তথ্যঃ অভিষেক চট্টোপাধ্যায়
প্রকৃতি তার রূপের থালায় সাজিয়েছে বৈচিত্র্যের অপরূপ রংছবি। কোথাও বনে বনে লেগেছে সবুজ আবিরের আভা, কোথাও বা শীর্ণকায়া নদী পরিচয় বদলে নিজেকে করে তুলেছে উত্তাল ঝরনা। আর শুষ্ক প্রান্তরের রুক্ষ আবেশ, সেও যেন এক অনন্য শোভায় নিজেকে মেলে ধরেছে পর্যটকদের কাছে। রয়েছে ঐশ্বরীয় ইতিহাসঘেরা মন্দিররাজি। এককথায় মধ্যপ্রদেশ যেন এই বিশ্বপ্রকৃতির একটা আস্ত পরিচয়পত্র। পথ-আপথের আঁকেবাঁকে এখানে লুকিয়ে আছে আনন্দের পরোয়ানা।
ভূপাল(Bhopal)- সেই ১১শতকের রাজা ভোজের আমল। প্রতিষ্ঠা হল ভূপাল। শোনা যায়, রাজা ভোজ কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন। কোনও এক সাধুর নির্দেশমতো তিনি একটি সরোবর খনন করেন। তারপর সেই সরোবর জলে স্নান করে তিনি রোগমুক্ত হন। তাই সেই সরোবরের নাম হয় ভোজপাল। কালে কালে ভূপাল। দিনানুদিনের পরিবর্তনে এ শহরের গায়ে লাগল আধুনিকতার হাওয়া। আজ তো এই ঐতিহাসিক শহরই এ রাজ্যের রাজধানী। নতুন-পুরনো ভূপালের ঠিক মাঝবরাবর রয়েছে আপার লেক এবং লোয়ার লেক। শহরের চকবাজারে চোখ টানবে সুবিশাল তাল-উল মসজিদ। রয়েছে ১৮৩৭ এর জামা মসজিদ। অবশ্য এরপর ১৮৬০ সালে তৈরি হয় আরও একটি মসজিদ। নাম তার মোতি মসজিদ। শহরমধ্যের বাজারটা ছাড়ালেই শ্বেতমর্মর শরীর নিয়ে আজও একইভাবে আকর্ষণের বিন্দু। রাজা মানেই তো রাজ্যপাট। আর রাজ্যপাট বললেই মনে পড়ে রাজার সভা অর্থাৎ এখানকার সদর মঞ্জিল। এসব ছাড়াও আদিবাসী জীবন কোলাজে গড়ে ওঠা ট্রাইবাল মিউজিয়াম, ভারত ভবন আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়াম। ওই যে আপার লেকের কথা বললুম, ওর ঠিক পাশেই বনচর প্রাণ ঘেরা বনবিহার সাফারি পার্ক। লোয়ার লেকের ধারে অ্যাকোয়ারিয়ামটাও দেখার মতন। নতুন ভূপাল শহরের আরও একটি দ্রষ্টব্য হল লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। সংলগ্ন অঞ্চলেই বিড়লা সংগ্রহশালা।
থাকা- ভূপালে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল রয়েছে। (ক) পলাশ রেসিডেন্সি (খ) লেকভিউ অশোক। এছাড়াও প্রচুর বেসরকারি হোটেল।
সাঁচি (Sanchi)- বুদ্ধমন্ত্রের এক পীঠস্থান বলা যায়। সাঁচির খ্যাতির মূলে প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধস্তূপগুলি আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। পুঁথির পাতা ওলটালেই ধ্যানমৌন সম্রাট অশোকের পাথরখোদাই ছবি। সাঁচির স্তূপ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা এখানেই। রয়েছে শ্রীলঙ্কা মহাবোধি সোসাইটির বুদ্ধমন্দির ও পুরাতত্ত্ব মিউজিয়াম।
থাকা- এখানে দু’টি হোটেল রয়েছে মধ্যপ্রদেশে পর্যটনের। (ক) গেটওয়ে ক্যাফেটেরিয়া এবং (খ) গেটওয়ে রিট্রিট। এছাড়া মহাবোধি সোসাইটির অতিথিনিবাসেও থাকা যায়। তবে সেটা অনুমতিসাপেক্ষ।
বিদিশা (Bidisha)- ইতিহাস-মেশা নামটায় লেগে আছে মহাকবি কালিদাসের কলম-কালি। তাঁর কাব্য মেঘদূতম্। বেঁচে থাকার ইতিকথা শোনাতে এই বিদিশার বুকেই কখন যেন মিলে গেছে বেতোয়া ও বেস নদী। এ শহর প্রায় ২,৭০০ বছরের বৃদ্ধ। এর যৌবনটাকে চিনিয়ে দেয় গ্রিক-সম্রাট আলেকজান্ডারের হেলিওডোরাস স্তম্ভ। তা সে প্রায় ১৪০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কথা।
উদয়গিরি (Udaygiri)- বিদিশা থেকে মাত্র ১০কিমি দূরত্বে উদয়গিরি। ভারতীয় ভাস্কর্যের সোনার কাল এখানেই থমকে আছে। রয়েছে উদয়গিরি গুহা। অতীতে অনেককটা গুহার অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে সর্বসাকুল্যে কুড়িটি গুহার দেখা মেলে। ভাস্করের নিপুণ হাতেই ফুটে উঠেছে বিষ্ণুর বরাহ অবতার আর অনন্তশয়ান রূপ। রয়েছে মুখাবয়ব খোদিত শিবলিঙ্গ। এখানে হিন্দুভাস্কর্যের সাথে অনায়াসে মিশে গেছে জৈন সংস্কৃতি।
থাকা - একদিনেই সাঁচি-বিদিশা-উদয়গিরি দেখে ফিরে আসা যায় ভূপালে। তাই বিদিশা ও উদয়গিরিতে থাকার প্রয়োজন নেই। মধ্যাহ্ন ভোজন সারবার ভালো জায়গা রয়েছে সাঁচিতে। মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের ট্র্যাভেলার্স লজ।
ভোজপুর (Bhojpur)- সময়টা মধ্যযুগ। উদ্দেশ্য ছিল চাষাবাদের জন্য সরোবর নির্মাণ। লক্ষ্য সফল হবার পর সরোবরের তীরেই পারমার রাজা ভোজের উদ্যোগে পত্তন হল নগরের। বর্তমানের ভোজপুর। প্রাচীন নগরীর পূবদিকে অনুচ্চ টিলায় লাল বেলেপাথরের শিবমন্দির। নাম সোমনাথ ভোজেশ্বর মন্দির। মন্দির অসমাপ্ত হলেও এর গায়ের কারুকাজ আর মনোলিথিক ঢঙে একপাথরের সুবিশাল শিবলিঙ্গ পর্যটক–দর্শকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
ভীমবেটকা (Bhimbetka)- এ যেন দুর্গম বিন্ধ্যপর্বতের ঢালে ঘন শালবনের গভীরে অতীতের ঘুমিয়ে থাকা। ৭০০-রও বেশি গুহাকন্দরে নীরব হয়ে আছে ইতিহাস ভাঙা কথোপকথন।উচ্চতা প্রায় ২,২০০ফুট। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আঁকা গুহাছবিগুলি চোখের পাতায় আদিমতার স্পর্শ এঁকে যায়। অনুমান এগুলি প্রায় দশ হাজার বছরের প্রাচীন। এছাড়াও রয়েছে পাহাড়ি ঝরনা আর দেবী দুর্গার মন্দির।
পাঁচমারি (Panchmari)- এ যেন সবুজ মোড়কে মোড়া প্রকৃতিদত্ত এক পাহাড়ি আনন্দ। সাতপুরার কোলে এর বেড়ে ওঠা। ১৮৫৭-য় ক্যাপ্টেন ফোরসাইথ জঙ্গলের মধ্যে এই উপত্যকার সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন। তারপর এখানে ব্রিটিশদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়। ফলে জায়গাটি শহরের রূপ পেতে শুরু করে। ১,০৬৭ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট চমৎকর এই শহরটি এখনও কিছুটা নিরিবিলি। এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য জটাশঙ্কর গুহা, পাণ্ডব গুহা, হান্ডি খো ভিউপয়েন্ট, প্রিয়দর্শিনী পয়েন্ট, বড় মহাদেব, গুপ্ত মহাদেব, বি-ফলস, পাঁচমারি লেক, মিউজিয়াম, ধূপগড়ের সানসেট পয়েন্ট প্রভৃতি।
থাকা- এখানে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের ৮টি হোটেল রয়েছে। অমল তাস, ক্লাব ভিউ, গ্লেন ভিউ, হিলটপ বাংলো, হোটেল হাইল্যান্ডস, পঞ্চবটি, রক অ্যান্ড ম্যানর এবং সাতপুরা রিট্রিট। বেসরকারি হোটেলও আছে প্রচুর।
জব্বলপুর(Jabalpur)- পুরো শহরটাই যেন পাথর দিয়ে তৈরি। অবাক করা ব্যালেন্সিং রক, পাশেই তার রানি দুর্গাবতীর মদনমহল ফোর্ট। রয়েছে গোণ্ডরাজাদের দুর্গ। পুরাণ-মেশা ইতিহাস আছে চৌষট যোগিনী মন্দিরে। কালীর চৌষট্টিজন যোগিনী ছাড়াও আরও প্রচুর দেবদেবীর পাথরমূর্তি এবং গর্ভগৃহে শিব-পার্বতীর ঘোড়ায় চাপা যুগল মূর্তি সত্যিই আশ্চর্য করবে পর্যটকদের। শহরমধ্যে বিনিময়মূল্যে দেখা হয়ে যাবে বিশাল রানি দুর্গাবতী মিউজিয়াম। উত্তাল আনন্দকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে যেতে হবে ধোঁয়ামাখা ধুঁয়াধারে। সেই ঝরনায় বাঁধা পড়েছে নর্মদার বিপুল রূপ। ওরই মধ্যে চোখের ওপর রং ছিটিয়ে যাবে জলকুচি আঁকা রামধনু। ওখান থেকে ৩কিমি দূরেই ভেরাঘাট। পাথুরে আশ্চর্যের অসাধারণ প্রকাশ এখানে। চারপাশ ঘেরা মার্বেল রকসের অলিগলি বেয়ে নর্মদার বুকে ভ্রমণার্থীদের নৌকো ভেসে চলে। মাথাপিছু ভাড়ার হেরফেরে একঘন্টা কিম্বা আধঘন্টা, ইচ্ছেসুখে দেখা হয়ে যাবে সাদা, হলুদ, কালো পাথরের পাহাড়গুলোর রূপবদলের ছবি। মাঝিমুখের কবিতার ছন্দে পরিচয় হবে পাহাড়গুলোর সাথে। চাঁদনি রাতে এর শোভা নাকি দুর্দান্ত। একটু দূরেই তিলওয়ারা ঘাট। ভেসে যাওয়া নর্মদার তীর জুড়ে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে সাধুসন্তের মুখ। ওখানেই রয়েছে তিলতিল করে নিত্য বেড়ে ওঠা শিবলিঙ্গ। কত মানুষ এই তিলভাণ্ডেশ্বর শিবের মাথায় জল ঢেলে প্রার্থনা ভাসিয়ে দেন নর্মদার জলে।
থাকা- জব্বলপুরে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল – কালচুরি রেসিডেন্সি। এছাড়াও অনেকগুলি বেসরকারি হোটেল আছে।
যাওয়াঃ- ভূপাল-সাঁচি-বিদিশা-পাঁচমারি-জব্বলপুর সার্কিটের জন্য প্রথমে ভূপাল(BPL) পৌঁছতে হবে। ভূপালে থেকে সাঁচি-বিদিশা ঘোরাই সুবিধাজনক। অবশ্য ভূপালের আগের স্টেশন বিদিশা হওয়ার দরুন সাঁচি-বিদিশা ঘুরেও ভূপালে যাওয়া যায়। বিদিশা থেকে সাঁচি ৮ কিলোমিটার দূরে। ভূপালের দূরত্ব ৫০-৬০ কিলোমিটার। ভোজপুর-ভীমবেটকা ঘোরার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়টি হল ভূপাল থেকে গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া। ভূপাল থেকে ভোজপুর প্রায় ২৮ কিলোমিটার এবং ভীমবেটকা প্রায় ৫০ কিলোমিটার। ভূপাল থেকে পাঁচমারির দূরত্ব ২১০ কিলোমিটার। এ পথে বাস সার্ভিস আছে। ট্রেনপথে পাঁচমারি পৌঁছতে গেলে ভূপাল বা জব্বলপুর থেকে পিপারিয়া যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে পাঁচমারি। পাঁচমারি থেকে সাতঘন্টার বাসজার্নিতে জব্বলপুর পৌঁছানো যায়।
জব্বলপুর থেকে ১৯০ কিমি দূরে পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভ বা ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্ক। পেঞ্চ নদীকে ঘিরে মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র এই দুই রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছে এই অরণ্যভূমি। ১৯৭৭ সালে স্যাংচুয়ারি, ১৯৮৩তে ন্যাশনাল পার্ক এবং সবশেষে ১৯৯২ সালে ব্যাঘ্র প্রকল্পের তকমা মেলে এই অরণ্যের। মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে দূরত্ব মাত্র ১০০ কিমি। এন.এইচ.৭-এ বাস থেকে নেমে পড়ুন খ্বাসায় – সেখান থেকে জিপে ১২ কিমি দূরে তুরিয়া। নাগপুর থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে সরাসরিও পৌঁছান যায় হাজার দেড়েক টাকায়। বেশ কয়েকটা বেসরকারি হোটেল আছে আর এম.পি. ট্যুরিজমের রিসর্ট কিপলিংস্ কোর্ট তো খুবই ভাল – অনেকটা খোলামেলা – সুন্দর সাজানো আর খাওয়াদাওয়া-ও দারুণ! পেঞ্চ নদীর পাড়ে রয়েছে ফরেস্ট রেস্টহাউসও। সেগুন-টিক-মহুয়া-পলাশ-অমলতাসের সবুজ অরণ্যের বুকে চিতল হরিণ, নীলগাই, শম্বর, বাইসন, চিতা – এমন নানা চেনাঅচেনা বন্যপ্রাণের মাঝে ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে হঠাৎ হয়ত বাঘের দেখাও মিলে যেতে পারে।
ভ্রমণ কাহিনি - || হঠাৎ দেখা ||
অমরকন্টক (Amarkantak)- বলা যায় নর্মদার আঁতুড় ঘর। এখানকার নর্মদাকুণ্ড থেকেই উৎপত্তি হয়েছে নর্মদা নদীর। উৎপত্তিস্থলটা ভক্তপ্রাণের কাছে নর্মদা মাঈ কি উদ্গম নামেই খ্যাত। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই রয়েছে ধবধবে সাদা পাথর নির্মিত সাতাশ মন্দির কমপ্লেক্স। ওর ভেতরেই এই স্থান। এছাড়াও ওই মন্দিরচত্বরের ছোট-বড় চূড়াবিশিষ্ট পাথরঘরের আড়াল ভেঙে পর্যটকদের দেখা দিয়ে যান গোরখনাথ, মনসা, শ্রীদুর্গা, রোহিনী, কার্তিক, বালাসুন্দরী, পার্বতী আরও কত দেবপ্রতিবেশীরা। মূল মন্দিরের গর্ভে পাথরমূর্তিতে অধিষ্ঠান করছেন দেবাদিদেব শিব ও শিবের মানসকন্যা দেবী নর্মদা। মন্দিরেই রয়েছে একটি পাথরের হাতি, যার পায়ের তলা দিয়ে একবারে সাষ্টাঙ্গে গলে যেতে পারলে নাকি পাপক্ষয় হয়। এই মন্দির কমপ্লেক্সের ঠিক পাশটাতেই কেয়ারি-সবুজ আচ্ছাদনে সাজানো প্রাচীন কালচুরি রাজত্বের পাতালেশ্বর মন্দিররাজি। শিবভূমি অমরকন্টকে শিবের মাহাত্ম্যই সর্বত্র প্রচারিত। এই মন্দিরও তার ব্যতিক্রম নয়। মূল গর্ভগৃহে পাতালফুঁড়ে বসে আছেন স্বয়ং শিব। চত্বরেই সূরযকুণ্ড। সংলগ্ন অঞ্চলটার কেয়ারি করার প্রয়োজনীয় জল ওখান থেকেই সরবরাহ করা হয়।
শুধুমাত্র নর্মদা নয়, এখানে আরও একটি নদী থুড়ি নদের উৎসমুখ আছে। নাম তার সোন। জায়গাটার নাম সোনমুড়া। সূর্যোদয়ের রাঙা আলোয় কিম্বা সূর্যাস্তের ছায়ারঙে জায়গাটা এক অজানা দৈবমাহাত্ম্যে ভরে যায়। ওখানেই একটা কুণ্ডের মধ্যে থেকে সোন বেরিয়ে আসছে জনপদে। চত্বরটার বিশাল বজরংবলির মূর্তি অথবা সিঁড়ি দিয়ে একটু উঠে দুর্গামন্দিরে সকাল-সন্ধের আরতি - সত্যি ভোলার নয়। অরণ্যের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে যেতে হবে মাঈ কি বাগিয়া । ছোটবেলায় এখানেই নাকি নর্মদা তার বাল্যসখীদের সঙ্গে খেলা করতেন। অন্যমতে, এটাই নর্মদার আসল উৎপত্তিস্থল। মন্দিরময় অমরকন্টককে কপিলধারা আর দুগ্ধধারার শোভা সাজিয়েছে অন্যরকম। কপিলধারা ২০০ফুট ওপর থেকে চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দুগ্ধধারার আকারের আভিজাত্য নেই ঠিকই তবে ক্ষুদ্র বলে সে তুচ্ছ নয়। গাড়িপথে বেশ কিছুটা পাহাড়ে উঠে আবার হাঁটাপথে বেশ খানিকটা নেমে ভৃগু কমণ্ডলু। এটা ভৃগুমুনির তপস্যাক্ষেত্র। বনবনানীর কোল উজাড় করে যাওয়ার রাস্তাটাই অসাধারণ। এসব ছাড়াও আছে মার্কণ্ডেয়াশ্রম, পঞ্চমুখী গায়ত্রী বা শুকদেবানন্দের আশ্রম, হনুমান মন্দির, শম্ভুধারা, মাঈ কি মাড়োয়া, কবির চবুতরা ইত্যাদি দ্রষ্টব্যস্থান।
থাকা- মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল (ক) হলিডে হোমস্ (খ) হোটেল শ্রীমাতা সদন। এছাড়াও হোটেল আর ধর্মশালা রয়েছে থাকা-খাওয়ার জন্য।
কানহা (Kanha)- ঘরকুনো ছাপোষা অথবা আনকোরা ভ্রামণিক - কানহা নামটা সকলের কাছে বহুল পরিচিত। ৯৪০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে ওয়াইল্ড গাউর, ভালুক, বুনো মোষ, ময়ূর, চিতল, সম্বর, বারাশিঙা প্রভৃতি জন্তুর গৃহস্থালি। আর বাঘ! তাকে দেখতেই তো কানহা যাওয়া। কানহা যাওয়ার দু’টি প্রবেশদ্বার আছে। কিসলি এবং মুক্কি। বিলাসপুর থেকে যাঁরা আসবেন তাঁদের জন্য মুক্কি জোন সবচেয়ে সুবিধাজনক। কিসলিতে বিদেশিদের যাতায়াতই বেশি। জঙ্গলে সকাল-বিকেল ট্রেল করানো হয়। হোটেল কর্তৃপক্ষই জঙ্গল ভ্রমণের জন্য জিপসির ব্যবস্থা করে দেন। জিপসিতে সব মিলিয়ে মোটামুটি ৬ জন যেতে পারবেন। এন্ট্রিপয়েন্ট থেকেই বন ঘোরার পারমিট দেওয়া হয়। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে তার চার্জও লাগবে। ১৯৫৫ সালে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় কানহাকে। ১৯৭৪ সালে কানহার মাথায় প্রোজেক্ট টাইগারের শিরোপা ওঠে। ওড়া ধুলোর ওড়না ফুঁড়ে ছুটে যাবে ট্রেলের জিপসি। গাইড শোনাবে জঙ্গলের দিবারাত্রির কাব্য। ঘন সবুজ বন- আড়ালের ফাঁক ফোঁকরে উঁকি দিয়ে যাবে সকাল অথবা গোধূলির সূর্য। মধ্যে মধ্যে থমকে দাঁড়ানো চুপচাপ- ‘ওই তো, চিতল না সম্বর!’ মুখে আঙুল দিয়ে শুনে নেওয়া পশুপাখিদের অ্যালার্ম টোন- ‘ওই ঝোপের আড়ালেই আছে। কেউ কথা বলবেন না’। গাইডের সতর্কবাণী।
থাকা- জব্বলপুর থেকে যাঁরা আসবেন তাঁদের জন্য সবচেয়ে সুবিধা কিসলিতে থাকা। সেখানে আছে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের বাঘিরা লগ হাউস ও বেসরকারি হোটেল।
বিলাসপুর থেকে আসা পর্যটকদের জন্য মুক্কিতে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের কানহা সাফারি লজ।
বান্ধবগড়(Bandhabgarh)- আয়তনে কানহার থেকে ছোট। তাই বাঘ দেখার সুযোগও বেশি। এখন মোটামুটি ৫৮-৫৯ টা বাঘ আছে বান্ধবগড়ে। উমারিয়া হয়ে বান্ধবগড় যাওয়া ভালো। বান্ধবগড় অভয়ারণ্যের আয়তন ৪৪৮ বর্গকিলোমিটার। অরণ্য অন্দরে জিপসিতে ছুটতে ছুটতেই পরিচয় হয়ে যাবে বিন্ধ্য পর্বতমালার কিছু কিছু শৃঙ্গের সঙ্গে। অরণ্যের প্রবেশদ্বার টালা। ছোট্ট একটা গঞ্জ এলাকা। ট্রেলের নিয়মকানুন পুরোটাই কানহার মতো। জীবজন্তু আর হরেক প্রজাতির পাখি ছাড়াও এই জঙ্গলে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন গুহা। জিপসি ছোটা রাস্তা ধরে পাহাড়ের ওপরে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখানে দশম শতকে তৈরি ৩০ফুট লম্বা বিষ্ণুর শায়িত মূর্তি রয়েছে। নাম ‘শেষ সায়া’। বিষ্ণুর পায়ের তলা দিয়ে কলকলস্বরে বেরিয়ে আসছে জল। লোকে বলে চরণগঙ্গা। বিষ্ণুর মাথার দিকে একটি বিরাট শিবলিঙ্গ এবং পায়ের দিকে ব্রক্ষ্মার মূর্তি রয়েছে। তবে প্রাচীন গাছের মোটা শাখা-প্রশাখায় ঢাকা পড়েছেন ব্রক্ষ্মা। এ জঙ্গলে দেওচক্রধারা, বড়াগুহা, সীতাকুণ্ড রয়েছে অতীতের স্পর্শ নিয়ে। এসব অঞ্চলে বাঘের দেখাও মেলে। পাহাড়ের একদম ওপরে রয়েছে কালচুরি রাজাদের ভগ্নপ্রায় রাজপ্রাসাদ এবং রামজানকী মন্দির, রোজ পুজো হয় সেখানে।
থাকা- মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল হোয়াইট টাইগার ফরেস্ট লজ-এ থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। এছাড়াও অনেককটা বেসরকারি হোটেল রয়েছে।
ভ্রমণ কাহিনি - কবিতায় চড়ে বান্ধবগড়ে ||
যাওয়াঃ- অমরকন্টক-জব্বলপুর-কানহা-বান্ধবগড় ঘোরার জন্য প্রথমে অমরকন্টক পৌঁছনোই সুবিধাজনক। নিকটতম রেলস্টেশন পেন্ড্রা (PND)। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘন্টাদুয়েকে অমরকন্টক। বিলাসপুর থেকেও অমরকন্টকে যাবার বাস পাওয়া যায়। অমরকন্টক ঘুরে অনুপপুর অথবা পেন্ড্রা হয়ে ট্রেনপথে উমারিয়া। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা বান্ধবগড়। কাটনি হয়েও বান্ধবগড় পৌঁছনো যায় একই ভাবে। বান্ধবগড় থেকে জব্বলপুর যাবার জন্য উমারিয়া কিম্বা কাটনি আসতে হবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে জব্বলপুর পৌঁছন। বান্ধবগড় থেকে জব্বলপুর বাস সার্ভিসও আছে। জব্বলপুর থেকে প্রতিদিন সকাল ৭টায় কানহা যাবার বাস ছাড়ে। মোটামুটি সাড়ে ৫ ঘন্টায় সেই বাস কানহা পৌঁছয়।
খাজুরাহো (Khajuraho)- মন্দিরের দেশ খাজুরাহোতে পা রাখা মানেই চান্দেলাদের রাজত্বে ফিরে যাওয়া। চোখের ওপর আশ্চর্য মন্দিরগুলির অলঙ্করণ শিল্প ফিরিয়ে আনবে ৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের বাতাবরণ। মন্দিরের গায়ে দেবদেবী, অপ্সরা, নর্তকী, মিথুন মূর্তিগুলিতে যেন প্রাণস্পন্দন পাওয়া যায়। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে খাজুরাহোর নাম। এক্কেবারে শহরের কেন্দ্রস্থলে মন্দিরগুলির অবস্থান। ফুলবাগিচায় সাজানো চত্বর জুড়ে কাণ্ডারীয় মহাদেব, লক্ষণ, জগদম্বা, চৌষটযোগিনী, চিত্রগুপ্ত প্রভৃতি মন্দিররাজির রাজমালা। মন্দিরগুলিতে প্রবেশ করা যায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। প্রতিদিন মন্দির কমপ্লেক্সে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের উদ্যোগে সান্ধ্য আসর বসে - লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। পূর্বদিকের প্রধান মন্দির শান্তিনাথ, আদিনাথ, ঘন্টাই ও পার্শ্বনাথ জৈন মন্দির। দক্ষিণ অংশের মন্দিরগুলি হল চতুর্ভূজ, দুলাদেও ও বিজামণ্ডল। অনেক মন্দির আবার ধ্বংসও হয়ে গেছে। এখানেই আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম ও আদিবাসী লোককলা মিউজিয়াম। তবে কেবল মন্দিরই নয়, খাজুরাহো দর্শনার্থীদের মিলবে অরণ্যের স্বাদও। ৩০কিলোমিটার দূরে পান্না অভয়ারণ্য।
থাকা- মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল ঝংকার, হোটেল পায়েল ও হোটেল রাহিল । আর প্রচুর বেসরকারি হোটেল।
উৎসব- প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ খাজুরাহো ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়।
ঝাঁসি (Jhansi)- ছোট্ট বয়স থেকেই সংগ্রাম। মেয়ে হয়েও পুরুষের মতো জীবনধারণ। পরবর্তীকালে গোটা একটা রাজ্যের ভার তাঁর কাঁধে। স্বামী মারা যান। দত্তকপুত্রকে নিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে সেই ভীষণ লড়াই। সঙ্গী কেবল ঘোড়া চেতক। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত লড়েছিলেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ। মৃত্যুর পর ব্রিটিশরাও এই এক নারীর তেজোদীপ্ত লড়াইয়ের কাছে মাথা নত করেছেন। খাজুরাহো থেকে দূরত্ব ১৭২ কিলোমিটার। বাস যাছে ৫ ঘন্টার দূরত্বে। শাণিত তরবারি হাতে বীরাঙ্গনা লক্ষ্মীবাঈ-এর পাথরমূর্তি। ছবিটা প্রায় সকলেরই চেনা। আর এই চেনা ছবির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে একটা নাম- ঝাঁসি। ১০ ফটকের ঝাঁসির দুর্গ দেখার মতো। দেয়ালে কান পাতলেই ব্রিটিশ আর লক্ষ্মীবাঈ-এর রণদামামার শব্দ। রয়েছে প্লেজার গ্রাউন্ড, শিবমন্দির, গণেশ মন্দির ও ৫৭-র বিদ্রোহে ব্যবহৃত কড়ক বিজলি তোপ কামানটি। অবশ্য দ্রষ্টব্য রানি কা মহল- লক্ষ্মীবাঈয়ের বাসগৃহ।
থাকা - মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল বীরাঙ্গণায় থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। আর আছে বেশকিছু বেসরকারি হোটেল।
ওরছা (Orchha)- বুন্দেল রাজত্বের রাজধানী ওরছা। ১৬-১৭ শতকে গড়া প্রাসাদ ও মন্দিরের জন্যই ওরছার খ্যাতি। শোনা যায় ১১ শতকে স্বয়ং দেবী বিন্ধ্যবাসিনী নাকি রাজপুতকুমারকে স্বপ্ন দিয়ে ‘বুন্দেলা’ নামকরণটি করেন। ১৫১৭য় মালোয়া মালভূমিতে বুন্দেল নায়ক রুদ্রপ্রতাপের হাতে তৈরি হয় এক রাজ্য। পরে ১৯৩১ সালে বেতোয়াকে ঘিরে এই যে দ্বীপ, এখানেই গড়ে ওঠে রাজধানী। বুন্দেলা শহরটিরই ঐতিহাসিক নাম ওরছা। এই গোটা রাজত্বের সাক্ষি ছিল বেতোয়া, যমুনা আর নর্মদা। যমুনা থেকে এ রাজত্ব শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল নর্মদায়।
বেতোয়া এখনও বয়ে যায়, নিজের মতো। কূলঘেঁষে ছুঁচলো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছত্রিগুলো। দিনদুপুরে ছত্রির খাঁজে খাঁজে বিশ্রাম নিয়ে যায় সবুজ টিয়ার দল। খাজুরাহো থেকে ঝাঁসি বরাবর যেতে গিয়ে মাঝপথেই হাত মেলাবে ওরছা। ১৬ শতকের বুন্দেলা রাজাদের দুর্গ, প্রাসাদ, মন্দির ঘেরা এক ঐতিহাসিক জায়গা। দূরত্ব বলতে গেলে ওরছা থেকে খাজুরাহো ১৭০ কিমি। রয়েছে রামরাজা মন্দির, চতুর্ভূজ মন্দির, পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালা, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, ফুলবাগ আর একাধিক ছত্রি।
বাজার-সংলগ্ন ১৭ শতকের রামরাজা মন্দির। এখানে ক্যামেরা আর চামড়াজাত দ্রব্যের প্রবেশ একদম নিষেধ। সাদার ওপর নীল রঙের দুর্দান্ত শিল্পকাজ। প্রবেশ তোরণটাই দেখার মতো। ফিরে আসে শিল্পীর অস্তিত্ব। তখন রাজা ছিলেন মধুকর শাহ। স্বপ্নাদিষ্ট রানির ইচ্ছানুসারে অযোধ্যা থেকে শ্রীরামের একটি মূর্তি আনেন রাজা। শ্রীরামের ইচ্ছা ছিল ৭ তলা চতুর্ভূজ মন্দিরের। মন্দির তৈরিকালে তাঁকে সাময়িকভাবে রাজপ্রাসাদেই স্থাপন করা হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে মন্দির গড়ে ওঠার পর। শ্রীরাম তাঁর অবস্থান আর বদল করতে চান নি। সেই থেকে সীতা-লক্ষ্মণ আর হনুমানের সাথে প্রাসাদেই রয়ে গেলেন রাম। তবে দেবতা নয়, এই প্রাসাদে রামকে রাজা রূপে পুজো করা হতে থাকে। তিনি রাজাধিরাজ-রাজারাম। কত মানুষের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন এই রাজা। মানত পূরণ হলে ভক্তেরা ভোগ দেন। সেই ভোগের ভাগ পেয়ে বেঁচে থাকে আতুর-অনাথ, দীন-দরিদ্র মানুষগুলো। মধুকর শাহ’র তৈরি সেই চতুর্ভূজ মন্দিরটি এক চটকে অনেকটা দুর্গের মতো। রাজার কালে এই মন্দিরটি বিগ্রহহীন থাকলেও আজ এখানেও শ্রীরামের অধিষ্ঠান। এই মন্দিরের ওপর থেকে ওরছার ছবিটা অসাধারণ। প্রায় সবকটি প্রাসাদ-দুর্গকেই এখান থেকে দেখা যায়। রামন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকেই মোগলি গার্ডেন-ফুলবাগ। ওটাকে পার করলেই ‘হরদৌল কা ব্যায়ঠকা’। সে একটা সময় ছিল যখন রাজা ছিলেন বীরসিং দেও। তার দ্বিতীয় পুত্র হরদৌল। দাদা ঝুজনের স্ত্রী অর্থাৎ বৌদির সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ের অভিযোগ ওঠে হরদৌলের বিরুদ্ধে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে হরদৌল। প্রতিবাদ করে বৌদি। বলে, হরদৌল তাকে মায়ের মতো ভালোবাসে। কিন্তু প্রমাণ কী? দাদা ঝুজনের নির্দেশে সত্যিকারের মাতৃত্বের প্রমাণ দিতে হয় বৌদিকে। বিষ মেশানো একবাটি পায়েস পুত্রসম দেওরের হাতে তুলে দেয় বৌদি। দেওর হরদৌলও বিনা দ্বিধায় সে পায়েস খেয়ে নেয়। বৌদি জ্ঞান হারায়। হরদৌল চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর? তারপর আর যাই ঘটুক না কেন তা সবই জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়া অবাঞ্ছিত কিছু উচ্ছিষ্টের মতো। সত্যি কেবল একটা প্রাণের বলিদান। সততার প্রমাণ! মানুষ থেকে দেবতা-স্থানীয় মানুষরা বিয়ের পর আজও আশীর্বাদ নিয়ে যান দেবতা হরদৌলের। কিন্তু সমাধির কোলে মুখ গুঁজে থাকা জীবনটা একবারের জন্যেও কি জানতে পারে সমাজের চোখে তার পরিবর্তন? কী লাভ মরণোত্তর পুরস্কারের?
ওরছার প্রধানতম আকর্ষণ দুর্গ। অন্যান্য দুর্গের মতো এটাও একটা ইতিহাসের বন্দীশালা। বুন্দেল থেকে মুঘল- রাজপথটা নিমেষে মিশে যায় রাজমহলে। ১৫৩১ সালে রুদ্রপ্রতাপের হাত ধরে শুরু হয়েছিল রাজপ্রাসাদের গড়ে ওঠা। শেষ হয় ১৫৪৫ সালে মধুকর শাহ-র কালে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় ইতিহাসের পূর্ণতা পেতে। কিন্তু দিন যতই যায় ইতিহাসের গায়ে স্যাঁতা পড়া দাগ ফুটে ওঠে। খাঁ খাঁ করে হাওদামহলগুলো। মণিমুক্তা-কাচের অলঙ্কার দিয়ে সাজানো এই প্রাসাদ। এর দুটো অঙ্গন। একটিতে নৃত্যশালা আরেকটিতে দেওয়ান-ই-খাস। রংবাহারি দেওয়াল জুড়ে ফ্রেস্কোর কারুকাজ প্রায় মুছে গেছে। তবু ঐ অস্পষ্ট স্মৃতিগুচ্ছ মনে করিয়ে দেয় বুন্দেলশৈলীকে। পৌরাণিক শিকার উৎসব থেকে চার বেহারার কাঁধে ভর দিয়ে চলা রাজপালকির ছবি- প্রাসাদের ভাঙা দেওয়ালেও বাঁচিয়ে রেখেছে রংবৈচিত্র। প্রাসাদেরই এক অংশের ভাঙা জাফরিতে চোখ রাখলে চোখে পড়ে যায় সেই চতুর্ভূজ মন্দির। রানির রাম দর্শনের জন্য প্রাসাদের সোজাসুজি ওই মন্দিরটা তৈরি করা হয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে দেওয়ান-ই-খাস। সেই কবে সভা ভেঙে গেছে। জনশূণ্যপুরীতে তবু আজও সংস্কার হয়। ইতিহাস বলে, ১৬০৬ সালে ওরছা সফরে আসেন স্বয়ং জাহাঙ্গির। তৎকালীন রাজা বীরসিংহ দেও জাহাঙ্গিরের থাকার জন্য একটি মহল তৈরি করে দেন। অসাধারণ ছত্তিশঘেরা সেই জাহাঙ্গির মহল এখন আমার চোখের সামনে। এই মহলে নিখুঁত জাফরিকাজে সমৃদ্ধ ঝুলন্ত বারান্দা আজও মানুষের কাছে বিষ্ময়। এখানকার কক্ষবিন্যাস, স্কন্দরূপী গম্বুজ একেকটা যেন পুরাকালের সাক্ষি। দুর্গের মাথায় পৌঁছাতেই সবুজ ওরছার সাজানো সংসার। তারই বুক চিরে দূরে একটা নীলরেখা -ওটাই বেতোয়া। এককালে এই প্রাসাদেই ছিল শিশমহল। কাল-অকালের চোরাবাঁকে সেই আরশিগুলো আজ নেই - সেখানে এখন বিলাসী হোটেলের রংবাসর।
দুর্গ সংলগ্ন অঞ্চলেই রাই পরভিন মহল। সময়টা ১৬৭০ সাল। আনন্দমহল বাগিচায় শোনা যেত শাহী ঘুঙরুর বোল, ভেসে আসত সাতনরিহার জড়ানো রেওয়াজি কন্ঠের আলাপ, অন্দরে চলত আসনাই। মেহফিল টলে যেত রাজনর্তকী রাই পরভিনের পদসঞ্চালনে, অঙ্গবিভঙ্গে, রতিসৌরভে। কীভাবে যেন সেই খুশবুর খবর পৌঁছেছিল আকবরের কান পর্যন্ত। পরে পরভিনের রূপলাবণ্যে মুগ্ধ আকবর ফরমান পাঠান। দিল্লি যান রাই পারভিন। কিন্তু সম্রাট জানতে পারেন ইন্দ্রমনি নামে এক যুবা-পুরুষের সঙ্গে পরভিনের প্রণয়কাহিনী। অবশেষে ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষায় ওরছায় ফেরত পাঠান পরভিনকে। তারপরে ঠিক কতটা সুখ, কতটা প্রেম বেঁচেছিল তাঁর জন্য? কে জানে!
থাকা- এখানে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের দুটি হোটেল রয়েছে - বেতোয়া রিট্রিট ও শিশমহল। বেসরকারি হোটেলও আছে প্রচুর।
ভ্রমণ কাহিনি - || পলকাটা হিরে - ওরছা ||
শিবপুরী (Shivpuri)- ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য মানেই কোনও না কোনও রাজার স্পর্শধন্য। গোয়ালিয়র-ইন্দোর রোডে ১৫৬ বর্গকিলোমিটার ব্যাপ্ত শিবপুরীও তার ব্যতিক্রম নয়। শিবপুরী নাকি সিন্ধিয়া রাজাদের গ্রীষ্মাবাস তথা মৃগয়াভূমি ছিল। পলাশ-তেন্দু গাছের ছায়াঘেরা মাধব জাতীয় উদ্যানে রয়েছে একটি হ্রদ- সখ্যসাগর। সার্কিট হাউসের কাছেই ছত্র। এখানেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহের নায়ক তাঁতিয়া তোপিকে। মাধব বিলাস প্যালেস আর জর্জ ক্যাসেলও চোখ টেনে রাখবে।
থাকা- থাকার জন্য রয়েছে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল ট্যুরিস্ট ভিলেজ। আর বেসরকারি হোটেল।
গোয়ালিয়র(Gwalior)- বদলে যায় রাজা, হাতবদল হয় রাজত্বের। প্রথমে প্রতিহার, তারপর কাছওয়া হয়ে গোয়ালিয়র হাতে আসে সিন্ধিয়াদের। দুর্গ-সৌধ আর প্রাসাদে সেই সময়ের ছাপ আজও স্পষ্ট। শহরমধ্যেই জয়বিলাস প্রাসাদ। এটাও সিন্ধিয়াদের কীর্তি। সময়টা ছিল ১৮৭৪ সাল। প্রাসাদের একাংশে এখন বিলাসবহুল হোটেল আর অন্য অংশে জিয়াজি রাও সিন্ধিয়া মিউজিয়াম। ঘাউস মহম্মদ টুম্বটিও দেখার মতো। এখানেই রয়েছে তানসেনের সমাধি। সবুজের পরিখা ঘেরা সূর্যমন্দির। পাহাড়চুড়োয় ইতিহাসের গল্প শোনাতে বসে থাকে বৃদ্ধ দুর্গটা। ওটাই গোয়ালিয়র দুর্গ। ওই দুর্গের অন্দর মহলে সজ্জিত উপকরণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। মানসিংহ মহল, মানমন্দির, শাস-বহুমন্দির, তেলি কি মন্দির, সুরজকুণ্ড প্রভৃতি।
থাকা- এখানে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল তানসেন রেসিডেন্সি। অনেক বেসরকারি হোটেলও রয়েছে।
যাওয়াঃ- খাজুরাহো-ঝাঁসি-ওরছা-শিবপুরী-গোয়ালিয়র ঘুরতে গেলে সাতনা(STA) পৌঁছতে হবে। তারপর ভাড়া গাড়িতে চেপে খাজুরাহো। সাতনা থেকে খাজুরাহো ১২০ কিলোমিটার। সাতনা থেকে বামিঠা গিয়ে সেখান থেকেও খাজুরাহো যাওয়া যায়। খাজুরাহ ঘুরে বাসজার্নি করে ট্রেন ধরতে হবে ঝাঁসি যাবার জন্য। খাজুরাহো থেকে ঝাঁসি ১৭৫ কিলোমিটার। ঝাঁসি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ওরছা। গাড়ি মেলে এ পথে। ওরছা থেকে শিবপুরী যেতে হলে ঝাঁসি হয়েই যেতে হবে। ঝাঁসি থেকে শিবপুরী ১০৭ কিলোমিটার।বাস যায় এ পথে। তারপর শিবপুরী থেকে বাসে গোয়ালিয়র ১১৪ কিলোমিটার। সময় লাগে ঘন্টা তিনেক।
উজ্জয়িনী (Ujjain)- শিপ্রা নদীর তীর ছুঁয়ে উজ্জয়িনীর গড়ে ওঠা। বেঁচে থাকা প্রচুর দেবালয় বুকে করে। এই নগরী বিখ্যাত মূলত কুম্ভমেলার জন্য। শিপ্রার স্রোতে স্নান করলে পুণ্য হয়– এমনই লোকবিশ্বাসে ভর করে জড়ো হন হাজার হাজার পুণ্যকামী মানুষ। দ্রষ্টব্য বলতে প্রথমেই উঠে আসে ত্রিবেণী ঘাটের কাছে নবগ্রহ শনিমন্দির। ফিরতি পথে পড়বে বেদশালা যন্তরমন্তর। এছাড়া হরসিন্ধি মাতা মন্দির, চিন্তামন গণেশ, বড় গণেশ এবং চারধাম মন্দির। এছাড়াও রয়েছে মহাকালেশ্বর মন্দির, গোপাল মন্দির, ভর্তৃহরি গুহা, গড়কালিকা মন্দির, কালভৈরব মন্দির, কালিয়াদেহ প্রাসাদ, সূর্য মন্দির, ক্লকটাওয়ার, সিদ্ধবট ইত্যাদি।
থাকা- এখানে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের দুটি হোটেল রয়েছে। শিপ্রা রেসিডেন্সি ও হোটেল অবন্তিকা। বেশ কয়েকটি বেসরকারি হোটেলও আছে।
মাণ্ডু (Mandu)- এখানে ধর্ম আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে ধর্মঘেরা প্রেমের আলোকবর্তিকা। রানি রূপমতী আর বাজবাহাদুরের প্রেমকাহিনি অমর করেছে মাণ্ডুকে। বিন্ধ্য পর্বতের প্রায় ২০০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ঐতিহাসিক এই জনপদ। রাজা-রাজড়ার প্রেম সড়কের চিহ্ন ধরেই পৌঁছে যাওয়া জাহাজমহল প্রাসাদে। জেনে নেওয়া ভালো অন্দর-প্রাসাদের দ্রষ্টব্য। হিন্দোলা মহল, নাহার ঝরোখা, গাদা শাহ প্রাসাদ, তাভেলি মহল, জলমহল – আরও কত। অবশ্য এখানকার অনেক সৌধই আজ কালের গর্ভে বিলীন। এ বাদেও দেখার মতো জায়গা বলতে রয়েছে পুরাতত্ত্ব মিউজিয়াম, জামি মসজিদ, হোসাঙ্গ শাহের সমধি, আশরফি মহল, রূপমতী মহল, রেওয়াকুণ্ড জলাশয়, বাজবাহাদুর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, নীলকন্ঠ মহাদেব মন্দির, ইকো পয়েন্ট, সানসেট পয়েন্ট, শ্বেতাম্বর জৈনমন্দির, রামমন্দির প্রভৃতি।
থাকা- মাণ্ডুতে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের দুটি হোটেল রয়েছে । মালোয়া রিসর্ট এবং মালওয়া রিট্রিট । আর কিছু বেসরকারি হোটেল।
মহেশ্বর (Maheswar)- শিবের মানসপুত্রী নর্মদা। তাই পিতৃনামে নামাঙ্কিত স্থানের কোলঘেঁসে কেবল সেই কন্যারই বয়ে চলা - নদী নর্মদা। পূর্বে নাকি এই জায়গারই নাম ছিল মহিষ্মতীপুরী। চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্তে পাওয়া যায় মহেশ্বরের কথা। ইন্দোরের রানি অহল্যাবাঈয়ের বিরাট রাজ্যপাটের একটি ছিল এই মহেশ্বর। এখানে অহল্যাবাঈয়ের তৈরি রাজওয়াড়া প্রাসাদও রয়েছে। আহিলেশ্বর আর বিটলেশ্বর মন্দির দুটি অসাধারণ। রয়েছে অহল্যাঘাট, রানি অহল্যার ছত্রি, পেশোয়া ঘাট, জলেশ্বর ও কালেশ্বর মন্দির।
থাকা- নর্মদা নদীর তীরেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল নর্মদা রিট্রিট। এছাড়া কয়েকটা বেসরকারি হোটেল আছে।
ওঙ্কারেশ্বর (Omkareswar)- এই তীর্থের বুক চিরেও বয়ে চলেছে হিল্লোলিনী নর্মদা।পাশেই আছে কাবেরী নদী। এখানে যে শিবলিঙ্গটি আছে তা দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গেরই অন্যতম। উজ্জয়িনী থেকে বাসে ইন্দোর এসে আবার সেখান থেকে সড়কপথে যেতে হবে ওঙ্কারেশ্বর। দ্রষ্টব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রী ওঙ্কারমান্ধাতা ওঙ্কারেশ্বর শিবমন্দির। এর পাশ দিয়েই পাহাড়ি পথে পৌঁছে যাওয়া মান্ধাতা রাজপ্রাসাদে। হাঁটাপথেই পৌঁছনো যায় মামলেশ্বর শিবমন্দিরে। এছাড়াও রয়েছে বিষ্ণু মন্দির, ঋণমুক্তেশ্বর শিবমন্দির, গৌরী সোমনাথ মন্দির, পাতালি হনুমান মন্দির, সিদ্ধনাথ মন্দির প্রভৃতি।
থাকা- এখানে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের একটাই থাকার জায়গা রয়েছে। সেটা হল নর্মদা রিসর্ট। এছাড়া অল্প কিছু লজ ও ধর্মশালা আছে।
ইন্দোর (Indore)- একদিকে বাণিজ্যিকতার তকমা, অন্যদিকে অহল্যার স্বপ্নপুরী ইন্দোর। একযাত্রায় দেখা হয়ে যাবে এই নগর। ৩৫০ বছরের রাজওয়াড়া প্রাসাদ কিম্বা হোলকারদের তৈরি গোপাল মন্দির ও আর্টগ্যালারির তুলনাই হয় না। এছাড়া গণপতি মন্দির, কৃষ্ণপুরা ছত্রি, অন্নপূর্ণা মন্দির, ক্লক টাওয়ার, টাউন হল, মহাত্মা গান্ধি হল, কাচমন্দির, লালবাগ প্যালেস – একের পর এক দ্রষ্টব্যে সাজানো ইন্দোর। না দেখলে ইতিহাসের অনেককটা পাতাই হয়তো বন্ধ থেকে যাবে।
থাকা- মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের ট্যুরিস্ট বাংলো রয়েছে ইন্দোরে। আর বেসরকারি হোটেল।
যাওয়াঃ- ভূপাল থেকে উজ্জয়িনী(UJN) যাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ট্রেন ও বাস দুই-ই পাওয়া যায়। ট্রেন রয়েছে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। ট্রেন পথের দূরত্ব ১৮৪ কিলোমিটার। উজ্জয়িনী থেকে ইন্দোর (INDB/INDM) ৫৫ কিলোমিটার। বাস ও ট্রেন উভয়ই রয়েছে। ইন্দোর থেকে বাসে চেপে ৪ ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক মাণ্ডু পৌঁছনো যায়। মাণ্ডু থেকে মহেশ্বর ৭৮ কিলোমিটার। বাসে চেপে ঘন্টা তিনেকে পৌঁছোন যায়। মহেশ্বর থেকে ৬২ কিলোমেটার দূরে ওঙ্কারেশ্বর। সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। ওঙ্কারেশ্বর থেকে ইন্দোর প্রায় ৭৮ কিলোমিটার। বাসে চেপে ঘন্টা তিনেক।