নন্দাকিনীর উৎসমুখে

সুদীপ্ত দত্ত

পূর্বপ্রকাশিতের পর -

~ রন্টি স্যাডল ট্রেক রুটম্যাপ || রন্টি স্যাডল ট্রেকের আরও ছবি ~

কালো গণেশ আর পাথুরে বাড়ি

পরদিন সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই চিঁড়ের পোলাওয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম ভাগুয়াবাসার দিকে। হাতে সময় অনেক, তাই আগের দিন যেখানে চা-ওমলেট খেয়েছিলাম সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গেলাম সেই পাহাড়ের চূড়াগুলো আবার দেখব বলে। আকাশ মেঘলা থাকায় তখন দেখা যায়নি কিন্তু এদিন পরিষ্কার আকাশে পরপর চূড়াগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠল। তবে এই পাহাড়ের সারি আমরা বেদনি বুগিয়ালে দেখেছি আর এর পরেও রাস্তায় অনেকবার দেখতে পাব তাই বেশি সময় নষ্ট না করে উঁচু পথ ধরলাম। এখান থেকে যে রাস্তা গেছে তা পুরোটাই পাহাড়ের শিরা বা রিজ বরাবর, আর তা ক্রমশঃই ওপরের দিকে উঠেছে। আমি মানবদার সঙ্গে খুব ধীরে ধীরে চলতে থাকলাম। পুরো পথটাই কালো পাহাড়ি অঞ্চল, শুকনো ঘাসে ঢাকা। ওপর দিয়ে বাজ আর কালো ফিঙের মতন এক ধরণের পাখি ঘুরপাক খাচ্ছে। এই পথে একলা চলতে চলতে অজানা আজগুবি ভয় মনের মাঝে দানা বাঁধা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়!

একটু পরপরই রাস্তার পাশে পাথর দিয়ে ছোট বেদির মতো করা আর তাতে একটা ঘন্টা রাখা রয়েছে, ভাবটা এমন যেন ওই ঘন্টাটাকেই পুজো দেওয়া হয়। আসলে ওই ঘন্টা বাজিয়ে পেছনের লোককে জানিয়ে দেওয়া যায় যে সামনে আমি কতদূরে রয়েছি। সরু পথ দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে দেখতে পেলাম আরও কিছু ট্রেকার এই পথ ধরে এগিয়ে আসছে। কিছু পরে নির্জন পথটা ট্রেকার আর মালবাহী খচ্চরে জমজমাট হয়ে গেল। তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে আন্দাজ করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম আর কত পথ চলতে হবে, তবে পাহাড়ে ওদের হিসাব আর আমাদের হিসাব একেবারেই মেলে না। মোটামুটি দুই কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় চলার গতি ধরে একটা সময় হিসাব করে এগোতে থাকলাম। পরপর কয়েকটা চড়াই পেরোনোর পর একটা বড় পাথরের নিচে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে একটা খাড়া সিঁড়ির মতো পথ ওপরে উঠে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে কয়েকটা বাঁক নিয়ে ওপরে উঠতেই লোকজনের দেখা পাওয়া গেল, সঙ্গে একটা ছাউনিও চোখে পড়ল। পাশে ত্রিশূল আর অসংখ্য ঘন্টা লাগানো গণেশ ঠাকুরের মন্দির। পথে আসার সময় যেমন ঘন্টা রাখার জন্য পাথরের বেদি দেখেছিলাম এখানে গণেশের মন্দিরও সেরকম পাথরের বেদির মত। তবে গণেশের মূর্তি কালো পাথরের। স্থানীয় লোকদের মতে সারা ভারতের মধ্যে এখানেই একমাত্র কালো গণেশের পুজো করা হয়। পৌরাণিক মতে ব্যাসদেবকে অনুসরণ করে চলতে চলতে গণেশ ঠাকুর চড়া রোদে কালো হয়ে যান আর তার প্রতীক হিসাবেই এই মন্দিরে রয়েছেন কালো গণেশ বা কালৌ বিনায়ক। এখানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই কুয়াশার মতো মেঘে আকাশ ঢেকে গেল, তবে সে মেঘে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা কম। পাথর নাচুনি থেকে রওনা দিয়ে একটানা ঘন্টা তিনেক চড়াই পথে চলা হয়েছে, এখান থেকে ভাগুয়াবাসার দূরত্বও খুব বেশি নয়, তাই মনে হল এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যেতেই পারে। ক্যাপ্টেন অনেক আগে পৌঁছে সেই ছাউনি করা দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়েই রেখেছিল। গরম চা খেতে খেতে মেঘের মধ্যে দিয়ে চারপাশের পাহাড়কে যতটা সম্ভব নজরে আনার চেষ্টা করলাম। কালৌ বিনায়ক একটা পাহাড়ের মাথায় হওয়ায় এখান থেকে উঁচু পাহাড়গুলোকে ছোট পাহাড়ের আড়াল এড়িয়ে সামনাসামনি দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকায় সেই সুন্দর ছবি চোখের আড়ালেই লুকিয়ে রইল। নাছোড়বান্দা হয়ে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করলাম। তার মাঝেই মেঘের আড়াল থেকে মাত্র একবারের জন্য উঁকি দিল নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূল পাহাড়ের চূড়া, আর তাদের মাঝে আমাদের লক্ষ্যপথের শেষ সীমানা রন্টি স্যাডেল।

কালৌ বিনায়কের পরের রাস্তা পুরোটাই পাথরের, রাস্তায় চড়াইউতরাই নেই বললেই হয়, আর তার পাশে কিছু শুকনো ব্রহ্মকমল দেখতে পাওয়া গেল। পাথরগুলো নড়বড়ে আর কুয়াশাবৃষ্টিতে ভিজে থাকায় পিছলও বটে। তাই খুব সাবধানে পা ফেলে হাঁটতে হল। কিছুটা এগোতেই খুব ছোট ছোট পাথরের ঘর দেখতে পেলাম। আনন্দের কাছ থেকে জানতে পারলাম ওগুলো নাকি শেপার্ডস হাট, ভেড়া চড়াতে এসে রাখালরা এখানেই বিশ্রাম নেয়। ওর মাঝে পাথরের একটা বড় ভাঙাচোরা ঘর দেখিয়ে বললো এটা নাকি কোনো এক রানির আঁতুড়ঘর বা "রানি কা সুন্তেলা" ছিল। মাত্র আধঘন্টা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে আমরা ভাগুয়াবাসা পৌঁছে গেলাম।

মেঘলা, কুয়াশাঢাকা ভাগুয়াবাসাকে প্রথম দেখায় একেবারেই ভালো লাগল না। রাস্তার পাশে একটা বড় পাথরবিছানো সমতল জমির ওপর অনেকগুলো টেন্ট বসেছে। আমাদের টেন্টটা পাহাড়ের একটা ঢালের ঠিক পাশেই। পাহাড়ের ঢালটা বেশ ময়লা আর একটু তলার দিকে দুটো টেন্ট টয়লেট বসানো হয়েছে। কুয়াশা-বৃষ্টিতে ভিজে পাথরগুলো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে রয়েছে। অনেক ট্রেকার এসে পড়ায় লোকজনের ভিড় একটু বেশিই বলে মনে হল। একটু পরেই লাঞ্চ রেডি হয়ে গেল আর টেন্টেই খাবার পৌঁছে দেওয়া হল। গরম গরম খাবার পেটে পড়তেই আশ্চর্যভাবে যেন জায়গাটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করলাম। এখানে টেন্টের খুব কাছ থেকেই মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল, আর এই শেষ ক্যাম্প যেখান থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছিল। বিকেলের দিকে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হতে ত্রিশূল পাহাড়ের একটা চূড়া নজরে এল। পড়ন্ত সূর্যের আলো মেঘ আর ত্রিশূলের চূড়ার ওপর পড়ে সেই পরিচিত লাল আভা ছড়িয়ে দিল। অন্য একটা ট্রেকিং দলের গাইড হয়ে মহিপৎ এখানে এসেছে। ও এসে আমাদের শরীর স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞেস করল। একটা অক্সিমিটার জোগাড় করে শরীরে অক্সিজেন চলাচল ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখে নিল।

সন্ধ্যা নেমে এলেও লোকজনের চলাফেরায় পুরো জায়গাটাই বেশ জমজমাট হয়ে রইল। ভাগুয়াবাসায় একটা ছাউনিফেলা দোকান রয়েছে, দিদনার এক বয়স্ক ভদ্রলোক সেই দোকানের মালিক। তাঁর এই দোকান প্রায় দশ বছরের পুরনো আর শুধু চা-বিস্কুটই নয় টর্চের ব্যাটারি, ফেভিকলের মতো ভীষণ দরকারি জিনিসও পাওয়া যায়। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসতেই গোল থালার মতো চাঁদ পাহাড়ের মাথার ওপর উঁকি মারল। চাঁদের আলো উপভোগ করতে করতেই দোকানির সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিলাম। পাথরনাচুনির গল্পটা আবারও একবার শুনে নেওয়া গেল। তবে ট্রেকিংয়ে মেয়েদের উপস্থিতি যে ওঁর খুব একটা পছন্দ নয় তা কথাবার্তাতেই ফুটে উঠছিল। শুনলাম রূপকুণ্ডের কঙ্কালের ইতিহাস। তবে ইতিহাসের চেয়ে পৌরাণিক কাহিনিতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন। জানালেন রূপকুণ্ড তৈরির পৌরাণিক কথা। একবার ভগবান শিব আর দেবী পার্বতী চলতে চলতে এই পাহাড়ে এসে উপস্থিত হলেন। এতটা পথ চলতে চলতে দেবী পার্বতীর জলতেষ্টা পেল, কিন্তু এই রুক্ষ পাহাড়ে শিব কিভাবে সেই ব্যবস্থা করবেন? তখন তিনি নিজের ত্রিশূল দিয়ে পাহাড়ের গায়ে এমন জোরে আঘাত করলেন যে তার থেকে জল বেরিয়ে এসে এক লেক তৈরি হল! সেই লেকের জলে তেষ্টা মেটাতে গিয়ে দেবী পার্বতী নিজের রূপ দেখতে পেয়েছিলেন বলে এই লেকের নাম হল রূপকুণ্ড। দোকানি ভদ্রলোক আরও যোগ করলেন যে এই পথে অনেক লোক প্রাণ হারিয়েছে, কিন্তু কখনোই ভূত-প্রেতের কোনো অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি, কারন এ স্থান যে দেবভূমি।
একে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, তার ওপর পাথুরে জমিতে ঠাণ্ডা নামে খুব তাড়াতাড়ি। সাড়ে সাতটা বাজতেই টেন্টে রাতের খাবার চলে এলো। ডাল, ভাত, রুটির সঙ্গে ডিমের কারি দিয়ে ডিনার সারা হল। এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমির ওপর ফেলা টেন্টে শান্তিতে ঘুমানো বেশ কঠিন, কিন্তু তা সত্ত্বেও নিস্তব্ধ ভাগুয়াবাসায় কখন যেন দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে এল।

রহস্যময় রূপকুণ্ড আর স্বপ্নের দেশ শিলাসমুদ্র

রাতভোর হওয়ার আগেই বাইরে বেশ একটা সাজো সাজো রব শোনা গেল। রূপকুণ্ড যাওয়ার ট্রেকিং দলগুলো রাত সাড়ে তিনটে-চারটের সময় রওনা দিয়ে দিল, ফিরতি পথে ওদের পৌঁছাতে হবে বেদনি বুগিয়াল। আমরা এপথে ফিরব না, তাই আমাদের আরও কিছুক্ষণ পরে বেরোলেও চলবে। ঘুমটাকে টেনে আরেকটু লম্বা করে যখন বাইরে আলোর আভাস দেখা গেল, টেন্টের চেন-দরজাটা খুলে দিলাম। ভোরবেলায় আকাশ একেবারে পরিষ্কার আর সামনে সেই পাহাড়ের সারি – নীলকন্ঠ, বালাকুন, চৌখাম্বা, জাহ্নুকুট, সতোপন্থ আর ভাগীরথী। সকালে অন্যান্য ট্রেকাররা না থাকায় রাঁধুনিদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে কাটালাম। এর পরের কদিন ওরাই হবে পথের একমাত্র সঙ্গী। ওদের মধ্যে বয়সে একটু বড় হীরা সিং হল হেড কুক, রান্নার সময় কিভাবে স্বাদ আর স্বাস্থ্যের ব্যালেন্স রাখতে হয় তা তার বিলক্ষণ জানা রয়েছে। ওর দুই সহকারী মনিন্দর আর বিনোদ যেন এনার্জির অফুরন্ত ভাণ্ডার। বহুদূর থেকে জল বয়ে নিয়ে আসা থেকে খচ্চরের জন্য ঘাস জোগাড় করা কোনোকিছুই যেন ওদের ক্লান্ত করতে পারে না!
রূপকুণ্ডের পথে যখন পা বাড়ালাম তখন প্রায় সকাল নটা। আগের দিনের পাথুরে রাস্তাটাই এগিয়ে চলেছে লেকের দিকে, শুধু এবার তা আরও সরু, পাশাপাশি দু'জন যাওয়াও বেশ বিপজ্জনক। কোথাও কোথাও রাস্তায় নড়বড়ে পাথর এতটাই বিপদের যে একটু অসতর্ক হলে গভীর খাদে তলিয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। সুখেনদার কাছে জানতে পারলাম কয়েক বছর আগে এই রাস্তার একটি জায়গায় দেয়াল বেয়ে এক রকম রক ক্লাইম্বিং করে উঠতে হত, এখন সেখানে সিঁড়ি তৈরি হলেও সে পথে প্রাণ হাতে করেই চলতে হয়। শুধু তাই নয়, পাথুরে পাহাড়ে যখন তখন পাথর গড়িয়ে পড়াও অসম্ভব নয়। এতটা রুক্ষ পথে মাইলের পর মাইল হাঁটতে খুব যে আনন্দ পাচ্ছিলাম তা বলতে পারি না। অনেকটা হাঁটার পর পাথরের রাস্তা এবার নুড়িপথে পরিণত হল! এ রাস্তায় পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা ষোলআনা। যদিওবা ওপর দিকে ওঠা যায়, কিন্তু নিজের ওপর সম্পূর্ণ ব্যালেন্স রেখে নীচের দিকে নেমে আসা খুবই কঠিন। একটা চায়ের দোকান পার হয়ে গড়ানো পথে আর কিছুটা ওপরে উঠতেই পৌঁছে গেলাম রহস্যে ঘেরা লেক রূপকুণ্ডে, ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর বারোটা।

পাহাড়ের খাঁজে নুড়ি পাথরে ঢাকা একটা সমতলে খুব ছোট একটুকরো কালচে জলের আধার এই রূপকুণ্ড, কিন্তু লোককথায় এর মহিমা অসীম। প্রতি বারো বছর অন্তর এখানে ঘটা করে উৎসবের আয়োজন করা হয়। এমন একটি প্রাকৃতিক লেক নুড়ি পাথরে প্রায় বুজে এসেছে, জলের পরিমাণ খুবই সামান্য। শীতে এর পুরোটাই বরফে ঢেকে যায়। লেকের পাশে কতগুলো হাড়গোড় স্তূপ করে রাখা রয়েছে। এগুলো লেকের ভেতর থেকে পাওয়া গিয়েছিল আর তারপরেই এ নিয়ে হয়েছে অনেক গবেষণা।

পাহাড়ের খাঁজে নুড়ি পাথরে ঢাকা একটা সমতলে খুব ছোট একটুকরো কালচে জলের আধার এই রূপকুণ্ড, কিন্তু লোককথায় এর মহিমা অসীম। প্রতি বারো বছর অন্তর এখানে ঘটা করে উৎসবের আয়োজন করা হয়। এমন একটি প্রাকৃতিক লেক নুড়ি পাথরে প্রায় বুজে এসেছে, জলের পরিমাণ খুবই সামান্য। শীতে এর পুরোটাই বরফে ঢেকে যায়। লেকের পাশে কতগুলো হাড়গোড় স্তূপ করে রাখা রয়েছে। এগুলো লেকের ভেতর থেকে পাওয়া গিয়েছিল আর তারপরেই এ নিয়ে হয়েছে অনেক গবেষণা। মোটামুটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী রাজা যশধবল তার দলবল নিয়ে এ পথ দিয়ে যাবার সময় দস্যুদের কবলে পড়ে প্রাণ হারান। তাঁদের মৃতদেহগুলোই এই রূপকুণ্ডের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আবার বিখ্যাত বাঙালি পর্বতারোহী শম্ভুনাথ দাসের মতে এই কঙ্কালগুলো আসলে এখানে পুজো দিতে আসা পুণ্যার্থীদের, যারা ক্লান্ত পায়ে জুনারগলি যাওয়ার পথে ধ্বসে বা গড়ানো পাথরে পিছলে এই লেকে এসে পড়েছিল। এছাড়াও রয়েছে আরো অনেক মত, অনেক ধারণা। আমাদের পক্ষে এর কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা তা মিলিয়ে দেখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তবে কঙ্কালগুলো দেখার পর এই লেকের ধারে খুব বেশিক্ষণ কাটানোর আর ইচ্ছে রইল না। লেকের পাশে আলগা পাথর দিয়ে বানানো হরগৌরীর ছোট্ট মন্দির, আর তাতে রয়েছে শিব-পার্বতীর ফটো। পুজোর সরঞ্জাম বলতে কতগুলো ঘন্টা আর গোটা দুয়েক শাঁখ। অন্যান্য শিবমন্দিরের মতই এখানেও মাথার ওপর শোভা পাচ্ছে একখানা বড় ত্রিশূল। ক্যাপ্টেন আর মহিপৎ অনেক আগেই এখানে পৌঁছে গেছিল। একটু পর খচ্চর নিয়ে রাঁধুনিরাও এসে হাজির হল। বাবুদা আর মানবদা একটু পিছিয়ে পড়েছে। মনিন্দর মন্দিরের শঙ্খ বাজিয়ে আমাদের লেকে পৌঁছে যাওয়ার খবর জানিয়ে দিল।

মাত্র মিনিট পনেরো লেকের ধারে ঘোরাঘুরি করে ওপর দিকে জুনারগলির পথ ধরলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মনিন্দররা খচ্চরগুলো নিয়ে পাহাড়ের ওপর অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আর ক্যাপ্টেন এগোতে থাকলাম, সঙ্গে চলল মহিপৎ, আমাদের জুনারগলি পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রূপকুণ্ড থেকে এই পথ অসম্ভব খাড়াই, ধীরে সুস্থে না হাঁটলে মাঝপথেই বেদম হয়ে পড়তে পারি, তাই ভয়ে এক পা দু'পা করে এগিয়ে চললাম। খুব ধীরে ধীরে প্রায় ঘন্টা খানেক একনাগাড়ে চলার পর একটা বাঁক ঘুরতেই দেখতে পেলাম রাস্তা শেষ হয়ে পাহাড়ের একটা শিরার মাথায় উঠে এসেছি। সেখানে একটা ভাঙাচোরা সাইনবোর্ড মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে, তাতে লেখা "জ্যুঁরাগলী" 'সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৪৭৮৯ মিটার'। ট্রেকিংয়ে রওনা দেওয়ার আগে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এর উচ্চতা দেখেছিলাম ৫১৫০ মিটার বা তারও বেশি, কিন্তু এই সাইনবোর্ড দেখে একটু যেন হতাশই হলাম। যতক্ষণ মানবদা আর বাবুদা না পৌঁছায় আমি আর ক্যাপ্টেন এখানে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই টপের চারদিক আরও উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা, তার ওপর জমাট কুয়াশা থাকায় বিশেষ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তার মধ্যেই মহিপৎ আশেপাশের পাহাড়গুলো কোথায় কী আছে বলে যাচ্ছিল, কাছাকাছি কালো পাথরের মত কালি ডাক, একটু ওপরে চন্দনিয়া টপ আর সামনের বড় পাথরটার পেছনে রূপকুণ্ডের গ্লেসিয়ার, কিন্তু কোনোটাই আমার চোখে ধরা পড়ল না। শুধু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সামনের ত্রিশূল পর্বত, আর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারা নন্দাঘুন্টি! বেশ কিছুক্ষণ পর বাবুদা আর মানবদা এসে পৌঁছাল। বেশ বুঝতে পারছিলাম অ্যান্টিবায়োটিকের অ্যাকশনে মানবদার শরীর আর এগোতে চাইছে না, শুধু মনের জোরকে সম্বল করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে যাতে কোনোভাবেই আমাদের সবাইকে ফিরে না আসতে হয়। সবাই পৌঁছে গেলে আমরা মহিপৎকে বিদায় জানালাম, এত বেলায় রওনা হয়েও সে এখান থেকে ফিরে যাবে দিদনা!
প্রায় সোয়া একঘন্টা জুনারগলিতে কাটিয়ে আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটু উঁকিঝুকি মারতেই পাথরের পাশ থেকে একটা লুকিয়ে থাকা সিঁড়ির দেখা মিলল পাহাড়ের অপর ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামার জন্য। এ যেন এক গোপন পথ, কোনও এক অজানা অচেনা পৃথিবীতে পৌঁছে যাওয়ার চাবিকাঠি। সুখেনদা বলল, কিছুদিন আগে এ পথে পাথরের ওপর এরকম ধাপ করা ছিল না, একবার নিচের দিকে নামতে শুরু করলে মাঝপথে থামা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত। সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা নামার পর আকাশে হালকা রোদের ঝিলিক দেখা গেল, কুয়াশাও কিছুটা পরিষ্কার হয়ে এল। খয়েরি রঙের ঘাসে ঢাকা এক সমতল পাহাড়ের মাথায় পৌঁছতেই চোখ জুড়ানো একটি ছবি সামনে ভেসে উঠল। নিচে রয়েছে এক স্বপ্নের উপত্যকা, তাতে তিন দিক থেকে তিনটে নদীর মত জলের ধারা একটি বিন্দুতে মিশেছে। নদীতে জল হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলায় পাহাড়ের এত ওপর থেকেও আমরা ওদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তিনটে নদী মিলে দুটি 'ব' বা ডেল্টা আকৃতির অববাহিকা তৈরি করেছে। ডেল্টাগুলো এখানকার পাহাড়ের মতোই খয়রি ঘাসে ঢাকা। ডান দিকের ডেল্টায় একটা নদীর কাছাকাছি বিশাল কালো পাথরের পাশে দুটো সবুজ টেন্ট পাতা রয়েছে, ওটাই আজ রাতের ঠিকানা। আমাদের যেন আর তর সইছিল না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রায় ছুটতে ছুটতে নিচের দিকে নামতে থাকলাম।

কিন্তু পাহাড়ের ওপর থেকে খুব কাছে মনে হলেও নিচ পর্যন্ত নামতে সময় লাগল দু ঘন্টারও বেশি। অবশেষে একটা নদীর ধারা পেরোতেই চোখে পড়ল সাইনবোর্ড 'শিলা সমুদ্র'। আর সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা? খুবই বিতর্কিত! পাশাপাশি দুটো সাইনবোর্ডের একটিতে লেখা ৩৮৯৫ মিটার আর অন্যটায় ৪০৪৫ মিটার! সামনেই টেন্ট, কিন্তু এই অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ঘেরা উপত্যকার ছবি ক্যামেরাবন্দি না করে সেখানে পৌঁছানোর কথা মনেও আনতে পারছিলাম না। ক্লান্ত শরীরে একটা প্যানোরমিক ছবি তুলতে যেতেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল। বিকেল তখন সাড়ে চারটে, অনেক আগে পৌঁছে হীরা, মনিন্দর আর বিনোদ ততক্ষণে টেন্ট খাটিয়ে খাবারের বন্দোবস্তও করে ফেলেছে। পৌঁছানোর পর এক মুহূর্তও দেরি না করে হাতে স্যুপ আর ম্যাগি তুলে দিল।

টেন্টগুলো যে পাতা হয়েছে একটা মস্ত পাথরের আড়ালে তা জুনারগলি থেকে নামার সময়ই দেখতে পেয়েছিলাম। এই কালো পাথরটা নাকি কোনও সময় পাহাড় থেকেই নেমে এসেছিল, আর ওর দৌলতেই প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া থেকে আমাদের টেন্টগুলো বেঁচে যাচ্ছিল। পাথরের আরেক পাশে শেফার্ডদের ঘরের মত পাথরের টুকরো দিয়ে ঘিরে তার ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে বানানো হয়েছে রান্নাঘর। আমাদের কুক, পোর্টার আর গাইড এখানেই রাত কাটাবে বলে ঠিক করেছে। আমাদের টেন্টের কাছে কতগুলো ছোটো ছোটো আলগা পাথরবসানো মন্দির রয়েছে, এখানে বিগ্রহের বদলে রয়েছে এক একটি ছোট পাথরের অংশ আর ত্রিশূল। অধিকাংশ ট্রেকিং দল রূপকুণ্ড থেকেই ফিরতি পথ ধরে, জুনারগলি পেরিয়ে এপথে বড় একটা কেউ আসে না, তাই আগের ক্যাম্পগুলোর মত ঘিঞ্জি পরিবেশ এখানে নেই। আমাদেরও নির্জন শিলাসমুদ্রের সৌন্দর্য অন্য কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হল না।
ত্রিশূল পাহাড়ের ঠিক পায়ের কাছে শিলাসমুদ্রের চারদিকই উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। ত্রিশূল আর ডানদিকের বরফঢাকা একটা নাম না জানা পাহাড় এতটাই কাছে যে মনে হয় এই বুঝি সামান্য হাঁটলেই ওদের চূড়ায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। দুটো পাহাড়ের মাথাই দুধসাদা তুষারে ঢাকা আর সেই তুষারের নদী পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে এই উপত্যকার দিকেই। শুনেছি সময় সময় এই তুষারে ধ্বস বা অ্যাভালাঞ্চ নামে, সেই ধ্বস যদি বড় রকমের কিছু হয় তবে কী যে হবে তা ভাবতেও ভয় হচ্ছিল। তবে ছোটখাটো অ্যাভালাঞ্চ এখানে লেগেই থাকে আর তাতে যে বরফ খসে পড়ে তা থেকেই তৈরি হয়েছে এক মস্ত হিমবাহ।

শেষ বিকেলে কুয়াশা কিছুটা পরিষ্কার হয়ে এলেও নন্দাঘুন্টির দেখা মিলল না। পড়ন্ত সূর্যের আলো সাদা তুষারঢাকা ত্রিশূল পাহাড়ের ওপর পড়লেও পরিচিত লাল আভা খুঁজে পেলাম না। কনকনে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে সন্ধ্যা হতে না হতেই তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেল আর আনন্দরা তাঁবুতেই সেই খাবার পৌঁছে দিল। খুব তাড়াতাড়িই স্লিপিংব্যাগের আশ্রয় নিতে পারলাম। আগের ক্যাম্পসাইটগুলোর মত এখানে লোকজনের কোলাহল নেই। মালপত্র নেওয়ার খচ্চরগুলো ছাড়া নেই আর কোনও ঘোড়া বা খচ্চরের চিৎকার। কিন্তু একটানা নদীর শব্দ আর মাঝে মাঝে তুষার ভেঙে পাহাড় থেকে অ্যাভালাঞ্চ নেমে আসার আওয়াজে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। এক ঘুম দেওয়ার পর মনে হল বুঝি রাত পেরিয়ে গেছে, ঘড়িতে দেখলাম রাত মাত্র সাড়ে দশটা, আবার ঘুম ভাঙলে ঘড়ি দেড়টার বেশি এগোয় না! এভাবে অনেকক্ষণ আধঘুম অবস্থায় কাটিয়ে শেষমেষ হাল্কা আলোর আভাস দেখা দিতেই টেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। একটু এদিক ওদিক তাকাতেই ঘাসের জমির ওপর দিয়ে কী যেন একটা নড়েচড়ে উঠল! দেখলাম বড় পাকানো শিংওয়ালা হরিণের মত দেখতে এক ধরনের জন্তু নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। খুব সাবধানে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ক্যামেরা বের করলাম আর বাকি তিনজনকেও ডেকে তুললাম। ক্যাপ্টেন বলল ওগুলো আইবেক্সজাতীয় পাহাড়ি ছাগল, স্থানীয় নাম ভরাল। শিলাসমুদ্রের এই পৃথিবীতে প্রকৃতিই রাজা তাই বন্য জীবজন্তু ঘুরে বেড়ায় বিনা বাধায় নির্ভয়ে। মানুষ এখানে ক্ষণিকের অতিথি, কেবল দর্শক মাত্র। সুখেনদা বলল এই ছাগলগুলো নাকি দল বেঁধে চলে আর পাহাড়ে চড়তে ভীষণ পটু, অনেক সময় পাহাড়ের গায়ে গা ঘষটে অনেকটা ওপরে উঠে যেতে পারে! তবে ভয় একটাই অনেক সময় পাহাড়ের ওপর থেকে এরা পাথর গড়িয়ে ফেলে আর তাতে মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনাও ঘটে যায়। কখনো কখনো ভরাল শিকার করতে গিয়ে পাহাড়ি চিতা চলে আসে ক্যাম্পের কাছে, তাই এদের দেখতে পাওয়া সব সময় যে সৌভাগ্যের হবে তা বলা যায় না! পাহাড়ি ছাগলগুলো অনেকক্ষণ আমাদের ক্যাম্পের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করল। মনিন্দররা আবার একফাঁকে গিয়ে পাথরের ওপর কিছুটা নুন রেখে এল, ওরা নাকি নুন খুব ভালো খায়! আর সেই নুন খেতেই কয়েকটা ভরাল টেন্টের খুব কাছে চলেও এল! ওদের মধ্যে একটির মাথায় বেশ বড় শিং, সম্ভবত ও দলের নেতা, সতর্কচোখে চারদিকে নজর রাখছিল, আর বাকি ভরালগুলো নিশ্চিন্তে ঘাস খেয়ে চলেছিল। বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর সূর্যের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পাথরের নদী আর চঞ্চলা নন্দাকিনী

শিলাসমুদ্র একটা ভ্যালি হওয়ায় সূর্য ওঠারও অনেক পরে এখানে আলো এসে পৌঁছায়, তাই এখানে পাহাড়ের চূড়ার লাল আভা দেখতে পাওয়া মুশকিল। তবে আকাশ পরিষ্কার থাকায় সামনে নন্দাঘুন্টিকে খুব কাছ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এদিনের চলার পথ সেই পাহাড়কে লক্ষ্য করেই, পৌঁছতে হবে ওরই পায়ের কাছে দোদাংএ। এর মাঝে একটা হিমবাহ পেরোতে হবে, আর সেটা করতে হবে রোদের তাপ বেড়ে বরফ গলে যাওয়ার আগেই। তাই রাস্তা খুব বেশি না হলেও আমরা সকাল ন'টার মধ্যে শিলাসমুদ্র ছেড়ে রওনা দিলাম। জুনারগলি থেকে আসার সময় তিনটে জলের ধারার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে নালাটা দেখতে পাচ্ছিলাম এগিয়ে গেলাম সেদিকেই। পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে ওঠা লাল-হলুদ বাহারি গাছ আর ছোটো ছোটো ফুলে শিলাসমুদ্র যেন সেজে উঠেছে। এদিকে একটা ছোটো হেলিপ্যাডও বানানো হয়েছে, আপৎকালীন উদ্ধারকাজে হয়তো তার ব্যবহার হয়। হেলিপ্যাডের পাশের একটা সরু রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগোতেই হিমবাহের ওপর মোরেন জোন দেখতে পেলাম।

অসংখ্য পাথরের বোল্ডার একটা খাতের মধ্যে জমা হয়ে যেন পাথরের একটা নদী তৈরি হয়েছে। এই পাথরের নদী পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে অন্য পাড়ে। কিন্তু এই নদীর কিনারা পর্যন্ত পৌঁছানোই তো এক দুঃসাধ্য কাজ! একটা গড়ানো পাথরের ঢালু রাস্তা নেমে গেছে পাথুরে নদীর তীর পর্যন্ত। কোনোরকমে চলার মতো এই রাস্তা আনন্দ নিজেই বানিয়ে নিয়েছে! এর মধ্যে বাবুদা ট্রেকিংএর ঠিক আগে যে নতুন জুতোজোড়া কিনেছিল তা পড়ে চলতে অসুবিধা হওয়ায় মানবদার সঙ্গে বদলা-বদলি করে নিয়েছিল। এখানে তাই দুজনকেই নিজেদের অচেনা জুতো পড়ে নিচে নামতে হবে। এই সরু রাস্তার বাঁ দিকটা খোলা, আর তার নিচে সেই অগুনতি পাথরের নদী। তাই মুহূর্তে অসতর্কতায় কেউ যদি ব্যালেন্স হারিয়ে সেদিকে চলে যায়… এরপর আর ভাবতেও ভয় হচ্ছিল। ছোটোবেলায় হলে চোখ বুজে এখানেই দাঁড়িয়ে যেতাম আর হাজার চেষ্টাতেও কেউ এক পাও নড়াতে পারতো না! কিন্তু এখন উপায় নেই, হিমবাহ গলার আগে এই নদী পেরোতেই হবে। কখনও একপা আগে ফেলে, কখনও বসে পড়ে, কখনও বা উল্টোমুখী হয়ে হাত দিয়ে খড়কুটো আঁকড়ে নিচে নামার চেষ্টা করে গেলাম। অবশেষে আনন্দের সাহায্য নিয়ে প্রায় গড়িয়ে খানিকটা হাঁচোড়পাঁচোড় করে নিজেদের নদীর কিনারায় নিয়ে ফেললাম। এমন ঘটনা রোজ রোজ ঘটে না, কখনওবা 'ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম', তাই বাবুদা নিজের মোবাইলে পুরো অভিজ্ঞতা রেকর্ড করে নিল। তবে এ তো সবে পাথর-নদীর ধার, পেরোতে হবে পুরো মোরেন জোনটাই! এমন পথে যাওয়ার কোনও ধারণাই আমার ছিল না, তাই ক্যাপ্টেন আমায় দেখিয়ে দিচ্ছিল যে এই পাথরের নদীর নিচে রয়েছে জমাট বাঁধা বরফ, যা আসলে একটা হিমবাহ। সেই বরফ কোথাও কোথাও গলে নদীর আকার নিয়েছে। এই হিমবাহ গলার জায়গাটাকে বলে স্নাউট পয়েন্ট, আর এরকমই একটা স্নাউট পয়েন্টের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। এবার বড় বড় পাথরের ওপরে পা ফেলে মোরেন জোন পেরোনোর পালা। সমস্যা একটাই, কিছু পাথর বেশ নড়বড়ে, আর একটু ডিসব্যালেন্স হলে হয় পা মচকাবে নয়তো হাড়গোড় ভাঙবে। আবার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও চলবে না, নীচের বরফ গলতে শুরু করবে। অনেকটা এক্কাদোক্কা খেলার মতো পাথরের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে অবশেষে সেই নদী পেরোনো গেল। নদী পেরিয়ে একটা ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে আসতেই নতুন এক জগৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল। একপাশে নন্দাঘুন্টি পাহাড় আর তার পাশ দিয়ে প্রবল স্রোতে নেমে এসেছে নন্দাকিনী নদী, অন্য পাশে রয়েছে রংবাহারি ঘাস, লাল ছোট ফল আর জংলি ফুলের উপত্যকা। রন্টি স্যাডেল যাওয়ার পথে সবচেয়ে ভালো বিষয়টা হল যখনই কোনও কঠিন পথ পেরোনো হয়েছে তার ঠিক পরপরেই পাওয়া গেছে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মত এক প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাই এতদিন একনাগাড়ে পথচলা হলেও কখনোই তা একঘেয়ে বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি।

সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে হিমবাহের বরফ গলার আগেই মোরেন জোন পেরিয়ে যাওয়ায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। এর পরের পথ বিশেষ চ্যালেঞ্জিং নয়। কখনও পাহাড়ের গায়ে খয়েরি-সবুজ ঘাসের মাঝে মাটির পথ আবার কখনও নদীর ধারের পাথুরে পায়ে চলা পথ ধরে ধীরেসুস্থেই চলতে থাকলাম। পথে চড়াই কম, মোটামুটি সোজা রাস্তাই বলা যায়। বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় ঘেউথাপ্পানের কাছাকাছি পৌঁছে বিশ্রামের সময় হল। আনন্দ জানাল ব্যাগপত্তর আর রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে বিনোদরা এখনও এসে পৌঁছায়নি, তাই বেশ কিছুটা সময় রয়েছে এই সুন্দর জায়গাটাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার জন্য। রোদের তাপ আস্তে আস্তে বাড়ছে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসছে। সামনে প্রবল স্রোতে বয়ে চলেছে নন্দাকিনী নদী, কিন্তু তার জল বালি-পাথরে ভরা। ক্যাপ্টেন শিখিয়ে দিল যে নদীর ধারের দিকে শ্যাওলাপড়া জমির ওপর দিয়ে যে জল বয়ে যায় সেই জল অনায়াসে খাওয়ার জন্য নেওয়া যেতে পারে। সেইমতোই আমরা বোতলে ঠাণ্ডা জল ভরে নিলাম আর প্রাকৃতিক কোল্ডড্রিঙ্কস-এ গলা ভেজালাম। ব্যাগ থেকে আস্তে আস্তে বিস্কুটের প্যাকেট আর শুকনো খাবার বেরিয়ে এল, তাই দিয়েই দুপুরের টিফিন সারা হল। আনন্দ সেই লোহাজং থেকে একখানা রামধনুর মতো সাতরঙা ছাতা নিয়ে পথ চলছিল, এখানে এসে সেটা মেলে রোদের আড়াল খোঁজার চেষ্টা করল। নদীর ধারের এই জায়গা থেকে আঁকাবাঁকা নন্দাকিনীকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। পরের পথের প্রায় পুরোটাই পাথুরে আর সাদা ছাইয়ের মতো রঙের।
কিছুক্ষণ পর রাঁধুনি আর পোর্টাররা এসে পড়লে আবার এগোতে শুরু করলাম। এপথে কোথাও কোথাও পথের ধারে লাল রঙের বাহারি পাতার গাছ, কোথাও ছোট ছোট বুনো ফল দেখতে পেলাম। কোথাও কোথাও দু-এক গোছা জংলি ঘাসও রয়েছে, কিন্তু তা খচ্চরের খাবার জোগানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই বিনোদ আর মনিন্দর অনেক দূর থেকে জোগাড় করা ঘাস পিঠে-মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলেছে পরের ক্যাম্পের দিকে।

হঠাৎই পাহাড়ের ওপরে একটা শব্দ শুনতে পেলাম, ওপরদিকে তাকিয়ে দেখি বেশ কিছু পাথর ধুলো উড়িয়ে পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে। আনন্দ বলল, পাহাড়ে ধ্বস নেমেছে, তবে তা খুবই ছোটখাটো আর আমাদের রাস্তা থেকে অনেক দূরে, তাই চিন্তার কিছু নেই। নদীর ধার বরাবর কিছুদূর যাওয়ার পর একটা পাথরের মন্দির চোখে পড়ল, এর নাম "ছোটা হোমকুণ্ড"। যদিও এখানে একটা সাইনবোর্ডে হোমকুণ্ড লেখা এবং সমুদ্র থেকে উচ্চতা ৫১০০ মিটার বলা হয়েছে, কিন্তু এই যায়গাটা জুনারগলির চেয়ে উঁচু মনে হল না। ছোটা হোমকুণ্ডের পাশে একটা পাথরে ঘেরা দুর্গ মতন করা রয়েছে তবে এর আশেপাশে কোনো "কুণ্ড" জাতীয় জলার দেখা পেলাম না, কী জানি হয়তোবা নজর এড়িয়ে গেল!
ছোটা হোমকুণ্ড পেরোতেই একটা বিশাল পাথরের আড়ালে সবুজ টেন্টগুলো চোখে পড়ল, এর মধ্যেই পোর্টাররা গিয়ে সেখানে ক্যাম্প বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু পৌঁছাতে গেলে আবারও পেরোতে হবে অনেকটা বোল্ডার জোন, সেই এক্কা-দোক্কা খেলা, পাথরের ওপর লাফালাফি! তবে এবার পাথরগুলো ততটা নড়বড়ে নয় আর এখানে নিচে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। পাথরের ওপর পথের কোনো অস্তিত্ব নেই, তবে তার শেষ মাথায় আবার পায়ে চলা পথের আভাস দেখা যাচ্ছে। সেদিকে নজর রেখে সাবধানে পাথরের ওপর পা ফেলে চলতে থাকলাম। বোল্ডার জোন পেরোতেই একটা কাঠের পুল চোখে পড়ল। সেদিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে ওপারে খয়েরি ঘাসের মধ্যে থাকা ভরালগুলো নজর কেড়ে নিল। এখানে মানুষজনের উৎপাত নেই তাই দিনদুপুরের ওরা নির্ভয়ে খোলা জমিতে চড়ে বেড়াচ্ছে। সামনের ভরালটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই ও বোধহয় লজ্জা পেয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়ল। কাঠের পুল পার করে দোদাং-এ পা দিলাম। পুলের ঠিক বাঁপাশে সিঁড়ির মতো একটা ঢালু রাস্তা নেমে গেছে ক্যাম্পের দিকে। শিলাসমুদ্রের চেয়ে অনেক অনেক বড় একটা পাথরের আড়ালে আমাদের থাকার টেন্টগুলো পাতা হয়েছে। বিকেল তখন পৌনে তিনটে, সূর্যের আলোর তেজ সেরকম কমেনি, কিন্তু একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত সবসময় বয়ে চলেছে। তবে টেন্টটা পাথরের আড়ালে হওয়ায় সেই হাওয়ার দাপট থেকে অনেকটাই রক্ষা পাচ্ছে। সেই কাত হওয়া পাথরের ওপর পলিথিন খাটিয়ে রান্নাঘর আর গাইড পোর্টারদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। খচ্চরগুলোকে বেঁধে রাখা রয়েছে পুলের কাছাকাছি।

সুখেনদা অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিল, আমি আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবুদাও পৌঁছে গেল। তবে মানবদা দুর্বল শরীরে বেশ কিছু পরে ক্যাম্পে পৌঁছাল। এখানেও টেন্টগুলো শক্ত পাথরের ওপরে পাহাড়ের ঢালে ফেলা হয়েছে তাই রাতে যে ঘুমোতে একটু সমস্যা হতে পারে তা আঁচ করে নেওয়া গেল। সুখেনদার কাছে জেনেছিলাম কাছাকাছি জলের জোগান না থাকলে ক্যাম্প বসানো সম্ভব নয়, কিন্তু এখানে নন্দাকিনী নদীর ধারা বয়ে গেছে দোদাংয়ের অনেক নীচ দিয়ে। সেখান থেকেই জল বয়ে নিয়ে এসে আমাদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পপকর্ন আর চা পেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। বাবুদা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত, যেখানেই ফুরসত মেলে সেখানেই সমস্ত অঞ্চলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণসমেত চারপাশের পরিবেশের ভিডিও মোবাইলে রেকর্ড করে নেয়, আর সক্কলের সঙ্গে কথা বলে তাদের মধ্যে ক্লান্তির ছোঁয়াটুকুও লাগতে দেয় না। এদিকে নতুন জুতোয় পায়ে ফোস্কা পড়ে যে যন্ত্রণা হচ্ছে তা বাবুদার মুখ দেখলে একটুও বোঝা যাবে না। এখানেও রান্নাঘরে হীরা, বিনোদ আর মনিন্দরের সঙ্গে কথা বলে এসে বসে গেল আনন্দের ইন্টারভিউ নিতে। 'কাল সকাল চারটেয় ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়তে হবে', 'রাস্তা ভীষণ চড়াই', 'ঠাণ্ডার জন্য গ্লাভস সঙ্গে রাখবেন আর বরফে যাতে চোখ ঝলসে না যায় তাই সানগ্লাস' এরকম কিছু ভয়-পাওয়ানো কথার মধ্যে দিয়ে নিজেদের মানসিক প্রস্তুতি সেরে নিলাম।

দোদাংয়ের পুরোটা পাহাড়ে ঢাকা না হলেও আশেপাশে অনেকগুলো উঁচু চূড়া দেখা যায়। খুব কাছে, প্রায় ঢিলছোঁড়া দূরে দেখা যাচ্ছে নন্দাঘুন্টিকে। অন্যপাশে চোখের আন্দাজে প্রায় একই রকম দূরে রয়েছে ত্রিশূল। মাঝে একটা নাম না জানা রুপোলি পাহাড়, পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়ে তা চকচক করতে লাগল। এই পাহাড়ের দুপাশ থেকে পাথরের সারি নেমে এসেছে দোদাং লক্ষ্য করে। আশপাশের সবগুলো ছোট পাহাড়ই যেন গড়ানো নুড়ি-পাথরের চাদরে ঢাকা! পুলের কাছে গেলে শিলাসমুদ্র আর জুনারগলিও চোখে পড়ে, আর উল্টোদিকে দূরে পাহাড়ের ওপর দেখতে পাওয়া যায় আঁকাবাঁকা বরফের রেখায় ফুটে ওঠা রন্টি স্যাডলের পথ। ত্রিশূল অভিযানের জন্য একটু দূরে একটি পর্বত অভিযাত্রীদল ছাউনি ফেলেছে, এটাই ওদের বেস ক্যাম্প।
দোদাং-এ সৌন্দর্য শিলাসমুদ্র বা বেদনি বুগিয়ালের মত নয়, নিতান্তই সাদামাঠা। তবে নির্জন টেন্ট এরিয়ার নিচ দিয়ে বয়ে চলা নন্দাকিনী নদী, আশেপাশের চকচকে পাহাড় আর দুষ্প্রাপ্য ভরাল-এর উপস্থিতির জন্যেই পাহাড়ি ক্যাম্পসাইট হিসাবে দোদাং তার আভিজাত্য ধরে রেখেছে। আনন্দের আনা রেডিওর গান শুনে আর নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিতে দিতেই সন্ধ্যা নেমে এল। একটু পরে ভাতের সঙ্গে পনির আর ডিমভাজার কুচি দিয়ে রাতের খাবার সেরে টেন্টে আশ্রয় নিলাম। হয়তো অক্সিজেনের অভাবেই হবে, মাথাটা সামান্য ধরা ধরা লাগল। নন্দাকিনীর স্রোতের একটানা শব্দ আর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা সত্ত্বেও চেষ্টা করলাম তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার, পরদিন রাতভোরেই যে বেরিয়ে পড়তে হবে রন্টি স্যাডলের পথে।

~ ক্রমশঃ ~

~ রন্টি স্যাডল ট্রেক রুটম্যাপ || রন্টি স্যাডল ট্রেকের আরও ছবি ~

'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণপত্রিকার সহসম্পাদক সুদীপ্ত দত্ত ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়েন নিরালার খোঁজে। নতুন জায়গার সাথে মিশে আপন করে নেন সেখানকার জীবন, সংস্কৃতি আর খাদ্যাভ্যাস। তারপর তাঁর প্রিয় পত্রিকাটির পাঠকদের সাথে ভাগ করে নেন সেই যাত্রাপথের খুঁটিনাটি।

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher