ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - তৃতীয় পর্ব
কেদার ভ্রমণের বুকলেট
অভিষেক ব্যানার্জি
~ কেদারের আরও ছবি ~
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_১৩আনার_গয়না
#কুড়িয়ে_পাওয়া_ম্যাপল
#পিপলকোটির_খটাখটি
"জানে না কহাঁ ওহ দুনিয়া হ্যায়,
জানে না ওহ হ্যায় ভি ইয়া নহি,
জহাঁ মেরি জিন্দেগি মুঝসে,
ইতনি খফা নহি..."
তুঙ্গনাথ থেকে নেমে হিসেব মিলিয়ে জিনিস ফেরৎ দিতে পারায় আমরা মহা খুশি। ডিপোজিট মানি বাপিস নিয়ে ড্যাংড্যাং করতে করতে নেমে এলুম। গেটে ঘন্টা বাজিয়ে যাত্রাশেষ করে হাঁকুপাঁকু করে ছুটলাম খাবার দোকানে। পেটে খিদে চাগাড় দিচ্ছিল। ব্রেকফাস্টের দোকানে না গিয়ে অন্য আরেকটায় গিয়ে জমিয়ে ভাত-রুটি খাওয়া হল। এরপর প্ল্যান ঠিক ছিল না আমাদের। তুঙ্গনাথ যেতে যেতে ঠিক হয়েছিল আরেকটা কেদার কল্পেশ্বর করা হবে। দুটো অলরেডি করে ফেলেছি। একযাত্রায় তিনখানা হয়ে গেলে পায় কে। কিন্তু ইন্দ্রের একখানা হতচ্ছেদ্দা লাইন ড্রয়িংওলা ম্যাপ আমাদের ভরসা। তাতে দেখাচ্ছে জোশীমঠের রাস্তায় হেলাং হয়ে যেতে হবে। কিন্তু কতটা হাঁটতে হবে পেলাম না। নেটও ঝোলাচ্ছে, যাই হোক ঠিক যখন হয়েছে তখন দেখাই যাক না।
ভালোমন্দ খাইয়ে ভাণ্ডারীকে গাড়িতে তোলা হল। উঠেই সিটে বসে প্রশ্ন "অব কাঁহা?" ইন্দ্র সামনে বসেছিল। বলল চামোলি হয়ে আমরা হেলাং যেতে চাই। ব্যস! জ্বলে আগুন, তেলে বেগুন। টিকিধারী বিহারি এই মারে তো সেই মারে, একেবারে রেগে কাঁই। লালমোহনবাবু লিখলে লিখতেন –"ইয়ার্কি পায়া হে?" কিন্তু ভাণ্ডারীর হিন্দি ভালো, স্পষ্টভাষায় জানালো হবে না। পারব না। ২০০ কিমি এক্সট্রা ঘুরতে পারব না, আপনারা গাড়িমালিকের সাথে কথা বলুন। এরকম হুটহাট রুট পাল্টালে হবে না। কোথায় যাবার কথা ছিল রাঁশি সেখানে কল্পেশ্বর। ওসব আমি চিনি না, নিয়েও যেতে পারব না। গাড়ি ঠিক করার দায়িত্বে ছিলেন অধিনায়ক স্বয়ং। ত্রিভুবনেশ্বর বিষ্ণুর কাছে আসা ব্যাকুল দেবতাদের মত আমরাও অসহায় মুখে অধিনায়কের দিকে তাকালাম। এদিকে আমরা ফোন করার আগেই ভাণ্ডারী ফোন লাগিয়ে ফেলেছে। যাইহোক গাড়ির মালিক বেওয়াফাই না করে রাজি হয়ে গেল, ভান্ডারীর কানে কী ফুসমন্তর দিল জানিনা, গজগজ করতে করতে সে গাড়ি ছেড়ে দিল। তবে গাড়ির স্পিড দেখে ঠেকুয়া যে বেশ শক্তপাকের হয়েছে বোঝাই যেতে লাগল হাড়ে হাড়ে।
জানলা খুললেই লাউডগা সাপের মত হিলহিলে ঠাণ্ডা হাওয়া ছোবল মারছে। এদিকে ইন্দ্রর ফোনের পর ফোন আসছে। ওর বাবা-মা আর ছাত্রদের একটা দল আসছে কলকাতা থেকে। ওরা আজ দুন-এ উঠবে। তারপর ইন্দ্রর সাথে মিট করবে জোশীমঠে। আমরা ব্যাক করব আর ওরা বদ্রীনাথ যাবে। যতবার 'জোশীমঠ, মানা, বদ্রীনাথ' এইসব শুনছে, ততবার কান খাড়া হচ্ছে আর টিকি দুলছে ভান্ডারীর। মনে মনে শিওর ভাবছে এরা আমায় বদ্রীনাথ টেনে নিয়ে যাওয়ার তাল করছে, শালা কী খচ্চর এই বাঙালিগুলো। গাড়ি এগোচ্ছে ভালোই। সগর পেরিয়ে চামোলির দিকে যেতে যেতে রাস্তায় চেরিগাছের মেলা বসেছে দেখলাম। অপূর্ব লাগছে, যেন একমুঠো গোলাপী আবির কেউ ছিটিয়ে দিয়েছে গাছগুলোর উপর। ঠিক হয়েছিল চামোলিতেই থাকব। চামোলির মেইন মার্কেটের রাস্তা যখন পেরিয়ে যাচ্ছে তখন জিজ্ঞেস করায় ভাণ্ডারী জানালো এই ব্যস্ত জায়গায় থাকার মত ভালো হোটেল নেই। এদিকে সবাই ক্লান্ত। কারো আর এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু ভান্ডারী কারো কথা শুনতে রাজি নয়। আশ্বাস দিয়ে বলল আমি একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি চলো, যদি পছন্দ না হয় বলবে আমি ফিরে আসব। এরপর আর কথা চলে না।
দিনের বেলা যেসব জিনিস দেখা যায়না, অন্ধকারের ওড়না জড়িয়ে তারাই হাজির হয় আলগোছে, পা টিপে টিপে। কখন একা আর ফাঁকা করে দিয়ে চলে যায় বোঝা যায় না। এতক্ষণ গাড়িতে এসে সবাই চুপ। ঘেঁটুফুলের গন্ধের মত পাহাড়ের গন্ধে মাতাল হয়ে সবাই বাইরের দিকে তাকিয়ে। একটা জায়গায় রাস্তা অনেক চওড়া। মাঝখানে একটা ন্যাড়া গাছ গা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একলা, হয়তো কারো বাড়ির উঠোনের প্রিয় গাছের কথা মনে পড়ায় তারা আর কাটেনি। অনেকক্ষণ কথা না বলায় অধরে জুড়ে গেছে ওষ্ঠ। মিউজিক সিস্টেমে কী গান বাজছে কারো খেয়াল নেই। ঘন নীল থেকে ছাই হতে হতে আকাশ যখন কালো, তখন যেন চটকা ভাঙল। কিলোমিটারের সাইন বলছে আমরা এসে গেছি পিপলকোটি। হেডলাইটের আলোর কাটাকুটি পেরিয়ে যখন কাটা আর গোল্লা দিয়ে সব ঘর ভর্তি, তখন শুধু জিতে গেল হিমালয়। আমরাও শ্বাস ফেললাম হোটেল দেখে। ১২০০ টাকার বিশাল ডরমিটরি ১০০০-এ হয়ে গেল ইন্দ্রর কথার গুণে। আমরাও খুশ, ভান্ডারীও।
সবাই অনেকদিন পর গরম জলে শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে স্নান সারলাম। তারপরেই হাঘরের মত সাতজন্মের খিদে তেড়ে এল। নিচেই হোটেলের রেস্টুরেন্ট। সুখাদ্যের ঘ্রাণ টম আর জেরির মত নাকের সামনে গন্ধ-আঙ্গুল দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ডেকে নিয়ে গেল। থালি নিল কিছুজন আর আমরা কজন রুটি আলুর দম, ভিন্ডিভাজা। সামনের টেবিলে খাবার আসছে আর আমরা সামনে থেকে দুধের বাটি কেড়ে নেওয়া দামড়া হুলো বেড়ালের মত হাঁ করে থাবা চাটছি। অবশেষে খাবার এল। অপূর্ব রান্না। আলুর দমে আলুর রং পুরো লাল, সঙ্গে উপরে চিজ ছড়ানো। দেখেই আমি ছ্যাড়ানোর ভয়ে একপিস আলু আলাদা করে তুলে নিলাম। অনেকদিন পর ভালো খাওয়া হল। মৌরি চিবোতে চিবোতে উপরে গিয়ে হ্যাহা-হিহি চললো বেশ কিছুক্ষণ। ঘরটা বেশ বড়। দুইপ্রান্তে দুটো বিছানা কিংসাইজ। একটায় 'জয় শ্রীরাম'-পুর-এর তিন ব্যাক্তি, আর আরেকটিতে ইন্দ্র-আমি-দেবজিত। যথারীতি সব জায়গার মত মাঝে পেস্ট হবার কপাল আমারই। ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে কল্পেশ্বর মন্দিরের ৩০০ মিটার আগে অবধি গাড়ি যায় কাজেই নো চাপ।
রাত্তিরে আমার ঘুম আসে কম। পাতলা ঘুম, তার ওপর ছ'জনের মধ্যে আমি সৌনিপ বাদে সবাই নাক ডাকে। অধিনায়ক এখানেও বিরাট কোহলি। আবার জিরো পাওয়ার এর ল্যাম্পও জ্বলছে। শুয়ে পড়ার আধাঘন্টা পর মাথা উঁচিয়ে দেখলাম সৌনিপ বেচারা কোনমতে একদিকে পড়ে আছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে তন্দ্রা এসে গেছিল।
P.S: সবার জিন্দেগিই হয়ত সবার ক্ষোভ বয়ে নিয়ে চলেছে। ১৩ আনায় বিক্রি হচ্ছে স্মৃতির গয়না। কিছু খারাপ থাকা আমরা দেখাতে পারি, কিছু পারি না। কিছু ঘা আবার দেখতে পায় শুধু বিশেষ কিছু মানুষ। হাত ধরা সহজ, আমার মত মানুষের ক্ষেত্রে হাত ছাড়াও ততটাই কঠিন। কেউ না বুঝলেও পাহাড় ঠিক বোঝে আর সবার ভাবনায় 'দেখানো পাহাড়প্রেম এর' উপহাস পেরিয়েও বোঝে। তাই যখন বাথরুমে মুখে জলের ঝাপটা মেরে আয়নায় দেখি ভেজা মুখ আর কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের দাগ, মনে হয় ভালো থাকার চেয়ে হয়ত ভালোবাসাটাই বেশি দামী।
"এখানেই থেকে যাও, ঠিক এই পাশটায়
যেখানে বসলে সরাসরি দেখা যায় পাশে থাকা-
আমার থাকুক বাসি শরীর, বাসি মন
খোলা মেঝেয়, এঁটো বাটিতে, আঢাকা"।
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_১৪গুষ্ঠীর_ষষ্ঠীপূজো
#কল্পেশ্বর_মহাদেব
#ভিনরাস্তায়_ভিন্নপথিক
'টি টি টি টি টি টি টিং টিং...টি টি টি টি টি টি টিং টিং ... টি টি টি টি টি টি টিং টিং করে অ্যালার্ম বাজল ঠিক ছটায়। বন্ধ করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। ছজন আমরা, বাথরুম একটাই। সবাই আজ স্নান-টান করবে বেরোনোর আগে। তাড়া খুব একটা নেই। আজ পুরোটাই গাড়িতে। পিপলকোটি থেকে আমরা যাব হেলাং। ৩৪ কিলোমিটার রাস্তা ন্যাশানাল হাইওয়ে-৭ ধরে। তারপর হেলাং-উরগ্রাম রাস্তা ধরে ১১ কিলোমিটার কল্পেশ্বর। স্থানীয় ড্রাইভাররা বলেছে মন্দির অবধি গাড়ি যায়। আমরা আনন্দেই আছি আজ হাঁটা নেই। একে একে স্নান করে স্যাক গুছিয়ে একেবারে নিচে নেমে এলাম। ব্রেকফাস্ট করে ফার্স্ট এগুনো। জানিনা ভান্ডারীর মর্জি কেমন আছে।
খাবার টেবিলে বসে দেখি ভান্ডারী তৈরি। সে দিব্যি ভালো ঘুমিয়েছে বাকি ড্রাইভারদের সঙ্গে। তবে দিল খুশ নাকি নাখুশ বোঝা যাচ্ছে না। আমরা নাস্তার অফার দিতে বলল 'জি ঠিক হে, আপ জো বোলেঙ্গে'। বুঝলাম এখনও বাউন্সার ধেয়ে আসেনি। সে সোনামুখ করে আলুর পরোটা নিয়ে আলাদা বসল আর আমরা আলু-পরোটা, পুরী আর রুটি মিলিয়েমিশিয়ে নিলাম আর তারপর কফি, আমারটা অ্যাজ ইউজুয়াল ব্ল্যাক। পয়সা মিটিয়ে গাড়িতে উঠলাম। বেশ ঠান্ডা, তবে যে ঠান্ডা কাটিয়ে এলাম তার কাছে নস্যি। রোদ উঠেছে পরীক্ষাশেষের আনন্দের মতন। আজই ইন্দ্রের শেষ রজনী এবারে আমাদের সঙ্গে। ওর বাবা মা আসছেন। রওনা দিয়ে দিয়েছেন হরিদ্বার থেকে সাঙ্গপাঙ্গ সমেত। একটু যেন মন খারাপ হচ্ছে। কেউ কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না আমরা। গাড়ি ছুটেছে হাইওয়ে ধরে। মাঝ সকালের উত্তরাখন্ডি হাইওয়ের ধার যেমন সংসার করার করছে নিজের মত। কোন ঘরের বারান্দায় চলছে ভেজা সোয়েটার মেলা, আবার কালভার্টের ধারে গান গাইতে গাইতে হাতে বোনা সোয়েটারের হাতা গুটিয়ে বোতল কাটা দিয়ে জল ছুঁড়ে ছুঁড়ে গাড়ি ধুচ্ছে কোন ড্রাইভার।
SBI পেরিয়ে হেলাং মোড়ে গাড়ি বাঁদিকে বেঁকে ঢুকে গেল হেলাং-উরগ্রাম রোডে। রাস্তা আর পাকা নেই। পাহাড়ি মাটি-পাথরের। ঝুপ করে যেন সভ্যতা থেকে জঙ্গলে ঠেলে ফেলে দিল কেউ। একটু এগিয়েই অলকানন্দার ওপর ভারী সুন্দর এক লোহার ব্রিজ। নীচে খিদে পাওয়া সিংহের মত বয়ে যাচ্ছে সে। রাস্তা জঘন্য। দুলতে দুলতে চলেছি। মাথা ঠুকে যাচ্ছে বারবার। সরু একরোখা চড়াই, সঙ্গে যত্রতত্র হেয়ারপিন বেন্ড আর নরকঙ্কালের মত ছোট-বড় বোল্ডারের পাঁজর। ভান্ডারী খুব খচে গেছে। "ইয়ে কাঁহা ফঁসা দিয়া আপনে। পুরা ফাঁকা ইলাকা হে। কিসি কো কুছ হো গয়া তো ইয়েহি মরনা পড়েগা"। গজ গজ করেই চলেছে। একটু এগিয়েই রাস্তা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকল। হুট করে যেন অন্ধকার জ্বেলে দিল কেউ। সঙ্গে এক অদ্ভুত ঝিমধরা নিস্তব্ধতা। মনে হল কোন মহাজাগতিক পোর্টাল পেরিয়ে অন্য কোন ডাইমেনশনে পৌঁছে গেছি। ওয়াল্টার ডি লা মেয়ারের 'লিসনারস' এর সেই ট্রাভেলারটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। 'Is there anybody there' বারবার ডেকেও যে সাড়া পায়নি বন্ধ দরজার আড়াল থেকে। তবে হিমালয়ের ভাবনা বরাবরই একটু অন্য রকম। চমকে দেওয়া। একটা বাঁক ঘুরেই সভ্যতার দেখা পেলাম। রাস্তা হচ্ছে। কালো কেউটের মত চকচকে গলা পিচ সমান্তরাল প্রগতিতে শুয়ে আছে মাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান সমেত। কায়িক শ্রমিকদের সমবেত কথা, পিচগলানো ইঞ্জিনের ঘড়ঘড়, আলকাতরার গন্ধ, ঘামেভেজা ধুলোর গন্ধ, রাস্তার ধারের ত্রিপল-ঝুপড়ি-টেন্ট, পোড়া বিড়ি আর কালো তামাকের ছাপঅলা দাঁতেরা জানিয়ে দিল আরেকটু এগিয়েই উরগ্রাম বা উরগম গ্রাম।
পিচরাস্তা শেষ হয়ে রাস্তা আবার কাদামাটির। সদ্যকাটা রামদানার কাজ ফুরোনো কান্ডেরা পড়ে আছে অবহেলায়। জ্বলেপুড়ে খাক হবার অপেক্ষা করছে। রাস্তার ধারের এক দোকানী মহিলা জানালেন কিলোমিটার দুই এই রাস্তা ধরে সোজা গেলেই একটা নতুন ব্রিজ পড়বে। কল্পগঙ্গা ব্রিজ। ওপারে আর ৩০০ মিটার হেঁটে উঠলেই কল্পেশ্বর। গ্রাম ছাড়িয়ে একটু এগোতেই রাস্তা ঢালু হয়ে গেছে, বাঁদিক থেকে নেমে আসা এক ঝরনা বয়ে চলেছে রাস্তার উপর দিয়ে তীব্রবেগে। ওটা পেরোতে গিয়ে হর-কি-দুন ট্রেকে সাঁকরি থেকে তালুকা যাওয়া মনে পড়ছিল। আরও একটু এগোতে ঘন জঙ্গলের মাঝে এক সবুজ ছোট্ট বুগিয়াল হাজির হল আর তার সামনেই অপূর্ব সুন্দর নতুন কল্পগঙ্গা ব্রিজ।
পেরোতে গিয়ে ২০১৩-য় ধ্বংস হয়ে যাওয়া পুরনো রাস্তা আর ব্রিজের অবশেষ চোখে পড়ল। এমন আবেশমাখানো সবুজ আর অপার শান্তির সহাবস্থান আগে দেখি নি। কল্পগঙ্গা যার পৌরানিক নাম হিরণাবতী, তার বয়ে চলা আর পাখির শব্দ ছাড়া একটাই চেনা শব্দ পাচ্ছিলাম, মন্দিরের ঘন্টার। ওই ভাইব্রেশনে যেন চিরকালীন মহাবিশ্বের শাশ্বত রেজোন্যান্স 'ওম' বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কয়েকশো সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছে গেলাম মন্দিরে।
পুরাণ অনুসারে ভীমের সঙ্গে যুদ্ধের পর শিবের জটা পড়েছিল এখানে। সেই জটারূপী মহাদেবের পূজা হয় পঞ্চকেদার যাত্রার পঞ্চম কেদার কল্পেশ্বরে (২১৩৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মন্দির)। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে এই জটারূপী পাথরটা একেবারে আসল জটার মত দেখতে এক বিরাট গ্রানাইট 'Monolith' (একটাই একক পাথর)।
পাথররূপী শিবকে ছুঁয়ে হলুদ-চন্দন মাখিয়ে মন ভরানো পুজো দেবার পর পুরোহিত নেগীজি জানালেন যে এখানেই আছে সেই কুন্ড যেখান থেকে মহাদেব সমুদ্রমন্থনে জলদান করেন এবং সৃষ্টি হয় 'চৌদ্দটি অমূল্য রত্নের'। এবার ফেরার পালা। পথে দেখা হল কল্পেশ্বর থেকে রুদ্রনাথ ট্রেকের রাস্তার গেট আর উরগমের 'ধ্যান বদ্রী' মন্দির। একযাত্রায় তিন কেদার আর এক বদ্রী। মন্দ কি?
ফেরার সময় ততটা কষ্ট হলনা। আগে থেকেই রাস্তার আন্দাজ ছিল। মাঝখানে আধঘণ্টায় ঘুরে আসা হল ধ্যান বদ্রী মন্দির। ফেরার পথে টের পাওয়া গেল খিদের টান। রাস্তার ধুলো বেশ এপেটাইজার এর কাজ করছিল। আর কিছুক্ষণ। পিপলকোটি অবধি পৌঁছে লাঞ্চ করে ইন্দ্র বিদায় নেবে। ওখান থেকে যোশীমঠ এক ঘন্টাও না। ওদের GMVN বুক করা আছে। আমাদের নেমে যাওয়া রুদ্রপ্রয়াগ অবধি। দেখা যাক কোথায় গিয়ে শেষ হয় আজকের মত পথ চলা।
P.S: কল্পেশ্বরে গাড়ি থেকে নেমে বনেটে হেলান দিয়ে বিড়ি খাচ্ছে ভাণ্ডারী। বন্ধুরা "উফ কি অসাধারণ জায়গা" বলছে আর শব্দ পাচ্ছি একের পর এক ক্যামেরার শাটারের। আমি জিজ্ঞেস করলাম - কি? যাবে না পুজো দিতে? বলল - হ্যাঁ যাব, এত কাছে এসেছি একটা কেদার দেখেই যাই। এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করলাম বাড়িতে কে কে আছে? বলল বউ একা থাকে তিনটে বাচ্চাকে নিয়ে। দুই মেয়ে এক ছেলে। ভারী চিন্তায় আছে, কারণ বউ চতুর্থ সন্তান গর্ভে ধারণ করে আছে এখন। তাই বিপদের আশঙ্কায় বারবার বাড়িতে ফোন করছে হেডফোন লাগিয়ে। বলার সময় মাথাটা নুয়ে দৃষ্টি চলে গিয়েছিল মাটির দিকে। ব্রিজে উঠব, সামনে থেকে চারটে খচ্চর আসছে মালপত্র নিয়ে। সরে দাঁড়ালাম। ভাণ্ডারী বলে চলেছে। যতদূরের ট্রিপ হোক না কেন মালিক মাসে ৫০০০ দেয়। ভেবেছিল আমাদের ট্রিপ শেষ করে জলদি বাড়ি ফিরবে। সে ছমাস ওই ভাড়ার গাড়ি চালায়, ছমাস বন্ধ। কিন্তু মাইনে পায় পুরোই। তাই সে বেশি দাবি করে না, পাছে এটাও যায়। বলতে বলতেই কখন এগিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। থেমে গিয়ে তাকিয়েছিলাম নদীর দিকে। ভাবছিলাম আমরা কত মজা করেছি ওকে নিয়ে। মুসৌরির কোন এক নাম-না-জানা কাঠের বাড়ির মাটির উঠোন তখন চোখে ভাসছে। সন্ধে হবে হবে। সদ্যধরানো কাঠের জ্বালের উনুনের ধোঁয়া চোখে এসে লাগল। সানগ্লাস ভারী কাজের জিনিস।
"এতদিন বলোনি তো রূপকথা লিখবে
পাশের পাড়ায় ঘুড়ি ওড়ায় যুবরাজ,
আমার জন্য বাড়ি ফেরো ঘামে ভিজে?
রাত করে, হাতে নিয়ে তারার সাজ..."
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_মনখারাপের_১৫
#ফিরে_আসার_পাঁচকাহন
#পাহাড়_মাখা_ধুলো
সব চরিত্র বাস্তবিক(?)
পিপলকোটির আগেই হেলাং এ দুপুরের খাওয়া সারা হবে। আজ এক বন্ধুকে বিদায় জানানোর দিন। খাওয়ার পরেই ইন্দ্রকে ছেড়ে যাওয়া। ওর বাবা-মা আসছেন। তবে ওনাদের গাড়ি অনেক পিছনে। এই অবধি পৌঁছতে অন্ততঃ ঘন্টা পাঁচেক লাগবে। তাই ও এখান থেকে জোশীমঠ গিয়ে GMVN-এ রেস্ট নেবে। সবাই খেতে বসলাম। আমি আর জয় রুটি। জয়ের শরীরটা একটু খারাপ। জ্বর এসেছে। বাকিরা মিক্সড থালি। ইন্ডিয়ার খেলা হচ্ছে টিভিতে। সবারই মন একটু খারাপের দিকে। দুই মেয়ের বাপ - সুদীপ আর দেবজিত-এর মন টিকছে না আর। এবার ফিরতে পারলে বাঁচে। দেবজিতের মেয়ে এক্কা বাবার সাথে ভিডিও কলে কথাই বলল না। মায়ের হাত ঠেলে সরিয়ে দিল। বিপদ সঙ্কেত। সুদীপের মেয়ে মোহর অবশ্য ছোটো আরও। সে বাবাকে দেখছে নাকি কাকে বুঝতে না পেরে ফোনটায় খাবলা মারল। সৌনিপের কোনও বিকার নেই। তার চোখে পাহাড়ের আফিম। তিন বছরের বেশি পাহাড় ছেড়ে রয়েছিল, তাই কোনোদিকে তাকাবার তার মন নেই। ইন্দ্র বারবার ফোন করছে। আমারো কোন পিছুটান নেই এখনো অবধি। নেই নয়, আছে অল্প। সন্তান নেই, তবে বড় বড় দুই বুড়ো শিশুকে ঘরে রেখে এসেছি যারা মেট্রোর টাইমটেবিলের মত অবুঝ।
হ্যাঁ। পাহাড়ের গল্প শেষ। এবার ফেরার গল্প। আর কিছু ইন্টারেস্টিং নেই। সব একঘেয়ে। ফেরাগুলো যেমন হয় আর কি। একপেশে বক্সিং ম্যাচের মত। মার খেতে খেতে নক আউট। একটু আগে ইন্দ্র নেমে গেল। ওর রুকস্যাক আর পুজোর প্রসাদের ঝোলা আমরা নামিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে হেলাং-এর খাবার দোকান থেকে কেনা এক পেটি জলের বোতল থেকে দুটো। বুঝে নিয়েছি টাকার হিসেব, ফেরত দিয়েছি প্রাপ্য। এখন পিছনে হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারছি বেশ। তবু কেন পিছনের দরজার কাচ দিয়ে 'না আর দেখবই না' দৃষ্টি বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। ছেড়ে আসা রাস্তা কাছ থেকে দূরে যেতে যেতে হিমালয়কে ছুঁয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনখারাপ হচ্ছে কি? সামনে বসেছে ভান্ডারীর পাশে দেবজিত। কোলে ব্যাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। ট্রেক পোলগুলো গাড়ির মেঝেয় গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। ধপ করে জলের বোতলটা পড়ে গিয়ে জয়ের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। সৌনিপেরও জ্বর জ্বর। ক্রোসিন দিলাম। হাতে মাথা দিয়ে ঘুমোলো সে। বাইরে তখন মাঝদুপুরের ঝিম। রোদের অত্যাচার সইতে না পেরে তার মা তাকে আচ্ছা করে কানমলা দিয়েছে। তার চোখে বাষ্প। পাহাড়ের গায়েও তার ছাপ। পেরিয়ে গেলাম সেই একলা গাছ। চোখের মণির মত তাকে মাঝখানে রেখে। আগেরবারে গাড়ি দিয়ে এঁকেছিলাম ওপরের পাতার কাজল, এবার নিচের পাতাটা এঁকে দিয়ে যাচ্ছি। রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছতে অন্ধকার হবে।
চা-তেষ্টা পাচ্ছে। ভান্ডারীকে বলতে বলল রাস্তায় এক দোকানে খাওয়াবে বলে রেখেছে ফোনে। সেখানে তার এক দোস্তও দাঁড়াবে। আড্ডা হবে কিছুক্ষণ। রাস্তার ধুলোর সঙ্গে ভিজতে চাওয়া পাহাড়ের পাতলা কুচি কুচি বাষ্প মিশে গাদা গাদা অ্যামিবয়েড এঁকে রেখেছে গাড়ির জানালায়। চামোলি পেরিয়ে দেখা হল জ্যামে আটকে থাকা কাকিমাদের গাড়ির সঙ্গে। কাকু আমায় চিনতে পেরে হাত নাড়লেন জানলা দিয়ে। কাকিমা হেসে মোবাইল বের করলেন দেখলাম, ছেলের কাছে ফোন যাবে এবার। সে খবর দিয়েছে অনেক আগেই পৌঁছে গেছে জোশীমঠে। রাস্তা পেরিয়ে চোখে পড়ল চা-দোকানের হাল। পাহাড়ি ঢালে অর্ধেক ঝুঁকেথাকা একটা বয়স্ক ঝুপড়ি। আরেকটা গাড়ি থেকেও কিছু বয়স্ক মহিলা পুরুষ নেমে একটা খাটিয়ায় বসে আছে। সামনে বস্তায় রাখা আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, শিকড়বাকড়। সব দোকানীর নিজের ক্ষেতের। যদি কিছু বিক্রি হয় এই আশায় সাজিয়ে রাখা। দুটো কালি আর চারটে দুধবালি চায়ে অর্ডার দেয়া হল ছ'জনের জন্য। পয়সা বের করতে গিয়ে মনে পড়ল একটা দুধ-চা ক্যান্সেল করতে হবে। আমরা এখন পাঁচজন। মনের পেন্ডুলামে আরেকটা জোরে টোকা মেরে কেউ অসিলেশন বাড়িয়ে দিল। একজন কম, একজন কম। দিন নিভে আসছে হুট করে। ফেরায় কি ঘা শুকোয় নাকি রক্ত পড়ে বেশি? এখনও বুঝিনি।
রুদ্রপ্রয়াগ ঢোকার আগে জানা গেল প্রয়াগ দেখা হবে না। এখন বাইপাস দিয়ে ওয়ান ওয়ে। আমাদের নদী ক্রস করে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সিটির বাইরে কোথাও থাকতে হবে। গাড়ির ভিতর থমথম করছে। একটা কথাই ঘুরে ফিরে আসছে ইন্দ্র থাকলে ভালো হত। ওর মত মজা করতে আমরা সত্যি কেউ পারিনা। একটা ড্রাগ উইথড্রয়াল রিহ্যাব-এর মত পরিবেশ। একটার পর একটা গাড়ি চলেছে লাইন দিয়ে। হেডলাইটের কাটাকুটি আর চোখ মারামারি চলছে। পিছনের দরজার জানালায় আলো পড়ে ভান্ডারীর সিটে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছায়া পড়ছে দেবনাগরীতে লেখা "ভান্ডারী বন্ধু"-র, সঙ্গে Mob. 9536385841-এর পরের লেখাগুলো উঠে গেছে। ঠিক ধ্বসে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তার মত। এখানে এখন চারধাম প্রজেক্টের রাস্তা হচ্ছে। ধুলো পাক খেয়ে উঠছে। সৌনিপ আর জয় গল্প জুড়েছে অনেকক্ষণ পর রুদ্রপ্রয়াগের বিখ্যাত ম্যানইটার চিতার শিকার কাহিনি নিয়ে। জিম করবেট কিভাবে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে সাহ্সিকতার সঙ্গে তাকে হত্যা করেন তার রোমহর্ষক বর্ণনা। নদী পেরোলাম। গাড়ি এসে থামল প্রথমদিন যাওয়ার সময় যেখানে লাঞ্চ করেছিলাম সেই হোটেলে। কিন্তু দামে বা ঘরে পোষালো না। তাই আরেকটু এগিয়ে হোটেল "সাংগ্রি লা"। সুন্দর এক ফোর-বেড রুমে ঠাঁই মিলল রাত্রিবাসের। কাল হরিদ্বার।
P.S.: হেলাং এ খেতে বসার আগে সুদীপকে দেখছিলাম। বাইরে পাতা চেয়ারে বসে ভিডিওকল করছিল মোহরকে। ফোন রাখার পরেও তাকিয়ে স্ক্রিনের দিকে। কখনও কখনও আমরা বুঝে পাইনা মায়া আগে, নাকি মুক্তি। এই সাতদিনে টাগ-অফ-ওয়ারে মুক্তি এগিয়ে ছিল। আজকের দিনটা আলাদা, আজ মায়া টানছে গায়ের জোরে। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ি বৈঁচি থেকে থাকার বাড়ি রামপুরহাটে আসার সময় ষ্টেশনের কাঠচাঁপা গাছ থেকে পড়ে থাকা ফুল কুড়োতাম। একটু পরে শুকিয়ে যাবে জেনেও। ফেরার গন্ধ কি কাঠচাঁপার মত?
"লুকিয়ে রাখি ঘাস বাঁদিকের বুকপকেটে
কিছুতো একটা সবুজ থাক,
দলছুটের সালতামামি শেষ হলে
যদি পারিস, তোর দলে আমায় রাখ"।
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_১৬_কলা_পূর্ণ
#খেল_খতম_পয়সাও_খতম
#চলো_রে_ভক্তোঁ_বদ্রীনাথ_ধাম
(অন্তিম পর্ব)
আর বেশি জ্বালাব না। এই শেষ। এটা একটু বড় করে লিখে নিই, তারপর আর না। এবার খতম, দি এন্ড, যাকে বলে ফুল খাল্লাস। আগের পর্বটা নাকি বেশ মনখারাপের ছিল? মামা-ভাগ্নে পাহাড় এর মামা বা ভাগ্নে কোন পাথরটা বড় জানিনা, সেইটা নাকি বুকের উপর চেপেছে অনেকের। তা বাপু আমি কী করব, মন আমাদের সবার খারাপ ছিল। সেটাই লিখেছি। পড়ে কার কী হল তার দায় আমার না। যাই হোক, ঘটনায় আসি।
তো আমরা 'সাংগ্রি লা' হোটেলে বডি ফেললাম। চারবেড রুম হাজার টাকায়। ম্যানেজার জানাতে ভুলল না সিজনে এই রুম তিনহাজার নেয়। যাইহোক খাসা ব্যবস্থা। দুটো বড় বড় ছয় বাই সাত খাট। খাটের মাথার দিকে উঁচু তক্তাটায় আবার প্যাড দেয়া। যাতে ঠুকে গেলে ব্যথা না লাগে। তবে এই বড় দুখানা খাটের ঘরে খাটে প্যাডের কী প্রয়োজন বুঝলাম না। যাই হোক মাথা না ঘামানোই ভালো, মাথার ঘামের অনেক দাম, পায়ে ফেলার মত কিছু রাখতে হবে নাহলে রোজগার হবে না সৎপথে। রাতের খাওয়া চমৎকার। রুটি, চিজ দেওয়া ছোলা, আলুর দম। সবাই যে যার মত ফোনে ব্যস্ত। নেট আছে। খুললেই টুং টাং মেসেজ। ভান্ডারী দেখলাম খুশিতে। এবার বাড়ি ফিরবে সে, পরিবারের কাছে। কে জানে বাড়ি ফিরে ছোট মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে কোথায় চরতে বেরোবে। সকালে তাড়াতাড়ি বেরোবে জানিয়ে সে বিদায় নিল। আমরা রাস্তায় হালকা পায়চারি করে দূরের টিমটিমে আলোয় সাজানো পাহাড়ের গায়ে রাতের রুদ্রপ্রয়াগ দেখে ঘরে ফিরলাম।
সকাল সাতটায় বেরোনো। আজ কথা আছে দেবপ্রয়াগে একটু থামা হবে। আগেরদিন প্রয়াগ ভালো করে দেখা হয়নি। যদিও ভাণ্ডারী বলেছে বেশি সময় দিতে পারবে না। ছটায় তৈরি হয়ে নিচে নেমে দেখি ওই সকালে ঠাণ্ডায় একটা পাতলা ফুলহাতা গেঞ্জি পরে ভান্ডারী গাড়ি ধুচ্ছে পরম মমতায়। মনে হল অনেকদিন পর যেন তার পোয়াতি বউকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে মনভরে। আমরা এক কাপ করে চায়ের অর্ডার দিয়ে বসলাম। চা খেয়ে বেরোনো হল সাতটা কুড়িতে। রাস্তা ভালো গাড়ি ছুটছে হুহু করে। শ্রীনগর পৌঁছে ব্রেকফাস্ট করা হবে। আজ সবাই ভালো মুডে। বলা হয়নি। গতকাল আসার সময় সন্ধ্যেবেলা ভাণ্ডারীর ভক্তি উছলে পড়ছিল। তাই সে ভক্তিগীতি চালিয়েছিল গাড়িতে। আজো সেগুলোই চলছে রিপিট মোডে। তার মধ্যে সেরার সেরা অলিভেরা হলঃ "চলো রে ভক্তোঁ বদ্রীনাথ ধাম"। কি সব এপিক এপিক গান- "দুনিয়া চলেনা শ্রীরাম কে বিনা/রাম কি চলেনা হনুমান কে বিনা", "এয় দ্বারপালোঁ/কনহাইয়া সে কেহদো/মিলনে সুদামা গরীব আ গয়া হে", "মাতা শেরোঁবালি/উঁচে ডেরোঁবালি/বিগরে বানায়ে মেরা কাম/নাম রে"...ইত্যাদি প্রভৃতি এইসব গান অনেক্ষণ চলছিল। মাঝখানে একবার নেমে আমি হ্যাল খেয়ে বেশ জোরেই গাইছিলাম –"চলো রে ভক্তোঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ...", পাশ থেকে একটা নেড়ি মুখ উঁচিয়ে ভেঙিয়ে দিল-"ভৌ উঁ উঁ উঁ...", গাড়িতে উঠেই সুদীপকে বললাম, ভাই কুমার শানু চালা।
শ্রীনগর ঢুকলাম নটার পর। খিদেয় পেটে হারকিউলিস ডন মারছে। একটা খাসা রেস্টুরেন্ট দেখে গাড়ি থামালো ভান্ডারী। আজ ইন্দ্র নেই। তাই কেউ আর বলল না, "থোড়া আগে চলিয়ে"। পানসি ভিড়ে যেতে নেমে পড়ল বনিকের দল। আমি মশলা ধোসা আর বাকিরা লুচি আর চানা নিল। দেখলাম আরেকটা টেবিলে ইন্ডিয়াহাইকস-এর একটা দল নতুন ট্রেকের রেকি করে ফিরছে। সন্ধ্যা আর আশীষকে চিনতে পারলাম কিন্তু কথা বলা হল না। আমাদের আগেই ওরা বেরিয়ে গেল। পেটপুরে খেয়ে সম্বরের ঢেঁকুর তুলে গাড়িতে উঠলাম। ইঞ্জিন অন হতেই বেজে উঠল "ম্যায় দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা/তেরি চাহত মেঁ"। গানটা শুনতে শুনতেই লিখছিলাম #যা_দেখি_তাই_লিখির পর্ব-৩ #মিসিং_ডায়রি।
এরপর আর কিছু না। সরলরেখার সাথে মাঝে মাঝে জটিলরেখার পথ মিলে মিশে নেমে আসা। বাঁদিকে সবুজ আলকাতরা মেখে পাশে পাশে চলেছে অলকানন্দা। একটা বাঁক ঘুরতে দেখি সামনে রাস্তার কাজের জন্য গাড়ি খিদে পাওয়া শুঁয়োপোকার মত আস্তে আস্তে ধুলো খেতে খেতে চলেছে। বাঁদিকে নেমে গেছে গভীর গর্জ। দুটো পাহাড় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। তাদের মাঝখানে আকাশ যেন পাতলা বাঁশের বাখারিতে বসতে গিয়ে মাঝখান থেকে ভেঙে ফেলেছে, আর কেটে গিয়ে হিমোসায়ানিন মাখা ডিপ নীল রক্ত বেরোচ্ছে। এদিকে এক মাথায় ঝুড়িভর্তি পাথরঅলা ধুলোমাখা ঘাঘরা চোলির মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে কাঁধের সেলাই খুলে যাওয়া ঝ্যালঝেলে ফুলহাতা শার্টের হাতের গামছা। তাকিয়ে থাকা যায়না এমন ভালো চাওয়ার দিকে বেশিক্ষণ, নিজেকে খালি লাগে। ভাগ্যিস ভালোবাসা কিনতে পাওয়া যায় না শপিং মলে। ভাগ্য ভালো গাড়ি ছুটল। কষকষে প্রেম-মাখা চোখ-তাকিয়ে খেয়ে কাগজটা চেটে নিয়ে পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলাম জানলা দিয়ে মনে মনে।
নেক্সট স্টপ দেবপ্রয়াগ। ঠিক প্রয়াগের জায়গায় এখন একটা সুন্দর দোতলা ভিউপয়েন্ট হয়েছে। ভান্ডারীর কাছে পনের মিনিট সময় চেয়ে নেমে এলাম। যতই দেখি আর ছবি তুলি মন ভরে না কিছুতেই। নিচে নদীর পাড়ে কোন এক দেহের আগুন সমাধি হচ্ছে। পোড়া মানুষের গন্ধ নিয়ে পাক দিয়ে উঠে আসছে সাদা ধোঁয়া। যাক, মিশে যাক পাহাড়ের গায়ে পড়ে আসা সময়ের নামতা মুখস্ত বলে। উঠে এলাম। যন্ত্রের মত গাড়িতে বসলাম। হাইওয়ে বেয়ে ছুটল "ভান্ডারী বন্ধু"। দেড়টা নাগাদ ব্যাসী এলাম। সেই যাওয়ার সময় জল খাবারের দোকানেই থালি আর স্যান্ডুইচ ভাগ করে খেয়ে উঠে এলাম। মন আর মন-এ নেই।
হৃষীকেশ-এ নামা হল দেবজিতকে লছমন ঝুলা আর বিদেশিনী দেখানোর জন্য। আমরাও মাঝখানে দু-একটা বিকিনি বেবস দেখে চোয়াল ঝোলাইনি বললে সরাসর ঝুট হবে আর আমি কালো কাউয়ার কামড় খেতে নারাজ। লছমনঝুলায় লোকের কালো মাথা, খান দশেক গরু, কিলো বিশেক গোবর, বাঁদরের সার্কাস দেখে, খান সতেরো কনুই, কুলফি মালাই আর ঘটিগরম খেয়ে গরমে কুলকুল ঘামতে ঘামতে পার্কিং লটে ফিরে এলাম। এবার সোজা হরিদ্বার।
হরিদ্বারে বলার মত ঘটনা কিছুই নেই। পিওর ল্যাদ, ক্লিশে কিন্তু অভ্যেসে দাদা বৌদির দোকানের নিরামিষ খানা খেয়ে, ঘরের লোকেদের দাবিমত হাবিজাবি কিনে কোমরভাঙার ব্যবস্থা করে, সুদীপের নাকডাকার আওয়াজে ঘুমোতে না পেরে ব্যাটাকে মার্ডার করার ইচ্ছে চেপে রেখে, ভোরভোর দিল্লির জন্য জনশতাব্দী ধরে লাগেজ রাখার জায়গা না পেয়ে বাংলায় ঝগড়া করে কেটে গেল। অতঃপর দিল্লি এসে রিটায়ারিং রুমে স্নান, দোকানের ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন খেয়ে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম এবং বনগাঁ লোকালের মত মারামারি করে রাজধানীতে ওঠা। লাগেজ সামলে বসে কয়েক দান টোয়েন্টি-নাইন খেলে বোর হয়ে গিয়ে বারবার "চলো রে ভক্তোঁ", "দুনিয়া চলেনা", "এয় দ্বারপালোঁ" ইত্যাদি গাওয়া এবং ইউটিউব দেখা এবং হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া করতে করতে কখন হাওড়া পৌঁছলাম মালুম হল না।
P.S: এরপরেও ভাবছেন পুনশ্চ আছে? জি হাঁ। কলকাতা নেমে প্রিপেড ট্যাক্সিতে চেপে যখন হাওড়া ব্রিজে উঠছি ডিরেক্ট অফিস যাব বলে তখন কে কী ভাবছিল জানি না, আমি ভাবছিলাম বাড়ি গিয়ে মাকে দেখতে পাব। একেই বলে ভেতো বাঙালির অ্যাডভেঞ্চার, বাড়ি থেকে বেরিয়েও আনন্দে কাঁদে, বাড়ি ঢুকেও। উফঃ। শেষ, আপনারা বাঁচলেন আমিও।
"তীর বেগে ছুটে আসে সময়
ভাঙা বারান্দার শার্সি আর ধুলো মাখা রোদকুচি বেয়ে,
সাজিয়ে রাখো মরশুমি স্মৃতির তাক অযত্নে-
শুধু আয়না থাক তোমার পথ চেয়ে ।"
- সমাপ্ত -
~ কেদারের আরও ছবি ~
জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার টেকনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন পাহাড়ে না গেলেই ডিপ্রেশনে ভোগেন। ট্রেকে বেরোলেই ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। কিন্তু ফিরে এসে লিখতে বসলেই আবার ল্যাদ খান। তবে এর পরেও কষ্টেসৃষ্টে যেটুকু লেখেন তা স্রেফ ''আমাদের ছুটি'-র জন্যই। বাড়িতে চমৎকার রুটি বানান। মাঝেমধ্যে রান্না করতেও ভালোবাসেন।