বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।

 

['সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত' –এই ভ্রমণকাহিনিটি ধারাবাহিকভাবে বেরোত প্রবাসী পত্রিকায় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে। লেখক শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায় বিশেষ পরিচিত কোনও নাম নয়। আজকের ইন্টারনেট-গুগুল ম্যাপ-ইন্সটাগ্রাম-ফেসবুক লাইভ যুগের তরুণ-তরুণীদের জন্য এখানে রইল প্রায় একশো বছর আগের কয়েকজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি তরুণের ভ্রমণকথা।]

 

সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত

শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়


পূর্বপ্রকাশিতের পর -

২০ শে অক্টোবরঃ - সকাল সাতটা। কুয়াশায় চারিদিক্ অন্ধকার। আকাশ পরিষ্কার হ'লে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়্লাম আস্তানার খোঁজে। রাস্তায় কোথা থেকে পুলিশ এসে পাক্ড়াও করলে। সমস্ত খোঁজ-খবর নেওয়া হ'লে তাদের কাছ থেকে আমরা খবর নিয়ে এখানকার মিলিটারী একাউন্টসের শ্রীযুক্ত চুণীলাল মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ীতে হাজির হ'লাম।
শিয়ালকোটে যে ক্রিকেট ব্যাট, পোলো-খেলার ছড়ি প্রভৃতি খেলাধূলার সরঞ্জাম তৈয়ারী হয় সে-কথা বোধ হয় সবাই জানেন। জম্মু এখান থেকে মাত্র ৩১ মাইল দূর। জম্মুর এত কাছে এসে আবার পাঞ্জাবে এক রাত কাটাতে মন চাইলে না। সেজন্য বেলা তিনটের সময় জম্মুর পথে সাইকেল চালিয়ে দেওয়া গেল।
সহরের সীমানা ছাড়িয়ে বাঁ দিকে চাইতেই দেখা গেল দূরে, বহুদূরে বরফে-ঢাকা সাদা পাহাড় সূর্য্যের আলোয় ঝলমল করছে। তার পায়ের নীচের দিগন্তবিস্তৃত অসীম মাঠের যেন আর শেষ নেই। এরই কোণ ঘেঁসে সাদা রংয়ের সরু পথটি জম্মুর দিকে চ'লে গেছে। কয়েক মাইল পরে এই পথের ওপর এক লোহার প্রকাণ্ড ফটকের মাথায় ইংরেজীতে বড় বড় ক'রে লেখা আছে - হল্ট (Halt)। এইখানে গাড়ী ঘোড়া মোটরের জন্য মাশুল আদায় হয়। কয়েকটি মোটর ফটকের এদিকে দাঁড়িয়ে ষ্টেটের কর্ম্মচারীদের কাছে মাশুল দিয়ে ছাড়পত্র সংগ্রহ করছে। আমরাও নেমে' পড়ে' অপেক্ষা করতে লাগলাম - কখন্ আমাদের ডাক পড়ে। কিন্তু আমাদের দিকে দেখেও কেউ মনঃসংযোগ করা দরকার মনে করলে না। অগত্যা আমরা আর মিছামিছি দেরী না ক'রে সাইকেলে উঠে পড়্লাম। ক্রমশঃ পথটি ঢালু হ'য়ে হঠাৎ এক নদীর ধারে এসে' পড়্ল।

ঢালু রাস্তা থেকে ওপরে উঠে একটা বাঁক ফিরেই আমরা একটি প্রকাণ্ড পর্ব্বতশ্রেণীর সুমুখে এসে পড়্লাম। সুবিশাল হিমালয়ের এক শ্রেণীর গায়েই জম্মু সহর। সবুজ রংয়ের পাহাড়ের গায়ে জম্মুর সাদা সাদা অসংখ্য মন্দির যেন ছবির মতই সুন্দর। জম্মুর মন্দিরের চূড়াগুলি পিতলের পাতে মোড়া। এই চড়াইয়ের উপরে উঠে দেখা গেল, জম্মুর পিছনে অসংখ্য পাহাড়ের শ্রেণী - তাদের মাথা গিয়ে আকাশ ঠেকছে। এইখান থেকে হঠাৎ চড়াই সুরু হ'ল। এই পাহাড়-পর্ব্বত পার হ'য়ে শ্রীনগরে পৌঁছতে হবে। রাস্তার নমুনা দেখে বোঝা গেল, এইবার এই পথ দিয়ে পাড়ি লাগান বাস্তবিকই একটু শক্ত ব্যাপার। জম্মু ক্যান্টনমেন্ট্ বেশ বড়। সহর ও ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে তাউই নদী। তাউইয়ের ওপর তারের ঝোলান পুল। এই পুল পার হ'লেই জম্মু সহর।
সহরে ঢুকেই শ্রীনগরের পথ কেমন তাই দেখবার জন্যে সবাই ঝুঁকে পড়ল। সেইজন্যে শ্রীনগরের রাস্তায় খানিকটা এগিয়ে গেলাম। পথটি সহরের বাইরে দিয়ে বরাবর দুই মাইল চলে' গিয়ে রামনগর রাজপ্রাসাদের সুমুখ দিয়ে কাশ্মীর অভিমুখে গেছে। এই দুই মাইল পথ সবটুকুই চড়াই। রামনগর জম্মু সহরের সীমানা ও সহরের মধ্যে সব-চেয়ে উঁচু জায়গা। এইখান থেকে আবার সহরের মধ্যে ফেরা গেল। এবার বরাবর উৎরাই। চোখের নিমেষে তাউইয়ের ঝোলান পুলের সামনে এসে পড়্লাম। সহরের ভেতরে যেতে বরাবর চড়াই আর এদিকে আসতে হ'লে বরাবর উৎরাই। এখানকার পথ-ঘাট অতি সুন্দর। বাজার-হাট পাথর দিয়ে বাঁধান। কলের জলের কোন ট্যাকস্ নেই, মহারাজ বারমাস প্রজাদের জল দান ক'রে পুণ্য সঞ্চয় করেন।
আমরা ধর্ম্মশালা বা সরাইয়ের খোঁজ নিতে ব্যাগ্র হ'য়ে পড়লাম। ধুতিচাদর পরা একটি ছেলেকে এদিকে আসতে দেখা গেল। এগিয়ে জিজ্ঞাসা কর্লাম, "ভাই, এখানে কাছাকাছি সরাই-টরাই কোথায় আছে বলতে পার?" "আপনারাই বুঝি কলকাতা থেকে এসেছেন?" "হাঁ সরাই বা ধর্ম্মশালা" - "আমাদের বাড়ী যাবেন না?" এরকম প্রশ্নে বেশ কৌতুক বোধ করলাম। বললাম "চল"। তাউই পুলের সাম্নে এক বাড়ীর সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ছেলেটি তাড়াতাড়ি উপরে চ'লে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে এক সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক নেমে এসে বল্লেন "এ্যাঁ, আপনারা - আজ্ঞে হ্যাঁ, কলকাতা থেকে আসচি, এখানে সুবিধা-মতন একটা জায়গা" - "আচ্ছা আচ্ছা সব বন্দোবস্ত হ'য়ে যাবে, ভেতরে আসুন।"
আজ মোট ৩১ মাইল আসা হয়েছে। মিটারে উঠেছে ১৪.৮। ২১, ২২, ২৩ ও ২৪শে অক্টোবর। - জম্মু মাত্র ১৫০০ ফুট উচ্চ ও কাশ্মীর ষ্টেটের শীতকালের রাজধানী। শীত কাশ্মীরের চেয়ে অনেক কম। মহারাজ প্রতাপ সিং এর মৃত্যু উপলক্ষ্যে এখানে এখন সব প্রকার আমোদ-প্রমোদ বন্ধ, এমন-কি বাড়ীতে গান-বাজনা পর্য্যন্ত বারণ।
২১শে সকালে জম্মুর রাস্তা লোকজনে পরিপূর্ণ। সকলেই উদ্গ্রীব হ'য়ে শ্রীনগরের পথের দিকে মৃত মহারাজের শবাধারের জন্য অপেক্ষা কর্ছে। বার জন সৈনিক শবাধারে রক্ষিত ভস্ম শ্রীনগর থেকে বহন ক'রে হরিদ্বারে নিয়ে যাবে। এই দীর্ঘপথ এক এক দল পদাতিক, অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ সৈন্য মৃত মহারাজার প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শনের জন্য শ্রীনগর থেকে বরাবর হরিদ্বার পর্য্যন্ত সামরিক প্রথায় শবাধারের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।
জম্মুর বিজলীঘরের বৈদ্যুতিক শক্তি জলের সাহায্যে উৎপাদন করা হয়। চেনাব নদী থেকে এই উদ্দেশ্যে জম্মু অবধি একটি খাল কেটে আনা হয়েছে। এই খালের জলকে আবার জলসেচ কাজেও লাগান হয়।

জম্মুতে স্কুল কলেজ লাইব্রেরী এমন কি ছোট খাট একটি মিউজিয়মও আছে।* লোকদের পোষাক-পরিচ্ছদ পাঞ্জাবীদের মতই। এরা নানা প্রকার উজ্জ্বল রংয়ের পোষাক পরতে ভালবাসে। এখানকার অধিবাসীরা বেশীর ভাগই হিন্দু, ডোগরা, রাজপুত শ্রেণীর ও বেশ সুশ্রী। মেয়েরা চালাক চতুর ও স্বাধীন ভাবাপন্ন। জম্মু থেকে একদিনের পথ ত্রিকুটা দেবী এ-অঞ্চলের নামজাদা তীর্থ। পাঞ্জাব থেকে প্রতিবৎসর অনেক যাত্রী ত্রিকুটায় তীর্থ করতে আসেন। মেয়েদের উৎসাহ এবিষয়ে বোধ হয় সব দেশেই বেশী। তাঁদের মধ্যে অনেকে এই দুর্গম গিরিপথ টোঙ্গার অভাবে অশ্বারোহণে অতিক্রম করছেন।
*এখানকার ডাক-বিভাগ গভর্ণমেন্টের কিন্তু টেলিগ্রাফ অফিসগুলি ষ্টেটের।

বাঙালীর সংখ্যা জম্মুতে খুবই কম। তাঁদের প্রায় সকলই এখানকার বিশিষ্ট কর্ম্মচারী। একজন বাঙ্গালী মহিলাও নিজে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করেন। মোবারক মণ্ডি বা পুরাতন রাজপ্রাসাদের কাছেই কাশ্মীরের ষ্টেট কাউন্সিলের সিনিয়র মেম্বর ঋষিবর মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ী। ইনি পূর্ব্বে মহারাজের প্রধান জজ ছিলেন।
এইখানে আমাদের গরম কাপড়-চোপড় না আসা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করতে হ'বে। জম্মু-শ্রীনগরের পথ রাওলপিণ্ডির পথের চেয়ে দুর্গম ও সম্প্রতি তৈরী হয়েছে বলে' রাওলপিণ্ডির পথের মত ভাল বন্দোবস্ত এখনও হ'য়ে ওঠেনি।
শ্রীনগরের দূরত্ব, চড়াই ও বনিহাল গিরিসঙ্কটের তুষারপাত ইত্যাদির উল্লেখ ক'রে সকলেই আমাদের এই দুঃসাহসিকতা থেকে বিরত হ'তে অনুরোধ করতে লাগলেন। গিরিপথের নানাপ্রকার কষ্ট ও তুষারপাতের বিভীষিকার কথা যতই শুনতে লাগলাম এ-পথ দিয়ে শ্রীনগর পৌঁছবার আগ্রহও ততই বাড়তে লাগল। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কেবল যথেষ্ট উৎসাহান্বিত করেছিলেন। এঁর সাহায্যেই আমরা এই পথের একরকম একটি মানচিত্র খাড়া করি। কোনো কাজ করতে বেরিয়ে কেবল বিপদের কথা শুনে' পেছিয়ে যাওয়া তিনি পছন্দ করতেন না। সেইজন্যেই বোধ হয় এ'র সঙ্গে আমাদের এমন ঘনিষ্ঠতা হ'য়ে উঠেছিল।
২৪শে সকালে আমাদের গরম কাপড়-চোপড় এসে পৌঁছল। এইজন্যেই আমাদের এই কয়দিন জম্মুতে আটকে থাকতে হ'ল। ক্রমাগত চারদিক্ থেকে 'নিরাশার সুর' শুনে মন বড়ই চঞ্চল হ'য়ে উঠেছিল। জম্মু আর যেন কিছুতেই ভাল লাগছিল না। আর দেরী না করে' পরদিন সকালেই যাতে রওনা হ'তে পারি তার যোগাড়-যন্ত্র করতে শুরু করে' দিলাম। কি করে' আমাদের এই অভিযানকে সফল করে' তোলা যায় সন্ধ্যাবেলায় তারই বৈঠক বসল।

২৫ শে অক্টোবর রবিবার। - বেশ পরিষ্কার সকাল। রামনগর প্রাসাদের সুমুখ দিয়ে শ্রীনগরের পথ। প্রাসাদের কিছু দূরেই জম্মু সহরের সীমানা। জায়গাটায় বেশ একটা লম্বা উৎরাই। এই উৎরাইয়ের মুখে একজন উর্দ্দিপরা পুলিস কর্ম্মচারী মাথার ওপর দু'হাত তুলে আমাদের থামাবার জন্য ইঙ্গিত করতে লাগল। নেমে পড়ে শুনলাম যে, আমাদের আবার ফিরে সহরের মধ্যে পুলিস অফিসে যেতে হ'বে। এদের হাতে পড়লে অনেকটা সময় বৃথা নষ্ট হ'বে ভেবে আমরা তাকে বুঝিয়ে নিরস্ত করতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু তার কাছে উর্দ্দুভাষায়, পাঞ্জা মারা হুকুমনামা দেখে সে আশা পরিত্যাগ করতে হ'ল। অগত্যা আবার সহরের মধ্যে পুলিশ অফিসে ফিরে এলাম। সেখানে মিছামিছি ঘন্টা দুয়েক বসিয়ে রেখে মামুলি নাম ধাম লেখার পর নিষ্কৃতি পেয়ে জম্মু থেকে দ্বিতীয় দফা রওনা হলাম বেলা ১০ টায়।
ছ' মাইল উৎরাইয়ের পর ছোট চটি নাগরোটা। এইবার গিরিপথের সুবিধা-অসুবিধা বেশ বুঝতে পারা গেল। মাথার ওপর থেকে পথের আশেপাশে এক-একটা প্রকাণ্ড পাথরের চাঙ্গড় বার হ'য়ে রয়েছে। মনে হয় বুঝি ঘাড়ে পড়ল। ঘন ঘন বাঁকের জন্য পথের অবস্থা কিছু বুঝবার উপায় নেই। লম্বা উৎরাই দিয়ে নামতে নামতে বাঁকের মুখে এসে বুকটা ছ্যাৎ করে' ওঠে; কি জানি ওদিকে কি আছে; কারণ প্রায়ই দেখা যায় যে, বাঁকের ওদিকে হয়ত পাহাড় থেকে ধস্ নেমে রাস্তা একেবারে বন্ধ হ'য়ে গেছে। সেরকম জায়গায় ঠিক সময়মত গাড়ী থামাতে না পার্লে দুর্ঘটনা অনিবার্য্য। আবার ও রকম দ্রুতগতিশীল সাইকেলকে হঠাৎ ব্রেক্ (Brake) ব্যবহার করে' থামানও বিপদ্জনক। তা ছাড়া পরে দেখেছিলাম যে, খুব লম্বা ঢালু পথে অনবরত ব্রেক্ ব্যবহার করলে সাইকেলের চাকা (Rim) ক্রমশঃ জখম হ'য়ে যায়।
নাদানি অপেক্ষাকৃত বড় চটী। এর উচ্চতা প্রায় ৫০০০ ফিট। দেশী ভাষায় সেইসব হোটেল বা দোকানকে বলে তন্দুর। নাদানি থেকে মাইল তিনেক পর ত্রিকুটাদেবীর মন্দিরে যাবার রাস্তা। ত্রিকুটাযাত্রীদের ভিড়ে চটী আজ সরগরম। যাত্রীরা সকলেই এখানে খাওয়াদাওয়া সেরে নিচ্ছে। চটীর শেষেই প্রায় সিকি মাইল লম্বা এক সুরঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গ পার হ'য়ে আমরা আবার সাইকেল চালিয়ে দিলাম। ক্রমাগত চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে বেলা প্রায় চারটার সময় উপস্থিত হ'লাম উদমপুরে। উদমপুর সহর রাস্তা থেকে প্রায় তিন চারশ ফিট উঁচু একটা বড় টিলার উপর। আজকে এইখানেই রাত কাটাবার ব্যবস্থা ক'রে ফেললাম। এখানকার ইঞ্জিনিয়ার শ্রীযুত পতিরাম চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে জম্মুতেই আলাপ হয়েছিল। তাঁরই বাংলোর সামনে এক তাঁবুতে আস্তানা নেওয়া গেল। উদমপুরের উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফিট। জম্মু ১৫০০ ফিট; কিন্তু এই ১০০০ ফিট ওঠার জন্য আমাদের ৫০০০ ফিট পার হ'য়ে আস্তে হ'ল। আজকের দৌড়, মাত্র ৪১ মাইল; কিন্তু জম্মুর কয়দিনের ঘোরাঘুরির জন্য দেখা গেল মিটারে উঠেছে ১৪৫৬।

২৬ শে অক্টোবর, সোমবার। - তাঁবুর গায়ে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। কম্বল থেকে গলা বার ক'রে কানাতের ফাঁক দিয়ে আকাশের অবস্থা দেখে বড় নিরাশ হ'য়ে গেলাম। মেঘে সব পাহাড়ের ওপর একেবারে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় অন্ধকার। বনিহাল গিরিসঙ্কটে তুষারপাতের জন্য আমরা সর্ব্বদা সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছি। কাশ্মীর পৌঁছবার জন্য আরও আগে চেষ্টা করা উচিত ছিল। এই প্রচণ্ড শীতের ওপর যদি বরফ পড়তে আরম্ভ করে তবে হয়ত কাশ্মীর পৌঁছান সুদূরপরাহত হ'য়ে উঠবে। সেপ্টেম্বরের পর বনিহাল গিরিসঙ্কট দিয়ে এভাবে শ্রীনগর যাওয়া বড় বিপদজনক। এইসব কথা আমরা জম্মু থেকে শুনেছি। জম্মু থেকেও একরকম সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য ক'রে চ'লে এসেছি। এখানকার একমাত্র বাঙালী ও আমাদের আশ্রয়দাতা ইঞ্জিনিয়ার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ও বলছেন, এ চেষ্টা অন্ততঃ এ বছরের মত পরিত্যাগ করতে। চারদিক অন্ধকার, চুপচাপ, কেবল তাঁবুর কানাতে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ; প্রকৃতির কেমন যেন একটা নিরানন্দ ভাব। সময়ের দাম এখন আমাদের কাছে বড় বেশী। গিরিসঙ্কটে যে কোন দিন থেকে তুষারবর্ষণ সুরু হ'তে পারে। হয়ত আজকের দিনের এই ব'সে থাকার জন্য যে সময় নষ্ট হচ্চে সেই সময়টুকুর জন্য পরে আপশোষের সীমা থাকবে না; সেই সময়টুকুর অভাবই হয়ত বনিহাল-সঙ্কট পার হওয়ার অন্তরায় হ'য়ে দাঁড়াবে। অথচ এই বৃষ্টির মধ্য দিয়েই বা কি ক'রে অগ্রসর হওয়া যায়! আর এই দারুণ শীতে, ভিজা কাপড়-চোপড় গায়ে থাকলে ত সঙ্গে-সঙ্গে অসুখ, নিউমোনিয়া বা আর কিছু। এই রকম ভাবনার মাঝখানে চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তাঁবুর ভেতর এসে উপস্থিত হ'লেন; কথাবার্ত্তা সুরু হ'ল।
"দেখছেন ত! এ রকম দুর্য্যোগে আপনাদের আর অগ্রসর হওয়া উচিত হবে না।"
"এতদূর এসে পেছিয়েই বা যাই কি ক'রে বলুন?"
"কিন্তু কি ক'রে যাবেন? এ পাহাড়ে দেশের কিছু ঠিক নেই। এই যে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে হয়ত সাত আট দিন ছাড়বেই না। এ যেরকম দুর্য্যোগ দেখছি তাতে বোধ হয় বনিহালে বরফ পড়তে আরম্ভ হ'য়ে গেছে। আপনাদের এইরকম সামান্য শীতবস্ত্র নিয়ে যে কি ক'রে যাবেন তাও ত ভেবে পাচ্ছি না। এবার বরঞ্চ ফিরে যান।"
বিকাল চারটার সময় বৃষ্টি থামল। আমরা দেখ্লাম, এই সুযোগ। আর একটুও দেরী না করে' নিজেদের জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি করে' নিয়ে চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে একরকম দেখা না করে'ই বেরিয়ে পড়্লাম।

বেলা পাঁচটা। কোথায় চলেছি ঠিক নেই। মাথার ওপর দিয়ে দু'তিন পসলা বৃষ্টি হ'য়ে গেল। বড়বড় চড়াই। এ রাস্তায় সাইকেল চালান অতি কষ্টকর। তার ওপর উল্টা দিক থেকে ঝড়ের মত জোরে হাওয়া বইছে। সামনে-পিছনের কারু সঙ্গে কথা বলতে হ'লে চীৎকার ক'রে না বললে কিছু শোনবার উপায় নেই। প্রায় তের মাইল এই রকম হেঁটে সন্ধ্যার পর ধরমতল ব'লে একটা ছোট জায়গায় উপস্থিত হ'লাম। পাহাড়ের ওপর একটা টিলার মাথায় সরকারী বাংলো (Rest House) দেখে মনে মনে ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে সেইখানে ঢুকে পড়্লাম।
এই পাহাড়ের মধ্যে, নেহাৎ ছোট একটা গ্রামে একজন বাঙালীর সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমরা বড়ই উপকৃত হয়েছিলাম। শ্রীযুত গুরুদাস বিশ্বাস এখানকার ওভার্সিয়ার। তাঁরই অনুগ্রহে আমরা ঘরের ভিতর সারারাত চিমনী জ্বালাবার মত কাঠ পেলাম। এই দারুণ শীতে, ভিজে কাপড়ে রাত কাটাতে হ'লে বড়ই মুস্কিলে পড়্তাম। ওরই মধ্যে যেটুকু সুবিধা ক'রে নেওয়া যায় তাই ক'রে ফেললাম। আগুনের চার দিকে ভিজে জামা প্যান্ট সব শুকাতে দিয়ে, এবার কি করা যাব তারই আলোচনা সুরু করলাম। আকাশের অবস্থা বড়ই খারাপ। মনটা আরও যেন দমে' গেল। আজকের দৌড় ঐ ১৩ মাইল - মিটার বল্ছে ১৪৬৯।

২৭ শে অক্টোবর, মঙ্গলবার। - শীতের সকাল। মেঘে মেঘে আকাশ অন্ধকার। এত বৃষ্টির পরও আজ সমস্ত দিনেও যে বৃষ্টি ছাড়বে তার কোন লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে না। চারিদিক নিস্তব্ধ। এমন দিনে ঘরের ভেতর আগুন জ্বেলে ব'সে প্রিয়-পরিজনের সঙ্গে গল্পগুজব ক'রে কাটিয়ে দিতে বেশ ভাল লাগে। কিন্তু আমাদের মনের অবস্থা তখন অন্য রকম। সঙ্গে রসদ-পত্র খুবই অল্প, টাকার জোরে অনেক সাহায্য ও সুবিধা এই জনহীন দুর্গম স্থানে ক'রে নেওয়া যায়, সেই জোরও ক্রমশঃ কমে' আস্ছে। সুমুখে ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই পথ - শ্রীনগর এখনও ১৫২ মাইল দূর। আকাশের অবস্থা ক্রমশই খারাপ থেকে আরও খারাপ হ'য়ে আসছে। তার ওপর ক্রমাগত ঠাণ্ডা লাগার দরুণ ও ভিজে কাপড়ে থাকার জন্য সর্দ্দি-কাশিতে প্রায় সকলেই অল্প-বিস্তর ভুগছে। এ পথে যদি কারও অসুখ-বিসুখ হ'য়ে পড়ে তবে আর মুস্কিলের সীমা থাকবে না। উদমপুরের পর থেকে শ্রীনগরের আগে আর ডাক্তার বা হাঁসপাতাল কিংবা চিকিৎসা বিষয়ের কোন সাহায্য কোথাও পাওয়া যাবে না। বৃষ্টি-বাদলের জন্য অসুখ-বিসুখ হ'য়ে বা অন্য কোন কারণে যদি পথে কোথাও আট্কে পড়তে হয় তবে খরচ-পত্রের জন্য টাকা-কড়িও শ্রীনগরে পৌঁছবার আগে পাবার উপায় নেই। এইসমস্ত বিষয় ভেবে, সঙ্গে যা টাকা-কড়ি আছে তাতে দেখা গেল সকলের চলা অসম্ভব। অথচ এইসব কারণের জন্যে নিজেদের লক্ষ্য - এতদিনের পরিশ্রম ও অবিশ্রান্ত চেষ্টার পর যে ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসতে হ'বে - সে কথা ভাবতে গেলেও মন তাতে সাড়া দিতে চায় না বরং বিদ্রোহী হ'য়ে ওঠে।
ধরমতলের সেদিনের কথা (২৭শে অক্টোবর) অনেকদিন আমাদের মনে থাকবে। বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, পথঘাট জনহীন, চারদিক্ নিস্তব্ধ আর ঘরের ভিতর আগুনের চারপাশে আধভেজা আধশুকনো কম্বল জড়িয়ে শীতের হাত থেকে আমাদের পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা। কি ক'রে আমাদের উদ্দেশ্যকে সফল ক'রে তোলা যায়, গন্তব্য স্থানের এত কাছাকাছি এসেও এই অভিযান যাতে ব্যর্থ হ'য়ে না যায় - আর তার জন্যে এখন, এ অবস্থায় আর কি রকম চেষ্টা বা ত্যাগ স্বীকার করা দরকার তারই আলোচনা।
সব দিক্ দিয়ে দেখা গেল যে, আমাদের সকলেরই শ্রীনগর অবধি যাওয়া বর্ত্তমান অবস্থায় সম্ভবপর নয়। কাজে-কাজেই কে কে অগ্রসর হবে আর কে-ই বা ফিরে যাবে তাই নিয়ে এখন মুস্কিল বাধল। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে শেষে আনন্দ ও নিরঙ্কের জম্মু ফিরে যাওয়া আর মণি ও আমার শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া স্থির হ'য়ে গেল। এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হ'তে যে কত দীর্ঘ সময় তর্ক-আলোচনায় অতিবাহিত কর্তে হয়েছিল, জন-মানব-বিরল পাহাড়ে দেশের সেই ছোট ঘরখানায় যে, সে দিন কি উত্তেজনার সৃষ্টি ক'রে তুলেছিলাম তা আজও বেশ মনে পড়ে। আর এত পরিশ্রম, এত চেষ্টার পর গন্তব্যের এত কাছাকাছি এসেও যদি কাউকে দলছাড়া হ'য়ে ফিরে' যেতে হয় কেবল নিজেদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সফল ক'রে তোল্বার জন্যে, তবে তাদের সে ত্যাগস্বীকার করার যে কত দাম, তা আমাদের মত ভবঘুরেরা বেশ জানে। তবু, তারা সেদিন যখন সমস্ত ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝেছিল তখন আর ইতস্ততঃ করেনি কারণ, তারা জানত যে, এই অভিযানের ওপর আমাদের নিজেদের অনেক ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা নির্ভর করছে।
তারপর সুরু হ'ল জিনিসপত্র ভাগাভাগি করার পালা। আমাদের সঙ্গে ওষুধপত্র, দরকারী সাজ-সরঞ্জাম বেশী ক'রে নেওয়া হ'ল। গরম কাপড়-চোপড়ও ত বেশী ছিল না, তাই ওরা নিজেদের গা থেকে গরম সোয়েটার কামিজ খুলে আমাদের পরতে দিলে। বনিহালের তুষার-বর্ষণ ইত্যাদি মনে ক'রে অপেক্ষাকৃত গরম কাপড়-চোপড় আমাদের সঙ্গে নেওয়ার ঠিক ক'রে ফেল্লাম। ডবল ডবল জামা গায়ে দিতে আমাদের রোয়া-ফোলান কাবুলী বেরালের মত দেখাতে লাগল।
সারাদিন এই রকম উৎকন্ঠায় কেটে গেল। এ দিকের ব্যাপার কতকটা ঠিক হ'য়ে গেলে আকাশের অবস্থা নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা সুরু হ'ল। আজকের দিনটা বড়ই খারাপ ভাবে কাটল। কালও যদি বৃষ্টি না ছাড়ে, আকাশের অবস্থা যদি এই রকমই থাকে তখন কি করা হবে? এখানে যত দেরী হ'বে ওদিকে বনিহাল-সঙ্কট পার হওয়াও তত কঠিন হ'য়ে উঠ্বে। এখানকার আকাশের অবস্থা যখন এই রকম তখন বনিহালে যে বরফ পড়্তে সুরু করেনি সে আশা করাই অন্যায়। যদি আরও দু'দিন এই রকম বৃষ্টি হতে থাকে তবে ত বরফ পড়ার জন্যে বনিহাল পার হইয়াই সুদূর-পরাহত হ'য়ে উঠ্বে। এখন আমাদের সুমুখে মাত্র এক উপায় আছে। সে হচ্ছে যেমনই আকাশের অবস্থা থাক্ না কেন, বৃষ্টি ছাড়ুক বা না ছাড়ুক, এগিয়ে যাওয়া।
সন্ধ্যার পর ঠিক হ'য়ে গেল, কাল সকালেই আমরা বনিহালের দিকে অগ্রসর হ'ব। আর যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তবে ঐ সকালেই আনন্দ ও নিরঙ্ক জম্মুর দিকে ফেরবার জন্য বেরিয়ে পড়বে।

২৮ শে অক্টোবর, বুধবার। - ঘুম ভাঙবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলাম আকাশের অবস্থা কেমন দেখবার জন্যে। আঃ বাঁচা গেল! আকাশ পরিষ্কার, যদিও মাঝে মাঝে এখনও মেঘের যাওয়া-আসা রয়েছে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে রোদও দেখা দিয়েছে। কিন্তু আশে-পাশের পাহাড়ের চূড়া একেবারে বরফ পড়ে সাদা হ'য়ে গেছে। ঘরের চারদিকে চোখ পড়তে দেখা গেল অতদূরে কেন, যে টিলার মাথায় আমাদের ঘর তারও আশে-পাশে শ্যাওলার ওপর জায়গায় জায়গায় বরফ জমে' রয়েছে।
বেলা আটটার মধ্যে আমরা তৈরী হ'য়ে বেরিয়ে এলাম। এখান থেকে পত্নীটপ এই ১৭ মাইল বরাবর চড়াই। এপথে সাইকেল চলবে না, হেঁটে যেতে হ'বে। পত্নীটপ প্রায় ৭০০০ ফিট উঁচু। সেখান থেকে ২৪ মাইল উৎরাইয়ের পর রামবান। রামবানেই আজ রাত কাটান হবে এই রকম ঠিক করেছিলাম। ম্যাপে দেখা গেল, পত্নীটপের ১২ মাইল পর বটোথ ব'লে একটা ছোট জায়গা রয়েছে।
আর দেরী না ক'রে আমরা হাঁটতে আরম্ভ ক'রে দিলাম। পর পর দুটি বাঁক ফিরে দেখা যেতে লাগল জম্মুযাত্রীরা টিলার ওপর থেকে আমাদের দিকে চেয়ে ক্রমাগত টুপি নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। আর একটা মোড় ফিরতেই ধরমতল একেবারে আড়াল প'ড়ে গেল। এইবার এই নির্জ্জন পথে কেবল আমরা দু'জন।
মাইলখানেক যাবার পর বাঁকের ওপারে, রাস্তার ওপর একটা টাঙ্গা দেখতে পেলাম। কাছাকাছি এসে দেখা গেল, আমাদের পরিচিত উদমপুরের ইঞ্জিনিয়র চট্টোপাধ্যায় মশায়ই এই টাঙ্গার মালিক। আমাদের সঙ্গে চোখোচোখি হ'তেই বললেন -
"কি! আপনারা তা হ'লে কিছুতেই ফিরলেন না?"
"হ্যাঁ। ফিরলে আপনার ওখান থেকেই ফিরতাম। আপনি এখানে?"
"আমি এসেছি। আজই আবার মোটরে উদমপুর ফিরে যাব।"
তারপর চার পাশের পাহাড়ের মাথার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, "পাহাড়ের মাথা বরফ প'ড়ে সাদা হ'য়ে গেছে দেখছেন ত? এইখানেই এই, তা হ'লে আরও ওপরে কি রকম অবস্থা বুঝতে পারছেন না? হ্যাঁ তাইত! আপনারা শুধু দু'জন যে?"
"অনেক কারণে তাদের আর আসা –"
"তা বেশ ভালই হয়েছে। আপনারাও আমার সঙ্গে ফিরে চলুন। এই দুর্য্যোগে –"
"না, মাপ করবেন। আমরা যাব ব'লেই বেরিয়েছি।"
ভদ্রলোক আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখে বোধ হয় দুঃখিত হলেন ও যখন দেখলেন যে আমাদের ফিরে যাবার কিছুমাত্র ইচ্ছা নেই তখন বল্লেন, "আপনারা যখন যাবেনই, কিছুতে বুড়োর কথা শুন্লেন না তখন এক কাজ করুন। এ চড়াইয়ে ত আপনাদের হেঁটে যেতে হচ্ছে - একটা শর্টকাট রাস্তা আছে, হাঁটা পথ, ও পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হ'বে; তবে সুবিধে খুব। এই পথটা দিয়ে গেলেই আপনারা একেবারে পত্নীটপের মাথায় গিয়ে পড়বেন। তবে ও পথে সাইকেল ঘাড়ে ক'রে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।"
চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুগ্রহে কয়েকটি কুলী পাওয়া গেল। এরা পত্নীটপ অবধি আমাদের সাইকেল পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে। সেখান থেকে উৎরাই। সুতরাং পত্নীটপের পর আর বিশেষ গোলমাল নেই। যতই বৃষ্টি বাদল আসুক না কেন পত্নীটপ পৌঁছতে পারলে সেখান থেকে ২৪ মাইল উৎরাই, সাইকেলে বেশীক্ষণ লাগবে না। এই ভেবে মনটা প্রফুল্ল হ'য়ে উঠল। এই অপ্রত্যাশিত সাহায্য পেয়ে এ সময়ে বড়ই উপকৃত হ'লাম।
এবার আর রাস্তা-ঘাট কিছু নেই। আগে আগে সাইকেল ঘাড়ে কুলীরা, পিছনে আমরা। সোজা খাড়াই পাহাড় ডিঙিয়ে পথ। কুলীরা মাঝে মাঝে বিশ্রাম কর্বার জন্যে থাম্তে লাগল। লটবহর শুদ্ধ সাইকেল ঘাড়ে ক'রে পাহাড় ডিঙিয়ে চলা এ দেশের লোকের পক্ষেই সম্ভব।
এই দারুণ শীতেও ক্রমাগত উঁচুতে ওঠার জন্য ঘাম বেরিয়ে গেল। প্রায় পৌঁনে দু'ঘন্টা এই ভাবে চলে', একটা পাহাড় ডিঙিয়ে আমরা পত্নীটপ পাহাড়ের মাথায় (৭০০০) ফিট এসে উপস্থিত হ'লাম। রাস্তাকে আবার এইখান থেকে ধরা গেল। পাহাড়ের ঠিক মাথায় দু'শ ফিট জায়গা বেশ সমতল। তার ওদিক্ থেকে রাস্তা হঠাৎ এমন ঢালুভাবে নেমে গেছে যে, সে-পথ দিয়ে সাইকেলে নামা প্রথমটায় ত বড়ই বিপদজনক ব'লে মনে হয়। পত্নীটপ পাহাড়ের মাথার ঠিক যেখান দিয়ে রাস্তা চলে' গেছে তার আরও কয়েক শত ফিট ওপরে কাশ্মীর-জম্মুর মহারাজার ছাউনি (encamping ground) ফেল্বার প্রকাণ্ড সমতল ভূমি। মোটর চলন হবার পূর্ব্বে মহারাজারা জম্মু থেকে কাশ্মীর যাতায়াতের সময় এইসব জায়গায় সৈন্য-সামন্তদের সঙ্গে তাঁবু ফেলে থাকতেন। এই রকম ছাউনি ফেলে থাকবার জন্যে পাহাড়ের ওপর এইরকম সমতল জায়গা এই পথে আরও কয়েক জায়গায় দেখা গেল।
এইখান থেকে আমরা কুলীদের ফিরিয়ে দিয়ে আবার সাইকেলে উঠে পড়্লাম। সাইকেল ঢালু পথ দিয়ে ভীষণ জোরে গড়াতে আরম্ভ করলে। ঘন ঘন বাঁকের মুখে মোড় ফেরাবার জন্য দ্রুতগতিশীল সাইকেলের বেগ কমান এক বিপদজনক কাজ। হঠাৎ ব্রেক্ (Brake) ব্যবহার করলে ত আরোহীর সাইকেল থেকে ছিট্কে পড়ে' যাবার খুব বেশী সম্ভাবনা। রাস্তার গায়ে এক দিকে গগনস্পর্শী পাহাড়ের দেয়াল আর একদিকে বরাবর হাজার হাজার ফিট নীচু খাদ। সেইদিকে মাত্র তিন ফুট উঁচু পাথর রেলিংয়ের কাজ করছে। কোন রকমে সেই পাথরের বেড়া টপকালেই আর তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার দফা নিশ্চিন্ত। আর এইরকম দারুণ ঢালু পথে বাঁকের মুখে মোড় ফিরবার সময় খুব বেশী ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন হয়। এই সময় একটু অন্যমনস্ক বা ঢিলা হ'লেই হয় পাহাড়ের গায়ে বা পাথরের রেলিংয়ে সবশুদ্ধ ধাক্কা। না হ'লে সাইকেল শুদ্ধ পিছলে রেলিং টপকে নীচে পড়া অনিবার্য্য।

বটোথ (৫৬০০ ফিট) পত্নীটপের মাথা থেকে ঠিক ১২ মাইল দূর। এই ক'মাইল রাস্তা এমন ঢালু যে বটোথ আসতে আমাদের মাত্র পঁচিশ মিনিট সময় লেগেছিল। এইভাবে সাইকেল চললে রামবান আর আধঘন্টারও পথ নয়। তা হ'লে আজ রামবানে পৌঁছান সম্বন্ধে আর কোন মুস্কিল হবে না। এই রকম মনে করছি এমন সময় বটোথ পুলিস থানার সামনাসামনি দেখলাম, পথের ধারে একটা উঁচু জায়গায় দু'জন কনেষ্টেবল হাত তুলে' আমাদের থামবার জন্য ইঙ্গিত করছে। অগত্যা নেহাৎ অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক দূর থেকে আস্তে আস্তে ব্রেক্ কসে' গাড়ী থামিয়ে ফেল্লাম। জম্মুর মত এখানেও আবার সেই ধরণের জিজ্ঞাসাপড়া শেষ হ'য়ে গেলে আবার ঢালু পথে গাড়ী চালিয়ে দিলাম। রামবানের আগেই চেনাব নদী। চেনাব পার হ'য়ে রামবান (২৫০০ ফিট) পৌঁছলাম ঠিক সন্ধ্যার আগেই। পুলের ওপর দিয়ে পার হ'বার জন্য আমাদের কয়েক আনা শুল্ক দিতে হ'ল।
উদমপুরে রামবানের ইঞ্জিনিয়র পণ্ডিত জীরালাল সোফরীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ইনি আগে থেকেই আমাদের নিমন্ত্রণ ক'রে রেখেছিলেন। আমরা সেইখানেই রাত্রের মত উঠে পড়্লাম। তা ছাড়া আর-একটা দরকারী কাজ ছিল - সে হচ্ছে বনিহাল চটী থেকে বনিহাল পাস সম্বন্ধে একটা পায়ে হাঁটা-পথের সন্ধান নেওয়া। বনিহাল থেকে রাস্তায় এর দূরত্ব পড়ে ঠিক কুড়ি মাইল। বরাবর খাড়া চড়াই। সে পথে সাইকেল চলবে না হাঁটতে হ'বে। কুড়ি মাইল হেঁটে চলা সারা দিনের ধাক্কা। বনিহাল-পাস থেকে আরও বার মাইল নীচে গেলে তবে ওপর মুণ্ডা। ওপর মুণ্ডার আগে এই ৩২ মাইলের মধ্যে মাথা গোঁজবার মত কোনো জায়গা নেই। কিন্তু বনিহালের কয়েক মাইল পর টাকিয়া থেকে ধরমতল পত্নীটপের মত আর-একটা পায়ে-হাঁটা পথ আছে। এই পায়ে হাঁটা পথে গিরিসঙ্কট মাত্র দু'মাইল। তবে এই দু'মাইল বরাবর সাইকেল ঘাড়ে ক'রে ওঠা ভিন্ন কোন উপায় নেই। ওদিকে কুড়ি মাইল পথ হেঁটে পাসের ওপর পৌঁছতেই প্রায় সন্ধ্যা হ'য়ে যাবে। তারপর আর বার মাইল নীচে গেলে তবে আশ্রয় পাবার মত জায়গা। যদি এই পথ ঠিক সময়ের মধ্যে অতিক্রম করতে না পারি তবে ত রাত্রে সেইখানেই বরফের মধ্যে জমে থাকতে হবে। এই সব ভেবে আমরা অধিক কষ্টকর কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম দূর, এই হাঁটা পথের সাহায্যে গিরিসঙ্কট পার হ'ব এই রকম স্থির করেছিলাম। এই শর্টকাট রাস্তার সন্ধান জম্মুর আশুবাবু আমাদের দিয়েছিলেন।
কিন্তু এই পথ দিয়ে যাওয়া স্থানীয় কুলীদের সাহায্য ব্যতীত সম্ভব নয়। প্রথমত পদে পদে রাস্তা হারাবার সম্ভাবনা। তারপর এই দু'মাইল খাড়া চড়াই পাহাড়ের গা দিয়ে, সাইকেল কাঁধে ক'রে ওঠা সেও আর এক বিষম ব্যাপার। এখানে লোক যোগাড় করা বিদেশীর পক্ষে শক্ত ব্যাপার। কাজে কাজেই ইঞ্জিনিয়র সোফরী সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ ক'রে যা হোক্ ঠিক করা যাবে এই মনে ক'রেই সেইখানে উঠে পড়েছিলাম।
সোফরী সাহেব টাকিয়ার সাব্-ওভারসিয়ারের কাছে কুলী ঠিক করার জন্যে আমাদের একখানা চিঠি দিলেন। পথ সম্বন্ধে আরও অনেক খোঁজ-খবর এঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল। আজকের দৌড় মাত্র ৪৪ মাইলের, কিন্তু কতকটা পথ কুলীর ঘাড়ে সাইকেল আসার জন্য মিটারে উঠেছে ১৫১০ মাইল।

২৯শে অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। - বেলা সাতটা - তখনও কুয়াশায় চারদিক্ অন্ধকার, আমরা বেরিয়ে পড়্লাম। আজকে রাত্রিবাস হ'বে টাকিয়াতে। আজকের এই ত্রিশ মাইল পথ বরাবর চড়াই। হাঁটা ভিন্ন উপায় নেই।
এই পাহাড়ে পথের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। চার পাশেই পাহাড় কেবল মাথার ওপরে আকাশটুকু ফাঁক। তবে এ পথের জলের বন্দোবস্ত আছে। ক্রমাগত চড়াই উঠতে উঠতে মোটরে জল বদ্লাবার জন্য মাঝে মাঝে ঝর্ণা থেকে, জল বেঁধে রাখা হয়েছে। সেইসব জায়গা থেকে মাঝে মাঝে জল খেতে খেতে আমরা অগ্রসর হ'তে লাগলাম। সাইকেলকে টানতে টানতে বরাবর চড়াই উঠতে পরিশ্রম বড় কম হয় না। এই দারুণ শীতেও ঘন ঘন জল খেতে হচ্ছিল।
সমস্ত দিন পরিশ্রমের পর বেলা প্রায় চারটার সময় বনিহাল চটীতে (৬০০০ ফিট) পৌঁছলাম। পথে রামসু ব'লে একটা চটীতে কিছু খেয়েছিলাম। এ পথে দিগদল ব'লে আর-একটা চটী আছে।
বনিহাল বেশ বড় চটী। পীরপাঞ্জালের নীচেই বনিহাল। এই পীরপাঞ্জাল শ্রেণীর একটা চূড়ার ওপর বনিহাল গিরিসঙ্কট।
বনিহাল চটী বেশ সমতল জায়গার ওপর। এখান থেকে আর চার মাইল দূরে টাকিয়া। প্রায় সাড়ে তিন মাইল পর রাস্তার ওপর একটি পাহাড়ে নদীর সাঁকো; সেই সাঁকোর পাশ থেকে পাহাড়ের গা-বেয়ে টাকিয়ার হাঁটা পথ। এইখান থেকে আমরা লটবহর শুদ্ধ সাইকেল কাঁধে করে' টাকিয়া পৌঁছবার জন্য পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগলাম। রাস্তা থেকেই পাহাড়ের গায়ে টাকিয়া দেখা যাচ্ছিল, বোধ হয় আধ মাইলও নয়। কিন্তু এই পথটুকু আসতে আধ ঘন্টারও বেশী লেগে গেল।
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি সাব্-ওভারসিয়ার ও কয়েকটি কুলি নিয়ে এই বসতি। এদের রসদপত্র সব বনিহাল থেকে আনতে হয়। আমরা সাব্-ওভারসিয়ার মুকুন্দ সিংকে ইঞ্জিনিয়র সোফরি সাহেবের চিঠি দিলাম ও আমাদের অভিপ্রায় সব বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বল্লাম। ইনি অতিশয় ভদ্রলোক। বল্লেন, আপনারা যখন এতদূর আসতে পেরেছেন তখন আমার সাহায্যের অভাবে যে, আপনাদের এই অভিযান ব্যর্থ হবে না সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকুন। বলা বাহুল্য যে, অনেক দিন পর এরকম উৎসাহপূর্ণ কথা শুনে মনটা চাঙ্গা হ'য়ে উঠেছিল। আজকের পথে মাইল তিন চার সাইকেল করা গিয়েছিল বাকী সবই হেঁটে আসতে হয়েছে। দৌড় মোট ৩০ মাইলের - মিটার ১৫৪০।
৩০শে অক্টোবর, শুক্রবার। - খুব সকালে আমরা প্রস্তুত হ'য়ে পড়লাম। পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের অনুগ্রহে দেখি কুলী হাজির। ঘরের সাম্নে জায়গায় জায়গায় শিশির জমে সাদা হ'য়ে রয়েছে। আশপাশের পাহাড়ের গা একেবারে সাদা। কাল সব কাপড়-চোপড় শুদ্ধ কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালিয়েও কাঁপতে হয়েছে।
রওনা হলাম ন'টার পরেই। তখনও বেশ রোদ ওঠেনি। সাইকেল কাঁধে করে' চার জন কুলী আমাদের আগে আগে চলল। এ পথের আর কোন রকম বিশেষত্ব নেই; কেবল খাড়া চড়াই, হাঁটা পথ। মাঝে মাঝে একটা পাতলা মেঘের জাল আমাদের ঢেকে ফেলছিল। মনে হচ্ছিল যেন কাপড়-চোপড় ভিজে গেল। পাহাড়ের গায়ে গাছপালা কিছু নেই কেবল বড় বড় ধূসর রংয়ের শ্যাওলার চাপ। সেইসব শ্যাওলার ওপর জায়গায় জায়গায় তুষার প'ড়ে সাদা হ'য়ে রয়েছে। কুলীরা মাঝে মাঝে বিশ্রাম করার জন্য দাঁড়াতে লাগল। এই দারুণ শীতেও ভীষণ পরিশ্রম করার জন্য ঘাম হ'তে লাগল। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা আর ভেতরে কাপড়-চোপড় ঘামে ভিজে জল। বরাবর হাঁটতে পার্লে একরকম ভাল, কিন্তু একটু দাঁড়ালেই ভেতরে ভেজা জামার জন্য হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি লাগিয়ে দেয়। অথচ না থেমে ক্রমাগত এই রকম চড়াই ওঠার চেষ্টা কর্লে নিশ্বাস বন্ধ হ'য়ে আসে, মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম কর্তে থাকে। এই চড়াইটার খাড়াই খুব বেশী, ১৫ মাইল পথ ঠিক ২ মাইলে এসেছে।
প্রায় তিন ঘন্টা এইরকম পরিশ্রমের পর আমরা বনিহাল-সঙ্কটের কাছাকাছি এসে পড়লাম। মাথার কয়েক শত ফিট ওপরেই একটা পাহাড়ের চূড়ার দিকে দেখিয়ে কুলীরা ব'লে দিলে ঐ আমাদের গন্তব্য স্থান। বিস্ময় পুলকে মনটা দুলে উঠল। কারণ ঐখান থেকে বরাবর ঢালু পথ। ঐখানে পৌঁছলেই শ্রীনগর পৌঁছান সহজ হ'য়ে আসবে।
আরো কয়েক মিনিট পর আমরা একবারে বনিহাল-সঙ্কটের সামনে (১০০০০ ফুট) রাস্তার ওপর গিয়ে পড়লাম। সমুখেই সুড়ঙ্গ; ভিতর একেবারে অন্ধকার। সেই সুড়ঙ্গ পার হ'য়ে ওদিকে যেতে হ'বে। এইখান থেকে আমরা কুলীদের বিদায় দিলাম। এদের সাহায্য না পেলে এত শীঘ্র কাজ উদ্ধার হ'ত না। বেচারারা এত সরল ও নিরীহ প্রকৃতির যে, যাবার সময় আমাদের কাছ থেকে কিছু বকশিসও চাইলে না। যথা সাধ্য তাদের সন্তুষ্ট ক'রে তাদের ফিরে যেতে ব'লে দিলাম। সাময়িক সাহায্যের জন্য এদের কাছে আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।

বেলা ১২টা। ক' মিনিট দাঁড়িয়ে কথাবার্ত্তা বল্তেই ঠক্ ঠক্ ক'রে কাঁপুনি লাগিয়ে দিয়েছে। ডায়েরীর পাতায় দরকারী কয়েকটি কথা লেখার জন্য কলম ধরা দায়। হাত পায়ের আঙুল, নাকের ডগা চিন্ চিন্ করতে সুরু ক'রে দিয়েছে। ভেতরের কাপড়-চোপড় ঘামে ভিজে একেবারে ঠাণ্ডা কন্ কন্ কর্ছে। মণি অনেক চেষ্টা ক'রেও খাতার পাতায় কয়েকটি আঁচড় কাটতে পারলে না। তারপর আমার পালা। খানিকক্ষণ চেষ্টার পর নিজের হাতের লেখা নিজেই পড়তে পারলাম না। এমন কি শ্রীনগরে পৌঁছে সে লেখা বাংলা কি ইংরেজী সেই গবেষণা করতে হয়েছিল।
এইবার আমরা চলতে সুরু করলাম। অন্ধকার সুড়ঙ্গ চারদিক্ ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে। এক এক জায়গায় ওপর থেকে টপ টপ ক'রে জল পড়ছে। নিস্তব্ধ মিশকালো অন্ধকারের ভেতর আমরা দু'জন। কেবল আমাদের সাইকেলের ফ্রি হুইলের টিক্ টিক্ আওয়াজ। ক্রমশঃ সামনে থেকে ধোঁয়া ভরা ক্ষীণ আলো দেখতে পেলাম। বুঝলাম ঐখানে সুড়ঙ্গ শেষ হ'য়েছে। আরো দু'এক মিনিট পরেই আমরা একবারে সুড়ঙ্গ পার হ'য়ে রাস্তার ওপর এসে পড়লাম। সুড়ঙ্গের ওপরে খোদাই ক'রে লেখা A.D. 1920|660 ft.। এদিকে দৃশ্য একেবারে বদলে গেছে। চারদিক্ অন্ধকার; দশ গজ দূরে নজর চলে না। পাহাড়ের রং বরফে একবারে সাদা। পথের ওপর প্রায় চার ইঞ্চি তুষার পড়ে 'রয়েচে। আর ঠাণ্ডা যেন ওদিকের চেয়ে তিন গুণ বেশী। এই পীরপাঞ্জাল শ্রেণীর ওদিকে জম্মু প্রদেশ ও এদিকে কাশ্মীর প্রদেশ।
সঙ্গে কয়েকটি গরম কাপড়ের পট্টি ছিল। ঠাণ্ডার চোটে সেইগুলি এখন পা থেকে কোমর অবধি জড়িয়ে ফেললাম। শীতের জন্য আঙুল অবশ। যতই আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে লাগলাম ততই হাড়ের মধ্যে কন্ কন্ বোধ কর্তে লাগলাম। এখন কি করে' অগ্রসর হওয়া যায় সেই হ'ল সমস্যা। এই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ঢালু পথে বরাবর পনের কুড়ি মাইল পথ নামা বড় মুস্কিলের কথা। তুষার পাতের জন্য রাস্তা পিছল; যদি কোনরকমে দশ হাজার ফুট ওপর থেকে সাইকেলের চাকা পিছ্লায় তবে কোথায় কত নীচে ছিটকে পড়তে হ'বে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। সুতরাং মনে করলাম হেঁটেই চলা যাক্ - কুয়াসা কাটলে সাইকেলে চড়া যাবে। কিন্তু প্রায় মাইল খানেক হাঁটার পরও যখন কুয়াসা কিছুমাত্র কমল না, চারদিক্ সেই রকমই অন্ধকার তখন বাধ্য হ'য়ে সাইকেলে উঠতে হ'ল। কারণ, তখন ঠান্ডার চোটে অবস্থা কাহিল হ'য়ে এসেছে। মুখ, হাত আর মাথার মধ্যে চিন্ চিন্ করছে আর পায়ের তলা অসাড়।
ঘন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আগে পিছনে আমাদের সাইকেল ছুটে চলেছে। ঢালু রাস্তার জন্য সাইকেলের গতির বেগ ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্চে। প্রাণপণ ব্রেক্ কসেও তার বেগ কমান যায় না। টায়ারের পাশ দিয়ে গুড়িগুড়ি তুষার ছিটকে চোখে মুখে লাগছে। কানের পাশ দিয়ে ঝড়ের মত হাওয়ার গর্জ্জন। মাঝে মাঝে আমরা চীৎকার ক'রে পরস্পরের খবর নিচ্চি। আবার ঘন ঘন বাঁকের জন্য এক-এক জায়গা একবারে নিস্তব্ধ, বাতাসের লেশমাত্র নেই। সেখানে অন্ধকারের মধ্যে কেবল মিটারের ক্রমাগত টিক টিক শব্দ।
দশ মাইল পরের ওপর-মুণ্ডার বাংলো এখন আমাদের লক্ষ্য। ক্রমাগত ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর যেন অসাড় হ'য়ে গেল। প্রায় ন'মাইল এই ভাবে চলার পর কুয়াশা যেন কিছু হাল্কা হ'য়ে গেল। অস্পষ্ট আলোর ভেতর দিয়ে ক্রমশঃ পাহাড়ের গায়ের একখানি ছোট ঘর দেখা গেল। মণি চীৎকার করে ব'লে উঠল, "ওপর-মুণ্ডার বাংলো"।
এই পথটায় একটাও জন-প্রাণী দেখতে পেলাম না। তাই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, ঐ বাংলোর মধ্যে আবার লোকজন আছে। যাই হোক এখানে আগুন জ্বালাবার জন্য যথেষ্ট কাঠ পাওয়া গেল। খানিকক্ষণ আগুনের পাশে বসে' অনেকটা সুস্থ হ'য়ে উঠ্লাম। তারপর গরম গরম কয়েক পেয়ালা চা। এ রকম সময় এই জায়গায় যে পয়সার বিনিময়ে সাহায্য পাব তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কাজে-কাজেই এই সাময়িক সুবিধা ও সাহায্য পেয়ে নিজেদের খুব সৌভাগ্যবান ভেবে মনে মনে তারিফ করতে লাগলাম।
বেলা প্রায় দেড়টা। কিন্তু বাইরে এসে দেখলে মনে হয় বুঝি এই সবে ভোর হচ্চে। আব্ছা কুয়াশার ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা ক্রমাগতই নীচের দিকে নেমে গেছে। এখান থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব মোট ৫৯ মাইল। আরো খানিকটা উৎরাই, তার পর থেকে সমান রাস্তা সুরু হ'বে। বেলা দেড়টা, সুতরাং চেষ্টা করলে আজই শ্রীনগর পৌঁছান যাবে এই ভেবে আবার বেরিয়ে পড়লাম।
আকাশ পরিষ্কার। ঠিক তিন মাইল আসার পর একটা প্রকাণ্ড বাঁকের ওদিকে ঘুরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন মন্তরের চোটে চার দিকের পাষাণ প্রাচীর অদৃশ্য হ'য়ে গেল। পায়ের নীচের দিগন্ত বিস্তৃত চীর ও পাইনের শ্রেণীতে ভরা সবুজ শস্যশ্যামল সমতল ভূমির মাঝে রূপালি সূতার মতই সরু নদী খামখেয়ালী ভাবে ঘুরে বেড়িয়েচে। এর সীমানা নির্দ্দেশ করেছে দিক্চক্রবালের গায়ে বরফ-মাখা বিরাট্ পর্ব্বতশ্রেণী। এইসব অনন্ত-তুষারাবৃত পাহাড়ের গায়ে জায়গায় জায়গায়, সূর্য্যের আলো যে কত বিভিন্ন রকমের রং বেরঙের সৃষ্টি করেছে তার ইয়ত্তা নেই। পীরপাঞ্জাল শ্রেণী থেকে বিশ্ববিখ্যাত কাশ্মীর উপত্যকাকে এই রকমই দেখায়।

এর পরেই নীচু-মুণ্ডা (Lower Moonda) পার হ'য়ে কোয়াজিগন্দে এসে পড়লাম। এইখান থেকে সুন্দর, দুপাশে চীর গাছের সারি দেওয়া সমান রাস্তা সুরু হ'ল। অনেক দিন পর পাহাড়ে পথের কাছ থেকে পরিত্রান পেয়ে আমরা খুব শীঘ্রই খানাবলে এসে পড়লাম।
বনিহালের পর খানাবলই বেশ বড় চটী। এখানে অনেক রকম জিনিস পত্র মেলে। ডাক বাংলো, সরাই ইত্যাদি আছে। জম্মু থেকে যে পথ দিয়ে আমরা এতদিন এলাম সে-পথ এখানে এসে শেষ হ'য়ে গেছে। সে রাস্তার নাম বনিহাল কার্ট রোড (Banihal Cart Road)। এবার খানাবল থেকে যে পথ দিয়ে আমাদের শ্রীনগর যেতে হ'বে তার নাম শ্রীনগর অনন্ত নাগ রোড্। খানাবল এই রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়। এখান থেকে শ্রীনগর মোট ৩৫ মাইল দূর। রাস্তা ভাল, বেলা মোটে ৩টা; সুতরাং অনেক দিন পর আজ নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া-দাওয়া শেষ করা গেল।
রওনা হ'লাম বেলা চারটার সময়। বাকী পঁয়ত্রিশ মাইল রাস্তা যে কি ক'রে চ'লে এসেছিলাম তার কিছু খেয়ালই নেই। পথের ওপরেই পড়ল অবন্তীপুরার ধ্বংসাবশেষ। মাঝে মাঝে ছোটখাট গ্রামও দেখা যেতে লাগ্ল। এইসব ছাড়িয়ে আমরা বিজলী-বাতি-ওয়ালা পামপুর সহরে উপস্থিত হ'লাম। পামপুর জাফরাণের চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। রাস্তা থেকে কিছু দূরে জাফরাণের চাষও দেখা যেতে লাগ্ল। আর মাইল দশের মধ্যেই শ্রীনগর। ভাব্লাম অল্পক্ষণের মধ্যেই শ্রীনগরে উপস্থিত হ'তে পারব। কিন্তু আমাদের শেষ পর্য্যন্ত একটা-না-একটা মুস্কিলে পড়তে হ'বে বোধ হয় এই রকম কিছু কথা ছিল। সেইজন্য পামপুরের পরই হঠাৎ ২নং ষ্ট্যান্ডার্ড সাইকেলের ফ্রি হুইল (Free wheel) বিগ্ড়ে গিয়ে সাম্নে পিছনে দু'দিকেই নির্ব্বিকারভাবে ঘুর্তে সুরু ক'রে দিলে। মনে কর্লাম নিশ্চয়ই ভেতরের স্প্রিং কেটে এই অবস্থা হ'য়েছে। সেই জন্য এই অন্ধকারে আর সমস্ত খোলাখুলি করার হাঙ্গাম না ক'রে এই সাত আট মাইল হেঁটেই চ'লে যাওয়া স্থির কর্লাম। কিন্তু পর দিন শ্রীনগরে গিয়ে মেরামত করার জন্য সমস্ত খুলে দেখা গেল ভিতরে স্প্রিং ঠিকই আছে। ঠাণ্ডার চোটে ফ্রি হুইলের স্প্রিং ভেতরের ভেসলিনের সঙ্গে জমে' পাথরের মত শক্ত হ'য়ে রয়েছে। আর সেই জমাট ভেসলিনের মধ্যে স্প্রিং আটকে যাওয়ার দরুণ কোন কাজ করতে না পারায় এই বিপত্তি।
সাইকেলে শ্রীনগর প্রবেশ আর আমাদের দ্বারা হ'য়ে উঠল না। পাহাড়ের চূড়ার ওপরকার মন্দিরের তীব্র বিজলী আলো জানিয়ে দিলে আমরা সহরের খুব কাছে এসে পড়েছি। হাঁট্তে হাঁট্তে রাত প্রায় ন'টার সময় সহরের এলাকার মধ্যে প্রবেশ করলাম। এরই খানিকক্ষণ পরে সহরের এক প্রান্তে একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাংলোর সামনে আমাদের ঘন ঘন ঘন্টাধ্বনি শুনে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ব্যস্ত-সমস্ত হ'য়ে বেরিয়ে এসে বললেন -
"ওঃ আপনারা? এতদিন পরে? আমি রোজই আপনাদের expect করছি। আমার ছেলে এই সেদিনও আপনাদের কথা লিখেছে। তা আপনাদের আর দু'জন?"
বল্লাম - "অনেক কারণে সকলেরই আর আসা সম্ভব - "।
কাশ্মীরের চিফ্ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (Chief Electrical Engineer) শ্রীযুত ললিতচন্দ্র বসু মহাশয়ের সৌজন্যের বিষয় আর নূতন ক'রে লেখার কোন প্রয়োজন নেই। উত্তর ভারতে এঁর অতিথিপরায়ণতার কথা না জানে এরকম প্রবাসী বাঙালী অতি বিরল। ঘন্টা-খানেকের মধ্যেই আমরা যথেষ্ট আরামের রাজ্যে এসে পড়লাম –। কালকের রাতের সঙ্গে আজ কত তফাৎ। এই দিনের মত আরামে আর কখনও ঘুমিয়েছি কি না জানি না। আজকের দৌড় ৭২ মাইলের - মিটারে উঠেচে ১৬১২ মাইল।

শেষ
শ্রীনগরে তিন দিন কাটিয়ে ঝেলাম ভ্যালী রোড্ দিয়ে মারী পাহাড় (প্রায় ৭০০০ ফিট) পার হ'য়ে রাওলপিণ্ডি। সেখান থেকে দিল্লী আগ্রা হ'য়ে মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যার ভেতর দিয়ে সাইকেল আমাদের কলকাতা পৌঁছে দিয়েছিল ৩১শে ডিসেম্বর। সময়াভাব বশতঃ বাকী অংশটুকু আর এখন প্রকাশ করা সম্ভবপর হ'য়ে উঠল না। কলকাতা থেকে বার হ'য়ে এই পথ দিয়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসার জন্য আমাদের মোট ৪০১৪ মাইল পথ অতিক্রম করতে হ'য়েছিল।
সারা পথেই আমরা প্রবাসী বাঙালী অবাঙালীদের কাছ থেকে যথেষ্ট সহানুভূতি ও উপকার পেয়ে এসেছিলাম। তাঁদের সাময়িক সাহায্য ও সময়োচিত পরামর্শ না পেলে এই ভ্রমণ যে সুচারুভাবে শেষ করা যেত না, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। জম্মুর অধ্যাপক শ্রীযুত আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়, কাশ্মীরের ইঞ্জিনিয়র-দ্বয় শ্রীযুত পতিরাম চট্টোপাধ্যায় ও পণ্ডিত জীরালাল সোফরী, সাব্-ওভারসিয়র শ্রীযুত মুকুন্দ সিং ও দিল্লীর অধ্যাপক শ্রীযুত আশুতোষ বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি মহাশয়গণের কাছে এই 'অভিযান' বিশেষভাবে উপকৃত। এঁদের ও অপরাপর আর সব ভদ্রলোকের কাছে আমরা সকলে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিচ্চি। এই ভ্রমণ-কাহিনীর কথা মনে হ'লেই রবিবাবুর দু'লাইন মনে পড়ে যায় -

কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ঘরে দিলে ঠাঁই।
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।।

- সমাপ্ত -

(প্রবাসী, চৈত্র ১৩৩৩ সংখ্যা)

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ

[ মূলের বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher