বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই কিন্তু এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - amaderchhuti@gmail.com
হঠাৎ দেখা
ডঃ দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত
|| তথ্য - পেঞ্চ অভয়ারণ্য ||
ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে সাতটা - জানুয়ারি মাসের শেষে শীত বেশ ভালোই পেঞ্চ অভয়ারণ্যে। গত দু দিন ধরে সকাল – বিকেলের জিপ সাফারিতে আমরা অগুনতি চিতল হরিণ আর সম্বর ছাড়াও নীলগাই, বুনো শুয়োর, লাঙ্গুর আর গোটা চারেক শেয়ালের দেখা পেয়েছি। আর অনেক পাখি – মাছরাঙা, মেছো বক, নীলকন্ঠ, ক্রেস্টেড সার্পেন্ট ঈগল, ব্ল্যাক কোরমোরান্ট, রঙবেরঙের বী ক্যাচার, জমকালো ময়ূর। দিনের আলো এড়াতে গাছের কোটরে বসে আছে ছোট পেঁচা। শালের জঙ্গল আর মাঝে মাঝে ‘ভৌতিক’ সাদা গাছ। বেশ বোঝা যায় চাঁদনি রাতে এই গাছগুলো দেখলে বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে শুরু করবে।
পেঞ্চ-কে এক সময় লেপার্ডের জায়গির বলা হত – যদিও ফরেস্ট গার্ডরা বলছিল বাঘের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে লেপার্ডরা ক্রমশ লুকিয়ে পড়ছে। বাঘ লেপার্ডের জাত শত্রু – আকারেও অনেক বড়। শেষ গণনা অনুযায়ী পেঞ্চ-এ এখন বাঘ আছে ৩৩টা। অভিজ্ঞদের মতে তাঁদের দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর – এ ব্যাপারে পেঞ্চের বিখ্যাত প্রতিবেশী বান্ধবগড় আর কানহা অনেক এগিয়ে।
এখনো অবধি যা দেখা গেছে তাতে আমরা বেশ খুশিই ছিলাম। ঘন সবুজ বনের নিস্তব্ধতা চিরে মাঝে মাঝে অচেনা পাখির ডাক, পাতা মাড়িয়ে খসখসে আওয়াজ তুলে হরিণের পালের দৌড়ে যাওয়া – এই তো অনেক! তবু যত পাওয়া যায়, ইচ্ছে আরও বেড়ে যায়! যদি সত্যি দেখা পাওয়া যেত বাঘের...
আমাদের জিপ একটা বাঁক ঘুরতেই আমরা এক দল গাউর-এর মধ্যে গিয়ে পড়লাম। আমাদের চারপাশে ঘিরে আছে ওরা, এমন সময় আশপাশ থেকে নানান আওয়াজ শুরু হল। গাছের মাথায় থাকা লাঙ্গুরদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল – বাঘ দেখতে পেলে যেমন ‘কাঁক-কাঁক’ করে ডাকে। বিশাল আকৃতির গাউরগুলোর মধ্যেও একটা অস্থিরতা – পিছন দিকে ফিরে ফিরে দেখছে। আমাদের ড্রাইভার ইঙ্গিতটা বুঝে গাড়ি ঘোরাল। সকলের মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা – অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা। ড্রাইভার-ই প্রথম নজর করল – জঙ্গলের পথে রাজকীয় ভঙ্গিমায় হেঁটে যাচ্ছে - আমাদের থেকে একটু বাঁদিকে। বিরাটকায় একটা বাঘিনি – কমলা-হলুদের ওপর ডোরাকাটা গায়ে ঝলমল করছে রোদ্দুর – গলায় একটা রেডিওকলার (পরে জেনেছিলাম ফরেস্ট গার্ডরা ওকে ‘কলারওয়ালি’ নামে ডাকে)। জিপের এত কাছাকাছি ছিল যে আমি প্রথমটায় ভেবেছিলাম এদিকেই হয়তো আসছে! কিন্তু আমাদের পাত্তাই দিলনা, দিব্যি সোজা রাণীর মতো হেঁটে গিয়ে সামনের একটা গাছে নিজের মূত্র স্প্রে করে এলাকা চিহ্নিত করল। যেন বুঝিয়ে দিল এখানে ওই সর্বেসর্বা। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গেল ‘জামনালা’-র দিকে। যতক্ষণ ও ছিল – একটা পিন পড়লেও যেন শোনা যেত। ছবি তোলার কথাও শুরুতে ভুলেই গিয়েছিলাম!
ফেরার পথ ধরলাম আমরা। মনটা আনন্দ আর উত্তেজনায় ভরে আছে - শুধু একটা আফসোস হচ্ছিল ভাল করে ক্যামেরায় ধরে রাখতে পারলাম না বলে। অন্যান্য পর্যটকরা – এমনকি অন্য জিপের ড্রাইভার, ফরেস্ট গার্ডরাও আমাদের ভাগ্যের প্রশংসা করছিল। ‘পাগমার্ক’ চোখে পড়েছে অনেকেরই – কিন্তু সেদিন বাঘ দেখার সৌভাগ্য আর কারোর হয়নি!
বাঘ দেখতে বান্ধবগড় আর কানহা তো অনেকেই যান, আমি বলি বরং ঘুরে আসুন পেঞ্চ থেকে। নাগপুর থেকে মাত্র ১০০ কিমি। এন.এইচ.৭-এ বাস থেকে নেমে পড়ুন খ্বাসায় – সেখান থেকে জিপে ১২ কিমি দূরে তুরিয়া। নাগপুর থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে সরাসরিও পৌঁছাতে পারেন হাজার দেড়েক টাকায়। বেশ কয়েকটা বেসরকারি হোটেল আছে আর এম.পি. ট্যুরিজমের রিসর্ট কিপলিংস্ কোর্ট তো খুবই ভাল – অনেকটা খোলামেলা – সুন্দর সাজানো আর খাওয়াদাওয়া-ও দারুণ! তারপর সবুজ অরণ্যের বুকে চেনাঅচেনা বন্যপ্রাণের মাঝে হঠাৎ যদি বাঘের দেখা মেলে তাহলেতো কথাই নেই…।
(অনুবাদঃ রত্নদীপ দাশগুপ্ত)
পেশায় চিকিৎসক দেবপ্রিয় নেশায় ভ্রামণিক।
হাউসবোটে একদিন
অদিতি ভট্টাচার্য
দুপাশে ছবির মত গ্রাম, বৃষ্টিভেজা সবুজ সবুজ ধান ক্ষেত, ছোট ছোট শহর, কোথাও মাঠে বাচ্চারা খেলছে, কোথাওবা জলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে নারকেল গাছ, দূর থেকে ভেসে আসছে চার্চের ঘন্টাধ্বনি। হাউসবোটের কোলে বসে দুচোখভরে দেখছি প্রকৃতির এই অপরূপ চিত্রবিন্যাস।
কেরালার ব্যাক ওয়াটারের খ্যাতিতো সারা পৃথিবী জুড়েই। মালাবার উপকূলের সমান্তরালে অবস্থিত এই ব্যাক ওয়াটার দৈর্ঘে সমগ্র কেরালা রাজ্যের প্রায় অর্দ্ধেক। ২০১০-এর অক্টোবর মাসে এই ব্যাক ওয়াটারে পুরো এক দিন এক রাত কাটাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
কোভালাম থেকে এক অকাল বৃষ্টি ভেজা সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হয় কোট্টায়াম জেলার কুমারাকোমের উদ্দেশ্যে। কেরালার ব্যাক ওয়াটার ক্রুইসগুলো সবই শুরু হয় কুমারাকোম নয় আলেপ্পি থেকে। দু’ধরণের হয় এই ভ্রমণ, একটা কয়েক ঘন্টার আর একটা পুরো চব্বিশ ঘন্টার। আমাদের ভ্রমণ সংস্থা আগে থেকে আমাদের জন্যে একটা দু’ রুমের বাতানুকূল হাউসবোট বুক করে রেখেছিল। পুরো হাউসবোটে কুক আর দুজন চালক ছাড়া ছিলাম আমরা তিনজন - আমি আর মা-বাবা।
কেরালা গভর্ণমেন্টের নির্ধারিত নিয়মানুসারে হাউসবোট তিন রকম হয় - প্ল্যাটিনাম, গোল্ড, সিলভার। হাউসবোটের স্থানীয় নাম কেট্টুবাল্লাম। দু’হাজারেরও বেশি হাউসবোট এই রুটে টুরিস্ট নিয়ে চলাচল করে। ভাসমান এই বাড়িগুলোর আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা সত্যিই দেখার মত। পরিষ্কার- পরিছন্ন রান্নাঘর, বিলাসবহুল হোটেলের সমতুল্য শোয়ারঘর, লাগোয়া বাথরুম, তিনদিক খোলা প্রশস্ত ডাইনিং রুম - যেখান থেকে এই ব্যাক ওয়াটার ভ্রমণ পুরোপুরি উপভোগ করা যায়। একদিন আগেই ফোন করে জেনে নেওয়া হয়েছিল আমরা কি ধরণের খাবার পছন্দ করব,আমিষ না নিরামিষ।
ওঠার সঙ্গেসঙ্গেই ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে এল সরবত। মৃদুমন্দ গতিতে চলতে শুরু করল হাউসবোট। বৃষ্টিও ততক্ষণে ধরে গেছে। উন্মুক্ত ডেকে বসে দৃশ্য উপভোগ করতে ভারি ভালোলাগছে। অচেনা গ্রাম-শহর, মাঠ-ধানক্ষেত পেরিয়ে ভেসে চলেছি। কোথাও ছোট মন্দিরের সামনে ম্যারাপ বেঁধে কোনো পুজো হচ্ছে, কোথাওবা জলের দুপাশে শুধুই সবু্জ, আবার কোথাওবা সাজানোগোছানো বিলাসবহুল রিসর্টের চেনা ছবি। হাউসবোট যত এগোচ্ছে দুধারের ছবির মত দৃশ্য বদলে বদলে যাচ্ছে। ফিস স্যাংচুয়ারির পাশ দিয়ে এগিয়ে জলের ধারে বার্ড স্যাংচুয়ারি দেখতে দেখতেই ভেসে যেতে লাগলাম। দেখতে পেলাম সমুদ্রতলের থেকেও নীচুতে অবস্থিত ধানের ক্ষেত।
দেখতে দেখতেই ডেকে বসে লাঞ্চও সারা হল। ভাত, নানারকম তরকারি, পাঁপড় ভাজার সঙ্গে ছিল ব্যাক ওয়াটারের বিখ্যাত ব্ল্যাক ফিসের একটা অতুলনীয় পদ। পথেই দেখেছি চাইনিজ ফিসিং নেট দিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতিতে মাছ ধরা। কেরালার ব্যাক ওয়াটারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার জল নদীর জলের থেকে বেশি নোনা কিন্তু সমুদ্রের জলের মত অতটা নয়।
বিকালবেলা এসে পৌঁছলাম ভেম্বানাদ লেকে, দৈর্ঘ্যে যা ভারতের সবচেয়ে বড় লেক। এখানে একটা ব্যারেজ তৈরী করা হয়েছে যাতে আরব সাগরের নোনা জল নদীর জলের সঙ্গে মিশতে না পারে। এই সব নদীর জল চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়। এখানে একটা রেল কাম রোড ব্রিজ রয়েছে যা কোট্টায়াম আর আলেপ্পি এই দুটো জেলাকে যুক্ত করেছে। বিকাল পাঁচটা থেকে সকাল ন’টা পর্য্যন্ত কোনো হাউসবোট চলাচল করে না, এই সময়টা মাছ ধরা হয়। বেশিরভাগ হাউসবোট তাই ভেম্বানাদ লেকে রাত কাটায়।
আমাদের হাউসবোটও লেকেরই পাশে একটা গ্রামের ধারে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাউসবোট থেকে নেমে গ্রামে ঘুরতে বেরোলাম। মাটির দেওয়াল আর খড়ে ছাওয়া ছোট ছোট বাড়ি, সবুজ ধান ক্ষেত আর তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেঠো রাস্তা। সন্ধে হতেই আবার হাউসবোটে ফিরে আসা। কাছে দূরে আরও কয়েকটা হাউসবোট ততক্ষনে জড়ো হয়েছে ভেম্বানাদ লেকে। দেখতে দেখতে সব কটাতে জ্বলে উঠল হালকা আলো। চতুর্দিক অন্ধকার,শুধু হাউসবোটে জ্বলা বিন্দু বিন্দু আলো, ঝিঁঝিঁর একটানা আওয়াজ, কত নাম না জানা নিশাচর পাখির ডাক – সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ। আমরা ডেকেই বসে রইলাম তা উপভোগ করার জন্যে। দূরে একটা অপেক্ষাকৃত বড় হাউসবোট থেকে ভেসে আসছিল অন্তাক্ষরী খেলার আওয়াজ। এমন রোমাঞ্চময় পরিবেশে আলো আঁধারিতে জলের ওপর খোলা ডেকে ডিনার করার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল ঝলমলে রোদ্দুরে। আগের দিন যেটুকু মেঘ ছিল তাও যেন কোন মন্ত্রবলে উধাও। ঝকঝকে নীল আকাশ, জলে রোদের ঝিকিমিকি, মাছরাঙার উড়ে যাওয়া, হাঁসের পালের ভেসে যাওয়া – হ্যাণ্ডিক্যাম সুইচ অফ করতেই ইচ্ছে করছিল না। দোসা আর আলুর তরকারি দিয়ে প্রাতরাশ সারার পর হাউসবোট আবার চলতে শুরু করল। ঘন্টা দুয়েক চলার পর আবার কুমারাকোমে এসে থামা। হাউসবোট থেকে নেমে রওনা দিলাম থেক্কাডির দিকে। মনের মধ্যে রয়ে গেল জলপথে ভ্রমণের এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা আর হাউসবোটের ক্রু-এর অতুলনীয় আতিথেয়তা।
সংখ্যাতত্ত্ববিদ অদিতির কাছে বই আর অক্সিজেন সমতুল্য। কর্মসূত্রে বছর খানেক আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। ভ্রমণ, ছবি তোলা, এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি লেখালেখিতেও সমান উৎসাহী।