ভিয়েতনাম-কাম্বোডিয়া – সাতান্ন বছর পরে আবার

তপন পাল


~ পূর্বপ্রকাশিতের পর ~

সায়গন! সায়গন!!

সায়গন প্রত্যাগত হওয়ার সুবাদে এজি বেঙ্গল অফিসে আমার বাবার নাম সুনীলকুমার বদলে হয়ে যায় সায়গন পাল। সর্বস্তরের কর্মচারীরা তাকে ওই নামেই চিনতেন, ঘনিষ্ঠরা বলতেন ভিয়েতকং পাল। ভিয়েতনাম নিয়ে তখন ভেতো স্ফীতোদর বাঙালির আদিখ্যেতা তুঙ্গে, আমাদের বিদ্যালয়েরই পদার্থবিদ্যার এক শিক্ষককে আমার পিতা জিজ্ঞাসা করেছিলেন ভিয়েতনামটা কোথায়? জবাব পেয়েছিলেন আফ্রিকায়; বলিভিয়া, অ্যাঙ্গোলা, তারপরেই ভিয়েতনাম। শিক্ষকটিকে দোষ দেওয়া যায় না। তখন স্মার্টফোন ছিল না, ছিল না গুগল ম্যাপস। ইংরিজি না জানা বিপ্লববিলাসী বাঙালির বিপ্লবস্পৃহা মেটানোর জন্য সৌরীন সেন, বেদুইন, কলহন ইত্যাদি লেখকরা তখন বলিভিয়া অ্যাঙ্গোলা ভিয়েতনাম প্যালেস্টাইন ইত্যাদি নামে কল্পবিপ্লবের মোটা মোটা বই লিখতেন। পাড়ার গ্রন্থাগারে সেই বইয়ের চাহিদা ছিল বিপুল। ১৯৬৮-র নভেম্বরের শেষাশেষি, নকশালবাড়ির বছরখানেক পরে, বিশ্বব্যাঙ্কের সদ্যদায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান (১৯৬৮-১৯৮১) রবার্ট স্ট্রেঞ্জ ম্যাকনামারা [Robert Strange McNamara] (১৯১৬ – ২০০৯) কলকাতায় আসেন। তাঁর কলকাতা দর্শনকালে 'বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণের দায়ে দেশকে বিকিয়ে যেতে দিচ্ছি না দেব না' বলে ইস্কুলে আমাদের চেঁচাতে বলা হয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ম্যাকনামারা সাহেব ছিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব (১৯৬১ – ১৯৬৮)। তাইতেই তাঁর আগমনে গাঙ্গেয়ভূমির সাম্যবাদীদের গায়ে জ্বালা ধরেছিল,তুমুল বিক্ষোভ হয়েছিল, বিমানবন্দর থেকে ধর্মতলা সাহেবকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে আনতে হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ থেকে কিছু বালক সেই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে সশরীরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সামিল হওয়ার আনন্দে সে রাত্রে চাট্টি ভাত বেশি খেয়েছিল।
মনে পড়ল এই রানওয়েতেই জ্ঞানত প্রথমবার বাবার সঙ্গে দেখা। বস্তুত এবারের ভ্রমণ এক অর্থে বাবার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যজ্ঞাপন। বিগত বছর চল্লিশ ধরে ভিয়েতনাম কাম্বোডিয়া যাওয়ার স্বপ্ন লালন করেছি; মধ্যবিত্ত প্রেক্ষাপটে তা কোনদিন সম্ভব হবে ভাবিনি। এর মধ্যে ইতিহাস বদলে গেছে অনেকখানি। ১৯৭৫-এ দেশ এক হলেও সূক্ষ্ম ভেদরেখা থেকেই গেছে। উত্তর গ্রামীণ, কৃষিভিত্তিক, গরিব, বছরে ছটা আটটা টাইফুন নিয়ে ঘর করা মানুষজন; দক্ষিণ উর্বর মাটির দেশ, সমৃদ্ধ কসমোপলিটান – ফরাসি ও মার্কিন ছত্রছায়ায় লালিত, সেই সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত। তাই আমাদের পূর্ব-পশ্চিমের মত এদের উত্তর দক্ষিণও যেন বাঙাল ঘটি – মুখের ভাষা থেকে হাবভাব ব্যবহারেই বুঝে ফেলা যায় কে দক্ষিণের মূলবাসী আর কে কাজের খোঁজে উত্তর থেকে আগত।

পুরো ভিয়েতনামেই (এবং কাম্বোডিয়াতেও) দোকানপাট বাজারহাট সর্বত্র মহিলাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। সাতান্ন বছর আগেও ঠিক এমনটিই ছিল। সত্যজিৎ রায় যখন রক্ষণশীল পরিবারের গৃহবধূর গণ্ডীর বাইরে বেরিয়ে চাকরিগ্রহণের সামাজিক চিত্রণে ব্যস্ত, তখন ভিয়েতনামে রিকশা থেকে নৌকা সবই চালাতেন মহিলারা। তখন শুনতাম দেশের ছেলেরা সব ভিয়েতকং হয়ে যুদ্ধে গেছে, মহিলারা অর্থনীতি সামলাচ্ছে। যুদ্ধ মিটে গেছে, রেওয়াজ রয়ে গেছে; বিমানবন্দরের পুরুষ শৌচালয়েও মহিলা সাফাইকর্মী। জীবনজীবিকার সর্বক্ষেত্রে মহিলাদের প্রাধান্যের জন্যই আমাদের সংস্কৃতিতে যে কাজগুলি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট, যথা স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদানকারী সেবিকা বা বিমানসখি, সেগুলিতে পুরুষকর্মীদের দেখা যায়।
১৯৭৫-এ যুদ্ধ শেষ হয়ে দুই ভিয়েতনাম যখন এক হয়, ভিয়েতনামি অর্থনীতি ছিল পৃথিবীর গরিবতম অর্থনীতিগুলির অন্যতম। আশির দশকের মাঝামাঝি অবধি মাথাপিছু জিডিপি দুশো থেকে তিনশো মার্কিন ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করত। ১৯৮৬-তে সরকার "Đổi Mới" শীর্ষক একগুচ্ছ আর্থিক ও রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এখন ভিয়েতনামি অর্থনীতি সমাজতন্ত্র অভিমুখিন বাজার অর্থনীতি। তবে রাজনৈতিক দল একটিই; কমিউনিস্ট পার্টি এবং যে কোনও কমিউনিস্ট পার্টির মতোই দুর্নীতি নিয়ে বিব্রত। ভিয়েতনামে পর্যটকদের মধ্যে চালু একটি বদ রসিকতা হচ্ছে 'ভিয়েতনামে যা ইচ্ছা করতে পারো, শুধু রাজনৈতিক দল খুলতে যেও না।'

অপরাহ্ণে সায়গন স্কোয়ারে, কেনাকাটা বিশেষ কিছু হল না কারণ সব বস্তুই অতীব মহার্ঘ। বসে বসে বিস্তর আখের রস NƯỚC MÍA ও Lychee Iced Tea খেলাম। স্থানীয় লোকজন সবাই দেখলাম সায়গনই বলছে, কেউই হো চি মিন সিটি বলছে না। দোকানপত্তরের সাইনবোর্ডেও কোথাও হো চি মিন সিটি লেখা নেই, বড়জোর দায়সারাভাবে HCMC লেখা। HCMC মানে কী জিজ্ঞাসা করায় এক বিক্রেতা বললেন হো চি মিন সিটি; তারপর স্থানীয় ভাষায় অক্ষরচতুষ্টয়ের একটি অতীব অশ্লীল বিস্তৃতি দাখিল করে বললেন এটিই বাজারে বেশি চালু। বস্তুত, দক্ষিণ কোনওকালেই হো চি মিন-কে দেবতা ভাবেনি। ১৯৫৪-এর জেনেভা কনফারেন্স-এ ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত হওয়ার পরে Ngô Đình Diệm (৩ জানুয়ারি ১৯০১ – ২ নভেম্বর ১৯৬৩)-এর রাজত্বকালে দক্ষিণের লোক উত্তরের লোকের চেয়ে শতগুণে ভাল ছিল – সমাজজীবন ছিল মুক্তমনা। হো চি মিন-এর প্রভুত্ববাদী এক ভিয়েতনামের স্বপ্ন তাদের যাবতীয় দুর্দশার মূল। এ যেন মধ্যযুগীয় কোন ছ্যাঁচড়া রাজার রক্তের মূল্যে সাম্রাজ্যবিস্তারের ব্যাকুলতা।
নবম দিনে আমরা টিকিট কেটে দেখতে গেলাম Củ Chi Tunnels; ভিয়েতনাম যুদ্ধের এক বিশিষ্ট স্মারক, আমাদের ইস্কুলজীবনে শিক্ষকদের মুখে এর গল্প শুনেছি। রাস্তায় অনেকক্ষণ সায়গন নদী (Sông Sài Gòn) আমাদের পাশাপাশি চলল। দক্ষিণ-পূর্ব কাম্বোদিয়ার Phum Daung থেকে নির্গত এই নদী সায়গন শহরের জীবনপ্রবাহ; সায়গন বন্দরের প্রাণভোমরা। মনে পড়ল, ছোটবেলায় রোজ সন্ধ্যায় বাবা মার হাত ধরে এখানে বেড়াতে আসতাম। একটুকরো বাঁশ, তার উপরিভাগ পাঁচভাগে বিভক্ত, প্রতিটি ডগায় এক টুকরো করে আখ গাঁথা – খেতে খুব ভালোবাসতাম। বাবা-মা খেতেন বাদামসিদ্ধ। নদীর ওপরে একটি আহারশালা ছিল, সেখানে গান হত – আমরা মধ্যে মধ্যে সেখানে খেতে যেতাম। এই সায়গন নদীতেই মার্কিন রণতরী দেখেছিলাম, বাবার কূটনৈতিক পরিচয়পত্রের সুবাদে তাতে উঠেওছিলাম।

Củ Chi Tunnels-এ গিয়ে দেখা গেল এখন এটি নেহাতই এক পর্যটন কেন্দ্র। বিস্তর টানেলের এক বিস্তৃত ঊর্ণনাভ চু চি, সাকুল্যে একশো একুশ কিলোমিটার। তদানীন্তন উত্তর ভিয়েতনাম থেকে লাওস ও কাম্বোডিয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ ভিয়েতনামে রসদ পাঠিয়ে ভিয়েতকংদের সাহায্য করে প্রতিবেশী দেশে গণ্ডগোল পাকানোর পাকিস্তানসুলভ অপচেষ্টা, হো চি মিন-এর সাম্রাজ্যবিস্তারের স্বপ্নের দোসর এই টানেল। পাশাপাশি আত্মগোপনের জায়গা, যুদ্ধপ্রস্তুতির কেন্দ্র। ১৯৬৮-তে ভিয়েতকংদের Tết Offensive-এর ঘাঁটি ছিল এই টানেল। পুরোটাই জঙ্গলাকীর্ণ, গেরিলা যুদ্ধের নানাবিধ উপকরণ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পয়সার বিনিময়ে গোলাগুলি ছোঁড়ারও বন্দোবস্ত রয়েছে।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকখানি হাঁটতে হয়। একজায়গায় দেখি আমেরিকান বি-৫২ বিমান থেকে ফেলা বোমায় সৃষ্ট এক মস্ত গর্ত, তার মধ্যে এক অতিকায় সাহেব দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে বসে বিয়র খাচ্ছে। সামনে একটি বোর্ড - I lost my Dad somewhere here; did You? দেখে আমার যে কি আনন্দ হল বলার নয়, সাহেবের সঙ্গে যোগ দিতেই সাহেব দৌড়ে আমার জন্যও বিয়র কিনে আনল, BIA Saigon Special, সরকারি উদ্যোগে টানেলের ভিতরেই প্রাপ্তব্য। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে মৃত বাবার জন্যে তার কী কান্না রে ভাই সে কী বলব! আমার ধারণা ছিল শুধু ভারতীয় পুরুষরাই কাঁদে, এ দেখলাম আমাদের ছাড়িয়ে যায়। আমার বাবা দেখলে খুশি হতেন, বাবার সারাজীবনের আক্ষেপ ছিল আমার তো মেয়ে নেই, আমি মরলে কেউ কাঁদবেও না।

সাহেব কেঁদে আকুল, এদিকে আমার হাসি পাচ্ছে, পেটের মধ্যে ভুসভুসিয়ে উঠছে হাসি। গতবছর এই সময়েই গনগনির মাঠে পিকনিকে গিয়েছিলাম। জলতেষ্টা পেয়েছিল বলে সবে জলের বোতলের ছিপিটা খুলেছি, কিছু ইস্কুলমাষ্টারমার্কা অকালপক্ক যুবক এসে বলল, দাদা, এটা স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান। এমনকিছু করবেন না যাতে রাণী শিরোমণির অসম্মান হয়। আর এরা! আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ধ্বংসাবশেষ আমেরিকানদেরই দেখিয়ে সেন্টুতে সুড়সুড়ি দিয়ে বেশি দামে বিয়র বিক্রি করে দুটো পয়সা কামিয়ে নিল। ধন্য ব্যবসাবুদ্ধি!

পরদিন মেকং বদ্বীপ ভ্রমণ; তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অবলোকন ও গ্রামীণ আতিথেয়তার হাতছানি। ভিয়েতনামের দক্ষিণ পশ্চিমের এই অংশটুকু অনেকটাই আমাদের সুন্দরবনের মত, মেকং বদ্বীপ সমুদ্রতলের সমতায় নদী জলাভূমি দ্বীপ ও ধানক্ষেতের এক বিস্তীর্ণ বায়োস্ফিয়ার - আয়তন ৪০, ৫৭৭ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা ২.১৫ কোটি (২০১৯)। ভিয়েতনামের 'রাইস বোওল' বলে খ্যাত এই অঞ্চলে জীবন চলে মেকং-এর ছন্দে, শিরা উপশিরা ধমনীপ্রবাহের মত বিস্তৃত জলজালিকায় ভাসে বাড়ি নৌকা, বাজার, জীবন।

জীবন এখানে শ্লথ, মহিষ নদী পেরোয় নিজের খেয়ালে, নারকোলভর্তি নৌকা পাড়ি দেয় এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে, ম্যানগ্রোভের অরণ্য শিকড় হাওয়ায় ভাসিয়ে শ্বাস নেয়। ভিয়েতনামের ধান ও মাছের মোট উৎপাদনের অর্ধেক আসে এই অঞ্চল থেকে। স্বাভাবিকভাবেই একদিনের আট ঘণ্টার ভ্রমণে কতটুকু আর দেখা হয়, তবু ধারণাটি করা যায়; কিঞ্চিৎ পরিচিত হওয়া যায় তাঁদের জীবনযাত্রার সঙ্গে। আমাদের হিমালয় থেকেই বিশ্বের দ্বাদশ ও এশিয়ার সপ্তম দীর্ঘতম নদী মেকং এর উৎপত্তি, দৈর্ঘ্য ৪,৩৫০ কিলোমিটার, জল নিষ্কাশন এলাকা ৭,৯৫,০০০ বর্গকিমি। তিব্বতীয় মালভূমি থেকে চিনের ইউনান প্রদেশ হয়ে, মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়ার মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামে এসে দক্ষিণ চিন সাগরে তার পরিসমাপ্তি।

সায়গন থেকে বাসে Mỹ Tho। পথে, Mỹ Phong শহরের Mỹ Hóa অঞ্চলে, Bảo Định খালের ধারে, দু হেক্তার জমির উপর বিস্তৃত Vĩnh Tràng Chùa (Vĩnh Tràng Temple) একটি অতিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির। তাকে ঘিরে সুসজ্জিত উদ্যান। স্থাপনাকাল থেকে যে সব মহারাজরা এই মন্দিরের দায়িত্বে ছিলেন তাদের সমাধি বাগানের এখানে ওখানে। স্থানীয় জমিমালিক Bùi Công Đạt-এর বদান্যতায় ১৮৫০ সালে এই বৌদ্ধমন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। তারপর ১৮৫৯ থেকে ১৮৬২ ফরাসি সেনাবাহিনীর সঙ্গে Emperor Tự Đức-এর যুদ্ধে মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লোকে ক্রমশ এর কথা ভুলে যায়। ১৮৯০-এ পুনঃ সংস্কার, ১৯০৪ এর ঘূর্ণিঝড়ে ধূলিসাৎ,এবং ১৯০৭ এ পুনর্নির্মাণ – এভাবেই রূপকথার ফিনিক্স পাখির মত এই মন্দিরের জেগে ওঠা। এর স্থাপত্যে প্রাচ্যের সাবেকি চৈনিক, ভিয়েতনামি ও কিমায়ের ধাঁচের সঙ্গে পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ ধাঁচের রোমান খিলানের অভূতপূর্ব সহাবস্থান। পুরো মন্দিরটিতে পাঁচটি ভবন, ১৭৮টি স্তম্ভ; সঙ্গে অতিকায় তিনটি বুদ্ধমূর্তি। দণ্ডায়মান অমিতাভ বুদ্ধ আনন্দঘন করুণার প্রতীক, হাস্যরত বুদ্ধ সুখ সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের প্রতীক,আর শায়িত গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ – জরা ব্যাধি মৃত্যুর জগত থেকে নিষ্কৃতির প্রতীক। এছাড়াও ষাটটি তামা ও কাঠের মূর্তি, ১৯০৭ সালে একই কাঁঠাল গাছের কাঠে তৈরি অষ্টাদশ অর্হৎ (নির্বাণপ্রাপ্ত বা নির্বাণের অধিকারী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী)-এর মূর্তি, ১৮৫৪-এ নির্মিত ব্রোঞ্জের একটি অতিকায় ঘণ্টা। ১৯৮৪ সালে ভিয়েতনাম সরকার এই মন্দিরকে জাতীয় স্মারকের মর্যাদা দেন। মন্দিরের সঙ্গেই আছে একটি অনাথ আশ্রম। মেকং ডেলটাগামী বিদেশি পর্যটকদের কাছে এই মন্দির অবশ্যদ্রষ্টব্য। মন্দিরে ঢোকার তিনটি প্রবেশপথ। আশ্চর্যজনকভাবে মূল প্রবেশতোরণ সর্বদাই রুদ্ধ। পাশের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকলে চোখে পড়বে ভাঙা রঙিন কাচের টুকরো সাজিয়ে পোর্সেলিন মোজেইক – তাতে বুদ্ধের জীবনকাহিনি বিবৃত।

ভিয়েতনামের যে কটি বৌদ্ধমন্দির দেখলাম, হ্যানয়ের টেম্পল অফ দ্য জেড মাউন্টেন (Đền Ngọc Sơn) বৌদ্ধমন্দিরসহ, সর্বত্রই বুদ্ধের দেশের লোক বলে বাড়তি সমাদর পেলাম। এখানে এক মহারাজ আমি বেশ কয়েকবার সারনাথ গিয়েছি শুনে আশ্চর্য হলেন; অতিকায় ডাব খাওয়ালেন (এরা ডাবের নিচের দিকটা কাটে), জিজ্ঞাসা করলেন কবে ফিরছি; এবং দুদিন পরে ফিরছি শুনে ফল দিলেন অনেকগুলো; বললেন, 'এখানে খেয়ো না,ভারতে নিয়ে যেও।'
বিদেশি ভ্রমণার্থীরা আসেন বলে বাজার বসে গেছে; মূলত ভিয়েতনামি হস্তশিল্পের। রেশম, চিনামাটির চিত্রিত জিনিষপত্র, হাতে তৈরি কাগজ, Lacquerware, Calligraphic Clothes, পুতুল, ভিয়েতনামি মেয়েদের শঙ্কু আকৃতির টুপি, কাঠের ত্রিমাত্রিক জিগ-স পাজল। আমাদের বাড়িতে দুই বোন থাকেন, তাদের বয়সের ব্যবধান সামান্যই। সেই দুই বোন – আমার মাতাঠাকুরানী ও আমার পৌত্রী – আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছিলেন তাদের জন্য শঙ্কু আকৃতির টুপি আনতে। প্রথমা স্মৃতিচারণে, দ্বিতীয়া তাঁর মুখে গল্প শুনে শুনে। বেয়াড়া আকৃতির এবং নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় এতদিন কেনা হয়নি; এখানে কেনা হল। যখন ফিরছি, মহারাজ বললেন, তোমার কার্ড দাও তো একটা। কলকাতা পৌঁছে তোমাকে ফোন করব। 'উই উইল ভিসিত সারনাথ এন্দ বোধগয়া তুগেথার' !

Mỹ Tho থেকে সাম্পান নৌকায়, ভাসমান এক বাজার ছুঁয়ে, এক দ্বীপে। দ্বীপের জেটিতেই সংবর্ধনা, দুজন ভিয়েতনামি পুরুষ গিটার ও বেহালা জাতীয় একটি স্থানীয় যন্ত্র বাজালেন, চারজন নানা বয়সের মহিলা, দেখলেই বোঝা যায় তাঁরা একই পরিবারের, ভিয়েতনামি গান গাইলেন তিনটে। তারপর সেই সব গান কেউ শুনছে না দেখে চারজনে একসঙ্গে 'If you're happy and you know it/Clap your hands/ If you're happy and you know it/ Clap your hands/If you're happy and you know it/Then your face will surely show it/ If you're happy and you know it/ Clap your hands' গাইতে লাগলেন।
অতঃপর আপ্যায়ন। বাম্বু টি (আজ্ঞে হ্যাঁ, এই দশদিনে যে কতরকমের চা খেয়েছি তা আপনাদের বলে বোঝান যাবে না। জেসমিন টি, লোটাস টি, সিত্রাস টি, হনি টি, বাম্বু টি, এগ টি, লিচি টি, জিনসেং টি, ম্যাঙ্গো টি...), সঙ্গে মাছভাজা, মাছটি আমাদের তেলাপিয়া গোত্রের, কুমড়োর মত কোন সবজির গায়ে চালবাটা মাখিয়ে ভাজা, প্রচুর ফল, নারকোলের জলে জারিত মিষ্টি আদা,এবং মধু। আমরা যখন খাচ্ছি তখন মেয়েগুলি এসে প্রতি টেবিলে একটি করে সুদৃশ্য বাঁশের ছোট ঝুড়ি রেখে গেল। তাইতে টগর ফুল,তুলোর (পরে জেনেছি বাঁশের ফুল থেকে আহরিত তন্তুর) ছোট্ট একটি করে পুতুল, আর একটি কার্ড -Please Tip. We live for You Tourists. Minimum USD 2 per person!

এবার ঘোড়ার গাড়ি; প্রতি গাড়িতে আরোহী দুজন। গাড়ি ছুটে চলল গ্রামীণ পাকা রাস্তা দিয়ে। রাস্তার দুধারে ফুল ফুটে আছে অনর্গল; অতিকায় জবা, টগর, কামিনী, অপরাজিতা (বড় সাদা প্রজাতিটি; মহাশ্বেতা), আকন্দ, কাঠচাঁপা, গন্ধরাজ - পুকুরে পদ্ম ও শালুক। কেউ তোলে না। আমার বাড়ির তুলসীপাতা গাঁদালপাতা নিমপাতা বেলপাতা ধর্মপ্রাণ চোর প্রাতর্ভ্রমণকারীর দল ঝেড়ে ফাঁক করে দিল। পাশাপাশি ফলের গাছ; আম, আমলকী, বাতাবিলেবু, জাম, জামরুল, আঁশফল, আতা, কলা, কাঁঠাল, লিচু, কুল, চালতা। গিয়ে জেটিতে, সেখানে ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক - তালজাতীয় ছোট ম্যানগ্রোভ গাছের তালশাঁসের রস।
এইবারে ক্যানোবিহার। তিন দশক আগে মুর্শিদাবাদে চাকরি করার সময় তালগাছের ডিঙিতে অনেক চেপেছি। তিনিই যে এখানে এসে নাম বদলে ক্যানো হয়েছেন তা আমি জানবো কী করে! দুজন মহিলা মাঝি, আরোহী আমরা দুজন, সঙ্কীর্ণ খাঁড়িপথ, দুধারে ম্যানগ্রোভ – ঠিক যেন সুন্দরবন। Cần Giờ Biosphere Reserve পেরিয়ে খাঁড়ি এসে মিশলো প্রশস্ত নদীতে, সেখানে জেটি। মাঝিপিসিটি হাত ধরে বললেন 'তিপ ফো দলার, দিয়ে যা ভাইপো। তোর বাবা মা সব কেমন আছে বললি না তো!'
নৌকায়। Sóc Trăng দ্বীপে কাম্বোদিয়ান একদা উদ্বাস্তুদের বাস। কাম্বোদিয়া দেখে এসেছি, তাই আর গেলাম না। এবার একটি দ্বীপে নারকোল কারখানা দর্শন। নারকোল এদেশে সহজলভ্য, কাম্বোদিয়ায় আমরা রোজ অতীব মিষ্টি জলের অতিকায় ডাব DỪA TƯƠI খেয়েছি। তবে নারকোল থেকে যে কত কি হতে পারে তাই দেখেই আমরা স্তম্ভিত। কারখানা সংলগ্ন শোরুমটি অতিকায়; শ্রীমতী পাল সেখান থেকে কোকোনাট ক্যান্ডি ও নারকোলের মালার সুদৃশ্য বাটি কিনলেন।
ফের নৌকায়। মেকংযের মস্ত বিস্তৃতি; অনেক জাহাজ, নৌকা, রৌদ্রতপ্ত দিন। তালশাঁসের রস খেয়েই মাথাটা ভার করেছিল, তার ওপরে নারকোলের কারখানায় সবাইকে ছেড়ে আমাকে ওরা বিনিপয়সায় কোকোনাট ওয়াইন খাইয়ে দিলেন। একটু ঝিমুনি এসেছিল। এবারের পথ অনেকখানি, নৌকার যন্ত্রে ইংরাজি গান বাজছিল। একটা গানের সুর চেনা চেনা লাগছিল, কান পেতে শুনে বুঝলাম অতিপুরাতন ডরিস ডে (১৯২২-২০১৯) 'Que Sera Sera, Whatever will be will be'। চেনা লাগার কারণ উত্তম-অঞ্জনার 'চৌরঙ্গী' ছবিতে এই গানটি ছিল। এই প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে জুতসই গান আর হয় না। ডরিস ডে-র অন্যান্য গানও বাজছিল। আমি বিস্মিত হলাম। এতকিছুর পরেও আমেরিকান গান! আর পাকিস্তানের শিল্পীদের আমরা হেনস্থা করি!!
পরবর্তী দ্বীপে মধ্যাহ্নভোজ। ছড়ানো অনেকখানি জায়গা জুড়ে গাছপালা, তাতে হ্যামক টাঙানো, ফোয়ারা। মস্ত এক চালার নিচে খাওয়ার বন্দোবস্ত। অতিকষ্টে একটি হ্যামকে উঠে সবে রাজ কাপুরের গান ধরেছি, য়ে রাত ভিগি ভিগি, য়ে মস্ত ফিজায়েঁ, উঠা ধীরে ধীরে, য়হ চাঁদ প্যায়ারা প্যায়ারা। ওমা! দেখি কি হোটেলের এক ভিয়েতনামি মহিলা কর্মচারী নার্গিসসুলভ আ আ আ আ আ ধরলেন। তড়িঘড়ি নেমে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি জানলে কি করে? তিনি বললেন আমাদের এখানে অনেক ভারতীয় আসেন, আর যে ভারতীয় হ্যামকে ওঠে সেই এই গানটা গায়। শুনে আমি অপ্রস্তুত।
আস্ত মাছ ভেজে টেবিলে সাজানো,সঙ্গে অতিকায় ফুচকার মত রুটি, আঠালো ভাত। গোবিন্দভোগ চালের ফ্যান-ভাত বাটিতে দিয়ে বললো 'ইত ইস ত্রাদিশনাল ভিয়েতনামিজ রাইস পরিজ'। সঙ্গে অতিকায় গেলাসে ঈষদুষ্ণ জেসমিন টি, শ্রীমতী পাল জল চাইলেন, 'তোমরা কেমন লোক গো! লোককে খেতে দিলে জল দিতে হয় জানোনা'! অমনি একটা মেয়ে এসে সাড়ে সাতশো মিলিলিটারের এক বোতল জল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল ত্রি দলার। আহারে পদের শেষ নেই; মাছই অনেক রকমের, স্কুইদ, অয়েস্তার, শূয়র, সাপ, ঝিনুক, ফল, সবজি, নুদলস।
ফেরার পথে একটি বাঁশের কারখানা দেখা হল। বাঁশ থেকে যে এরা কত কী যে তৈরি করে! শ্রীমতী পাল বাঁশের ফুল থেকে আহরিত তন্তুর ঝাড়ন কিনলেন রান্নাঘরের জন্য। আমি একটি গামছা কিনলাম। গামছা ভিয়েতনামি সংস্কৃতির মুখ বিশেষ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা ভিয়েতকং গেরিলারা কাঁধে গামছা রাখতো; ওটিই ছিল তাদের পরিচিতি, পরিচয়পত্র।

এবারে সায়গনে ফেরা, নেপথ্যে তখন বেহালা বাজছে। দশদিন মহা আনন্দে কাটল, অদ্য শেষ রজনী। অপরাহ্ণে যাওয়া হল সায়গন শহরের কেন্দ্রে Nguyen Hue Walking Promenade-এর শেষে পিপলস কমিটি বিল্ডিং দেখতে। কলকাতার যেমন ভিক্টোরিয়া বা হাওড়া সেতু, লন্ডনের যেমন বিগ বেন, সায়গনের তেমনি ১৮৯৮ সালে নির্মিত ফরাসি স্থাপত্যের উজ্জ্বল হলুদবরণ এই ভবন শহরের অভিজ্ঞান। সরকারি অফিস, তাই বহিরাগতের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটি অপরাহ্নিক বিনোদন কেন্দ্র, মস্ত বাঁধানো চাতাল, পিপলস কমিটির জন্মশতবার্ষিকী (১৯৯০)তে প্রতিষ্ঠিত পুস্তক পাঠরত হো চি মিনের মূর্তি – কাছাকাছির মধ্যে শহরের আরও কিছু দর্শনীয় ভবন, সায়গন অপেরা হাউস, রেক্স হোটেল, নতরদাম ক্যাথিড্রাল, কেন্দ্রীয় ডাকঘর, ইউনিয়ন স্কয়ার শপিং মল। রেক্স হোটেলের ছাদের আহারখানাটিতে বসে সিঁদুর ছড়ানো সূর্যাস্ত না দেখলে নাকি সায়গন দেখা পূর্ণ হয় না, এমনটিই প্রবাদ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কালে রেক্স হোটেল (Khách Sạn Rex) ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের আস্তানা; সেই সুত্রে কূটনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্র। বাবার মুখে নাম শুনেছি,গিয়েওছি। ১৯২৭ সালে যাত্রা শুরু করা এই হোটেলের ভবনটি পাঁচতলা, সর্বমোট ২৮৬ টি ঘর।

ইংরাজি নববর্ষ সদ্য গেছে, সামনেই Tết Nguyên Đán (Festival of the First Morning of the First Day),বসন্ত উৎসব,ভিয়েতনামি নববর্ষ এবং ভিয়েতনামের সর্বপ্রধান উৎসব। আমাদের দুর্গাপূজা চারদিনের,ওদের Tết কমপক্ষে তিনদিনের, বেশিরদিকে দশ বা পনেরো দিনের। আমাদের হোটেলের এক কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি কতদিন ধরে Tết করেন'। 'যতদিন না টাকা ফুরাচ্ছে, বা হোটেল কর্তৃপক্ষ চাকরি খাওয়ার ধমকি দিচ্ছে' - তার সপ্রতিভ জবাব। ওদের ক্যালেন্ডার আমাদের বাংলা পঞ্জিকার মত, সৌর ও চান্দ্র বৎসরের সমন্বয় সাধনের অদম্য প্রচেষ্টা; তাই তারিখ এক থাকে না। ২০২০ সালে Tết পড়েছিল ২৫শে জানুয়ারি। গোটা চত্বর,তার আশেপাশের রাস্তাঘাট Tết উপলক্ষে আলোয় সেজেছে; আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে আলো। আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো। আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো। সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা, যেদিকপানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো। ভিয়েতনামের ও চন্দননগরের 'আলোকের এই ঝর্ণাধারা'র যৌথ সংস্কৃতির পিছনেও কি যৌথ ফরাসি ঐতিহ্য?

নিখিলের আনন্দধারায় স্নান করতে করতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। সারা পৃথিবীর লোকের সঙ্গে গায়ে গা লাগছে। লোকে ফুটপাথে বসে কফি সিগারেট আর ভিয়েতনামের জাতীয় পদ ফো (Phở; ভিয়েতনামি নুডল সুপ) খাচ্ছে, বিয়ার খাচ্ছে, সাবান জলের বুদবুদ ওড়াচ্ছে, বিদেশি পর্যটকরা ছবি আঁকছেন, বিক্রি করছেন, দাম লেখা এনি প্রাইস। বোঝা গেল তরুণ প্রজন্মের বাজেট পর্যটকরা এভাবেই বিদেশে কিঞ্চিৎ আয়ের প্রচেষ্টা করে থাকেন।
ভিয়েতনাম দেশটি, ১৯৭৫ সালের সংযুক্তির পর,বেশ বড়সড়। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃতি ১৬৫০ কিলোমিটার,পূর্ব পশ্চিমে মোটামুটি পঞ্চাশ থেকে একশো কিলোমিটার। উত্তর দক্ষিণ ১৬৫০ কিলোমিটার বিস্তৃতির পুরোটাতেই পূর্বে সমুদ্র। দেশটিতে দেখার জিনিসের শেষ নেই, বিশেষত যাঁদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে আগ্রহ, তাঁদের। আর পর্যটনকে এঁরা এত সুন্দর প্যাকেজিং-এ উপস্থাপিত করে, যে বাঁকুড়ার একটি গ্রামীণ রাস্তাকেও এরা আন্তর্জাতিক ভ্রমণগন্তব্য বানিয়ে দিতে পারে। একদম উত্তরের লো নদীর তীরে Ha Giang শহরে সময় নাকি থেমে আছে। একদম দক্ষিণের ক্যানন থো আর হাউ নদীর মিলনস্থলে Can Tho ভাসমান বাজার। আর এই দুইয়ের মাঝখানে ছড়িয়ে আছে অগণন ভ্রমণ গন্তব্য - উত্তরের ব্যাং জিয়াং নদীর তীরে শান্ত শহর Cao Bang, হ্যানয় শহর, চুনাপাথরের পর্বত Ninh Binh, শিল্প শহর Haiphong, সমুদ্রতীরের শহর Dong Hoi, ঐতিহাসিক শহর Hue, প্রাচ্যের ভেনিস Hoi An, গ্রামীণ ভিয়েতনামের গন্ধমাখা Kon Tum, চিরবসন্তের ফরাসি পর্যটনকেন্দ্র Dalat, দক্ষিণ চিন সাগরের পারে সৈকত শহর Nha Trang; আর দক্ষিণে সাবেকি সায়গনকে ঘিরে Mekong Delta, ফরাসি ঔপনিবেশিক শহর Vung Tau, কাম্বোডিয়ার সীমান্তে কৃষ্ণকুমারী (Black Virgin) পাহাড়ের গায়ে Tay Ninh, নদীমাতৃক My Tho। এবারে Hue ও Dalat যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, Dalat-এ সবাই ক্লাউড হান্টিং করতে যান; কিন্তু ভ্রমণসংস্থাটি খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না; বললেন তাহলে আপনার ভ্রমণসূচি কাস্টোমাইজ করতে হবে, খরচও পড়বে বিস্তর। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, মনে নেই ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় (১৯৬৮) গাঢ় শীতে মধুপুরে স্কাউট ক্যাম্পে গিয়ে টিলার মাথায় মেঘ দেখে দৌড়ে দৌড়ে উঠে গিয়ে দেখেছিলাম কোথায় কী; এ তো ঘন কুয়াশা! ধরে নাও ওই-ই তোমার ক্লাউড হান্টিং।
ভারত থেকে আমাদের সঙ্গে একজন ট্যুর ম্যানেজার গিয়েছিলেন – ছেলেটি হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাস, পর্যটনশিল্প পরিচালনায় ডিপ্লোমা না ডিগ্রি কি একটা আছে; অনেকগুলি ভাষা জানেন। তবে তার ভূমিকা ছিল সদস্যদের সুবিধা অসুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা, বিশেষত সবাই যখন বয়স্ক। ভ্রমণ ব্যবস্থাপনার ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক ব্যাপার স্যাপার তারা ভাগ করে দিয়েছিলেন হ্যানয়, সিয়েম রিপ আর সায়গনের তিনটি ভ্রমণসংস্থাকে – তারাই থাকা খাওয়া ঘোরানোর সব ব্যবস্থা করেছিলেন, দেশের ইতিহাস সংস্কৃতি রাজনীতি মোটামুটি জানা আছে এমন ইংরাজি জানা গাইড দিয়েছিলেন (হ্যানয়ে হোয়ে, সিয়েম রিপে শরথ আর সায়গনে নিক)। নিক ছেলেটি হাসিখুশি, সে আমাকে সায়গনের ইতিহাস বলবে কি, ১৯৬৩ র সামরিক অভ্যুত্থানের সময় আমি সায়গনে থাকতাম শুনে সে আমার থেকেই শহরটা কেমন ছিল জানতে চায়। ফেরার আগের দিন তাকে বললাম, তোমাদের কনডাকটেড ট্যুরের চক্করে পড়ে আমার Hue ও Dalat যাওয়া হাতছাড়া হল। শুনে সে অবাক! বললো এই নাও আমাদের সংস্থার কার্ড, জানো তো ভিয়েতনামের ৩৩১,২১২ বর্গ কিলোমিটারের দেশে দশটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর - Cần Thơ, Da Nang, Hai Phong, Hanoi, Ho Chi Minh City, Huế, Nha Trang, Phú Quốc, Quảng Ninh ও Vinh; তেরোটি ঘরোয়া বিমানবন্দর। তোমার যেদিন আসতে ইচ্ছে হবে, শুধু জানিয়ে দেবে কবে কোন উড়ানে তুমি কোথায় নামছো, – বাকিটা আমাদের ওপর ছেড়ে দাও। আশায় আশায় বসে আছি ওরে আমার মন।

আমাদের ফেরার টিকিট ছিল সায়গন থেকে বিকাল চারটে চল্লিশের মালয়েশিয়ান এয়ালাইন্সের MH ৭৫৯ ধরে সাতটা পঁয়তাল্লিশে কুয়ালালামপুর; সেখান থেকে রাত নটা পঞ্চাশের মালয়েশিয়ান এয়ালাইন্সের MH ১৮০ ধরে রাত এগারোটায় চেন্নাই, সেখান থেকে পরদিন সকালের ইন্ডিগো ধরে কলকাতা। আমরা টিকিটটা বদলে করে নিয়েছিলাম সায়গন থেকে দশ তারিখে রাত দুটো চল্লিশের ইন্ডিগো ধরে সকাল চারটে চল্লিশে সরাসরি কলকাতা। উদ্দেশ্য সায়গনে একটা বাড়তি দিন পাওয়া।
ন তারিখ সকাল থেকেই হোটেল (Aristo Saigon Hotel. 3A Võ Văn Tần, Phường 6, Quận 3, Hồ Chí Minh City) খালি হতে শুরু করল। বেলা বারোটায় চেক আউট করে আমরাও। আমাদের ভ্রমণসংস্থা হোটেল থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার জন্য একটি গাড়ির বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমরা তার সঙ্গে বাড়তি বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলাম রাত দশটা অবধি। ঘোরা হল শহরের সেই সব এলাকাগুলো যেখানে টুরিস্টরা সচরাচর যায় না - স্থানীয় লোকজনদের জনবসতি, পাড়া, বাজারহাট, ঝগড়াঝাঁটি। সেই সন্ধ্যায় আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম সায়গন নদী (Sông Sài Gòn)র তীরে। চন্দননগরের স্ট্র্যান্ড এর মতন নদীতীর – দুটিই তো ফরাসি উপনিবেশ ছিল – যদিও এরা বলে রিভিয়েরা। সেদিন শুধু আমরা দুজন; মনে পড়লো ছোটবেলায় (১৯৬৩) রোজ সন্ধ্যায় বাবা মার হাত ধরে এখানে বেড়াতে আসতাম। এই নদীর উপরে নাকি পরীদের ওড়াউড়ি। সূর্যাস্তের পরে পুরুষ নারী ঘনিষ্ঠ হয়ে এই নদীর ধারে বসলেই মিচকে পরীরা নাকি উড়ে এসে তাদের কোলে একটি শিশু ফেলে দিয়ে যায়। ফিরে এসে মাকে গল্পটা বলতেই তিনি বললেন 'ওমা! এই গল্প তো আমিও শুনেছি। আমি তো ভয়ে ভয়ে থাকতাম; নাকচ্যাপ্টা ছেলে নিয়ে দেশে ফিরলে লোকে কি বলবে! '

স্মৃতির টান ভয়ানক। সময় ওপর দিয়ে বয়ে যায় দ্রুত,নিচে ফেলে রেখে তার মলিন ছায়া। নদীতে বান আসার কিছুক্ষণ পরেই পালটি বান আসে,তখন স্রোত ধায় বিপরীতে। জাগিয়ে তোলে স্রোতে ভেসে আসা কচুরিপানা, আবর্জনা, মৃত পশুর শব। স্মৃতিও তেমনি উজানে বায়। সময় ধায়, স্মৃতি ধায় বিপরীতে। সাতান্ন বছর পর সেই ফেলে আসা সেই 'বাঁশের ডগায় আখ' এর জন্য আমার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল।
তবে পাওয়া গেল না। কুচো করে কাটা আখ পাওয়া যাচ্ছে, আখের রস (nước mía/ mía đá)-এর দোকান সার দিয়ে, আখের রস দিয়ে ঠাণ্ডা চা (Nước Sâm) ও পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু আমি যে জিনিসটি খুঁজছি, পাচ্ছি না। আরও অসুবিধা বস্তুটির নাম জানিনা, আর ভাষাগত সমস্যা তো আছেই। ধরলাম এক বৃদ্ধ ভিয়েতনামি ভদ্রলোককে; পোষাকে-আশাকে ফিটফাট, স্যুট-টাই পরা, হাতে ছড়ি – নদীতীরের এক বেঞ্চিতে চুপচাপ নদীর দিকে চেয়ে বসেছিলেন – দেখে মনে হল ইনি নিশ্চয়ই ইংরিজি জানবেন।
প্রৌঢ় মানুষটি বোধহয় ঠিক এটাই চাইছিলেন যে কেউ তার সঙ্গে কথা বলুক। প্রাথমিক ভূমিকার পর উনি আমাকে সিগারেট দিতে চাইলেন, সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। ভিয়েতনামি সিগারেট অতি কড়া, চোদ্দ বছর বয়স থেকে সিগারেট খাচ্ছি, তাও কাশি আসে। আর আমার অভ্যাস চেঙ্গাইল বা চেন্নাই, বেলুড় বা বেলুর – যেখানেই যাই না কেন, নিজের ব্র্যান্ডের সিগারেট নিয়ে যাওয়া। তাই থেকে দিলাম একটা। খুশি হলেন।
আলাপ গড়াল। বিবরণ শুনে বললেন ওই জিনিসটাকে বলে mía ghim; গুগলে দেখ, ছবি পাবে। তবে এখন আর ওই জিনিস পাওয়া যায় না – মানুষের স্বাস্থ্য-সচেতনতা বেড়েছে, আর জিনিসটি তৈরি করাও সময় এবং শ্রম সাপেক্ষ।
তার গল্প শুনলাম। তিনি সায়গনেরই লোক, শৈশব কৈশোর এখানেই কেটেছে, আমার মতোই তিনি সায়গনে Trưng Sisters-দের মূর্তি দেখেছেন; সায়গনের রাস্তায় মার্কিন সেনা বা সাঁজোয়া গাড়ি দেখেছেন। ১৯৬৩র সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী ডামাডোলের দিনগুলিতে তিনি ফরাসি দেশে গিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য, পঁচাত্তরের ৩০ এপ্রিল সায়গন শহরের পতনের পর দেশে ফিরতে সাহস পাননি, চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। সেখানেই মেমসাহেব বিবাহ, সংসার, পুত্রকন্যা। দুবছর হল একাই নিজের দেশে ফিরেছেন; বড় ইচ্ছা নিজের দেশে সমাহিত হবেন।
সময় গড়ায়, বিদায় নেওয়ার পালা, প্রবীণ মানুষটি সুভেনির শপ থেকে কিনে আনলেন সাবেকি দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতাকা – হলুদ জমির উপর আনুভূমিক তিনটি লাল সরলরেখা, ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৫ এটাই ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতাকা - ধাতব ব্রোচ, শ্রীমতী পালের জন্য। আমাদের একটি প্রজন্ম যেমন সাতচল্লিশের দেশভাগ মানতে পারেননি, উদ্বাস্তু হয়ে বোঁচকা পুঁটলি নিয়ে হাঁটা দিয়েছিলেন অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে; ওনাদেরও একটি প্রজন্ম তেমনি পঁচাত্তরের দেশ- সংযুক্তি মানতে পারেননি, Boat People (Thuyền nhân Việt Nam) হয়ে বোঁচকা পুঁটলি নিয়ে ডিঙি নৌকায় ভেসে পড়েছিলেন দক্ষিণ চিন সাগরে। আজও সায়গনকে স্থানীয়রা সায়গনই বলে,হো চি মিন সিটি কেউ বলে না। ভদ্রলোক আমাকে দিলেন ভিয়েতনামের পাউরুটি Bánh mì, বললেন বাড়ি গিয়ে ছেলে বউমা নাতনির সঙ্গে খেও, বোলো আমি পাঠিয়েছি। আমি তাকে দিলাম ভারতীয় সিগারেট। বহতা নদীর সমুখে, নক্ষত্রখচিত অন্ধকার আকাশের নিচে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন শেষ হয়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ, পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক— কর্কট— তুলা— মীন।
বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে কেউ টিকিট বা পরিচয়পত্র দেখতে চাইল না। ভিয়েতনামি ডং বদলে মার্কিন ডলার নিলুম,মেয়েটা ফরফর করে গুনে দিয়ে দিল,একবারও বলল না পাসপোর্ট দাও,প্যান নম্বর দাও। সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল বলে শ্রীমতী পাল শূয়র খেতে রাজি হলেন না,অথচ সারা বিমানবন্দরে শূয়র ব্যতীত কিছু নাই। ভেজ বার্জারে শুয়রের দুটো চাকতির ওপর শশা পিঁয়াজ লেটুস,চিজ বার্জারে শুয়রের দুটো চাকতির ওপর চিজ ছড়ানো। একজন বললেন বাইরের পিজা হাটে যাও; বলবে ইন্দিয়ান জৈন পিজা। বিমানবন্দরের দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে,খেয়ে,আবার দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম; কেউ গ্রাহ্যও করল না। আমার চেন্নাই বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা মনে পড়ছিল। নিরাপত্তায় ঢুকে দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালাম, রক্ষীটি বললেন দোন্ত স্তপ,কিপ ওয়াকিং। অভিবাসনে এখানেও সেনাবাহিনীর লোক,তবে উত্তরীয় স্তালিনিয় কোটের বদলে সাদা হাফ শার্ট পরা; টাইয়েরও কোন বাপ মা নেই,কেউ পরেছে কেউ পরেনি। শোল্ডার ব্যাজ দেখে বুঝে নিতে হয় এনারা সেনাবাহিনির। দুই ভিয়েতনামের চারিত্রিক বিভাজনের এক নির্ভুল অভিজ্ঞান।
আমরা বেড়াতে গেলে শ্রীমতী পাল খরচখরচার একটি হিসাব রাখেন। দুঃখজনকভাবে এইবারেই প্রথম তার ব্যত্যয় ঘটল। কারণ খরচ হয়েছে ভারতীয় রুপিতে (ভিয়েতনামের অনেক দোকানেই, বিশেষত ফুটপাথের হকাররা, ভারতীয় রুপি নেন), মার্কিন ডলারে, ভিয়েতনামি ডং-এ, কাম্বোদিয়ান রিয়েলে (কাম্বোদিয়ায় মার্কিন ডলারই চলে, তবে দোকানদাররা ফেরত দেওয়া অর্থের পরিমাণ এক মার্কিন ডলারের কম হলে কাম্বোদিয়ান রিয়েল দেন), মাল্টিকারেন্সি কার্ডে, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ক্রেডিট কার্ডে। এর মধ্যে আবার ভারতীয় রুপি বদলে মার্কিন ডলার, মার্কিন ডলার বদলে ভিয়েতনামি ডং,ভিয়েতনামি ডং বদলে মার্কিন ডলার,মার্কিন ডলার বদলে ভারতীয় রুপি; তাদের পারস্পরিক বিনিময়হার – হিসাব রাখতে গেলে বেড়ানো ছেড়ে সারাদিন ওইই করতে হয়।

আমি গাই ঘরে ফেরার গান

ইন্ডিগো এল, উঠে বসলাম। উড়োজাহাজ যখন দৌড় শুরু করছে, বুকের মধ্যে এক পুকুর আবেগ যেন উঠে এল। বিদায় ভিয়েতনাম। ধন্যবাদ দেখা করার জন্য। বিগত চল্লিশ বছরে কখনও ভাবিনি দেখা হবে। আর ভালো হত যদি সেই লোকটাকে নিয়ে আসতে পারতাম। লোকটা তোমায় বড্ড ভালোবাসতো গো!
আমাদের সহযাত্রিণী এবারে এক জাপানি পিসিমা। ঈশ্বর আছেন কি না জানি না, তবে বিমানসংস্থাগুলি দেখেছি চিরকাল আমার পাশের আসনে বকমবাগীশ বক্তিয়ার খিলজি গোছের লোককেই বসান। ইনিও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ঘুমোবে? আমি বললাম এই সিটে ঘুমনো যায় নাকি! গল্প করবো! তিনি আমাকে ফস করে জিজ্ঞাসা করলেন, 'গল্প শুনবে'? আমি তো এক পায়ে খাড়া।
পিসি বললেন 'জানো তো! জাপান বলে না একটা দেশ আছে। তার চারিদিকে সমুদ্র; আর লোকগুলো ফর্সা ফর্সা। আজ থেকে অনেক অনেক অনেক অনেক বছর আগে সেখানে উরাশিমা তারো বলে একটা লোক ছিল। সে একদিন সমুদ্রের ধার ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, দেখে কি কটা ছেলে একটা ছোট কচ্ছপ ধরেছে, আর তার পায়ে দড়ি বেঁধে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। উরাশিমা ছেলেগুলোকে বললো অমন করছ কেন, ওকে ছেড়ে দাও। ছেলেগুলো বলল - না, আমরা ওকে বিক্রি করব, সেই পয়সায় ঘুড়ি কিনব, আর কিনে ওড়াব। উরাশিমা আর কি করে, সে টাকা দিয়ে কচ্ছপটি কিনে নিল। কিনে তাকে সমুদ্রে ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়েই কচ্ছপটি চার পা নেড়ে দ্রুত সমুদ্রে মিলিয়ে গেল।
তার অনেকদিন পরে একদিন সন্ধ্যাবেলা উরাশিমা সমুদ্রের ধার ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, শুনতে পেল কে তার নাম ধরে ডাকছে। অন্ধকারে খুঁজেপেতে দেখল জলের কিনারে এক মস্ত কচ্ছপ। কচ্ছপটি বলল কি গো! আমাকে চিনতে পারলে না! সেই তুমি আমাকে কিনে জলে ছেড়ে দিয়েছিলে। উরাশিমা তো অবাক! কি বিরাট বড় হয়ে গেছে সে। সে বললো 'শোনো না! তুমি সে সেদিন যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে, তাতে আমাদের রাজামশাই খুব খুশি হয়েছেন। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে আমাদের দেশে নিয়ে যেতে। তুমি শিগগির আমার পিঠে উঠে বসো তো! উরাশিমা কচ্ছপের পিঠে উঠে তার গলা জড়িয়ে বসলো,আর তক্ষুনি কচ্ছপটি ভুস করে ডুব দিয়ে তাকে সমুদ্রের তলায় ড্রাগনরাজের মণিমাণিক্য ভরা সুখের রাজ্যে নিয়ে হাজির করলো। রাজামশাই উরাশিমাকে দেখে ভারি খুশি, তুমি আমার প্রজা কচ্ছপের প্রাণ বাঁচিয়েছো; তুমি আমাদের অতিথি। থাকো আমাদের সঙ্গে যতদিন ইচ্ছে। সেই কচ্ছপ ছিল ড্রাগনরাজকুমারীর সখি; তার সখির প্রাণ যিনি বাঁচিয়েছেন তিনি এসেছেন শুনে ড্রাগনরাজকুমারী উরাশিমাকে ধন্যবাদ জানাতে এলেন। দুজনের ভারি বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
উরাশিমার ভারি মজা, খায় দায় গান গায়, মহাসুখে দিন যায়। শুধু মধ্যে মধ্যে নিজের ফেলে আসা গ্রামটির জন্য মন কেমন করে, কিন্তু এরা তাকে এত আদরযত্নে রেখেছে যে সঙ্কোচে সে কিছু বলতেও পারে না; এভাবে কিছুদিন কাটল। শেষে সে একদিন রাজামশাইকে বলল যে সে একবার বাড়ি যেতে চায়। রাজামশাই উৎসাহ দেখালেন না, কিন্তু উরাশিমা নাছোড়;শেষে রাজামশাই রাজি হলেন। উরাশিমা চলে যাবে শুনে রাজকুমারী সজলচোখে বিষণ্নমুখে চেয়ে রইলো তার দিকে, উরাশিমা তাকে বোঝাল, 'আমি তো মায়ের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসব। চিন্তা কী!'
রাজকুমারী রাজি হল উরাশিমাকে যেতে দিতে। বিদায়কালে রাজকুমারী উরাশিমার হাতে এক রত্নখচিত বাক্স দিয়ে বললো 'খুব সাবধানে রাখবে এই বাক্স। কিছুতেই এই বাক্স খুলো না। যদি খোলো তবে আর আমাদের দেখা হবেনা।' ইতোমধ্যে রাজকুমারীর সখি সেই কচ্ছপ এসে হাজির,সেই পিঠে চাপিয়ে উরাশিমাকে পৌঁছে দিল ঠিক সেই জায়গাটিতে যেখান থেকে সে উরাশিমাকে নিয়ে গিয়েছিল।
কচ্ছপ চলে গেল, কিন্তু উরাশিমা কিছুই চিনতে পারে না। চারিদিকে মস্ত মস্ত বাড়ি,চওড়া চওড়া রাস্তা,অচেনা সব মুখ। এক বুড়োমানুষের সঙ্গে দেখা হতে সে জিজ্ঞাসা করল,এই গ্রামে উরাশিমা বলে একজন থাকে,তার বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারেন? বুড়োমানুষটি অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপরে বলল, 'সে অনেক অনেক দিন আগের কথা,উরাশিমা তারো বলে একজন নাকি এই গ্রামে থাকত। সে সমুদ্রের নিচের ড্রাগনরাজ্যে চলে গেছিল বলে গল্প আছে। সেখানে নাকি ড্রাগনরাজকুমারীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। তবে বাছা, গল্পের কি আর কোনো আগামাথা থাকে?' উরাশিমা চেঁচিয়ে বলে 'আমিই সেই উরাশিমা; সত্যিই ড্রাগন রাজকুমারীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। এই দ্যাখো তার দেওয়া উপহার'। উত্তেজনার বশে সে সেই রত্নখচিত বাক্স বার করে খুলে ফেলল।
অমনি বাক্স থেকে বেরিয়ে এল বদ্ধ সময়ের নীলচে ধোঁয়া, তিনশোটা বছরের বোঝা আছড়ে পড়ল উরাশিমার গায়ে। ধোঁয়া লাগতেই মুহূর্তে সে জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ হয়ে গেল। তারপর তার দেহ বালি হয়ে মিশে গেল বালুকাবেলায়। ড্রাগনরাজকুমারী এসব কিছুই জানতে পারল না। সময়বিহীন কল্পলোকে সে বসে রইল উরাশিমার প্রতীক্ষায়।
শুনে তো আমি একেবারে অভিভূত,আপ্লুত! ও মা গো কি বলে গো! এ তো আমাদের কালিদাসবাবুর বিক্রমোর্বশীয়ম্ – নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ,-অনন্তযৌবনা নন্দনবাসিনী ঊর্বশীর প্রতি মরণশীল রাজা পুরূরবার মুগ্ধ অপার আকুতি। পিসিকে আমি সংক্ষেপে ঊর্বশী-রাজা পুরূরবার প্রেমপোখ্যানটি শোনালাম। তাঁদের বিবাহে ঊর্বশীর শর্তচতুষ্টয়ের (১। উর্বশী যেন কখনো পুরূরবাকে নগ্ন অবস্থায় না দেখেন। ২। শুধুমাত্র উর্বশী চাইলেই পুরূরবা তাঁর সাথে মিলিত হতে পারবেন। ৩। উর্বশীর শয্যাপার্শ্বে দুটি মেষশাবক বাঁধা থাকবে এবং তাদের চুরি হওয়া থেকে রক্ষার দায়িত্ব পুরূরবার। ৪। পুরূরবা মাত্র এক সন্ধ্যা ঘি খেতে পারবেন) শুনে পিসির কী হাসি! তোমাদের দেশে মেয়েরা বিয়ের আগে এমন শর্ত দেয় নাকি! তারপরেই শ্রীমতী পালকে জিজ্ঞাসা করলেন কি গো! তোমার এমন কোনও শর্ত ছিল নাকি!
রাত বাড়ছে। আমরা উড়ে চলেছি উত্তর-পশ্চিমে, তাই দীর্ঘায়িত হচ্ছে সময়; জানালায় লটকানো মস্ত এক চাঁদ। মনে পড়ল, একদা গ্রীষ্মের রাতে ছাদে শুয়ে শুয়ে বাবা চাঁদের চরকাকাটা বুড়ির গল্প বলতেন। দশ দিনের পুরো ভ্রমণটিতে এতবার বাবার কথা মনে পড়েছে! দেশে ফেরার পরেও ভিয়েতনামের প্রতিটি খবরে বাবার উৎসাহ ছিল অসীম। ১৯৯৭ পূর্ববর্তী আন্তর্জালবিহীন সেই যুগে কাজটা সহজ ছিল না। বাবার সঙ্গেই New Empire এ Roland Joffe র The Killing Fields দেখেছি; দেখেছি The Iron Triangle; Good Morning, Vietnam; Born on the Fourth of July; নন্দনে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম Operation Dumbo Drop দেখাতে, বাবার সেই শিশুর মত উচ্চকিত হাসি আজও কানে লেগে।
দমদম বিমানবন্দর। কার্ড বিনিময়। পিসি জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, যাচ্ছেন বারাণসী। জাপানে আমন্ত্রণ জানালেন।
বাড়ি। অনেকদিন ছিলাম না; ফ্রিজ খালি। তাই বাজারে। বিস্তর সবজিপাতি কিনে দাম দেওয়ার জন্য পকেটে হাত দিতেই অপ্রস্তুত। ওমা! এ তো সব ডলার!

হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূল ক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সে বিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালের বাংলায় ভ্রমণকাহিনি লেখালেখির প্রেরণা 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না।'

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher