বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।

 

['সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত' –এই ভ্রমণকাহিনিটি ধারাবাহিকভাবে বেরোত প্রবাসী পত্রিকায় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে। লেখক শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায় বিশেষ পরিচিত কোনও নাম নয়। আজকের ইন্টারনেট-গুগুল ম্যাপ-ইন্সটাগ্রাম-ফেসবুক লাইভ যুগের তরুণ-তরুণীদের জন্য এখানে রইল প্রায় একশো বছর আগের কয়েকজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি তরুণের ভ্রমণকথা।]

 

সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত

শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়


পূর্বপ্রকাশিতের পর -

দিল্লী

১০ই অক্টোবর, শনিবার - আমাদের মতন ভ্রমণকারীদের পক্ষে নিজের শরীর ও সাইকেলের প্রতি মনোযোগী হওয়া বিশেষ দরকার। বেনারসের পর বিশ্রাম ও সাইকেলের যথাবিধি সংস্কার দিল্লীতে করা হ'বে আগে থেকে স্থির ছিল। আর দিল্লীর নাম ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িত ও এখানে দেখবার জিনিস এত বেশী যে, সে-সমস্ত এড়িয়ে চ'লে যাওয়া কারও পক্ষেই সম্ভবপর নয়। এদিকে কাশ্মীরে প্রচণ্ড শীতের দিনও ঘনিয়ে আসছে। দেরী করলে হয়ত বরফের জন্য পথ বন্ধ হ'য়ে যাবে - শ্রীনগর পৌঁছবার আশা ত্যাগ করতে হবে। সেজন্যে এখানে দু দিনের বেশী থাকা সমীচীন হবে ব'লে বোধ করলাম না। দুপুরের বিশ্রামের পর সাইকেলে সহর দেখতে বেরিয়ে পড়্লাম। আজ পিছনে কোন বোঝা না থাকায় অনেকদিন পর 'সাইকেল চড়ার 'আরামটুকু বেশ উপভোগ করা গেল।

প্রাচীনকালের কথা বাদ দিলে দিল্লীকে মোটামুটী দু'ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে, অর্থাৎ মুসলমান-যুগের ও আধুনিক ইংরেজ আমলের। পুরানকালের দিল্লীই সাতটি। এক-একজন সম্রাট্ নিজের নিজের খেয়াল ও সুবিধা মত এক-এক জায়গায় তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের সকলের রাজধানীরই কিছু-না-কিছু চিহ্ন এখনও গৌরবময় অতীতের সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর আধুনিক দিল্লী দুটি-একটি স্থায়ী রাজধানী যা এখনও সম্পূর্ণ তৈরী হ'য়ে ওঠেনি ও অপরটি অস্থায়ী রাজধানী, এখন যেখানে রাজধানীর কাজ-কর্ম্ম হ'য়ে থাকে। বিজলী বাতী দেওয়া সুন্দর চওড়া রাজপথ ঘাসে-মোড়া বাগানের উপর শাদা রংয়ের সারি সারি সৌধশ্রেণী ও একছাঁচে ঢালা সরকারী বাড়ীগুলির দৃশ্য যেমন মনোরম এদের গঠন-প্রণালীও তেমনি সুরুচির পরিচায়ক।
দিল্লীর রাস্তায় টাঙ্গারই চলন বেশী, ট্রামও আছে। ট্যাক্সি যে নেই তা নয়, তবে কলকাতার মতন এত বেশী নয়। মোড়ে মোড়ে কোন্ সময় থেকে গাড়ীতে আলো জ্বালতে হবে তার নোটীশ দেওয়া রয়েছে। এবিষয়ে কলকাতা অপেক্ষা দিল্লী-পুলিসের ঢের বেশী কড়া নজর। ষ্টেশনের পাশেই কুইন্স্ পার্ক্, কতকটা কলকাতার ইডেন গার্ডেনের মতন; তবে এর ভেতর দিয়ে লোকজন, গাড়ী-ঘোড়া যাবার পথ রয়েছে, যা কলকাতার কোন পার্কেই নেই।

১১ই অক্টোবর রবিবার - সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া ক'রে কুতবের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়্লাম, এখান থেকে ১১ মাইল দূর। সময় বড় অল্প। এরই মধ্যে যা-কিছু ঘুরে দেখে নিতে হবে, সেজন্যে টাঙ্গা ভাড়া ক'রে ঘোরার চেয়ে সাইকেলে যাওয়াই সুবিধাজনক হবে ব'লে বোধ হ'ল।
সহরতলীর গা ঘেঁসে নূতন রাজধানী হচ্ছে, তারই মধ্য দিয়ে কুতব যাবার পথ। পাশে পাশে সরকারী দপ্তরখানার গোড়াপত্তন সুরু হয়েছে। বড় বড় কপি কল (Crane), পাথরের টুকরা, প্রয়োজনীয় মাল-মসলা ও লোকজন মিলে সেখানে একটা বিরাট ব্যাপার ক'রে তুলেছে।
এসব ছাড়িয়ে একেবারে সহরের শেষে এসে পড়্লাম। মাইলের পর মাইল রাস্তা চ'লে গেছে, সুন্দর সমান আর দু'ধারে নূতন ধরণের শ্রেণীবদ্ধ আলোর স্তম্ভ। এরই পাশে রোদে-পোড়া তৃণশূন্য শুষ্ক মাঠ, মাঝে-মাঝে প্রাচীন কীর্ত্তির ধ্বংস স্তূপ, কোথাও বা লতাগুল্মবিহীন পাহাড়ের এক-আধটা ছোট-খাট সংস্করণ।

মোগল-সেনাপতি সফদরজঙ্গের সমাধির সুমুখ দিয়ে কুতব মিনারের পথ। এইপথে প্রথমেই চোখে পড়ে মহারাজ জয়সিংহের তৈরী অসম্পূর্ণ 'যন্তর মন্তর' বা মান-মন্দির। সেনাপতি সফদরজঙ্গ বহুদিন অযোধ্যা প্রদেশের শাসনকর্ত্তা ছিলেন। সমাধিটি সম্রাট্ হুমায়ুনের সমাধির অনুকরণে লাল পাথরে তৈরী। চার পাশে ছোট-ছোট অসংখ্য ঘর দিয়ে সমাধি-মন্দিরের সীমানা তৈরী হয়েছে।

আরও ৬ মাইল পরে কুতব মিনার। মিনারের গঠন সুরু হয় কুতবউদ্দিনের হাতে, আর সম্রাট্ আলতামাস একে সম্পূর্ণ ক'রে তোলেন। মিনারটি এক পাশে একটু হেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেউ কেউ বলেন,পৃথ্বীরাজ না কি এর খানিকটা তৈরী করিয়েছিলেন, এর ওপর থেকে সংযুক্তা যমুনা দেখবেন ব'লে। ২৩৮ ফিট উঁচু মিনারে আমাদের গুনতি হিসাবে দেখা গেল ৩৭৯ ধাপ আছে। এর চেয়ে যে মিনারটি আরও-কিছু উঁচু ছিল তা বোঝা যায় এর উপরের কয়েকটি ধাপের ভগ্নাবস্থা দেখে। মাথাটি একেবারে খোলা, হয়ত উপরে অন্যান্য মিনারের মতন এক সময় আবরণ ছিল। তবে চারপাশে এখন সরকার বাহাদুর রেলিং ক'রে দিয়েছেন। নীচে থেকে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে উপরে উঠতে হাঁফিয়ে যেতে হবে ব'লে যেন পর পর চারিটি বারান্দা করা হয়েছিল। এই বারান্দাগুলির জন্যেই কোনরকমে উপরে ওঠা যায়, তা না হ'লে দিন-দুপুরেও আলো না নিয়ে ভিতরে ঢোকে কার সাধ্য! বাইরের দিক্ দিয়ে নীচে থেকে উপর অবধি মিনারটিকে ঘিরে ফার্সী বয়েৎ লেখা। এখানে সমাধি, মসজিদ সব জায়গাতেই এমনি ফার্সী বয়েতের ছড়াছড়ি।

এরই একপাশে কুতব মস্জিদ ও প্রাঙ্গণে লৌহস্তম্ভ। আশে পাশে অসংখ্য ছোট-খাট সমাধি। কুতব মস্জিদ হিন্দু মন্দির ধ্বংস ক'রে যে তৈরী করা হয়েছে তা দেয়ালে হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমূর্ত্তি দেখে বেশ বোঝা যায়। এই মস্জিদের দেয়ালে প্রত্নতত্ত্ব-বিভাগের হিসাব-অনুযায়ী দেখা গেল ২৭টি মন্দির ধ্বংস ক'রে এই মসজিদ তৈরী করা হয়েছিল।
মিনারের প্রাঙ্গণের লৌহস্তম্ভটির গায়ে পালি ভাষায় লেখা আছে চন্দ্রগুপ্ত বঙ্গ-বিজয়ের স্মরণার্থে বিষ্ণুদেবের উদ্দেশ্যে এটিকে তৈরী করিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন, এর নাম অশোক স্তম্ভ। স্তম্ভটি যে-লোহা দিয়ে তৈরী তার এমনি বিশেষত্ব যে হাজার দেড় হাজার বছরের জল ঝড় মাথা পেতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে - গায়ে তার একটু মরিচা ধরেনি। সহজেই বোঝা যায় সেকালের বৈজ্ঞানিকদের লৌহশিল্পে কত বেশী জ্ঞান ছিল। কাছেই পৃথ্বীরাজের মন্দির। পৃথ্বীরাজের রাজধানী এইখানেই ছিল, আসে পাশে তারও ধ্বংসাবশেষ প্রচুর।

সহর থেকে দূর বলে এখানে চা জলখাবারের বন্দোবস্ত আছে। তবে তার সেলামী সহরের চেয়ে অনেক বেশী। হুমায়ুনের সমাধির পথ ধ'রে ফির্লাম। সফদরজঙ্গের সমাধিরই যেন উন্নত সংস্করণ। এর ফটকে দরজায় ফাটল ধরেছে। সাদা, কাল ও লাল এই তিন রংয়ের পাথর দিয়ে সমাধিটি তৈরী। হুমায়ুন-মহিষী হামিদা বেগম এটি তৈরী করান। এখানে সম্রাট্ ও মহিষী দুজনেরই সমাধি রয়েছে দেখা গেল।
দিল্লী গেট পার হ'য়ে সহরে ফিরে এলাম। বাঁ পাশে চাইতেই চোখে পড়্ল জুম্মামসজিদ। ছোট-ছোট অসংখ্য ধাপ পার হ'য়ে উপরে উঠ্তে হয়। ডানদিকে শাহজাহানের তৈরী লাল পাথরে গড়া দূর্গের প্রাচীর সুরু হয়েছে। ফটকের সামনে আসতেই কতগুলি গাইড এসে পাকড়াও করলে। ফটকের পরেই পথের দুধারে ছোট ছোট অনেকগুলি ঘর। সেগুলি আগে বোধহয় সৈন্য সামন্তদের, তাঁবেদারদের থাকবার জন্য নির্দ্দিষ্ট ছিল। এখন সোডা, লেমনেড, পান, সিগারেটের দোকানে পর্য্যবসিত হয়েছে। একটা খিলান পার হ'য়েই প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণ। এই প্রাঙ্গণ পার হ'য়ে গাইড্ আমাদের দেওয়ান-ই-আমে নিয়ে হাজির করলে।

দেওয়ান-ই-আম থেকে বার হ'য়েই ডান দিকে শ্বেতপাথরে তৈরী দেওয়ান-ই-খাস। কয়েকটি মোটা মোটা থামের ওপর এর ছাদ। এইখানেই তখত-ই-তাউস্ বা ময়ূর-সিংহাসনে ব'সে শাহজাহান মোগল সাম্রাজ্যকে উন্নতির চরম সীমায় নিয়ে গিয়েছিলেন, আবার এই ময়ূর-সিংহাসন থেকেই ঔরংজীব মোগল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের পথে নিয়ে এলেন। সম্রাটের সামান্য ইঙ্গিতে কত আশা, ভরসা, হাসি, কান্না, হা-হুতাশের অভিনয়ই না এখানে হ'য়ে গেছে। আবার নিয়তির কঠোর পরিহাসে এইখানেই সেই সম্রাট্-বংশধরেরা বিদেশী বিজেতার কাছ থেকে অপমানের বোঝা মাথায় তুলে নিয়েছিলেন।
এই দেওয়ান-ই-খাসের সামনের খিলানের ওপরের ফার্সী লেখার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে গাইড্ আমাদের পড়তে বললে। আমাদের নিজেদের এ বিষয়ে অক্ষমতা জানালে সে নিজেই প'ড়ে গেল -
অগর্ ফিরদৌস্ বর্ রুহে জমীনস্ত
হমীনস্ত, ওয়া হমীনস্ত, ওয়া হমীনস্ত।
অর্থাৎ পৃথিবীতে স্বর্গ যদি থাকে কোনখানে
এইখানে, এইখানে, তাহা এইখানে।
দেওয়ান-ই-খাসের এ দুলাইন লেখা সম্বন্ধে কে না শুনেছে? মোগল আমলের গৌরবময় অতীতের কথা ভেবে মন সম্ভ্রমে ভ'রে গেল।
দেওয়ান-ই-খাসের উত্তরে সোণার কলাই করা গম্বুজওয়ালা শ্বেত পাথরের মসজিদটির দিকে আপনি চোখ পড়ে। এটির নাম মতি মসজিদ। বাদ্শা ঔরংজীব এই মসজিদটি তৈরী করান কেবল তাঁর ও সম্রাজ্ঞীর উপাসনা করবার জন্যে। আর একটু দক্ষিণে রঙমহাল বা রাজপরিবারের বাস-গৃহ।
এই বিশ্রামের দু দিনেও ৩৩ মাইল ঘোরাঘুরি হয়ে গেল - মিটারে মোট ৯৫৫ মাইল।

১২ই অক্টোবর সোমবার - কলকাতা থেকে মনিঅর্ডার আসার কথা আছে, কিন্তু কোন খবর নেই। সেইজন্য প্রাতরাশ সেরে, রওনা হ'বার আগে পোষ্ট অফিসে একবার খোঁজ নিতে গেলাম। আমাদের চিঠি-পত্র, টাকা-কড়ি সবই পোষ্টমাষ্টারের হেফাজতে আসার কথা। যাঁরা এরকম ভ্রমণে বেরোন এ ভিন্ন তাঁদের আর কোনো ভাল উপায় নেই। চিঠি-পত্র আমরা বরাবর পোষ্ট অফিস থেকে নিয়ে আস্ছি, কিন্তু এইবার টাকার বেলায় গোলমাল বাধল। টাকা হাজির, কিন্তু সনাক্ত কর্বার জন্য কোন স্থানীয় লোক সঙ্গে না থাকলে পোষ্ট অফিসের কর্ত্তাদের টাকা দেবার নিয়ম নেই। অগত্যা কাশ্মীর গেটে আমাদের প্রোফেসর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ীতে শীঘ্র টাকা পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ ক'রে আমরা ফিরে এলাম।
রওনা হ'তে ন'টা বাজ্ল। পানিপথের উদ্দেশে রওনা হ'লাম। পর পর দু'টি ফটক পার হ'য়ে সহরের বাইরে যেতে হয়। দিল্লী সহর হঠাৎ শেষ হ'য়ে গেল। এই বিশেষত্বটা সহজেই চোখে পড়ে, এত বড় সহরের সহরতলী ব'লে কোন জিনিস নেই।
প্রখর রোদ, জনশূন্য পথের ওপর কেবল আমরা চারজন। যতদূর দেখা যায় সবুজের লেশমাত্র নেই। ধূসর রংয়ের মাঠের মধ্য দিয়ে পথ চলেছে। গরমও যেন আজ বেড়ে উঠেছে। মাঝে-মাঝে একটা আগুনের মতন গরম হাওয়ার হলকা মুখের ওপর দিয়ে ব'য়ে যাচ্ছে। ক্বচিৎ মাঠের মাঝে ফণীমনসার ঝোপ বা এখানে সেখানে দুএকটা নিম গাছ যেন প্রকৃতির এই নির্ম্মমতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘূর্ণি-হাওয়ায় বালি উড়ে আমাদের সমস্ত শরীর ভরিয়ে দিয়েছে।
ঠিক ১৫ মাইল পর দিল্লী প্রদেশের সীমানা শেষ হ'ল। তেষ্টায় অস্থির, কিন্তু এখানে জল পাবার কোন উপায় নেই। আরও কিছুদূর এগিয়ে রাস্তার বাঁ ধারে রাই-ডাকবাংলো দেখতে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচ্লাম। তেষ্টার চোটে সেখানে এমন জল খেয়েছিলাম যে, শেষে সাইকেল চালানই কষ্টকর হ'য়ে দাঁড়াল।

বেলা ১টা। কুড়ি মাইল এসেছি, কিন্তু রাস্তার পাশে গ্রাম বা বসতির চিহ্নমাত্র নেই। এতদিন পথে খাবার পাওয়া যেত ব'লে আমরা বেরোবার আগে আর খাবার কিনে বোঝা বাড়াতাম না। আজ হঠাৎ গ্রামবিহীন পথে একটু মুস্কিলে পড়্লাম। কিছুক্ষণ পরে রাস্তার পাশে এক পথনির্দ্দেশক ফলকের ওপর দৃষ্টি পড়্ল। সকলেই ব্যস্ত হ'য়ে এগিয়ে চললাম দেখ্বার জন্যে। রাস্তা থেকে মাইল দেড় দূরে মারথাল গ্রাম। সেখানে কিছু খাবার মিলবে আশা হ'ল, কিন্তু পথের নমুনা দেখে আর যেতে ইচ্ছে হয় না। কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে নেমে পড়্লাম বালির রাস্তায়। মনে মনে আশা, খানিক পরেই রাস্তার অবস্থা ভাল হবে। কিন্তু তা হ'ল না, বালির ওপর দিয়ে সাইকেল চল্বে না। অগত্যা হাঁটতে-হাঁটতে যখন মারথাল গ্রামে পৌঁছলাম তখন বেলা আড়াইটা। গ্রামের ভেতর রাস্তার বালাই নেই। এক বাড়ীর উঠান দিয়ে, অপর বাড়ীর ভেতর দিয়ে দোকানের সন্ধানে চললাম। গ্রামের কুকুরের দল আমাদের আবির্ভাবে তারস্বরে চীৎকার করতে সুরু ক'রে দিল।
মিছামিছি এতকষ্ট স্বীকার ক'রে আসাই সার - লাড্ডু বা ঐ জাতীয় মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। দোকানের সামনে কুকুরের দল আর ভেতরে মাছির ভন্ভনানি। গ্রামের এক প্রান্তে একটি ছোটখাট ইংরেজী স্কুল দেখতে পেলাম। গুরুমশায় ও পড়ুয়ারা সকলেই কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। গ্রামের বাড়ীগুলির ছাদ পর্য্যন্ত মাটির। এখানকার মাটি বাংলা দেশের মতন নরম নয় আর বৃষ্টিও ওখানে আমাদের দেশের মতন অত বেশী হয় না ব'লে মাটির ছাদেও এখানে বেশ চ'লে যায় - বর্ষায় অসুবিধা হয় না। দেয়াল ও ছাদের রং একই রকমের ব'লে দূর থেকে বোঝা যায় না যে, ঘরের ওপরে ছাদ আছে। পাঞ্জাবের সীমানায় এসেছি বটে, কিন্তু এখানকার লোকজনের ধরণ-ধারণ ও পোষাক-পরিচ্ছদের কিছু পরিবর্ত্তন নজরে পড়ল না। এখানকার লোকেদের চেহারাও পাঞ্জাবীদের মত লম্বা-চওড়া নয় বরং যুক্তপ্রদেশের লোকেদেরই অনুরূপ।
আবার সেই দেড় মাইল বালি ঠেলে ট্রাঙ্করোডে ফিরে আসা গেল। পানিপথ এখান থেকে ৩৩ মাইল দূর। আজ সেইখানে রাত্রিবাস করা হ'বে এই রকম ঠিক আছে। সেইজন্যে আর দেরী না ক'রে রওনা হ'য়ে পড়্লাম।

সন্ধ্যা হয় হয়। আলো জ্বালার জন্য দিয়েশালাই বার ক'রে দেখি বাক্স একবারে খালি। মুস্কিল? পানিপথ এখনও ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা। অন্ধকারে এতক্ষণ অজানা পথে চলা বড় যুক্তিযুক্ত হবে ব'লে মনে হ'ল না। সন্তর্পণে চলেছি। মিশকালো অন্ধকারে রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ রাস্তার একপাশ থেকে ঘন্টার টুং-টুং শব্দ ও মাঝে মাঝে অস্পষ্ট জটলার আওয়াজ কানে এল। সেই শব্দ লক্ষ্য ক'রে এগিয়ে চললাম। বেশীদূর যেতে হ'ল না, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা একদল উটওয়ালার ছাউনির ভেতর এসে পড়্লাম। প্রকাণ্ড মাঠের ওপর সারি সারি উট বাঁধা। আর তাদের পাশে বা সামনে ছোট-ছোট দল বেঁধে আগুনের সামনে উটওয়ালারা জটলা করছে। কেউ কেউ মাটির ঢেলা দিয়ে উনোন তৈরী ক'রে খাওয়া-দাওয়ার জোগাড় সুরু করছে। এরা বিদেশ থেকে এইরকম দল বেঁধে উট আমদানী ক'রে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মেলায় বিক্রী করে। রেল-কোম্পানীর কোনো ধার এরা ধারে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে ও সন্ধ্যার সময় সুবিধা মতো জল পাওয়া যায়, এমনি একটা জায়গায় আড্ডা ফেলে রাত কাটিয়ে দেয়। মুক্ত আকাশের তলায় যে যার কম্বল বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে - সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর তাতে তাদের কোনোরকম কষ্ট বা কিছুমাত্র অসুবিধা মনে হয় না।
এদের ছাউনিতে এসে আমাদের আর ফিরে যেতে ইচ্ছে হ'ল না। এদের সহজ সরল ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করলে। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত সারাজীবনই এই কাজ করছে। কতবার যে তারা এই রাস্তার একদিক্ থেকে আর একদিক্ পর্য্যন্ত এইভাবে যাওয়া-আসা করছে তার ঠিক নেই। পথিকমাত্রেরই ওপর এদের যেন একটা সহানুভূতি আছে। বিহারে কোথায় যেন এইরকম এক দলের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। সাহস ক'রে এরা আমাদের থাকতে অনুরোধ করতে পারছিল না, কিন্তু সেই ধরণের আলোচনা আমাদের কানে এল। এদের অবস্থা সেরকম নয় আর আমাদের নিজেদের কিছু জোগাড় ছিল না ব'লে এখান থেকে দিয়েশালাই জোগাড় ক'রে পানিপথের দিকে এগিয়ে পড়্লাম।

চারপাশে প্রকাণ্ড প্রাচীরের মধ্যে পানিপথ সহর। সহরে যাওয়া-আসা করার জন্যে কয়েকটি ফটক আছে। রাত ন'টার পর একবার ফটক বন্ধ হ'লে আর ভিতরে যাবার কোন উপায় থাকে না। সরু সরু পাথর বাঁধান গলিতে বড় বড় পুরাণ ধরণের তিনতলা বাড়ীতে লোক গিসগিস্ করছে। ধর্ম্মশালা বা সরাইয়ের প্রাচুর্য্যও এখানে খুব। কিন্তু এখানে যেন হাঁফিয়ে উঠ্লাম। সেইজন্যে ফটক পার হ'য়ে সহরের বাইরে এসে ষ্টেশনে আশ্রয় নেবার জন্যে চললাম।
ষ্টেশনে আড্ডা ফেলার জোগাড় দেখছি এমন সময় বাঙালী-পোষাক-পরা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হ'য়ে গেল। এ পাগড়ীর দেশে খালি মাথা সহজেই নজরে পড়ে। ভদ্রলোকটির নাম শ্রীযুত মনোমোহন চট্টোপাধ্যায়, এখানকার রেলের ডাক্তার। ষ্টেশনের পাশেই এঁর কোয়ার্টার। বলা বাহুল্য যে, ষ্টেশনে ইনি আমাদের এভাবে রাত কাটাতে দিতে রাজী হলেন না। অগত্যা তাঁর দাওয়াইখানার একটা ঘরে রাতের মতন আশ্রয় নিলাম। খাওয়া-দাওয়া আগেই হ'য়ে গেছে, বিছানা ক'রে শুয়ে পড়্লাম - চোখের সামনে ভেসে উঠ্ল উট-ওয়ালাদের ছাউনির কথা - আগুনের অস্পষ্ট আলোর সামনে ছোট-ছোট দলে বিভক্ত লোকেদের জটলা, সারিবাঁধা উটের গলার ঘন্টার টুং-টাং শব্দ আর সবল, কর্ম্মঠ, রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ-দেহধারী উট-ওয়ালাদের সহজ সরল ব্যবহার।
আজ মোট ৫৩ মাইল আসা হ'ল। মিটারে ১০০৮ মাইল উঠেছে।

- ক্রমশঃ -

(প্রবাসী, পৌষ ১৩৩৩ সংখ্যা)

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ

[ মূলের বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher