তরঙ্গ ছুঁয়ে
মানব চক্রবর্তী
~ তথ্য - তামিলনাড়ু কোস্টাল ট্রেক ~ ট্রেক রুট ম্যাপ ~ কোস্টাল ট্রেকের আরো ছবি ~
পয়েন্ট ক্যালিমার থেকে কুড্ডালুরু। এই দু'শো দশ কিলোমিটার পথ, সমুদ্রের পার ধরে চলা। কাঁধে রুকস্যাক্। তাতে আমাদের প্রয়োজনীয় র্যাশন। রান্নার সরঞ্জাম, জামাকাপড়, সব। মানে পিঠে চেপে বসা চলমান সংসার।
চলেছি কোস্টাল ট্রেকিংয়ে। ছয় সঙ্গী।
তামিলনাড়ুর নাগাপট্টিনম ডিস্ট্রিক্টের একেবারে শেষ মাথায় দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে সেই স্বপ্নের জায়গাটি। যার নাম পয়েন্ট ক্যালিমার। তামিল ভাষায় বলে কোডিয়াকড়াই। ট্রেনে হাওড়া থেকে চেন্নাই। চেন্নাই থেকে মাদুরাই। মাদুরাই থেকে বাসে গুরুভায়ুর হয়ে ভেদারানিয়ান। এখান থেকে মাত্র বারো কিলোমিটার পয়েন্ট ক্যালিমার।
এবার থেকে শুরু হল মূলপর্ব। বাসে যখন যাচ্ছি, একপাশে ঘন বন। অন্যদিকে অজস্র নুন তৈরির ভেড়ি। অনেকটা মাছের ভেড়ির মত শয়ে-শয়ে পুকুর। সমুদ্রের জল ঢুকিয়ে তা থেকে নুন তৈরি হয়। মাইলের পর মাইল একই ছবি। এই পুকুরগুলিই পরিযায়ী পাখিদের স্বর্গরাজ্য। পয়েন্ট ক্যালিমারের বার্ড স্যাংচুয়ারির খুব নাম। ফ্লেমিংগো, পেলিক্যান ও আর যে কত পরিযায়ী পাখির মেলা বসে যায়!
পয়েন্ট ক্যালিমারে একটা বন দপ্তরের বাংলো আছে। দুর্দ্দান্ত। সমুদ্র ও বার্ডস্যাংচুয়ারির পাশে ছবির মত একটা দোতলা বাংলো। প্রশস্ত ঘর। সমুদ্রের উদোম হাওয়া যেন আমাদের শহুরে কালিমা ধুয়েমুছে সাফ করে দেবে।
একদিন থাকব ওখানে। কাল ভোরে বার্ড স্যাংচুয়ারি দেখে পরশুদিন সকালে স্টার্ট হবে আমাদের কোস্টাল ট্রেকিং।
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েছি পয়েন্ট ক্যালিমারের বার্ড স্যাংচুয়ারি দেখতে। হিমে ভেজা পথ। গাছগাছালি। টুপটুপ করে শিশির ঝরছে। আর অগভীর জলের অজস্র নোনাপুকুরের মাঝ দিয়ে সে এক মিস্টিক পদযাত্রা। যেন স্বর্গের খিল নাড়তে চলেছি। ধীরে ধীরে সূর্যের আলোয় জলে রংবাহারি খেলা আর মুগ্ধচোখে দেখি পাখির মেলা। চুপ, ক্যামেরা চলছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। পেলিক্যান, ফ্লেমিঙ্গো, আর কত কী! আমি কি ছাই পাখি চিনি? শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে বড় হয়েছি আর পৃথিবীর দূরতম প্রান্ত থেকে আসা পরিযায়ী পাখিদের দেখছি। মুগ্ধ। শুধু মনে হচ্ছিল বড় টেলি-লাগানো দামি একটা ক্যামেরা কেন যে আমার নেই!
রাতে বন-বাংলোয় স্বপাক-রন্ধন। স্যাকে সব আছে। স্টোভ, কেরোসিন, চাল-ডাল, আলু, মশলাপাতি এবং বাসন। বিলু, শুভব্রত, সৌমেন আর অজিত চারজন মিলে দারুণ ডিমের ঝোল, ভাত আর একদলা করে আলুরচোখা করল। না, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হল না। পরম তৃপ্তিতে খেলাম। তারপর টিম মিটিং। পরদিন সকাল ছ’টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব।
সমুদ্রের হাতছানি। ঢেউয়ের গর্জন। অচেনা সৈকত। রাত কেটে গেল। বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের যাত্রা শুরু হল। পয়েন্ট ক্যালিমারের সমুদ্র পারে অনেকগুলো মাছধরা যন্ত্রচালিত নৌকা দুলছে। বা কেউ রাতভর সমুদ্র-সফর সেরে ফিরছে। সূর্য উঠি-উঠি। সৌমেন শুভব্রতরা ছবি তুলল। ফেনিল সমুদ্র ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সেই ভেজা বালিতে পা ফেলে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি।
অজস্র লাল কাঁকড়ার যেন এক অন্তহীন কার্পেট বিছানো। দেখে দেখে আশ মেটে না। মনে হয় পায়ের চাপে মারা পড়বে। কিন্তু ওরা বালিতে কম্পন টের পায় আর সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট গর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। এত ছোট জীব, কিন্তু কি বিরাট লুকোচুরি!
সবার আগে সৌমেন, অজিত আর বিলু। ওদের পেছনেই শুভব্রত। তার পেছনে আমি আর সুব্রত। আমাদের ডানদিকে সমুদ্র। এখান থেকে শ্রীলঙ্কার জাফ্না মাত্র ষোলো কিলোমিটার, সমুদ্রপথে। রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকলে জাফ্নার উচু আলোকস্তম্ভ দেখা যায়।
রোদ উঠেছে। বালি গরম হয়ে উঠছে। টানা দু’ঘন্টা হেঁটে বাঁ পাশে অজস্র নারকেল গাছ ঘেরা একটা গ্রামের ছবি অস্পষ্ট দেখা গেল। আমাদের জলের বোতল প্রায় শেষ। ঘাম হচ্ছে খুব। প্রধানত জলের প্রয়োজনেই সমুদ্রতট থেকে আধ কিলোমিটার বাঁ দিকে ঢুকে গ্রামে পৌঁছতেই সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
আমাদের পরনে চেরি রঙের ট্রাকশ্যুটের লোয়ার আর উজ্জ্বল হলুদ রঙের টিশার্ট, মাথায় চেরি রঙের সুদৃশ্য টুপি। সবার পিঠে কালো-হলুদ রুকস্যাক। সুতরাং ঐ জমকালো পোশাক দেখে গ্রামের মানুষ অবাক বিস্ময়ে ঘিরে ধরল। বাচ্চা বুড়ো ছেলে মেয়ে। ওদের ভাষা বুঝি না। ওরাও আমাদের কথা বোঝে না।
গ্রামের শুরুতেই একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জল খাবার ভঙ্গি করতেই এক বৃদ্ধা এক হাঁড়ি জল এনে দিলেন। বুঝলাম তৃষ্ণার ভাষা ইউনিভার্সাল। আমার সঙ্গীদের ততক্ষণে নজর পড়েছে গাছে ঝুলে থাকা বড় বড় ডাবের দিকে। কি আশ্চর্য, গ্রামবাসীরা আমাদের মনের ভাষা বুঝে সেই মুহূর্তেই একটা ছেলেকে গাছে উঠতে বলল। ছেলেটা তরতর করে গাছে উঠে অনেকগুলো ডাব নামাল। তারপর দা দিয়ে কেটে হাতে হাতে ধরিয়ে দিল। আঃ.. ডাবের জল খেয়ে শরীর যখন চাঙ্গা, তখনি একটা মোটরবাইকে চেপে দুজন পুলিশ ইন্সপেক্টর হাজির।
শুরু হল প্রশ্ন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। আমরা কারা! কোত্থেকে এবং কেন এসেছি। আমাদের আই-কার্ড এবং পুলিশ কমিশনারেট (আসানসোল-দুর্গাপুর) মহাশয়ের পার্মিশন লেটার দেখালাম। তারপরে ওরা শান্ত হল। তখন একজন অফিসার তার মোবাইলে আমাদের সবার ছবি তুলে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনারা যেতে পারেন।
ঘন্টা দুয়েক ফের সৈকত ধরে হেঁটে থামতে হল। সামনে খাঁড়ি। জুতো-মোজা, ফুলপ্যান্ট খুলে স্যাক মাথায় নিয়ে অগভীর খাঁড়ি পার হওয়া গেল। ফের শুরু হল পথ চলা। এবারে বাঁদিকে বিস্তীর্ণ ঝাউসারির ছায়ায় একটু বসা। মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি। সূর্য তখন মধ্যগগনে।
স্যাক থেকে পলিথিন শিট বার করে ঝাউবনে পেতে সবাই বসলাম। অজিত ছাতুর প্যাকেট বার করে প্রত্যেককে নুন চিনি ও লেবুর রস দিয়ে ছাতুর সরবত করে দিল। সঙ্গে বিস্কুট আর খেজুর। আধ ঘন্টার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজ শেষ। পনেরো মিনিট বিশ্রাম। আজ আঠাশ কিলোমিটার দূরবর্তী মল্লারপুরম পৌঁছোতেই হবে।
এবারে ঘন্টা তিনেক একটানা পথচলা। কষ্ট হচ্ছে। পায়ের তলা জ্বালা করছে। কিন্তু আনন্দও কম নয়। মাঝে মাঝে জেলেদের জিজ্ঞাসা করলে ওরা হাতের পাঞ্জা তুলে কি দেখায়। বুঝি না। এক পাঞ্জা মানে কি পাঁচ মাইল? মল্লারপুরম কি আর পাঁচ মাইল?
মাঝে আর একটা খাঁড়ি। তবে এটাতে জল কম। জুতো খুলে পার হয়ে, তখন বিকেল, যে গ্রামে পৌঁছলাম তার নাম পুষ্পভরম। এবং জানলাম, পুষ্পভরমেরই পোশাকি নাম মল্লারপুরম।
গ্রামে ঢুকতেই আবার আমাদের ঘিরে ভীড়। অনেক চেষ্টার পর পঞ্চায়েত প্রধানকে বোঝানো গেল যে আমরা কোস্টাল ট্রেকার। সবার কাছেই প্রশাসনের বৈধ কাগজপত্র আছে। এবার আতিথ্যের পালা। ওরা থাকার জন্য একটা বড় ঘর খুলে নিজেরাই ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। যাক, নিশ্চিন্ত। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। হঠাৎ গ্রামের একজন ছেলে তার বাড়িতে মাছভাত খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। আমরাও তৎক্ষণাৎ রাজি। কারণ তাহলে আর আমাদের রান্নার হ্যাপা পোহাতে হবে না।
কি আন্তরিক ব্যবহার ! থালায় ভাত, চার রকমের সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া। দেখে চোখ ছানা বড়া। অচেনা মাছ খেয়ে যদি পেট খারাপ হয়? তবু পারলাম না ফেলতে। জিত হল জেলে পরিবারের আন্তরিকতায়। সবাই খেলাম। রাতে গ্রামের অলিগলি হয়ে ফিরে এলাম আস্তানায়।
সত্যি, পুষ্পভরম যা আতিথ্য দিল বলার নয়। ৯-১২-২০১১ তারিখের রাত। রাতে শুয়ে ভাবছিলাম মানুষ কখনো খারাপ হ্য় না। আমাদের ভুল বোঝাই সম্পর্ক খারাপ করে।
১০-১২-১১ তারিখ সকাল থেকেই ফের পথচলা। এখানকার বালিটাতে পা ঢুকে যাচ্ছে। ফলে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যেতে তো হবেই। স্যাকের ওজনও প্রায় ষোলো কেজি। গড়পড়তায় সবারই স্যাকের ওইরকম ওজন। তার ওপর সমুদ্র সৈকত সবসময়ই একদিকে ঢাল। আজ আমাদের সন্ধের মধ্যে পৌঁছোতে হবে কামেশ্বরপুরম। প্রায় তিরিশ কিলোমিটার।
পথ চলতে চলতে একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারছি বিগত সুনামি এই উপকূলের বহু চালচিত্র বদলে দিয়েছে। সমুদ্র-সন্নিকটে যে সব গ্রাম ছিল সুনামির বিধ্বস্ততার কারণে তা দূরে চলে গেছে। সমুদ্র ধার ঘেঁষে অজস্র বনাঞ্চল প্রায় মুছে গেছে। নতুন করে বেড়ে ওঠা ঝাউয়ের সারি যেন সেই কথাটাই বলে দেয়। পুষ্পভরমে দেখেছি গোটা গ্রামটাতেই প্রায় দু’ফুট বালির আস্তরণ। এ সবই প্রলয়ঙ্কর সুনামির অবদান। ওই গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তাদের গ্রামের আটষট্টি জন মানুষ সুনামির তান্ডবে মারা যায়।
যাক, পুষ্পভরম পেরিয়ে অনেকদূর চলে এসেছি। একটা খাঁড়ি পার হতে হল। ভিল্লাপালম নামে একটা গ্রামের কাছে এসে দুপুরের খাওয়া সারব। রোদ্দুরে বালি তেতে উঠছে। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নিচে জ্বালা-জ্বালা করছে।
সঙ্গী বদু বলল, ওখানে ফোস্কা পড়বে। রাতেই লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে নিয়ো।
আমাদের প্রত্যেকের কাছেই লিউকোপ্লাস্ট আছে। কারণ কোস্টাল ট্রেকিংয়ের এটা একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। দীর্ঘ পথচলায় পায়ে ফোস্কা। যাই হোক দুপুরে একটা ঘন বাবলাগাছের অল্প ছায়ায় লাঞ্চ ও বিশ্রাম। অজিত আর বিলু ছাতুর সরবত তৈরি করতে লেগে গেল। আমসত্ত্ব, খেজুর, কয়েকদানা করে কাজুবাদাম, কিসমিস সেই সঙ্গে বিস্কুট - এই হল লাঞ্চ।
তারপরই পিঠে স্যাক তুলে চলা শুরু।
সন্ধের আগে ক্লান্ত শরীরে পৌঁছলাম কামেশ্বরপুরম গাঁয়ে। প্রচুর মানুষ ঘিরে ধরল। তাদের নানা প্রশ্ন। নানা সংশয়। আমরা শুধু মিটমিট হাসছি। গ্রামস্থ একটা চায়ের দোকানে বসেই সেন্টু বড়া-র অর্ডার দিল। বড় সাইজের দুটো করে পেঁয়াজ আর ডাল দিয়ে তৈ্রি বড়া। সেইসঙ্গে চা।
ততক্ষণে গ্রামের পঞ্চায়েত হাজির। আমাদের সুবিধেই হল। তাঁকে সব বুঝিয়ে বললাম। রাতে আমাদের আশ্রয় চাই। উনি আমাদের সব কাগজপত্র দেখে রাজি হলেন। একটা স্কুলঘর, ছোট্ট বরাদ্দ হল। আমরা যেতেই সেই নাইটস্কুল, গোটাকুড়ি বাচ্চা ছেলেমেয়ে পড়ছিল, মাস্টার ছুটি দিয়ে দিল। সামনে ছোট একটা পুকুর। পাশেই টিউবকল। আমাদের জন্য আদর্শ জায়গা।
রাতে অজিত আর বিলু আলু-সয়াবীনের তরকারি, ঘন মুসুর ডাল আর ভাত করল। খেয়ে দেয়েই ঘুমের দেশে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই বুড়ো আঙ্গুলের নিচে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে নিলাম। দেখি অজিত আর বদুও লাগাচ্ছে। তারপরই দ্রুত বেরিয়ে পড়া।
সমুদ্রের পার ধরে হেঁটে চলছি।
এই দীর্ঘ পদযাত্রাকালীন মাঝে মাঝে একঘেয়েমি গ্রাস করে। রাত্রিদিন অন্তহীন ঢেউ আর তটরেখা, যতদূর দৃষ্টি যায় নীল জল, মাথার ওপর নীল আকাশ। তখন একঘেয়েমি কাটাতে মনে মনে ভাবি প্রকৃতির তুলনায় আমরা কত তুচ্ছ! কত সামান্য! কত ক্ষুদ্র! অথচ আমাদের অহং তবু যায় না। এই কোস্টাল ট্রেকিং সেটা যেন হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিল। স্বামী বিবেকানন্দ সারা ভারত প্রদক্ষিণ করেছিলেন। ভারতের আত্মাকে অনুভব করতে। আমরা তো মাত্র দুশো দশ কিলোমিটার হাঁটব। এটা ভাবতেই ভেতরটা চাঙ্গা হয়ে উঠল।
সৌমেন, অজিত অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমরা সামান্য পিছিয়ে। আজ একটা খুব বিখ্যাত চার্চ পড়বে পথে। ভেলাংগিনি। এই চার্চ ভেলাংগিনি সমুদ্রসৈকত দেখতে বহু দূরদেশ থেকে মানুষ আসে।
সাড়ে এগারোটা অবধি হেঁটে ভেলাংগিনি পৌঁছোলাম। সমুদ্রের ধার থেকে শ্বেতপাথরের চূড়া আর অপূর্ব গথিকশৈলী দেখেই বুঝলাম ভেলাংগিনি চার্চ যে অতি বিখ্যাত একটা জায়গায় তা মিথ্যে নয়।
অজস্র মানুষ সমুদ্রতীরের বোল্ডারে বসে আছে। কেউ খাচ্ছে। কেউ গল্প করছে। অতি উৎসাহী কেউ বা জলে সাঁতার কাটছে। অনেকটা আমাদের দীঘার মত।
আমরা স্যাক কাঁধে চললাম ভেলাংগিনি চার্চ দেখতে। সত্যি, চোখ জুড়িয়ে যায়। কী অপূর্ব শৈলী! তবে কিনা মানুষের প্রচন্ড ভীড়। গিজগিজ করছে। হবে নাই বা কেন? খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের কাছে এ অতি পবিত্র তীর্থ।
ঘন্টাখানেক দেখে বেরিয়ে এলাম। সারি সারি দোকান। মাছভাজা খেতে খুব ইচ্ছে হল। আমাদের ক্যাপ্টেন বিলু দু’তিন রকম মাছভাজার অর্ডার দিল। সবই অচেনা মাছ। কিন্তু খেলাম খুব স্বাদে। তারপর ফের হাঁটা। আজ আমাদের টার্গেট নাগাপট্টিনম।
ভেলাংগিনি পেরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে একটা শাখানদীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নদীটা সমুদ্রে মিশেছে। জল অনেক। একজন জেলের কাছে শুনলাম এটা নৌকো ছাড়া পেরুনো সম্ভব নয়। নৌকো পাই কোথায়? ধারে কাছে তো নৌকো দেখা যাচ্ছে না একটাও। আধঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় দূরে ঐ শাখানদীতে একটা নৌকো দেখে সৌমেন অজিত হাত নেড়ে চিৎকার করতে লাগল, হেল্প...হেল্প...হেল্প...।
ভাগ্য ভালো বলতে হবে। ওদের চিৎকারে মাঝির নজর কাড়ল। সে নৌকো নিয়ে আমাদের কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। মোটর বসানো মাছ ধরার নৌকো। ছ’জন চেপে বসলাম। নদী পার করে দিল মাঝি।
সুব্রত বলল, কত টাকা দিতে হবে?
মাঝি হেসে বলল, নো...নো...ফ্রেন্ড...ফ্রেন্ড...
এই হল মানুষ।
আর এই মানুষের স্বরূপ দেখার জন্যই তো বেরিয়ে পড়া। নাগাপট্টিনম এসে যাত্রাবিরতি।
আশ্চর্যজনকভাবে নাগাপট্টিনম থানার সৌজন্যে রাতে একটা ম্যারেজ-হলে থাকার সুযোগ পেয়ে গেলাম। বাথরুম, টয়লেট, চকচকে মেঝে। রাতে রান্না হল ডিমের ঝোল আর ভাত। খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম।
পরদিন ভোরে ফের সমুদ্রসৈকত ধরে চলা। আজ ১২-১২-১১। দারুণ দিন। ঝকঝকে রোদ। সমুদ্র ঢেউ দু’হাত তুলে হাতছানি দিচ্ছে। পায়ের ফোস্কায় লিকোপ্লাস্ট লাগিয়ে হাঁটছি। কিন্তু মাঝে মাঝে খাঁড়িগুলো বিপত্তি ঘটাচ্ছে। জলে লিকোপ্লাস্ট-এর আঠা নষ্ট হয়ে যায়। উপায় নেই। অবশেষে অনুভব করলাম সব কষ্টই একসময়ে সয়ে যায়, যদি না অন্য কোনও উপায় থাকে।
ঘাড় ঘুরিয়ে সৌমেন আমাকে দেখেই বলল, সাবাশ। আপনার সত্যি দারুন স্ট্যামিনা। এই বয়সেও এমন তাল মিলিয়ে হাঁটছেন।
সৌমেনের কথাটা মনের জোর অনেকটা বাড়িয়ে দিল। আসলে নিজে সৌমেন খুব ভালো ট্রেকার। মনটাও চওড়া। তাই ও এমন করে উৎসাহ দিতে পারে।
পাশে চলা বদুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কোথায় আমাদের রাত্রিবাস হবে?
- সম্ভবত তরঙ্গমবাড়ি।
নামটা শুনেই মন আনন্দে নেচে উঠল। সমুদ্রতীরে ‘তরঙ্গমবাড়ি’। নামটা অর্থবহ শুধু নয় দারুণ লিরিক্যাল।
গতরাত্রে আমাদের রান্নার স্টোভটা বিট্রে করেছিল। তাই ওটাকে বঙ্গোপসাগরের জলে বিসর্জন দিয়ে নতুন স্টোভ কেনা হয়েছে। অজিত সাউ তার স্যাকের ওপর পাম্প-স্টোভটা বেঁধে নিয়ে দিব্যি দ্রুতগতিতে হাঁটছে। এই অতিরিক্ত ওজন বহন করার জন্য তার কোনো আপত্তি বা রাগ নেই। হাসিমুখেই চলেছে। একেই তো বলে প্রকৃত টিম-ম্যান।
শুভব্রত, বিলু, অজিত, সৌমেনের অক্লান্ত পরিশ্রম, রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ, আমাকে অবাক করছে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। বদু’র কথাও বলব। অসম্ভব মনের জোর। অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। সবাই মিলে যেন একটা ইউনিট।
মোটরচালিত নৌকোর ব্লেডে কাটা পড়া প্রকাণ্ড একটা সাপ সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে এল। মোটা এবং লম্বা। জেলেরা বলল বিষাক্ত সাপ। ‘নাগোর’ পেরিয়ে একটু বিশ্রাম।
হঠাৎ মোটরবাইক নিয়ে প্রায় ধাওয়া করার মত এক কোস্ট গার্ডের পুলিশ বালির ওপর আমাদের আটকাল।
সুতরাং থামা। সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখে কোস্টগার্ড বলল, কোস্টাল ট্রেকিংয়ে কি হয়?
আমি বললাম, শুধু কষ্ট হয়। আর শুধু আনন্দ হয়।
ও অবাক হয়ে বলল, হাউ ফানি! বলে চলে গেল।
দুটো নাগাদ ‘কাদাইকোল’ নামে একটা গ্রামের পাশে, সমুদ্রের ধারেই বসলাম। লাঞ্চ হবে। আশেপাশে বালির ওপর বহু নৌকো মেরামতি হচ্ছে। অজস্র জাল গুটিয়ে রাখা।
ছাতুর সরবত, খেজুর, বিস্কুটের লাঞ্চ দ্রুত শেষ হল। জল খেয়ে ফের চলা। বিকেলে পৌঁছলাম ‘তরঙ্গমবাড়ি’। চমৎকার স্পট। সমুদ্রপারেই একটা বিশাল দুর্গ – ট্রানকুয়েভার ফোর্ট। ডেনমার্কের কোন অভিযাত্রী করেছিল। তার পাশেই সুদৃশ্য চার্চ। তাদের গেস্ট হাউস। দুধসাদা রঙ। মনে হবে ফাইভস্টার হোটেল। ঝাঁ-চকচকে গোটা জায়গাটা। আমরা রাত্রিবাসের জায়গা খুঁজছি। সেখানকার ফাদারের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিতে লাগলেন। কোথায় আমাদের আশ্রয় দেওয়া যায়। অবশেষে একটা মিশনারি স্কুল হস্টেলের দোতলায় আমাদের ব্যবস্থা হল। অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। এককোণায় আমরা রান্না করলাম। তরঙ্গমবাড়ির তরঙ্গমালার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
১৩-১২-১১ সকালে যথারীতি হাঁটা শুরু হল। বিদায় তরঙ্গমবাড়ি। ঘাড় ঘুরিয়ে ফোর্টটা দেখছি আর যারা করেছিলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাচ্ছি। এ যেন সমগ্র সুন্দরের শীর্ষে সুন্দরতমের আবাস।
আজকের তিরিশ কিলোমিটার হাঁটার উল্লেখ্য জায়গা হল কাবেরি নদী পার হতে হবে। ভেবেছিলাম অনেকটা ঘুরে গ্রামের মধ্যে দিয়ে নৌকো করে পার হব। কিন্তু যেখানে সমুদ্রে এসে কাবেরি নদীতে মিশেছে সেখানে মাত্র এক হাঁটু জল। এর কারণ সম্ভবত প্রলয়ংকর সুনামি। সুনামির ধাক্কা যে কত নদী খাঁড়ি ইত্যাদির ভূগোল পরিবর্ত্তন করেছে তার ইয়ত্তা নেই। যেখানে গ্রাম ছিল সেখানে সমুদ্র। গ্রাম সরে গেছে বহুদূরে। হয়ত বা জলের তলায়।
কাবেরি নদী পার হয়ে পম্পিহার। বিশ্রাম। ফের চলা। সবাই এখন ভীষণ টায়ার্ড। এবারে দেখি সামনেই সমুদ্রের সমান্তরাল এক ভয়ঙ্কর বেগবতী খাঁড়ি। একদম পাড়সমান জল। দেখলে ভয় লাগে। নৌকোতেও যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে যখন দিশেহারা তখনই এল একটা দাঁড়টানা নৌকো। দুজন দুজন করে ঐ পারে নিয়ে যাবে। যেখানে আজ রাত্রিবাস। গ্রামটা বেশ বড়। নাম থিরুমুলাইভাসাল।
অনেক ঝুঁকি নিয়ে কোনক্রমে টাল খেতে খেতে ডিঙ্গি নৌকো ঐ পারে সবাইকে পৌঁছে দিল। যাক, আজকের রাতের মত নিশ্চিন্ত। জলকাদা পেরিয়ে গ্রাম। একদফা জিজ্ঞাসাবাদ। তারপর একটা আশ্রয় মিলল।
কোনরকমে রাতটুকু কাটিয়ে পরদিন সকালে ফের সমুদ্রের বালি ছুঁয়ে হাঁটা শুরু। থুডুয়াই, পাসিয়ার পেরিয়ে গেছি। ইত্যবসরে দুটো খাঁড়ি পেরিয়েছি। প্রত্যেকেই এখন ক্লান্ত। সন্ধে অবধি হাঁটা। বিশ্রাম কম। একসময় পৌঁছে গেলাম আজকের টার্গেটে এম. জি. আর. থেট্টি।
গাঁয়ের মানুষের সহায়তায় একটা বিশাল কম্যুনিটি সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা হল। এই কমিউনিটি সেন্টারে স্তূপাকার জাল। নানা রকমের। একটা গোটানো জাল দেখলাম যার দাম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। ওজন তিন টন। ট্রাকে চাপিয়ে সমুদ্রতীরে নিয়ে যেতে হয়। টানা দু কিলোমিটার লম্বা। এক কিলোমিটার ঝুল। এছাড়া আরও যে কত জাল। এরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। আকিবা বলে একটা শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বহুক্ষণ গল্প হল।
সে বলল এটা অরিজিনাল এম. জি. আর. থেট্টি নয়। সে জায়গাটা সুনামিতে সমুদ্রের জলে চাপা পড়ে গেছে। এটা তারপরে তৈরি হয়েছে। আপনারা যদি চান তো দেড় কিলোমিটার সমুদ্রের মধ্যে গেলে সেই পরিত্যক্ত গ্রামটা আমি দেখিয়ে আনতে পারি।
আমরা পরম উৎসাহিত হয়ে বললাম, কাল সকালে উঠে আমরা যাব। তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
আকিবা কথা দিয়ে চলে গেল। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা শুয়ে পড়লাম।
আজ ১৫-১২-১১। আজই আমরা আমাদের শেষ টার্গেট কুড্ডালুরু পৌঁছাব। উৎসাহে টগবগ করছি। সকালেই নৌকো করে সুনামি বিধ্বস্ত এম. জি. আর. থেট্টি দেখতে চললাম। সমুদ্রের মধ্যে একটা জায়গায় জল-বালি আর অজস্র নারকেল গাছ। আকিবা বলল, এটাই। একদিন মানুষের কোলাহলে এই গ্রাম মুখর থাকত। আজ কেউ নেই। কিছু নেই। সুনামিতে আমাদের গ্রামের একশ পঁচিশ জন মারা গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে।
আকিবা চোখের জল মুছল।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা নৌকো করে আবার সমুদ্রপারে ফিরে এলাম। শুরু হল হাঁটা। কিছুতেই আকিবার কান্নাটা ভুলতে পারছিলাম না।
দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছি। আকাশে মেঘের আনাগোনা। পুডুকুপম্ পেরিয়ে গিয়ে বৃষ্টি। ঝমঝম শব্দে। আশ্রয় নিলাম সমুদ্রেরতীরে একটা গাছের নিচে। কিন্তু তাতেও ভিজে গেলাম। ফের চলা। জেলেরা আজ কেউ আর মাছ ধরতে যায়নি। সমুদ্রে সতর্কবার্তা জারি হয়েছে। সকালে টিফিন না করেই হাঁটা চালিয়ে যাচ্ছি। যত দ্রুত চলা যায়। ধীরে ধীরে নীল আকাশ গোটাটাই মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল। দুপুরের ছাতু, বিস্কুট, খেজুর, কিসমিস খেয়ে আর বিশ্রাম নয়। তাড়া করছে ঐ কালো হয়ে আসা মেঘ। আহিপেট্টাই, পাটোরা পেরিয়ে তখন বিকেল। ক্লান্তিতে শরীর যেন আর চলতে চাইছে না। একটা খাঁড়ি পথ আটকাল। জেলেদের কাছে খবর পেলাম খাঁড়ি পার হয়ে আর মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে কুড্ডালুরু।
আনন্দে অজিত চিৎকার করে উঠল, ইয়া হু...।
খাঁড়ি পার হয়ে ঘন্টা দুয়েক হাঁটতেই আলোকিত জেলাশহর কুড্ডালোর ঝলমল করে উঠল।
আমরা পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। হাতে হাত রেখে ঈশ্বরের উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানালাম।
আজ কুড্ডালুরু থেকে বাসে চলে যাব পন্ডিচেরি। মাত্র বাইশ কিলোমিটার। একদিন সেখানে থেকেই চেন্নাই। তারপর বাড়ি ফেরার ট্রেন। বিলু অনেক ঝিনুক কুড়িয়েছে ওর মেয়ের জন্য। আমরা স্মৃতির ঝাঁপি ভর্তি করছি। সৌমেন ক্যামেরার রিল শেষ করছে। আহা কী আনন্দ আজ আকাশে বাতাসে।
~ তথ্য - তামিলনাড়ু কোস্টাল ট্রেক ~ ট্রেক রুট ম্যাপ ~ কোস্টাল ট্রেকের আরো ছবি ~
কথাসাহিত্যিক মানব চক্রবর্তীর প্রথম উপন্যাস দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত 'কুশ' আবির্ভাবেই জনপ্রিয় হয়েছিল। বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা ছোট গল্পগুলি। কয়েকটি ছোটগল্পের মঞ্চায়নও হয়েছে। তবে শুধু কলমই নয় মানবের ভালোলাগার আরেক নাম ভ্রমণ। মাঝেমধ্যেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতি আর মানুষের আরও কাছাকাছি পৌঁছে যেতে। ষাট পেরনো এই যুবক এখনো রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠেন ট্রেকিং-এর কথায়। অনেক পাহাড়-সাগর পেরিয়ে তাঁর চরৈবতি ভারতবর্ষের নানান প্রান্তে আজও অবাধ।