মুম্বই (Mumbai)- আরবসাগরের তীরে ৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ভারতের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক শহর মুম্বই মহারাষ্ট্রের রাজধানী। ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযোগকারী ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস (CST) শহরের কেন্দ্রস্থলে। ১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিল ভারতীয় রেলওয়ের প্রথম বাষ্পচালিত ট্রেন রওনা হয় এই সি.এস.টি. বা অতীতের ভি.টি. (ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস) থেকে থানে ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে। গথিক শৈলীতে নির্মিত এই স্টেশনটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। স্টেশনের উল্টোদিকে ১৮৯৩ সালের তৈরি মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁহাতে দাদাভাই নওরোজি রোড ধরে কিছুটা এগোলে ফ্লোরা ফাউন্টেন। বর্তমানে নাম পুতাত্মা চক। পাশেই সেন্ট টমাস ক্যাথেড্রাল। কাছেই ১৮২৯ সালে তৈরি মিন্ট। চার্চ গেট স্টেশনের কাছে ১৮৩৩ সালে তৈরি টাউন হল। পাশে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
ফ্লোরা ফাউন্টেনের কাছে এম জি রোডে ইন্দো-সেরামিক ধাঁচে তৈরি মিউজিয়াম। ভাস্কর্য ও ছবির সংগ্রহ দেখবার মত। সোমবার প্রদর্শনী বন্ধ থাকে।
জলপথে ভারতের প্রবেশদ্বার - গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া (Gateway of India), সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ । ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি এখানেই জাহাজ থেকে অবতরন করে দিল্লির দরবারে অংশ নিতে যান। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করবার জন্য পরবর্তীকালে হিন্দু ও মুসলমান স্থাপত্যের মিশ্রনে প্যারিসের আর্ক দ্য ট্রায়ামফ্–এর আদলে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া তোরণদ্বারটি তৈরি করা হয়। সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ভারি সুন্দর। এখান থেকেই লঞ্চ যাচ্ছে এলিফ্যান্টায় (Elephanta Caves)। উল্টোদিকে তাজ ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল।
গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া থেকে জলপথে ১ ঘন্টার দূরত্বে এলিফ্যান্টা। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত এই গুহামন্দির হিন্দুরাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর আমলে ৪৫০-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছিল। নাম ছিল ঘরাপুরি। জৈন ও বৌদ্ধপ্রভাবও রয়েছে ভাস্কর্যে। শিব উপাস্য দেবতা। মোট গুহার সংখ্যা ৭টি। এর মধ্যে প্রথম গুহাটি ছাড়া অন্যান্য গুহার ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথম গুহা মন্দিরে (১)তান্ডবনৃত্যে শিব, (২)দৈত্যবধে শিব, (৩)শিব-পার্বতীর বিয়ে, (৪)গঙ্গার অবরোহণ, (৫)মহেশমূর্তিরূপে শিব, (৬) অর্ধনারীশ্বররূপে শিব, (৭)কৈলাসে শিব ও পার্বতী, (৮)দানবরাজা রাবণ শিবকে লঙ্কায় নিতে বাড়িসমেত কৈলাস তুলেছে, (৯)যোগীরূপে শিব- এই দশটি ভাস্কর্য রয়েছে। মূল গুহার পাশে ছোট গুহাটির দেওয়ালে অষ্টমাতৃকার মূর্তি রয়েছে। আর রয়েছে দু-পাশে গণেশ ও কার্তিক মূর্তি।
১৫৩৪ সালে পর্তুগিজদের দখলে আসে এই দ্বীপ। পর্তুগিজদের হাতেই ধ্বংস হয়েছিল এই গুহামন্দিরগুলি। এলিফ্যান্টা নামটিও তাদেরই দেওয়া। সেকালে বিরাটাকার পাথরের হাতিও ছিল জাহাজঘাটায়। ভেঙে পড়া একটি হাতির মূর্তি পরে ভিক্টোরিয়া গার্ডেনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
লঞ্চে করে জেটিতে পৌঁছে টয়ট্রেনে বা হেঁটে পাহাড়তলিতে। তারপর অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে পাহাড়ের মাথায় গুহায় পৌঁছান। সিঁড়ির দু’পাশে হরেকরকম পশরা নিয়ে বসেছে দোকানিরা। ফেব্রুয়ারিতে এলিফ্যান্টা ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে ভিড় জমে ওঠে এই ছোট্ট দ্বীপে।
গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া থেকে মিনিট দশেকের দূরত্বে নরিম্যান পয়েন্ট (Nariman Point) পেরিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভ (Marine Drive) যা বর্তমানে নেতাজি সুভাষ রোড নামে পরিচিত। মসৃণ ও প্রশস্ত রাজপথ আরবসাগরের তীর ধরে অর্ধচন্দ্রাকারে এগিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে মালাবার হিলে (Malabar Hills)। মালাবার হিলসের মাথায় গভর্নর প্যালেস। রাতে মেরিন ড্রাইভের আলোকমালায় সজ্জিত পথকে মনে হয় যেন সমুদ্রের বুকে ঝলমলে বহুমূল্য রত্নহার- ‘কুইনস নেকলেস’।
মালাবার হিলসে রয়েছে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পত্নীর নামে কমলা নেহরু পার্ক আর ১৯০৩ সালে তৈরি দ্বিতল জৈনমন্দির। মালাবার হিলসের চূড়ায় হ্যাঙ্গিং গার্ডেন বা ফিরোজ শাহ মেহেতা গার্ডেন। রংবেরঙের ফুলে সাজানো এই বাগানে রয়েছে গাছ ছেঁটে তৈরি নানা জীবজন্তুর মডেল। এখান থেকে সূর্যাস্ত অপরূপ।
মুম্বইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈকত মেরিন ড্রাইভ ধরে মালাবার পথে চৌপট্টি বিচ (Chowpatti Beach) আর ২০ কিলোমিটার দূরে জুহু বিচ (Juhu Beach)। চৌপট্টি বিচটি সান্ধ্যভ্রমণের আদর্শ স্থান। উপরি আকর্ষণ সৈকতের ধারে চানা-বাটোরা, ভেলপুরি, পানিপুরি আর কুলফি মালাইয়ের দোকানগুলো। এখানে গণেশ চতুর্থীর উৎসব শেষে সাগরে প্রতিমা নিরঞ্জন দেখার জন্য হাজার হাজার পুণ্যার্থীর সমাবেশ ঘটে। জুহুর কাছেই সান্তাক্রুজ বিমানবন্দর।
বম্বেতে এলে গান্ধিজি মণিভবনে বাস করতেন। এখন এটি তাঁর ছবি, বই ও ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংগ্রহশালা।
শহর থেকে ৪০-৪২ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণগিরি জাতীয় উদ্যান। আরও ৮ কিলোমিটার দূরে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকে নবম শতকে তৈরি ১০৯টি বৌদ্ধচৈত্য ও বিহার যা কানহেরি গুহা নামে পরিচিত।
এছাড়া মুম্বইয়ের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়, রাজাবাই ক্লকটাওয়ার, হাইর্কোট, পুরোনো সেক্রেটারিয়েট, রাজ্য পুলিশের সদরদপ্তর, নরিম্যান সার্কেল, এশিয়াটিক লাইব্রেরি, টাউন হল, ছত্রপতি শিবাজি সংগ্রহশালা, তারাপোরোয়ালা অ্যাকোয়ারিয়াম, রানিবাগ বা জিজামাতা উদ্যান, চিড়িয়াখানা, বোটানিকাল গার্ডেন, ফিল্ম সিটি গার্ডেন, মহালক্ষ্মী মন্দির, সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির, হাজি আলি ইত্যাদি।
যাওয়াঃ- পশ্চিম ও মধ্য রেলওয়ের সদর দপ্তর মুম্বই। মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস(CST) ও লোকমান্য তিলক টার্মিনাস(LTT)-এই দুই রেলস্টেশনই প্রধান। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সাহারা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সি.এস.টি-র বিপরীতে মহারাষ্ট্র স্টেট ট্রান্সপোর্ট ডিপো।
মুম্বই সি.এস.টি. স্টেশনের পাশেই এম.টি.ডি.সি.-র কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে সারাদিনের ট্যুরে মুম্বই ঘুরে নেওয়া যায়। আধবেলার ট্যুরেও বিশেষ কিছু স্থান দেখা যায়। এছাড়া প্রাইভেট কোম্পানির লাক্সারি বাসেও ঘুরে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- মহারাষ্ট্র পর্যটন উন্নয়ন নিগমের হোটেল রয়েছে মাদাম কামা রোডে। মুম্বই সি এস টি স্টেশনের কাছাকাছি বিভিন্ন বাজেটের প্রচুর প্রাইভেট হোটেল আছে। এছাড়া মুম্বই জুড়েই হোটেলের ছড়াছড়ি। মুম্বইয়ের এস টি ডি কোডঃ- ০২২ ।
লোনাভালা-খান্ডালা (Lonavala-Khandala)- সহ্যাদ্রি পর্বতমালার পশ্চিমভাগের পাহাড়ের ঢালে যমজ শৈলশহর লোনাভালা ও খান্ডালা। লোনাভালা লেকের নামেই শহরের নাম। শান্ত, স্নিগ্দ্ধ, মনোরম জলবায়ুর জন্য এই দুই শহর খুবই প্রসিদ্ধ। জাতীয় সড়কের ধারে ১ কিলোমিটার দূরে রাইডার্স পার্ক। পাশেই লোনাভালা লেক। অল্পদূরে টাইগার্স লিপের পাহাড়ি চূড়া, কুনাপয়েন্ট, লোহাগড়, বলবান ড্যাম, রাইউড পার্ক, বুশি ড্যাম এবং স্টুড্ডারলি লেক। ডানহাতে ১,৩৫৭ মিটার দীর্ঘ ওয়াল ওয়ান বাঁধ। লোনাভালা থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে খান্ডালার জলপ্রপাত খুবই আকর্ষণীয়। বর্ষায় চারপাশের পাহাড় থেকে নেমে আসে অসংখ্য ঝরনা। ওইসময় মুম্বই থেকে ট্রেনে একের পর এক টানেল পার হওয়ার সময় দুদিকের পাহাড় থেকে নেমে আসা শ্বেতশুভ্র জলরাশি মুগ্ধ করে যাত্রীদের। সন্ধ্যায় আলোকমালায় সজ্জিত হয় দুই শহর। শুটিং স্পট হিসেবেও এই দুই শহর খুবই জনপ্রিয়। এখানে সাহারা ইন্ডিয়া গড়ে তুলেছে লেক সিটি। বেশকিছু অসাধারণ ভিউপয়েন্ট - রিভার্সিং পয়েন্ট, রাজমাচি পয়েন্ট, এছাড়া সেন্ট জেভিয়ার্স মিশন, টুংফোর্ট ছড়িয়ে আছে এই দুই শহরে।
লোনাভালা থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে ভারতের বৃহত্তম বৌদ্ধ চৈত্য নিয়ে বৈজয়ন্তীর শ্রেষ্ঠী ভূতপালের নির্মিত কারলা গুহা। অপরূপ ভাস্কর্যময় গুহাটি হীনযান বৌদ্ধধর্মীদের। কারলা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ভাজা গুহার বৌদ্ধ চৈত্য ও ভাস্কর্যও দর্শনীয়।
যাওয়াঃ- মুম্বই থেকে লোনাভালা ১২৪ কিলোমিটার এবং সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে খান্ডালা। তবে পুনে স্টেশন থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে লোনাভালা। এই পথে সারাদিনই বেশ কয়েকটি ট্রেন চলে। দুটি স্টেশনেই ট্রেন থামে। এছাড়া বাসও চলে ১৫-২০ মিনিট অন্তর।
থাকাঃ- দু জায়গাতেই প্রচুর হোটেল রয়েছে। বিভিন্ন মানের। অফ সিজনে ঘরগুলির ভাড়া অনেক কমে। লোনাভালা ও খান্ডালার এস টি ডি কোডঃ- ০২২।
পুনে - মারাঠাদের ঐতিহাসিক শহর আজকের বাণিজ্যনগরী পুনে। মারাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজির হাতে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে বাহামনিদের পরাজয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায় পুনা নগরী। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে বালাজি বাজিরাও, আহম্মদ শাহ দুরানির কাছে পরাজিত হওয়ায় মারাঠা সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। পেশোয়া নানাসাহেবের হাতে আবার ওই শতকের শেষদিকে হৃত সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধার হয়। ১৮১৮ সালে পেশোয়াকে পরাজিত করে ব্রিটিশরা দখল করে এই শহর। মনে করা হয় ‘পুণ্যাপুর’ নামটি থেকে পরবর্তীকালে ‘পুনা’ নামটি এসেছ। অন্য মত হল, পুণ্যেশ্ব অসুরের মন্দিরের নাম থেকেই পুনে। গণেশ চতুর্থী ও পালকি উৎসব উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ পর্যটক সমাবেশ হয় এখানে।
পুনে শহরের সাড়ে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ১৭৫৩ সালে বালাজি বাজিরাওয়ের আমলে তৈরি শ্বেতশুভ্র পার্বতীমন্দির। মন্দিরের মূর্তিটি সোনার। দেবী পেশোয়া শাসকদের গৃহদেবতা। ১০৮ টি সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। দেবীর সঙ্গে মন্দিরের অন্যান্য কক্ষে স্থান পেয়েছেন দুর্গা, গণেশ, কার্তিক, বিষ্ণু ও সূর্য দেবতারা। মন্দির থেকে কয়েক ধাপ নেমে এলেই পেশোয়া শাসকদের ব্যবহৃত নানান সামগ্রীর সংগ্রহশালা। প্রবেশমূল্য দিয়ে সংগ্রহশালা দেখে নেওয়া যায়। খুবই ভালো লাগবে। মন্দিরের উপর থেকে চারপাশের দৃশ্যও খুব সুন্দর।
এখান থেকে অল্প দূরে বাঙালির গর্ব সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। রাজা দিনকর কেলকারের একক সংগ্রহে গড়ে ওঠা মিউজিয়ামটিও অসাধারণ। রাজস্থানি স্থাপত্যে গড়া বাড়িটিতে প্রায় হাজারদুয়েক বছরের পুরোনো সামগ্রী রয়েছে। এগুলি সাজানো আছে ৩৬ টি কক্ষে। রয়েছে বিচিত্র সব মন্দিরভাস্কর্য, প্রাসাদ শিল্প থেকে নানান বাদ্যযন্ত্র, মারাঠাদের রকমারি পোশাক, সমরাস্ত্রের সম্ভার, পোড়ামাটির কাজ, জরির কাজের অপূর্ব শিল্পকর্ম, তৈলচিত্র থেকে জলরঙের অসাধারণ চিত্রসামগ্রী।
ইতালীয় স্থাপত্যে গড়ে তোলা আগা খাঁ প্রাসাদ বা গান্ধি জাতীয় মিউজিয়াম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অধ্যায়ের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে এই প্রাসাদে বন্দি ছিলেন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধি, কস্তুরবা গান্ধি, সরোজিনী নাইডু, মহাদেবভাই দেশাইসহ আরও অনেক জাতীয় নেতা-নেত্রী। বন্দি অবস্থাতেই মারা যান কস্তুরবা গান্ধি ও মহাদেবভাই দেশাই। শ্বেতমর্মর সমাধি রয়েছে প্রাসাদপ্রাঙ্গণে। পাশেই গান্ধি মিউজিয়াম। কস্তুরবার ছবি, আসবাবপত্র, সংক্ষিপ্ত জীবনাবলি, বাংলায় লেখা একটি চিঠিও রাখা আছে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে এই প্রদর্শশালা।
১৭৩৬ সালে পেশোয়া বাজিরাওয়ের তৈরি শানওয়ার ওয়াধা প্রাসাদটিও দর্শনীয়। শত্রুপক্ষ যাতে হাতির পিঠে চড়ে আক্রমণ করতে না পারে তার জন্য রয়েছে গজাল লাগানো মজবুত সিংহদরজা - দিল্লিগেট। ১৮২৭ সালে বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় প্রাসাদের বেশিরভাগ অংশ। সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই সামনে নগরখানা। প্যালেস অফ মিউজিক-এর জাফরির কাজ মুগ্ধ করে পর্যটকদের। গেটে ঘোড়সওয়ার রাজাজির মূর্তি।
শহরের আরেক প্রান্তে রেসকোর্স। ভান্ডারকর ইনস্টিটিউটে পুঁথির সংগ্রহও দেখে নেওয়া যায়।
৮ম শতকে তৈরি অতিপ্রাচীন পাতালেশ্বর শিবের দর্শন করতে যেতে হবে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পাতালেশ্বর গুহামন্দিরে। মন্দিরের পাশেই আছে তান্ত্রিকসাধক মাতাজির মন্দির।
এছাড়া ট্রাইব্যাল মিউজিয়াম, এমপ্রেস উদ্যান, ছোটো একটি চিড়িয়াখানা, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট, মুথার নদীর পাড়ে শেখ সল্লাহর দরগা, মুলা ও মুথানদীর সংগম, মহাদজি সিন্ধিয়া ছত্রি প্রভৃতিও ঘুরে দেখে নেওয়া যেতে পারে।
শহর থেকে ২৪-২৫ কিলোমিটার দূরে ১,২৯০ মিটার উঁচুতে পাহাড়ি টিলায় সিংহবিক্রম তানাজির স্মৃতিবিজরিত সিংহ গড়। তিনি ছিলেন শিবাজি মহারাজের সেনাপতি। বিজাপুর সুলতানের কাছে পরাজিত হওয়ার পর দুর্গটি হাতছাড়া হয়। শিবাজির মায়ের ইচ্ছায় দুর্গটি পুনরুদ্ধারের জন্য মাত্র ৩০০ জন বিশ্বস্ত মাওয়ালিবীর সৈন্যকে নিয়ে তানাজি রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করেন ও জয়ী হন। কিন্তু তিনি ওই যুদ্ধে নিহত হন। যেখানে তাঁর দেহ পাওয়া যায় সেখানে তাঁর কষ্টি পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন শিবাজির মাতা জিজাবাই। ওখানে আছে শীতল জলের পুকুর। তার পাড়ে তানাজির ব্যবহৃত কামান ও ভগ্নপ্রায় ভবানীমন্দির। গান্ধিজি ১৯১৫ সালে লোকমান্য তিলকের সঙ্গে দেখা করতে যান ওই দুর্গে। প্রবেশদ্বারে দ্রোণাচার্যের ১১ফুট উঁচু মর্মরমূর্তি। এছাড়া পুনে থেকে গাড়ি ভাড়া করে শিবাজির তৈরি তোর্না দুর্গ, রায়গড়, ৪০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমঘাট পর্বতের ১,৩৫০ মিটার উঁচুতে পুরানদার দুর্গ এবং ৯৫ কিলোমিটার দূরে শিবাজির জন্মস্থান শিবনেরি দুর্গ দেখে আসা যায়। শিবনেরি দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবাই মাতা। শিবাজির নামকরণ এই দেবীর নামেই। এখানে দুর্গের নীচে একসঙ্গে ৫০টি বৌদ্ধগুহা আছে।
পুনে থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম ভীমাশংকর মন্দির রাজ্য পরিবহণ দপ্তরের বাসে ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। ভীমাশংকরের পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গ স্বয়ম্ভু। এখানকার মন্দিরটি তৈরি করেন মহারাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি নানা ফড়নবিশ। পাথরের খোদাই শিল্পের নিখুঁত কাজ এককথায় অতুলনীয়। এছাড়া পাহাড় ও অরণ্যে ঘেরা ভীমাশংকরের পরিবেশ খুবই উপভোগ্য। ভীমানদীর জন্মও এখান থেকে। মহাশিবরাত্রির উৎসব উপলক্ষে মেলা বসে। প্রচুর তীর্থযাত্রীর সমাগম হয় এখানে।
যাওয়াঃ নিকটবর্তী রেলস্টেশন পুনে। পুনে শহরে ২-৩ দিন থেকে আশপাশের সব জায়গাগুলি একটি গাড়ি ভাড়া করে অথবা স্টেট বাসে ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। পুনে রেলস্টেশনের বাসস্ট্যান্ড থেকে মুম্বই, গোয়া, মহাবালেশ্বর, পঞ্চগনি, প্রতাপগড়, লোনাভালা যাওয়ার সরকারি বাস পাওয়া যাবে। শিবাজি নগর বাসস্ট্যান্ড থেকে ঔরঙ্গাবাদ, নাসিক, আহমেদনগর ও সিরডি পর্যন্ত যাওয়ার বাস পাওয়া যায়।
থাকাঃ পুনে শহর জুড়ে নানা মান ও দামের হোটেল রয়েছে। পুনের এস টি ডি কোডঃ ০২০।
পঞ্চগনি - সমতল থেকে ১,৩৩৪ মিটার উঁচুতে পাঁচ পাহাড়ে ঘেরা, সিলভার ওক আর ঝাউয়ে ছাওয়া ছোট্ট শৈলশহর পঞ্চগনি পুনে-মহাবালেশ্বর পথে পড়ে। সারাবছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তাই ভারতে চেরাপুঞ্জির পরেই এর স্থান। ১৮৫০ সালে ইংরেজরা প্রথম এখানে এসে বসবাস শুরু করে। মনোরম জলবায়ুর জন্য এখানে তৈরি হয় টি বি (বেল-এয়ার) স্যানিটোরিয়াম।
শহরের ১ কিলোমিটার দূরে পার্শি পয়েন্ট। পাশেই নজরমিনার। ওখান থেকে দেখা যায় নীচ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা কৃষ্ণানদী। পাশেই স্ট্রবেরি খেত। দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের মাথাটা সমতল উপত্যকার মতো - প্রাকৃতিকভাবে তৈরি টেবিল ল্যান্ড ভিউপয়েন্ট। এখান থেকে নীচে ছড়িয়ে থাকা শৈলশহরের সৌন্দর্য অপরূপ। পাশেই রাজপুরী গুহা। বর্ষার পরে পঞ্চগনি পাহাড় থেকে নেমে আসা লিঙ্গমালা ঝরনার সৌন্দর্য অপরূপ। এছাড়া আছে বেবি পয়েন্ট, ইলো পয়েন্ট, নিডল হোল পয়েন্ট এবং গণপতি মন্দির। রাতের বেলায় পাহাড়ের ওপর থেকে আলোকমালায় সজ্জিত দূরের পুনে শহর বেশ লাগে। রংবেরঙের ফুলে যেমন সেজে ওঠে এই শহর, তেমনি প্রচুর ফল হয়। বিশেষ করে স্ট্রবেরি।
যাওয়াঃ পুনে রেলস্টেশনের পাশের বাসস্ট্যান্ড থেকে মহারাষ্ট্র্র নিগমের বাসে অথবা প্রাইভেট বাসে পঞ্চগনি যাওয়া যায়। দূরত্ব ১০১ কিলোমিটার। এছাড়া প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়। এখান থেকে মহাবালেশ্বর ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জুন থেকে আগস্ট এই তিনমাস অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের জন্য না যাওয়াই ভালো। অন্য সময় খুবই মনোরম। তবে শীতে ভালোরকম গরম পোশাক প্রয়োজন।
থাকাঃ থাকার জন্য প্রচুর হোটেল আছে। পঞ্চগনির এস টি ডি কোডঃ ০২১৬৮।
মহাবালেশ্বর (Mahabaleswar) - মহারাষ্ট্রের উচ্চতম ও সেরা শৈলশহর। উচ্চতা প্রায় ৪,৫০০ ফুট। বেড়ানোর ভাল সময় এপ্রিল-মে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। সিজন ছাড়া অন্য সময় এখানে ঘরভাড়া ও খাবারের দাম তুলনায় কম থাকে।
পুনে থেকে মহাবালেশ্বর যাওয়ার পথ খুব সুন্দর। পথে বেশ কয়েকটি টানেল পড়ে।
দেখার সুবিধার জন্য মহাবলেশ্বরকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) প্রতাপগড় দর্শন (২) মহাবলেশ্বর দর্শন (৩) পঞ্চগনি দর্শণ (৪) পঞ্চগনি এবং ওয়াই দর্শন।
প্রথম দর্শনীয় মহাবালেশ্বর মন্দির। মন্দিরের নামেই শহরের নাম। পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো ভূগর্ভস্থ শিবলিঙ্গ। বিশাল আকারের শিলাখন্ডের ওপরে একেকদিকে পার্বতী, গণেশ, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুমূর্তি পাথরে খোদাই করা। পাণ্ডবগুরু দ্রোণাচার্য স্বপ্নাদেশে এই শিবলিঙ্গের কথা জানতে পারেন, পরে পাণ্ডবেরা ওই মন্দির তৈরি করলে দ্রোণাচার্য নিজেই প্রতিদিন পুজো করতেন। পাশেই অতিবলেশ্বর মন্দির। অতিবল ও মহাবল দুই দৈত্যভাই। এদের অত্যাচার আশপাশের দেবতা-মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। এই নিয়ে নানান গল্পকথা আছে। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু এলেন এদের বধ করতে। সহজেই পরাজিত হলেন অতিবল। কিন্তু মহাবলের বীরত্বের কাছে বিষ্ণু যখন পরাজিত তখন মহাবল নিজেই আত্মসমর্পণ করে বললেন বিষ্ণুকে নিজহাতে বধ করতে হবে (মতান্তরে মহাদেব)। এই ইচ্ছাকে স্মরণীয় করে রাখতেই মহাবলেশ্বর নাম। পাশেই মহারাজার মঠ। এরপর পঞ্চগঙ্গা মন্দির। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে যাদবরাজ সিংহাসন এই মন্দির তৈরি করেন। বারেবারে নানা মহারাজার হাতে এমনকী ছত্রপতি শিবাজির হাতেও সংস্কার হয় এই মন্দিরের। কৃষ্ণা, বৈষ্ণা, কোয়না, সাবিত্রী এবং গায়ত্রী এই পাঁচনদীর জল আসছে গোমুখ দিয়ে। পবিত্র এই জলে স্নানে পুন্য হয়। মহাশিবরাত্রির মেলায় বহু তীর্থযাত্রী সমাগম হয়।
আধঘন্টার মত সময় লাগে বিভিন্ন সানসেট পয়েন্টগুলি ঘুরে দেখতে। প্রথমেই আর্থাস মিট পয়েন্ট। আর্থার থেকে কোঙ্কণ উপত্যকার দৃশ্য অপূর্ব। বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী আর্থারসাহেব এখানে বসে ছবি আঁকতেন। তাঁর নামেই এই জায়গার নাম। তাছাড়া এখানকার আরেকটি মজা হল দুপুর ২টো-৩টের পর এখান থেকে পাহাড়ের নীচে কোন হাল্কা কিছু যেমন-বোতলের ঢাকা, খুচরো ৫-১০ পয়সা ছুঁড়ে ফেলা যায় তবে সেই পয়সা বা ছিপি নীচে না গিয়ে ৪০০-৫০০ ফুট উপরে উঠে ভাসতে ভাসতে ২০০-২৫০ মিটার পিছনে গিয়ে ছিটকে পড়ে। ওখান থেকে হলদেরঙের বড়ো বড়ো ঘাসে ভরা একটি পাহাড় দেখা যায়। রোদের আলো পড়লে সেটি যেন সোনার রঙে জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই পাহাড়টি ম্যাকেনাস গোল্ড রক নামে পরিচিত। ইকো পয়েন্টে এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে কোনও কথা বললে তা বিভিন্ন পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ম্যালকাম পয়েন্ট থেকে কায়না ভ্যালির অপরূপ সৌন্দর্য এবং নীচ দিয়ে বয়ে চলা সাবিত্রী নদী মুগ্ধ করে পর্যটকদের। টাইগার স্প্রিং পয়েন্টে বাঘেরা আজও মিষ্টিজল খেতে আসে। পাশেই হান্টিং পয়েন্ট। এই টাইগার স্প্রিং পয়েন্টের ওপর থেকে আগে রাজা-মহারাজারা বাঘশিকার করতেন। একটু এগোলেই উইন্ডো পয়েন্ট। চারদিক থেকে প্রচণ্ড জোরে হাওয়া বয়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টকর তবে অসাধারণ প্রাকৃতিক রূপ মুগ্ধ করে। প্রতিটি পয়েন্টই ওই ম্যাকেনাস গোল্ড রক-কে বেষ্টন করে। আরও ২ কিলোমিটার ওপরে মহাবালেশ্বরের উচ্চতম (১,৪৬০ মিটার) উইলসন পয়েন্ট। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। এখান থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য সারাজীবন মনে থাকবে। একটু দূরে মাঙ্কিস পয়েন্ট। তিনটি তিনটি পাথরের খণ্ড বাঁদররূপে চোখ, কান ও মুখে হাত দিয়ে পাশপাশি বসে আছে অল্পদূরে পাহাড়ের মাথায়। এদের দেখে মহাত্মা গান্ধির বিশিষ্ট উক্তি মনে পড়ে যায়, ‘বুরা না বোলো, বুরা না দেখো এবং বুরা না শুনো’। এছাড়া ক্যাসল রক, সাবিত্রী পয়েন্ট, মারজোরি পয়েন্ট, আল্পসটন পয়েন্টগুলি রয়েছে। ১,২৯৪ মিটার উঁচু বম্বে পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অসাধারণ। ১,২৩৯ মিটার উঁচুতে লোডউইক পয়েন্টে রয়েছে ব্রিটিশ জেনারেল লোডউইকের স্মৃতিতে তৈরি মনুমেন্ট। এলফিনস্টোন পয়েন্ট থেকে দেখা যায় কোঙ্কণ উপত্যকার সুন্দর দৃশ্যাবলী। আরও কিছুটা গেলে দেখা যাবে কায়না ভ্যালির দৃশ্য ও চিনাম্যান ফলসের জন্য বিবিংটন পয়েন্ট। হাতির মাথার মতো পাহাড়ের জন্য কেটিস পয়েন্ট। এখান থেকে কৃষ্ণা ভ্যালির অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
১৬৫৬ সালে ছত্রপতি শিবাজি মহাবলেশ্বর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে জাভালির যুদ্ধে মোর রাজাকে পরাজিত করে এলাকা দখল করার পর ভোরপা পাহাড়ের মাথায় প্রতাপগড় দুর্গ তৈরি করেন। দুর্গের নকশা ও পরিকল্পনা শিবাজির নিজের। ৪৫০টি সিঁড়ি বেয়ে ১৩০ মিটার উঁচুতে দুর্গের অবস্থান। মাঝপথে শিবাজির আরাধ্য দেবী ভবানীর মন্দির এবং দুর্গের শিরে রয়েছে শিবমন্দির। যুদ্ধে যাত্রা করার আগে শিবাজি শিবমন্দিরে পুজো দিয়ে ভবানীমাতার আশীর্বাদ নিয়ে যাত্রা করতেন। আবার যুদ্ধজয়ের পর দুর্গে ফিরে ভবানীমাতার চরণ স্পর্শ করে আশীর্বাদ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে দেখা করতেন।
স্থানটির আরেক ঐতিহাসিক মাহাত্ম্য হল এখানেই বিশ্বাসঘাতক আফজল খাঁকে হত্যা করেন শিবাজি ও তাঁর সঙ্গীরা। মৃত্যুর পর শিবাজি তাঁকে পূর্ণমর্যাদায় সমাধিস্থ করেন। ওই স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার নাম রাখেন টম্ব অফ আফজল খাঁ। ঠিক প্রতাপগড় দুর্গের পাদদেশে তৈরি।
সহ্যাদ্রি পর্বতমালার পাস এবং আমবেনালি পাসের মাঝে এই ভোরপা পাহাড়। এই দুর্গের চারদিক দুর্গম জলবেষ্টিত। দুর্গের প্রাচীর গুলি সুরঙ্গের আকারে তৈরি করেছিলেন যাতে উপর থেকে চারদিকে লক্ষ রাখা যায়। মাঝে মাঝে গুপ্ত দরজা রয়েছে প্রহরীদের পাহারার জন্য।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে সামনেই প্রধান ফটক। ফটক পার হলেই ডানদিকে একটি গুপ্তকক্ষ। এখানে সৈন্যরা লুকিয়ে লক্ষ রাখতেন। শত্রুসৈনরা উপরে উঠে এলে প্রথমেই এদের হাতে বাধাপ্রাপ্ত হত। আরেকটু এগোলেই ফ্ল্যাগ বেসিন। এখানেই প্রতিদিন সৈন্যদের কুচকাওয়াজ হত, সেইসময় সকাল-বিকেল প্রতিদিন দুর্গের পতাকা উত্তোলন হত এই ফ্ল্যাগ বেসিনে। এখনও পতাকা উত্তোলিত হয় সে নিয়ম মেনে।
এরপর আরও একটু উপরে উঠলেই পুরোনো দরজা। এটাই দুর্গে প্রবেশের প্রধান দরজা। বাঁদিকের পথ গিয়েছে ভবানীমন্দিরে। অষ্টাহাতদেবী ভবানীমাতা মহিষাসুরবধিনী মূর্তিটি পাথরের তৈরি। নেপালে তৈরি এই মায়ের মূর্তি এখানে এনে প্রতিষ্ঠা করেন শিবাজি। পাশেই হস্তশিল্পের প্রদর্শনকক্ষ। এখান থেকে স্থানীয় মানুষের তৈরি অসাধারণ হস্তশিল্প সংগ্রহ করা যেতে পারে।
আরও উপরে সদর (রাজদরবার)। যেখানে বসে শিবাজি মহারাজ মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং যে কোন সিদ্ধান্ত ও বিচার পরিচালনা করতেন।
পাশেই কেদারেশ্বর শিবমন্দির। শিবাজি মহারাজকে স্মরণ করে মহারাষ্ট্র সরকার মন্দিরের সামনে ঘোড়ার পিঠে যুদ্ধরত সাজে তাঁর বিশাল ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করেন। এখান থেকে পশ্চিমদিকে এগিয়ে গেলে দুর্গের প্রাচীরঘেরা পানিশমেন্ট পয়েন্ট। সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের উপর থেকে ২,০০০ ফুট নিচুতে কোঙ্কণ উপত্যকায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত।
যাওয়াঃ মুম্বই কিংবা পুণে থেকে সড়কপথে মুম্বাই-ব্যাঙ্গালোর হাইওয়ে হয়ে সাতারা রোড ধরে যাওয়া যায়। মুম্বই থেকে দূরত্ব ৩২০ কিমি। নিকটতম পুনে রেলওয়ে স্টেশনের পাশেই বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে মহাবালেশ্বরগামী স্টেট বাস ছাড়ে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায়। দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। ভাড়াগাড়িও পাওয়া যায়। পুণে থেকে যেতে সময় লাগে চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টা। সিজনে ২৪ ঘন্টাই বাস চলে। ওই সময় খুব ভিড় হয়। এছাড়া কন্ডাক্টেড ট্যুরের ব্যবস্থাও আছে মুম্বই শহর থেকে।
থাকাঃ মহাবালেশ্বরে মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের হোটেল হলিডে রিসর্ট। এছাড়া প্রচুর বেসরকারি হোটেল আছে। প্রতাপগড় দুর্গের পাশেই পি ডব্লু ডি-র রেস্টহাউস। মহাবালেশ্বরের এস টি ডি কোডঃ ০২১৬৮।
ভ্রমণ কাহিনি - মেঘমুলুক ~ || ~ মহাবালেশ্বরের ছবি - নিমার্ল্য চক্রবর্তী ~
ঔরঙ্গাবাদ(Aurangabad)-ইতিহাসের গন্ধমাখা শহর। আবিসিনিয়ার এক ক্রীতদাস মালিক অম্বর ভারতবর্ষে এসে তাঁর ভাগ্য ফিরিয়ে ক্রমে আমেদনগরের রাজার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন। তিনিই খাড়কে নামে একটি শহরের পত্তন করেন, ঔরঙ্গজেবের আমলে যার নাম বদলে হয় ঔরঙ্গাবাদ। অজন্তা-ইলোরার এন্ট্রিপয়েন্টই শুধু নয়, দৌলতাবাদ দূর্গ (Daulatabad Fort), বিবি-কা-মকবারা (Bibi-ka-Makbara), পানিচাক্কি -অতীতের আনাচে কানাচে অন্য এক সফরঠিকানাও। ১১৮৭ সালে পাহাড়ের গায়ে দৌলতাবাদ দূর্গটি তৈরি করেন যাদবরাজ ডালোমা। ১৬৩৬ সালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দখলে আসে ঔরঙ্গাবাদ। পত্নী রাবেয়া বেগমের স্মৃতিতে তাজমহলের আদলে গড়ে তোলেন বিবি-কা-মকবারা।
যাওয়াঃ-নিকটতম রেলস্টেশন ঔরঙ্গাবাদ।
থাকাঃ- ঔরঙ্গাবাদ স্টেশন রোডে এম টি ডি সি-র হলিডে রিসর্ট। ঔরঙ্গাবাদ সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের বাইরে সারি দিয়ে হোটেল।
অজন্তা(Ajanta)- সময়টা ১৮১৯ সাল। বাঘের পিছনে ধাওয়া করে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ে আকস্মিকই অজন্তার গুহারাজির সন্ধান পান মাদ্রাজ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জন স্মিথ। বাগোরা নদীর উপর সারি দিয়ে ঝুলে থাকা ৩০টা গুহা। ভারতীয় ম্যুরাল পেন্টিংএর অনবদ্য নিদর্শন এই গুহাগুলি প্রায় ৯০০ বছর ধরে পাহাড় কেটে ৬০০ গজ জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছিল। বাকাতক মন্ত্রী বরাহদেব সংক্রান্ত খোদাই, কিংবা চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর মুছে আসা ছবিতে গুহার বয়সের আন্দাজ পাওয়া যায়। হিউয়েন সাং-এর লেখায় সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই গুহাগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়।
নির্মাণশৈলী অনুযায়ী অজন্তার গুহাগুলিকে চৈত্য ও বিহার এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। অজন্তার ৩০টা গুহার মধ্যে ৯, ১০, ১৯, ২৬, ২৯-এই ৫টি গুহা চৈত্য ও অবশিষ্ট ২৫টি বিহার। চৈত্যগৃহের ঠিক মাঝখানে রাখা চৈত্য বা স্তুপ-বুদ্ধের আদিমতম প্রতীক। গুহাগুলিতে ছবি আঁকা হয়েছে দুই পর্যায়ে। খ্রিঃপূঃ প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে সাতবাহনদের রাজত্বকালে ছবি আঁকা হয় ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৫ নম্বর গুহায়। সাতবাহন রাজারা ধর্মে হিন্দু হলেও বৌদ্ধদের ছবির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি গুহাগুলোয় ছবি আঁকা হয়েছে চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত, বাকাতক ও চালুক্য রাজাদের আমলে। অজন্তার প্রথম ছবি পাওয়া যাবে ৯ এবং ১০ নম্বর গুহায়, শেষ ছবি আছে ১ নম্বর গুহায়। ৬৪২ সালে পল্লবদের হাতে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী নিহত হওয়ার সাথে সাথেই অজন্তার ছবির দিন শেষ হয়।
অজন্তার ছবির স্টাইল ন্যারেটিভ। ছবির মাধ্যমে শিল্পী আমাদের গল্প শুনিয়েছেন। গল্পগুলো বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বের জীবনের বা জাতকের গল্প। জাতকের গল্প বুদ্ধের অনেক অনেক পূর্বজন্মে ঘটে থাকা ঘটনাবলী। একটা গোটা দেওয়ালকে অনেকগুলো প্যানেলে ভাগ করে একেকটা প্যানেলে একেকটা গল্পের ছবি আঁকা হয়েছে। প্রত্যেকটা প্যানেলই ছবির দিক থেকে সম্পূর্ণ। সংলগ্ন দুটো প্যানেলের মাঝখানে বিভাজনরেখারূপে রয়েছে থাম বা গাছের ছবি, যা দুটো প্যানেলের ছবিরই অংশ।
মোট ৫৪৭টা গল্প নিয়ে জাতক কাহিনি যার কোথাও বুদ্ধ শ্বেতহস্তী, কোথাও বণিক, যোদ্ধা, রাজা কিংবা প্রেমিক। বিষয়ের খাতিরে শিল্পীকে এঁকে ফেলতে হয়েছে গ্রাম, শহর, মন্দির, রাজপ্রাসাদ, বিচারসভা ,সমাজের সমস্ত স্তরের নারী-পুরুষ আরও কত কী। যাবতীয় খুঁটিনাটি মাথায় রেখেই আঁকা হয়েছে প্রত্যেকটি ছবি। শুধু মনুষ্যজীবন আর তার পারিপার্শ্বিকই নয় গল্পের খাতিরে চিত্রপটে হাজির হয়েছে যক্ষ, কিন্নর, গন্ধর্ব, অপ্সরা-সকলেই। ছাদের অলঙ্করণেও রয়েছে অগুন্তি মোটিফ- পাখি, ঘোড়া, সিংহ, আরও কতজনই ।
১ নম্বর গুহা- এটি অজন্তার একেবারে শেষ পর্যায়ের বিহার। সম্ভবত ৪৭৫-৫০০ সালের মধ্যে এর জন্ম। পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কিছু ছবি আঁকা হয়েছে অজন্তার এই ১ নম্বর গুহায়। থামেঘেরা বারান্দা, হলের ভিতরে গলিপথ, পথের দুপাশে অনেকগুলি কুঠুরি আর অ্যান্টিচেম্বার। বারান্দার মাঝের থাম দুটোর নীচের দিক থেকে প্রথমে আট-কোনা, তার ওপর ষোলো-কোনা, তারও ওপর খাঁজকাটা। উপরের মাঝের অংশে খোদিত রয়েছে বামন, বাইরের দিকের ছড়ানো অংশে মালা হাতে উড়ন্ত দম্পতি। মূল দরজার চৌকাঠের উপরে লিন্টেল অংশে পাঁচ জোড়া নারীপুরুষ পাঁচ রকম বাজনা নিয়ে ব্যস্ত। হলের পিলারগুলোর মধ্যে একেবারে পিছনের সারির মাঝের দুটোয় বুদ্ধজীবনের নানা ঘটনা আঁকা। ডানদিকেরটার মাঝখানে এক মাথায় চারটে হরিণের বিখ্যাত মোটিফ। ভিতরের ঘরে ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধের দুপাশে চামর হাতে দুই বোধিসত্ত্ব। বুদ্ধের মাথার পিছনের জ্যোতির উপরের কোণে মালা হাতে দুই উড়ন্ত মানুষ। আসনের সামনে দুই হরিণের মাঝখানে একটা চক্র, বাঁদিকের হরিণের পাশে পাঁচ শিষ্য। নিঃসন্দেহে এটি সারনাথে বুদ্ধের প্রথম ধর্মপোদেশ দানের চিত্র। ভিতরের ঘরের ঠিক বাঁ ও ডানদিকের দেওয়ালে, অজন্তার সর্বাধিক পরিচিত দুই বিশাল বোধিসত্ত্বের ছবি। বাঁদিকে পদ্মপাণি, পাশে তাঁর সঙ্গিনী। পৃথিবীর ছবির ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক নারীমূর্তি। বাঁদিকের কোণে স্বর্গের বাজনদাররা আর উড়ন্ত দেবদূত। এদের ঠিক নীচেই পাহাড়ি নিসর্গে এক দম্পতি। হলের ভিতরের দেওয়ালে, মূল দরজার বাঁদিক থেকে, পরপর আঁকা রয়েছে শিবিজাতক, নন্দের সংসারত্যাগ, শঙ্খপাল এবং মহাজনক জাতক। ডানদিকের দেওয়ালে বোধিসত্ত্বের পাশে আঁকা চম্পেয় জাতক।
মূল দরজার ঠিক ডানদিকেই চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর বিখ্যাত ছবিটা। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী পারস্যরাজ খসরু পারভেজের প্রতিনিধিদের রাজসভায় স্বাগত জানাচ্ছেন। ঘটনাটা ঘটেছিল ৬২৬ থেকে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনও এক সময়ে। সম্ভবত এটাই অজন্তার শেষ আঁকা ছবি।
হলের বাঁদিকের সারির একটি থামের গায়ে রয়েছে ষাঁড়ের লড়াইয়ের একটা অসাধারণ ছবি। স্তব্ধ ফ্রেমে গতির বিভ্রম কীভাবে আনতে হয়, শিল্পী এখানে তা দেখিয়েছেন।
২ নম্বর গুহা-অজন্তার সবচেয়ে অক্ষত অবস্থায় থাকা ছবিগুলো এখানেই আছে। বারান্দার দুপাশে দুটো পর্চ, ডানদিকের মাঝখানে আছেন নাগরাজ, দুই পাশে দুই যক্ষ। বাঁদিকে মাঝখানে শিশু কোলে হারীতি। ভিতরের ঘরের ডানদিকের ছোটো ঘরটায় রয়েছেন পঞ্চিকা এবং তার সঙ্গিনী হারীতি, তাঁদের মাঝখানে বাঁহাতে পায়রা ও ডানহাতে ফুল নিয়ে এক নারী, তাদের দুপাশে আরও দুই নারী, হাতে চামর। ফুল, ফল, পাখির মোটিফ, অপ্সরা, জ্যামিতিক নকশা-অজস্র কিছু রয়েছে সিলিং-এ। গর্ভগৃহের ভিতরের সিলিং জুড়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় উড়ন্ত ২৩টা হাঁস- অজন্তার সেরা একটি ছবি।
ভেতরের ঘর ও গর্ভগৃহের পাশের দেওয়াল, হল-এর বাঁদিকের দেওয়ালের কিছুটা এবং পিছনের দেওয়ালের বাঁদিক জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বুদ্ধের নানাছবি। বাঁদিকের দেওয়ালে তিন নম্বর ঘরের দরজা পর্যন্ত আঁকা রয়েছে মায়াদেবীর স্বপ্নদর্শন। হলের একেবারে বাঁদিকের দেওয়ালে আঁকা হংসজাতক। ডানদিকের দেওয়াল জুড়ে বিধুরপন্ডিত জাতক। এই গল্পে নাগরাজকন্যা ইরান্দুতির দোলনায় বসা ছবিটা অসাধারণ। পরের বাঁপাশের ছবি মৃগজাতক। ডানদিকের প্রথম কুঠুরির মাথায় আঁকা ক্রুদ্ধ রাজার সামনে ক্ষমা প্রার্থনারত নারী।
৪ নম্বর গুহা-অজন্তার বৃহত্তম বিহার। মূল দরজার বাইরের দিকে খোদাই করা হয়েছে পাঁচ মহিলা দ্বারপাল, এবং দেবদূত। চৌকাঠে পদ্মাসীন অনেক বুদ্ধমূর্তি, সঙ্গে মালা হাতে বামন ও গণ। দরজার উপরের পাড়ে পাঁচটা চৈত্যজানালার মোটিফ, তার তিনটের মধ্যে বুদ্ধমূর্তি। দরজার উপরের কোণে কয়েকজন সিংহ-সওয়ারি। দরজার ডানদিকে চৌকো প্যানেলের মাঝখানে বোধিসত্ত্ব, তার জাতমুকুটে ধরে আছেন ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রায় বুদ্ধকে। বোধিসত্ত্বকে ঘিরে উদ্ধারপ্রার্থী ভক্তের দল, তারা মুক্তি চায় আট রকম ভীতির হাত থেকে-সিংহ, হাতি, আগুন, সাপ, তস্কর, জল, শিকল এবং দানব। দরজায় অন্য অংশে রয়েছে আবার ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি। হলের ভিতরের ঘরের দেওয়ালে বিশাল ছয় বুদ্ধমূর্তি। এর মধ্যে দুটি অসমাপ্ত। বুদ্ধের ডান হাতে অভয়মুদ্রা, বাঁ হাতে ধরা পোশাকের কোণ।
৬ নম্বর গুহা-এটি দ্বিতল বিহার, বাইরের দিকে অনেকটা ভেঙে গেছে। গর্ভগৃহের ভিতরে পিছনের দেওয়ালে খোদিত ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রায় বুদ্ধ। দুটো ছোটো ঘরের মধ্যে ডানদিকের চৌকাঠে বেশকিছু বুদ্ধের শরীর রয়েছে। গর্ভগৃহের বাঁদিকে দেওয়ালে চুনের প্রলেপ দেওয়া ছোট্ট এক বুদ্ধমূর্তি। দেখে মনে হয় যেন মূর্তিটা মার্বেলের। এর পায়ের কাছে পদ্মের কুঁড়ি হাতে ভিক্ষু।
৯ নম্বর গুহা-সম্ভবত খ্রিঃপূঃ প্রথম শতকে তৈরি হীনযান প্রভাবপুষ্ট এই গুহা। অজন্তার প্রাচীন গুহাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। বুদ্ধের মূর্তিগুলো পরে তৈরি। স্তূপটা অন্যরকম। হলের মাঝামাঝি চোঙাকৃতি বেসের ওপর স্তূপ, মাথায় রেলিং ঘেরা হর্মিকা, উল্টানো খাঁজকাটা পিরামিডের মতো। হর্মিকার গায়ে বাঁট গোঁজার ফুটো থেকে বোঝা যায় এর উপর কাঠের ছাতা বসানো থাকত। সে সময়ে সাধারণ রীতি ছিল পুরোনো ছবি সম্পূর্ণ মুছে না ফেলেই তার উপরে আবার ছবি আঁকা। এখানে তা বারবার ঘটেছে। এতে অজন্তার দুই পর্যায়ের ছবির পার্থক্য বোঝা সহজ হয়।
১০ নম্বর গুহা- অজন্তার প্রাচীনতম গুহা। ছাদের পাথর কেটে কড়িকাঠের আকার দেওয়া হয়েছে। বাঁদিকের দেওয়ালে তৃতীয় থামের পিছনের ছবির বিষয়বস্তু-সৈন্য, নর্তকী, বাজনদার ও রানিদের সঙ্গে নিয়ে কোনও রাজার বোধিবৃক্ষ দর্শন। ছবিতে উল্লেখ করা লিপি থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটা আঁকা হয়েছে খ্রিঃপূঃ দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি। ছবিটা আঁকা হয়েছে একটাই লম্বা সরু প্যানেলে যা অজন্তার প্রথম পর্যায়ের ছবির বৈশিষ্ট্য।
ডানদিকে ১১ থেকে ১৫ নম্বর থামের পিছনের দেওয়ালে আঁকা হয়েছে সমজাতক, তারপর ছদ্দন্ত জাতক। দ্বিতীয় ছবির শেষ ফ্রেমে একদল দাসী পরিবৃত হয়ে রাজা ও রানি এক চৈত্যমন্দিরে আসছেন।
১৬ নম্বর গুহা-এরই সিঁড়ির দুপাশের দেওয়ালে হিউয়েন সাং এর লেখায় উল্লেখ্য দুই হাতির রিলিফ। বারান্দার বাইরের দেওয়ালের বাঁদিকে বাকাটরাজ হরিসেনের মন্ত্রী বরাহদেব সংক্রান্ত লিপি, যা থেকে গুহা তৈরির সময়কাল জানা যায়। ভিতরের বাঁদিকের দেওয়ালে নন্দের গৃহত্যাগ সংক্রান্ত ঘটনায় আঁকা হয়েছে দু’দুটো বিশ্ববিখ্যাত ছবি-কপিলাবাস্তুতে নন্দের প্রাসাদে বুদ্ধ ভিক্ষা চাইতে এলেন। সংলগ্ন ছবিতে দেখা যাচ্ছে নন্দ স্ত্রী সুন্দরীকে স্নানপর্বে সাহায্য করছেন। এটিই বিখ্যাত ‘টয়লেট সিন’। নন্দ ভিক্ষা দিতে এলে বুদ্ধ তাঁর হাতে ভিক্ষাপাত্র ধরান ও তাঁকে সংঘে নিয়ে যান। এর পরের ছবিতে এক দাসের হাতে নন্দের পরিত্যক্ত রাজমুকুট, সামনে শোকস্তব্ধ সুন্দরী। পরের প্যানেলের দু সারি বুদ্ধের ছবি পেরিয়ে সিংহাসনারূঢ় ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রায় বুদ্ধ। মাথার ওপর এক উড়ন্ত নারী- আধবোজা চোখ, শরীর গতিময়, দেহভঙ্গি চঞ্চল। ডানদিকের দেওয়ালে পর পর আঁকা সুজাতার পায়েস নিবেদন, তপসা আর বল্লিকার অর্ঘ্য, শহরের রাস্তায় ভিক্ষাপাত্র হাতে বুদ্ধ, হলকর্ষণের আগে বুদ্ধের ধ্যান, মায়াদেবীর স্বপ্নদর্শন। হলের সামনের দেওয়ালে বাঁদিক থেকে পর্যায়ক্রমে আঁকা রয়েছে হস্তী জাতক এবং মহাউমাগা জাতক। দ্বিতীয় ছবিতেই একটা ফ্রেমে মহাসোধার রথের প্রকৃত মালিক নির্ধারণের ছবি।
১৭ নম্বর গুহা- ছবির দিক থেকে হয়তো অজন্তার শ্রেষ্ঠ গুহা। দরজার ওপরের প্যানেলে আঁকা রয়েছে ছয় মানুষী বুদ্ধ, সঙ্গে ভবিষ্যতের বুদ্ধ, অর্থাৎ মৈত্রেয়। বারান্দার বাঁদিকের দেওয়ালে সভাসদদের নিয়ে মেঘে ভাসমান ইন্দ্র। বারান্দার বাঁয়ের দেওয়ালে বিখ্যাত ‘হুইল অফ লাইফ’–সবুজ রঙের হাত, তাতে চক্র। ডানদিকের দেওয়ালে উড়ন্ত অপ্সরা, তার দৃষ্টি নত, মাথায় রত্নখচিত মুকুট। বারান্দা থেকে শুরু করে দরজার বাঁপাশ আর হলের পুরো বাঁদিকের দেওয়াল জুড়ে আঁকা রয়েছে বসন্ততারা জাতক। এরপর ছদ্দন্ত জাতক, হংস জাতক। গুহার পিছনের দেওয়ালে আঁকা মহাসুতোসম জাতক। গর্ভগৃহের ডানদিকের দেওয়ালে আঁকা মহিষজাতক। হলের ডানদিকের দেওয়ালে আঁকা সিমহালার অবদান গল্পটা অজন্তার দীর্ঘতম কম্পোজিশন। গর্ভগৃহের ভিতরের দেওয়ালে আঁকা পিতৃপরিচয়ের স্বীকৃতি পেতে মা রাহুলকে পাঠালেন বাবার কাছে, নতমুখ বুদ্ধ শিশুপুত্রকে এগিয়ে দিলেন ভিক্ষাপাত্র।
২৬ নম্বর গুহা- এখানে ছবির থেকে ভাস্কর্য বেশি। মূল স্তূপটি একেবারে ছোট। নীচের পাটাতনটা বেশ লম্বা, সেখানে সামিয়ানার নীচে প্রলম্বপদ আসনে খোদিত বুদ্ধ। হর্মিকার উপর থেকে বাকি অংশ ভেঙে গেছে। থাম থেকে দেওয়াল সর্ব্ত্র অজস্র বুদ্ধমূর্তি। বারান্দার পিছনের দেওয়ালের লিপি থেকে জানা যায়, বুদ্ধভদ্র নামে এক ভিক্ষু মন্দির তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। হলের বাঁদিকের দেওয়ালের ভিতরের দিকে রয়েছে মারের আক্রমণ সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনার পাথর খোদাই। আর বাঁদিকের ছোটো দরজাটার পাশের দেওয়ালে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ।
ইলোরা (Ellora)-ইলোরায় গুহার সংখ্যা অজন্তার চেয়েও বেশি, মোট ৩৪টি। এর মধ্যে ১ থেকে ১২ বৌদ্ধ, ১৩ থেকে ২৯ ব্রাহ্মণ্য, ৩০ থেকে ৩৪ জৈন গুহামন্দির।
ইলোরার বৌদ্ধ গুহাগুলি তৈরি হয় ৫ম থেকে ৭ম শতাব্দীতে মহিষমোতির কালুচরী ও বাদামীর চালুক্যদের সময়ে। ৭৫০-৯৭৫ খ্রিঃ রাষ্ট্রকূট রাজবংশের সময় হয় হিন্দু গুহাগুলি। এগারো-বারো শতাব্দী নাগাদ জৈন মন্দিরগুলো গড়েন কল্যাণীর চালুক্য ও দেবগিরির (বর্তমান দৌলতাবাদ) যাদবরা। ইলোরা অজন্তার মতো কখনোই হারিয়ে যায়নি। কৈলাস মন্দিরের উপস্থিতি আজন্ম বাঁচিয়ে রেখেছে ইলোরাকে। হিউয়েন সাং ছাড়া আর কারোর লেখায় যেখানে অজন্তার উল্লেখ নেই, সেখানে ইলোরা নিয়ে লিখেছেন আরব ভূগোলবিদ আল মাসুদি, ঐতিহাসিক ফিরিস্তা, নিকোলাই মানুচ্চি, চার্লস মালে।
ইলোরার বৌদ্ধ গুহা (১ থেকে ১২)- বারোটি গুহায় বুদ্ধমূর্তির সংখ্যা মোট ১৭৯। এর মধ্যে ১৩টিতে বুদ্ধ পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে, ৫২টিতে প্রলম্বপদ আসনে ও ১১২টায় পদ্মাসনে আসীন। মূর্তিগুলিতে ধর্মচক্রপ্রবর্তন, ভূমিস্পর্শ এবং ধ্যান-তিনটি মুদ্রাই ঘুরিয়েফিরিয়ে রয়েছে।
অজন্তার দ্বিতীয় পর্যায়ের বিহার ও চৈত্যমন্দিরের গড়নের সাথে ইলোরার গড়ন একদম এক। ১ ও ৫ নম্বর গুহাই সবচেয়ে পুরোনো। ১ নম্বর গুহাটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ২ নম্বর গুহার বাইরের দরজার দুপাশে কুবের আর হারীতি। আর হলের দরজায় দুপাশে অবলোকিতেশ্বর এবং বজ্রপাণি। চারটি মূর্তিই বিশাল। গর্ভগৃহে সিংহের ওপরে সিংহাসনে ধর্মচক্রমুদ্রায় বুদ্ধ। ভিতরের ঘরের চার দেওয়ালে চারটে দরজার পিছনে চারটে ছোট ঘর। প্রত্যেকটিতেই বুদ্ধমূর্তি। হলের পিলারগুলো নীচ থেকে প্রথমে বর্গাকার, তারপর আটকোনা, সবার ওপরে খাঁজকাটা। সম্ভবত ২ নম্বর গুহাটি ছিল চৈত্যমন্দির। বড় হলঘরের শেষ মাথায় প্রকান্ড এক বুদ্ধমূর্তি। ৫ নম্বর গুহার গঠন কিছুটা আলাদা। এই গুহায় দুই সারিতে মোট ২৪টা থাম আছে। দুটো থামের মাঝখানে একটা করে ছোটো কুঠুরি, সবমিলিয়ে ২০টা। ঘরের পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর লম্বা দুটো পাথরের বেঞ্চ আছে। সম্ভবত এটি অতিথিশালা। ৬ নম্বর গুহার হলে কোনও থাম নেই। বাঁদিকের দেওয়ালে রয়েছেন বৌদ্ধদেবী তারা, ডানদিকের দেওয়ালে তান্ত্রিক দেবতা মহাময়ূরী। স্তুপে খোদিত বুদ্ধমূর্তির সঙ্গে আছেন একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রী সহচরদেবতা।
১০ নম্বর গুহা-বিশ্বকর্মা মন্দির নামে পরিচিত এই গুহাটি অনেকটাই অন্যরকম। স্থানীয় ছুতোরেরা এখানে নিয়মিত পুজো দিতে আসেন। মূল দরজার উপরের জানালাটি প্রায় সম্পূর্ণ গোল। খোদাই না করে স্তূপের পিছনে দিকের গড়নেও অদ্ভুত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বুদ্ধের দুই পা একসাথে মাটি ছুঁয়ে আছে। এটা একটা সম্পূর্ণ নতুন ভঙ্গি।
১২ নম্বর গুহা- অজন্তা-ইলোরার গুহাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় এই গুহাটি তিনতলা বৌদ্ধবিহার। প্রথম তলার কোনার মন্দিরে বুদ্ধ ও কিছু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। দোতলায় উঠেই একটা বিশাল হল। এর পিছনের দেওয়ালে মোট ১৩টি কুঠুরি। পুবদিকের মন্দিরে ভূমিস্পর্শমুদ্রায় বিশাল বুদ্ধ খোদিত রয়েছে। তিনতলায় মন্দিরে বুদ্ধের দুপাশে পদ্মমণি ও বজ্রপাণি। হলের পিছনের দেওয়ালে উত্তরদিকে সাত মানুষী বুদ্ধ এবং দক্ষিণে সাত দেব বুদ্ধ পাশাপাশি।
ইলোরার ব্রাহ্মণ্য গুহা (১৩ থেকে ২৯)- ১৪ নম্বর গুহা - রাবণের বাসস্থল নামে পরিচিত এই গুহাটিতে থামঘেরা বড় উঠোন পেরিয়ে মন্দিরের ভিতরে শিবলিঙ্গ। উঠোনের দুপাশের গলিপথের পিছনের দেওয়ালে নানারকম শৈব মোটিফ। শিবের হস্তিদানবকে নিধণ করার মূর্তিটি অসাধারণ।
১৫ নম্বর গুহা- এটিই বিখ্যাত দশাবতার গুহা। এখানেই প্রথম একটাই পাথর কেটে মন্দিরের রূপ দেবার চেষ্টা হয়। গুহার শুরুতে প্রকান্ড একটা চাতাল, তার মাঝখানে ছোট্ট মন্দির। মূল মন্দিরটি দোতলা। দেড়তলায় উঠে একটা খোলা জায়গা। দেওয়ালের গায়ে দেবদেবীর মূর্তি। আরও খানিকটা উঠে তিনদিক বন্ধ একটা প্রকান্ড হলঘর। সারিসারি কারুকার্য করা থামগুলো হলের ছাদটাকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর আর দক্ষিনের দেওয়ালে আশ্চর্য সব পৌরাণিক দৃশ্য খোদাই করা।
১৬ নম্বর গুহা (Kailash Cave) - বিরাট একটি পাহাড় কেটে বিখ্যাত কৈলাস মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম কৃষ্ণের আমলে, ৭৫৭ থেকে ৭৮৩ সাল নাগাদ। কৈলাস মন্দিরই প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মনোলিথিক ভাস্কর্য। তিনদিকে পাহাড়ের দেওয়ালের মাঝখানে কৈলাস মন্দির। মন্দিরের এক পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করে পিছন দিক দিয়ে ঘুরে আবার সামনে ফিরে আসা যায়। প্যাসেজটা মোটামুটি আট-দশ হাত চওড়া। মন্দিরের ডাইনে আর বাঁয়ে পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলো গুহার মতো ঘর রয়েছে, তারমধ্যেও অনেক মূর্তি আছে। তিনদিকে পাথর কেটে খাদ তৈরি করে এই ৩০০ফুট লম্বা, ১৫০ফুট চওড়া, আর ১০০ফুট উঁচু মন্দিরটি বার করা হয়। এরপর চুড়ো থেকে শুরু করে পাথর কাটতে কাটতে শিল্পীরা নীচের দিকে নামতে থাকেন। একটাই মাত্র পাথরে একই সাথে গড়ে তোলা হয়েছে চুড়োর সিংহ, ভিতের হাতি, প্রকাণ্ড হল, হলের সিলিং জুড়ে নটরাজ মূর্তি।
কৈলাস অর্থে শিবের বাসস্থান, এটি শিবমন্দির। হিন্দুমন্দিরের চিরাচরিত বিন্যাস অনুযায়ী মন্দিরটি পরপর পাঁচটা ভাগে বিন্যস্ত রয়েছে - গোপুর, অর্ধমণ্ডপ, মণ্ডপ বা নাটমন্দির, জগমোহন, গর্ভগৃহ ও শিখর বা বিমান। বিভিন্ন তলে অবস্থিত পাঁচটা ভাগের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে আছে সিঁড়ি বা করিডোর। লেভেলের তারতম্যে মন্দিরের দেওয়ালে তৈরি খালি অংশগুলি ভরিয়ে তোলা হয়েছে নানা ভাস্কর্যে। কৈলাসের গোপুরাটি দোতলা, দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর। বাইরের দিকের দেওয়ালে তিনটি মূর্তি-শিব, বিষ্ণু, আর অষ্টদিকপাল। ভিতরের দেওয়ালে মহিষাসুরমর্দিনী, বিষ্ণু ও কামদেব। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে প্রথমেই বিখ্যাত গজলক্ষ্মী মূর্তি। তার পিছনে উঠোনের দুপাশে দুটো বিশাল মনোলিথিক হাতি। হাতিদুটোর দুপাশে দুটো ধ্বজস্তম্ভ চৌদ্দ মিটার উঠে গেছে। একটু পিছনে একটা ছোট্ট মন্দিরে তিন দেবী-গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী।
উঠোনের দুদিক থেকে দুটো সিঁড়ি উঠে গেছে মণ্ডপ বা নাটমন্দিরে। নাটমন্দিরের পাটাতনটি ৮ মিটার উঁচু। এটাই মূল মন্দিরের প্রধানভাগের প্রথম অংশ। পুরো নীচটা জুড়েই সার দিয়ে হাতি, সিংহ এবং পৌরাণিক নানা জীবজন্তুর মূর্তি খোদাই করা আছে। মনে হয়, এরাই যেন গোটা মন্দিরটাকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেওয়ালের প্যানেল জুড়ে মহাভারত, রামায়ণ আর কৃষ্ণলীলা। মণ্ডপটা ভিতরের দিকে একটা থামঘেরা ঘর। সিলিং-এ দুই সময়ের ছবির মিশ্রন। প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্রকূটদের ও দ্বিতীয় পর্যায়ে হোলকারদের সময়কার আঁকা কিছু ছবি। মণ্ডপ-এর সিলিং-এ খোদিত নটরাজ। জগমোহন পেরিয়ে গর্ভগৃহ। দেবতা এক বিশাল মনোলিথিক লিঙ্গ। ওপরের সিলিং-এ এক বিরাট পদ্ম।
মণ্ডপের আগে অবস্থিত নন্দীমণ্ডপটিকে মন্দিরের প্রধান অংশের সাথে যুক্ত করেছে পাথরের একটি সেতু। এই সেতুর নীচের দেওয়ালে শিব ও কালভৈরবের মূর্তি। পাশের দেওয়ালে একাধিক শিব ও পার্বতী। এরই মধ্যে রাবণের কৈলাস পাহাড় নাড়ানোর মূর্তিটিও আছে।
২১ নম্বর গুহা- রামেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত এই গুহাটিও শিব মন্দির। সম্ভবত হিন্দু মন্দিরগুলির মধ্যে প্রথম। তা সত্ত্বেও বৌদ্ধ মন্দিরের গঠনশৈলীর প্রভাব প্রচুর।মূল মন্দিরের সামনে উঁচু পাটাতনে নন্দীমূর্তি রয়েছে। জগমোহন নেই, মণ্ডপের পরেই গর্ভগৃহ। মণ্ডপ ও তার দুপাশের দুই ঘরে বিশাল সব মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের গোপুরায় দ্বারপালের মূর্তি দুটি অসাধারণ।
২৯ নম্বর গুহা - চারকোণে চারটে ঘরের মাঝখানে গর্ভগৃহে লিঙ্গ স্থাপিত রয়েছে। চার দরজায় চার দ্বারপাল।
জৈন গুহা(৩০ থেকে ৩৪)- ৩০ নম্বর গুহা- কৈলাসের একটি অসমাপ্ত ক্ষুদ্র নকল।
৩২ নম্বর গুহা – গুহার শুরুতেই দক্ষিণী শৈলীর গোপুরা। তারপর উঠোনে ঢুকে মনোলিথিক মন্দির, এর বাঁদিকে একটা বিশাল হাতি, ডানদিকে প্রকান্ড থাম- মানসস্তম্ভ। সিঁড়ি দিয়ে উঠে মূল মন্দির। মাঝখানে আছেন সর্বতোভদ্র, চারকোনায় চার তীর্থঙ্কর। পশ্চিমের দরজা দিয়ে চলে যাওয়া যায় মহাবীরের আরেকটি মন্দিরে।
যাওয়াঃ- ঔরঙ্গাবাদ থেকে অজন্তার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার আর ইলোরার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। অজন্তায় যেতে হলে নামতে হবে কেভ পয়েন্টে। সাতসকালে পৌঁছে ঝকঝকে ব্যাটারিচালিত সাদা বাসগুলোর কোনওটায় উঠে একেবারে গুহার দোরগোড়ায়। এখানে মাথাপিছু দক্ষিণা গুণে গুহা পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়া। রাত্তিরটা ঔরঙ্গাবাদে কাটিয়ে সকালে ইলোরা। এই সার্কিটেই জুড়ে নেওয়া যায় খুলদাবাদ এবং দৌলতাবাদ দুর্গ, পানিচাক্কি আর বিবি-কা-মকবারা।
থাকাঃ- অজন্তা ও ইলোরা – দুই জায়গাতেই মহারাষ্ট্র পর্যটন নিগমের আবাসে থেকে এই দুই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-কে ধীরেসুস্থে অনুভব করা যায়।
কোঙ্কণ রেলপথ(Konkan Railway)
১৯৯৮ সালের ২৬ জানুয়ারি কোঙ্কণ রেলওয়ে কর্পোরেশন মহারাষ্ট্রের রোহা থেকে কেরালার ম্যাঙ্গালোর পর্যন্ত রেলপথে যোগাযোগের সূচনা করে। পরে মুম্বই সি.এস. টি. স্টেশনের সঙ্গে রোহার রেলপথ যুক্ত করা হয়। মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটক ও কেরালা এই চার রাজ্যকে জুড়ে ছুটে চলা রোমাঞ্চকর এই রেলপথের দৈর্ঘ্য বর্তমানে ৭৬০ কিলোমিটার। অসাধারণ সুন্দর এই রেলপথে রয়েছে ২০০টি টানেল ও ২,০০০টি ব্রিজ। এশিয়ার দীর্ঘতম টানেলটিও (৬.৫ কিলোমিটার) এই পথেই। পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে সঙ্গী করে পথ চলা। পথে গিয়েছে পাহাড়, নদী, জঙ্গল ও গভীর খাদের মধ্য দিয়ে। রোহা স্টেশন থেকে পথের শোভা আরও সুন্দর। ছোটো ছোটো সবুজ পাহাড়গুলো চলার পথে একবার বাঁয়ে আরেকবার ডাইনে সঙ্গী হবে। খের স্টেশন থেকে শাস্ত্রীনদী সঙ্গ দেবে প্রায় পুরোটা পথ। বালগঙ্গাধর তিলকের পৈতৃক বাড়ি ছিপলুন গ্রামে। গ্রামের নামেই ছিপলুন স্টেশন। এর পরে রত্নগিরি রেলস্টেশন। এখানে নেমেই রত্নগিরি এবং গণপতিপুলে যেতে হয়। মুম্বই থেকে গোয়া রেলপথ-ও এটা।