বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।

 

['সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত' –এই ভ্রমণকাহিনিটি ধারাবাহিকভাবে বেরোত প্রবাসী পত্রিকায় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে। লেখক শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায় বিশেষ পরিচিত কোনও নাম নয়। আজকের ইন্টারনেট-গুগুল ম্যাপ-ইন্সটাগ্রাম-ফেসবুক লাইভ যুগের তরুণ-তরুণীদের জন্য এখানে রইল প্রায় একশো বছর আগের কয়েকজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি তরুণের ভ্রমণকথা।]

 

সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত

শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়


পূর্বপ্রকাশিতের পর -

যুক্ত প্রদেশ

৩০শে সেপ্টেম্বর বুধবার - বেলা ৭ টার সময় রওনা হ'লাম। মাঠে গরু মহিষের দল বরাবর রাস্তার পাশে চর্‌ছে। কিন্তু দুধের জন্য আশেপাশের গ্রামে চেষ্টা ক'রে সামান্য দুধও জোটাতে পার্‌লাম না। কাজেকাজেই টিনের দুধ ও ছোলা খেয়ে প্রাতরাশ সেরে ফেল্‌লাম।

বেলা ১১৷৷ টার সময় বিহারের সীমানা কর্ম্মনাশা নদীর পুল পার হ'লাম। যুক্ত-প্রদেশের রাস্তার বিশেষত্ব অল্পক্ষণ পরেই পাওয়া গেল। রাস্তা মাটির মত সাদা ও ধূলায় ভর্ত্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের কাপড়-চোপড় ও সাইকেলের চেহারা ধূলায় সাদা হয়ে গেল। আজ বেজায় গরম, হাওয়া বিপরীত দিক্‌ থেকে বইছে। ক্লান্ত হ'য়ে একটা গাছতলায় কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলাম।

গ্র্যাণ্ডট্রাঙ্ক্‌ রোড্‌ ছেড়ে বেলা ৫টার সময় মোগলসরাইয়ে এসে চা খাওয়া গেল। এখান থেকে বেনারস ৮ মাইল মাত্র। গঙ্গার ওপর ডাফ্রিন ব্রিজের ওপর দিয়ে রেলের লাইন ও দু'পাশে গাড়ী যাওয়ার রাস্তা। এই ব্রিজ পার হ'য়ে কাশী ষ্টেশনকে বাঁদিকে রেখে আমরা বেনারস সহরে ঠিক সন্ধ্যার সময় উপস্থিত হ'লাম।

দশাশ্বমেধ-ঘাটের কাছে একটা রেঁস্তরায় ঢুকে পড়্‌লাম। রেঁস্তরাটি বাঙালী ভদ্রলোকে পরিপূর্ণ। এক স্থুলকায় প্রৌঢ় ভদ্রলোক এতক্ষণ পেয়ালার মধ্যে গোঁফ ডুবিয়ে নিবিষ্টমনে চা পান কর্‌ছিলেন; এইবার পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে, ভরাগলায় জিজ্ঞাসা কর্‌লেন -
"কল্‌কাতা থেকে ঐ সাইকেল ক'রে কাশ্মীর পর্যন্ত যাবে?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ, আবার সাইকেলেই ফির্‌ব মনে কর্‌ছি।"
"ঘাড়ে এ ভূত চাপ্‌ল কেন?"
আমরা বল্‌লাম, "দেখুন ইউরোপীয়েরা কি না কর্‌ছে! তারা দেশ দেশান্তর থেকে আমাদের দেশে এসে এভারেষ্টে উঠ্‌ছে - "
"ওসব সাহেবসুবোদেরই পোষায়,বাঙ্গালীর ছেলে একি খেয়াল বাপু! চেহারাও ত দেখ্‌ছি সে রকম নয় - শেষে হার্টফেল্‌ না করে। কাশী অবধি এসেছ বেশ হয়েছে, এইবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।" আমরা তাঁর দিকে আর মনঃসংযোগ না করে খেতে আরম্ভ ক'রে দিলাম।

সে রাত্রের মতো লাক্‌সায় রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে উঠে পড়্‌লাম। এখানের সেবা-আশ্রমটি মিশনের অন্যান্য সকল জায়গার সেবাশ্রম অপেক্ষা বড় ও বন্দোবস্ত বেশ সুন্দর। এখানে যথেষ্ট জল পাওয়া গেল,সমস্ত দিনের রোদ ও ধূলো ভোগের পর স্নান ক'রে বেশ চাঙ্গা হ'য়ে উঠলাম।
আজ ৬২ মাইল এসেছি - কল্‌কাতা থেকে মোট ৪৩৯ মাইল।

১ লা অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকালে উঠে নাগোয়ায় এলাম। হোষ্টেলের ছাত্রেরা আমাদের দেখে খুব আনন্দিত হলেন। সাইকেল পরিষ্কার ও অল্পস্বল্প যে মেরামত করা দর্‌কার হ'য়ে পড়েছিল এখানে তা সেরে নেওয়া গেল। সুখের বিষয় এ পর্য্যন্ত টায়ার বা টিউব আমাদের কোনো কষ্ট দেয়নি।
বিকাল বেলায় সহরের দিকে কতগুলি দর্‌কারী জিনিষপত্র কেন্‌বার জন্যে বার হ'লাম। রাস্তায় বেজায় ধূলো, পুরাণ ধরণের বাড়ী ও গলিঘুঁজি প্রচুর। সহরে বাঙালীর অভাব নেই। রামলীলার জন্য রাস্তায় ভিড় যথেষ্ট। এখান থেকে চা দুধ প্রভৃতি কিনে হোষ্টেলে ফিরে আস্‌তে রাত ১০টা বেজে গেল। হোষ্টেলে কাশ্মীরের চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রীযুক্ত ললিত বসু মহাশয়ের পুত্রে সঙ্গে আলাপ হ'ল। কাশ্মীর-যাত্রী শুনে ইনি শ্রীনগরে তাঁদের বাড়ীতে অতিথি হবার জন্যে আমাদের নিমন্ত্রণ কর্‌লেন।

২রা অক্টোবর শুক্রবার ভোরের আলোয় ইউনিভার্সিটীর সারি সারি বাড়ীগুলি ঘুমন্ত পুরীর মতোই নিঝুম। চারপাশের সবুজ মাঠের ভিতর দিয়ে লাল কাঁকরের সোজা সোজা রাস্তা। ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং ভারতীয় স্থাপত্যকলার অনুকরণে তৈরী ব'লে মনে হয় যেন প্রাচীন যুগের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়েছি।

এখান থেকে একটি রাস্তা জোয়ানপুর ও প্রতাপগড় হ'য়ে এলাহাবাদে গেছে। রাস্তা ভাল, এলাহাবাদ প্রবেশ করার জন্যে গঙ্গার ওপর ও.আর.আর এর ব্রিজ (কার্জ্জন ব্রীজ) আছে। পুলের নীচের তলায় রেল-লাইন ও ওপর দিয়ে গাড়ী ঘোড়া লোকজন পার হয়। কিন্তু এলাহাবাদ এ পথে প্রায় ১০০ মাইলের ধাক্কা। এই রাস্তা দিয়ে রায়বেরিলি হ'য়ে লক্ষ্ণৌ যাওয়া যায়,দ্বিতীয়টি গ্র্যাণ্ডট্রাঙ্ক রোড। এ পথ মোগলসরাই থেকে সোজা এলাহাবাদ গেছে যমুনা ব্রিজ পার হ'য়ে। এ পুলটিও দ্বিতল,উপরে রেলের লাইন, নীচের পথটি গাড়ী ঘোড়া ও লোকজনের জন্যে। আমরা জোয়ানপুর-প্রতাপগড়ের রাস্তা ছেড়ে ও গ্র্যাণ্ডট্রাঙ্ক রোড ধরার জন্যে মোগলসরাইয়ে ফিরে না গিয়ে ঝুঁসীর পথে এলাহাবাদ অভিমুখে চল্‌লাম। সহর থেকে বার হ'য়ে বি.এন.ডব্লিউ লাইন পার হ'বার পরই একটা গাড়ীর ফ্রি হুইলের স্প্রিং কেটে গেল। যন্ত্রপাতি বার ক'রে সার্‌তে প্রায় আধ ঘন্টা সময় লাগ্‌ল।

আজ খুব জোরে বাতাস বইছে। পথ ট্রাঙ্করোডের মতোই চওড়া,তবে বেজায় ধূলো - এটা বোধ হয় যুক্তপ্রদেশের রাস্তার বিশেষত্ব। পাশের ক্ষেতে হিন্দুস্থানী চাষা,গায়ে পাঞ্জাবী,চাষ কর্‌ছে, পিছনে ঘাঘরা-পরা মেয়েরা বোধ হয় বীজ ছড়িয়ে চলেছে। এখানকার মেয়েদের শাড়ী পরার রেওয়াজ নেই। হিন্দুরা পরে ঘাঘরা ও মুসলমান মেয়েরা পায়জামা। আর একটা জিনিস বেজায় চোখে ঠেকে সেটা হচ্ছে সাদা রংয়ের গাধা। পাশের গাছে বাঁদরদের সভার কিচির মিচির শব্দ আর রাস্তার কাঠবিড়ালীদের ছুটাছুটি আজকের পথের একঘেয়েমি দূর করেছে।

দুপুর বেলা গোপীগঞ্জে নামা গেল। একটি ছোটখাট সহর। পথের ধারে ধারে বড় বড় পুকুরের মাঝখানে একটি করে লম্বা ত্রিশূল বার হয়ে আছে। আর পুকুরের ধারে ধারে শিব-মন্দির। এই রকম একটা পুকুরের ধারে বটগাছের তলায় কয়েক ঘন্টার জন্যে আমরা আড্ডা ফেল্‌লাম। পুকুরে স্নান ক'রে বাজারের পুরী খেয়ে পেট ভরান গেল। এখান থেকে সোজা জোয়ানপুরে যাবার পথ আছে।
রওনা হ'তে বেলা ৪টা বাজ্‌ল। রোদের তেজ ও হাওয়ার জোরের জন্যে আমরা বেশী এগোতে পার্‌ছি না। ঝুঁসী পৌঁছতে প্রায় রাত ৯টা বাজ্‌ল। পথটি গঙ্গার ধারে একটি পন্টুন ব্রীজের সাম্‌নে এসে শেষ হ'য়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ বরাবর থেকে মে মাসের শেষ অবধি এই পুল দিয়ে পার হবার বন্দোবস্ত থাকে। বাকী সময় পাছে বর্ষার স্রোতে পুল ভেসে আয় এইজন্যে পুল খোলা থাকে। রাত বেশী হ'য়ে যাওয়ায় ফেরী পাওয়া গেল না। অগত্যা কোনো উপায় না দেখে বি, এন, ডব্লিউ রেলের পুল দিয়ে পার হ'বার কথা হ'ল। ঝুঁসীর মিলের বিজলী বাতি দেওয়া রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে অনেক খানা, ডোবা, নালা, ঝোঁপঝাঁপ পার হ'য়ে প্রায় মাইল খানেক যাবার পর লাইনের উঁচু বাঁধের ওপর অতি কষ্টে উঠ্‌লাম। পুলের ওপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে যাওয়া এক বিষম ব্যাপার! তিন চার হাত পর পর প্রায় আট দশ ইঞ্চি উঁচু লোহার কড়ি বরাবর লাইনের দু'পাশে বার হ'য়ে আছে। এর ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। পথটি হাত তিনেক চওড়া,পাশে মাত্র দু'টি তার রেলিঙের কাজ কর্‌ছে। সাইকেল কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে চল্‌লাম। লোহার পাতে আমাদের জুতো মাঝে মাঝে পিছলে যেতে লাগ্‌ল। সাইকেল শুদ্ধ নীচে গঙ্গায় পড়া বিশেষ বাঞ্ছনীয় হবে না ব'লে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হ'তে লাগ্‌লাম। পুল আর শেষ হয় না,কেবল জ্যোৎস্না ছিল ব'লে কোন দুর্ঘটনা ঘট্‌ল না।

সম্মুখেই ষ্টেসনের মিটিমিটি আলো জ্বল্‌ছে। প্রায় ত্রিশ ফুট নীচে এলাহাবাদ সহরতলীর রাস্তা। ষ্টেসন দিয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত হ'বে না ভেবে এইখান থেকেই নীচে নাম্‌বার চেষ্টা দেখতে লাগ্‌লাম। লগলাইন দড়ি লগেজ খুলে বার ক'রে তার সাহায্যে একে একে সাইকেলগুলিকে বেঁধে ঝুলিয়ে নীচে নামান হ'ল। এতেও নিষ্কৃতি নেই, নীচে শালের খুঁটীর বেড়া। কোনো রকমে বেড়া টপ্‌কে রাস্তায় এসে হাঁপ ছাড়লাম। চারদিকে অল্প অল্প কুয়াসা। ঘামে-ভেজা জামা গায়ে থাকায় এখন শীত শীত কর্‌তে লাগ্‌ল। রাত প্রায় এগারটা। পুল পার হ'য়ে রাস্তায় আস্‌তে দেড় ঘন্টার ওপর লেগেছে। মাইল দুই আসার পর এলাহাবাদ সহরের মধ্যে পৌঁছলাম। সব দোকান পাট বন্ধ, সহর নিস্তব্ধ। ঘোরাঘুরি কর্‌তে কর্‌তে একটা কাশ্মিরী হোটের খোলা দেখে সেইখানেই ঢুকে পড়্‌লাম।
আজ ৭৪ মাইল বাইক করা গেছে। মিটারে দেখা গেল কল্‌কাতা থেকে মোট ৫১৩ মাইল এসেছি।

৩রা অক্টোবর,শনিবার - ডাঃ নীলরতন ধর মহাশয়ের সঙ্গে দেখা কর্‌বার জন্যে সকালে উঠে আমরা কর্ণেলগঞ্জের দিকে রওনা হ'য়ে পড়্‌লাম। তিনি আমাদের দেখে ভারী খুসী হলেন ও তাঁর বাড়ীতে থাকার জন্যে অনুরোধ কর্‌লেন। হোটেলের পাওনা মিটিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে ফির্‌তে বেলা হ'য়ে গেল। ধূলোয় সাইকেলগুলির অবস্থা এমন হয়েছে যে রীতিমত পরিষ্কার না কর্‌লে আর তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করা দুষ্কর।
ইউনিভার্সিটী,হাইকোর্ট প্রভৃতি দেখ্‌তে দেখ্‌তেই সন্ধ্যা হ'য়ে গেল। রাস্তায় ট্রাম বা ট্যাক্‌সির চলন নেই,আছে কেবল টোঙ্গা - এক্কার উন্নত সংস্করণ। এক্কার মতো চারদিকে লোক না ব'সে কেবল সাম্‌নে পিছনে দু'জন দু'জন ক'রে বস্‌তে পারে। এখানে ইতর ভদ্র সকলেরই যান টোঙ্গা ও এক্কা। চাঁদনি রাত - রাস্তায় আলোর বালাই নেই। জিজ্ঞেস ক'রে জানা গেল কৃষ্ণপক্ষ ছাড়া অন্য সময়ে এখানে রাস্তায় আলো জ্বালা হয় না।

৪ঠা অক্টোবর রবিবার - খুব ভোরে বেরিয়ে পড়্‌লাম। ফোর্ট ও যমুনার দ্বিতল পুলের ওপর থেকে গঙ্গাযমুনা সঙ্গম দেখে আবার গ্র্যাণ্ড্‌ট্রাঙ্ক্‌ রোড ধর্‌লাম। মাইল ছয় অতি খারাপ রাস্তা, বেজায় ধূলো। এইখানে রাস্তার বাঁদিকে বামরুলা এয়ারডোমে যাবার পথ। কিছুদূর থেকে ভাল রাস্তা পাওয়া গেল। পাশে পাশে বরাবর গম, ভুট্টা ও জোয়ারের ক্ষেত, মাঝে মাঝে দু'একটা ধানের ক্ষেতও আছে। পথের ধারে ধারে শুক্‌নো ডোবায় কাদাখোঁচা, কাক, সারস প্রভৃতি অনেক রকম পাখী দেখা যাচ্ছে। আম জাম নিম গাছের সারি রাস্তার দু'পাশে চলেছে। তারি ছায়ায় ছায়ায় চ'লে আমরা দুপুরবেলায় খাগোয়া চটীতে, বড় পুকুরের ধারে এক বাগানের মধ্যে আড্ডা ফেল্‌লাম।

এখানে একটা ভারি মজার ঘটনা হয়েছিল। বাগানের মধ্যে দলে দলে বাঁদরের সভা ব'সে গেছে। পুকুরে স্নান ক'রে ফির্‌ছি, দেখ্‌লাম সাম্‌নেই এক 'পালের গোদা' আমাদের এক টুপি মাথায় পরে, একটু আগে আমরা যে রকম ভাবে গাছে ঠেস দিয়ে বসেছিলাম ঠিক সেইভাবে আসর জাঁকিয়ে বসে আছে। এই রোদে টুপি না থাক্‌লে যে কি বিপদে পড়্‌তে হবে সে আর বুঝ্‌তে বাকী রইল না। তাড়া দিতেই টুপীপড়া বাঁদরটি লাফ মেরে গাছে উঠ্‌ল, টুপিটা মাথা থেকে পড়ে গেল। আমরাও বাঁচলাম। এবার থেকে আমরা সাবধান হ'য়ে গেলাম। পাহারার বন্দোবস্ত না ক'রে জিনিষপত্র ফেলে আর কোথাও যেতাম না।

আমাদের দেশের তুলনায় এখানকার গরু ছাগল খুব বড়। রাস্তার পাশে মন্দির ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে। ঘন্টা বাজিয়ে দুল্‌কি চালে সারি সারি উটের দল চলেছে। তাদের পায়ের ধূলোয় পিছনের রাস্তা অন্ধকার। খোঁজ নিয়ে জান্‌লাম দিনাজপুরের মেলায় বিক্রীর জন্য এদের নিয়ে যাচ্ছে।

বেলা পাঁচটার পর ফতেপুরে। ছোট খাট সহর। বাজনা বাজিয়ে নিশান উড়িয়ে একটা শোভাযাত্রা চলেছে। ঘুর্‌তে ঘুর্‌তে ডাকবাংলায় গিয়ে উঠ্‌লাম। বাংলায় ইঞ্জিনিয়ার শ্রীযুত শৈলেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী মহাশয় আমাদের সাদর অভ্যর্থনা কর্‌লেন। রাত্রে এখানকার ওভারসিয়ার শ্রীযুত দেবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া করা গেল। ফতেপুরে ইনিই একমাত্র বাঙালী। এখান থেকে ডান দিকে রায়বেরিলি ও বাঁদিক্‌ দিয়ে গাজীপুরে যাওয়ার রাস্তা দেখা গেল।
এলাহাবাদ থেকে আজ ৮০ মাইল আসা হয়েছে, রাস্তা মোট ৫৯৩ মাইল উঠেছে।

৫ই অক্টোবর সোমবার। কানপুরের পথে মোহার ব'লে একটা ছোট গ্রাম আছে। এখানে গাছে গাছে অসংখ্য পাখী দেখা যাচ্ছে। কাঁক, কাস্তেরো, কাদাখোঁচা, মাণিকজোড় সবই শিকারের পাখী। সঙ্গে বন্দুক না থাকার জন্যে বড় আপ্‌শোষ হচ্ছিল। ফতেপুর থেকে ৩৫ মাইল ও কলকাতা থেকে ঠিক ৬২৮ মাইল আসার পর একটা ষ্টাণ্ডার্ড গাড়ীর পিছনের চাকায় ফুটো (puncture) হ'ল। এই প্রথম puncture। আজ রাস্তা বেজায় খারাপ - গাড়ীর ধাক্কার (jolting ও jerking) জন্যে গায়ে হাতে ব্যথা হ'য়ে গেল। বেলা দেড়টার পর আমরা কাণপুর সহরতলীতে এসে পড়লাম। পাশে পাশে মিল ও মিলের রেল-লাইন আর তার পাশে পাশে বস্তি। কাণপুরে প্রথম ট্রাম দেখা গেল, কলকাতার তুলনায় বেজায় ছোট ও নেহাৎই যেন কেমন-কেমন।

যুক্ত-প্রদেশের মধ্যে কানপুর সব-চেয়ে বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। সিপাহী বিদ্রোহের জন্যে কানপুর প্রসিদ্ধি লাভ করেছে বটে, কিন্তু কানপুরের কলকারখানা, বাজারে নানাপ্রকার ফসলের আমদানী-রপ্তানী ও লোকজনের ব্যস্ত-সমস্ত ভাব সহজেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এইসবই আধুনিক কানপুরের প্রসিদ্ধি ও সমৃদ্ধি লাভের কারণ। কানপুর থেকে রাস্তার বাঁদিকে ঝান্সী ও ডান দিকে লক্ষ্ণৌ যাওয়ার রাস্তা।
মিটারে ৬৪০ মাইল উঠেছে। সুতরাং আজ আমরা মোটে ৪৭ মাইল এসেছি।

৬ই অক্টোবর মঙ্গলবার। সকাল থেকেই মেঘ ক'রে রয়েছে। দিনটা বেশ ঠাণ্ডা। বি-বি,সি-আই রেল লাইন,পাশে পাশে রাস্তার সঙ্গে চলেছে। এক পাশে একটা বড় সর্‌কারী কৃষিক্ষেত্র দেখা গেল। ইসান রেল ও রাস্তার পুল পার হ'য়ে সূরযপুর গ্রাম। মাইল পঞ্চাশ আসার পর একটি রাস্তা ট্রাঙ্ক রোড থেকে ডান দিকে চ'লে গেছে। মোড়ের পথ নির্দ্দেশক কাষ্ঠফলক, ডান দিকের রাস্তাটি দিল্লী দিয়া ও সোজা রাস্তাটি কনোজের দিকে গেছে, দেখাচ্ছে। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড এপর্য্যন্ত কোথাও এরকম হঠাৎ মোড় ফেরেনি। সেইজন্য আমাদের এখানে একটু সন্দেহ হ'ল। দূরে ডানদিকের রাস্তা থেকে একটা এক্কা আস্‌তে দেখে তার কাছ থেকে সঠিক খবর পাব এই আশায় আমরা সেইখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর্‌তে লাগ্‌লাম।

এক্কার ভেতর থেকে একটি প্রৌঢ় হিন্দুস্থানী ভদ্রলোক (পরে অবগত হলাম তিনি পুলিশের লোক) মুখ বার ক'রে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছেন দেখতে পেলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর্‌লাম -
"দিল্লীর রাস্তা কোন্‌টি বল্‌তে পারেন?"
গম্ভীর ভাবে উত্তর হ'ল - "সোজা যাও।"

সুতরাং দেখলাম কাষ্ঠফলকে ভুল নিশানা দেখাচ্ছিল। কিন্তু পাঠকগণের স্বভাবতই কৌতূহল হ'তে পারে যে, রাস্তায় এরকম ভুল নিশানা থাক্‌বার কারণ কি। এইরকম ভুল নিশানার জন্যে রাস্তা-বিভ্রাট পরেও আমাদের হয়েছিল। এর কারণ আর কিছু নয়; সাধারণতঃ রাস্তার এইরূপ মোড়ে যে-সব নিশান-ফলক থাকে,সেগুলি প্রায়ই তেমন মজবুত ও দৃঢ়ভাবে মাটির সঙ্গে গাঁথা থাকে না। কাজেই একটু বেশী ঝড়-হ'লে বৃষ্টি বা চলন্ত গরুর গাড়ীর সামান্য একটু ধাক্কা লাগ্‌লেই নিশান-ফলকগুলি ভূমিসাৎ হয়। তারপর যথাসময়ে সর্‌কারী কুলীরা যখন রাস্তা মেরামত কর্‌তে আসে তখন তারা পুনরায় নিশান-ফলকটিকে কোনো রকমে দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন নিশান-ফলকটি উল্‌টা-পাল্‌টা হ'য়ে যায়। তারা ইংরাজীতে লেখা ফলকের দিক-নির্দ্দেশ কিছুই বোঝে না। সুতরাং বিদেশী পথিককে রাস্তা হারাতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না।

খানিক দূর গিয়ে একটা ছোট গ্রামের ধারে চা তৈরী কর্‌বার জন্যে নেমে পড়্‌লাম। গ্রামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হ'ল। ইনি আমাদের কয়েক প্যাকেট চা উপহার দিলেন। রাস্তার ওপরে এঁর আতর ও গোলাপ-জলের প্রকাণ্ড কার্‌খানা। গ্রামের পাশের এক রাস্তা দিয়ে কনোজ মাত্র এক মাইল দূর। এ সুযোগ ছাড়া উচিত মনে হ'ল না। সোজা কনোজে গিয়ে উপস্থিত হ'লাম। কনোজ এখন একখানি গ্রাম মাত্র। জয়চাঁদের দুর্গ প্রায় দেড়শত ফিট উঁচু মাটীর স্তূপ - উপরে এখন ভুট্টার চাষ হচ্ছে। দুর্গের স্মৃতিস্বরূপ এক পাশে একটি থামের ভগ্নাবশেষ মাত্র এখন দেখা যায় প্রাচীনযুগের নিদর্শন হিসাবে এইখান থেকে একটা লতাপাতাকাটা ছোট ইট সংগ্রহ ক'রে নিলাম। এরই পাশে একটি বড় সুন্দর ও পুরানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেল।
সূর্য্য অস্ত যায়-যায়। গুরসাহীগঞ্জ আর কয়েক মাইল দূর। সেইখানেই আজ রাত্রের মতো ছাউনি পড়্‌বে। পালে পালে গরু মহিষ মাঠ থেকে ফির্‌ছে। গোধূলি-বেলায় অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু যেন 'গোধূলিতে' আরও ম্লান হ'য়ে গেছে। সমস্ত 'গো-ধূলি' শরীরে ও কাপড়-চোপড়ে সঞ্চয় ক'রে আমরা গুরসাহীগঞ্জে এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে একটি রাস্তা ডানদিকে ফতেগড় অভিমুখে গেছে।

গুরসাহীগঞ্জ বি-বি,সি-আই রেলের একটি ছোট ষ্টেশন। রাস্তার দু'পাশে কয়েকটি দোকান ও বাড়ী নিয়ে গ্রামটি তৈরী হ'য়েছে। সুবিধা মতো থাক্‌বার জায়গা না পেয়ে প্রথমে ষ্টেশন-মাষ্টার মশায়ের কাছে দর্‌বার করা গেল;সুবিধা কর্‌তে পার্‌লাম না। শুন্‌লাম একটি ধর্ম্মশালা এখানে আছে, অগত্যা সেইখানেই যাওয়া গেল।

যুক্ত-প্রদেশের মতো আচার-ব্যবহারের গোঁড়ামি আর আমরা কোথাও দেখিনি। এখানে কূয়া থেকে জল তোল্‌বার বালতি হিন্দু ও মুসলমানদের আলাদা আলাদা। ভুলক্রমে যদি কোনো মুসলমান হিন্দুদের 'ডৌল' ছোঁয় তা হ'লে সেখানে রীতিমত এক দাঙ্গা বেধে ওঠ্‌বার জোগাড় হয়। দৈবাৎ যদি কোনো বিদেশী, মুসলমানের কাছ থেকে খাবার জিনিষ-পত্র কেনে তবে পরে হিন্দুদের কাছ থেকে তার কোনো কিছু কিন্‌তে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। হিন্দু হ'য়ে জুতা প'রে জল খাওয়া ও মাথায় 'সাহেবী টোপ' পরার উদ্দেশ্য যে কি তা কিছুতেই বোঝাতে পারি-নি। মুসলমানেরা কাচের বাসন ব্যবহার করে ব'লে চায়ের এনামেলের মগ-গুলিও আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াল।

সুতরাং ধর্ম্মশালায় আর আমাদের স্থান হ'ল না। অনেক কষ্টে ধর্ম্মশালার বাইরের রোয়াকে থাক্‌বার 'অনুমতি' জোগাড় কর্‌লাম। এক কনোজীয়া ব্রাহ্মণের দোকান থেকে পুরী, মাংস কিনে রাতের মতো খাওয়া শেষ করা গেল। কনোজীয়াদের গোঁড়ামি কিছু কম, এরা বাঙ্গালীদের মতো মাছ-মাংস সবই খায়।
সব সাইকেলগুলিকে এক-সঙ্গে চাবি দিয়ে আমরা সতর্ক হ'য়ে শুয়ে পড়্‌লাম। আজ ৬৫ মাইল আসা হয়েছে। কলকাতা থেকে এখানকার দূরত্ব ৭০৫ মাইল।

৭ই অক্টোবর বুধবার। আজকে রাস্তার প্রথমে দুপাশে ভূট্টা জনারের ক্ষেত; কদাচিৎ দু'একটা ধানের ক্ষেতও আছে। কূয়ার গভীরতা বড় বেশী ব'লে বলদের সাহায্যে জল তুলে এরা ক্ষেতে ফসল তৈরী করে। এখানকার চাষী বাংলার মতো অদৃষ্টবাদী নয়। আশ্চর্য্যের বিষয় এই দেখ্‌লাম, কোথাও কোথাও পুকুরে পাট পচান ও আছড়ান হচ্ছে। উটে-টানা দ্বিতল গাড়ী সারি দিয়ে চলেছে। গাড়ীর চেয়ে তাকে খাঁচা বল্‌লেই ভাল হয় - একটি দ্বিতল খাঁচা গরাদে দেওয়া তলায় চারটি ছোট ছোট চাপে। পাশে হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড মাঠ দেখা গেল যেন সবুজ মখমলে মোড়া। এঅঞ্চলে এরকম মাঠ প্রায়ই দেখা যায়। এগুলিকে এন্‌ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড বলে। এখানে সর্‌কারী কর্ম্মচারীরা সফরে এসে ছাউনি ফেলে থাকেন।

দুপুরের পর বেওয়ার ব'লে একটা বড় গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এটা-র দিকে সাইকেল চালিয়ে দিলাম। বেওয়ার থেকে ডান দিকে ফতেগড় ও বাঁদিকে এটোয়া যাবার পথ। চারিদিকের দৃশ্য যেন হঠাৎ বদ্‌লে গেল। এখানে রাস্তার পাশে পাশে বড় বড় elephant grass কয়েক মাইল ধ'রে চলেছে। একদল হরিণ হঠাৎ রাস্তার একপাশ থেকে বেরিয়ে আমাদের সাইকেলের সুমুখ দিয়ে ছুটে বড় বড় ঘাসের বনের মধ্যে অদৃশ্য হ'য়ে গেল। এক দলের পর আর-এক দল এম্‌নি পালে পালে কৃষ্ণসার কখন বা ছোট চিতল হরিণের দল দেখা যেতে লাগ্‌ল। টিয়ার ঝাঁক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, বিচিত্র কলরব কর্‌তে কর্‌তে। পথে কেবল হরিণের পাল আর টীয়ার ঝাঁক - যেন আমরা এদেরই রাজত্বে এসে পড়েছি!
প্রায় বেলা তিনটার সময় ভনগাঁওয়ে উপস্থিত হ'লাম। এখান থেকে বাঁদিকে সিকোহাবাদ হ'য়ে আগ্রার পথ চ'লে গেছে। দূর মোট ৭৫ মাইল। ডান দিকে ফতেগড় যাবার রাস্তা।

অস্তগামী সূর্য্যের রক্তিম ছটায় মাঠ পথ লাল হ'য়ে গেছে। ক্রমশঃ অন্ধকার পৃথিবীকে ছেয়ে ফেল্‌লে। পর পর তিনটি খাল (Lower Ganges Canal) পার হ'য়ে আমরা আলো জ্বেলে চলেছি। কর্ম্ম-কোলাহল-রত ভারাক্রান্ত ধরিত্রী এখন নিস্তব্ধ, স্থির! অন্ধকারের বুক চিরে' একটা আলোর রেখা আমাদের সাম্‌নে এসে পড়্‌ল। উৎসাহে এগিয়ে চল্‌লাম, মনে হ'ল আজকের মতো পথের শেষে এসে পড়েছি। সমস্ত দিনের রোদ,তৃষ্ণা ও এই পরিশ্রমের পর - আঃ সে কি আরাম!
বাজনা ও লোকজনের গোলমাল কানে এল - ভাবলাম বোধ হয় সহরে কোনো কারণে মিছিল বেরিয়ে থাক্‌বে। পাঞ্চ-লাইট্‌-দেওয়া চৌমাথায় এসে দেখি পাশের মাঠেই সিনেমা ব'সে গেছে। এদের ঐক্যতান-বাজনার হট্টগোল আমরা অনেক দূর থেকে শুন্‌তে পাচ্ছিলাম। তা হ'লে এটায় এসে পড়েছি! এইবার থাক্‌বার জায়গার বন্দোবস্ত কর্‌তে পার্‌লেই আজকের মতো নিশ্চিন্ত। বাঁদিকে বড় বড় অনেক হাঁসপাতালের কোয়ার্টার্‌স্‌ খালি রয়েছে দেখা গেল। এরই যে-কোনো একটা বারান্দায় আমাদের বেশ চ'লে যেতে পারে। হাঁসপাতালের 'বড় ডাক্তার সাহেবের' কাছে যাওয়া গেল অনুমতি চাইবার জন্যে। হিন্দুস্থানী ভদ্রলোকের কাছে বাঙালী ব'লে পরিচয় দিতেই তিনি সোজা পথ দেখিয়ে দিলেন বাইরের দিকে। আমরা আর-এক রকম অভিজ্ঞতা লাভ কর্‌লাম। উপায় না দেখে অগত্যা একবার পুলিসের কাছে ভাগ্য পরীক্ষা কর্‌বার জন্যে থানার দিকে রওনা হ'লাম।
থানায় মামুলি পরিচয় দিতে খানিক্ষণ গেল। এই একটা কাজ যা ক্রমশঃই বিরক্তিকর হ'য়ে দাঁড়াচ্ছিল। প্রথমতঃ আমাদের আদ্যোপান্ত বিবরণ! হয়ত প্রত্যেক দিন কম ক'রে পাঁচ-সাত বার দিতে হয়, তার ওপরে উপর্য্যুপরি সম্ভব অসম্ভব নানা-প্রকারের প্রশ্ন! যাই হোক এখানকার ইন্‌স্‌পেক্টার্‌ সাহেব বেশ ভদ্রলোক। ইনি আমাদের জন্য ঘর, 'চারপাই', স্নানের জন্যে জল প্রভৃতির বন্দোবস্তও ক'রে দিয়েছিলেনই, উপরন্তু তাঁর অনুগ্রহে ফাই-ফরমাস শোন্‌বার একটা চাকরও সে-রাতের মতো আমরা পেয়ে গেলুম। এ অবস্থায় একটি অনুগত ভৃত্য লাভ আমাদের পক্ষে বড় কম সৌভাগ্যের কথা নয়। বাজার থেকে খাবার আনিয়ে বিছানায় ব'সে খাওয়া হ'ল। বিছানা পাতা, সাইকেল পরিষ্কার, জিনিসপত্রের ধূলা ঝাড়া এইসব কাজ আমাদের আর কর্‌তে হ'ল না। চাকরের দ্বারাই সব সারা গেল। আজ ৭৯ মাইল আসা হয়েছে,কলকাতা থেকে দূরত্ব মোট ৭৮৪ মাইল।

৮ই অক্টোবার বৃহস্পতিবার - এটা, জেলার সদর। বেশ জায়গা, ওরই মধ্যে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু রেলওয়ে এখান থেকে দূর ব'লে জায়গাটা তেমন বিখ্যাত নয়। এটা থেকে ২০ মাইল দূরে সিকান্দ্রারাউয়ের রেল ষ্টেশন। এখান থেকে সিকান্দ্রারাউ অবধি মোটর লরী যাতায়াত করে। রাস্তার বাঁদিকে পর পর দু'টি রাস্তা দেখা গেল, একটি সিকোহাবাদ অপরটি মথুরা অভিমুখে গেছে। এই জেলায় চোর-ডাকাতের উৎপাত খুব বেশী, ক্রিমিন্যাল ডিষ্ট্রিক্‌ট ব'লে এটার অখ্যাতি শোনা গেল।

সকালে রওনা হ'য়ে উল্লেখযোগ্য জিনিষ দেখ্‌ছি খইয়ের আড়ত। দোকানের সাম্‌নে চটের ওপর পাহাড়ের মত খই ঢালা হ'য়েছে, কেবল একজায়গায় নয়, রাস্তার দু'পাশেই এই রকম খইয়ের পাহাড়। আর দেখলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্ডেন - ঘাসে-ঢাকা এক টুক্‌রো ছোট্ট বাগান আর তার মাঝখানে ভিক্টোরিয়ার মর্ম্মর-মূর্ত্তি।

মাইল দশ পরে গ্যাঞ্জেস্‌ কেনাল ব্রিজের ওপাড় থেকে আলিগড় জেলার সীমানা সুরু হ'ল। গয়া জেলার মত এখানে খাপ্‌ছাড়া ভাবে পথের পাশে এক জায়গায় পলাশের বন দেখতে পেলাম। বেলা দশটার সময় আমরা সিকান্দ্রারাউ সহরে এসে বিশ্রাম কর্‌বার জন্যে নেমে পড়্‌লাম। রোদের তেজ আজ বেজায়, রাস্তা ধূলায় অন্ধকার। তারি মাঝে গাছের ছায়ায় ছায়ায় দোকান ব'সে গেছে। কূয়ার ধারে ধারে টিনের নল বা বাঁশের চোঙ্গায় একটি লোক জল ঢাল্‌ছে আর তৃষ্ণার্ত্ত পথিকেরা দু'হাতে ক'রে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সেই জল পান কর্‌ছে। এইরূপ জলসত্রকে এ দেশী ভাষায় পিয়াউ বলে। তৃষ্ণার্ত্ত পথিককে জলদান অতিশয় পুণ্যের কাজ ব'লে এখানকার ধনী ব্যক্তিরা পিয়াউর জন্য মাহিনা ক'রে লোক নিযুক্ত করেন। তারা বেলা ৮টা থেকে ৫টা অবধি পথিকদের শীতল জল দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে। যুক্ত প্রদেশে ও পাঞ্জাবে এই পিয়াউর যথেষ্ট প্রচলন আছে।
বেলা আড়াইটা তিনটার সময় সিকান্দ্রারাউ থেকে বেরিয়ে পড়্‌লাম। সহর থেকে দলে দলে এক্কা বাইরে যাওয়া-আসা কর্‌ছে। পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে চলেছি। পাশের খোড়ো ও খোলার বসতি, কৃষাণ ও মজুরাণীদের হাস্য-কোলাহলে মুখরিত হ'য়ে উঠেছে।

এসব ছাড়িয়ে আমরা নির্জ্জন পথে এসে পড়্‌লাম,গাছের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর ব'সে আছে। ছোট ছোট ছানাগুলি রাস্তার ধারে ধারে চ'রে বেড়াচ্ছে। তারা আমাদের দেখে ত্বরিত পদে একটু স'রে গিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে রইল, এক-একটা বা আধটুভাবে ডানা নাড়্‌তে নাড়্‌তে গাছের ওপর তার মায়ের কাছে উড়ে গিয়ে যেন নিশ্চিন্ত হ'ল। তাদের ডানা থেকে খ'সে-পড়া পালক কুড়ুতে কুড়ুতে আমরা এগিয়ে চল্‌লাম।
ক্রমশঃ এসব মিলিয়ে গেল, আবার সারি সারি এক্কা ও মাল-বোঝাই গরু-মহিষের গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে আমরা চলেছি, সকলের গন্তব্যই একদিকে। রাস্তাও খারাপ হ'য়ে এল। প্রত্যেক বড় সহরের প্রবেশ-পথ এইরকম হয়। বুঝ্‌লাম, আলিগড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি।

সহরে বাঁদর ও হনুমানের উপদ্রব খুব। এখানকার উল্লেখযোগ্য জিনিসের মধ্যে মুস্‌লিম ইউনিভার্সিটি। মাখমের কার্‌খানা ও খেলাধূলার জন্যেও আলিগড়ের নাম আছে। জায়গাটি মুসলমান-প্রধান ও আয়তনে বড় কম নয়। ধূলা, নোংরা ও ঘন ঘন বসতিতে পরিপূর্ণ। পথের ওপর একটা বড় বাড়ীর ফটকে বাংলা হরফে 'যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়,উকিল' লেখা দেখে আমরা আর ইতস্ততঃ না ক'রে সেইখানেই আজকের মত আস্তানা গাড়্‌বার জন্যে প্রবেশ কর্‌লাম।

গৃহস্বামী আমাদের পরিচয় ও অ্যাড্‌ভেঞ্চার্‌ শুনে বিশেষ পুলকিত হ'য়ে উঠ্‌লেন। এঁরা এখানে প্রায় চল্লিশ বৎসর বাস কর্‌ছেন। কম্পাউণ্ডে অনেক ঘোড়া রয়েছে দেখে কৌতুহল হ'ল, জিজ্ঞাসা ক'রে জান্‌লাম এঁদের ঘোড়ার ব্যবসা আছে। ভাল ঘোড়ার প্রজনন আলিগড়ে হয়। এখানকার অশ্বব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেইসব ঘোড়া গবর্ণ্‌মেন্ট অশ্বারোহী ও অন্যান্য সামরিক বিভাগের জন্য ক্রয় করেন।
ঘরের বারান্দায় 'চারপাই'য়ের ওপর বিছানা করা হ'ল। আজ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা মনে হ'তে লাগল, পায়ের তলায় কম্বলগুলি বিছিয়ে রেখে আমরা নিদ্রাদেবীর আরাধনা কর্‌তে সুরু ক'রে দিলাম। আজ ৪৫ মাইল মাত্র বাইক করা হয়েছে, কলকাতা থেকে মোট ৮২৯ মাইল।

৯ই অক্টোবর শুক্রবার - আজ আমাদের দিল্লী পৌঁছবার কথা। দিল্লী! অতীত গৌরবমণ্ডিত দিল্লী! যেখানে কত সম্রাট্‌ কত বাদশা'র ভাগ্য নিরূপিত হয়েছে, কত জাতির উত্থান-পতনের অভিনয় যে রঙ্গমঞ্চে হ'য়ে গেছে - যার ভাগ্য-পরিবর্ত্তনের সঙ্গে-সঙ্গে এক সূত্রে গাঁথা সমস্ত ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, আজ আমরা সেই দিল্লী-যাত্রী।

প্রথমেই হ'ল রাস্তার গোলমাল। একটু বড় সহর হ'লেই গ্র্যাণ্ড-ট্রাঙ্ক রোড সহরের মধ্যে এসে এমন লুকোচুরি খেলে যে তার নাগাল পেতে হায়রান হ'তে হয়। বরাবর বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে চ'লে আবার ট্রাঙ্ক রোডকে ধরা গেল। পাশে পাশে ছায়াশীতল বাগান কখন বা পথের পাশে শুষ্ক তৃণহীন ধূসর রংয়ের পোড়ো মাঠ। ত্রিশ মাইল পরে রোদ বেশ চন্‌চনে হ'য়ে উঠ্‌ল; আমরাও ট্রাঙ্ক রোড ছেড়ে খুরজা সহরে প্রাতঃরাশ সেরে নেবার জন্যে প্রবেশ করলাম। খুরজার খ্যাতি ঘিয়ের জন্যে, প্রমাণও তার চোখে পড়্‌ল। সহরের মধ্যে ঘিয়ের আড়ত প্রচুর, আশপাশ থেকে গাড়ী বোঝাই টিন টিন ঘি সহরের মধ্যে আসছে। ঘিয়ের গাড়ী চলাচলের জন্যে রাস্তার অবস্তা একেবারে শোচনীয়।
বাজারে প্রাতঃরাশের জন্য মুড়ি ও লাড্ডু ছাড়া আর কিছু মিল্‌ল না। এ অঞ্চলে দোকানে মিষ্টান্ন ছাড়া আর কোন রকম খাবার পাওয়া যায় না, তার মধ্যে লাড্ডুই বেশী। আমরা ভাবলাম দিল্লীর লাড্ডু না কি? এখানে মুড়ি ১৲ সের হিসাবে বিক্রী হয়।

খুরজা সহর থেকে একটি কাঁচা রাস্তা সেকেন্দ্রাবাদ অবধি গিয়ে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে মিশে গেছে। ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই রাস্তায় প্রায় দশ মাইল শর্টকাট হয়, সেইজন্যে আমরা খুরজা থেকে আবার ট্রাঙ্ক রোডে ফিরে না এসে এই রাস্তা দিয়ে সেকেন্দ্রাবাদ অবধি যাব স্থির ক'রে বেড়িয়ে পড়্‌লাম। কিন্তু রাস্তাটি সহর থেকে মাইল দুই গিয়ে নিজেকে মাঠের মধ্যে এমন হারিয়ে ফেলেছে যে এরাস্তায় আমাদের শর্টকাটের কিছুমাত্র সুবিধা হবে ব'লে বোধ হ'ল না। কাজে-কাজেই আবার খুরজায় ফিরে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধর্‌তে হ'ল। ঘন্টাখানেক যাবার পর একটা Canal Bridge পার হ'য়ে, সাম্‌নেই বুলানসহর যাবার রাস্তা দেখ্‌তে পেলাম,দূর মোটে দেড় মাইল। সেখান থেকে ট্রাঙ্ক রোড বাঁদিকে ফিরে চ'লে গেছে। এই মোড়ে ছায়া-ঢাকা একটি বড় পিয়াউ দেখে আমরা জল-খাবার জন্যে নেমে পড়্‌লাম।

ঠিক দেড় মাইল আসার পর আবার একটি মোড়। কাষ্ঠফলকে বাঁ দিকের রাস্তা মিরাট ও সোজা রাস্তা দিল্লীর নিশানা দিচ্ছে। আমরা নির্দ্দেশ - অনুযায়ী সোজা রাস্তা ধ'রে চল্‌লাম। হঠাৎ নজর পড়্‌ল মাইল-ষ্টোনের দিকে। মাইল-ষ্টোনে দিল্লীর কোন উল্লেখ নেই কেবল মিরাটের দূরত্ব-জ্ঞাপক সংখ্যা দেখে আমাদের সন্দেহ হ'ল। পুনরায় মোড়ে ফিরে এসে অনুসন্ধান ক'রে বুঝ্‌লাম কাষ্ঠফলকের ভুল নিশানাই এই বিপত্তির কারণ। পাছে আমাদের মত আর কেউ এই বিভ্রাটে পড়ে সেইজন্যে আমরা নিশান ফলকটিকে ঠিক করে দিয়ে বাঁ-দিকে রাস্তায় প'ড়ে জোরে সাইকেল চালিয়ে দিলাম। এই মোড় থেকে দিল্লী ও মিরাটের দূরত্ব এক - মোট ৪৪ মাইল। ট্রাঙ্ক রোড এইখানে যেমন মাঝে মাঝে হঠাৎ মোড় ফিরেছে সে রকম এপর্য্যন্ত আর কোথাও দেখিনি। একটু অসাবধান হ'লেই রাস্তা গোলমাল। এরকম জায়গায় শুধু নিশানফলকের উপর নির্ভর না ক'রে স্থানীয় লোকজনের কাছে সঠিক সংবাদ নিয়ে অগ্রসর হওয়াই উচিত।

বড় বড় গাছের তলা দিয়ে রাস্তাটা চ'লে গেছে। এখানে অনেক খেজুর-গাছের সারি দেখা গেল। ক্রমে আমরা সেকেন্দ্রাবাদ সহরে এসে পড়্‌লাম। পুরাতন সহর। রোদে কাঠ ফাট্‌ছে, চারিদিকে একটা রুক্ষভাব, বেলা আন্দাজ দেড়টা। আমরা খাওয়া-দাওয়া সার্‌বার জন্যে পথের পাশে একটা সরাইয়ে প্রবেশ কর্‌লাম।

প্রায় ২৷৷০ টার সময় আমরা কিছু দূরে রাস্তার ধারে রোদের জন্যে একটা বাগানের মধ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হ'লাম। ঘন্টা দুই বিশ্রামের পর আবার সাইকেলে উঠ্‌লাম। সন্ধার আগে একটা জায়গায় আকের ক্ষেতের ধারে ধারে অনেক ময়ূর দেখা গেল; তাদের ঝরে-পড়া পালকে রাস্তা ছেয়ে গেছে। আমরা এখান থেকে অনেক পালক সংগ্রহ কর্‌লাম। বিজয়ী সৈনিকের মত টুপিতে পালক গুঁজে দিল্লী প্রবেশের জন্য আমরা অস্থির হ'য়ে উঠলাম।

ঠিক সন্ধ্যার সময় সাইকেলে আমাদের গাজিয়াবাদে নামিয়ে দিলে। এলাহাবাদ থেকে গাজিয়াবাদ পর্য্যন্ত ই-আই-আর এর ছোট লাইন গাজিয়াবাদ থেকে আবার ডবল লাইন সুরু হ'য়েছে। মিরাটের শাখা-লাইনও এইখান থেকে বেরিয়েছে। একটা রাস্তাও লাইনের সঙ্গে-সঙ্গে ২৮ মাইল চ'লে মিরাটে উপস্থিত হয়েছে।

দিল্লী একটা খুব ছোট বিভাগ। সহরের চারপাশে কয়েক মাইল ক'রে ধ'রে এই বিভাগকে যুক্তপ্রদেশ ও পাঞ্জাব থেকে আলাদা করা হ'য়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা যুক্তপ্রদেশের সীমানা ছাড়িয়ে গাজিয়াবাদ থেকে ৪ মাইল পর দিল্লীর সীমানার মধ্যে এসে পড়্‌লাম। রাস্তা বেজায় খারাপ, বেশী গরুর গাড়ী চলাচলের জন্য বড় বড় সহরের প্রবেশ-পথগুলি যেমন হয়। সহরতলীর আলোর প্রতীক্ষা কর্‌তে কর্‌তে চলেছি, কিন্তু কোথায় আলো? অন্ধকারে অন্ধকারে আমরা যমুনা পুলের সাম্‌নে এসে পড়্‌লাম। পুলে কোনোরকম আলোর বন্দোবস্ত নেই, অথচ ওপারেই রাজধানী দিল্লী! বাস্তবের কাছে কল্পনা বেজায় খাট হ'য়ে গেল। সাইকেলের আলোগুলো উজ্জ্বল ক'রে দিয়ে সব দেখ্‌তে দেখ্‌তে আমরা এপারে এসে পড়্‌লাম।

প্রথমেই চোখে পড়ল রাস্তার মিটমিটে কেরাসিনের আলো। সামান্য কিছুদূর যাবার পর একটা রেলের ব্রিজের তলা দিয়ে ওদিকে যেতেই বৈদ্যুতিক আলোক উদ্ভাসিত রাজধানীর রাস্তা এসে পড়্‌লাম। আমাদের আজ দিল্লী পৌঁছবার কথা, এখানকার হিন্দু কলেজের প্রোফেসর শ্রীযুত আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের জানা ছিল। আমরা ঘোরাঘুরি না ক'রে কাশ্মীর-গেটে তাঁর বাড়ীতে উপস্থিত হ'লাম। তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা কর্‌লেন। আজ আমাদের ঘোরাঘুরি ৯৩ মাইল হ'য়েছে। মিটারে সবশুদ্ধ উঠেছে ৯২২ মাইল।

- ক্রমশঃ -

(প্রবাসী ১৩৩৩ সাল, ক্রমান্বয়ে আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ সংখ্যা)

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ

[ মূলের বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher