মেঘমুলুক

সুচেতনা মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী

 

~ মহাবালেশ্বরের তথ্য ~ || ~ মহাবালেশ্বরের আরো ছবি ~

 

মেঘ বলেছে ‘যাব যাব- তাই মন বলছে যাই মহারাষ্ট্রের অন্যতম পুণ্যতীর্থ মেঘভূমি মহাবালেশ্বরে। পাহাড়ের কোলে যেন ছোট্ট একটি মেঘালয়।
পুরাণে আছে প্রচণ্ড দুই দানব মহাবলি আর অতিবলির হাত থেকে রেহাই পেতে পূজারিরা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণুর সাথে যুদ্ধে অতিবলি মারা যান। ক্রুদ্ধ হয়ে মহাবলি যুদ্ধে মত্ত হন। মহাবলিকে যুদ্ধে পরাস্ত করা সহজ নয়। তাই বিষ্ণু শরণাপন্ন হলেন মহাবলির আরাধ্য দেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের। মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন না মহাবলি। বরং ইচ্ছামরণের পথ বেছে নিলেন এই শর্তে যে তাঁর নাম যুক্ত হবে এই পুণ্যস্থানে যেখানে স্বয়ং শিব ও বিষ্ণু অধিষ্ঠান করেছেন। তথাস্তু বললেন দেবতারা। সেই থেকে এই স্থানের নাম হল মহাবালেশ্বর।
On way to Mahabaleswarপুণে থেকে রওনা হলাম সকাল সকাল। মুম্বই-ব্যাঙ্গালোর হাইওয়ে ধরে গাড়ি চলেছে হু হু করে। কখনও লোকালয় কখনও বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে। শহুরে রাস্তাটা পাহাড়ের কোলে মিলিয়ে গেছে। একপাশে খাড়া পাহাড়। আমরা পাহাড়ের রাস্তা নিলাম। তারপর একটার পর একটা পাহাড় পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছোলাম পঞ্চগনি। মহারাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয় এই হিল স্টেশন। দুপাশে স্ট্রবেরির ক্ষেত। পঞ্চগনির স্ট্রবেরি বিশ্ববিখ্যাত। অবশেষে পঞ্চগনি রোডের ওপর একটা বেশ জনবহুল জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। জায়গাটার নাম ম্যাপ্রো গার্ডেন। এখানে স্ট্রবেরি জ্যামের ফ্যাক্টরি, মার্কেট ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। পিজা থেকে শুরু করে আইসক্রিম কোল্ডড্রিংক্‌স্ সবই পাওয়া যায়। আর জ্যাম তো আছেই। বিক্রির সময় ডেমোনস্ট্রেশন দিচ্ছে ইউনিফর্ম পরা মেয়েরা। চেখে দেখবার সুযোগও পাচ্ছেন পর্যটকেরা।  কিছু স্ট্রবেরি জ্যাম কিনে রওনা হওয়া গেল।
পঞ্চগনি থেকে আর কিছুটা গেলেই মহাবালেশ্বর। মহাবালেশ্বর ক্ষেত্রের দুটি অংশ -একটি হালে গড়ে ওঠা ছোট্ট শহর। অপরটি পুরোনো মহাবালেশ্বর। যার দূরত্ব শহর থেকে ছকিলোমিটার। গাড়ি সেদিকেই এগিয়ে চলল। মনে হল দূরের পাহাড় চূড়োগুলো সব যেন নিশ্চিন্ত মনে মেঘের রাজ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে  রাস্তাটাও যেন মেঘের মধ্যে ডুবে গেল। যতই এগোনো যাচ্ছে মহাবালেশ্বরের দিকে দিনের আলো ততই ফিকে হয়ে আসছে। মাঝে মধ্যে এলোমেলো রোদ্দুরের উঁকি আবার লুকিয়ে পরা, সব যেন একদিন কল্পনাতেই দেখেছিলাম।
বর্ষাতেই মহাবালেশ্বর সবথেকে সুন্দর। তাই বর্ষার শুরুতেই রওনা হয়েছি। সঙ্গে ছাতা, অল্প শীতের পোশাক। ক্রমেই মেঘ স্পর্শ করলাম আমরা। কখনও মনে হল সাদা ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেল। তারই মধ্যে দিয়ে গাড়ির জোরালো হেডলাইট পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। কি অসামান্য সুন্দর এই জায়গা!
মহাবালেশ্বর পৌঁছোলাম। রাস্তার দুপাশে দামি, কমদামি নানানধরনের রিসর্ট-হোটেলের ছড়াছড়ি। মহারাষ্ট্র সরকারের অতিথিশালাটি অল্প বাজেটে বেশ সাজানো গোছানো। আমাদের বুকিং ওখানেই ছিল। খানিক বিশ্রামের পর স্নান আর সুস্বাদু খাবার খেয়ে বেরিয়ে পরলাম। যাত্রার উদ্দেশ্য প্রতাপগড় ফোর্ট। মহাবালেশ্বর থেকে ২১ কিমি দূরে শিবাজি মহারাজের তৈরি এই ফোর্টের কয়েকটা সিঁড়ি উঠলেই দেখা যায় শিবাজির আমলে ব্যবহার করা কামান। ২৫০ সিঁড়ি ওপরে ভবানী মায়ের মন্দির। রয়েছে শিবাজির গুরু রামদাস পূজিত হনুমান মন্দিরও।
On way to Mahabaleswarএই দুর্গের পাঁচিলে গায়ে রয়েছে চৌকো করে কাটা ছিদ্র। শোনা যায় শত্রুপক্ষ যখন আক্রমণ করত তখন এই ছিদ্রপথ দিয়ে ওপর থেকে তাদের গায়ে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হত। দুর্গে সিঁড়ি প্রচুর। ওপরে ওঠার সময় তাই খানিক পরপর বসবার জায়গা আর রেস্টুরেন্ট বানানো। কখনও সখনও বৃষ্টি পরছে। আমরাও এখানে বসে একটু চা খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ এই মেঘে ঢাকা দুর্গে সময় কাটিয়ে ফিরলাম মহাবালেশ্বরের পথে। ফেরবার পথে পাহাড়ি ঝরনার ধারে ছবি তোলা, কিংবা সঙ্গে কোয়েনা নদীর কুলকুল শব্দে মেতে ওঠা, এসব পেরিয়ে গেস্টহাউস পৌঁছোতে বিকেল গড়িয়ে এল। গেস্টহাউসের কাছেই সানসেট পয়েন্ট। একে বোম্বে পয়েন্টও বলে। দিনশেষের সূর্যের বিদায় আজ এখানেই। বোম্বে পয়েন্টের মত  মাঙ্কি এবং এলিফেন্টস্টোন পয়েন্ট দুটি থেকেও সানসেট দেখা যায়।
Koyna River flowing through Mahabaleswarপরদিন আবার সকাল সকাল তৈরি। শহর থেকে সাড়ে ১২ কিমি দূরে আর্থার সি পয়েন্ট। কোঙ্কন উপত্যকার চমৎকার নিসর্গ এখান থেকে দেখা যায়। মারাঠা যোদ্ধাদের ব্যবহার করা একটি পুরোনো রাস্তাও আমাদের ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছিল। মুনি-ঋষিদের ব্যবহার করা গুহাও রয়েছে এখানে। স্থানীয়রা মনে করেন একসময়ের হোম যজ্ঞের কারণে এখানকার মাটি ধূসর বর্ণের।
মহাবালেশ্বরের শিবমন্দিরে স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ রয়েছেন পর্বতশিলার আকারে। রয়েছেন এক পত্নী গায়ত্রী নদীর জলের আকারে। ১২১৫ খ্রীষ্টাব্দে স্বয়ম্ভু শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন দেওয়গিরির রাজা। ১৫৭৮ এ কৃষ্ণাবাজি মোরে এই মন্দিরকে আরও সুসজ্জিত করে তোলেন। আর শিবাজিমহারাজ একে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। হোমযজ্ঞে এই স্থান মুখরিত। মহাশিবরাত্রিতে এখানে বড় মেলা বসে। দোকান পসরা, আতসবাজি, গানবাজনায় জায়গাটি জমজমাট হয়ে ওঠে।
শিবমন্দিরের অনতিদূরেই পঞ্চগঙ্গা মন্দির। ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক সত্য যে মহাবালেশ্বর পাঁচটি নদীর উৎসস্থল -কৃষ্ণা, কোয়েনা, ভেন্না, সাবিত্রী এবং গায়ত্রী। জাভালিরাজ চন্দ্ররাও মোরে এই পঞ্চনদীর অবস্থানগত কারণেই পঞ্চগঙ্গা মন্দির স্থাপন করেছিলেন।
অবশেষে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতেই আমাদের ঘোরা শেষ হল। এই মেঘ-ছায়ে সজলবায়ে যেন পুরাণ, ইতিহাস, অরণ্যভূমি, পাহাড়, নদী উৎসের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করলাম। মনে হল কোথায় যেন প্রকৃতি আর মানুষ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।

~ মহাবালেশ্বরের তথ্য ~ || ~ মহাবালেশ্বরের আরো ছবি- নিমার্ল্য চক্রবর্তী ~

ভ্রমণ সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী সুচেতনার প্রিয় বিষয় জঙ্গল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখায় পাহাড়, নদী, পশুপাখি আর অরণ্যের আদিবাসী জীবনের পাশাপাশি উঠে এসেছে শহুরে জীবনের বিচিত্রতাও। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘অরণ্য হে’।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher