ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - দ্বিতীয় পর্ব

কেদার ভ্রমণের বুকলেট

অভিষেক ব্যানার্জি

~ কেদারের আরও ছবি ~

পূর্বপ্রকাশিতের পর

#যা_দেখি_তাই_লিখি
##পর্ব_নয়_নয়_করে_৯
#মনখারাপ_আর_মন_ভালোর_মাঝামাঝি
#গৌরীকুণ্ডের_রাত_সকাল

তো ব্যাপারটা দাঁড়াল যে রাতকানা পাবলিকেরা হাফ টিমের প্রায় আধাঘন্টা পরে হ্যাপিডেন্ট চিবিয়ে দাঁত বের করে তার আলোয় রাস্তা দেখে জি.এম.ভি.এন. পৌঁছল। আগের টিমে অধিনায়ক ছিলেন। যথারীতি খাসা রুম পেলাম। ক্লোকরুম থেকে লাগেজের চারানা পার্টগুলোও এসে গেছে রুমে। শুধু কারেন্ট ছিল না। সুদীপ মোমবাতি জ্বালাল। দেশলাই কোথায় পেল জিজ্ঞেস করিনি। যাইহোক। মোমবাতির টিমটিমে আলোয় বেশ একটা তমরাজ কিলবিষ মার্কা ফিলিং হচ্ছিল। দেওয়ালে লম্বা ছায়া দুলে বেড়াচ্ছে প্রেতের মত। ক্লান্তির সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে অন্ধকার খোলামেলা হচ্ছে রাতপোশাক পরে। তাল কেটে দিল হঠাৎ আলো জ্বলে। আয়নার সঙ্গে সরল কোণে বসেছিলাম মাথা ঝুঁকিয়ে। একটা আধভাঙা ধুলোমাখা প্রতিবিম্ব স্বাগত জানালো। গিজারের সুইচ অন করে টাওয়েল নিয়ে এগিয়ে গেলাম ক্লান্ত ব্যথাতুর পায়ে বাথরুমের দিকে। ঘরের দখল নিয়েছে তখন নিবিয়ে দেওয়া পোড়া মোমের গন্ধ।
গায়ে ব্যথার জায়গায় গরম জল ঢেলে আর ভালো করে স্নান সেরে বেশ ঝরঝরে লাগল। সবাই ওঘরে আড্ডা দিচ্ছে। সেই সুযোগে কয়েকটা ফোন সেরে নিলাম। আমাদের মদমহেশ্বর-এর গাইড দাদাকে ফোন করে জানাতে হল অনিবার্য কারণবশত আমরা যেতে পারছি না। দুদিনে প্রায় চল্লিশ কিমি হেঁটে সত্যি কারো শক্তি ছিল না। আর কেদারে খরচও এস্টিমেটের চেয়ে একটু বেশি হয়েছিল। বদলে তুঙ্গনাথ আর কল্পেশ্বর করা হবে ঠিক হয়েছে। মাঝে একদিন বানিয়াকুণ্ডে 'leisure day'। বানিয়াকুণ্ড চোপতার পাঁচ কিমি আগের একটা বুগিয়াল। সেখানে ফিক্সড টেন্টের ক্যাম্প আছে। সামনে বসে অসাধারণ পিক দেখা যায়।
পা থেকে লেপের উষ্ণতা সরিয়ে পাশের ঘরের দিকে এগোলাম ক্যাডবেরি চিবোতে চিবোতে। ওঘরে সভা বসেছে। পাঁচখানা খাতা-পিতা লাশ বিছানায়। আমার আর জায়গা হয় না। ডালমুটের প্যাকেট এহাত ওহাত ঘুরছে। তার মধ্যে বুলডোজার (দেবজিৎ) একাই অর্ধেক খনিজ পদার্থ এক্সট্রাক্ট করে প্রসেসিং ইউনিটে চালান করে দিচ্ছে। আজ সবাই হালকা মেজাজে। স্যাক আর ন্যাপস্যাক-এ জিনিস অল্টার করা চলছে। সবার ক্যামেরাও ঘুরছে এ হাত ওহাত। খিদেও পেয়েছে কিন্তু যেতে কারো ইচ্ছে নেই। হাঁটু খুলে আলাদা করে রাখা আছে। হাতে করে পা তুলে স্ক্রু জায়গায় লাগিয়ে টাইট দিলে ঠিক হয় এমন অবস্থা। তবু পেটের দায় বড় দায়। সাড়ে আটটায় খেতে নামা হল। গরম রুটি,কালি দাল,গোবির তরকারি আর উপাদেয় ভিন্ডি ফ্রাই (যাঁরা ভিন্ডি খান ভীষণভাবে রিকমেন্ড করছি। এই খাবারটা আমাদের সারা ট্যুরে বাঁচিয়েছে অখাদ্য লোকি কি সবজির হাত থেকে) দিয়ে জমিয়ে খাওয়া হল। ইন্দ্র দোকানদারকে শশা রাখতে দেখেছিল। কিন্তু ব্যাটা স্যালাডে শশা দেয়নি। 'ভাইয়া ক্ষীরা হ্যায়,দিজিয়ে না,দিজিয়ে না' করে দোকানদারকে ব্যস্ত করে শশা আদায় করল। মৌরি-চিনির ডেডলি কম্বো চিবোতে চিবোতে 'খোঁড়া ল্যাং ল্যাং ল্যাং' করতে করতে ওপরে উঠলাম। তাপ্পর আর কি। হরিদ্বারে হোটেল থেকে পাওয়া Oyo Room-এর ফ্রি বায়োটিক-এর ক্রিম মেখে,ঠোঁটে আর নাকের বল্টুতে পুরু করে বাঙালির প্রিয় 'সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন' দিয়ে আলেকজান্ডাররূপী শীতকে 'আয় তোকে দেখে নিচ্ছি' টাইপ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেলুম।
আমার ডিপ ঘুম হয়না। পাহাড়ে তো নয়ই। ঘুমের মধ্যে নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না স্বপ্নে। একমাথা কোঁকড়ানো চুলের একটা ছেলে,ইন হিজ টোয়েন্টিজ,একটা বাঁশের বাঁশি হাতে সবুজ মখমলের মত বুগিয়ালে ছুটে বেড়াচ্ছে। খালি পায়ে। ছোট ছোট সাদা ফুল চারিদিকে। আর ভীষণ আলো। খুব রোদ। আর কিছু মনে নেই। এটুকুই। শুধু মনে আছে তার আধময়লা জ্যাকেটের পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছিল একটা ছেঁড়া মোজা আর আঙুলকাটা দস্তানার তর্জনী আর মধ্যমা।

ভোর ছটায় অ্যালার্ম বাজল। রোজকার মত আমিই উঠলাম প্রথম। আজ শুধু গাড়িতেই যাওয়া তাই টেনশন কম। দেবজিৎ আর ইন্দ্র ঘুমোচ্ছে। মুখ ধুয়ে জ্যাকেটটা চাপিয়ে বাইরে বেরোলাম। সেরকম ঠান্ডা আর লাগছে না। গৌরীকুণ্ড জেগে গেছে আগেই। যাত্রীদের হাঁটা শুরু। রবিঠাকুর মনে পড়ল,"তোমার হল শুরু,আমার হল সারা।" ভদ্রলোক জীবনের সব সিচুয়েশনের জন্য কথা রেখে গেছেন বইয়ের তাকে। টুক করে তুলে নেওয়া শুধু। নীচে উষ্ণকুণ্ডে স্নান করছেন কালকের দেখা বাঙালি ভদ্রলোক,ত াঁর স্ত্রী এবং পঁয়ষট্টি বছরের মা। শ্রদ্ধা হয়। মনে পড়ল ২০১১-এর কথা। সব কথা মনে পড়া ভালো না সব সময়। তখনকার সঙ্গে এখনকার গৌরীকুণ্ড মিলবে না। মন্দাকিনীর পাশে পাহাড়ে আঁশবঁটিতে আঁশ তোলা পাকা রুইমাছের মত ক্ষত। সবুজে ধূসরের ধর্ষণ। দাঁত বের করে আছে গভীরতা, আগে হাসত, এখন হিংস্র শ্বাপদ লাগে। লোকজনও কেমন মরিয়া পসরা বিক্রিতে,আবার উদাসীনও। কেমন প্রাণহীন অতিপ্রাণে ভর্তি চারিদিক। ভিখিরির কুড়ানো সারাদিনের খুচরো জিনিস ফুটো বস্তা বেয়ে একটু একটু করে গলে পড়ছে, তাতে তার খেয়াল নেই। কুণ্ড থেকে একটা পাতলা সরের মত ধোঁয়া কোন সাতমহলা বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরীর চায়ের কাপের সঙ্গে গল্প করবে ভেবে মাঝপথেই হাল ছেড়ে দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়। পরে বুঝলাম ওটা কুণ্ডের ধোঁয়া না। ভেসে যাওয়া মানুষগুলোর চিতার ধোঁয়া, এই মন্দাকিনীর পাড়েই তো...। থাক সেকথা। ঘরে ফিরে এলাম। এক কাপ রোদ হলে মন্দ হত না, চোখ বুজে ঠোঁট ঠেকিয়ে খেতাম পেয়ালা থেকে পিরিচে ঢেলে, হালকা ফুঁ দিয়ে। সে ইচ্ছেও পূরণ হয়েছে। বলছি পরে।
"Should it be your wish
To fulfill mine,
Come closer you'd know for sure
How far I'm gone,how long I'm gone
Your touch is,was and always
Will be the magic wand".

#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_১০_বাহানে_কর_কে_লে_গয়ে_দিল
#গুপ্তকাশির_গুপ্তশিব_উখিমঠের_ঊষা
#আমি_আছি_আগামীতে
#চেরিব্লসম
গৌরীকুণ্ড থেকে জনপ্রতি কুড়ি টাকার বোলেরো ট্যাক্সিতে উঠলাম। আমরা ছ'জন আর একজন স্থানীয়। ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আরো লোক নেবার জন্য ওয়েট করবে বলছিল। আমরা টাকা দিয়ে দেব বলায় 'ফির তো কাম তমাম' বলে গাড়ির ছাদে উঠে স্যাক চাপাতে লাগল। বাঁধাবাধির কোন সিন নেই। আমরা আঁতকে উঠলাম, যদি পড়ে যায়। বলল কুছ নেহি হোগা, ইঁহা পে গাড়ি তিরিশ সে উপর নেহি যাতা। অগত্যা। গাড়ি ছুটল। সঙ্গে ঠোঙায় ভরা নতুন কোলগেট পেস্টের মত নড়তে চড়তে আমরাও। চারিদিকে একটা মন খারাপ আলো। সঙ্গে পাতকুড়ানি ছায়া পিছনে ছুটছে। এক মোড়ে একলা দুটো খচ্চর মালিকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তাদের মাথানীচুর ঘন্টা পাহাড়ের গলিতে 'চলো দেরি হচ্ছে' ডেকে বেড়াচ্ছে। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম একটা ঝরনা পেরিয়ে। হর-কি-দুনের তালুকা যাওয়ার রাস্তা মনে পড়ছিল আমার আর সৌনিপ-এর।

শোনপ্রয়াগের কাছে এলাম। শোন গঙ্গা আর মন্দাকিনী মিলছে। প্রয়াগের আগের চেহারা আর নেই। ২০১৩-র বন্যা একগাদা গিলে হজম করতে না পেয়ে হাজার বোল্ডার বমি করে রেখেছে। গলা টিপে মেরেছে স্রোতদের। তাদের বয়ে চলা আহত হয়ে পড়ে আছে অববাহিকায়। যাহোক,ধুলোর পর্দাকে গাড়ির ওয়াইপার কিচ কিচ শব্দ করে সাফ করে চলেছে। ৫ কিমি যেতে দশ-বারো মিনিট লাগল। শোনপ্রয়াগের বাস স্ট্যান্ডে রোদের গামছা মেলা। কড়াইচাঁচা পাতলা দুধের সরের মত ধুলোর পরত রুকস্যাকের গায়ে। লোকাল বোলেরো থেকে দূরপাল্লার ভান্ডারীজি'র বোলেরোতে ধুলো খাওয়া স্যাক চালান হল। গন্তব্য বানিয়াকুণ্ড।
ঠিক হল গুপ্তকাশী আর উখিমঠ-এ স্টপেজ দিয়ে মন্দির দর্শন করে যাওয়া হবে। গাড়ি চলেছে গড়গড়িয়ে। ভান্ডারীজির মুড ভালো না। ওকে যেই বলা হয়েছে প্ল্যান চেঞ্জ, বানিয়াকুণ্ড-এ থাকব আর কল্পেশ্বর যাব জোশি মঠের দিকে হেলাঙ হয়ে, ওর তার কেটে গেছে। এত এক্সট্রা তো আমি যেতে পারব না। 'এরকম প্ল্যান পাল্টালে হবে না, আমি কোথায় থাকব' এইসব নানা অভিযোগ। পার ডে নির্দিষ্ট টাকার হিসেবে ওনাকে বুক করেছিলাম। তাই আপত্তি থাকার কথা নয়। তবু আপত্তি। হয়ত তার বিভিন্ন ড্রাইভারসুলভ কর্মকান্ডের রুটিন ঠিক করা ছিল। সেটা হুট করে পাল্টালে রাগ হবেই। পিছন থেকে এক ঝলক দেখে মনে হল টিকিটা যেন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে রাগে। দেখার ভুল হতে পারে, সানগ্লাস পরে ছিলাম। যাই হোক। ক্যাপ্টেন জয় ও গাড়ির মালিক-এর কথোপকথনের পর ভান্ডারীজির কাছে কিছু নির্দেশ এল। অতঃপর, ভালো রাস্তায় গাড়ির গতি বাড়ল আর আমরাও শান্তি পেলাম।

গুপ্তকাশি পৌঁছে গেলাম তাড়াতাড়ি। এখানে মন্দিরে ওঠার গেটের উল্টোদিকেই একটা দোকানে,ভান্ডারীজি বললেন,ভালো আলুর পরোটা পাওয়া যায়। এর আগে উনি যে দোকান বলছিলেন ইন্দ্র তৎক্ষণাৎ-ই নাকচ করে এগোতে বলছিল। যাইহোক এর বেলায় তা না করার কারণ পেটে ছুঁচোর ডন। গরম আলুর পরোটা আর আলু মটর কা সবজি এল। সঙ্গে গুলাবজামুন। অসাধারণ তার টেস্ট। আরেকটু হলে তরকারির ঝোলের সঙ্গে আলুর টুকরো ভেবে নিজের আঙুলটাও খেয়ে ফেলেছিলাম। দাম বেশি না। তিরিশ টাকা পিস। দাম মিটিয়ে মৌরি চিবোতে চিবোতে গাড়িতে বসলাম। জয় গেল চৌখাম্বাকে ক্যামেরায় ধরতে। বাকিরা মন্দিরে পুজো দিতে। আমার আগেই যাওয়া। হাঁটুর কটকটানির জন্য আর অতগুলো সিঁড়ি ভাঙতে ইচ্ছে করল না। এতদিন পর সুযোগ পেয়ে প্রিয় খাদ্য ল্যাদ তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি ভান্ডারীজি ওষুধ খাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতে বলল তেজ বুখার। ডাক্তার দেখিয়েছে। ওষুধ খাচ্ছে। ভালো করে তাকাতে দেখলাম চোখটা লাল। মায়া হল। আমার ব্যাগভর্তি ওষুধ। বললাম কোন সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে বলতে। তিনিও 'জি আচ্ছা' বলে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে সামনের দরজাটা ঢাই করে বন্ধ করে উদাস চোখে আড়াই ইঞ্চি লম্বা উত্তরাখন্ডি বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিলেন। বিড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে উড়তে লাগল হতাশা।
একটু পরে ছেলেপুলে ওয়াপিস এলে আবার স্টিয়ারিং নড়ে উঠল। গন্তব্য উখিমঠ। বৈচিত্র্যহীন দু'ঘন্টার পর উখিমঠ পৌঁছলাম। এখানে শীতে কেদারনাথজির ডুলি থাকে। পুজোও হয়। মঠ কাম মন্দিরে ঢোকার মোড়টাতেই এক বাস চালক এক গামবাট বাস দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। রাস্তার দুদিকে সার দিয়ে গাড়ি পার্ক করা। আমাদের গাড়ি গেছে আটকে। বাসকে বেরোতে দিলে আমাদের গাড়িকে প্রায় দুশোমিটার ব্যাক করতে হবে। ভান্ডারী এমনিতেই রেগে ছিলেন। পুরো তার কেটে ফিউজ উড়ে গেল এবার। খিস্তির টাগ অফ ওয়ার চলল। মাঝখানে আমাদের নেমে যেতে বললেন। আমরা ওইটুকু এগিয়ে এসে পুজোর দোকানে সামগ্রী কিনছি দেখলাম ভান্ডারী অন্তত ৩০ কিমি গতিতে রিভার্স করে গাড়ি পিছিয়ে নিয়ে চলে গেলেন অবহেলায়। মনে মনে স্যালুট করে মন্দিরে ঢুকলাম।

সেই মহাভারতীয় পাথরের কাজের মন্দির। একটু ওড়িশি আর একটু দক্ষিণী স্টাইলও আছে। চমৎকার রঙকরা। ইন্দ্র পুজো দিল। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। পঞ্চকেদারও রয়েছেন এখানে। ডেমো দর্শন হয়ে গেল। সবাই ভিতরে। আমি চাতালের সিঁড়িতে বসে ডানদিকে তাকিয়ে দূরে কেদারশৃঙ্গ দেখতে পেলাম ব্যাকড্রপে। এখানেই রাজা মান্ধাতা তপস্যা করে ভগবান শিবের ওঙ্কারেশ্বর রূপের দর্শন পান। শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরূদ্ধের সঙ্গে বাণাসুরপুত্রী ঊষার বিবাহ হয় এই মন্দিরের মণ্ডপে। যা এখনও আছে। তখন এই স্থানের নাম হয় ঊষামঠ। কালের নিয়মে যা এখন উখিমঠ।
এরপর সোজা বানিয়াকুণ্ড। মাঝখানে কোথাও একটা খাওয়ার ব্রেক। গাড়ির দিকে আসতে আসতে অনেক চেরি গাছ দেখলাম। পাতা নেই, শুধু গোলাপি চেরিব্লসমে ভর্তি। আগামী শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঝরে যাওয়ার আগে খুব মন দিয়ে ফুটেছে একাঙ্ক নাটকের মত। দেখাচ্ছে ঠিক অন্যের সঙ্গে বিয়ে হতে যাওয়া নতুন গোলাপি লেহেঙ্গায় নিজের প্রেমিকার মত।

গাড়ি এগোল। একটু এগিয়ে জি এম ভি এন। ওখানে খাবার পাওয়া গেল না। বলল বাজার গিয়ে সবজি কিনে আনতে হবে দেড় ঘণ্টা লাগবে। আবার গাড়িতে ওঠা। শহরের বাইরের দিকে ভারত সেবাশ্রম। ইন্দ্র নেমে ম্যানেজ মারতে গেল এবং হাসিমুখে ফিরে এল। ইতিমধ্যে আমরা সেলফি তুলেছিলাম। ভিতর থেকে ইন্দ্র ডাকছে, পরে ফিসফিসিয়ে বলল ওকে নাকি মহারাজ বলেছে, "Is the green T-shirt guy with you? Call him right now"। যাকগে, বিনা কারণে বকুনি খেয়ে খিদে পেয়ে গেল। উপাদেয় ভাত, ডাল, তরকারি, চাটনি, পাঁপড় সাঁটিয়ে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে গাড়িতে উঠলাম। ইন্দ্রকে খিস্তি করছিলাম প্রথমে এখানে নামার জন্য। পরে এত ভালো খাওয়ানোর জন্য চুমু খেতে ইচ্ছে হল। একটা গ্রুপ সেলফি তুলে গাড়িতে উঠলাম। কাল তুঙ্গনাথ। পারব কি? মহাদেব জানেন।
"তীব্র হয়ে আসা বাঁকে
চির আরামের ঝুঁকে থাকা সাবধানবাণী,
শুরুটা বরাবরই কঠিন
শেষটা আমরা সবাই জানি।"

#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_একাদশে_বৃহস্পতি_নাকি_শনি?
#টেস্টোহেডো_বনবনাইটিস
#বানিয়াকুণ্ডের_বানিয়া
ভারত সেবাশ্রমে চর্ব্যচোষ্য আর বকুনি গিলে পেট আইঢাই। কেউ সামনের সিটে বসতে চাইছে না। ঘুমোলে বকুনি শুনতে হবে ভান্ডারীজির সেই ভয়ে। ইন্দ্র সাহস করে চোখে সানগ্লাস এঁটে বসল। যাতে ঘুমোনোর টুকলি মাস্টার না ধরতে পারে। গাড়ি ছুটেছে চোপতার পথে। আমাদের আজকের রাত্রিকালীন বিশ্রামস্থল বানিয়াকুণ্ড। চোপতার পাঁচকিমি মত আগে একটা পাইনের জঙ্গলের মধ্যে ঢালু ওপেন হাফ বুগিয়াল। সেখানে অনেক ফিক্সড টেন্ট আছে। অসাধারণ ভিউ। সামনেটা পুরো খোলা। এখানে রাস্তা ভালো। গাড়ি গতি নিচ্ছে। দেবজিত মাঝখানে বসে স্পিডোমিটার দেখছে আর কমেন্ট্রি দিচ্ছে,"ভাই পঞ্চ (৫০),ভাই ষষ্ঠ (৬০),ভাই সপ্তমে তুলে দিয়েছে (দাঁতে দাঁত চিপে আস্তে আস্তে)"। সুদীপ পিছন থেকে হাল্কা পিনিক দিলো,"চোখ বুজে একটু ঘুমিয়ে নে ভাই।" আমি ব্যাগ থেকে লজেন্স বের করে সবাইকে দিয়ে একটু স্বাদ বদলের চেষ্টা করলাম আর কী।
রোদের বেলা বাড়ছে,আর সে চুনজলের উপর পাতলা অস্বচ্ছ সরের মত একটা ঘোলাটে পর্দা মেলে দিচ্ছে আলতো করে। খোলা মনে না দেখলে অবশ্য বোঝা যাবে না খোলা চোখে দেখলেও। একটু এগোতেই ডানদিকে দূরে তুঙ্গনাথ আর চন্দ্রশিলা দেখা গেল। কাউকে বলিনি। বুকটা একটু কেঁপে গেল। ওই চূড়ায় উঠতে হবে? এই কান্নিক খাওয়া হেঁচকিতোলা হাঁটু নিয়ে পারব কি? আজ যদিও রেস্ট, দেখা যাক। আকাশে দাঁড়কাক উড়ছে। পাতিকাক এদিকে দেখিনি খুব একটা। আর কিছুক্ষণ, তারপরেই পৌঁছব।

রাস্তা ছায়ায় ঢেকেছে। সারি দিয়ে পাইন উইয়ের ঢিপিতে আলপিনের মত পোঁতা আছে। উইন্ডস্ক্রিনে পাতার ছায়ারা আদর বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কথা বলছিনা কেউ। অদ্ভুত কো-ইন্সিডেন্সে ভান্ডারীজিকে দেয়া জয়ের পেনড্রাইভে "রোজা জানেমন,তু দিল কি ধড়কন,তুঝ বিন তরসে ন্যয়না"...বাজছে। বুঝতে পারছি হিমালয় গিলে নিচ্ছে আমাদের আস্তে আস্তে ক্ষুধার্ত অজগরের মত আর আমরাও মোহাবিষ্টের মতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি আবহে। হঠাৎ সাড় জাগিয়ে পিছন থেকে অধিনায়ক জয় বলল ভাই অভিষেক খেয়াল রেখো 'নীলকন্ঠ'ক্যাম্প, একটা মোড় ঘুরে পড়বে। আর ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই অধিনায়কের বোলিং চেঞ্জ সঠিক প্রমাণ করে উইকেট পড়ল নীলকণ্ঠ ক্যাম্পে একটা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির মোড় ঘুরেই।
ক্যাম্প পুরো ফাঁকা। তুঙ্গনাথজির ডুলি কালই এই পথে উখিমঠের দিকে রওনা দিয়েছে। জঙ্গলের পথে তুঙ্গনাথজিকে নিয়ে যাওয়া হয় উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে। লোকাল লেজেন্ড অনুযায়ী যদি কেউ ওনার জন্য কোন ধাতব গহনা বানিয়ে রাখেন আর উনি সেটা দেখতে পান যাওয়ার পথে আর তিনি সেখান থেকে নড়েন না। শত চেষ্টাতেও ডুলি আর মাটিছাড়া করা যায় না। তাই এই ব্যবস্থা। আমরাও গাড়ি থেকে নেমে বুক ভরে সবুজের গন্ধ নিলাম। ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোকের সাথে অধিনায়কের কথা হল। আগেরবারও ওরা এখানেই ছিল। নশো টাকা করে নিয়েছিল বলায় সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন 'তাই-ই দেবেন' বলে। আলাভোলা বুগিয়ালিস সবুজের ঢাল বেয়ে উপরে টেন্টের দিকে এগোলাম। দুজন ছেলে স্যাক টেন্টে দিয়ে যাবে বলল। ভান্ডারীজিও ডাইনিং রুমে শুতে পারবেন জেনে খুশি হয়ে মোবাইলে হেডফোন লাগিয়ে উত্তরাখন্ডি বকবক শুরু করলেন।
খাসা টেন্ট। ডবল লেয়ার। বাইরে চেয়ারপাতা সঙ্গে টেবিলও। ভিতরে কিংসাইজ বেড উইথ ডবল কম্বল। সঙ্গে অ্যাটাচড টয়লেট। কোমোড বেসিন বালতি মগ সব আছে।

বাইরে বেরোলাম চেঞ্জ করে। রোদ পড়ে আসছে শেষ তিরিশের কোঠার যৌবনের মত। বেরিয়ে এসে হকচকিয়ে গেলাম। এতক্ষণে মন দিয়ে দেখলাম বানিয়াকুণ্ডকে। দূরে স্পষ্ট কেদাররেঞ্জ। মাঝখানের পিকটা চিনতে পারিনি। ডানদিকে উঁকি দিচ্ছে চৌখাম্বার দুই খাম্বা। আবার মাঝেমধ্যে লুকোচ্ছে ঘুড়িওড়া মেঘে। মাঝে আদিগন্ত ছোট ছোট পাহাড় আর তাদের পুঞ্জাক্ষি রং-কুয়াশা-ধোঁয়ায় মাখামাখি 'স্মাজড প্যাস্টেল কালার'-এর ক্যানভাস। এদিকে সেদিকে গড়াচ্ছে সবাই। এন্তার ফোটশুটের মাঝে চিঁড়েভাজা আর চা-ব্রেক হয়েছে। আর হয়েছে সৌনিপের ক্যামেরায় অপূর্ব সব সেলফটাইমার গ্রুপফোটো। একটা আমাদের মতই ছন্নছাড়া সারমেয় বলে বলে পোজ দিয়ে গেল সবার সঙ্গে। আমার বেলাতেই শুধু গায়ে উঠল আর হাউ হাউ করে চাটল,ছবি তুলতে দিল না। তার কয়েকটা বন্ধু পাখি, হিমালয়ান ইয়েলো বিলড ব্লু ম‍্যাগপাই (Himalayan Yellow Billed Blue Magpie) লম্বা লম্বা লেজ ঝুলিয়ে ট্রিট্রি করে উড়ে বেড়ালো আসমান জুড়ে। ছায়ারাও লম্বা হতে হতে মিলিয়ে যাওয়ার পথে। ঠান্ডা বেড়েছে অনেকটাই, জ্যাকেট টুপি চড়িয়ে বাইরে চেয়ারে বসে হাঁ করে গিলতে লাগলাম হিমালয়ান সিনেপ্লেক্স এর থ্রি ডি মুভি।
মোমগন্ধী বিকেল নিভে যাওয়ার পর একটা আবগারি শুল্ক ফাঁকিদেওয়া চোরা ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত বইতে লাগল আর আমাদেরও টেন্টের ভিতর ঢুকতে বাধ্য করল। নিচে কিচেন থেকে মর্ত্যবানী হয়েছিল আগেই রাতের পাতে গরম খিচুড়ি, ডবল ডিমের মামলেট (বলতে ভাল লাগে অমলেটের চেয়ে) আর পাঁপড়, ঠিক সাড়ে সাতটায়। কিন্তু সাতটাতেই ডাক পড়ল। একটা ভিজে ঠান্ডা অন্ধকারে সোলার লাইটের পোস্টগুলো আত্মহত্যার আদর্শ বটগাছের মত দাঁড়িয়ে আছে। আলোর জোর না খেতে পাওয়া ঝাড়গ্রামের শবরদের মত। বাইরে বেরিয়ে ঠান্ডায় একটু কেঁপে নিয়ে হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে এগোলাম। ডাইনিংরুমে ওঠার পাথরের সিঁড়িতে দেবজিত একটু ঠোক্কর খেয়ে খিদেটা ঝালিয়ে নিল। গরম ধোঁয়াওঠা খিচুড়ি আর প্রায় পোড়া মামলেট গোগ্রাসে গিলে নিলাম গরুর মত সবাই।
সকালেই বেরোনো,তাই বিল আনতে বললাম একেবারে টাকা মিটিয়ে দেবার জন্য। পাঁচ মিনিট আড়ালে ফিসফাসের পর আমার হাতে বিলটা ধরাতেই টেস্টোহেডো বনবনাইটিস হয়ে গেল (আশা করি ব্যাখ্যা লাগবে না শব্দবন্ধটার)। পার টেন্ট নশো টাকার বদলে পার হেড নশো টাকা ধরে ভাড়া হয়েছে পাঁচ হাজার চারশো আর খাবারের বিল আলাদা। অধিনায়ক বিল দেখে স্টেপআউট করল এবং ওই আধাঘুমন্ত ফুলদুলন্ত বোলারকে সোজা স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠিয়ে দিল ব্যাট হাঁকড়ে। ভদ্রলোকের জলের সঙ্গে হোমিওপ্যাথি ওষুধ একটু বেশি হয়েছিল। তিনিও চুপচাপ মেনে নিয়ে এবং পার টেন্ট ন'শো করে নিয়েই বোলিং রানআপে ফিরে গেলেন। শুধু বিলটি চেয়ে নিলেন। আমরাও বানিয়াকুণ্ডের বানিয়াদের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে মৌরি চিবোতে চিবোতে বোতলে গরম জল নিয়ে টেন্টে ফিরে এলাম আর স্ট্র্যাটেজি মিটিং-এ ঠিক হল কাল এদের ঘুম ভাঙার আগেই পগার পার হতে হবে। অতএব, ধোঁয়াগন্ধের জল দিয়ে রাত্রিকালীন পিল টপ করে পপ করে সোজা কম্বলের তলায়। আধসেদ্ধ খিচুড়ি অম্বল তৈরি করার আগেই ঘুম এসে গেল। সব ভালো যার পেট ভালো।
"লুকিয়ে লুকিয়ে এখনো দেখো আমায়,আমি জানি -
শুধু স্বীকার করোনা মুগ্ধতা,
আমাদের জল ন্যাকড়া দিয়ে মোছা স্লেটে
থেকে গেছে,এখনও,হাতেখড়িটা।"

#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_১২ইয়ারির_খোঁয়াড়ি
#তুঙ্গনাথের_দেওয়াললিপি
#ট্রেক_না_এর_গল্প
টেন্টের ভিতর অন্ধকার হাতড়ে মাথার কাছে একমাত্র আলোর স্যুইচটা জ্বালালাম। কম্বল থেকে মুখ বার করে বাইরের ঠান্ডার একটা মৃদু আভাস পাওয়া গেল। একটা সন্ত্রাসবাদী হাওয়া টেন্টের দেওয়ালে ঝাপটা মারছে। উঠতে হবে। যত সকালে পারা যায় এখান থেকে পালানোর টার্গেট। তাছাড়া আজ তুঙ্গনাথ অ্যাটেম্পট করার কথা। না পারলে চোপতা বুগিয়ালে গড়াগড়ি খেয়ে চৌখাম্বা দেখে ছবি তুলে এগিয়ে যাওয়া।
যথারীতি সবার আগে আমিই বিছানা ছাড়লাম। সাড়ে পাঁচটায় চা দেবার কথা কিন্তু চারিদিক যা শুনশান মনে হয়না কেউ উঠেছে কয়েকটা পাহাড়ি ঝিঁঝিঁ ছাড়া। ধরাচূড়া পরতে পরতে বাকিরা উঠল। বাইরে সৌনিপের আর সুদীপের গলা। ভোরের আকাশ সেদিনের নতুন সূর্য প্রসব করতে তৈরি, প্রসবযন্ত্রণা উঠে গেছে আগেই। বাইরে এলাম। এই ঠান্ডাটার জন্যই পাহাড়ে আসা। প্রথম মদ খেয়ে বাড়ি ঢুকে বাবার কাছে ধরা পড়ে কড়া ধমকের মত কড়া,অথচ সঙ্গে,সামনে থেকে মা চলে যাবার পর 'লিমিটে খাবি, ছড়াবি না আর বাড়ি ঢোকার আগে পান খেয়ে নিবি'-র সু-পরামর্শের মত একটা পাতলা কুয়াশার চাদর গায়ে জড়ানো ঠান্ডা। চেয়ার এনে বসলাম। কাল এখানেই সূর্যডোবা দেখেছি, আজ উঠতে দেখব। ভালোবাসার মানুষের ঘুমোতে যাওয়া আর ঘুম ভেঙে তাকানো দেখার মত প্রজাপতি উড়ছে মনে। টুপি কান অবধি টেনে নিলাম ভালো করে।

নীল থেকে বেগুনি থেকে গোলাপির দিকে এগোচ্ছে সময়। প্রথম আলো ছুঁল কেদারশৃঙ্গে। সেই আহ্লাদী কমলা আলো ফুঁ দিয়ে কুয়াশা উড়িয়ে দিতে দিতে জাঁকিয়ে বসতে লাগল শৃঙ্গগুলির মাথায়। একটার পর একটায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামার মত খেলছে আলো। আমরা ছবি তুললাম যত তার থেকে অনেক বেশি দেখলাম,না,গিললাম হাভাতের মত। চারিদিক এত নিস্তব্ধ যে টেন্টের চাল থেকে কুয়াশার টুপটাপ ঝরে পড়া, আমাদের ফিসফাস, পায়ের আওয়াজ, জ্যাকেটের ঘষা খাওয়া, হাওয়ার দোলা পাইন আর ভোরের আলো ফোটার শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এমন সশব্দ নিস্তব্ধতা হেরোইনের চেয়েও বেশি নেশা ধরায়। আলো যখন ঠিক গায়ে হলুদ দিল আমরাও উঠলাম। স্যাক গোছানোর অল্পকিছু ছিল। করে নিয়ে টেন্ট চেক করে নিচের দিকে এগোলাম। কাল রাতের ল্যাম্পপোস্ট ডিউটি সেরে ঘুমোচ্ছে। গাড়ির কাছে এসে দেখে শান্তি হল যে ভান্ডারী গাড়িতে শোয়নি। গাড়ির কাচে তখন সময় গড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিকের রাস্তা ঘুরে জলের রেললাইন হয়ে। কেউ মিশেছে, কেউ পারেনি আমার মত।
ভাণ্ডারীজিকে ডেকে তোলা হল। সামান্য সময় চেয়ে নিলেন ফ্রেশ হতে। আমরাও যেটা কলকাতায় জীবনে করি না সেটা করতে শুরু করলাম ওই হাড়কাঁপানো ঠান্ডায়। ওই প্রাতঃভ্রমণ আর কি! একটা চায়ের দোকান খুলছে সবে। পিচরাস্তার ধার, দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কুয়াশাভেজা টায়ার, ঝাঁটার ধুলো আর কাঠের উনুনের ধোঁয়া মিলেমিশে একটা কাঁচা সকালের গন্ধ চারিদিকে। ভান্ডারীবাবুকে চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়ে আমরা এসে বসলাম। কালি এবং দুধওয়ালি চায়ের অর্ডার দিয়ে আগুনের কাছে জড়ো হলাম। একটা ফোটোফ্রেমের মত জানালা দোকানটার আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে যেন।

ওই জানলা দিয়েই পুরো রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে গাছপালা বুকে জড়িয়ে। ওখানেই চা-দোকানের কাছে তুঙ্গনাথজির ডুলি যাত্রার গল্প শুনলাম যেটা আগেই বলেছি। ধোঁয়া, বউনি আর ভালোবাসামেশানো চা খেয়ে এবার পালা গাড়িতে ওঠার। মাত্র পাঁচ কিমি পথ চোপতা। ওখানে ব্রেকফাস্ট করে তুঙ্গনাথ ওঠা হবে। পারলে চন্দ্রশিলাও। হুশ করে পৌঁছে গেলাম চোপতা বাসস্ট্যান্ড। তুঙ্গনাথ ওঠার গেটের ঠিক উল্টোদিকে অনেকগুলো হোটেল। ২০১১-এর সঙ্গে কোন মিল নেই। তখন একদম ফাঁকা ছিল চোপতা। একটা দোকানে ঢুকে খাবার অর্ডার দেওয়া হল। আমি ভেজ ম্যাগি, ইন্দ্র রুটি সবজি আর বাকিরা আলুর পরোটা। মালিক ব্যাটা রুটির সাথে সবজির কম্বিনেশন শোনেনি তাই খালি রুটি দিয়ে গেল,তাও সবার পরোটা দেবার পর। ইন্দ্র বেচারা আর তরকারি না চেয়ে সবার থেকে একটু করে তরকারি নিয়ে খেয়ে এমবি। আমার ম্যাগিটা দুর্দান্ত বানিয়েছিল। কিন্তু এতই বেশি ছিল চেষ্টা করেও শেষের একটুখানি আর খেতে পারলাম না।
পৌনে নটা বাজে। আমাদের প্ল্যান ছিল আটটায় শুরু করা। হল না। গেটে ঘন্টা বাজিয়ে একটু এগোতেই ফরেস্ট চেকপয়েন্ট। নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ট্রেকারকে দেড়শো টাকা প্রবেশমূল্য দিতে হবে। সঙ্গে গ্রুপপিছু জন্য পাঁচশো টাকা ডিপোজিট মানি আর নিজেদের কাছে থাকা সমস্ত প্লাস্টিক সামগ্রীর হিসেব। ওঁরা সমস্ত নোট করে নিলেন নামসহ এবং প্রতিটি প্লাস্টিক জিনিসে মার্কার দিয়ে মার্ক করে দিলেন,সঙ্গে সতর্কতা যে একটিও ফিরিয়ে না আনলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। তুঙ্গনাথ মন্দির বন্ধ,তাই সতর্ক করে দেওয়া হল যে বিকেল চারটে হল টাইমলিমিট। তার মধ্যে নেমে আসতেই হবে,ওপরে থাকা খাওয়ার জায়গা এবং জলের সোর্স প্রায় শেষ। জি হুজুরি করে টানা চড়াই ওঠার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে হাঁটা আরম্ভ হল ঠিক নটা পাঁচ মিনিটে।

সুন্দর বাঁধানো রাস্তা পুরোটাই। প্রথমটুকু পাইন, ওক, ম্যাপল, রোডো-র জঙ্গল। আরো গাছগাছালিতে ভর্তি। আর আছে লেঙ্গুর শ্রেণীর একগাদা বাঁদর। বেশ কনকনে ঠান্ডা, নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেন বরফকুচি ঢুকে যাচ্ছে। আমি প্রতিবারের মত পিছনে। জঙ্গল মাখতে মাখতে হাপর টানতে টানতে উঠছি। পায়ে ব্যথা থাকলেও তেমন না। সেরকম কষ্ট হচ্ছে না। অধিনায়ক বলেছিল চোপতা বুগিয়াল এক ঘন্টার বেশি লাগবে। গতবার ওদের তাই লেগেছিল। আমরা সাধারণ হেঁটেও পঁচিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। একফালি একটা চায়ের দোকান। বয়স্ক গাড়োয়ালি কাকিমা চা খাবার অনুরোধ জানাতে সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। চৌখাম্বা স্বমহিমায় আলোর পাউডার মেখে চকচক করছে। কয়েকটা হিপি ডিপি তোলা হল আর ঠিক হল সময় লাগুক তুঙ্গনাথ উঠবোই। চারিদিক ঝকঝকে। সোনাঝরানো আলো। রোদে আসতেই একটু গরম লাগল। জ্যাকেট খুলে ফ্লিস (fleece) পরে নিলাম আর সানগ্লাসও। আস্তে আস্তে ওঠা হচ্ছে। এইসব করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছিলাম। ওরা রাস্তা দিয়ে না গিয়ে একটা ভয়ানক চড়াই পাকদন্ডী ধরেছে বুঝিনি। একটু এগিয়ে ওই পাকদন্ডীর আশা ছেড়ে আবার বাঁধানো রাস্তা ধরলাম। মিটিং পয়েন্টে ওরা হাঁপিয়ে রেস্ট নিচ্ছিল। উঠে আবার হাঁটতে লাগল। আমি একটু বসে জল আর চকোলেট খেয়ে পিছু ধাওয়া করলাম।
আজ তাড়া নেই। বেশ স্পিডেই উঠছি। তাই সময় নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছি। কিছু কিছু জায়গায় ফ্রস্টিং হয়ে বরফ জমে আছে। আরেকটু উঠে একটা দোকান এল। মালিকও দোকান গুটিয়ে নেমে আসার তোড়জোড় করছেন। সামান্য কিছু পসরা সাজানো। একটা লেবুজলের ব্রেক নেয়া হল। ভদ্রলোক আমাদের এতটা আসতে দেড় ঘণ্টা লেগেছে শুনে বললেন আর ম্যাক্সিমাম এক ঘন্টা লাগতে পারে। আমরাও আনন্দে এক পাক নেচে নিয়ে উঠতে লাগলাম।

আনইভেন্টফুল চকোলেট,ম্যাংগোবাইট,কাজু কিসমিস এবং ফটোব্রেকসহ পঞ্চাশ মিনিটের হার্ডকোর চড়াই ভাঙার পর পৌঁছে গেলাম তুঙ্গনাথ মন্দিরের কাছাকাছি। চারিদিকে একটা শূন্যতা। কেউ নেই কোথাও। কয়েকটা ঘর, হোটেল-মত, সব বন্ধ। ছেড়ে যাওয়ারা যেন চিৎকার করে বলছে আমরা ছিলাম,আমরা ছিলাম হৈ-হুল্লোড় আনন্দ আর বেঁচে থাকা নিয়ে। হাওয়াদের বেশ মজা হয়েছে। অলিতে গলিতে বইছে মাতাল দাঁতাল-এর মত। একটা বাঁক ঘুরতে দেখা গেল একটাই বাড়িতে কিছু লোকজন তখনও রয়ে গেছে। কয়েকজন শ্রমিক এবং রাজমিস্ত্রি সিমেন্ট মেখে কিছু একটা করছিল, সাকুল্যে দশজন হবে। সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের রাস্তায় ওঠার আগে দেখলাম একটা বাড়ির দেয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে আঁকা একগাদা শিব জি'র স্কেচ। কে এঁকেছে বোঝা গেল না, তবে এটা বোঝা গেল যেই আঁকুক তার চারকোল পেন্টিং-এর অভ্যেস আছে। কিছু আধমোছা অক্ষর যেন পেইন্টারের প্রতি কৌতূহল আরো বাড়িয়ে দিল।

ঠিক এগারোটা পঞ্চাশ মিনিটে মন্দিরের গেটে ঘন্টা ছুঁতে পারলাম। সৌনিপ আর ইন্দ্র মিনিট কুড়ি আগেই এসে গেছে। এসে শুনলাম সৌনিপ নাকি এগিয়ে গেছে চন্দ্রশিলার দিকে। আমাদের আর ইচ্ছে ছিল না। আমরা ছ'জন ছাড়া আর দুজন বাঙালি ভদ্রলোক,একটি সোলো মেয়ে ট্রেকার আর পাঁচজন সাউথ-ইন্ডিয়ান কলেজস্টুডেন্ট ছাড়া কেউ নেই। মন্দিরের গেট বন্ধ। ফাঁক দিয়ে জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে এল না। পুজো দেবার তাড়া নেই শুধু ঘুরে দেখা আর ছবি তোলা। ঠিক হল সাড়ে বারোটায় নামতে শুরু করা হবে। একটু পরেই সৌনিপ ফিরে এল। রাস্তা খুঁজে পায়নি বোল্ডারের মধ্যে। আসলে বরফ থাকলে সুবিধে। এখন বরফ নেই। পুরোটাই শুকনো হলুদ ঘাসে ভর্তি। তাছাড়া বিকেল চারটের মধ্যে নামতেও হবে। মনভরে ফাঁকা মন্দির চত্বরে ঘুরে,শুয়ে,বসে ছবি তুলে পৌনে একটায় নামতে শুরু করলাম। চৌখাম্বার গায়ে তখন পাতলা ওড়নার মত সাদা মেঘ জড়াতে শুরু করেছে। হাঁটু একটু জানান দিচ্ছে তার আর পোষাচ্ছে না এসব। তবে বেশি গাঁইগুঁইও করছে না। আধ ঘন্টায় লেবু জলের দোকানে পৌঁছে আরেকপ্রস্থ শরবত খেয়ে ঠিক হল টানা চোপতা বুগিয়াল নামতে হবে। ওখানে কিছুক্ষণ কাটানো অধিনায়কের মনের ইচ্ছে।

চোপতা বুগিয়াল নামতে আরো চল্লিশ মিনিট লাগল। বড়ই সুন্দর থাকার কথা বর্ষার সময় এই বুগিয়ালের। এখন সবুজের ওপর একটা ধুসরের প্রলেপ পড়েছে পুরোনো কম্বলে ধুলোর মত। যেকোনো মানুষেরই এখানে বলিউডি হিরোদের মত হিরোইনকে জড়িয়ে গড়াতে ইচ্ছে হবে। আমার হিরোইনও নেই আর ইচ্ছেও হলনা একগাদা খচ্চরের গু দেখে। মিনিট দশেক বসে উঠে পড়লাম। ছায়ারা লম্বা হতে শুরু করেছে। জঙ্গলে ঝুপসি নামার সময় আসছে। ঠান্ডাটা মালুম হচ্ছে আবার। ক্ষিদেও পেয়েছে। আজেবাজে বকতে বকতে আর দেবজিতের চওড়া কপালের জন্য আমাদের তুঙ্গনাথ হল বলে ধন্যবাদ দিতে দিতে তিনটের আগেই ফরেস্ট চেকপয়েন্টে পৌঁছে গেলাম।

"এই নাটকের সাড়ে সতেরো অঙ্ক
পর্দা ভীষণ কালো, নোনতা, ভারী
অভিনয়ের আংটি বদলশেষে
সূত্রধরই সত্যির কারবারী...।"

(ক্রমশ)

~ কেদারের আরও ছবি ~

জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার টেকনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন পাহাড়ে না গেলেই ডিপ্রেশনে ভোগেন। ট্রেকে বেরোলেই ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। কিন্তু ফিরে এসে লিখতে বসলেই আবার ল্যাদ খান। তবে এর পরেও কষ্টেসৃষ্টে যেটুকু লেখেন তা স্রেফ 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই। বাড়িতে চমৎকার রুটি বানান। মাঝেমধ্যে রান্না করতেও ভালোবাসেন।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher