্রায় পনেরো ফিট উঁচু দুটি স্তম্ভ থাকে। এইগুলিই চটীর নিদর্শন ও এদের নাম 'কোশমিনার'। এইসমস্ত সেরশা'র অমর কীর্ত্তির সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এই অঞ্চল থেকে রেলওয়ে দূর ব'লে চটীগুলির প্রয়োজনীয়তা বেশ অনুভব করা যায়। সেইজন্যে এই-গুলির অবস্থা পূর্ব্বের মতই আছে। কিন্তু যেখানে রেল, কার্‌খানা বা অপর কোনো কারণে রাস্তার আশে-পাশে সহর গ'ড়ে উঠেছে সেখানে এরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারেনি। কেবল কোশমিনারগুলি অতীতের চিহ্ন-স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে।

পোষ্ট অফিস থেকে বেরুতেই দেখি পুলিশ হাজির। নাম ধাম অন্য খোঁজ-খবর দিয়ে রওনা হ'য়ে পড়্‌লাম। রাস্তায় বেরিয়ে পুলিসের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয়। তখন বেলা প্রায় আটটা। রোদ বেশ চন্‌চনে। রাস্তাও অসম্ভব রকমের উঁচু নীচু। ছোট ছোট চটীতে ঘন ঘন জল খাওয়া ও বিশ্রাম নেওয়া সুরু হ'ল। মোটরের টায়ার ফাটাতে এক সাহেবকে বিশেষ ব্যস্ত হ'য়ে পড়্‌তে হ'য়েছে। রোদে তার অবস্থা আমাদেরই মতন। আটাশ মাইল আসার পর গোবিন্দপুরে পৌঁছলাম। পোষ্ট আফিস, থানা ও ডাক্তারখানা ছাড়া পাকা বাড়ী দু'চার খানা আছে। খাবারের দোকানে পুরী ভাজার গন্ধে ক্ষিদেটাও বেড়ে উঠ্‌ল। জায়গাটি বেশ ছায়া-ঢাকা ও খাওয়া-দাওয়ার সুবিধা হবে ব'লে এইখানেই এবেলার মতন ছাউনি ফেলা গেল।

এখানকার বাঙালী ডাক্তার-বাবুর সঙ্গে পরিচয় হ'তে দেরী হ'ল না। তাঁর বাড়ীতে চা খাওয়ার পর ট্রাঙ্ক রোডের বাঁদিকে পুরুলিয়ার রাস্তার ওপর একটি বড় পুকুরে স্নান করা হ'ল। এখান থেকে পুরুলিয়া মাত্র ৪০ মাইল দূর।

যখন রওনা হ'লাম তখন বেলা তিনটা। বৃষ্টির দরুন্‌ রাস্তার পাশে একটা পোড়ো গোয়ালের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। পাশের গ্রামে নবমী পূজার ঢাক ঢোল বাজ্‌তে সুরু হ'ল। কতকগুলি ছেলে-মেয়ে আমাদের পোষাক-পরিচ্ছদ ও যান-বাহনের সরঞ্জাম দেখে আমাদের বিষয় গভীর আলোচনা আরম্ভ ক'রে দিলে। ঘন্টাখানেক পর বৃষ্টি থাম্‌লে আমরা আবার বেরিয়ে পড়্‌লাম। আকাশ বেশ পরিষ্কার হ'য়ে গেল। সুমুখে দূরে পরেশনাথ পাহাড়টি নীল আকাশের গায়ে আঁকা-বাঁকা-লাইন-টানা একখানা ছবির মতন দেখাতে লাগ্‌ল। বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার মধ্যে পরেশনাথ সব-চেয়ে উঁচু পাহাড় (৪৪৫০ ফিট) ও জৈনদের একটি মহাপীঠস্থান। দূরবীণ দিয়ে পাহাড়ের ওপরের জৈন মন্দিরটি বেশ স্পষ্ট দেখা গেল। আমরা ক্রমেই পরেশনাথের কাছে এগিয়ে আস্‌তে লাগ্‌লাম।

রাস্তা বেজায় উঁচু নীচু ব'লে আমরা পরস্পর ছাড়াছাড়ি হ'য়ে পড়্‌তে লাগ্‌লাম। দেখ্‌তে ভারী মজা লাগছিল-কেমন ক'রে মাঝে-মাঝে একজন হেল্‌তে-দুল্‌তে অতি কষ্টে চড়াইয়ের উপর উঠ্‌ছে আবার সমুদ্রের জাহাজের মতন প্রথমে পিছনের চাকা, কম্বল, পরে পিঠ ও শেষে টুপি অদৃশ্য হ'য়ে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে ঘনিয়ে এল। পরেশনাথ তার সমস্ত কবিত্ব মুছে অন্ধকারে বিরাট্‌ দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নীচে তোপচাঁচির বাংলোতে আমরা রাত কাটাবার ব্যবস্থা কর্‌লাম। একদল সাহেব মেম এখানে চড়ুইভাতি ক'রে পাত্‌তাড়ি গুটাবার বন্দোবস্ত কর্‌ছিল। তাদের সঙ্গে আমাদের আলাপ জমে' উঠ্‌ল। তাদের মধ্যে একজন নিজের কাশ্মীর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে দেখবার মতো জায়গার খোঁজ দিলে ও সকলে আমাদের কৃতকার্য্যতা কামনা ক'রে বিদায় নিলে।

মিটারে ২০০ মাইল উঠেছে। সুতরাং আজ আমরা মাত্র ৪২ মাইল এসেছি।

২৭শে সেপ্টেম্বর রবিবার - তোপচাঁচি বাংলোর এক মাইল দূর থেকে পরেশনাথ পাহাড় আরম্ভ হ'য়ে রাস্তার ডানদিক্‌ দিয়ে বরাবর সাত আট মাইল এসে ইস্রি ষ্টেশনের কাছে শেষ হ'য়েছে। আজ তিন দিন পর আবার রেলের লাইনের সঙ্গে দেখা হ'ল। একটা ছোট নদী মহুয়া বনের ভেতর থেকে এসে একেবারে রাস্তার ওপর দিয়ে চলে গেছে। পাহাড়ী নদী - জল বেশী নেই, ছোট ছোট পাথরের ওপর দিয়ে জল যাওয়ার শুধু কুলকুল শব্দ। শরতের পরিষ্কার আকাশ, ভোরের মিঠে হাওয়া ও দূরের মহুয়া বনের নিস্তব্ধতায় চারদিকে বেশ একটা স্নিগ্ধ ভাব এনেছে। রাস্তা মন্দ নয়, তবে উঁচু নীচু। ছোটখাট পাহাড় জঙ্গল পিছনে ফেলে রেখে চলেছি।

আজ বিজয়া দশমী। বিহারীদের দশহরা; তারা দলে দলে পূজা ও মেলা দেখতে চলেছে। পথের দু'পাশে ঘন গাছের সারি। ক্রমশঃ যাত্রীর দল বাড়তে লাগল। শুন্‌লাম বাগোদরে মেলা বসেছে - উৎসববেশে সজ্জিত নরনারী দলে দলে বাগোদর অভিমুখে যাচ্ছে। এক এক করে তাদের সকলকে পিছনে রেখে আমরা বাগোদরে পৌঁছলাম। লোকে লোকারণ্য, রাস্তার দু'পাশে সারি সারি দোকান ব'সে গেছে, চার পাশে মাঠে তামাসা দেখান হচ্ছে। আমরা মেলার কাছে মাঠে একটা বড় গাছের তলায় দুপুরের জলযোগের জন্য নেমে পড়লাম।

বাগোদর থেকে বাঁদিকের রাস্তায় হাজারিবাগ ও ডান দিকের রাস্তা দিয়ে গিরিডি যাওয়া যায়। ঐ দু'জায়গাতে যাওয়ার জন্য মোটর সার্ভিস আছে। লোকেরা প্রথমে দূর থেকে কৌতুহল-দৃষ্টিতে আমাদের দেখছিল। ক্রমে বোধ হয় তাদের সাহস বেড়ে গেল। একে একে পুরুষ ও পরে তাদের সঙ্গিনীরাও কাছে এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। এদের অধিকাংশের মুখ চোখ দেখে ঠিক খাঁটী বিহারী বা সাঁওতাল ব'লে মনে হয় না। তবে এরা সরল ও কর্ম্মঠ ব'লেই মনে হ'ল। এদের ভদ্রোচিত আচার ব্যবহার বেশ চোখে লাগে। গরুর গাড়ী থেকে এক বৃদ্ধ এসে মেলায় নাম্‌ল। কয়েকটি বালিকা ও তরুণী তাকে দেখে প্রত্যেকে মাথা নত ক'রে দু'বার তার পায়ে হাত ঠেকিয়ে নিজেদের মাথায় ছোঁয়ালে ও পরে গলায় আঁচল জড়িয়ে প্রণাম কর্‌লে। এদের শীলতা ও শিষ্টতা আমাদের চেয়ে কিছু কম নয়।

আজ বিপরীত দিক্‌ থেকে হাওয়া বইছে; সুতরাং উঁচু নীচু রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটু বেশ শক্ত হ'য়ে দাঁড়াল। মেলা হ'তে দলে দলে লোক ফির্‌ছে। রাস্তায় বড় ভিড়। পুরুষরা গায়ে হল্‌দে চাদর ও হাতে লাঠি নিয়ে গম্ভীর ভাবে চলেছে। মেয়েরা রঙ-বেরঙের ছোপান কাপড় প'রে, মাথায় ফুল গুঁজে, মেলা থেকে পুঁথির মালা আর্‌সি চিরুণী কিনে হাসি মুখে বাড়ী ফির্‌ছে। ছোট ছেলেদের এক হাতে খাবার, আর এক হাতে তারা মায়ের কাপড় ধ'রে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি যাওয়ার চেষ্টা কর্‌ছে। বছরের পরবের দিন, সকলের মুখে চোখে যেন একটা হাসিখুসী ভাব লেগে রয়েছে।

সন্ধ্যা ৬৷৷ টার সময় আমরা বর্হিতে পৌঁছলাম। এটি একটি বেশ বড় চটী। এখান থেকে রাস্তার ডান পাশে বজৌলী যাবার পথ ও বাঁদিকের পথ দিয়া হাজারিবাগ যাওয়ার যায়।

শ্রীযুত রাধিকানাথ গুঁইয়ের অনুগ্রহে থাক্‌বার জায়গা পাওয়া গেল। এখানেও পূজার ধুম কম নয়। প্রতিমা বিসর্জ্জন দেখে ফির্‌তে অনেক রাত হ'য়ে গেল ব'লে দোকান বন্ধ - কোন খাবার যোগাড় কর্‌তে পারা গেল না। আজ মোট ৫৮ মাইল এসেছি। কল্‌কাতা থেকে ২০৮ মাইল আসা হ'ল।

২৮শে সেপ্টেম্বর সোমবার -
কাল রাত্রে কিছু খাওয়া হয় নাই ব'লে নিজেরা রাঁধবার ব্যবস্থা কর্‌লাম। বাজার থেকে চাল ডাল ইত্যাদি কিনে এনে খিঁচুড়ী রান্না হ'ল। এখানে শ্রীযুক্ত অশ্বিনীকুমার দালালের সঙ্গে আলাপ হ'ল। ইনি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটীতে তাঁর সহপাঠীদের নিকট আমাদের জন্য একখানি চিঠি লিখে দিলেন।

রওনা হ'লাম ১২৷৷৹ টায়। রোদ ও খিঁচুড়ী খাওয়ার জন্য তেষ্টায় অস্থির। মাইল দশ দূরে চৌপারণ থানায় নেমে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। চৌপারণের কিছু পর থেকেই হাজারিবাগের জঙ্গল সুরু হয়েছে। সাত আট মাইল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তাটি চ'লে গেছে। এই পথটুকু বেশীর ভাগই উৎরাই। কিন্তু রাস্তার অবস্থা বড় মন্দ ব'লে উৎরাইয়ে'র সুখটুকু উপভোগ করা গেল না। জঙ্গল খুব ঘন নয়। শাল পলাশ ও মহুয়া গাছই বেশী। জঙ্গলের সীমানায় একটা নদীর পুলের উপর এসে বস্‌লাম। খানিক দূরে এক সাহেব মোটর সারাচ্ছে। আমরা নদীতে জল খেতে যাবার আয়োজন কর্‌ছি এমন সময় সেই সাহেবের মেম ও তাদের মেয়ে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ সুরু কর্‌লে। এঁরা কুল্‌টীতে থাকেন। মোটরে গয়া যাচ্ছেন। জঙ্গলে টায়ার ফেটে আট্‌কে পড়েছেন। সাহেব টায়ার মেরামত কর্‌লে তবে যাওয়া হবে। আমাদের সঙ্গে অল্পক্ষণের মধ্যে বেশ আলাপ হ'য়ে গেল। প্রত্যেক জিনিস পত্র দেখাতে হ'ল। সাইকেলের সাম্‌নে বোর্ডে লেখা প্রোগ্রাম দেখে তাঁরা খুব উৎসাহ প্রকাশ কর্‌লেন। ম্যাপ চেয়ে নিয়ে রাস্তা দেখলেন ও আমাদের অনেক লজেঞ্জুস্‌ ও সুইট্‌স্‌ দিলেন।

এখানে এসে জান্‌তে পার্‌লাম বাইনাকুলার গগ্‌লস্‌ ও রিং শুদ্ধ চাবি কোথায় পড়ে গেছে। বাইনাকুলার এর জন্য পরে বিশেষ অসুবিধা হয়েছিল। মাইল তিন চার পর থেকে গয়া জেলা আরম্ভ হ'ল। এখান থেকে সমান ও সুন্দর রাস্তা সুরু হয়েছে। অনেক দিন পর সমতল রাস্তা পেয়ে আমরা মনের সুখে জোরে সাইকেল চালিয়ে বড়াচটীতে এসে পড়লাম।

সন্ধ্যার ঠিক আগে ফল্গু নদীর ধারে এলাম। নদীর ওপরে পাথরের নীচু পুল। বর্ষার সময় পুলের ওপর দিয়ে জল যায়। পুলে কোন রেলিঙ্‌ নেই, কেবল মাঝে মাঝে এক ফুট উঁচু থাম। দূরে নদীর দু'পাশেই নীল পাহাড়ের সারি -মনে হয় যেন ফল্গু এক দিকের পাহাড় থেকে বেরিয়ে আর এক দিকের পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। বালীর চড়ার ওপর দিয়ে জলের শুধু একটি ক্ষীণ ধারা বয়ে যাচ্ছে। আর একটা ছোট পুলের পর ডান দিকে গয়া যাবার রাস্তা ২০ মাইল।

সন্ধ্যার সময় সাইকেল আমাদের সেরঘাটীতে নামিয়ে দিলে। গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোড থেকে ডান দিকে একটু নীচু জায়গায় সেরঘাটী সহর। এখান থেকেও গয়ায় যাবার রাস্তা আছে। এইখানেই খাবার জোগাড় করা হ'ল। খাওয়া দাওয়ার পর ঠিক হ'ল আজ সমস্ত রাত্রিই চলা হ'বে। সেইজন্য ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম নিতে আমরা একটা কুয়ার ধারে আস্তানা নিলাম। সেরঘাটী থেকে ডানদিকে গয়া ও বাঁদিকে ডাল্টনগঞ্জ যাবার রাস্তা আছে।

আমরা রওনা হ'ব এমন সময় থানা থেকে ডাক এল। মামুলি নাম ধাম দেওয়ার পর থানার দারোগা আমাদের রাত্রে চলার অভিপ্রায় শুনে পথের ধারে জঙ্গলে ভালুকের উপদ্রব আছে ব'লে নিরস্ত কর্‌তে চেষ্টা কর্‌লেন। কিন্তু হাজারিবাগ জেলার উঁচু নীচু রাস্তার জন্য এ ক'দিন আমাদের চলা বড়ই কম হচ্ছিল। আজকের সুন্দর সমান রাস্তা ও চাঁদনী রাতের আলো পেয়ে এ-সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছা হ'ল না। সেইজন্য আমরা আর বাক্যব্যয় না ক'রে বেরিয়ে পড়লাম।

মাইল দু'য়েক পর থেকে রাস্তা মেরামত হচ্ছিল। সেইজন্য মাঝে মাঝে হেঁটে যেতে হ'ল। ক্রমশ" ভাল রাস্তায় এসে চলেছি। খুব জোরে ঘন্টা বাজিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ পাশের গাছতলা থেকে এক বিকট চীৎকার শুনে আমরা হতভম্ব হ'য়ে ভাবলাম এ নিশ্চয়ই ভল্লুক! টর্চ্চ জ্বেলে দেখি আমাদেরই মত হতভম্ব একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা আর কিছু নয় বেচারা চৌকিদার, পাহারা দিতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল আমাদের চারজনের সাইকেলের ঘন্টা শুনে চম্‌কে চীৎকার ক'রে উঠেছে। ঘড়িতে দেখা গেল রাত ১টা। আর দেরী না ক'রে সাইকেলে উঠলাম।

ম্লান জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে দু'ধারে পাহাড় ও ঝোঁপ-ঝাঁপ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সুমুখ থেকে একটা গরুর গাড়ী ধীর মন্থর গতিতে আস্‌ছিল ব'লে জোরে ঘন্টা বাজাতে সুরু কর্‌লাম। আলো, টুপি ও ঘন্টার শব্দ শুনে গরু দু'টি কিছু মাত্র দ্বিরুক্তি না ক'রে রাস্তা ছেড়ে মাঠের ওপর দিয়ে ঘুমন্ত গাড়োয়ানকে নিয়ে ছুট দিল।

রাত ২৷৷ টার সময় আরাঙ্গাবাদে পৌঁছলাম। তখন চাঁদ ডুবে গেছে - অন্ধকারের জন্যে কি রকম সহর কিছু বুঝতে পার্‌লাম না। থানা ছাড়িয়ে চলেছি, এমন সময় পুলিশ পেট্রোলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হ'ল। এদের হাতে রিভলভার, কোমরে তলোয়ার ঘোড়ায় চ'ড়ে ডিউটি ক'রে ফির্‌ছে। মিলিটারী কায়দায় চ্যালেঞ্জ ক'রে দাঁড়াতে বল্‌লে। নাম ধাম লিখিয়ে এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে অন্ধকারে এক গাছতলায় ব'সে সঙ্গে-আনা খাবার নিঃশেষ কর্‌তে লাগ্‌লাম।

মাইল কয়েক পর বাতানা নদীর নীচু পুলের ওপর গিয়ে পড়্‌লাম। এই পুলটি ফল্গুর পুলের অনুরূপ। ওদিক্‌ থেকে এক সারি মাল বোঝাই গরুর গাড়ী আস্‌ছিল। সাইকেলের ঘন্টা শুনে ও আলো দেখে সাম্‌নের গাড়ীর গরু দুটি ঘুমন্ত গাড়োয়ান ও মাল ভর্ত্তি গাড়ী শুদ্ধ পুল থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়্‌ল। নদীতে বিশেষ জল ছিল না, আর নীচু পুল থেকে পড়ার জন্য বিশেষ কিছু ক্ষতি বোধ হয় হয়নি। এরা রাত্রে ঘুমিয়ে গাড়ী চালায় ব'লে কেবল তারা নিজেদের নয় অন্যান্য পথিকদেরও বিশেষ অসুবিধায় ফেলে। এ রকম ঘটনা আমরা পরে আরও দেখেছি।

রাস্তা বেশ সমতল ও সোজা। দূরে শোন ইষ্ট ব্যাঙ্ক ষ্টেশনের আলো হঠাৎ আকাশের গায়ে ফুটে উঠ্‌ল। আমাদের চোখও ঘুমে জড়িয়ে আস্‌ছে। মরুভূমির মরীচিকার মতন ষ্টেশন এই আসে আসে ব'লে নিস্তব্ধে গাড়ী চালাচ্ছি। ঘন্টাখানেক এইভাবে যাওয়ার পর শোন নদীর জলের শব্দ শুন্‌তে পেলাম। ক্রমেই জলের শব্দ বাড়তে লাগল; আমরাও নদীর কাছে এসে পড়েছি ব'লে সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে চল্‌তে সুরু কর্‌লাম। কিন্তু অনেক্ষণ হাঁটার পরও যখন নদীর দর্শন পাওয়া গেল না তখন আবার গাড়ীতে উঠলাম। নদীর ধারে এসে খবর নিয়ে জানা গেল এখানে পারের কোন বন্দোবস্ত নেই। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে কেবল শোনের ওপরই রেলের ছাড়া আর কোন পুল নেই। নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে মাইল খানেক সাইকেল চালিয়ে ঠিক ভোর ৪৷৷৹ টার সময় ইষ্ট ব্যাঙ্ক ষ্টেশনে এসে উঠলাম। বর্হি থেকে আজ আমরা ৯১ মাইল এলাম। কল্‌কাতা থেকে মোট ৩৪৯ মাইল আসা হ'ল।

২৯শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার - সকাল ৮টার গাড়ীতে শোন পার হওয়ার জন্য টিকিট ক'রে ফেল্‌লাম। ষ্টেশন মাষ্টার মহাশয় টুরিষ্ট ব'লে সাইকেলগুলি না বুক কর্‌লেও চল্‌তে পারে বল্‌লেন। কিন্তু ওপারের বিহারী ষ্টেশন মাষ্টার কর্ত্তব্যের জন্য পুরাপুরী সেলামী আদায় ক'রে ছাড়লেন। শোনের পুল লম্বায় দেড় মাইলেরও বেশী। ভারতবর্ষের মধ্যে বেশ একটা বড় পুল। এই সময়ে নদীতে খুব অল্প জল, সবই প্রায় চড়া, কিন্তু বর্ষার সময় বড় ভীষণ হ'য়ে ওঠে। পুলের ওপর বাঁ দিকে সরু ফুটপাথ দিয়ে এপার থেকে ডিহীরি যাওয়া যায়। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের শেষে নদীর ওপর বরাবর ওপার পর্য্যন্ত বাঁধ আর মাঝে-মাঝে ফাঁক আছে। জল কম থাক্‌লে বাঁধের ওপর দিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত থাকে। বর্ষার সময় বা নদীতে জলে বেশী থাক্‌লে রেলের পুল ভিন্ন অন্য কোন গতি নেই।

বেলা প্রায় ৯টার সময় ডিহীরিতে শ্রীযুত মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপ্যাধায়ের বাড়ীতে আতিথ্য গ্রহণ করা গেল। বেলা প্রায় ৫টার সময় আবার বেরিয়ে পড়লাম।

বেশ স্বাস্থ্যকর জায়গা ব'লে ডিহীরির প্রতিপত্তি আছে। সহরের মধ্যে কিন্তু আবর্জ্জনা ও ধূলার অভাব নেই। নদীর ধারটাই যা একটু ভাল ব'লে মনে হয়। ওপারের পাহাড়ের শ্রেণী ক্রমে অদৃশ্য হ'য়ে যাচ্ছে, শাল পলাশ মহুয়ার বনও মিলিয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে যতদূর দেখা যায় কেবল ধূধূ মাঠ।

সন্ধ্যার সময় সসারামে এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে ডান দিকে আরা যাবার রাস্তা। পথে ডুমরাও ও বক্সার যাওয়া যায়। এখানকার লোক সংখ্যায় বেশীর ভাগই মুসলমান। সহরটির পুরান ধরণের বাড়ী ও রাস্তাঘাট দেখলে মুসলমান আমলের সহর বলে চোখে ঠেকে। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর এ-রকম ধরণের সহর এই প্রথম। রাস্তার বাঁধারে জ্যোৎস্নার আলোতে দূরে শের সার সমাধি দেখা গেল। আজও সমস্ত রাত বাইক কর্‌ব মনে কর্‌ছি। চারদিক নিস্তব্ধ। যেখানে দু'পাশের গাছের ছায়ায় রাস্তা একেবারে অন্ধকার সেখানে আমাদের ল্যাম্পের আলো অন্ধকার দূর ক'রে যাবার যেমনি পথ কর্‌ছিল, ফাঁকা রাস্তার চাঁদের আলোতে নিজের অস্তিত্ব মিলিয়ে ঠিক তেমনি সুবিধার কারণ হচ্ছিল। প্রায় ১০৷৷টার সময় রাস্তার পাশে খালের ধারে একটি সুন্দর জায়গায় আমরা সে রাতের খাওয়া শেষ কর্‌লাম।

দূরে বোধ হয় রেলওয়ে ষ্টেশনের আলো দেখা গেল। সমস্ত রাত বাইক করার সঙ্কল্প কোথায় ভেসে গেল। বাকী রাতটুকু ঐখানেই কাটাব স্থির করা হ'ল। রাত ১১৷৷৹ টার পর কুদরা ষ্টেশনে এসে পৌছলাম। অ্যাসিষ্ট্যান্ট ষ্টেশন মাষ্টার মহাশয় বাঙালী। আমাদের পরিচয় পেয়ে ওয়েটীং রূমে থাক্‌বার ও আলো জল ইত্যাদির ব্যবস্থা ক'রে দিলেন। ডিহীরি থেকে আজ মোট ২৮ মাইল আসা হ'ল। কলকাতা থেকে মোট ৩৭৭ মাইল এসেছি।

- ক্রমশঃ -

(প্রবাসী, ভাদ্র ১৩৩৩ সংখ্যা)

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ

[ মূলের বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher