উত্তরাখণ্ডে ট্রেক

মৃণাল মণ্ডল


~ গঙ্গোত্রী-গোমুখ ট্রেকরুট ম্যাপ ~ গঙ্গোত্রী - গোমুখের আরও ছবি ~

~ পূর্বপ্রকাশিতের পর ~

গোমুখ অভিযান :

অভিমুখে

হোটেলে ফিরলাম না। সোমাঞ্জন গেল সন্দীপদাদের ডেকে আনতে, হোটেলে। সবাই যখন ফিরল, আগের দেখে রাখা সেই রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। তখন আটটা সাড়ে আটটা বাজে। দুটো টেবিলে ভাগাভাগি করে বসে আগে মেনু ঠিক করা হল আলোচনা করে। কারও রুটি, কারও ভাত। সঙ্গে ছোলেবাটোরা, মটরপনির আর বাটারপনির। সঙ্গে কেউ কেউ নিল টকদই। আর শেষে লস্যি। দারুণ রান্না। গোটা ট্রিপে আমাদের রসনার তৃপ্তি মেটানোর জন্য খাবারের যোগানের কথা ভাবলে ওটা ছিল পরমান্নসম।
খাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরলাম বাজারের মধ্যে। আমাদের এই আকস্মিক অভিযানের কথা শুনে সন্দীপদা না যেতে পারার আফশোসের কথা শোনাল। আর অভিজিৎদা গোঁফের নিচে হাসল।
হোটেলে ফিরে ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। জানালার বাইরে নিচে তখন খরস্রোতা গঙ্গার হুঙ্কার। আমরা চারজন (অতনু, অসীমা, রাখী আর আমি) গল্প করতে করতে ঘুমের দেশে যাত্রা করলাম।
পরেরদিন সকালে উঠে তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নেওয়া হল। মোটামুটি জিনিসপত্র কমিয়ে রেখে দেওয়া হল একটা দোকানে। অসীমা রুকস্যাক কাছছাড়া করতে চাইছিল না (কেন সেটা পরে বুঝেছিলাম, সময়মতো বলব সেকথা)। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ গোমুখযাত্রার প্রস্তুতি নিলাম। হোটেলে চেক আউট করার আগে প্রাতঃরাশটা সেরে নিতে ভুললাম না। ড্রাইভারকে খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিয়ে দেওয়া হল আর মোবাইল নম্বর নিয়ে নেওয়া হল। ঠিক হল যে গাড়িতেই রাত্রিযাপন করবে সে।
গঙ্গোত্রীর বাজার থেকে সবাই একটা করে লাঠি বেছে কিনে নিলাম। আর কেউ কেউ কিনলো জলের পাত্র। গোমুখ থেকে জল আনার উদ্দেশ্যে।
পথের রেশন তিনভাগে ভাগ করে নিয়েছিলাম আগেই। তিনটে ট্রেকের জন্য। যার একভাগের থেকে আবার আটভাগ করে যার যার ভাগ তাকে তাকে দিয়ে দেওয়া হল। রেশনে পাওয়া গেল কাজুবাদাম, কিসমিস আর খেজুর। আর সবার কাছে থাকল নিজেদের প্রয়োজনমতো পানীয় জল।
প্রথমেই একটা চেকপোস্ট পড়ল। অনুমতিপত্র দেখাতে হল। তার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরার জন্য অনুমতি নিতে হল। আর তার ভাড়া দিতে হল। সঙ্গের পাতলা প্লাস্টিক বাতিল করতে হল। সঙ্গে কতগুলো প্লাস্টিকের জিনিস নিয়ে যাচ্ছি (যেমন বোতল) তার হিসেব দিতে হল। ফেরার সময় হিসেব মিলিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পথে ফেলে দিয়ে নোংরা করে রেখে আসা যাবে না।
গোড়াতেই আমরা একটা ভুল করলাম। একটু ঘুরে না গিয়ে উঁচু সিঁড়ির শর্টকাট নিলাম। অতিরিক্ত শক্তিক্ষয় আর অল্পপথে বেশি পরিশ্রম হল।
যাই হোক, বামদিকের পাহাড় ধরে হাঁটা শুরু করলাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁসে পথ, প্রকৃতি তেমন রুক্ষ নয়, তবে গাছ বিশেষ নেই বলতে গেলেই চলে। যে পাহাড়টা ধরে আমরা চলছিলাম সেটাকে অনেকটা ফ্ল্যাট মাউন্টেন বলা চলে। ডানদিকে খাড়াই নেমে গিয়েছে গঙ্গার কাছে। অন্যপাশে উঠে গেছে আর এক পাহাড়। ওই পাহাড়ে গাছ অপেক্ষাকৃত বেশি।

আমার একটা সমস্যা আছে। ফুটবল খেলায় পাওয়া পুরোনো একটা চোট আছে বামপায়ের কুঁচকিতে। প্রত্যেক ট্রেকের শুরুর দিনে পীড়া দেয় সেটা। এখানেও তাই হল। ৪-৫ কিলোমিটার পরে মনে হল বামপায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। যেন অসাড় হয়ে গেছে পা, আর হাঁটতেই পারবো না। ওই অবস্থায় ব্যথা নিয়েই আরও ৫০০ মিটার যাওয়ার পর আর পারলাম না। বসেই পড়লাম। ভাগ্য ভালো গোটা দলই তখন বিশ্রাম নিতে একটু বসেছে। তাই ওদের আর জানালাম না। জানলো কেবল অসীমা। ও পা ধরে একটু টানাটানি করে দিল। ব্যথা খানিক কমলে আবার শুরু হল যাত্রা। অসীমা আর অভিজিৎদার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হল। তারপর সন্দীপদা আর অনসূয়া। মিঞা- বিবিতে দিব্যি চলেছিল। তাল মিলিয়ে। তারপর রাখী যেন অতনুকে নিয়ে চলছিল। ওদের পর সোমাঞ্জন। আর সবশেষে আমি। ব্যথার সঙ্গে যুদ্ধ করে কচ্ছপগতিতে চলতে হচ্ছিল।

পুরো রাস্তাটাই প্রায় জনমানবশূন্য। শুধু একটু দূরে দূরে কয়েকজনের দেখা মেলে। তারাও যাত্রী। না আছে গ্রাম। না কোনও ঘরবাড়ি, না দোকান। মাঝে মধ্যে একটা করে ঝরনা। সেখান থেকে জল নিয়ে তাতে জিওলিন মিশিয়ে নেওয়া হচ্ছিল।

তারপর আবার চলা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন হলে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম, বা পাথরের ওপরে বসে পড়ছিলাম সবাই একসঙ্গে। রেশন খাওয়া চলছিল, সঙ্গে জল। বিশ্রাম বেশিক্ষণের নয়। বড়জোর পাঁচ মিনিটের। কারণ বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিতে নেই। পায়ের পেশী বেশি বিশ্রাম পেয়ে গেলে ক্র্যাম্প হয়ে যাবে। তখন আর হাঁটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। আর একটা কথা হাঁটার সময় যতই ইচ্ছে হোক, মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া চলবে না। তাহলে গলা শুকিয়ে যায়। ক্লান্তি আসে তাড়াতাড়ি। তাই ছোটোছোটো করে, কিন্তু নাক দিয়েই, নিঃশ্বাস নিতে হয়।

অতনুর মাঝে মাঝে সামান্য শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু প্রতিবার সঙ্গে আনা কর্পূরের গন্ধ নেওয়ার পর সে কষ্ট চলেও যাচ্ছিল, আর নতুন উদ্যমে আবার হাঁটছিল। তবে অতনুর প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে রাখীর ভূমিকা যে বিশাল সেটা মানতেই হবে। জিনিসপত্রের সিংহভাগ রাখী একাই বয়ে নিয়ে চলেছিল। সোমাঞ্জনও তাল মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল। আমিই কেবল ধুঁকতে ধুঁকতে চলছিলাম। কুঁচকির ব্যথা একটু একটু কমতির দিকে থাকলেও ক্রমাগত বাধা দিচ্ছিল।
২০১৩ সালে একটা বড় বন্যা হয়েছিল এই অঞ্চলে। সেই থেকে রাস্তাঘাটের অবস্থা তথৈবচ। আস্তে আস্তে একটু ঢালুর দিকে নামতে থাকলাম। গঙ্গার ওপর একটা কাঠের পোলগোছের ফেলা আছে। এই জায়গাটায় স্রোত অনেকটা হলেও তার গভীরতা বা চওড়া অনেক কম। সাবধানে জায়গাটা পেরোলাম। নামার ফলে পায়ের যে বিশ্রামটা হয়েছিল, একধাক্কায় তার তিনগুণ শ্রম যে কপালে লেখা আছে তা তখনও জানা ছিল না। এবার চড়াই শুরু হল। ভীষণ খাড়া এক চড়াই। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘায়িত হল সেই চড়াই। মাঝে কয়েকবার বিশ্রাম নিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রথম বড় বিশ্রামের জায়গা 'চিরবাসা'।

Pinus roxburghii, হল পাইন গাছের একটা বিশেষ প্রজাতি। এর সাধারণ নাম চিরপাইন। এ গাছের পিতৃপুরুষের বাস তিব্বত ও আফগানিস্তানে। সেখান থেকে জম্মু ও কাশ্মীর ঘুরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, নেপাল, সিকিম, ভুটান, অরুণাচল হয়ে মায়ানমার-এ। এর অন্যান্য ভাইরা (প্রজাতি) দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা পৃথিবীর পার্বত্য অঞ্চল । এ গাছ মোটামুটি ৩০-৫০ মিটার লম্বা হয়। ব্যাসে ২-৩ মিটার। পাতাগুলো সবুজ সূচের মতো দেখতে।

এই চিরপাইনের বাসভূমি হিসাবে জায়গাটার নামকরণ চিরবাসা।
প্রসঙ্গত গঙ্গোত্রী থেকে চিরবাসা ৯ কিমি দূরত্ব। গাছপালা ঘেরা ছোট্ট অঞ্চল। একটা খোলামেলা বিশ্রামস্থল আর খানচারেক ছোটবড় খাবারের দোকান, ব্যস! বিশ্রামের জায়গাটাতে বসার জন্য সিমেন্টের স্ল্যাব বানানো। আর ইতিউতি কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বসার জায়গা। জিনিসপত্রের দাম এখানে আকাশছোঁয়া (MRP-এর আড়াইগুণ)। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। এই পাণ্ডববর্জিত দেশে জিনিসপত্র বয়ে আনা যে কী কঠিন তা আমাদের থেকে ভালো আর কে জানে। সবাই চা খেলাম। তারপর আলুর পরোটা টমেটো সস দিয়ে। কেউ কেউ ম্যাগি আর অমলেট । তারপর একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক আর একটা মিল্কশেক। আহারপর্ব শেষ।

চিরবাসাতে মোটামুটি জনসমাগম আছে। দোকানের লোক। গাইড। মাল বয়ে দেওয়ার লোক। ট্যুরিস্ট। সব মিলিয়ে একটু জমাটি ব্যাপার। এর মধ্যেই দেখা গেল একজন জার্মান ট্যুরিস্টকে। সবথেকে কিউট বুকের কাছে তাঁর ছোট্ট বছর তিন-চারেকের বাচ্চা মেয়ে চেস্ট -হাইকিং-ক্যারিয়ারে আবদ্ধ থেকে আপনপমনে খাওয়াদাওয়া আর খেলা করে যাচ্ছিল সারাক্ষণ।
আবার এগোলাম। কখনও চড়াই, কখনও সমতল রাস্তা। এসে পৌঁছলাম সেই বিশেষ জায়গাটাতে যার বিবরণ গুগল থেকে পড়ে, ইউটিউবের ভিডিও দেখে আগেই জেনে এসেছি আমরা। আর সতর্ক হয়ে রয়েছি। কখন আসে !
জায়গাটির নাম 'গিলা-পাহাড়'। নাম শুনেই বোঝা যায় খানিক ব্যাপারটা।
চিরবাসা থেকে ৩ কিমি দুরে এই এলাকাটা আলগা পাথরে পরিপূর্ণ ও অত্যন্ত ধ্বসপ্রবণ। ২০১৩ সালের বন্যায় এই জায়গাটার ক্ষতি হয় সবথেকে বেশি। এখন এমন অবস্থা যে এই ৪০০/৫০০ মিটার অঞ্চল খুব সন্তর্পণে পেরোতে হয়। সামান্য কম্পনেও বিরাট ধ্বস নামতে পারে। বিশাল বিশাল পাথরের স্তূপ তৈরি হয়েছে ভীষণরকম আলগাভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একের ওপর অন্য পাথর ভর করে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এইখান থেকে শুরু হয়ে গোমুখ পর্যন্ত 'ভরল'-এর বিচরণভূমি। ভরল হল হিমালয়ের দশ হাজার ফুট উচ্চতায় বাস করা এক বিশেষ প্রজাতির ভেড়া। যেখানে সেখানে চরে বেড়ায় আর বড় বাঁকানো শিং দিয়ে পাহাড়ের গায়ে গোত্তা মারে।

আগেই এই অঞ্চল সম্বন্ধে জেনে এসেছিলাম। তাই সন্তর্পণে কিন্তু একটু দ্রুতপায়ে জায়গাটা পার হওয়ার চেষ্টা করলাম। পেরোনোর পরপরই ওপর থেকে বেশকিছু ছোট বড় পাথর গড়িয়ে পড়ল আর ওপরের দিকে তাকিয়ে যেন ভরল-ই দেখলাম খান দু-তিনেক। যাই হোক তখন জায়গাটা পেরিয়ে গেছি। অগ্রসর হলাম। আর পিছু ফিরে তাকালাম না।

গিলা-পাহাড় থেকে আবার খানিক চড়াই খানিক উৎরাই পেরিয়ে একটা বাঁক ঘুরে সামনে নিচে দেখতে পেলাম ভোজবাসার বিস্তীর্ণ পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা। মোটামুটি বেলা দুটোর মধ্যেই ভোজবাসা পৌঁছে গেলাম আমরা। গিলা-পাহাড় থেকে ভোজবাসা ৪ কিমি পথ।

পৌঁছেই আগে একজায়গায় জিনিসপত্র রেখে ঘরের সন্ধানে বেরোলাম। ঘর এখানে তিনরকমের। মিলিটারির তত্ত্বাবধানে টেন্ট। লালবাবা আশ্রমের খুপড়ি। আর আশ্রমের পিছনের দিকে ছোট ছোট ছাউনি। সব দেখেশুনে লালবাবা আশ্রমের একটা খুপড়ি নেওয়া হল। খুপড়ি তো খুপড়িই। আলোহীন। অনেক নিচু আর স্যাঁতসেঁতে একটা ঘর, মেঝেতে কম্বলপাতা। গায়ে দেওয়ার কম্বল রাখা আছে ঘরের মধ্যেই একটা উঁচুমতন জায়গাতে। সেখানেই ব্যাগপত্তর রাখলাম। টর্চের আলোয় সব গুছিয়ে রেখে বেরোলাম। দরজার অবস্থা খুবই খারাপ। আটকায় না বাইরে থেকে। ঘরের সামনে একটা অন্ধকার গলির মতো। সেই গলির দুপাশে মোট চারখানা খুপড়ি। আর শেষে দুটো বাথরুম। খাবারের ব্যবস্থা আশ্রম কর্তৃপক্ষের। মন্দিরের ঘন্টার ধ্বনি শুনে হাজির হতে হবে ভোজনকক্ষে, সেখানে লম্বা করে ফরাস পাতা। রান্নাঘর থেকে থালা নিয়ে বসে যেতে হবে সার দিয়ে। স্বেচ্ছাসেবকরা সবাইকে খাবার পরিবেশন করবেন। একটু পরিচ্ছন্ন হয়ে ভোজনকক্ষে গেলাম সবাই। শেষ দলের খাওয়া শুরু হবে তখন। দুপুরের আহারে জুটল ভাত, কলাই-এর ডাল, সয়াবিন-আলুর তরকারি। সাধারণ খাবার, কিন্তু তৃপ্তি লাগল খেতে। স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকের সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়ে গেল। ফোন নম্বরও নেওয়া হল। ফিরে এসে যোগাযোগও ছিল এদের দুজনের সঙ্গে বেশ কিছুদিন। খাওয়ার পর এবার এলাকা পরিভ্রমণে বেরোলাম।

উঁচু পাহাড়ে ঘেরা বিশাল উপত্যকা, তার বুক চিরে বয়ে গেছে গঙ্গা (আসলে ভাগীরথী গঙ্গা)। সেই গঙ্গার উজান ধরে দৃষ্টিকে প্রসারিত করলে উপত্যকার শেষ প্রান্তে ৩ কিমি দূরে গোমুখের কিয়োদংশ দেখা যায়। ঘেরা পাহাড়গুলোর মাথা বরফে ঢাকা। তার ওপর রৌদ্র আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। আমাদের ঘরের পিছনের একটা ঘরের সামনে পাথরের ওপর বসেছিলেন পাঁচজন যোগী। তাঁরা পঞ্চকেদার ও চারধাম নাকি পুরোটাই হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কেদার থেকে হেঁটেই এসেছেন এখানে। এবার যাবেন তুঙ্গনাথ। বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছিল। কিন্তু ঘরে ঢোকার কোনো ইচ্ছেই ছিল না আমাদের। আমি, অতনু, সোমাঞ্জন, অসীমা, রাখী একসঙ্গে গঙ্গার পাড়ে আর জলে নেমে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। অভিজিৎদা অদূরেই ঘুরে বেড়াতে লাগল। একটু পরে সন্দীপদা আর অনসূয়াও যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। মনোরম নয়নাভিরাম অনবদ্য পরিবেশে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইলাম প্রকৃতির দিকে। সূর্য ডুবল। তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ের চূড়ায়, বরফের ওপর। সে এক শোভা বটে। কোনও বর্ণনাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। অনুভবেই তার মাহাত্ম্য। মন্দিরের সন্ধ্যারতি দেখলাম। ঠান্ডা পড়ছিল জাঁকিয়ে। তাড়াতাড়ি আহার সারতে হবে। এখানে ঘরে যে একটা আলোর ব্যবস্থা আছে সেটা নাকি সাতটা-সাড়ে সাতটার পর নিভিয়ে দেওয়া হয়। ভোজনালয়ে গিয়ে রুটি তরকারি সহযোগে রাতের খাবার সারলাম। তারপর স্বেচ্ছাসেবকদের আরও দুটো বালিশ ও একটা গায়ে দেওয়ার কম্বলের আবেদন করে ফিরে এলাম ঘরে। যথাসময়ে বালিশ আর কম্বল চলেও এল। বিছানা করে শুয়ে পড়লাম একসঙ্গে। কম্বলের মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে ঢুকতে লাগলো ঠান্ডার আমেজ। সেসব উপেক্ষা করে কখন যে ঘুম এল তার হিসেব নেই। ঘুম ভাঙল মধ্যরাতে। রীতিমতো ভাঙানো হল। আর অসীমা যে কেন ব্যাগ কাছছাড়া করছিল না তার প্রকাশ পেল এবারে।
ভোজবাসায় সেই ঠান্ডার মধ্যে পাগলামি শুরু করল অসীমা। দলের বাকিরাও যে মোটামুটি পরিকল্পনা জানতো না তা নয়। দেখলাম যে কেবল আমিই জানতাম না। স্যুইস রোল কেক কাটতে হল। আমার জন্মদিন পালন হল সেই মাঝরাতেই। দলে আবার একজন স্বেচ্ছাসেবককেও জুটিয়েছিল। তার কাছ থেকে রান্নাঘরের ছুরি ধার নিয়েছিল। উপহারস্বরূপ মিলল সকলের শুভেচ্ছা, অতনু আর সোমাঞ্জনের তরফ থেকে পালস্ লজেন্স, একবাক্স আমুলের চকোলেট (সেই বাক্স আজও আমার কাছে সংরক্ষিত) আর আমার ক্যানন ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স (১০-১৮ মিমি)। অসীমা যে আবার আমার কলিগ ও বন্ধু অপূর্বকেও জড়িয়েছিল লেন্স কেনার ব্যাপারে সেটা বহুপরে জানতে পেরেছিলাম। সমগ্র পরিকল্পনার মূলচক্রী ছিল অসীমা। কেক, চকোলেট আর লেন্স সেই কলকাতা থেকে বয়ে বয়ে ব্যাগে নিয়ে বেড়াচ্ছিল ও, তাই ব্যাগ আগলে রাখা। এই জন্মদিনপালন আজও ভুলিনি আর ভুলব বলেও মনে হয় না। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। একেবারে অন্যরকম।
সবাই কেক খেলাম। বাকিটা ওই স্বেচ্ছাসেবককে দিয়ে এলাম। ওঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খেয়েছিলেন। সবাই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে অবশ্য দু-তিন জনের বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হওয়ায় আমি আর অতনু তাদের সঙ্গে টর্চ নিয়ে বেরোলাম। বাইরের উপত্যকা তখন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। গঙ্গার জল চিকচিক করছে আলো পড়ে। সে আর এক মোহময় পরিবেশ। কিছুক্ষণ সেই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে আবার ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড ঠান্ডা তখন (৪-৫ ডিগ্রি হবে)। তাছাড়া ভোরে গোমুখের উদ্দেশ্যে বেরোতে হবে। বেলা বেড়ে সূর্যের আলো হিমবাহের ওপর পড়লে বরফের চাঁই-এ ফাটল ধরে। আর বিস্ফোরণের মতো প্রচণ্ড শব্দে বরফের টুকরো গুলির মতো ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তার আগেই আমাদের গোমুখ দর্শন শেষ করতে হবে।
ঠান্ডার জন্য হোক আর রাতের অনুষ্ঠানের জন্য হোক উঠতে একটু দেরি হল। তাড়াতাড়ি সকালের কাজ সেরে শীতের পোশাক চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অধিকাংশটাই সমতলভূমি। তাই পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগলও না।

কিন্তু গোমুখকে একেবারে ওপর থেকে সামনাসামনি দেখতে হলে বড় অথচ আলগা পাথরের চাঁই-এর ওপর দিয়ে অনেকটা এগোতে হবে। অভিজিৎদা, অসীমা আর আমি এগোলাম। দেখাদেখি প্রথমে অতনু আর রাখী, আর পরে আস্তে আস্তে সবাই এগোল। একেবারে খাদের ধারে একটা পাথরের বড় চাঁই-এর ওপর বসলাম। নিচে খাদ। খাদের ভূমি সমতল কাদার। আর তার সামনে বিশাল এক পুরু হিমবাহ। মাত্র ৭০/৮০ মিটার দূরে। আর তার ঠিক নিচে ছোট্ট বরফের গুহার মুখ। এই সেই বহুশ্রুত গোমুখ গুহা। সেখান থেকে বেরোচ্ছে গঙ্গার জলধারা খুবই ছোট নালার আকারে। আর এগিয়ে চলেছে আমাদের ঠিক ডানদিক দিয়ে ভোজবাসার দিকে। তারপর তা ছাড়িয়ে আরও বহুদূরে।

হিমবাহের সর্বাঙ্গ যে বরফের জন্য শ্বেতশুভ্র, তা কিন্তু নয়। বয়ং গায়ে কাদার প্রলেপ অনেকাংশেই। যেন এক বিরাট যোগী গায়ে ধুলো মেখে ধ্যানমগ্ন হয়ে সমাধিস্থ। আর হিমবাহের পিছনে ডানদিক ঘেঁষে অনেকটাই উঁকি দিচ্ছে সেই শিবলিং শিখর। পুরোটাই ধবধবে সাদা। যেন বিশাল বড় একটা বরফের চাঁই কেউ আপনখেয়ালে প্রকৃতির মধ্যে আলতো হাতে বসিয়ে দিয়ে গেছে।

রোদ উঠল, শিবলিং-এর মাথা মেঘে ঢেকে গেল। তারপর শুরু হল বরফের ফাটল। আর কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমে আসতে শুরু করলাম টিলা থেকে। ফাটল তৈরি হওয়ার ও আওয়াজের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছিল।

যাঁরা তপোবন ট্রেক করেন তাঁদের ভোরবেলা ওই হিমবাহের বরফের ওপর দিয়ে বাঁদিক ঘেঁষে অগ্রসর হতে হয়। আরও সাড়ে চার কিমি ট্রেক করে তপোবন উপত্যকায় পৌঁছানো যায়। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২০১৮-এর পর থেকে গোমুখ হিমবাহে অতিরিক্ত ধ্বসের কারণে গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ হয়ে তপোবন ট্রেক এখনও অনুমতি দেওয়া হয়না আর। কবে আবার চালু হবে তাও জানা নেই)।
এবার আরেক বিপত্তি ফেরার পথে যেই না সেই আলগা পাথরের ওপর উঠেছি অমনি ডানদিকের পাহাড়ে সেই ভরলের দল এমনি উৎপাত শুরু করল যে ধ্বস নামল পাহাড়ের একটা অংশে। সেই বিপদসঙ্কুল আলগা চাঁই-এর ওপর দিয়ে আরও বেশি পথ ঘুরে নামতে হল।
ভোজবাসা ফিরলাম। লালবাবা আশ্রমের প্রাতঃরাশ চা আর লুচি-তরকারি খেয়ে নিলাম সবাই। আমাদের একদিনের থাকা ও খাওয়ার জন্য আশ্রমের ধার্য আগের দিনই মেটানো ছিল (লালবাবা আশ্রমে একদিনের সকলরকম খাওয়া, প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্নভোজ ও নৈশভোজসহ একজনের থাকার খরচ মাত্র সাড়ে তিনশ টাকা নিল)।

দ্রুত সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আশ্রম ও ভোজবাসাকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। মাঝপথে একজায়গায় ড্রাইভার মোমিনকে ফোন করে ফেরার খবর আর সম্ভাব্য সময় জানিয়ে দিলাম যাতে সে গাড়ি নিয়ে তৈরি থাকে। গঙ্গোত্রী পৌঁছে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আজই আমরা রওনা দেব সোনপ্রয়াগের উদ্দেশ্যে কেদার ট্রেকের জন্য। সেখান থেকে গৌরীকুণ্ড পৌঁছে তবেই ওই ট্রেক শুরু করা যাবে। তাই পা চালালাম। এবার চেনা পথে। আর অধিকাংশই উৎরাই। তাই বেলা বারোটার আগেই পৌঁছে গেলাম গঙ্গোত্রী। সেই রেস্টুরেন্টে সেরে নিলাম আহার। তারপর সমস্ত জিনিসপত্র গোছগাছ করে গাড়িতে উঠে শুরু করলাম পরবর্তী সফর। কেদারের লক্ষ্যে। রাত আটটার আগে যতদূর পৌঁছনো যায়।

~ ক্রমশঃ ~


~ গঙ্গোত্রী-গোমুখ ট্রেকরুট ম্যাপ ~ গঙ্গোত্রী - গোমুখের আরও ছবি ~

হাওড়া জেলার অঙ্কুরহাটি কিবরিয়া গাজি ঊচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক মৃণাল মণ্ডলের নেশা ভ্রমণ, খেলাধূলা ও সাহিত্য চর্চা।

 

 

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher