ভাঙা মন্দিরের দেশ কাম্বোডিয়া

মলয় সরকার


~ পূর্বপ্রকাশিতের পর ~

চললাম বায়োন মন্দির দেখতে। সবুজ গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পিচঢালা প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে টুকটুক চলেছে। এদিকে বোধহয় ট্যুরিস্ট ছাড়া কেউ আসে না। আর এসময়টা খুব বেশি ট্যুরিস্টের ভিড়ও হয় না। কাজেই রাস্তায় দু-একটা ট্যুরিস্টের টুকটুক ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। আসল আংকোর থোম-এর চৌহদ্দির মধ্যে দক্ষিণদ্বার দিয়ে ঢুকলাম। মন্দিরনগরে এরকম কয়েকটি দ্বার আছে। প্রাচীনকালের তৈরি ভারী ভারী পাথরের। আর সর্বত্র হয় হাতির বা ওই সমুদ্রমন্থনের মূর্তি। এসে পৌঁছালাম বায়োন মন্দিরে।

বায়োন মন্দিরটি একেবারে সেন্ট্রাল আংকোর থোমে। এটিও বেশ বড়। এখন কাম্বোডিয়া দর্শনের অসময় হওয়ায় আমরা সৌভাগ্যবান, কোথাও ভিড় পেতে হয়নি। এই মন্দিরটি আসলে অনেক মন্দিরের সমাহার। একই চত্বরে বেশ কতগুলি মন্দির আছে। এটি কিন্তু বিষ্ণুর নয়, শিবের মন্দির। অর্থাৎ দ্বিতীয় সূর্যবর্মণের আগে এখানের রাজারা শৈব ছিলেন। মন্দিরে একটি বড় চূড়া, অন্যগুলি সেটিকে ঘিরে। সব চূড়াতেই বিশাল শিবের মুখ, চারদিকে চারটি এবং মাথায় একটি গোল চক্র। শিবের মুখগুলি, যেখানে যত মুখ আছে (পরে অন্যান্য মন্দিরেও দেখেছি, একেবারে একইরকম মুখ) স্মিতহাস, স্নিগ্ধ সৌম্যভাবের নিমীলিত নয়নের মূর্তি।

মূর্তিগুলি, দেখেই বোঝা যায়, বড় বড় পাথরের খণ্ড জুড়ে করা। অত ভারী ভারী পাথর টুকরো টুকরো অবস্থায় জুড়ে কী করে অত ওপরে তোলা হয়েছিল, নাকি ওপরে তুলে জোড়া হয়েছিল তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। আজও তা এত ঝড়ঝঞ্ঝা সয়েও দাঁড়িয়ে আছে! তবে ঠিকমত যত্ন না হওয়ার ফলে এবং বোধহয় বেলেপাথরের কারণে মন্দিরগাত্র সবুজ মসে ভর্তি, যা মন্দিরের ক্ষয়কে দ্রুততর করছে। প্রধান দরজা পেরোলেই একটি উপবিষ্ট বুদ্ধের মূর্তি আছে,যা সম্ভবত পরিবর্তিত শিবমূর্তি। দেওয়ালের খোদাই কাজগুলি দেখার মত। একটি কাজ দেখে মনে হল নটরাজের মূর্তি, সেই একই মুদ্রা, একই ঢং। এখা্নে আমরা পরিষ্কার একটি শিবলিঙ্গ দেখেছি, যোনিপটের উপরে। এছাড়া অনেক উৎপাটিত শিবলিঙ্গের গর্ত দেখেছি।

চূড়ার ওই বড় বড় মুখগুলো শিবের কিনা এ নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। কেউ বলেন ওগুলো রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণের, কেউ বলেন বোধিসত্ত্বের। এখানেও সেই একই ব্যাপার, অর্থাৎ বেশ উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপরে মন্দির এবং সেই খাড়াই উঁচু সিঁড়ি। ফলে এখানেও আলাদা কাঠের সিঁড়ির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তবে এখানে যে সমস্ত মন্দির রয়েছে সেগুলো মনে হল ঠিক গোছানো নয়। মন্দিরে ঢোকার মুখেই সিংহের মূর্তি হিন্দুত্বকেই প্রকাশ করে। কী করে আজকের বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া সেকালের মানুষেরা এই সমস্ত কাজ করেছিলেন কে জানে! অথচ আজকের বিজ্ঞানের এত উন্নতি সত্বেও টাইটানিকও ডোবে আর বড় বড় সেতুও ভাঙে। তাহলে কী আমরা সত্যি বিজ্ঞানে এগিয়েছি না পিছিয়েছি সেই প্রশ্নই মাথায় ঘুরতে থাকে।

আংকোর থোম শহরে বা তার আশেপাশে অজস্র মন্দির - সব দেখা বোধ হয় কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। দেখতে দেখতে একঘেয়েমি এসে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আমাদের গ্রামের পুরনো শিব মন্দিরের মত পরিত্যক্ত, ছড়ানোছিটানো জঙ্গলে ঢাকা ছোটখাটো মন্দিরও অনেক আছে। কাজেই প্রধান প্রধান মন্দিরগুলো দেখারই পরিকল্পনা নিলাম। শান্তশিষ্ট জায়গায় পরিষ্কার পিচঢালা রাস্তায় টুকটুক চেপে ঘন সবুজের মাঝ দিয়ে অল্প রোদে পিঠ দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে যেতে ভালোই লাগছিল।
রাস্তার ধারে নানা জায়গায় গাছের সঙ্গে বাঁধা বা লোহার স্ট্যান্ডে ঝোলানো দড়ির লম্বা দোলনায় কেউ কেউ শুয়ে বসে আছে। এরা যাযাবর নাকি দোলনাগুলো বিক্রির জন্য এনেছে ঠিক বুঝলাম না। টুকটুকওয়ালা ছেলেটির এমনিতে ব্যবহার ভাল কিন্তু এতটাই কম কথা বলে এবং ইংরেজি কম বোঝে যে তার কাছ থেকে যে বিশেষ কিছু জেনে নেব তা আর সম্ভব হচ্ছে না। বেশ কয়েকবার ভাব জমাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তা মাঠে মারা গেল।
বায়োন মন্দিরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম। যেতে যেতে দেখলাম 'বিজয় দরজা' বা ভিকট্রি গেট। খমের রাজ কোনো যুদ্ধ জয় করে এই দ্বার তৈরি করেছিলেন। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৩ কিমি করে বর্গাকার আংকোর থোম শহরে প্রবেশের মোট পাঁচটি প্রধান দরজা আছে। বায়োন মন্দিরকে ঠিক মাঝখানে রেখে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ চারদিকে চারটি ছাড়াও পূর্ব দিকে আছে আরো একটি। সেটি এই বিজয় দরজা। প্রত্যেকটি দরজাই মন্দিরের ঢংয়ে নির্মিত। বিশাল একটি শিবের (মতান্তরে বুদ্ধের) মুখসহ বেশ কয়েকটি হাতির মাথা আর পদ্মফুল এবং কয়েকটি চূড়াসহ বিরাটাকার পাথরের গেটগুলি প্রাচীনত্বের ছাপ নিয়ে আজও স্বমহিমায় বর্তমান ।
পৌঁছলাম আংকোর থোমের ঠিক বাইরে টা কেও মন্দিরে। মন্দিরে ঢোকার মুখেই ঘাবড়ে গেলাম, প্রবেশদ্বারের মাথায় যে পাথর তাতেই একটা ঠেকা দেওয়া আছে। ভয় লাগছিল, ভেঙে পড়বে না তো! গোটা গেটটাই লোহার ঠেকা দিয়ে রাখা আছে। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে সব হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবে। যাই হোক ঢোকা তো গেল। এখানেও সেই গেটের মাথায় একই স্মিতহাস্য প্রকাণ্ড মুখ।

একটা ছোট পরিখার ওপর দিয়ে ঢুকতে হল। ঢোকার দরজাগুলো বেশ ছোট এবং সরু সরু – অর্থাৎ একসঙ্গে বেশি লোক ঢুকতে পারবে না। সাপের মাথাওয়ালা রেলিং দিয়ে ঘেরা বাঁধানো পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে এগোনো গেল। সব মন্দিরই বেশ পু্রনো তবে পথঘাট-মেঝে একেবারে পরিচ্ছন্ন। বিশাল বিশাল গাছ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে মন্দিরটাকে। বেশি ভিতরে ঢোকা গেল না। সরকারি নোটিসও রয়েছে ঢুকতে মানা করে। মন্দিরের পাথরের দেওয়ালগুলো প্রচুর অপ্সরী নিয়ে এমন অবস্থায় আছে যে, যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। মন্দিরগাত্রে গজিয়ে ওঠা গাছগুলি এতই বড় হয়ে গেছে যে তাদের হাত থেকে মন্দিরকে উদ্ধারের বিশেষ চেষ্টাও করা হয় নি। বোধহয় সেটা আর সম্ভবও নয়। আমার তো মনে হল পঞ্চাশ-ষাট বছর বাদে সম্পূর্ণই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মনটা অদ্ভুত রকমের খারাপ হয়ে গেল।

বিশালাকায় এই স্তাপত্য একটি অসমাপ্ত শিবের মন্দির। এটি রাজা পঞ্চম জয়বর্মণ-এর রাজকীয় মন্দির ছিল। মন্দিরের কাজ অসমাপ্ত রেখে দেওয়ার সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে এটি বহুদিন নানা সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল । এর চারধারে করিডরগুলি দেখার মতো। যদি সম্পূর্ণ হত তবে এটি আংকোর থোমের একটি অপরূপ অলংকার হত। এরও মাথায় মেরু পর্বতের অনুকরণে পাঁচটি চূড়া আছে।

বেরিয়ে আবার টুকটুকের সওয়ারি হলাম। সে আমাদের নিয়ে ছুটল পরের মন্দির দেখাতে। সেটির নাম টা প্রম। বেশি দূরে নয়, কাছেই।

টা প্রম মন্দিরটি ১৯৯২তে ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকাভুক্ত পেয়েছে। ঢোকার মুখেই দেখি বড় বোর্ড লাগানো আছে যে ভারতের আর্কিওলোজিক্যাল সোসাইটি ও কাম্বোডিয়া সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় এখানে সংস্কারের কাজ চলছে। এটি সপ্তম জয়বর্মন দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি করেছিলেন মহাযান বুদ্ধ মন্দির ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে। মন্দিরটির বিশেষত্ব এই যে মূল অংশটি বৃক্ষের করালগ্রাসে এবং সেটি সেইভাবেই দর্শনীয় হয়ে আছে। দর্শনার্থীরা মন্দিরটিকে এইরকম বৃক্ষপরিবেষ্টিত বা শিকড়পরিবেষ্টিতরূপে দেখার জন্যই আসেন। হাঙর বা কুমির কোনো প্রিয়জনকে আক্রমণ করেছে এবং সেই নিদারুণ দৃশ্য নিশ্চেষ্ট হয়ে দেখতে হলে যে অনুভূতি হতে পারে, আমার অবস্থা তদ্রূপ। দুঃখে যন্ত্রণায় মন ভরে যাচ্ছে যে নিকট ভবিষ্যতের গর্ভেই হয়তো শেষ হয়ে যাবে এই অভূতপূর্ব স্থাপত্য। অথচ এই শিকড়ের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে গেলে এখন যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাও ধ্বংস হয়ে যাবে। উদ্ধারকারীর দল মন্দিরকে গাছের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার চেষ্টাও করেননি। গাছগুলি ঠিক বট বা অশ্বত্থ নয়, তবে ওই জাতীয়, গাছের গায়ে নাম লেখা দেখলাম 'ছম্বক'। বিশাল অজগর সাপের মত শিকড়ের চেহারা সত্যিই বিস্ময় জাগায়। মনে হল সভ্যতার অগ্রগতির পাশাপাশি বনরাজিকে নির্মূল করে মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। আবার সুযোগ পেলেই যে প্রকৃতি মানবসভ্যতাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে আপন অস্তিত্বকে যে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনবে এটাই তার প্রমাণ। বোধহয় এই অবস্থাকে প্রত্যক্ষ করার জন্যই অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় বেশি ভিড় এখানে। চতুর্দিকে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে প্রচুর পাথরের স্তুপ, যা এককালে মন্দিরের শোভাবর্ধন করেছিল।

যতদূর জানা যায় মন্দিরটি রাজা জয়বর্ধনের মাকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। এককালে আশিহাজার মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল এই মন্দির। প্রচুর করিডোর বা বারান্দা আছে, যেগুলি এখন প্রায় দুর্ভেদ্য এবং অপ্রবেশ্য। নানা বিদেশি সিনেমার শুটিংও হয়েছে এখানে। চতুর্দিকে গাছের পাতায় ঢাকা এই বিশাল মন্দিরে যেন এক দুঃখের সবুজ ছায়া একটা ভিজে ভিজে অশ্রুমাখা আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। ঝোপঝাড়ের জঙ্গলটুকু সরিয়ে মন্দিরটিকে দর্শনীয় করে রাখা হয়েছে। এখানকার বড় গাছগুলিকে আর সরানো সম্ভবও নয়। মন্দিরের এক-এক টনেরও বেশি ওজনের পাথরের একটিও যদি পড়ে যায়, যে কোনো মুহূর্তে এক মারাত্মক কাণ্ড ঘটে যাবে।

মন্দিরের অদূরেই এক দিঘি, পাথর দিয়ে বাঁধানো স্নানের ঘাট। রাজকীয় স্নানের এই দিঘির নাম শ্রা শ্রাং। প্রায় ৭০০ মি লম্বা আর ৩৫০ মি চওড়া বিরাট দিঘিটির মাঝে একটি দ্বীপ। এটি দশম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় বেশ সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। এখানে এসে মন কিছুটা তৃপ্ত হল। মন্দির দেখতে দেখতে খানিক ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। বিশেষ কিছু দ্রষ্টব্য না থাকলেও বসলাম দিঘির কাকচক্ষু শান্ত জলের দিকে তাকিয়ে সেই যুগটাকে মনে করে নিজেকে একটু চাঙ্গা করে নিতে। বাঁধানো পাড়ে বসে মানসচক্ষে দেখছিলাম রাজা-রানিদের জলকেলির দৃশ্য আর মাঝে মাঝেই হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে। এর কাছেই পাওয়া গেছে বেশ কিছু পারলৌকিক ক্রিয়ার কলস ও তাদের অবশিষ্টাংশ এবং একটি পারলৌকিক ক্রিয়ার স্থান। ভাবতে ভাবতে ভুলে যাচ্ছিলাম যে বেলা পড়ে এসেছে।

উলটোদিকেই আছে বান্তে কদেই। দৌড়লাম সেখানে। পাহারাদার বড় কড়া। বলল, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, আজকে আর ঢোকা যাবে না। সত্যি কখন যে সময় চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। তবু তার হাতে ধরে বললাম, এখনও তো বন্ধ হতে দশ পনের মিনিট বাকী, একটু গিয়েই চলে আসব। কী যেন ভাবল। বুঝলাম ঈশ্বর সহায়। বরফ গলল। বলল, যান তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন।

দৌড়লাম। এখানেও মন্দিরের ঢোকার মুখে সেই বিশাল মুখসহ দরজা। বেশ কিছুটা গাছে ঢাকা মোরামের রাস্তায় যাওয়ার পর একইরকম বিশাল পুরানো ধ্বংসপ্রায় মন্দির। তবে একটা জিনিস বারংবার লক্ষ্যণীয়, যেখানে ভাঙ্গাচোরা যাই থাক মন্দিরের সবকিছু একেবারে পরিচ্ছন্ন। কোথাও এতটুকু আবর্জনা নেই যা দেখে গা ঘিন ঘিন করবে। এত পুরোনো সব স্থাপত্য ভগ্নপ্রায় হয়ে গিয়েও সারা বিশ্বের পর্যটককে আকর্ষণ করছে বোধহয় এইজন্যই। আর আমাদের দেশে অজস্র দ্রষ্টব্য থাকা সত্ত্বেও ভ্রমণপিপাসুদের বড় অংশই সেদেশে আসেন না।

বায়োন মন্দিরের ঢঙে দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত বান্তে কদেই একটি বৌদ্ধ মন্দির। সম্ভবতঃ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আবাস ছিল এটি। বেশ কিছু পাথরের সিংহ আজও এই স্থাপত্য পাহারা দিয়ে চলেছে। নিম্নমানের পাথর দিয়ে তৈরি বলে দ্রুত নষ্ট হয়ে আসছে। তবে এটি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং বর্তমানে সংরক্ষণের কাজও চলছে।
সেই খালটির পথে ফিরলাম যার ওপর দিয়ে একসময় এই মন্দিরগুলি নির্মাণের পাথর বয়ে আনা হয়েছিল। খালের ধার বরাবর গাছ বা বসার জায়গা আছে অনেক জায়গাতেই। পারাপারের ছোট ছোট ব্রিজগুলিও বেশ সুদৃশ্য। শহরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত চলে গেছে এই খাল।
হোটেলে ফিরলাম। টুকটুকওয়ালা ছেলেটি বিদায় নিয়ে জানালো আবার কাল আসবে।

বিশ্রাম নিলাম খানিকক্ষণ। গতকাল কুলেন রেস্তোরাঁ থেকে ফেরার সময় দেখে এসেছিলাম পাশেই একটা রাস্তা আছে যেটা রাতকে প্রায় দিন করে ফেলেছে। তার নাম পাব স্ট্রিট। সেখানে ঝিং ঝ্যাং বিদেশি গান, নাচ আর পানীয়ের হুল্লোড়। প্রচুর ঠেলাগাড়িতে বিভিন্ন ধরণের আইসক্রিমের সম্ভার, ঠাণ্ডা পানীয়। খানাপিনার সঙ্গে রংবেরঙের আলোকসজ্জায় গোটা রাস্তাটাই যেন লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক-এর টাইম স্কোয়ারের কথা খুব মনে পড়ছিল। সারাদিন আংকোরভাটের ঘোরাঘুরির শ্রান্তির পর একটু মনের ক্লান্তি ঝরাতে পাবের, রেস্তোরাঁর কাম্বোডিয়ার সুন্দরীরাও ভীষণ তৎপর। স্পেশাল খমের ডিসের সঙ্গে বেশ সস্তা ঠাণ্ডা বিয়ার আর ককটেলে মনটাকে ভিজিয়ে একটু নেচে নিয়ে নিজেকে একটু আনন্দ দেওয়াই যায়। ঢুকলাম একটা নামী রেস্তোরাঁ, পেপার টাইগার ইটারি-তে। এখানকার সাজসজ্জা আর ট্রাডিশনাল খমের খাবারে মনোনিবেশ করলাম। বেশ ভাল লাগল রেস্তোরাঁটি, খাবারের দামও বিশাল কিছু নয়। সুন্দরীরা খাবার দিয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। এখানে নাচ-গানের ব্যবস্থা নেই্ তবে খমের খাবারের জন্য দোকানটি বিখ্যাত। শুকনো মাছ, শুকরের মাংস, নুডল খুব পছন্দের এখানের লোকজনের। ভাতও খায় তবে চালটা একটু আলাদা। মাছ এবং নারকেল দুধে তৈরি আমোক আর শুকরের মাংসভাজা লোক লাক এদের বিশেষ খাবার। নাম বান চোক বা খমের নুডল এক বিশেষ কাম্বোডিয়ান নুডল (এটার তৈরির পদ্ধতি পরে দেখেছিলাম), খেতে চমৎকার। নুডল সুপও বেশ ভালো। শুধু এই দোকান নয়, গোটা পাব স্ট্রিটটাই বেশ পরিচ্ছন্ন। নৈশবিনোদন শেষ হবে ভোর চারটেয়। পাশেই আছে নাইট মার্কেট। আমরা আর সেখানে যাইনি। তার বদলে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা কার্ট থেকে খেলাম ফ্রায়েড আইসক্রিম। নাম শুনে প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। আইসক্রিম আবার ফ্রায়েড হয় কী করে? দেখে বেশ লাগল – তাওয়ার মত একটা পাত্রের উপরে দুধ আর ফলের কুচি দিয়ে নিপুণ এবং দক্ষ হাতে সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে এই আইসক্রিম। বেশ লাগল খেতে। কয়েকটি দোকানে কাচের বেশ বড় গামলায় ছোট ছোট মাছ ঘোরাঘুরি করছে। আর সেই পাত্রের জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে দেশি-বিদেশি সুন্দরীরা। সকলের মুখে এক গা শিরশিরানি আনন্দের সুড়সুড়ির অভিব্যক্তি। কী ব্যাপার, কাছে গিয়ে দেখি, জলে ডোবানো পায়ের চেটোর চারপাশে মাছেরা ঠোকর দিচ্ছে। এই মাছগুলো নাকি চর্মভুক। পায়ের থেকে মরা চামড়া ঠুকরে খেয়ে নেয় এবং তার ফলে পা নাকি মসৃণ এবং সুন্দর হবে। এই ব্যবস্থা কয়েক বছর আগে তুরস্কে দেখেছিলাম। ভারতেও হয়তো আছে, তবে আমি কোথাও দেখিনি। রূপচর্চার কতরকমেরই কায়দা – দেখে আশ্চর্য হই।

এত রাতেও প্রচুর টুকটুক দাঁড়িয়ে আছে। তবে সওয়ারির তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি বলেই বোধ হল, যেমনটি আজকাল আমাদের এখানেও প্রচুর ই-রিক্সা হয়ে গেছে।
পরদিন সকালে স্নান সেরে আবার ঠিক সাড়ে আটটায় নীচে নেমে দেখি হোটেলের সামনে হাজির আমাদের গতকালের সারথি। তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে তাড়াতাড়ি প্রাতঃরাশ সারি। ভেবেছিলাম স্থানীয় কিছু খাব - কিন্তু হোটেলে গতানুগতিক কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট ছাড়া আর কিছু রাখে না। ওগুলো খেয়ে খেয়ে মুখে অরুচি ধরে গেছে। অগত্যা কী আর করা। বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকটা মশলা দেওয়া পুরভরা পরোটা নিয়ে গিয়েছিলাম। গতকালও তাই দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরেছিলাম। যা আছে আজও হয়ে যাবে । অতএব ও ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। খেয়েদেয়ে সওয়ার হলাম টুকটুকের। গাড়ি ছুটল সেই আগের রাস্তাতেই লোকালয় ছাড়িয়ে, খাল পেরিয়ে, বাজার ছাড়িয়ে। মনে হল যেন ছুটেছে মনপবনের নাও। সবুজের বন্যার মধ্যে দিয়ে ভেসে চলেছি আধো রোদ আধো ছায়াঘেরা ফাঁকা রাস্তায়, দু-একটি টুকটুক ছাড়া আর কিছু চলাচল করছে না। পাশে পড়ে রইল বিশাল দেহ আর সুউচ্চ চূড়া নিয়ে আংকোরভাট। আমাদের যাচ্ছি আংকোর থোমের ছোট বৃত্ত ছাড়িয়ে বড় বৃত্তের দিকে। সাউথ গেট ছাড়িয়ে বায়োন মন্দির পাশে রেখে উত্তরদ্বার দিয়ে বেরিয়ে পৌঁছলাম প্রিয়া খান-এ। নামিয়ে দিয়ে চালক বললেন, আপনারা এই গেট দিয়ে ঢুকে ওপাশের গেট দিয়ে বেরোবেন। আমি ওখানে থাকব।

প্রবেশদ্বারে কালকের সেই টিকিট দেখিয়ে এগোনো গেল। গেট থেকে মূল মন্দির বেশ কিছুটা দূরে। গাছেঢাকা রাস্তার পাশে কয়েকজন প্রতিবন্ধী মানুষ এক অদ্ভুত বাজনার সুর তুলেছে কিছু রোজগারের আশায়। দু-একজন হস্তশিল্পের পশরা সাজিয়ে বসেছে। তবে দাম আর জিনিসের মানে পোষালো না। এগিয়ে চললাম মন্দিরের দিকে। মন্দিরের ঢোকা এবং বেরোনোর মুখে সেই দেব-অসুরের বাসুকীকে ধরে টানাটানির মূর্তি – কিন্তু ধর্মীয় লড়াইতে সবাই কবন্ধ। অর্থাৎ মানুষের লড়াইয়ের ফলে দেব-দানব এক হয়ে গেছে! মন্দিরের দরজার দুপাশে দুই দ্বারপাল মুণ্ডহীন অবস্থাতেও তাদের কর্তব্যে অবিচল থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চত্ত্বরে অন্যান্য মন্দিরের মতই অনেকগুলো ছোট ছোট মন্দির, বারান্দা, দেওয়াল জুড়ে নানা মূর্তি, কোথাও ক্ষতবিক্ষত, কোথাওবা অবিকৃত। বৌদ্ধ এবং শৈবের মিলনক্ষেত্র দেখলাম এখানে, যেটা আগে ঠিক কোথাও এইভাবে দেখিনি।

বেশ কিছু যোনিপট দেখলাম, শিবলিঙ্গ তুলে নেওয়া হয়েছে। একটি অক্ষত শিবলিঙ্গও দেখা গেল। আবার এক জায়গায় একটি বৌদ্ধ স্তুপও দেখলাম, ওপরটা খোলা রাখা হয়েছে যাতে আলো আসতে পারে। আলো-আঁধারির জাদুতে রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রহস্য চিত্রনাট্যের সিনেমার শ্যুটিং করার জন্য আদর্শ জায়গা।

শুনলাম সংস্কারের কাজ কিছুটা করার পর পরিত্যক্ত হয়েছে। সেই একই দৃশ্য – চতুর্দিকে ভাঙাচোরা ছড়ানোছিটানো বিপুলাকৃতি পাথরের স্তুপ - প্রতিটার গায়েই বয়ে আনার সময়ের দু-তিনটি ফুটো রয়েছে। একটা জায়গায় বেশ একটা উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর দ্বিতল একটা গ্যালারি বা ওই ধরণের কোন হলের কাঠামো পড়ে রয়েছে।
জানা গেল এটিরও নির্মাণ দ্বাদশ শতাব্দীতে। একশো চল্লিশ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা মন্দির এলাকায় বাহাত্তরটি নাগ হাতে ধরা গরুড়ের মূর্তি পাওয়া যায়। সপ্তম জয়বর্মণ তাঁর বাবার স্মৃতিতে এই মন্দির তৈরি করেন। এখানে প্রায় হাজারখানেক নর্তক-নর্তকী, এক হাজার শিক্ষক ও এক লক্ষ মানুষ থাকতেন। একাধারে নগর, মন্দির ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করত এটি। এখানে বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা এমনকী শ্রীকৃষ্ণের গিরিগোবর্ধন ধারণের ভাস্কর্যও পাওয়া যায়। ভিতরে প্রবেশ করলে মন্দির ধ্বংসের কাজে শিমুল গাছের কী অমিত বিক্রম তাও দেখা যায়। এককালে যেসব অঞ্চল গমগম করত মানুষের কাজের ভিড়ে আজ হা হা করা শূন্যতা বুকে নিয়ে পুরানো গৌরবের স্মৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে আছে আর মৃত্যুর দিন গুনছে।

বেরিয়ে এলাম মন্দিরের অপরদিক দিয়ে। পাথরে বাঁধানো দীর্ঘ চত্বর পেরিয়ে তবে বেরোনোর রাস্তা। বেরোনোর আগে দেখে নিলাম বিশাল মহীরুহের, অজগরের মত, মন্দিরকে জড়িয়ে ধরে মরণপণ লড়াই। কী পরিমাণ দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং, শিল্প, সৌন্দর্যবোধ, পরিশ্রম ও অর্থের সম্মিলিত রূপ এই মন্দির – ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। বাইরে এসে বসলাম ছোট্ট দোকানে। ডাব বিক্রি করছে। নিলাম এক ডলার করে তিনটে ডাব। তবে একসঙ্গে নেওয়ার জন্য নিল আড়াই ডলার। এখানেও যেমন জল, তেমন শাঁস - খেয়ে পেট একেবারে পুরো ভর্তি হয়ে গেল।
কিছু লোক নানারকমের হস্তশিল্পের নিদর্শন বিক্রি করছে, তবে সবাই বেশ গরীব শ্রেণীর। ইচ্ছা থাকলেও নেওয়ার মত কিছু পেলাম না। ইতিমধ্যে চোখ গেল উল্টোদিকে এক আদিগন্তবিস্তারী জলাশয়ের দিকে। দেখে খুব গভীর মনে হল না। মনে হল একটা নীচু জায়গার জমা জল। পাড়ে কিছু ছোট ছোট শালতি ধরণের নৌকা রয়েছে। বুঝলাম এটা অল্পদিনের নয়। জলের মাঝে মাঝে অনেক বড় বড় গাছও রয়েছে - কিছু মরা, শুকনো ডালপালা মেলে উদবাহু হয়ে নৃত্যভঙ্গিমায় আর কিছু বেশ জীবন্তই। এই জলাশয়ের নাম প্রিয়া খানের বারায় বা জায়তাটাকা বারায়। এটা আসলে একটা কৃত্রিম জলাশয়। আশেপাশের যত বাড়তি জল সব এখানে জমা করা হয়। বিভিন্ন রকম ছোট-বড় গাছে ভরা জলাশয়টি ৩৫০০ মিটার লম্বা ও ৯০০ মিটার চওড়া। নীল আকাশের নীচে এই কৃত্রিম জলাধারটি বর্ষায় বেশ জলে ভরে ওঠে আবার কখনো কখনো প্রায় শুষ্ক হয়ে পড়ে। তবে এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না ।
জলাশয়ের মাঝে একটি কৃত্রিম দ্বীপে আছে আর একটি ছোট মন্দির –নিক পিন। এটিও দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা সপ্তম জয়বর্মন তৈরি করান। প্রথমে বুদ্ধকে উৎসর্গ করে এটি নির্মিত হয় এবং পরে তা বোধিসত্ত্ব লোকেশ্বরকে উৎসর্গ করা হয়। প্রিয়া খান থেকে বেরিয়ে জলাশয়ের ধার ধরে কিছুটা এগোতেই এসে পৌঁছালাম একটি লম্বা সরু, পায়ে হাঁটার কাঠের ব্রিজের কাছে। ব্রিজটি জয়তাটাকা বারায়ের ওপর দিয়ে সোজা দ্বীপটিতে পৌঁছেছে। নীচ দিয়ে অগভীর জল বয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি দুজন যেতে পারবে না এমনই সরু ব্রিজ। নিক পিন মন্দিরটি ছোট এবং একটি ছোট পুকুরের মধ্যে রয়েছে। কাছে যাওয়া গেল না, পুকুরের পাড় থেকেই দেখতে হল। মন্দিরের চারদিকেই দরজা তবে বর্তমানে একটি দরজাই খোলা মনে হল। একটি পাথরের ওপর রয়েছে মন্দিরটি অবস্থিত, একটি বড় সাপ পাক দিয়ে রয়েছে পাথরটিকে। এছাড়া মন্দিরে অনেক সিংহ, ঘোড়া, হাতি ইত্যাদির মূর্তি দেখলাম। শিবলিঙ্গ আর যোনিপীঠো রয়েছে অনেকগুলি। বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম এখানে যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ফেরার সময় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল। সঙ্গে তাঁর স্বামীও ছিলেন। বললেন, ওঁরা প্যারিস থেকে এসেছেন। আমরা ভারতের, বিশেষ করে কলকাতার শুনে বললেন ওঁরাও এখন কলকাতা থেকে আসছেন। ওঁদের ছেলে জোকায় ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটে পড়ে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। শুনে ভাল লাগল যে সুদূর ফ্রান্স থেকে কেউ কলকাতায় পড়তে এসেছে।
ফেরার পথে ব্রিজের মুখে দেখি অনেক জামাকাপড় বিক্রি হচ্ছে। মেয়ে দু-একটা নিল এখানকার স্মৃতিচিহ্ণ হিসাবে।
একটু এগোতেই পেলাম আর এক মন্দির, টা সোম। ঢোকার মুখে দেখি একটি বাচ্চা ছেলে মন্দিরের ছবি এঁকে চলেছে আপনমনে। হয়ত এই আশায় যে এটা বিক্রি করে কিছু পাবে। ভিখারি নেই কোথাও, নেই কোনো গাইডের উৎপাত। সবটাই পরিচ্ছন্ন শূন্য পরিত্যক্ত - এককালের গরিমামণ্ডিত বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত। বেলেপাথরের মন্দিরটির দরজায় যেভাবে ঠেকা দেওয়া রয়েছে প্রতি মুহূর্তেই পড়ে যাবার ভয় লাগে। পূর্ব দরজাতে একটা বিশাল বৃক্ষদানব যেভাবে তার করাল গ্রাসে সমস্ত শিল্পসৌন্দর্য আত্মসাৎ করেছে তা রীতিমত ভয়ের উদ্রেক করে। যদিও এটা তুলনামূলক ভাবে ছোট, তবু বায়োনের ঢঙে রাজা বা বোধিসত্ত্বের মুখ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত মন্দিরটি যথেষ্ট সুন্দর। এখানেও উদ্ধারকার্য পরিত্যক্ত। এটিও দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজা সপ্তম জয়বর্মন তৈরি করান। সুদীর্ঘকাল জঙ্গলের গ্রাসে পড়ে থাকার পর ১৯৩০ সালে পুনরুদ্ধার করা হয়।
এরপর পৌঁছলাম ইস্ট মেবোন অঞ্চল ছাড়িয়ে প্রায় শ্রা শ্রাং দীঘির কাছাকাছি একটি পাঁচ চূড়া বা পাঁচটি আলাদা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এক চাতালের ওপর মন্দির নিয়ে প্রি রুপ মন্দিরে। ঢোকার মুখেই ধাক্কা খেলাম সিঁড়ি দেখে। সরকার ব্যবস্থা করেছেন, তবে আমার মত ভ্রমণপিপাসুদের কাছে সেও বড় কঠিন পরীক্ষা। সিঁড়িগুলো এমনই যে যেকোনো মুহূর্তে পড়ে গিয়ে বিদেশে হাসপাতালবাসী হওয়ার পক্ষে অতি প্রশস্ত রাস্তা। মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে এখানে মনে হল না খুব সূক্ষ্ম কাজ ছিল। উঁচু দেওয়ালের ওপর হাতি বা সিংহ একেবারে জীবন্ত। এখানেই দেখলাম পাথরের সঙ্গে পাতলা পোড়া ইটের ব্যবহার। পুরো মন্দিরটাই ইট দিয়ে তৈরি। বিশাল চাতাল বা মন্দিরের ইঞ্জিনিয়ারিং নকশা নিখুঁত। এই মন্দিরটি অপেক্ষাকৃত ভাবে পুরাতন - দশম শতাব্দীতে নির্মিত হয় মন্দির এবং এটি একটি হিন্দু মন্দির। তবে মনে করা হয় এটিও পারলৌকিক কাজেই ব্যবহৃত হত। চাতালে অবস্থিত চৌবাচ্চাটিও এই ধারণাকেই সমর্থন করে। এক সময় এখানে লক্ষ্মী, উমা, বিষ্ণু, শিব সবার মূর্তি ছিল। পশ্চিমের বিদায়ী সূর্য যখন রক্তাভ লাল আভার সিঁদুর ছড়িয়ে দিগন্তের সিঁথি লাল করে তার কোলে আশ্রয় নিতে যান, সেই লালিমা ছড়িয়ে পড়ে মন্দিরের আপাদমস্তক। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মন্দিরগুলো লাল বেলে পাথরে তৈরি হওয়ায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত এখানে ছবি শিকারী আর সৌন্দর্যরসপিপাসুদের কাছে দুটি খুব মূল্যবান সময়।
ওপর থেকে দেখা যায় বহুদূর অবধি, নিশ্চিন্ত মনে রাখাল ঘুরে বেড়াচ্ছে বা তার চিকণ কালো ভঁইসের দল আরামে ঘাসে মুখ ডুবিয়ে রয়েছে। তখন একবারও মনে হয় না যে বিদেশে আছি। বরং আরও বেশি করে নিজের সেই শান্ত শ্যামল গ্রাম বাংলাকে মনে পড়ে।
টুকটুকওয়ালা বলল, বলুন এবার কোথায় যাবেন। বললাম, শুনেছি টোনলা স্যাপ বেশ ভালো, দেখার মত। সেখানে কি আজ যাওয়া যাবে? বলল, হ্যাঁ, তবে রাস্তা ২৫ মাইল, আমাকে এর জন্য আরও দশ ডলার বেশি দিতে হবে। বললাম, চলো। ভাবলাম, টোনলা স্যাপ তো একটা লেক, তাতে জলবিহার করার অত আগ্রহ নেই। তবে লেকের ধারে গিয়ে অবস্থাটা দেখে আসব।
গাড়ি ছুটল সিয়েম রিপের গ্রামের মধ্যে দিয়ে। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ছিলাম আসামে, ঘুরেছি সেখানকার নানান গ্রামে। আমার মনে হল অনেকদিন পর যেন আবার আসামে এসেছি। এদের খাওয়াদাওয়া, ঢং, বেশবাস বিশেষ করে গ্রামের বাড়ি বা তার আশেপাশের পরিবেশ সবটাই যেন আসামের সঙ্গে অনেক মেলে। বাড়িগুলিও মাটি থেকে উঁচুতে কাঠের খুঁটির ওপর। তলাটা ফাঁকা – সেটা বন্যা থেকে বাঁচতে কী বন্য জন্তুর থেকে বাঁচতে তা জানিনা। অনেকে সেই ফাঁকা অংশে গ্যারেজ করেছে বা কোন ছোট মেসিন বসিয়েছে আবার কেউ ফাঁকাই রেখেছে। বাড়ির মেয়েরা কিছু গৃহসামগ্রী বা ফল সবজি এইসব টুকিটাকি নিয়ে বাড়ির সামনে ছোট দোকান করেছে। সব মিলিয়ে একটুকরো আসাম বলেই মনে হল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক এইভাবে চলার পর ড্রাইভার বলল, আর যাওয়া যাবে না। এখান থেকে টিকিট কাটতে হবে। ওর কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলাম না। বললাম, লেকটা কই? আমরা তো লেকের ধারে যাব। আর তাছাড়া আমরা তো নৌকা সফর করব না। তাহলে আলাদা টিকিটের ব্যাপার কীসের? ও যা বোঝাতে চাইল তাতে ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
সামনেই রয়েছে একটি টিকিট কাউণ্টার। তবে আশেপাশে কোন লেক বা গাড়ি-নৌকো কিছুই দেখলাম না। টিকিট কাউন্টারটিও দেখে শ্রদ্ধা হল না। সরকারি নয়, মনে হল স্থানীয় কিছু ছেলে মিলে করেছে। ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝতে গেলাম কাউন্টারে। যা বুঝলাম তা হল, এর বেশি ওরা যেতে দেবে না যদি না টিকিট কাটা হয়। টিকিট মাথাপিছু পঁচিশ ডলার। ওদের গাড়ি ছাড়া বাইরের আর কোনো গাড়ি এর বেশি যেতে পারবে না। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে, এরপর গিয়ে নৌকোভ্রমণের সময়ও থাকবে না। অত চড়া দাম দিয়ে টিকিট নিয়ে লাভ নেই দেখে ফিরে আসছি তখন কাউণ্টারের বাইরে দাঁড়ানো একটি ছেলে বলল, আপনারা তিনজন আছেন, চলুন একটু সস্তা করে করে দেব। আমরা তা-ও যাইনি।
ফিরে এসে পড়াশোনা আর জিজ্ঞাসাবাদ করে যা জানতে পারলাম তা হল, টোনলা স্যাপ ১২০ কিমি লম্বা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ মিষ্টি জলের হ্রদ যা মেকং নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অনেকটা আমাদের কাশ্মীরের ডাল হ্রদের সঙ্গে তুলনীয়। এখানেও হ্রদে অনেক গাছপালা পাখি মাছ এবং বহু লোকের বাস আছে। হ্রদের জলের ওপর নির্ভর করে জীবিকা অর্জন করে বহু মানুষ। অনেকেই খুবই দরিদ্র কিন্তু দারিদ্র্যও যে বিক্রি হয়, সেটাও একটা পণ্য তা এখানে এলে দেখা যায়। অবশ্য ভারতীয়রাও কম যাই না। আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তিও একটা এইধরণের ব্যবসা। বহু নেতা, ধনীমানুষ এই বৃত্তির পিছনে আছেন। কিন্তু রাষ্ট্র বা শাসকরা এটা জেনেও নিঃশব্দে চুপ করে থাকেন। এখানকার ব্যাপারটা হল, এরা অনেক দাম দিয়ে, পঁচিশ ডলার মাথাপিছু করে টিকিট কেটে এখান থেকে নিয়ে যায় এবং কিছুদূর নৌকায় নিয়ে যাবার পর বাধ্য করে আবার অন্য আর একটি নৌকায় যেতে, যার জন্য আবার টাকা দিতে হবে। অন্য সবকিছু দেখানোর সঙ্গে প্রধানতঃ মানুষগুলোর দারিদ্র্যটাই দেখায়। দারিদ্র্য কী করে একটা দেশের দেখানোর জিনিস হতে পারে তা আমার মাথায় ঢোকে না। একই কথা মনে হয়েছিল আমস্টারডামে গিয়ে। ওখানে অনেক কিছু দ্রষ্টব্যের মধ্যে দেহোপজীবিনীদের দেখানোটাও একটা কায়দা। এটা কী করে দেখার জিনিস হতে পারে আমি জানি না। মানুষ পেটের তাগিদে নিজের দেহ বেচছে এতে দেশের গর্ব করার মত কী থাকতে পারে কে জানে!
যাইহোক এই দারিদ্র্য, যেটা এরা দেখায় তা সম্ভবতঃ সাজানো বা নকল। দর্শকদের কাছ থেকে যেভাবে ডলারে এর দাম আদায় করে তাতে এমনই প্রশ্ন জাগে। জলের ওপর গ্রামগুলোকে ওরা বলে ভাসন্ত গ্রাম। তবে জল অনেক জায়গাতেই নোংরা এবং খুঁটির ওপর বাড়িগুলোও হতশ্রী। ওরা প্রকৃতঅর্থে ভিক্ষা চায়, কেউ একটা পোষা সাপ বাচ্চার গলায় জড়িয়ে, কেউ বা বাচ্চাদের খাতা-পেন্সিল কিনে দেওয়ার কথা বলে, বা কিছু জিনিস কিনতে হবে বলে। যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট নৌকা আছে এবং ছেলে-মেয়ে সবাই সে নৌকা চালানোয় পারদর্শী। হ্রদে বহু নৌকা পর্যটকদের শোষণ করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। এখান থেকে নদীপথেও নমপেনে যাওয়া যায়। ছ ঘণ্টা লাগে। এই যে টোনলাস্যাপে ভ্রমণ, এটাকে যদি ঠিকমত সরকারি প্রচেষ্টায়, পরিচ্ছন্নভাবে গড়ে তোলা যায় তবে এটা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।
কাল একটু বেলায় যাব বাটাম্বাং।

~ ক্রমশঃ ~


অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক আধিকারিক মলয় সরকার বর্তমানে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষভাবে যুক্ত। এছাড়া পড়াশোনা ও লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নেশা দেশ-বিদেশ ভ্রমণ এবং উদ্যানচর্চা।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher